মায়াবন_বিহারিণী ?,০২,০৩

0
1166

#মায়াবন_বিহারিণী ?,০২,০৩
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#দ্বিতীয়_পর্ব

৪.
– “আমি এই বিয়ে করতে পারব না আব্বা।”
উপমার দৃঢ় কন্ঠে বলা কথাটা মুহূর্তেই ইফতেখার সাহেবকে চুপ করিয়ে দিতে সক্ষম হলেও পেছনে থাকা বর বেশে দাঁড়িয়ে থাকা রফিক সাহেব একপ্রকার গর্জে উঠলেন।

– “চেয়ারম্যান সাহেব! এইসব কি তামাশা হইতাছে? কথা তো ছিল কোনো প্রকার তামাশা হইব না। তয় আপনে কি আপনার দেয়া কথা ভুইলা গেছেন? মনে রাইখেন, আপনার দেয়া কথার হেরফের হইলে সবকিছু বদলাইয়া যাইতে পারে।”
রফিক সাহেবের কথা শুনে ইফতেখার সাহেবের দুশ্চিন্তায় কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হলো। একরাশ ভীতি নিয়ে বড় বড় পায়ে এগিয়ে গিয়ে রফিক সাহেবের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি।
– “না, না আপনি কোনো চিন্তা করবেন না জামাই বাবু। আমি আমার দেয়া কথা ভুলি নাই। আপনের বিয়া উপমার লগেই হইব। উপমা ছোট মানুষ; হয়ত ভুলভাল কিছু বইলা ফেলছে। আপনি ভুল বুঝবেন না, বাবু।
আমেনা, এই আমেনা এহনো দাঁড়াইয়া আছো কেন? উপমারে তৈরি কইরা নিয়া আসো; বেলা যে গড়াইয়া যাইতাছে। হাতে সময় নাই।”

ইফতেখার সাহেব বেশ চড়া গলায় আমেনা বেগমকে তাড়া দিতেই আমেনা বেগম উপমার হাত শক্ত করে ধরে ভেতরে অগ্রসর হওয়ার জন্য পা বাড়ান। এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে সবটা মুখ বুজে সহ্য করলেও ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে তড়িঘড়ি করে নিজের হাত আমেনা বেগমের কাছ থেকে ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে কয়েক পা সরে আসে উপমা। তাকে পেয়েছে টা কি? সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করে বলে একজন বয়স্ক লোকের কাছে তাকে বিক্রি করে দেয়ার কথাটাও সহ্য করে নিবে।

– “ব্যাস, অনেক হইছে! আমি তো বলতেছি আমি এই বিয়ে করব না।
আর বিয়া বলতেছি কেন? এইটা তো কোনো বিয়ে না। আপনারা সবাই মিলে আমারে এই লোকটার কাছে বিক্রি করে দিতেছেন; ঠিক যেমন করে সারাবছর লালন পালন করা গরু ছাগল হাঁটে বিক্রি করে দেয়।”
এটুকু বলেই থামে উপমা। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ইফতেখার সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “আব্বা আপনি এইটা কি করে করতে পারলেন আমার সাথে? আমি তো আপনাকে আমার সব ভাবছিলাম কিন্তু আপনি আমারে এতটাই দু চোখের বিষ মনে করেন যে আমারে না জানাইয়া অন্য একটা লোকের কাছে বিক্রি করে দিতেছেন? আমি কি দোষ করছিলাম আব্বা যে আমার সাথে আপনি এমন করলেন! আমি কি বোঝা হয়ে গেছিলাম আপনার কাছে?”
কথাগুলো বলতে বলতে গলা বারবার কেঁপে উঠছিল উপমার। চোখ দুটোও অশ্রুসিক্ত। আশপাশের লোকজন অবাক চোখে উপমা আর চেয়ারম্যান সাহেবের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। গ্রামের প্রায় বেশিরভাগ মানুষই উপস্থিত দৃশ্য উপভোগ করছে।

