বাঁক,৪,৫

0
301

বাঁক,৪,৫
লেখা: MD Jobrul Islam
(৪র্থ পর্ব )

কাঁথার ফাঁক দিয়ে চোরা চাহনিতে তাকায় মৃদুল। সাদা ট্রে-তে দু’টা প্লেট। প্লেটে পিস পিস করা লাল টকটকে পাকা পেঁপে দেখে জিভে জল চলে এলো তার। পেটের ক্ষুধা পুনরায় মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। কিন্তু সে যে জ্বরে অপ্রকৃতিস্থ মানুষ। এখন কীভাবে মুখ ফুটে নিজ থেকে খেতে চাইবে? আপন মনে প্রার্থনা করে, এখন শুধু একবার ধাক্কা দেন কেউ। প্রার্থনা কবুল হলো না। সে নিজেকে সামলে নিয়ে কেবল চেয়ে রইল। চোখের সামনে বসেই মুরব্বি আর ইমাম সাহেব দুই প্লেট পেঁপে খেলেন। খানিক পর মেয়েটি আবার চা-বিস্কিট নিয়ে এলো। সে কাঁথার ফাঁক দিয়ে এই প্রথম তাকিয়ে দেখলো পিচ্চি ফাতিহাকে। ওর সামনের একটা দাঁত না থাকায় বিশ্রী লাগছে। বয়স কত হবে? সাত কি আট? দেখে তো মনে হচ্ছে তার থেকে কয়েক বছরের ছোট।

নাস্তা শেষে ইমাম সাহেব বললেন,
– ‘খান সাব এবার উঠি, মক্তবের সময় হয়ে যাবে।’

– ‘হ, আপনের তো যাইতেই হইব, আইচ্ছা যান।’

ইমাম সাহেব চলে গেলেন। মুরব্বি কাঁথার ভেতর দিয়ে তার কপালে হাত দিয়ে জ্বর আন্দাজ করলেন। ফাতিহা ট্রে হাতে নিল। তারপর দু’জন দরজা ভেজিয়ে বাইরে চলে গেলেন।
সে চুপচাপ শুয়ে থেকে নানান বিষয় নিয়ে ভাবে। সম্ভাব্য সকল প্রশ্নের অগ্রীম উত্তর ভেবে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়।
ঘন্টা খানেকের ভেতরে পুনরায় দরজার আর্তনাদ শুনতে পায়। বুঝতে পারে কেউ এসেছে। ভালোভাবে চোখবুজে নেয়। খানিক পর ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখে মুরব্বি মাটিতে শীতল পাটি বিছিয়ে গেছেন। পাশে পলিথিনের সাদা ব্যাগে ওষুধ। ফাতিহা ভাতের বাটি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। পেছনে পানির জগ আর গ্লাস নিয়ে মুরব্বিও এলেন। মৃদুল উনার দিকে এই প্রথম ভালোভাবে তাকায়। এই অল্প সময়ে অসম্ভব পছন্দ হয়ে গেছে মানুষটিকে। পরনে ফতুয়া। চুল-দাড়ি এখনও সাদা হয়নি। চওড়া কাঁধ, বুকের ছাতি বিশাল, দুধের মতো সাদা দাঁত, কৃষ্ণ বর্ণের চেহারা।
তার দিকে এগিয়ে আসছেন দেখে দ্রুত চোখবুজে নিল।

– ‘এই ছাগল উইটা ঘাস খা।’

দরজার ওদিকে চাপা হাসি শুরু হলো। ফাতিহা কি মুখ চেপে হাসছে? মেয়েটি মুরব্বির কী হয়? মেয়ে না-কি নাতনি?

তার মাথার ওপর থেকে কাঁথা সরে গেল।
সদ্য ঘুম থেকে উঠা মানুষের মতো ঘুম ঘুম চোখে পিটপিট করে তাকায় মৃদুল। মুরব্বি তার মাথা ঠেলে তুলে দেন।

– ‘চাচা আমি কোনে এখন?’

মুরব্বি রসিকতা করে বললেন,

– ‘শ্বশুরবাড়ি আছিস হারামজাদা। আমি তোরে ছাগল ডাইকা বইসা আছি। আর তুই আমারে চাচা ডাকতেছিস ক্যান? দাদা বল।’

ফাতিহা আবার খিলখিল করে হাসলো। মৃদুল চোখ কচলাতে লাগলো।
মুরব্বি এবার তাড়া দিয়ে বললেন,

– ‘রাতে বাইরে থাইকা জ্বর আনেছিস। এবার ভাত খা উঠে, ওষুধ খাইতে হবে তোর।’

মৃদুল ব্যগ্র গলায় বললো,

– ‘আমি এইখানে কীভাবে আইলাম দাদা?’

