#শেষের_পঙক্তি,পর্ব_২৩
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
উৎসব মুখর পরিবেশে আচ্ছাদিত বিয়ের ভেন্যু। তিন পরিবারের আত্নীয় স্বজনরা সব জড়ো হয়েছে। স্টেজে হলুদের সাঁজে সজ্জিত দুই কনে। হরেক রকমের আলোকসজ্জাতে দুই কনেকে অগনিত পুষ্পের মাঝে পরিস্ফুটিত পুষ্পের ন্যায় লাগছে। কাঁচা ফুলের গহনাতে পুষ্পরাণী উপাধি দিলে মন্দ হবে না। কনেদের মুখে লেগে আছে লাজুক হাসি। বিপরীত স্টেজে দুই বর বসে আছে। তাদের নজর আটকে আছে তাদের পুষ্পরাণীদের দিকে। মিহাল ফাইজাদের ইশারাতে তূরের সাথে একান্তে কথা বলিয়ে দিতে রিকুয়েস্ট করেছে কিন্তু ফাইজা ও লিরা মুখ ভেঙচি দিয়ে চলে গেছে। মিহাল ওদের ব্যাবহারে বে’ক্ক’ল বনে গেল।
মিহাল এবার অর্ক ও রাফিকে ডেকে বলে,
–একটু কথা বলার জন্য স্পেস করে দে না। পাঁচ মিনিট শুধু। কিছু কর। ডাক্তার ইফতিও নীরার সাথে কথা বলবে। কিছু ব্যাবস্থা কর। ফাইজা, লিরা ওদের বলেছিলাম। একেকটা ভাবের জন্য পাত্তাই দিলো না।
রাফি বাঁকা হেসে বলে,
–ব্রো! আমিও কনেপক্ষ। এমনি এমনি তো কথা বলার ব্যাবস্থা করবো না।
মিহাল ও ইফতি একে অপরের দিকে তাকিয়ে সেন্টি ইমোজির মতো হাসি দেয়। তারপর অসহায় কন্ঠে মিহাল জিজ্ঞাসা করে,
–কী করতে হবে?
অর্ক অতি উৎসাহী হয়ে বলল,
–সিঙ্গেল লাইফে কোনো রমনির আগমন করিয়ে বাধিত করেন দুলাভাইইই!
মিহাল ও ইফতি ভ্রঁ কুঁচকে তাকায় অর্কর দিকে। অর্ক ক্যাবলা মার্কা হাসি দিয়ে বলে,
–ইয়ে না মানে! যদি আপনাদের কোনো কাজিন থাকে। আপনারা আমাদের দুলাভাই লাগেন। এটা আপনাদের নৈতিক দায়িত্ব যে অবিবাহিত সিঙ্গেল শ্যালকদের মি’ঙ্গেল করানো।
ইফতি নিজের সোফায় গা এলিয়ে বলে,
–আমার কোনো আনম্যারিড কাজিন সিস্টার নেই। সো এসব তোমাদের বন্ধু প্লাস বড় দুলাভাইকে বলো।
অর্ক ইফতির কথা শুনে আশাহত হয়ে ছ্যা’কা’খো’র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বেদনাতুর কন্ঠে মিহালকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–দোস্ত তুই অন্তত আমার মতো অবলা বন্ধুকে ছ্যাকা দিস না। উপস দুলাভাই। পিলিজ! আপনার কি এই অসহায় শ্যালকদের প্রতি মায়াদয়া হয় না?
মিহাল বাঁকা দৃষ্টিতে তাকায় অতঃপর বলে,
–একটা কাজিন সিস্টার আছে কিছুটা বড়। আর বাকি যারা বড় ছিল সবগুলার আ’ণ্ডা’বা-চ্চাও আছে। আর গুরাগারি যা আছে সব ১৪ এর নিচে। তোর মতো ২৪ বছরের বু’ড়া নিশ্চই নিজের থেকে দশ বছরেরও বেশি ছোট বাচ্চার সাথে প্রেম করবে না!
অর্ক মুখ ফুলিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয় তাকে বু’ড়া বলাতে। রাফি হাসতে হাসতে ইফতির উপর পরে যেতে নিয়েও সামলে নিয়েছে। ইফতিও মুখ টিপে হাসছে। তখন সেখানে আসফি, তাইজুল, তাওহীদ, রণক, রিজভী ও শাফকাত এসে পৌঁছায়। শাফকাত জিজ্ঞাসা করে,
–এতো হাসছো কেনো রাফি? আর অর্ক এমন মুখ ফুলালো কেনো?
