#মম_চিত্তে
#পর্ব_৬,৭
#সাহেদা_আক্তার
৬
আদ্রিতা আর প্রিয়ান্তুকে নিয়ে আলিফ আগে শ্বশুরবাড়ি এল। যৌথ পরিবারের সবাই মুখিয়ে আছে ওদের জন্য। আলিফের বাড়িতে ওর বাবা থাকার কথা। গত বছরে মায়ের মৃত্যুর পর বাবাও ছন্নছাড়া হয়ে ঘুরে বেড়ায়। তাই বাড়ি যাওয়ার তাড়া নেই। এখানেই ভালো। কিন্তু মমকে দেখার পর থেকে ওর ভেতরে অস্থিরতা কাজ করছে। আদ্রিতা যে মমর ফ্রেন্ড এটা জানতো না আলিফ। জানলে বিয়েটায় না করে দিত। মম থেকে আদ্রিতা সবদিক থেকে পার্ফেক্ট ছিল। সৌন্দর্য্যে, উচ্চতায়, অর্থে বিত্তে। সবদিক দিয়ে ওর মনের মতো ছিল। আদ্রিতার ভালোবাসায়ও কমতি নেই। তাহলে কেন মমর পেছনে পড়ে থাকতো!? বিয়ে করেছে বেশ করেছে। নিজেকে বোঝালো আলিফ। কিন্তু পুরানো মায়াটা কোথাও থেকে একটা সজোরে টান দিল ওকে দেখার পর। বুঝতে পারল, এখনো কোথাও ওর প্রতি থাকা মায়া গোপন রয়ে গেছে। যা শুধু মমকে ঘিরেই।
শরবত খেয়ে আদ্রিতার রুমে চলে গেল। এক বছর পরে আসায় সবাই নিচে কত কথা বলছে গল্প করছে। কিন্তু আলিফের কিছুই ভালো লাগছে না। সে একটু একা থাকতে চায়। রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানা আধশোয়া হয়ে চোখের উপর হাত রাখল। ভেতর থেকে অজানা এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। একটু পর আদ্রিতা প্রিয়ান্তুকে এনে বলল, মেয়েটাকে রাখো তো। কেবল কাঁদছে। আমি সবার সাথে একটু কথা বলে আসি। আলিফ হুট করে রেগে গিয়ে বলল, একটা বাচ্চা সামলাতে পারো না তো কি পারো? সারাদিনে সামান্য বাচ্চাটাকে সামলাতে ঘাম বের হয়ে যায় তোমার। আলিফের ব্যবহারে আদ্রিতা চমকে উঠল। মুখে কিছু না বললেও চোখের গড়িয়ে পড়া পানিটুকু বলে দিল ও কষ্ট পেয়েছে। আলিফও দেখে নিজেকে সামলে নিল। মমকে দেখার পর থেকে বেশ এলোমেলো হয়ে গেছে ও। আদ্রিতাকে কেন যেন সহ্য হচ্ছে না। মমকে হারানোর জন্য ওকে দায়ি করছে মন। অথচ ওর একটা নাতেই বিয়েটা ভেঙে ফেলতে পারতো। তা না করে চোরের মতো বিয়ে করে ওকে নিয়ে বিদেশে চলে গিয়েছিল। নিজের ভুলটা কিছুতেই মানতে পারছে না। আদ্রিতা চুপচাপ চলে যেতে লাগলে আলিফ ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, সরি আদ্রি, ভালো লাগছিল না তাই তোমার সাথে এমন করে কথা বলে ফেলেছি। আদ্রিতা হুম বলে চুপ করে রইল। যেখানে আলিফ খুবই আস্তে কথা বলতো সেখানে ওর উপর চেঁচানোটা কিছুতেই মানতে পারছে না ও। তাই আঘাতটা একটু বেশিই লেগেছে। হঠাৎ এমন পরিবর্তন কেন হলো তা বুঝতেই পারছে না আদ্রিতা।
বাসায় এসেই মনটা ভালো হয়ে গেল মমর। বর্ষা আর বৃষ্টি এসেছে। ওর খালাতো বোন। বৃষ্টি ওর থেকে এক বছরের ছোট আর বর্ষা এক বছরের বড়। তিনজনই পিঠাপিঠি বলা চলে। ওদের দেখেই মুখে হাসি ফুটল ওর। আলিফের ব্যাপারটা বেমালুম ভুলে গেল। বাসায় পা দিতেই দুই বোন জড়িয়ে ধরল ওকে। মম জিজ্ঞেস করল, তোমরা!? আসবে বলোনি তো।
– বললে সারপ্রাইজ হতো কি করে?