– ‘মসজিদের ঘাট থাইকা তোরে তুইলা নিয়া আসছি বিয়া দিবার লাইগা। ইমাম আসতাছেন বিয়া পড়ানোর জন্য। তাড়াতাড়ি উইটা ভাত খা।’

আবার ঝর্ণার পানির কলকলানি শোনা গেল ওদিকে। মৃদুল নিজের অভিনয় দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে ভাবলো, অনেক হয়েছে এবার খাওয়া যাক। সে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে শীতল পাটিতে গিয়ে আসন পেতে বসে।

– ‘তুই সারা রাইত উপোস ছিলি, তাই নাস্তা না দিয়া বাড়িতে ভাত দিতে কইলাম। ব, তোর লগে আমিও ভাত খাইয়া নিমু। এই বান্দি, তুই খালি হাসতাছস কেন? আমাদের লগে খাবি?’

ফাতিহা মাথা দু’দিকে কাত করে বললো,

– ‘না।’

– ‘না ক্যান? তুই নজর দিবি না-কি বইসা বইসা? যা আরেকটা প্লেট নিয়া আয়। জলদি যা।’

সে পাতলা পায়ে এক দৌড়ে গিয়ে প্লেট নিয়ে এলো।

– ‘এই মাইলেনেউরি, জামাইর বাড়ি গিয়া তো খালি মাইর খাইবি। গ্লাস আর লবণ কে আনবো?’

সে আবার এক দৌড়ে গিয়ে গ্লাস আর লবণদানি নিয়ে এলো। বসলো তাদের সামনে আসন পেতে। দাদা তাদের দু’জনকে ভাত দিলেন। মৃদুলের পাতে রুই মাছের বিশাল মাথা দিয়ে বললেন,

– ‘আমরার পুকুরের মাছ। পেটপুরে খা।’

তারপর ফাতিহার দিকে তাকিয়ে বললেন,

– ‘তুই হা কইরা কি দেখতাছিস? দাঁত পড়া মাইয়া, গু খা টাইনা।’

ফাতিহা দাঁত কটমট করে তাকিয়ে ‘ওয়াক ভাতই খাইমু না’ বলে উঠে গেল। দাদা আবার ‘খ্যাক খ্যাক’ করে হাসতে হাসতে টেনে বসালেন।
মৃদুলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

– ‘লেবু কাঁচা মরিচ লাগলে নে, অবশ্য ডাইল আর গোসত ছাড়া লেবু জমে না। তোর লাগলে নে।’

মৃদুল একটা কাঁচা মরিচ নিয়ে কামড় দিয়ে তাকিয়ে দেখে একটা বিড়াল এসে ফাতিহাকে মানুষের হাতের মতো পা দিয়ে টানছে ফ্রকে ধরে। সে ভাত দিলে খায়, আবার খানিক্ষণ পর ফ্রকে টান দেয়।
দাদা একমনে খাচ্ছেন। তাদের খাবার শেষ হওয়ার পর ফাতিহা গিয়ে সুপারি আনলো। দাদা ওষুধ বের করে খেতে দিলেন মৃদুলকে। তিনি বিছানায় আসন পেতে বসলেন। ফাতিহা বাটি আর প্লেট ঘরে দিয়ে এসে বসলো চেয়ারে।
দাদা সুপারি মুখে পুরে বললেন,

– ‘এইবার ক তোর নাম কি?’

মৃদুলের পেট মোচড় দিয়ে উঠলো। তারমানে এখন একে একে সব জিজ্ঞেস করবেন? অবশ্য সে এই বিছানায় শুয়েই নিজেকে মনে মনে মিথ্যে পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। সকল প্রশ্নের মিথ্যে উত্তর তৈরি করে নিয়েছে। প্রথমেই নিজের আসল নাম গোপন রেখে বললো,

– ‘মৃদুল।’

– ‘এইটা আবার কি নাম। আমি তো উচ্চারণ ও করতে পারমু না। তা বল বাড়ি কোথায়? মসজিদের ঘাটে কোত্থাইকা আইলি?’

আবার সে খানিক আগে প্রস্তুত করা মিথ্যে কথাটি বলে দিলো,

– ‘আমার বাড়িঘর নাই।’

– ‘কি কছ? বাড়িঘর ছাড়া মানুষ কিরকম অয়? এখানে আওয়ার আগে কই আছিলি?’

