বাঁক,৩০,৩১
জবরুল ইসলাম
(৩০ পর্ব )
ইরফান কিছু বলতে চেয়েও বললো না। ড্রাইভার আর আফতাব না থাকলে জরুরি কথাগুলো সেরে নিতো সে। হাত ঘড়ি দেখে বললো,
– ‘আজ তাহলে উঠি, আমারও কিছু কাজ আছে।’
মানহা আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘আমার মনে হয় আমাদের একান্তে একবার বসা দরকার।’
– ‘হ্যাঁ সেটাই, কাল যখন ইশি আসবে তখন আমাকে কল দিয়ো।’
– ‘আচ্ছা।’
মৃদুল বুঝতে পারে একান্তে বসে ওরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবে ইশি যেন পুলিশের কাছে ধরা দেয়। এ ব্যাপারে ইরফানকে হয়তো মানহাই আড়ালে বুঝিয়েছে।
তাকে আনমনা দেখে মানহা বললো,
– ‘আমরা উঠি না-কি? তাদের বিদায় দেই।’
– ‘হ্যাঁ।’
চা’র বিল চুকিয়ে দিয়ে সবাই উঠে দাঁড়ায়।
ইরফান বললো,
– ‘কাল তো আর দেখা হচ্ছে। তাহলে আমি এখন যাই।’
মানহা আর মৃদুল সম্মতি জানায়। ইশির মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। আজকের আনন্দের দিনটাও কেমন যেন বেদনার লাগছে। ইরফান ভাইয়ের সঙ্গে তো কাল দেখা হবে না৷ এই প্রতারণা কীভাবে করবে সে? মৃদুল ভাই কেন তাদের এতো অবিশ্বাস করছে?
ইরফানের প্রস্থানের পথে সে জল টলমল নয়নে তাকিয়ে রইল।
– ‘চল তোদের বিদায় দেই।’
মৃদুলের কথায় যেন ইশি চেতনা ফিরে পেল। আফতাব আর ড্রাইভার সিএনজিতে চলে গেছে। মৃদুল মা’কে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মানহা আর সে পাশাপাশি। নেহারা বেগম সিএনজিতে উঠে গেলেন।
ইশি মানহাকে বললো,
– ‘তুমি কোথায় থাকো? আর মৃদুল ভাই কোথায় যাবে?’
মানহা ফিক করে হেঁসে চারদিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললো,
– ‘আমরা একসাথে থাকি, কাল থেকে তোমরাও আমাদের সাথে থাকবে একই বাসায়।’
ইশি বিস্মিত নয়নে ভাইয়ের দিকে তাকায়। কিছু একটা বুঝতে পারে সে। পুনরায় মানহার দিকে তাকিয়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো সে।
– ‘আরে কাঁদছো কেন? কালই তো দেখা হচ্ছে, সিএনজিতে উঠো।’
ইশি চোখ মুছে উঠে মায়ের পাশে বসে। সিএনজি চলতে শুরু করে। মানহা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মৃদুলের হাত ধরে বললো,
– ‘কি এতো ভাবছো বলো তো?’
– ‘কিছু না।’
মানহা তার বাহুতে গাল চেপে ধরে বললো,
– ‘অনেক কাজ বাকি, চলো একটা রিকশা নিয়ে বাস স্টেশন যাই।’
– ‘কি কাজ বাকি?’