– “হ ঠিকই বলছিস তুই! তোরে আমি বেইচা দিতেছি। আর দিবই না কেন? তোরে বিক্রি কইরা দেওনের বিনিময়ে রফিক সাহেব আমারে মোটা অংকের টাকা দিব। তোরে রাইখা লাভ কি আমার? ঘাড়ের উপর বইসা বইসা তো অন্ন গিলতেছিস; তোর মা মরনের পর থেইকাই তো আমার ঘাড়ে চাইপা বইসা আছিস। ভাবছিলাম মা মরণের পর তোকে ও বিদেয় দিয়ে দিব; কিন্তু ভাগ্যের চাকা এমনভাবে ঘুইরা গেছে সেই সুযোগ হাতছাড়া করি কইরা? এহন চুপচাপ এই বিয়ের পিঁড়িতে বইসা পড়। আমাকে কিছু করবার জন্যে বাধ্য করিস না উপমা; আমি আবার এক‌ কথার মানুষ।”
রুক্ষ কন্ঠস্বর। চারপাশের পরিবেশ নিস্তব্ধ কোলাহলহীন। ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে ঠিক এমনই থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। উপমার তো পায়ের তলা দিয়ে মাটি সরে যাওয়ার উপক্রম। তবে কি অয়ন্তিকার বলা কথাটাই কি সত্যি ছিল? একটা লোক কি করে এতটা জঘন্য হতে পারে?

৫.
ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে আমেনা বেগম ও উপমার দিকে তাকিয়ে মুখ বাকালে‌ন।‌ এদিকে বেশ ক্রোধ নিয়ে উপমার দিকে ইফতেখার সাহেব তেড়ে আসতে নিলে উপমা বরাবরের মতই হাত উঁচু করে কর্কশ গলায় বলে ওঠে,
– “ওখানেই থেমে যান চেয়ারম্যান সাহেব! ভুল কইরাও আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না। অনেক সহ্য করছি। ছোটবেলায় ভাবছিলাম হয়তো আমার কপাল ই খারাপ; যার জন্য কোনোদিন জন্মদাতা পিতার ভালোবাসা পাই নাই। মায়ের মৃত্যুর সময় ও আমার ভাবনা পাল্টায় নাই। কিন্তু আপনার এই ভন্ডামি ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে চাপা পইড়া ছিল। যা আজ সবার সামনে আইসা পড়ছে। আমাকে বাধ্য করবেন না এমন কিছু করার জন্য যার জন্যে আপনারে সারাজীবন পস্তাইতে হয়!”

এগোতে গিয়েও থেমে যায় ইফতেখার সাহেব। উপমার কথা যেন তার ঠিক হজম হয় নি। সে তো ভেবেছিল ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে তার কথামতো বিয়ের পিঁড়িতে চুপচাপ বসে পড়বে উপমা। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতা তাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। আর উপমা কিসের কথার হুমকি দিচ্ছে তাকে?
– “কি করবি তুই মুখপুড়ী‌? তোর সাহস তো কম না মুখের উপর তর্ক করিস; কি করবি তুই হ্যাঁ? কাজী সাহেব! আপনি বিয়া পড়ানো শুরু করেন।”
আমেনা বেগমের দৃঢ় কন্ঠ শুনতে পেলেও তেমন কোনো ভাবান্তর ঘটল না উপমার মাঝে।
– “কি হবে সেটা না হয় আমাদের উপরই ছেড়ে দেন চেয়ারম্যান সাহেব। বাকিটা আমরাই যাচাই-বাছাই করে নেব!”
পেছন থেকে কারো পরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই উপস্থিত সবাই সেই কন্ঠস্বর অনুসরণ করে পেছনে তাকায়। বিয়ে বাড়ির সদর দরজায় আইনের পোশাক পরিধান কারী পুলিশ অফিসার আমান সাহেবকে দেখতে পেয়ে ইফতেখার সাহেব, রফিক সাহেব, আমেনা বেগম সহ কাজী সাহেবের চেহারাতেও দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠতে শুরু করে। কাজী সাহেব তো ইতিমধ্যে দলিল, কাগজপত্র গুছিয়ে পোঁটলা বেঁধে নিয়েছেন। রফিক সাহেবের ও প্রায় পালাই পালাই ভাব। ইফতেখার সাহেব কোনোমতে আড়চোখে আমেনা বেগমকে ইশারা দিতেই তিনি দ্রুত পায়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করেন।