– ‘রাস্তায় ছিলাম। আমার বাড়িঘর নাই। আমারে এক ফকির ডাস্টবিনে পাইছিল। সেইই পাইলা বড়ো করছে। আমি তার লগে ভিক্ষা কইরা বড়ো হইছি। কয়েকদিন আগে মারা গেছেন উনি। আমি পড়ছি মুসিবতে। কেউ আমারে ভিক্ষা দেয় না। কয় শরীর গতর ভালা আছে ভিক্ষা করছ ক্যান? কাম কইরা খা। কিন্তু কেউ কাম আর দেয় না। ওইদিন শেরপুর লঞ্চে উঠছিলাম ভিক্ষা করার জন্য। সেখানেও কেউ তেমন ভিক্ষা দিল না। আমারে না-কি ভিক্ষুক লাগে না। পেটের ক্ষুধায় লঞ্চে ঘুমাইয়া পড়ছিলাম। ঘুম থাইকা উইটা দেখি রূপগঞ্জ বাজারে চইলা আসছি। তারপর আঁতকা মনে অইল। লোকে কয় ভাটি অঞ্চলে মানুষ বাড়িতে চাকর রাখে। ভাবলাম বাজারে গিয়া দেখি। সারাদিন বাজার আর এলাকায় ঘুরছি কাজ কাম নাই। রাত হইয়া গেছে শরীরেও জ্বর জ্বর ভাব। ঘুমাইবার জায়গাও পাইছিলাম না। তারপর মসজিদ দেইখা ঘাটপাড়ে শুইয়া পড়ছিলাম।’

– ‘হায় হায় কি বলিস? তোর কেউ নাই? কাম-কাজও নাই?’

মৃদুল তাকিয়ে দেখলো দাদার চেহারায় সহানুভূতির চাপ।
মিথ্যে গল্পটা সবচেয়ে বেশি স্পর্শ করলো ফাতিহার কোমল হৃদয়। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছে।
বুড়ো তাকে টেনে কোলে এনে বললেন,

– ‘কাদিস না বইন। ওরে আমরা রাইখা দিমু বাড়িতে। তোর লগে খেলবো। আমার লগে কাম করবো। তোর বাপ পইড়া আছে বিদেশ। আমি একা একা কি করমু। এখন মিদলও ও থাকবো।’

মৃদুল মনে মনে খানিকটা অবাকই হলো। এতো সহজে উনি বিশ্বাস করবেন আর কাজ দেবেন ভাবেনি সে। তারপর জীবনের প্রায় সতেরো বছর কেটে গেল এই সহজ-সরল মানুষদের সঙ্গে। যাদের হৃদয় অপার ভালোবাসা-মমতায় ভরপুর।
কিন্তু সে শেষপর্যন্ত কী করলো? তাদেরও নিঃস্বার্থ ভালোবাসার মূল্য কখনও দিতে পারেনি। পদে পদে চেতনে-অবচেতনে নিমকহারামি করেছে। চোখ ভিজে এলো মৃদুলের। আবার কী সে দাদার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে? একটুতে ফ্যাসফ্যাস করে কেঁদে ফেলা কোমল হৃদয়ের ফাতিহার বিশ্বাস কী রাখতে পারবে? সে আবার কী ফিরে পাবে মৃদুলকে? তার জীবন যে বড়ো বাঁক নেয়। পদে পদে বাঁক। ছোটবেলায় মা ছোট বোন ইশি আর তাকে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নানাবাড়িতে এসেছিলেন। শৈশবের একটা অংশ দাদার বাড়িতে রেখে নানাবাড়ি এলো সে। তারপর সেখানেও ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর পালিয়ে গেল রূপগঞ্জে। কত স্মৃতি জমা হলো রূপগঞ্জ। কত ভালোবাসার মানুষ। কতটা বছর কাটিয়ে বড়ো হলো সেখানে। কিন্তু ঠিকই সমস্যাটা পুনরায় সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে জলেস্বরী বাজারে। হাতের উলটো পিঠে চোখের জল মুছে স্মৃতি রোমন্থনের ইতি টানলো মৃদুল।

মধ্যবয়স্ক লোকটি কোলে টেনে এনে গালে চুমু খাওয়ার জন্য ঠোঁট সামনে নিতেই চোখবন্ধ করে ইশি মুখ সরিয়ে নিল।

– ‘কি হইল এমন করতাছস কেন?’