– ‘বাসে বসে বলা যাবে, এখন একটা রিকশা ডাকো।’
মৃদুল খানিক এগিয়ে এসে রিকশা পেল। একবার মাথায় এলো এখন যদি হুট করে মানহাকে রেখে সে চলে যায় সে? মানহা খুঁজে না পেয়ে কী করবে? ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে ভেতরটা দুমড়ে-মোচড়ে উঠলো তার। এভাবে সে পালাতে পারবে না। তবুও নিজেকে শক্ত করে পালাতে হবে। রিকশা ডেকে নিয়ে গেল সে। মানহা এসে পাশে বসল। চলতে চলতে অনেক বকবক করলো সে কিছুই মৃদুলের মাথায় ঢুকলো না। স্টেশনে এসে সঙ্গে সঙ্গেই বাস পেয়ে গেল তারা। মানহা জানালার পাশে বসে চোখবুজে। বড়ো ক্লান্ত লাগছে তার। মৃদুল আনমনা। মানহা হাই তুলে বললো,
– ‘ঘুম পাচ্ছে।’
– ‘ঘুমাও।’
– ‘তুমি আরেকটু আমার দিকে চেপে বসো।’
মৃদুল খানিকটা ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। মানহা কাঁধে মাথা রেখে বললো,
– ‘বাজারে একটা বাসা ভাড়া দিবে। দুইটা বেডরুম, একটা বাথরুম, কিচেন।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘জানো কত টাকা ভাড়া?’
– ‘কত?’
– ‘মাত্র পাঁচ হাজার। টাউনে হলে আরও বেশি হতো।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘দুই রুমে আমাদের হবে না? আমি আর তুমি এক রুমে। ইশি আর আন্টি এক রুমে।’
– ‘হবে।’
– ‘রোবটের মতো কথা বলছো কেন? তোমার কোনো আগ্রহই নাই দেখছি।’
– ‘এমনিই ভালো লাগছে না।’
– ‘কি এতো চিন্তা করছো বলো তো? এখন আর চিন্তার কিছু দেখছি না আমি। ইরফান আমি তোমার সাথে আছি। আন্টিও আছেন। আমরা প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী।’
– ‘ইশি পুলিশে ধরা দিক আমি চাই না মানহা।’
– ‘পাগল না-কি তুমি? এরকম তুমি শান্তিতে থাকতে পারবে না। তুমি ওর অপরাধ নিজের ঘাড়ে নিয়ে ফেরারির জীবন যাপন করার মানে হয় না। যেখানে ইশিও নির্দোষ।’
– ‘সে খুনি মানহা। নির্দোষ কীভাবে হবে?’
– ‘সেটা আদালত দেখবে মৃদুল। যেহেতু সে প্রাপ্তবয়স্ক ছিল না এবং আত্মরক্ষার জন্য খুন করেছে তাই ভালো লয়ার ধরে আমরা চেষ্টা করবো।’
– ‘যদি চেষ্টা করে ব্যর্থ হই বুঝতে পারছো কী হবে?’
– ‘কিন্তু চেষ্টা না করেও তো সমস্যা। এভাবে আর কত দিন? তোমার তো একটা ভবিষ্যৎ আছে। সুখ-শান্তিতে বাঁচার অধিকার আছে। তাছাড়া ইরফান আর আন্টি এখন তোমাদের পক্ষে আছে। সুতরাং দয়া করে তুমি এসব নিয়ে ভেবো না। আমি আর ইরফান আছি সবকিছু ঠিকঠাক হবে।’
মৃদুল আহত নয়নে খানিক্ষণ তাকিয়ে রইল।
মানহা পুনরায় তার হাতটা প্যাঁচিয়ে ধরে চোখবুজে। খানিক পরেই সে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। জলেস্বরী বাজারে যখন বাস এসে থেমেছে তখন আছরের আজান শোনা যাচ্ছে। মানহা ঘুমোচ্ছে। মৃদুল আস্তে আস্তে ডাক দিল মানহাকে। মানহার চোখে রাজ্যের ঘুম। চোখে মেলে তাকাতেই পারছে না।
– ‘উঠো, এসে গেছি৷’
মানহা কোনোভাবে তার সঙ্গে বাস থেকে নেমে এলো। শরীর যেন নিদ্রায় ভারী হয়ে আছে। মৃদুলের পিছু পিছু রাস্তা পেরিয়ে মামণি ফার্মেসির সামনে এলো। মামা তাদের দিকে কঠিন মুখে তাকিয়ে আছেন দেখেও ভ্রুক্ষেপ করল না মানহা। দু’দিন পরেই মৃদুলের সঙ্গে বিয়ে হবে। তাদের আলাদা সংসার হবে। এখন আর কাউকে ভয় পাওয়ার কিছু দেখছে না সে।