– যাক এসেছো ভালো হয়েছে। এক সপ্তাহ থেকে যাবে।
বর্ষা খুশিতে দাঁত দেখাতে লাগল। সোফায় আপেল খেতে থাকা জাবের বলল, মম বোনটি আমার। এই কাজ করো না। তাহলে এই অসহায় বেচারা না খেয়ে মরবো। মম হেসে বলল, তুমি থাকো না। কে না করছে?
– অফিস। কাজের চাপটা একটু বেড়েছে। এসেছি ওদের দিয়ে যেতে। একটু পর আবার বেরিয়ে যাবো।
– সেকি! এটা তো হবে না ভাইয়া। কালকের আগে ছাড়ছি না।
– না বোনু। মেলা কাম। তোমার বোন তো তোমার ডিভোর্স শুনে আসার জন্য এত পাগল হচ্ছিলো যে বাধা দেওয়ায় আরেকটুর জন্য প্রাণটা বের করে নিতো।
বর্ষা প্রতিবাদ করে বলল, মোটেও না। জাবের কমলার একটা কোয়া হাতে নিয়ে বলল, মোটেই হ্যাঁ। অনেক কষ্টে আজকে পর্যন্ত থামিয়ে রেখেছি। আসার সময় দুই দিনের রান্না করে এসেছে এই অধমের জন্য। এখন তোমার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে সেই রান্না কবুতরের মতো খুঁটে খুঁটে সাতদিন খাওয়া লাগবে। মম বলল, আরে ভাইয়া, ল্যাপটপ আর কাগজ পত্র নিয়ে এখানে চলে আসুন। আমি সহ না হয় দেখে দেবো।
– মোটেই না। খালুর কাছে শুনেছি তুই অফিস জয়েন করেছিস। ওখানে কাজ করে এসে এর কাজ সামলানোর দরকার নেই। তুই আসবি, আমাদের সাথে গল্প করবি, রেস্ট নিবি।
– দেখলে বোনু, কি হিংসুটে? আচ্ছা যাহোক, এবার আমি উঠি। এক সপ্তাহ পর আমার বউকে সহি সালামতে দিয়ে এসো বাসায়। ততদিনে আমি খাবারের অভাবে কঙ্কাল না হয়ে যাই সেই দোয়া করো। আসি।
জাবের বেরিয়ে গেল। মম হাসতে হাসতে বলল, ভাইটাকে এত কষ্ট দেওয়ার কি মানে? বর্ষা মুখ বাঁকা করে বলল, ঘরের খাটুনি করে করে যে আমি শুকিয়ে পাটকাঠি হয়ে গেছি দেখেছে একবারও? হোক কঙ্কাল। তারপর কঙ্কাল আর পাটকাঠি মিলে সংসার করবো৷ বৃষ্টি আর মম ওর কথা শুনে হাসতে লাগল।
রাতে খাওয়া শেষে তিন বোন গোল হয়ে বসল বিছানায়। ওদের মাঝে নিনি এসে আদর নিতে লাগল। বর্ষা শুরুতেই বলল, বল। কি করে কি হল!? মম বালিশ কোলে নিয়ে বলল, কি আর হবে? এটা তো হবারই ছিল। বিয়ের দিন রাতেই আমাকে বলে দিয়েছিল এই বিয়ের শেষ পরিণতি। বৃষ্টি রাগ দেখিয়ে বলল, বিয়ের আগেই বলে দিতো। মম শুকনো হাসি দিয়ে বলল, পরিবারের চাপে নাকি বাধ্য হয়ে বিয়েতে মত দিয়েছিল। যাহোক, যা হয়েছে ভালো হয়েছে। যে সম্পর্কের শুরুতেই পচন ধরেছে সেটা রেখে কষ্ট করার কোনো মানে হয় না। বর্ষা বলল, ভালো করেছিস। আজকাল কয়জন মেয়ে পারে সাহস করে এই পঁচে যাওয়া সম্পর্ক থেকে বের হতে? সমাজের ভয়ে মুখ বুঁজে থেকে শেষ চেষ্টা করে। ডিভোর্সি শোনার ভয়ে চুপচাপ সব সহ্য করে যায়। মম চুপ করে থেকে বলল, আমি চেষ্টা করিনি বলছো? ডিভোর্স হওয়ার আগের দিনও ওর সাথে এক ঘন্টা কথা বলেছিলাম। লাভ হয়নি। ফিরে আসেনি বরং সেদিন……; মম থেমে গেল। বাকিটুকু ওদের বলার মতো ওর রুচিতে এল না। বৃষ্টি টপিক ঘোরানোর জন্য বলল, মিষ্টি যে এনেছি খাওয়াসনি কেন কাউকে?