ইশি কোনো জবাব না দিয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললো।

– ‘এমন তো কথা আছিল না ইশি। এক দুই টাকা না, বারো হাজার টাকা নিছস কইলাম।’

ইশি নিজেকে সামলে নিয়ে চোখের জল মুছে সম্মতি জানিয়ে বললো, ‘হু।’

লোকটি এবার বুকে হাত দিয়ে গালে চুমু খেলো। ইশির যেন দমবন্ধ হয়ে আসছিল। সে চোখ বন্ধ করে শরীর শক্ত করে বসে রইল।

– ‘এইরকম টাইট হইয়া বইসা আছস ক্যান? শরীর ছাড় কইলাম।’

ইশি কোনো জবাব দিল না। লোকটি তাড়া দিয়ে বললো,

– ‘কামিজ খুল তো, বুক দেখি।’

ইশি বারবার নিজের সাথে যুদ্ধ করেও কামিজ খুলতে পারছে না। লজ্জায় ঘেন্নায় তার মরে যেতে ইচ্ছা করছে।
লোকটি বিরক্ত হয়ে নিজেই টেনে খুলে ফেললো। ইশি দুই হাতে বুক ঢেকে হাউ-মাউ করে কাঁদতে শুরু করে।

– ‘খানকি এমন করতাছস ক্যান টাকা নিয়া? তুই নিজেই তো রাজি হইছিলি। এখন এমন করলে আমি কিরকম মজা পাইমু? আনন্দই তো মাটি কইরা ফেলতাছিস। উঠ, বুক থাইকা হাত সরা।’

ইশির নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগে। কী করবে সে বুঝে উঠতে পারছে না। লোকটি টেনে হাত সরিয়ে বুকে মুখ ডুবিয়ে রাখে খানিক্ষণ পর বললো,
– ‘সেলোয়ার খুল।’

ইশি এবার কান্নায় ভেঙে পড়ে লোকটির পা দু’টি জড়িয়ে ধরে বললো,

– ‘আমজাদ ভাই আমারে মাফ কইরা দেন। আমি এই কাজ পারমু না। আম্মার জন্য আমার মাথা ঠিক আছিল না। তাই রাজি হইয়া গেছিলাম।’

আমজাদ চুলের মুঠি ধরে বললো,

– ‘বেইমান্নীর বাইচ্চা বলিস কি? আমার টাকার কি হইব।’

– ‘খোদার কসম কইরা কইলাম ভাই, আমি কাম কইরা দিয়া দিমু আপনার টাকা।’

– ‘চুপ কর খানকি, আগে রাজি হইলি ক্যান?’

– ‘আম্মার জন্য রাজি হইয়া গেছি ভাই। আম্মা ছাড়া যে আমার আর কেউ নাই। তখন বুঝি নাই কাপড় খোলা যে আমার দ্বারা হইব না।’

– ‘এখন বুঝলে হইব? আমার টাকা এখন দিতে পারবি?’

– ‘এখন না পারলেও আমি কাম কইরা দিয়া দিমু ভাই। বিশ্বাস করেন দিয়া দিমু।’

– ‘চুপ করে কাপড় খুল তাড়াতাড়ি, না হয় এখন টাকা ফেরত দে। তুই বেইমান্নী। কথা রাখস নাই।’

ইশি কাঁদতে থাকে৷ নিজের ইজ্জত ভিক্ষা চায়। উত্তেজনার সময় কান্নাকাটি করার কারণে আমজাদ বিরক্ত হয়ে গালি দেয়।

সেদিন ইশি কাজ থেকে ফিরে এসে দরজা খুলতেই দেখতে পায় মা বিছানায় পড়ে পেটে হাত দিয়ে কাতরাচ্ছেন। সে হাঁটু গেঁড়ে বসে জিজ্ঞেস করে,

– ‘কি হইছে আম্মা? এমন করতাচ্ছো কেন?’

ইশির হাত খামচে ধরে তিনি বলেন,

– ‘পেট ব্যথা করতাছে রে মা। আমি আর সহ্য করতে পারতেছি না।’

– ‘কখন থাইকা এমন করতাছে?’