সিঁড়ি বেয়ে এলো উপরে। চাবি দিল মৃদুলের হাতে। দরজা খুলতেই হাই তুলতে তুলতে বেডরুমে গিয়ে বিছানায় লম্বা হয়ে পড়লো।
– ‘মৃদুল আমি ঘুমাচ্ছি, এতোদিন পর মানসিক চাপ মুক্ত হয়েছি। এখন যা ভাবছি তাই ভালো লাগছে। শান্তির একটা ঘুম দেই। এতো আরামের ঘুম অনেকদিন হলো আসেনি।’
‘আচ্ছা ঘুমাও’ বলে মৃদুল বাথরুমে গেল। মুখ-হাত ধুয়ে মোবাইল পকেট থেকে বের করে দেখে ফাতিহার অনেকগুলো কল। একটা মেসেজ ভিউ করে দেখলো পনেরশো টাকা বিকাশ এসেছে। ফাতিহা তাহলে ছেড়েছে। টাকাগুলো দিয়ে কি মানহার জন্যে কিছু কিনবে? পালিয়ে যাওয়ার পর তো টাকার দরকার হতে পারে। বাসে আজ মানহার কথা শুনে তার সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর সংশয় দূর হয়ে গেছে। এখান থেকে পালাতেই হবে। মানহা কোনোভাবেই চাইবে না সে খুনের অপরাধ ঘাড়ে নিয়ে অস্থিরতার অনিশ্চয়তার জীবন যাপন করুক।
ইশি আর মা’কে নিয়ে সোজা রূপগঞ্জ যেতে পারবে না। ফাতিহা ছাড়া সবাই জানে তার আপনজন বলতে কেউ নেই। তবুও এখান থেকে বের হয়ে ফাতিহার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে হবে তাদের ওখানে যাওয়া সম্ভব কি-না। না হলে ফাতিহাকেই চলে আসতে বলতে হবে। সবাই মিলে কোথাও গিয়ে নতুনভাবে সবকিছু শুরু করবে তারা। মৃদুল আলগোছে বাথরুম থেকে বের হয়। মানহা ঘুমোচ্ছে। এখনই বের হয়ে যেতে হবে তার। ইশিদের কাছে পৌঁছে সে মানহাকে মেসেজ দিয়ে বিস্তারিত বলে সিম চেঞ্জ করে নিবে। খানিক্ষণ তাকিয়ে রইল ঘুমন্ত মানহার দিকে। বুকটায় চিনচিনে এক ব্যথা হলো। বড়ো মায়া হচ্ছে ওর জন্য। তবুও নিজেকে শক্ত করে নেয়। সে বিবাহিত, তার উপর ইশির নিরাপত্তা প্রশ্ন। সুতরাং এসব মায়াকে পাত্তা দিলে চলবে না৷ নিজের ব্যাগটা বের করে সে কাঁধে নিয়ে চুপিচুপি বের হয়ে গেল রুম থেকে। তারপর আলগোছে দরজা খুলে বের হয়।
____চলবে____
বাঁক ( ৩১ পর্ব )
_____________
মৃদুল সিঁড়িতে সতর্কভাবে পা ফেলে নিচে ‘মামণি ফার্মেসি’র সামনে এলো। মানহার মামা তার দিকে তাকিয়ে আছেন। সে পিছু ফিরে একবারও না দেখে গেল রাস্তার অপর পাশে।
একটা বাসের হেল্পার ‘সিলেট সিলেট’ বলে ডাকছে। উঠে পড়লো সে বাসে। বসলো গিয়ে জানালার পাশে। এখান থেকে সোজা ‘মানহা ডেন্টাল কেয়ার’ দেখা যাচ্ছে। মৃদুল সেদিকে তাকিয়ে রইল। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। মানহার অসহায় মুখটা চোখের সামনে বারবার ভাসছে। সেও জানে তারজন্য কম করেনি মেয়েটা। নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছে। মা-বাবাহীন মেয়েটির একমাত্র আপনজন মামা-খালাদের থেকেও তারজন্য বঞ্চিত হয়েছে। কিন্তু কি করার আছে? সে বিবাহিত, ইশিরও ভবিষ্যতের প্রশ্ন। পুনরায় চোখের জল মুছে নিল। বাস ছেড়ে দিয়েছে। সে মোবাইল বের করে ইশিকে কল দিল। দু’বার রিং হতেই রিসিভ করলো সে।
– ‘হ্যালো ভাইয়া।’
– ‘হ্যাঁ ইশি, আমি বের হয়ে গেছি।’
– ‘মানে।’
– ‘আরে আমি লুকিয়ে বের হয়ে বাসে উঠেছি। মানহা বা ইরফান কল দিলে রিসিভ করবি না।’
– ‘বলো কি আজই বের হয়ে গেছো?’