অর্ক শাফকাতের দিকে তেড়ে গিয়ে বলে,
–আপনি তো কথাই বলবেন না। আপনার চৌদ্দকুলে কোনো অবিবাহিত বিবাহ উপযোগ্য বোনই নাই। আমার বান্ধুবীগুলা আপনাদের মতো জামাই কেন বিয়ে করে? যারা সিঙ্গেল শ্যালকদের মিঙ্গেল করতে পারে না! আমি, তাওহীদ, আসফি, রিজভী কি সিঙ্গেল থেকে যাবো আজীবন?
মিহাল অর্ককে একটু রাগাতে বলে,
–একটা কাজিন সিস্টার কিছুটা বড় আছে। ১৭ বছর সেটার। কিন্তু তাও তো তোর থোকে সাত সাতটা বছরের ছোট! জাতি কী এই অসম মিলন মেনে নিবে! তুই তো আগে বলতি তোর বউ তোর থেকে পাঁচ বছরের বেশি ছোট হতে পারবে না।
অর্কর মন খুশিতে নেচে উঠলো। সে মিহালকে হুট করে জড়িয়ে ধরে বলে,
–আগের কথা ভুলে যাও বন্ধু। সাত আর পাঁচ কাছাকাছিই। আর নয়-দশ বেশি ডিফারেন্স হলেও সাত ঠিকই আছে। তোর ওই বোনই আমার বউ হবে!
শাফকাত কথার মাঝে বলে,
–আমার ও নাদিয়ার বয়সের ডিফরেন্স আট বছর। কিন্তু সে মাঝে মাঝে রেগে গেলে আমার মনে হয় সেই আমার থেকে বড়!
তাওহীদ শাফকাতের কাঁধে হাত রেখে বলে,
–আপনার কপাল ভালো যে এক বছর সংসার করেও আপনি অক্ষত আছেন। নেহাত নাদু আপনাকে অসম্ভব ভালোবাসে। নাহলে কবেই আমাদের বান্ধুবীর ধা’রা’লো নখের খা-ম-চি ও পাতলা হাতের কি-ল ও থা*প্প-ড় খেয়ে নিজের ৩১ বছরের জীবনটা বিসর্জন দিয়ে দিতেন। আমরা প্রচুর খা’ই’ছি এসব।
শাফকাত মলিন দৃষ্টিতে তাকায়। মিহাল ওদের খেঁজুরে আলাপ দেখে উতলা হয়ে বলেই ফেলে,
–এবার দয়া করে কিছু ব্যাবস্থা করেন ভাইয়েরা আমার।
বাকিরা যারা বিষয়টার সম্পর্কে অবগত ছিল না তাদেরকে বলা হয় সবটা। রাফি কিছু একটা প্ল্যান করে খাবারের টেবিল থেকে ফিরনির বাটি নিয়ে স্টেজের দিকে যায়। এরপর তূরের পাশে দাঁড়িয়ে হো’চট খাওয়ার ভান করে তূর ও নীরার শাড়িতে ফিরনি ফেলে দেয়। তূর ও নীরা হতবাক হয়ে রাফির দিকে মুখ হা করে তাকায়। নাদিয়া ও ফাইজা রাফির দিকে তেড়ে এসে বলে,
–কী করলি তুই এটা। ব-ল*দ জানি কোথাকার! নষ্ট করে দিলি তো শাড়িটা।
রাফি অনুতপ্ত হওয়ার ভান করে বলে,
–সরিরে। বুঝতো পারি নি। জলদি করে পরিষ্কার করে নে। ওয়াশরুমে যা জলদি।
জারিন ও নাদিয়া তূর ও নীরাকে ওয়াশরুমের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। রাফি ইশারা করে মিহালদের দিকে। আর আসফিকে ইশারা করে সকেট বোর্ডের কাছে যেতে। ওদিকে অর্ক মিহালের কাছ থেকে মিহালের কাজিন সিস্টারের খোঁজ নিয়ে ভাব জমাতে কাজিন সিস্টারের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে।
নাদিয়া ও জারিন তূর ও নীরাকে ওয়াশরুমের কাছে নিয়ে যেতেই হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে যায়। সবাই চিল্লাপাল্লা শুরু করে দেয়। কেউ কেউ মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট অন করছে। নাদিয়ারা কেউ সাথে করে মোবাইল আনে নি। তাই তূর ও নীরাকে নিয়ে যেখানে দাঁড়ানো সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।