– পরে খাবো। তা কিসের মিষ্টি?
– তুই জানিস না? খালু তোকে বলেনি?
– না তো।
বৃষ্টি দাঁত দেখাতে লাগলো। মম আন্দাজ করে বর্ষার দিকে তাকাতেই সে মুচকি হাসি দিলো। মম উত্তেজনায় বিছানা থেকে নেমে বলল, সত্যি!? আল্লাহ! আগে বলোনি কেন? দাঁড়াও না। বাবু আসলে বিচার দিবো। খালামনিকে তার খবর জানায়নি। কত দিন? বর্ষা বলল, দু মাস চলছে।
– আচার খাবে?
– এত রাতে? কই পাবি?
– আগে বলো খাবে কি না।
– তা তো একটু আধটু খেতে ইচ্ছে করছে।
– একমিনিট…
মম কিছুক্ষণ পর এক বয়াম জলপাইয়ের আচার, একটা বাটি আর কাঁটা নিয়ে রুমে ঢুকল। বিছানায় বসে ঢাকনা খুলতে খুলতে বলল, মাধুরী খালা কদিন আগে এক কেজি জলপাই আনিয়ে বানিয়েছে। আমি সাধ করে খেয়েছিলাম। এত টক বানিয়েছে আচারটা! বুঝিনি তোমার জন্য বানিয়েছে। দেখেছো সবাই আমার থেকে লুকিয়ে গেছে। দুই বোন হাসলো। বৃষ্টি আর মম মুখে দিতেই দাঁত টকে গেল। এদিকে বর্ষা দেখতে দেখতে পুরো বাটি শেষ করে ফেলল। গল্প শেষ হলো দুটোর দিকে। শুয়ে পড়ল তিনজন। মমর ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। ওরও তো এমন ছোট ছোট স্বপ্ন ছিল। সব মিশে গেল মাটির সাথে। এক ফোঁটা নোনা পানি গড়িয়ে পড়ল চোখের পাশ দিয়ে।
.
.
.
.
অফিসের মাঝেই আদ্রিতার ফোন পেল মম। আলিফের কথা ভেবে ধরতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। কিন্তু এক বিশ্বাসঘাতকের জন্য ওদের এতদিনের বন্ধুত্ব শেষ করার কোনো মানেই হয় না। ফোনটা অনেক ভেবে রিসিভ করল। ফাইল দেখতে দেখতে বলল, হ্যালো।
– কেমন আছিস?
– এই তো আলহামদুলিল্লাহ। তোর কি অবস্থা?
– ভালো। কই তুই?
– অফিসে কাজ করছি।
– ও তাহলে ডিস্টার্ব করলাম।
– কিছু বলার জন্য ফোন দিয়েছিলি?
– হ্যাঁ, তোর সাথে দেখা করতাম। তোর অফিস শেষ হয় কয়টায়?
– এই তো আটটার দিকে।
– ওকে।
– এককাজ কর। দুপুরে ব্রেকটাইমে আয়।
লাবিবা এসে মমকে বলল, এই ফাইলগুলো একটু চেক করে নাও। মম মুখে হাসি নিয়ে ফাইলগুলো নিলো। আদ্রিতা বলল, আচ্ছা তুই কাজ কর। পরে কথা হবে। ফোন কেটে দিল। মম ফোন রেখে মন দিল কাজে। ফাইল জমে যাচ্ছে। শুক্রবার বন্ধ থাকায় শনিবারে যত কাজের চাপ বাড়ে। মম চটপট ফাইল চেক করতে লাগল।
বাসার দরজার সামনে দাঁড়াতেই ভেতরে হাসাহাসির শব্দ শোনা গেল। বোঝা যাচ্ছে কেউ এসেছে। কলিংবেল টিপতেই বৃষ্টি দরজা খুলল। মম ঢুকে দেখলো আদ্রিতা বসে আছে সোফায়। বর্ষা ওর মেয়েকে কোলে নিয়ে খেলছে। মম তাকাতেই আদ্রিতা বলল, এতক্ষণে আসার সময় হলো? সাড়ে ন’টা বাজে। ও জুতো কেবিনেটে রাখতে রাখতে বলল, ফাইল চেক করতে করতে দেরি হয়ে গেল। কখন এলি?