– ‘বিকাল থাইকা।’

কথাটি বলে বিছানায় গড়াগড়ি শুরু করলেন। ইশি বুঝতে পারে এটা স্বাভাবিক ব্যথা না। মা’র ধৈর্য সম্পর্কে সে জানে। কিন্তু এখন কি করবে? কলোনিতে সবাই ক্লান্ত হয়ে কাজ থেকে ফিরছে। কাকে কি বলবে গিয়ে সে? তাড়াতাড়ি গিয়ে রাস্তা থেকে একটা রিকশা এনে মোড়ের ফার্মেসিতে নিয়ে যায়। ওরা কিছু ওষুধ দিয়ে বলে দিলো যদি ব্যথা না কমে সদর হসপিটালে নিয়ে যেও। ইশি মা’কে নিয়ে বাড়ি ফিরে। রাতের খাবার শেষে ওষুধ খাবায়। কিন্তু পুরো রাত ব্যথায় এপাশ-ওপাশ করে কেটে যায় মায়ের। ভোরে আবার একা একা সিএনজি এনে গেল সদর হসপিটালে। ওরা পরীক্ষা-নিরিক্ষার পর বললো, এপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা। দ্রুত অপারেশন করাতে হবে। টাকা লাগবে দশ হাজার। সে এতো টাকা পাবে কোথায়? মা’কে হসপিটাল রেখে কলোনিতে ফিরে এসে সবার ধারে ধারে ঋণ চেয়ে পেল না৷ সবাই বললো কলোনির মালিকের কাছে গেলে ঋণ পেতে পারে। সে আমজাদের কাছে যেতে চাইছিল না৷ কারণ লোকটি তাকে কয়েকবার খারাপ প্রস্তাব দিয়েছে। তবুও সেদিন মায়ের জন্য যেতে বাধ্য হয়। আমজাদ ইনিয়ে-বিনিয়ে আগের প্রস্তাবের কথা মনে করিয়ে দেয়। ইশি তখন বলে সবকিছু করতে রাজি সে। শুধু টাকা যেন দেয়। তার মা যেন বাঁচেন। আমজাদ তখন তাকে কাছে টেনে বললো, ‘কান্নাকাটি করিস না। এসব ব্যথা অহরহ হয় এখন৷ অপারেশন হইলেই ভালা হয়ে যাইব তোর মা। চল আমিও যাই তোর লগে হসপিটাল। আমি তোরে ভালোবাসি বইলাই তো কাছে চাই। তোর বিপদে আমজাদ থাকবো না কীভাবে বুঝলি? আগেই আসতি আমার কাছে আমি নিজেই ভর্তি করে দিয়া আসতাম।’

আমজাদ তার কথা রেখেছে। ইশির মা’র অপারেশনের টাকা সহ দেখাশোনা সবকিছুই পাশে থেকে করেছে সে। অপারেশন শেষ। তিনি এখন সিটে আছেন। ডাক্তার বলেছে কিছুদিন হসপিটালে থাকতে হবে৷ আজ ইশিকে নিয়ে নিজের পাওনা আদায়ের জন্য আমজাদ একটা হোটেলে এসেছে।
কিন্তু ইশি এখনও কান্নাকাটি থামছেই না। কোনোভাবেই কাপড় খুলতে রাজি হচ্ছে না সে। আমজাদের ধৈর্যের বাদ ভেঙে গেল। ক্রোধে জোরে একটা চড় দেয় ইশির গালে। তারপর নিজেই টেনে সেলোয়ার খুলতে যায়।

—- চলবে —–

লেখা: MD Jobrul Islam

বাঁক ( ৫ম পর্ব )
________

মোবাইল পুনরায় বেজে উঠলো। রাগে ইচ্ছা করছে মুঠোয় নিয়ে ছুড়ে মারে দেয়ালে। পাশের বিছানার ছেলেটি বালিশ থেকে মাথা তুলে লাল টকটকে চোখে তাকিয়ে বললো, ‘আরে ভাই কি শুরু করছেন কন তো? আপনের ফোনের যন্ত্রণায় তো ঘুমাইতেই পারতেছি না।’

মৃদুল বিছানা থেকে উঠে করিডরে এসে কল রিসিভ করে,

– ‘ম্যাডাম কি হয়েছে বলুন তো। এতো কল দিচ্ছেন কেন? বললাম তো আসছি।’

– ‘এতক্ষণ লাগে আসতে?’

– ‘এখন মাত্র সাতটা বাজে আমি আসবো কীভাবে?’

– ‘সাতটায় আসা যাবে না কেন?’