– ‘হ্যাঁ, তুই আমাকে রিসিভ করবি কোত্থেকে?’
– ‘আচ্ছা আফতাব ভাইকে বন্দর পাঠাব।’
– ‘না তুইও সাথে আসবি৷ আমাদের সিম চেঞ্জ করে নিব।’
– ‘মোবাইলের সকল নাম্বার?’
– ‘আরে বোকা জরুরি নাম্বার সব লিখে ফেল কাগজে।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
মৃদুল তারপর কল দিল ফাতিহাকে। কয়েকবার কল গিয়ে কেটে এলো। খানিক পর ব্যাক করলো ফাতিহা নিজেই।
– ‘হ্যালো, টাকা গেছিল?’
– ‘হ আইছে।’
– ‘তুমি এমন কেন কও তো?’
– ‘কেন?’
– ‘বিকাশের দোকানে বইসা কল দিয়েছিলাম টাকা পাইছো কিনা জানতে।’
– ‘আরে ঝামেলায় আছিলাম তো।’
– ‘কি এতো ঝামেলা?’
– ‘মা আর ইশিকে পাইয়া গেছি।’
– ‘কি কও, সত্যি না-কি?’
– ‘হ, এবার শোনো, মা আর ইশিকে রূপগঞ্জ নিয়া আসা কি সম্ভব?’
– ‘ওমা তা কি করে হইবে। সকলেই তো জানে তোমার কেউ নাই। লোকে কইব এখন হুট কইরা মা বোন জুটলো কোথা থেকে।’
– ‘হ তাই ভাবতেছিলাম। আইচ্ছা তাইলে তুমি চলে আসতে পারবে না আমাদের কাছে।’
– ‘তা তো পারমু।’
– ‘আইচ্ছা তাইলে পরে তোমারে কল দিমু আমি। আর শোনো, এই নাম্বার চেঞ্জ কইরা ফেলমু আইজ।’
– ‘আমি নাম্বার পাইমু কীভাবে তাইলে?’
– ‘আমি নিজেই কল দিমুনে।’
– ‘আইচ্ছা ঠিক আছে।’
– ‘তাইলে রাখছি।’
মৃদুল ফোন রেখে জানালার বাইরে চোখ রাখে। মানহাকে কি মেসেজ দিবে মাথায় গুছিয়ে নিচ্ছে সে। বাস চলছে। মাঝে মাঝে তার ঘুমে চোখবুজে আসছে। সিলেট পৌঁছে গেল সন্ধ্যায়। বাস থেকে নেমে মোবাইল বের করে। মানহা বোধহয় এখনও ঘুমোচ্ছে৷ না হলে কল দিতো এতক্ষণে। সে হেঁটে হেঁটে বন্দর চলে গেল। ইশিদের কল দিয়ে গিয়ে বসলো আগের জায়গায়৷ রাতে ঝলমলে বাতিতে আরও সুন্দর লাগছে সবকিছু। চেয়ারে বসে চা দিতে বললো সে। বসতে হলে একটা কিছু তো খেতেই হবে। মানহাকে কি মেসেজ দেবে ভেবে পাচ্ছে না৷ তবুও বিয়ের বিষয়টি আড়াল রেখেই সে ছোট ছোট করে একের পর এক মেসেজ দিল। এরিমধ্য ইশি আর আফতাব চলে এলো। সে অবাক হয়ে বললো,
– ‘তোমরা এতো তাড়াতাড়ি আসলে কীভাবে?’