– “আরে পুলিশ সাহেব আপনে? হঠাৎ আমার বাড়ি আসার কথা মনে পড়লো! তা বাইরে দাঁড়ায় আছেন ক্যান? ভেতরে আহেন।”
ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে আমান সাহেব ভেতরে প্রবেশ করে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলেন। যাক তাহলে তার কাছে পৌঁছানো তথ্য মিথ্যে ছিল না।
– “কি ব্যাপার চেয়ারম্যান সাহেব। বাড়ির সাজসজ্জা তো স্পষ্ট বলে দিচ্ছ কারো বিয়ে। তা আমার জানামতে এ বাড়ির বড় মেয়ের বয়স তো সবে মাত্র ষোল বছর। তবে কি লুকিয়ে লুকিয়ে মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে গ্রামের চেয়ারম্যান হয়েও অপকর্ম করছেন? নাকি দালালি নামক অপকর্মকে বাল্যবিবাহ নামক অপকর্ম দিয়ে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছেন চেয়ারম্যান সাহেব?
ঠিক বলেছি না কাজী সাহেব?”

অফিসার আমানের প্রশ্ন শুনে গলা শুকিয়ে আসে ইফতেখার সাহেবের। ব্যাপারটা বেশ ধোঁয়াশা রাখার জন্য মিনমিনে করে বলে উঠেন,
– “আরে সাহেব কি বলেন এইসব? আপনি হয়তো ভুলভাল কিছু শুনছেন; কিসের বাল্যবিবাহ? আর কিসের দালালি? আর উপমার যথেষ্ট বয়স হইছে তাই তার মঙ্গল কামনা কইরা আমি আমার মেয়ের সঙ্গে সুপুত্রর বিয়ে দিমু ঠিক করছি। কি ঠিক বলছি না, কাজী সাহেব?”
ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে কাজী সাহেব ও মাথা নাড়ায়। পুলিশ বাহিনীর আড়াল থেকে পূর্ণা চুপিচুপি এসে উপমার পাশে এসে দাঁড়ায়। চোখের ইশারা দিতেই উপমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। ভাগ্যিস সঠিক সময়ে পূর্ণা বাড়ির পেছনের আমবাগান দিয়ে চলে গিয়েছিল না হলে আজ এমন একটা ঘটনার সম্মুখীন হতে হতো তা ধারণার বাইরে ও ছিল উপমার।

৬.
– “ডক্টর আবেগ, আপনার ট্রান্সফারের ফাইলে সব ইনফরমেশন দেয়া রয়েছে। ইউ ক্যান চেক ইট নাও। বাই দা ওয়ে, আপনার জন্য একটা গুড নিউজ আছে।”
সদ্য কেবিনে প্রবেশ করে গলায় থাকা ঝুলন্ত স্টেথোস্কোপ‌টা টেবিলের উপর রাখতে যাচ্ছিল আবেগ। তখনই পেছন থেকে সিনিয়র ডক্টর ঈশান মির্জার কথা কর্ণকুহরে পৌঁছায় তার। পরনে সাদা অ্যাপ্রন‌, চোখে গোল ফ্রেমের‌ চশমা। আলতো করে ঘাড় বাঁকা তেই ডক্টর ঈশানের মুখশ্রী চোখে পড়ে তার।
– “ডক্টর ঈশান, আপনি? প্লিজ কাম ইন এন্ড থ্যাংকস ফর ইউর হেল্প।”
বলেই হাত বাড়িয়ে ডক্টর ঈশানের কাছে থাকা ফাইলটা নিয়ে নেয় আবেগ। বেশ কিছু প্রয়োজনে আবেগ সহ হসপিটালের আরো কয়েকজন ডক্টর দের দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হবে। সেই সুবাদে আবেগকে ও ‌হসপিটালের আন্ডারে যেতে হবে।
– “এই ট্রেনিং থেকে ফিরে আসলেই আপনার জন্য গুড নিউজ রয়েছে ডক্টর আবেগ। আই হোপ ইউ উইল ডান ইউর ওয়ার্ক প্রোপার্লি!”