– ‘আপনি ভোর ছয়টায় কল দিয়ে বললেন গোসল করে ভালো জামা-কাপড় পরে চেম্বারে যেতে। তখন বলেন নাই সাতটার আগেই যাওয়া লাগবে। আমি তো আপনাকে প্রতিদিন নয়টায় যেতে দেখি।’

– ‘আচ্ছা ঠিকাছে এখন বলছি, আপনি বিশ মিনিটের ভেতরে আসুন।’

– ‘বললেই তো হবে না ম্যাডাম। আমার এখানে একটা মাত্র টয়লেট আর গোসলখানা৷ একদল এখন হাত-মুখ ধুয়ে আটটায় কাজে যাবে। আরেক দল যাবে নয়টায়৷ এখন আমি গোসলে গেলে সবাই মিলে দরজা ভেঙে মারবে। তাছাড়া বিশ মিনিট তো এখন সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে থাকতেও চলে যাবে।’

– ‘ও আচ্ছা, তাহলে আপনি একটা কাজ করুন। পলিথিন বা কাগজের ব্যাগে লুঙ্গি গামছা ভরে এখানে চলে আসুন।’

– ‘কেন?’

– ‘এতো কথা বলেন কেন? আপনি আসুন তো, রাখছি।’

মৃদুল এখন নিজের উপরেই বিরক্ত। কোন উন্মাদিনীর পাল্লায় পড়েছে সে? প্রথমদিন নাম্বার না দিয়ে ভালোই করেছিল। কিন্তু গতকাল নিজ থেকেই তার কল দিতে হয়েছে। এক সপ্তাহ আগেই মালিককে বিস্তারিত সহ বলে দিয়েছিল নতুন লোক খুঁজতে, সে আর কাজ করবে না। গতকাল অন্য একজন কর্মচারী এসেছে। ডাক্তারনির সঙ্গে কথা বলে ঠিক হয়েছিল আজই সে চেম্বারে যাবে। তাই বলে ভোর ছ’টা থেকেই মালিকগিরি দেখিয়ে নির্যাতন শুরু করতে হবে? রাতে বরকত চাচাদের সঙ্গে তাস আর পাঞ্জা খেলে সে তিনটায় ঘুমিয়েছে। ভেবেছিল সাড়ে আটটায় উঠে গেঞ্জি একটা পরেই চেম্বারে চলে যাবে। কিন্তু না, ডাক্তারনি তাকে গুনে গুনে এ নিয়ে চারবার কল দিয়েছে। তার উপর আবার গোসল করে বাবু সেজেও যেতে হবে। মৃদুল একটা পলিথিনের ব্যাগে কাপড় ভরে ভাবলো এখানে দাঁত ব্রাশ করে যাবে না-কি ওখানে গিয়ে করবে? বাইরে উঁকি দিয়ে দেখে দু’জন বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একজন দাঁত ব্রাশ করছে আরেকজন লুঙ্গির ওপর দিয়ে উরু চুলকাচ্ছে। ব্রাশ আর পাউডার ব্যাগে ভরে রাস্তায় নেমে পড়ে৷ ফুটপাত ধরে পাঁচ মিনিট হেঁটে চলে এলো মামণি ফার্মেসির সামনে। উপরের তলায় দেখা যাচ্ছে ‘মানহা ডেন্টাল কেয়ার।’
ফার্মেসির ডান দিক দিয়ে সরু সিঁড়ি দেখে উঠে গেল উপরে। গ্লাস দিয়ে তাকিয়ে ভেতরের কিছুই দেখা গেল না। কয়েকবার নক দিয়ে অপেক্ষা করেও কোনো সাড়া না পেয়ে কল দেয়৷ কিন্তু রিসিভ না হয়ে কেটে এলো। বিরক্ত হয়ে বাইরে পায়চারি করে খানিক্ষণ। পাক্কা বিশ মিনিট পর কেউ গ্লাস টেনে খুলছে দেখে সে এগিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে গ্লাসের আড়াল থেকে মেয়েলি গলায় বললো,

– ‘এই আসবেন না।’

তখনই ফাঁক দিয়ে ফর্সা ভেজা একটা হাত বের হয়ে এলো,

– ‘বোতলটা নিন।’

মৃদুল বিরক্ত ভঙ্গিতে বোতল নেয়। পুনরায় হাত ভেতরে গিয়ে বের হয়ে এলো একশো টাকা সমেত।

– ‘ইউনিয়ন অফিসের পাশে একটা দোকানে দুধ বিক্রি করে। আপনি তাড়াতাড়ি গিয়ে দুধ নিয়ে আসুন।’

মৃদুল টাকা আর বোতল নিয়ে চলে যাবে মেয়েটি আবার ডেকে বললো,

– ‘এই শুনুন।’

– ‘আর কী?’

– ‘হাত স্পর্শ না করেও বোতল আর টাকা নেয়া যেতো।’

– ‘আশ্চর্য, আমি আপনার হাত ছুঁলাম কই?’