– ‘আমরা আগেই বের হয়ে গেছিলাম।’
– ‘ও আচ্ছা।’
মৃদুল তাদেরকেও চা দিতে বললো। খানিক পর ওয়েটার চা দিয়ে গেল।
ইশি আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘এখন আমরা কি করবো? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
মৃদুল চায়ে চুমুক দিয়ে আফতাবকে দেখিয়ে বললো,
– ‘উনি থাকলে সমস্যা হবে না?’
ইশি মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘না, উলটো উনি প্রয়োজনে আমাদের হেল্প করবেন।’
– ‘ও আচ্ছা, তাহলে শোনো, আমরা এখন গিয়ে নতুন সিম কিনবো। তুমি ইরফানকে মেসেজ দিয়ে সিম খুলে ফেলো।’
– ‘কি বলবো?’
– ‘বলো আমাদের জন্য চিন্তা না করতে। আমরা ইচ্ছা করেই দূরে সরে যাছি। তারা যেন খোঁজাখুজি করে অযথা হয়রান না হয়।’
ইশি মেসেজ দিয়ে সিম খুলে ভ্যানিটিব্যাগে রেখে দিল। মৃদুলও তার সিম বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
– ‘তোর ব্যাগে রেখে দে।’
তারা চা বিল চুকিয়ে উঠে গেল নতুন সিম কিনতে। মৃদুলের বুকটায় মানহার জন্য এক চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে৷ ইশির বারবার মনে হচ্ছে ‘আহারে ইরফান ভাই আমাদের জন্য কত কষ্ট করলো।’
অনেক্ষণ থেকে মোবাইলে রিং হচ্ছে। মোবাইল ভ্যানিটিব্যাগে, উঠে গিয়ে রিসিভ করতে মানহার ইচ্ছা করছে না। চোখবুজে আছে সে। কিন্তু একের পর এক কল দিচ্ছে কে? মানহা বিছানায় উঠে বসে হাই তুলে শরীর মুড়িয়ে আঙুল ফুটিয়ে সোফার দিকে গেল। ব্যাগ থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে ইরফান কল দিয়েছে। এতো কল দেয়ার কারণ সে বুঝতে পারছে না। অবাক হয়ে ব্যাক করল। রিং হওয়ার সাথে সাথেই রিসিভ হয়। ইরফানের অস্থির গলা শোনা গেল,
– ‘মানহা কল রিসিভ করছো না কেন? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
– ‘আরে এতো অস্থির হচ্ছ কেন? কি সমস্যা? কেন কল দিচ্ছ।’
– ‘মৃদুল ভাই কোথায়?’
মানহা মোবাইলে তাকিয়ে দেখে রাত আটটা বাজে। তাহলে সে অনেক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল। সুতরাং মৃদুল হয়তো বোর হয়ে কোথাও গেছে৷
– ‘কেন বলো তো? সে তো এখানে নেই, কল দিয়ে দেখি।’
– ‘মানহা আমি তাকে কল দিয়েছি মোবাইল বন্ধ।’
– ‘বন্ধ থাকার তো কথা না, আসুক জিজ্ঞেস করবো কি হয়েছে।’
– ‘তুমি বুঝতে পারছো না মানহা, ইশিরও মোবাইল বন্ধ।’
– ‘ওয়েট, ওয়েট, তুমি কি বলতে চাচ্ছ বুঝিয়ে বলো তো। আমি ঘুম থেকে উঠেছি, তোমার কথা কিছুই মাথায় ঢুকছে না।’
– ‘মানহা ওরা পালিয়েছে আবার।’
– ‘মানে?’