– এই তো হচ্ছে ঘন্টা দুয়েক।
– ওকে নিয়ে একলা এলি?
– না, আলিফ দিয়ে গেছে। কত করে বললাম তোর সাথে দেখা করে যেতে। কিছুতেই শুনলো না। জোর করে চলে গেল।
মম এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, কি নামরে তোর মেয়ের? আদ্রিতা বলার আগেই বর্ষা বলল, প্রিয়ান্তু। সুন্দর না? মম অন্যমনস্ক হয়ে বলল, হুম সুন্দর। মেয়ে বাবার মতো হয়েছে একেবারে। আদ্রিতা প্রিয়ান্তুকে কোলে নিয়ে বলল, একদম ঠিক বলেছিস। যেমন বাবার মতো হয়েছে তেমনি বাবাকে ছাড়া মেয়েরও এক মুহূর্ত চলে না। আলিফও প্রিয়ান্তু বলতে পাগল, জানিস!? মেয়ের একটু এদিক থেকে ওদিক হলে অস্থির হয়ে যায়। মম শুকনো হাসি দিয়ে বলল, আর মেয়ের মায়ের জন্য? ওর কথায় আদ্রিতা লজ্জায় প্রিয়ান্তুর সাথে খেলা করতে লাগল। মম ফ্রেশ হওয়ার কথা বলে নিজের রুমে চলে এল। ইচ্ছে হচ্ছে ফ্রেশ হয়ে রুম অন্ধকার করে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে কিন্তু কারো সন্দেহের পাত্রী হতে চায় না ও। ওরা দুইজন যদি দুইজনকে নিয়ে সুখে থাকে তবে তাদের মাঝে সন্দেহের বীজ ঢোকানোর কোনো মানে হয় না। নিজে সুখী নয় বলে অন্যের সংসার নষ্ট করার মতো বাজে রুচি মমর নেই। কাপড় বদলে সোজা রান্নাঘরে চলে এল। রায়হান সাহেবেরও আসার সময় হয়েছে। বরং আজ লেট হচ্ছে। ফোনটা করা দরকার। মাধুরী খালাকে খাবার বাড়তে বলে মম ফোন হাতে নিতেই আদ্রিতা রান্নাঘরে এসে ঢুকল। ওকে দেখে বলল, কি করছিস?
– আব্বুকে একটা ফোন করব ভাবছিলাম। আজকে থাকবি তো?
– না না। দশটার দিকে আলিফ এসে নিয়ে যাবে।
– এত রাতে যাওয়ার কি দরকার? থেকে যা।
– নারে, বললাম না, বাবা মেয়ে একে অপরকে ছাড়া থাকতেই পারে না। রাত হলে কান্না শুরু করবে। বাবাকে ছাড়া ঘুমায় না।
মম আবার একটা শুকনো হাসি দিল। বলল, ভালো তো। আচ্ছা খেয়ে তো যাবি। যা টেবিলে বোস। আমি খাবার নিয়ে আসি। আদ্রিতা ওকে টেনে রান্নাঘর থেকে বের করে বলল, আমি এসেছি তোর সাথে কথা বলতে আর সেটাই হচ্ছে না। ওকে বসার ঘরে নিয়ে এল আদ্রিতা। মম প্রিয়ান্তুকে কোলে নিল। মেয়ে আসলেই আলিফের মতো হয়েছে। বিশেষ করে চোখ দুটো। হালকা বাদামী। যে চোখ ওকে পাগল করে দিতো একসময়। ভাবতেই ঘৃণায় কাঁটা দিয়ে উঠল পুরো শরীর। আলিফের কথা মাথায় আসতেই ও প্রিয়ান্তুকে নিয়ে নিজের রুমে চলে এল। আলমারি খুলে একটা ছোট কৌটা বের করল। সেখানে একটা ছোট স্বর্ণের লকেট আছে। সেটা প্রিয়ান্তুকে পরিয়ে দিল মম। ফিসফিস করে বলল, তোমার বাবার দেওয়া উপহার তোমাকে দিয়ে নিজের ভেতরের সবচেয়ে বড় বোঝাটা নামালাম প্রিয়ান্তু।
– কি বলছিস রে ফিসফিস করে?
