#প্রমত্ত_হৃদয়-০৬
#লেখনীতে:সারা মেহেক
রাতের মেঘমুক্ত অন্তরিক্ষে মিটিমিটি তারকারাজি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের ন্যায় বিরাজ করছে। যেনো কালো চাদর স্বরূপ আকাশটি কেউ মণিমুক্তাদি দিয়ে ভরাট করে দিয়েছি। আর পৃথিবীবাসী সেই মণিমুক্তাদির সৌন্দর্য দু নয়ন দিয়ে উপভোগ করছে। ভেনিসে রাতের তাপমাত্রা দিনের তাপমাত্রার চেয়ে তুলনামূলক কম থাকে। ফলে দিনে তেমন হিম শীতল পরিবেশ বিরাজ না করলেও রাতে সর্বদিকে হিম অনল প্রবাহিত হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় যেনো এই হাওয়া সমস্ত শরীরে কাঁটা দিয়ে দেয়।
রাগীব গেস্ট হাউজের আলো নিভিয়ে ব্যাক ইয়ার্ডের সবুজ লনে বসে আছে। ব্যাক ইয়ার্ডের এ অংশে সাবিহাদের বাড়ির কোনো আলো আসছে না। সর্বোপরি চতুর্দিকে চন্দ্রিমাহীন আঁধারে ঘেরা দারুণ এক পরিবেশ তৈরী হয়েছে। রাগীব দু হাঁটু ভাঁজ করে হাতে ফোন নিয়ে বসে আছে। ফোনের স্ক্রিনে উজ্জ্বলমান সাবিহার হাস্যজ্জ্বল একটি ছবি। ছবিটি গত বছরের বসন্ত আগমনের ছবি। সাবিহা ও তার কয়েকজন ফ্রেন্ড গত বছরের বসন্তে চেরি ব্লোসমের একটি পার্কে গিয়েছিলো। সেদিন সাবিহা চেরি ব্লোসমের ন্যায় হালকা গোলাপি রঙের একটি টপস ও সাদা রঙের উলের তৈরী একটি সোয়েটার পরেছিলো। এ যেনো চেরি ব্লোসমে মুখোরিত পরিবেশে ধরণীতে মনু্ষ্যরূপী আরেক চেরি ব্লোসম। ভীষণ মিষ্টি দেখাচ্ছিলো তাকে। সেদিন তাদেরই ফ্রেন্ড সার্কেলের একটি গ্রুপ ছবি হতে পরে কাটছাঁট করে সাবিহার ছবিটি সযত্নে নিজের কাছে রেখেছিলো রাগীব৷ আজও সাবিহার সে মিষ্টিমাখা স্নিগ্ধ রূপে রাগীব পথহারা হয়। ক্ষণিকের জন্য জগত ভুলে তার স্নিগ্ধময়ীতে মত্ত হয় সে। হৃদয়টা ক্ষণিকের জন্য প্রমত্ততায় ডুবে দেয় সে।
” আপনি এতো সুন্দর গান গাইতে পারেন কি করে?”
আচমকা পেছন হতে সাবিহার কণ্ঠ শুনে ভড়কে গেলো রাগীব৷ তড়িঘড়ি করে ফোনের স্ক্রিন অফ করে পকেটে পুরে রাখলো। অতঃপর নিমিষের মাঝেই মুখশ্রীতে স্বাভাবিক রূপ ধারণ করে পেছন ফিরে চাইলো সে। তবে চতুর্দিক আঁধারিয়া পরিবেশ বিরাজ করায় সাবিহার চেহারা স্পষ্টরূপে দর্শনের সুযোগ পেলো না সে। স্মিতহাস্যে সাবিহাকে চেনার ভান করে বললো,
” সাবিহা? আপনিই এসেছেন না অন্য কেউ?”
রাগীবের প্রশ্নে সাবিহা মৃদু শব্দে হেসে উঠলো। অতঃপর অনুমতিবিহীন রাগীবের সম্মুখপানে বসে বললো,
” ইয়েস আই এম এণ্ড সরি ফর নট টেকিং দা পারমিশন। ”
রাগীব মুহূর্তেই বললো,
” এতো ফর্মালিটি করার প্রয়োজন নেই। আফটার অল ইটস ইউর হাউজ ম্যাডাম। ”
সাবিহা সশব্দে হেসে উঠলো। তার এ হাসি মিষ্টি সুরের ন্যায় রাগীবের কানে ঝংকার তুললো। আহা! কি দারুন হাসি তার স্নিগ্ধময়ীর! আচ্ছা, এ হাসি কি সবসময়ের জন্য শ্রুতিগোচর করা যায় না? বা কোথাও ধারণ করে রাখা যায় না? যেনো সময়ে অসময়ে নিঃসঙ্গতাকে আশ্রয় করে এ মিষ্টি হাসির ঝংকার শোনা যায়?