ডক্টর ঈশানের কথা শুনে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে নেয় আবেগ। তার কথার মানে কি? একটা নিউজ শোনার জন্য তাকে এতটা সময় ওয়েট করতে হবে? ইম্পসিবল! লাইফে যদি কোনো বিষয়ের প্রতি তার খুব বেশি বিরক্তি থাকে তবে সেটা হলো ধৈর্য। এই একমাত্র জিনিসটার প্রতি প্রবলভাবে বিরক্ত। তবুও খুব কষ্টে দাঁতে দাঁত চেপে বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই ডক্টর ঈশান পুনরায় বলে ওঠে,

– “Okay then see you soon after your twenty days journey, doctor Abeg!”
ডক্টর ঈশান কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে পড়তেই ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবেগ। তার এই ডাক্তারি লাইফের জার্নি বড়ই অদ্ভুত। কি আর করার? একবার যেহেতু ডাক্তার নামক এত বড় দায়িত্ব গলায় থাকা স্টেথোস্কোপের মত ঝুলে পড়েছে সেহেতু পালন তো করতেই হবে।
হাতে থাকা ফাইলটা টেবিলের উপর রাখতে গিয়েও থেমে যায় আবেগ। ইনফরমেশন গুলো আবারো চেক করার জন্য ফাইল খুলতেই সেখানে থাকা গুটিগুটি অক্ষরে লিখা গন্তব্যের নাম চোখে পড়ে তার। অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে বসে,

– “ত্রিমোহিনী! কোয়াইট ইন্টারেস্টিং!”
নামটা উচ্চারণ করে মৃদু হাসে আবেগ; যেন নামটা বেশ আকর্ষণীয় তার নিকট।………………

#চলবে ?

#মায়াবন_বিহারিণী ?
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#তৃতীয়_পর্ব

৭.
মানুষ দিয়ে পরিপূর্ণ উঠোন ধীরে ধীরে জনশূন্য হতে শুরু করেছে। পশ্চিমা আকাশেও‌ সূর্যের ঢল নামবে খুব শীঘ্রই। উঠোনের ঠিক মাঝখানে মোড়া পেতে বসে আছেন ইফতেখার সাহেব। দৃষ্টি তার মাটিতে স্থির। মুখশ্রীতে তার চাপা রাগ স্পষ্ট। কোনো কিছুর ক্ষোভে পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। তার তৈরি পুরো পরিকল্পনা এভাবে ভেস্তে যাবে কল্পনাও করে নি সে। তার বানানো পরিকল্পনা এভাবে উপমার জন্য ভেঙে চৌচির হয়ে গিয়েছে ভাবতেই রাগের পরিমাণ তীব্র হয় তার।
একটু আগের ঘটনা,
– “গ্রামের প্রধান হয়েও এমন কাজ কিভাবে করতে পারলেন আপনি চেয়ারম্যান সাহেব? এখন আপনি সত্যটা মুখ খুলে বলবেন নাকি আমরা আমাদের আইন প্রয়োগ করে সেটা বের করে নেব? ভুলে যাবেন না পাপ কিন্তু বাপকেও ছাড়ে না।”
অফিসার আমানের কথায় থতমত খেয়ে ইফতেখার সাহেব বেশ ইশপিশ করতে শুরু করলেন। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আড়চোখে উপমার দিকে তাকান তিনি। গলা শুকিয়ে আসছে ক্রমশ এই ভয়ে যদি উপমা মুখ ফসকে কিছু বলে দেয় তাহলে? অন্যদিকে রফিক সাহেব সহ কাজী সাহেব দুজনেই খুব সাবধানে এদিক ওদিক তাকিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বাড়ির প্রধান দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। উদ্দেশ্য সুযোগ পেলেই সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে উপস্থিত জনসভা থেকে পলায়ন করা। উপমা একবার চোখ তুলে ইফতেখার সাহেবের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। তার মুখে সবকিছু ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। না আর দুর্বল হলে চলবে না। ইফতেখার সাহেব যে ষড়যন্ত্র রচনা করেছেন তার বিরুদ্ধে এই দুর্বলতাকেই কাজে লাগাতে হবে।
অফিসার আমান সরু দৃষ্টিতে উপমার দিকে তাকিয়ে পুনরায় কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই উপমার কাটকাট গলায় প্রত্যুত্তর,