মম তাকিয়ে দেখল আদ্রিতা উঁকি মেরে আছে দরজায়। কাছে এসে বলল, ওমা! এটা ওকে কি পরিয়েছিস? দেখে তো সোনার মনে হচ্ছে! মম হেসে বলল, কিছু তো দেইনি তাই দিলাম।
– তাই বলে স্বর্ণ? আর বাচ্চা হলেই কিছু দিতে হবে এটা কোন নিয়ম?
– সমাজের নিয়ম। সমাজ যে কত নিয়ম তৈরী করেছে! যা হোক, এটা নিয়মের ধার না ধরেই দিয়েছি।
আদ্রিতা কিছু বলার আগেই আলমারিতে চোখ পড়ল। ভেতরে হ্যাঙ্গারে মমর শাড়ির সাথে একটা কোট ঝুলছে। একটু ভালো করে দেখতেই ওর চিনতে অসুবিধা হলো না কোটটা কার। কৌতুহলী হয়ে মমকে জিজ্ঞেস করল, মম, কোটটা কাররে?
চলবে…
#মম_চিত্তে
#পর্ব_৭
#সাহেদা_আক্তার
কোটের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, জানি না। তুই তো জানিস আমার এস্ট্রোফোবিয়া আছে। ডিভোর্সের দিন আসার সময় বৃষ্টি হয়েছিল। সেই সাথে বজ্রপাত। আমি তো ভয়ে কুঁকড়ে ছিলাম। তারপর সব বন্ধ হতেই কোনোমতে বাসায় এসে পৌঁছালাম। গোসল করতে এসে দেখি গায়ের উপর এই কোটটা। কার কে জানে। কে যে দিলো তারও খেয়াল নেই। মনে পড়ছে না কারো সাথে দেখা হয়েছে কি না। আদ্রিতা মুচকি হেসে বলল, কোটের মালিককে পেলে দিবি কোটটা? মম জোর দিয়ে বলল, অবশ্যই দেবো। কেন দেবো না?
– জানিস আমার না একটা রোগ আছে। জামাইর সব জামা কাপড় পরে বসে থাকি। চাইলেও দিতে ইচ্ছে করে না।
– সেটা স্বাভাবিক। বউ হিসেবে জামাইর জামা কাপড় ডাকাতি করাই যাই।
– বলছিস? তাহলে এই কোটও তোর।
– মানে?
আদ্রিতা কিছু বলার আগেই ওর ফোন বেজে উঠল। ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল, আলিফ এসেছে রে। নিচে অপেক্ষা করছে। যাই। মম বলল, আরে খেয়ে যাবি তো। প্রিয়ান্তুকে কোলে নিয়ে বলল, আরেকদিন। আজকেও তেমন কথা হলো না। তবে বৃষ্টি আপুর থেকে সবটা শুনেছি। শক্ত থাকিস। সব কাটিয়ে নিজের জীবনটাকে আবার সুন্দর করে গুছিয়ে নিস। খুব শীঘ্রই আবার দেখা হচ্ছে। সবার থেকে বিদায় নিয়ে আদ্রিতা বেরিয়ে গেল। মম ওর কথার আগামাথা কিছুই বুঝল না। রুম থেকে বেরিয়ে মাধুরী খালাকে বলল, নিনিকে দেখিনি যে। কোথায় ও? খালা বললেন, সাহেবের রুমে ঘুমাইতেসে।
– ও আচ্ছা। খালা, খাবার দিয়ে দাও। বর্ষাপুর সময় মতো খেতে হবে।
বর্ষা আর বৃষ্টি বসার রুমে টিভি দেখছে। ওর কথা শুনে বলল, খালু আসুক তারপর খাবো। হঠাৎ মনে পড়ায় ফোনটা হাতে নিল মম। রায়হান সাহেব কেন এত দেরি করছে আজ ভেবে চিন্তা হচ্ছে। কল ডায়াল করার আগেই কলিংবেল বাজল। বৃষ্টি দরজা খুলতেই রায়হান সাহেব আর জাবেদ খালু ঘরে ঢুকলেন। হাতে কিসের প্যাকেট। মাধুরী খালা গিয়ে প্যাকেটটা নিল। মম এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বলল, এত দেরি করলে যে আব্বু? তিনি গ্লাসটা নিতে নিতে বললেন, দেরি না। আমি তো আরো আগেই এসেছিলাম। মেহমান দেখে ভাবলাম একটু দই আনি। তা মেহমান কোথায়?