– ‘ওরা সবাই আমাদের থেকে পালিয়েছে।’
– ‘হোয়াট! ওরা আমাদের থেকে পালাবে কেন? আমরা তাদের কি করেছি? তোমার মাথা ঠিক আছে? আমরা তো ওদের হেল্প করছি।’
– ‘মানহা আমি ঠিক আছি। ওরা মূর্খ, বোকা, গর্দভ। এরা নিজের ভালোটাই বুঝতে পারেনি। নিজের ক্ষতি নিজেই করছে।’
– ‘কিন্তু তুমি কীভাবে জানলে ওরা পালিয়েছে।’
– ‘ইশি আমাকে মেসেজ দিয়ে ফোন বন্ধ করেছে।’
মানহার মাথা ভনভন করছে। ফোন কানে লাগেই রান্নাঘর, বাথরুম, বেলকনি দেখে এসে সোফায় বসে পড়লো। শরীর ঘেমে গেছে। ইরফান ওপাশ থেকে কথা বলেই যাচ্ছে৷ মানহা আস্তে করে বললো ‘এখন রাখো তো ভাই, পরে কল দিচ্ছি।’
মোবাইল স্ক্রিনে চোখ যেতেই মৃদুলের মেসেজ দেখে ভিউ করে। একেক করে মেসেজ পড়তে থাকে সে। শরীর কাঁপছে। পৃথিবীও কি দুলছে খুব? কান দিয়ে যেন গরম ভাপ বেরুচ্ছে। মানহা মৃদুলের ফোনে কল দিয়ে দেখে বন্ধ। মোবাইলটা রেখে চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়। বেলকনিতে গিয়ে খানিক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর সোজা বাথরুমে ঢুকে। শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছে। মৃদুল তাকে এটুকু বিশ্বাস আর ভরসা করতে পারেনি। সে তো ভালোর জন্যই বলেছিল ইশি পুলিশের কাছে ধরা দিতে। যেহেতু তাদের কাছে সাক্ষী প্রমাণ সব আছে। তাও যদি সে না চায় বুঝিয়ে বলে দেখতে পারতো। তা না করে এভাবে পালিয়ে গেল কেন? মানহা দুই হাতে মুখ ঢেকে বোবা কান্নায় কেঁপে উঠলো।
মৃদুল খেয়া থেকে নেমে বললো,
– ‘ইশিকে খুঁজে এদিকেই আমরা গিয়েছিলাম।’
আফতাব সম্মতি জানিয়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ ভাই, আলেয়া বেগমের বাড়ি এদিকেই যেতে হয়।’
মোবাইলের বাতি জ্বালিয়ে তারা গল্প করে করে হাঁটছে। মৃদুল যাচ্ছে ইশি আর আফতাবের পিছু পিছু৷ মোড়ের চা দোকানের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা দিয়ে ঢুকলো তারা। সামনে যেতেই দৃশ্যমান হলো ঝলমলে একটা বিশাল বাড়ি। আফতাব গেইটের সামনে যেতেই দারোয়ান খুলে দিল৷ ভেতরে ঢুকে মৃদুল অবাক হয়ে আফতাবকে বললো,
– ‘ভাড়া বাসায় থাকেন মনে হয়। তার উপর আমরাও এলাম।’
আফতাব হেঁসে বললো,
– ‘না, এই বাসা এখন আমারই বলতে পারেন। আপনারা যতদিন ইচ্ছা থাকতে পারবেন।’
– ‘এখন আপনারই বাসা মানে বুঝলাম না কথা।’
– ‘ভেতরে গিয়ে বসে বলছি চলুন।’
মৃদুল তাকিয়ে দেখে তিনতলা বাড়ি। জানালগুলোতে বাতি জ্বলছে। আফতাব ক্যাসি গেইট টান দিয়ে খুলে বারান্দা পেরিয়ে বাঁ দিকে গিয়ে দরজা খুলে ভেতরে গেল। ইশির পেছনে মৃদুলও ভেতরে গিয়ে চারদিকে তাকায়। মেঝেতে কার্পেট, দামি আসবাবপত্র, সুন্দর বিছানা। আফতাব বাথরুমে গেল। ইশি তাকে বললো,
– ‘আম্মু ওই রুমে আছে চলো।’
ইশি করিডর ধরে হাঁটছে৷ পেছনে যাচ্ছে সে। প্রথমে বাথরুম, তারপর কিচেন, এরপর দেখে আরেকটা বেডরুম। সেখানে নেহারা বেগম ঘুমিয়ে আছেন।
– ‘ডাকবো?’