গ্লাসের ওপাশে ফিক করে হাসার শব্দ শোনা গেল।

– ‘হাত দিয়েছেন তো দিয়েছেন আবার মিথ্যে বলেন। যান তাড়াতাড়ি গিয়ে দুধ নিয়ে আসুন।’

মৃদুল দাঁত কটমট করে খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিচে চলে যায়।
ইউনিয়ন অফিস কোথায় সে জানে না। তবে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে ইউনিয়ন অফিসের পাশের দুধের দোকানটি বের করতে তার খুব একটা সমস্যা হলো না। দুধ নিয়ে চেম্বারে ফিরে আসতে আটটা বেজে গেল। গ্লাসে কয়েকবার নক দিয়ে অপেক্ষা করে। খানিক পর মানহা গুনগুন করে এসে টান দিয়ে খুলে দেয়। মৃদুলের চোখের সামনে দৃশ্যমান হয় এক অপরূপ রূপবতী নারী। পরনে অচেনা রঙের শাড়ি। রঙটা সে ঠিক ধরতে পারছে না। এটা কী জলপাই রঙ? এরকমই কিছু একটা হবে। সদ্য গোসল করায় ভেজা চুল থেকে চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ছে। মুখে এখনও প্রসাধনী ব্যবহার করা হয়নি। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়নি তার মৌলিক সৌন্দর্য।
চুল ঝেড়ে-মুছে বাঁ পাশ দিয়ে সামনে রাখায় একধার ভিজে গেছে।

– ‘হা করে তাকিয়ে আছেন কেন? ভেতরে আসুন।’

ঈষৎ লজ্জা পেল মৃদুল। এবার সত্যিই সে অনেক্ষণ তাকিয়ে ছিল।
সে ভেতরে গিয়ে দেখে ডেন্টাল চেয়ার। তারমানে এটাই চেম্বার।

– ‘আসুন আমার সঙ্গে।’

মানহা গ্লাস খুলে পাশের রুমে যায়। সে পিছু থেকে তাকিয়ে আছে ওর ফর্সা নগ্ন কাঁধের দিকে। ছাই রঙা ব্লাউজের খানিকটা ভিজে গেছে।

– ‘বসুন।’ সোফা দেখিয়ে বললো মানহা।

মৃদুল সোফায় বসে চারদিকে তাকায়। ছোট্ট সুন্দর কামরা। নাকে একটা মিষ্টি ঘ্রাণ আসছে। একপাশে পালঙ্কে বিছানা করা। কেউ কি থাকে এখানে? দেয়ালের একপাশে রবীন্দ্রনাথের ছবি আর পৃথিবীর মানচিত্র।

মানহা বিছানায় সুন্দর করে বসে মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘নিচের দিকে তাকান।’

– ‘হ্যাঁ তাকিয়েছি।’

– ‘এটা কী?’

– ‘কার্পেট।’

– ‘আপনার পায়ে কী?’

‘জুতা’ বলেই মৃদুল নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে লজ্জিয় ভঙ্গিতে বললো, ‘সরি, আমি আসলে খেয়াল করিনি। এখনই বাইরে রেখে আসছি।’

– ‘থাক জনাব, এসেই যখন পড়েছেন আর রেখে আসতে হবে না। এবার এই যে দেখুন বাথরুম। গিয়ে গোসল করে নিন।’

– ‘জ্বি ম্যাডাম যাচ্ছি।’

– ‘সবকিছু নিয়ে বাথরুমে ঢুকবেন। ওখানেই সবকিছু শেষ করে কাপড় পরে বেরুবেন। আমাকে বডি দেখানোর জন্য গামছা দিয়ে শরীর মুছতে মুছতে বের হওয়া দরকার নেই।’

– ‘আমি আপনাকে বডি দেখাতে যাব কেন?’

– ‘আমি কী জানি কেন দেখাবেন, যান তো তাড়াতাড়ি গোসল করেন।’