– চলে গেছে।
– এত রাতে বাচ্চা নিয়ে চলে যেতে দিলি!?
– মানা করেছিলাম। শুনেনি, ওর জামাই এসে নিয়ে গেছে আব্বু। তুমি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।
– হুম।
সবাই রাতের খাবার খেয়ে যে যার ঘরে চলে গেল। বিছানায় পিঠ লাগতেই বৃষ্টির ঘুম। মমরও চোখ লেগে এসেছিল ক্লান্তিতে। বর্ষার একটা কথায় ঘুম পালিয়ে গেল। বর্ষার দিকে তাকাতেই সে আবার বলল, কি করে মেনে নিচ্ছিস? মম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, অতীতকে অতীত রাখাটাই ভালো। না হলে বর্তমানটা এলোমেলো হয়ে যায়।
– আলিফকে দেখে থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম। তুই যেমন ছবি দেখিয়েছিলি তেমন চেহারাই আছে এখনো।
– হুম।
– আদ্রিতাকে তো চিনি না তাই ভেবেছিলাম বউ দেখাতে এসেছে। পরে বুঝলাম আদ্রিতা তোর বান্ধবী।
বর্ষার কথা শুনে ফিক করে হেসে দিল মম। হাসি থামিয়ে বলল, ভালো বলেছো। বউ দেখাতে এসেছে। এই সাহসটুকু থাকলে আরো আগেই আসতো। নেহাত আদ্রিতা আমার বান্ধবী নাহলে ও আমার ছায়াও মাড়াতো না। চলো ঘুমাই। অনেক রাত হচ্ছে। কালকেও অফিস আছে। মম অপরপাশে ফিরে গেল। বর্ষা জানে এখন কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও ওর চোখে পানি আসবে। তারপর নতুন শক্তি সঞ্চয় করে ঘুমিয়ে পড়বে। যেমনটা এই এক বছর করে আসছে।
বাড়িতে এসেই সোজা রান্নাঘরে গিয়ে কাজে হাত লাগালো আদ্রিতা। ফেরদৌসি বেগুন ভর্তা বানাচ্ছিলেন। ও গিয়ে বলল, চাচি আমি করে দেই? তিনি একবার তাকিয়ে ফের কাজে মন দিয়ে বললেন, প্রায় শেষ। তুই ফ্রেশ হয়ে নে। সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছিল। টেবিলে সবাইকে ডাক তো। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আদ্রিতা কিছু বলবে বলবে করেও বলতে পারল না। এভাবে একলা না বলে সবাই যখন গল্প করবে তখন কথা তুলতে হবে। এগারটার মধ্যে খেয়ে বসার রুমে আরাম করে বসল সবাই। কে কি করল সারাদিন সেটা নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা চলছে। ছেলেরা সবাই ব্যবসার কথা আলোচনা করছে। আর বাকিরা তাদের নিজস্ব কথা বলছে। আদ্রিতা মনে মনে কথা গুছিয়ে নিয়ে একটা হাঁক ছেড়ে বলল, আমার কাছে একটা সুখবর আছে। সবাই ওর কথা শুনে তাকালো। অনি নীলি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি কি?? আদ্রিতা গলা পরিষ্কার করে বলল, ভাইয়ের কোটের খোঁজ পাওয়া গেছে। রিতু এক লাফে আদ্রিতার কাছে গিয়ে বলল, কে সে? দেখতে কেমন? কোথায় থাকে? ভাইয়ার সাথে কেমন লাগবে? আদ্রিতা ওকে শান্ত করে বলল, আরে বোস বোস। সব বলব বলেই তো এখন কথাটা তুললাম। আমার এক কলেজ ফ্রেন্ড আছে যে মনে আছে মম নামে? নাহার চাচি বললেন, ঐযে তোর থেকে একটু বাট্টি ছিল যে ঐ মেয়েটা?