– ‘না ঘুমাচ্ছেন যখন ডাকার দরকার নাই, চলো সামনের রুমেই বসি গিয়ে।’
তারা দু’জন সামনের রুমের সোফায় এসে বসে। আফতাব বাথরুম থেকে বের হয়ে এসে ইশিকে বললো,
– ‘খালা তো রান্নাবান্না করে চলে গেছে। তুমি একটু ভাইয়াকে নাশতা বানিয়ে দিতে পারবে না? নুডলস আছে দেখো।’
– ‘হ্যাঁ, পারবো যাচ্ছি আমি।’
ইশি চলে গেল। আফতাব মৃদুলকে বললো,
– ‘আপনি বাসার কথা বলেছিলেন। আসলে এটা আমার মামার বাসা। ওরা সবাই আমেরিকা থাকেন। আমি লোকদের ভাড়া দেই৷ দেখাশোনা সবকিছু করি এই আরকি।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘তা কি করতে চাচ্ছেন আপনি?’
– ‘কিসের কথা বলছেন?’
– ‘এইযে হুট করে সিম চেঞ্জ করলেন। আগের জায়গা থেকে চলে এলেন। এখন কি করবেন।’
– ‘আগের জায়গা থেকে এসেছি তা ঠিক না। আমি থাকতাম শ্বশুড়বাড়ি। কিন্তু সেখানে ইশি আর মা’কে নিয়ে যেতে পারবো না।’
– ‘আপনি বিয়ে করেছেন? ইশি তো জানে না মনে হয়।’
– ‘হ্যাঁ জানে না ওরা।’
– ‘ইশি আর আন্টি এখানেই যদি থাকেন আপনি যেতে পারবেন আগের জায়গায়?’
– ‘এখানে ওরা কীভাবে থাকবে? আপনি এমনিতেই অনেক করেছেন।’
– ‘সেটা সমস্যা হবে না। আপনি চাইলে ওদের রেখে যেতে পারেন। মাঝে মাঝে এসে দেখলেন।’
– ‘এটা কীভাবে সম্ভব?’
আফতাব আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘ইশিকে ধরুন বিয়ে দিয়ে দিছেন, ওর সঙ্গে আন্টি থাকেন।’
– ‘মানে?’
– ‘ওর জন্য না হয় আমি পাত্র দেখলাম৷ তারপর আপনাকে জানাবো৷ এখান থেকেই বিয়ে হল সমস্যা কী?’
মৃদুল ওর কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছ না৷ তবে ভাবছে এরা এখানে আপাতত থাকলে খারাপ হয় না। সে রূপগঞ্জ চলে যাবে। আবার কোনো সমস্যা দেখলে এখানে এসে থাকতে পারবে। নতুন কোনো কাজও না হয় দেখবে। আপাতত তারা এখানে থাকুক। তার ধারণা ছেলেটি ইশিকে বিয়ে করতে চাচ্ছে। ইশিও রাজি থাকলে তার কোনো সমস্যা নেই।
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর তারা সবাই অনেক গল্পগুজব করলো। ইশি আর মৃদুল নানান বিষয়ে কথা বললো। একে অন্যের এতদিনের সবকিছু জানলো। ইশি ভাবীকে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলো। তারপর আফতাব পরামর্শ দেয় মৃদুল ফাতিহাকে নিয়ে কয়েকদিনের জন্য এখানে বেড়াতে আসুক। মৃদুলও সম্মতি জানায়। মায়ের সঙ্গে ফাতিহাকে দেখা করানো দরকার।
পরেরদিন মৃদুল রূপগঞ্জ যাবার জন্য এখান থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়। কিন্তু সে ফাতিহার কাছে আর যেতে পারেনি। রূপগঞ্জ যাবার পথেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায়
_____চলবে____