এদিকে ইফতি ও মিহাল ফ্ল্যাশলাইট অন করে ওদের দিকে যাচ্ছে। ইফতি মিহালকে বলে,
–ওরা চিৎকার করবে নাতো? চিৎকার করলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
মিহাল ইফতিকে ভরসা দিয়ে বলে,
–আপনার রুমাল আছে না? আপনি তো ডাক্তার। সাথে একটা ক্লো’রোফর্ম স্প্রে থাকলে টেনশনই করতে হতো না। এখন রুমাল দিয়ে পেছোন থেকে মুখ চেপে ধরে কানের কাছে আস্তে করে নিজের নাম বলবেন। চিৎকার করবে কিনা তা আমার আইডিয়া নাই। কখনও এরকম করতে হয় নি তো।
ইফতি ও মিহাল তূর ও নীরার পেছোনে এসে দাঁড়িয়েছে। তূর হলুদ শাড়ি পরেছে আর নীরা বাসন্তী রঙের। কিন্তু মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় কোনটা কোন রঙ বোঝা যাচ্ছে না। ওরা দুজনে সন্দিহান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হুট করে ইফতি কী করলো! সে যেকোনো একজনকে কাঁধে হাত দিয়ে আস্তে করে ডাক দিলো। তাও ডাক দিয়েছে তূরকে। তূর আচমকা কাঁধে কেউ হাত দেওয়াতে ভয়ে ভ্যাবাচেকা খেয়ে পেছোনে ঘোরে। ইফতি নিজের ফোনের ফ্ল্যাশলাইট উপরের দিকে দিয়ে রেখেছে যাতে আবছা হলেও ওরা বুঝতে পারে কে ডেকেছে। তূর ইফতি ও তার পাশে মিহালকে দেখে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে। ইফতি ক্যাবলা হাসি দিয়ে বলে,
–আসলে আপু, নীরাকে একটু ডাক দিন প্লিজ আর আপনি মিহাল ভাইয়ের সাথে যান। সরি আপু।
তূর সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায় মিহালের দিকে আর মিহাল দাঁত কে-লি’য়ে হাসছে। নীরাকে তূর ডাক দিয়ে দেয়। এদিকে জারিন ও নাদিয়া কিছুটা সামনে এগিয়ে পরিচিত কাউকে আবছা আলোতে খোঁজার চেষ্টা করছে। মিহাল তূরকে ও ইফতি নীরাকে নিয়ে যায়। দুই জুটি টেরেসের দুই দিকে যায়। ইফতি নীরাকে বলে,
–সকাল থেকে তোমাকে কতোবার ফোন করেছি। একবারও ধরলে না। কেনো?
নীরা অস্বস্থি ও লাজুক স্বরে আমতা আমতা করে বলে,
–না মানে আসলে, আমার ফোনটা কই ছিলো জানতাম না।
ইফতি ফোনের স্বল্প আলোতে দেখতে পাচ্ছে নীরার কাঁচুমাচু করা মুখশ্রী। ইফতি গম্ভীর স্বরে বলে,
–মিথ্যা বলছো তুমি।
নীরা চুপ করে থাকে। ইফতি নরম কন্ঠে বলে,
–তোমার অস্বস্থি হচ্ছিলো? ইটস অকে। কালকে অস্বস্থি হলেও আমার সাথেই থাকতে হবে কিন্তু!
ইফতি বাঁকা হাসে। নীরা লজ্জায় নুইয়ে পরে। ওদিকে মিহাল তূরকে বলে,
–জানো কতো কসরত করতে হয়েছে তোমার বন্ধুগুলাকে কনভেন্স করতে? তোমার পক্ষে গিয়ে ওরা আমাকে থ্রে’ট দেওয়া শুরু করেছে।
তূর মিহালের সামনে দাঁড়িয়ে লজ্জায় জড়োসড়ো অবস্থা। একটু আগেও তূরের লজ্জা লাগছিল না কিন্তু হুট করে যেনো লজ্জারা ঝেঁকে বসেছে ওর উপর। তূরকে চুপ করে থাকতে দেখে মিহাল ভাবুক কন্ঠে বলে,
–কী হলো? কিছু বলো?