– ও এখন বাট্টি নেই। যথেষ্ট লম্বা হয়ে গেছে। আমার থেকে যদিও আধা ইঞ্চি কম। আজকে মমর আলমারিতে ভাইয়ের কোটটা দেখেছি।
রিতু অস্থির হয়ে বলল, আরে আমার প্রশ্নগুলোর তো উত্তর দিচ্ছো না আদ্রিপু। বল না, কেমন দে…। নিক্বণ পেছন থেকে চাটি মেরে বলল, অপেক্ষা কর না। বলতে দে ওকে। আগে থেকে পকপক করলে বলবে কি করে? কনক চাচি জিজ্ঞেস করলেন, আসলেই বল না মেয়েটা দেখতে কেমন? আদ্রিতা ফোন বের করে বলল, দাঁড়াও দেখাচ্ছি। ও একটা ছবি দেখালো। মম প্রিয়ান্তুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আলমারির কাছে। সবাই ছবিটা দেখতে লাগল। বোনেরা কাড়াকাড়ি লাগিয়ে দিল ছবি দেখতে গিয়ে। আদ্রিতা বলল, ছবিতেই দেখো। আলমারিতে কোটটা দেখা যাচ্ছে। কোট পকেটে বড় চাচির সেলাই করে দেওয়া ছোট ‘আর’ অক্ষরটা দেখেই চিনেছি। মমর রিসেন্টলি বিয়ে হয়েছিল একমাস হবে। কিন্তু জামাইর অন্য জায়গায় সম্পর্ক থাকায় ক’দিন আগে ডিভোর্স হয়ে যায়। নাহার চাচি আফসোসের সুরে বললেন, আহারে! মেয়েটা দেখতে তো বেশ ভালোই। কে বলবে তার জীবনে এমন হয়েছে!? ডিভোর্সের কথাটা শুনে সবার উচ্ছ্বাস যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। রিতু কেমন দমে গিয়ে বলল, আর আমি ভাবছিলাম…। বলে চুপ করে গেল। আদ্রিতা বলল, তোমরা যদি রাজি থাকো তো আমার একটা প্রস্তাব আছে। মমকে আমি যতটুকু চিনি ও খুবই ভালো মেয়ে। ঘরোয়া মেয়ে বলা চলে। তবে রিসেন্টলি ডিভোর্স হওয়ার পর একটা জব করছে। কোথায় করছে সেটা অবশ্য জানা হয়নি। আমার প্রস্তাব এই যে আমি চাই তোমরা ভাইয়ের জন্য ওকে পছন্দ করো।
সবাই চুপ করে রইল। দাদি রওশন আরা মুখে পান নিয়ে বললেন, দাদুভাই, একবার এনো তো ওকে। আমি দেখবো। যদি আমার মন জয় করতে পারে তবে ওকেই আমি নাতবৌ বানাবো। কেউ কিছু না বলে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগল। মমকে দেখার আগে কেউ আর কথা বাড়াতে চায় না। দেখেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে যে তাদের জীবন কোন দিকে মোড় নেবে।
রাতে প্রিয়ান্তুকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আদ্রিতা পোশাক বদলাতে গেল। আলিফ এসে বিছানায় বসল মেয়ের সাথে খেলা করতে। হঠাৎ প্রিয়ান্তুর গলায় চেইনটা দেখে চমকে উঠল। চেইনটা চিনতে অসুবিধা হলো না ওর। কারণ লকেটের উপরে খচিত নকশাটা আলিফ নিজে হাতে একে কারিগরকে দিয়ে বানিয়েছিল। আর এই চেইনই সে মমকে দিয়েছিল। আলিফের চিন্তার ছেদ ঘটিয়ে আদ্রিতা এসে বসল পাশে। আলিফ জিজ্ঞেস করল, এই চেইনটা কে দিয়েছে?
– মম। সুন্দর না?
– তার ব্যবহৃত জিনিস আমার মেয়েকে দিয়েছে কেন?
– তো কি হয়েছে? তুমি কি করে জানলে ব্যবহৃত?
– সেটা দেখেই বোঝা যায়। আর তাছাড়া তুমি তো হুট করে গেছো। এর মাঝে সে নতুন চেইন কোথা থেকে কিনবে? যাও এটা খুলে নাও।
– থাকুক না। দেখো প্রিয়া এটা নিয়ে খেলা করছে। ওরও পছন্দ হয়েছে। মানিয়েছে ওকে খুব।
আলিফ বিরক্ত হয়ে শুয়ে পড়ল। কড়া গলায় বলল, তাড়াতাড়ি লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ো। আর কাল যেন ওর গলায় চেইনটা না দেখি। ওর এখনো এসব দেওয়ার বয়স হয়নি। বলেই চোখের উপর হাত দিয়ে চুপ করে রইল। আদ্রিতা মন খারাপ করে চেইনটা খুলে আলমারিতে রেখে শুয়ে পড়ল। আলিফ দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে চেনা মানুষ অচেনা হলে সহ্য হয় না কেন কে জানে।
.
.
.
.