ক্ষণিক বাদে সাবিহা খানিক ইতস্ততার সহিত জিজ্ঞেস করলো,
” আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না যে?”
রাগীবের ঠিক মনে পড়লো না, সাবিহা তাকে কি প্রশ্ন করেছিলো। সে প্রশ্নাতুরে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” কোন প্রশ্নের জবাব?”
” এই যে, আপনি এতো ভালো গান গাইতে পারেন কি করে?”
সাবিহার প্রশ্নে রাগীব মৃদু শব্দে হাসলো। বললো,
” এতোটাও ভালো গাইতে পারি না আমি৷ টুকটাক মাঝেমধ্যে গান গাওয়া হয়। ”
” আমাকে একটা গান গেয়ে শুনাবেন?”
সাবিহার এহেন আবদারে রাগীব হকচকালো। বিমূঢ় এ পরিস্থিতিতে পড়ে বললো,
” আপনার এ আবদার রাখা যে বড়ই কঠিন আমার জন্য। ”
রাগীবের কথায় সাবিহার মনটা খারাপ হয়ে এলো। সে ভঙ্গুর মনে বললো,
” কেনো? কি এমন কঠিন আবদার করে ফেললাম আমি?”
রাগীব স্মিত হেসে অনুরাগ মিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
” এই যে গান গাওয়া। আমি হাতেগোনা কয়েকটা গান গাইতে পারি৷ আসলে আমি গান গাইতে কম শুনতে বেশি পছন্দ করি। মাঝে মাঝে যখন মনটা খুব ভালো থাকে, তীব্র ইচ্ছা থাকে, তখনই গান গাওয়া হয়৷ ”
” কেমন গান শুনতে পছন্দ করেন আপনি?”
” সব ধরণের গানই৷ বিশেষ করে ক্লাসিকাল গান বেশি শোনা হয়। মাঝে মাঝে শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে গ্রামোফোন চালিয়ে গান শুনতে থাকি। ”
‘গ্রামোফোন’ শব্দটি কর্ণপাত হতেই সাবিহা নড়েচড়ে বসলো। ভীষণ আগ্রহের সহিত আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বললো,
” আপনার কাছে গ্রামোফোনও আছে! বেশ তো! আমাকে দেখাতে পারবেন?”
সাবিহার চরম আগ্রহ দেখে রাগীব ভীষণ খুশি হয়। কিন্তু পরমুহূর্তে দুঃখী দুঃখী স্বরে বললো,
” সরি সাবিহা। আমার কাছে এখানে আপাতত গ্রামোফোন নেই।”
” তো কোথায় আছে? আমার যে দেখতে মন চাইছে!”
রাগীব এ পর্যায়ে উত্তর খুঁজে পেলো না। কারণ সাবিহার এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সময় এটা না৷ সে প্রশ্নটি এড়িয়ে যেতে বললো,
” আপনাকে না হয় একদিন গ্রামোফোন দেখাবো।”
সাবিহা কিঞ্চিৎ অখুশি হলো। খানিকক্ষণ চুপ নিশ্চুপ বসে রইলো। আঁধারিয়া পরিবেশে রাগীবের দিকে স্পষ্টভাবে তাকানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালালো সে। খানিক সময় বাদে তীব্র আবদারের সহিত বললো,
” সেই হাতেগোনা কয়েকটা গানের মধ্যে আমাকে আরেকটা গান শুনাবেন? আপনার কণ্ঠে গান দারুণভাবে মানিয়ে যায়। ”
সাবিহার শেষোক্ত কথাটি রাগীবের মনে রঙ তুলি দিয়ে ভালোলাগার আঁচড় দিয়ে দিলো। সাবিহার কথার সুরে সে স্পষ্ট অনুমান করতে পারলো, সাবিহার হৃদয়ে তার জন্য কিঞ্চিৎ পরিমাণে হলেও অনুগ্র অনুভূতি তৈরী হচ্ছে। এটাই তো সে মনেপ্রাণে চাইছিলো। ইশ, ব্যাপারটা এতো সোজা! পহেলা হতে জানলে সে এ গান গাওয়ার উপর জোর দিতো! তবে এখন যে হয়েছে, এই-ই ঢের ভালো৷ দু দিক দিয়েই সে সুবিধা পেলো। এক সাবিহার হৃদয়, অপরটি…………
রাগীব কোমল সুরে বললো,
” আপনি যখন এতো করে চাইছেন, আপনাকে একটি গান শোনানোই যায়। ”
সাবিহার আকুতিভরা চাহনি মুহূর্তেই হাস্যজ্জ্বল চাহনিতে রূপান্তরিত হলো। সে অতি আগ্রহের সহিত বললো,
” একটা বাংলা গান শোনাবেন প্লিজ। বাংলা গানের প্রতি আমার অনেক টান। ”
” আচ্ছা। তবে এর আগে রুম থেকে আমার গিটারটা আনা প্রয়োজন। একটু সুর না তুললে হয় না কি!”