মৃদুল বাথরুমে ঢুকে গেল। মানহা স্মিত হেঁসে উঠে দাঁড়ায়। তোয়ালে দিয়ে চুল আবার ভালোভাবে মুছে। তারপর দুধের বোতল নিয়ে বাথরুমের পাশের দরজাটি খুলে রান্নাঘরে যায়।
একটা প্লেট ধুয়ে ব্রেডের প্যাকেট থেকে এক পিস নিয়ে চাকু দিয়ে স্টিকসের মতো পাঁচ ভাগ করে কাটে। এভাবে সকল ব্রেড কাটার পর ফ্রাইপ্যান ভালোভাবে ধুয়ে চুলোয় বসিয়ে কয়েকটা ব্রেড স্টিক আলাদা আলাদা রেখে অল্প আগুন দেয়।
একটু পরেই একটা একটা করে উলটিয়ে দেখে নিচের দিকে লালচে আর মচমচে হয়ে গেছে।
নামিয়ে রাখে আলাদা প্লেটে। এভাবে সবগুলো স্টিক মচমচে করে ভেজে আলাদা প্লেটে রাখে। আবার ফ্রাইপ্যান ধুয়ে চুলোয় বসিয়ে অল্প চিনি আর পানি দিয়ে আগুনে কিছুক্ষণ নেড়ে অল্প একটু বাটার দেয়।
খানিক্ষণ এভাবে রেখে এক কাপ দুধ দিয়ে পুনরায় নাড়ে। অল্প সময় পর ভেজে রাখা ব্রেড স্টিকস একটা একটা করে ফ্রাইপ্যানে দেয়। দরজা দিয়ে তাকিয়ে দেখে মৃদুলের গোসল শেষ।

– ‘চেয়ার নিয়ে এখানে এসে বসুন।’

মৃদুল চেয়ার নিয়ে এসে বলে,

– ‘সবকিছুই এখানে আছে দেখছি৷ রান্নাঘর, বিছানা, বাথরুম। কেউ থাকে না-কি?’

– ‘না, তবে দাঁতের চেম্বারে রুগীর খুব বেশি ভিড় লেগে থাকে না। এখানেই শুয়ে-বসে কাটাই। নিজে এটা-সেটা বানিয়ে খাই। গান শুনি। বই পড়ি। রুগী এলে যাই।’

– ‘ও আচ্ছা। এগুলো কি করছেন?’

– ‘ব্রেড স্টিকস।’

– ‘এটা আবার কী?’

– ‘খেলেই বুঝবেন। এবার পারলে আপনি বঁটি দিয়ে নিচ থেকে পেয়াজ, আদা, কাঁচা মরিচ, টমেটো কাটেন। পারবেন?’

– ‘হ্যাঁ পারবো।’

– ‘ম্যাকারনির জন্য তাই কুচি কুচি করে কাটবেন।’

– ‘জ্বি আচ্ছা।’

– ‘আপনি কাটাকুটি পারায় ভালোই হলো। প্রতিদিন এভাবে ভোরে এসে এখানে গোসল করবেন। তারপর দু’জনে নাস্তা বানাবো।’

মৃদুল বঁটি নিয়ে বসতে বসতে বললো,

– ‘আপনার সহকারী একজন আছে বলছিলেন।’

– ‘সে তো এখনও স্টুডেন্ট। কলেজ শেষে আসে। তার চাকরির কারণ হচ্ছে শেখা।’

– ‘ও আচ্ছা।’

– ‘আপনি তো গোসল করলেন সবেমাত্র, তেল লাগবে?’

– ‘হ্যাঁ, থাকলে চুলে দিতাম একটু।’

মানহা মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘নেই, কাল এনে রাখবো।’

– ‘আচ্ছা ঠিকাছে।’

– ‘কিন্তু আপনারা চুলে তেল দেন কেন বলুন তো। ছেলেদের কিন্তু তেল ছাড়া সিল্কি চুলে সুন্দর লাগে।’

– ‘তাই না-কি?’

– ‘হ্যাঁ, তেল দিলে কিরকম যেন হয়ে যায়। বাট তেল না দিলে আবার শেষে চুল লালচে হয়ে যাবে। চুল সজীবতা হারাবে।’

– ‘হ্যাঁ সেটাই, তেল না দিলে কেমন হয়ে যায়।’

দু’জন গল্প করতে করতে ব্রেড স্টিকস আর ম্যাকারনি বানিয়ে প্লেটে করে টি-টেবিলে এনে রাখে।

মৃদুল সোফায় বসলো। মানহা চেয়ার টেনে এনে সামনে চলে গেল। একটা স্টিক মুখে দিয়ে বললো,

– ‘এই রুমে থাকবেন আপনি?’

– ‘বুঝিনি।’

– ‘বলছি রাতে এখানে থাকতে পারবেন চাইলে।’

– ‘আমার তো থাকতে সমস্যা নেই।’

– ‘ঠিকাছে, আজ রাতে আমরা এখানেই ঘুমাবো।’

– ‘আমরা মানে?’

– ‘আপনি আর আমি।’

কথাটি শুনে মৃদুলের হাতের ব্রেড স্টিক ভেঙে পড়ে গেল টেবিলে।

—চলবে—

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here