মিনহাজ একজন থেকে একটা ফাইল বুঝে নিচ্ছিল তখনই মম সালাম দিয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে বসল। ও মমকে দেখে চিন্তা করতে লাগল ওকে কোথায় যেন দেখেছে দেখেছে মনে হচ্ছে। কিন্তু মনে করতে পারছে না। ওর দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ মনে পড়ল কালকে আদ্রিতার ফোনে মমর ছবি দেখেছে। নামটাও মিলে গেছে। তাহলে মম ওদের কোম্পানিতে কাজ করে! মিনহাজ কাজ থেকে ফ্রি হয়ে আদ্রিতাকে ফোন করে বলল, তোর বান্ধবী তো আমাদের কোম্পানিতে কাজ করে।
– তাই নাকি!? তো কাল বললে না যে।
– মাথা থেকে ছুটে গিয়েছিল।
– দরকারি জিনিসই তুমি ভুলে যাও ভাইয়া। যা হোক, তাহলে আমি দুপুরে ব্রেকে ওকে নিয়ে আসবো বাসায়। তুমি বড় চাচার থেকে পারমিশন নিয়ে নাও।
– দেখি।
– দেখি না। আমি আসছি ওকে নিতে।
বলে আদ্রিতা ফোন কেটে দিল। মিনহাজ একটা নিঃশ্বাস ফেলে ফাইল নিয়ে দরজায় নক করল। ভেতরে রাকিব হাসান বসে কাজ করছেন। ও ঢুকে বলল, ফাইলগুলোয় সিগনেচার লাগবে। তিনি ওর দিকে না তাকিয়ে বললেন, রেখে যাও। ফাইল রাখতে রাখতে বলল, মেয়েটা আমাদের কোম্পানিতে জব করে। কথাটা শুনে তিনি স্বপ্রশ্নে তাকিয়ে বললেন, কোন মেয়ে?
– আদ্রি যার কথা বলল কালকে। এখন ও আসছে মমকে বাড়িতে নিয়ে যেতে লাঞ্চের পরে। তাই বলছে ওকে ছুটি দিয়ে দিতে।
রাকিব হাসান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ওকে। বলে দিস। মিনহাজ চলে গেলে উনি চেয়ারে হেলান দিলেন। রওশন আরার কথা উনি ফেলতে পারেন না। বাবা মারা যাওয়ার পর মাকে অনেক আগলে রাখেন তিন ভাই। মমকে যদি পছন্দ হয়ে যায় তবে কেউ না করবে না সেটা জানা কথা।
দুপুরের ব্রেকটাইম শুরু হয়ে গেছে কিন্তু মম এখনো চেয়ার থেকে ওঠেনি। কাজ শেষ হচ্ছে না। খেতে যে যাবে সেই সময়ও হয়ত পাবে না। ক্লান্তি আর খিদেয় আপনিই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হল। ওর ডেস্কের সামনে কে এসে বলল, কিরে কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে গেলি নাকি!? মম তাকিয়ে দেখল আদ্রিতা ওর সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। ও একটু অবাক হওয়া সুরে বলল, তুই? এখানে কি করে? ঢুকলি কিভাবে? বাইরের মানুষ তো তারা এলাও করে না।
– আরে ওকে, বাবা। এত চাপ নেওয়ার কিছু নেই। এখানে কেউ কিছু আমাকে বলবে না।
– কেন?
– এটা আমার বড় চাচার কোম্পানি তাই। এখন ওঠ।
– আগে বলিসনি তো।
– আমি কি জানতাম নাকি তুই আমার চাচার কোম্পানিতে জব করিস!? যাহোক ভালোই হয়েছে। এখন চল।
– কোথায়?
– আমার বাসায়। চাচাকে বলে ছুটি নিয়েছি তোর জন্য।
– আমার অনেক কাজ…
– ধুর চল তো। কাজ আমি ভাইয়াকে বলে কমিয়ে দিবো।
– ভাইয়া?
– মিনহাজ আমার বড় ভাই। এখন চল।
আদ্রিতা ওর ব্যাগ গুছিয়ে হাত ধরে হাঁটা দিল। মমকে বেগ পেতে হচ্ছে। ও কিছু বলার আগেই ওকে নিয়ে অফিসে বাইরে চলে এল। গাড়ির দরজা খুলে ওকে ঢুকতে ইশারা করে নিজেও উঠে বসল। গন্তব্য আদ্রিতাদের বাড়ি।
চলবে…