তূর তাও চুপ। মিহাল এবার তূরের বাহুতে আলতো স্পর্শ করলে তূরের শরীর কেঁপে উঠে। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। মিহাল কিছুটা বুঝতে পেরে বলে,
–আর ইউ ফিলিং সাই? প্লিজ ডোন্ট বি সাই। তাহলে আমারও লজ্জা করে। দুজনে লজ্জা পেলে আমাদের নাতি-নাতনি কিভাবে ডাউনলোড হবে!
তূর এরকম কথা শুনতে প্রস্তুত ছিল না। তূরের হাসি এসে পরে। হাসতে হাসতে ছাদের মেঝেতে বসে পরেছে। মিহাল ভ্রুঁ কুঁচকে নাক ফুলিয়ে তূরের হাসি দেখছে। মিহাল এবার বলে,
–তোমার লজ্জারা বড়োই চালাক। হুট করে আসে আবার হুট করে চলে যায়।
সিঁড়ির কাছ থেকে কয়েকজনের গলার আওয়াজ আসছে। তূর ও নীরা দুজনেই তটস্থ হয়ে মিহাল ও ইফতিকে লুকাতে বলে। মিহাল ও ইফতি প্রথমে না বুঝলেও যখন কন্ঠস্বর গুলো আরেকটু পরিষ্কার হলো তখন লুকাতে যায় আর নীরা তূরের কাছে আসে। নাদিয়া, জারিন ও আসফি এসেছে টেরেসে। জারিন এসে বলে,
–তোরা এখানে কেনো এসেছিস? বিয়ের কনেদের রাতবিরেতে একা আসা ঠিক না। তাও এখন সন্ধ্যা ৭.৩০টা। নিচে চল।
তূররা নিচে চলে গেলে আসফি মিহাল ও ইফতিকে ডাক দিয়ে নিয়ে যায়।
হলুদের সব কার্যকর্ম জলদি শেষ হয়। রাত ১০টার আগে অনুষ্ঠান শেষ করার তাড়া ছিল কারণ কমিউনিটি সেন্টারটা শুধু হলুদের জন্য বরাদ্দকৃত ছিল। বিয়ের অনুষ্ঠান অন্য জায়গায় হবে। বর ও কনেদের ফটোশেসন শেষ হতে সময় লাগে কিছুটা।
_____অনুষ্ঠানের পর বাড়ি ফিরে তূর ও নীরা শাওয়ার নিয়ে ক্লান্তিতে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। নাদিয়া ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে তূরের মুখের উপর তোয়ালে ছুঁড়ে বলে,
–মাত্র এটুকুতেই তুই হাঁপিয়ে গেছিস? তাহলে কালকে তো তোকে খুঁজেই পাওয়া যাবে না। ভারী শাড়ি ও গহনা পড়ে তো তুই চিৎপটাং হয়ে যাবি রে।
ফাইজা টিটকারি করে বলে,
–তাহলে তোকে যেমন জিজু কোলে করে গাড়িতে তুলেছিল অসুস্থ হয়ে যাওয়াতে তেমনি তূরকেও মিহাল কোলে তুলবে।
নাদিয়া চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। জারিন হাসতে হাসতে বলে,
–নাদু বেবি তো নাচতে নাচতে কাহিল হয়ে গেছিলো। নিজের বিয়েতে না নাচলে কী চলে! তাই না নাদু বেবি?
নাদিয়া জারিনকে রাগী লুক দিয়ে বলে,
–দাঁড়া তুই। তোর একদিন কি আমার একদিন!
ওরা দুজন চরকির মতো পুরো রুমে বিছানা-ফ্লোরে দৌঁড়ে চলেছে।
তূররা ওদের অবস্থা দেখে হাসতে থাকে তূরের ফোনে টেক্সট আসে। তাতে লেখা,
“এই লাজুকলতা! এতো হাসি কোথায় পেলে বলোতো? আমি একটু তোমার সাথে মন খুলে কথাও বলতে পারলাম না। থাক সেসব। কালকে ভাবছি, জোৎসনা আনবো তোমার শিয়রে! তারপর মুগ্ধ নয়নে অপলক দেখবো তোমায়।”
তূরের গাল দুটোতে ঈষৎ রক্তিম আভা ফুটে উঠে। চোখ বন্ধ করে ফোনটা বুকে চেপে ধরে মুচকি হাসে।
চলবে ইন শা আল্লাহ্,