এই বলে সে উঠে দাঁড়ালো। দু কদম যেতেই পিছন হতে সাবিহা অনুনয়সূচক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” আমি কি আপনার রুমে আপনার সাথে যেতে পারি?”
রাগীব চট করে পিছন ফিরে বললো,
” হোয়াই নট। কাম অন। ”
রাগীবের সম্মতি পেয়ে সাবিহা চট করে উঠে দাঁড়ালো। দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে রুমে চলে এলো। রাগীব রুমে প্রবেশ করেই আলো জ্বালালো। সাথে সাথে সাবিহা তড়িৎ গতিতে চোখ বন্ধ করে নিলো। এতোক্ষণ আঁধারে থাকার পর আচমকা আলোয় আসায় তার চোখ দুটো ক্ষীণ যন্ত্রণা অনুভব করলো। যদিও সে নিমিষের মাঝেই নিজেকে সামলে নিলো।
রাগীব বিছানার উপর হতে গিটার হাতে নিলো। তন্মধ্যে সাবিহা এক নজরে পুরো রুমটি দেখে নিলো। রুমের গোছগাছ, প্রতিটি জিনিস সঠিক জায়গায় দেখে সাবিহার বুঝতে অসুবিধা হলো না, রাগীব ভীষণ শৌখিন প্রকৃতির মানুষ। সে রাগীবের এতো গোছালো স্বভাব দেখে বিস্ময়ের সহিত বললো,
” আপনি এত গোছালো আর শৌখিন!”
রাগীব মৃদু শব্দে হাসলো। বললো,
” আসলে ছোট থেকেই এমন আমি। আমার জিনিসপত্র সঠিক জায়গায় না থাকলল আমার ভালো লাগে না। মনে উশখুশ করে। ”
বলামাত্রই দুজনে একত্রে হেসে উঠলো। অতঃপর রাগীব গিটার নিয়ে রুমের আলো জ্বালিয়েই সাবিহাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। পথিমধ্যে বললো,
” আপনি যে এখানে এসেছেন, আমার কাছে গান শুনতে চাইছেন, এটা আপনার বাড়ির কেউ জানে?”
” উঁহু। আর জানবেও না। কারণ সবার রুমই ওদিকটায়। আপনার গান ওপাশে পৌঁছাবে না। আর পৌঁছালেও কেউ গুরুত্ব দিবে না৷ এবার দ্রুত গাওয়া শুরু করুন। আই এম এজারলি ওয়েটিং ফর দিস।”
এই বলে সাবিহা পূর্বের স্থানে বসে পড়লো। বসে পড়লো রাগীবও। অতঃপর ক্ষীণ শব্দে কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে গিটারে সুর তুললো সে,
” তোমার আকাশ দুটি চোখে
আমি হয়ে গেছি তারা
ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে
আমি হয়ে গেছি তারা
এই জীবন ছিল
নদীর মতো গতিহারা
এই জীবন ছিল
নদীর মতো গতিহারা দিশাহারা
ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে
আমি হয়ে গেছি তারা।…….”
.
সোফিয়া ও সাবিহা ভার্সিটি শেষে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরছে। দুজনের মধ্যে চলছে জর্জকে নিয়ে বিস্তার আলাপ আলোচনা। তাদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু জর্জ কি পছন্দ করে এবং সেই পছন্দ অনুযায়ী সোফিয়া জর্জকে কিভাবে নিজের মনের অনুভূতি বলবে।
সোফিয়ার সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ সাবিহার চোখ আটকে গেলো গাড়ি হতে নামা রাগীবের দিকে। সাদা শার্ট,কালো টাই, কালো ব্লেজার ও প্যান্ট পরিহিত রাগীবের চোখে কালো রোদচশমা। ফর্সা মুখশ্রীতে ফর্মাল এ লুকে রাগীবকে দারুণ দেখাচ্ছে। কিন্তু রাগীব এতো ফর্মাল পোষাক পরে গাড়ি হতে নামছে কেনো? তার উপর আবার ব্যাক সিট হতে? কার গাড়ি থেকেই বা নামলো রাগীব?
রাগীবকে দেখে সাবিহার মস্তিষ্কে প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খেতে লাগলো।
#চলবে