– “আপনার প্রতিটা কথাই সত্য অফিসার সাহেব। আপনি যা দেখছেন তার সবটাই সত্যি। তয় আমি এই বিয়ে‌ করবার চাই না। আমি আরো বড় হইতে চাই; অনেক পড়বার চাই।”
এটুকু বলে থামে উপমা। ইফতেখার সাহেব বেশ ঘাবড়াচ্ছেন‌। তার মানে কি উপমা সব বলে দিবে অফিসারকে? তার এত বড় পরিকল্পনা নিমিষেই শেষ হয়ে যাবে? না, না এ কি করে সম্ভব? তার এসব চিন্তাভাবনার মাঝে‌ তাকে অবাক করে দিয়ে উপমা বলে ওঠে,
– “কিন্তু এইখানে আব্বার কোনো দোষ নাই অফিসার। আব্বা এইসব করছে একমাত্র রফিক সাহেব আর কাজী সাহেবের কথায় আইসা। যদি কেউ দোষ কইরা থাকে তা হইলো রফিক সাহেব আর কাজী সাহেব।”

উপমার কথা শুনে আঁতকে উঠলেন ইফতেখার সাহেব। উপমা মিথ্যে বলছে কেন? উপমা তো চাইলেই সব বলে দিতে পারত। তবে কি উপমা তার ভয়ে অফিসারকে কিছু বলেনি? যাক ভালই হয়েছে। অন্যদিকে উপমার কথা শুনে ভয়ে উপস্থিত মানুষ জনের আড়ালে রফিক সাহেব আর কাজী সাহেব পালাতে নিলেই তড়িৎ গতিতে দুজনকে আটক করে নেয় কনস্টেবল আলী আর ভুঁইয়া।
অফিসার আমান সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায় উপমার দিকে। উপমা কি সব সত্যি বলছে নাকি কিছু লুকাচ্ছে? কিছু একটা ভেবে বেশ গম্ভীর মুখে তিনি বলে উঠেন,
– “আচ্ছা ঠিক আছে। তবে প্রয়োজন পড়লে আমি আবারও আসব। আর হ্যাঁ চেয়ারম্যান সাহেব, তদন্ত করার পর উপমার জবানবন্দির ঠিক উল্টো কোন তথ্য আসে তাহলে কিন্তু আপনি আইনের হাত থেকে পার পাবেন না। আজকের পর থেকে আমার বিশেষ নজর আপনার ওপর থাকবে। আসি তাহলে।”
বলেই পিছন ফিরে হাঁটা শুরু করেন অফিসার আমান সহ বাকি সব পুলিশের সদস্য।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উপমা। তার জীবনের লড়াইয়ে একধাপ পার করে ফেলেছে সে। উপস্থিত মানুষ জনও একে একে কানাঘুষা করতে করতে বেরিয়ে যাচ্ছে চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে।

৮.
সবাই চলে যেতেই ইফতেখার সাহেব উপমার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকান। রাগে‌ ক্ষোভে এগিয়ে গিয়ে থাপ্পড় দেয়ার উদ্দেশ্যে হাত ওঠাতেই মাথা তুলে তাকায়‌ উপমা।
– “ভুল করেও এই ভুল করবেন না চেয়ারম্যান সাহেব। এই একটা ভুল আপনার পুরো খেলাকে বিগড়ে দিতে‌ পারে। আমি আর আগের উপমা নাই যারে আপনে হাতের পুতুল বানায় রাখবেন। এখন থেকে লড়াই আপনার আর আমার মাঝে।
আর আপনার একটা ভুল পদক্ষেপ; আপনারে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে আমার সময় লাগবে না যতই আপনে আমার জন্মদাতা পিতা হন না ক্যান! আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না পুরা গ্রামের সামনে আপনের কাছ থেইকা আপনার পদবি, সম্মান কাইড়া নিয়ে জেলে পাঠায় দেয়া হোক।”
উপমার শীতল কন্ঠে বলা কথা উক্ত মুহূর্তে বিক্ষত বাঘিনীর মত লাগছিল ইফতেখার সাহেবের কাছে। উপমার এমন পরিবর্তিত রূপ দেখে তিনি বেশ চিন্তিত। হাত নামাতেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ঘরের ভেতরে পা বাড়ায় উপমা। আজকের দিনটা তার অদ্ভুত রঙিন ছিল।
উপমা চলে যেতেই ইফতেখার সাহেব রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে মোড়াতে সজোরে লাথি মারতেই তা ছিটকে পড়ে কয়েক মিটার দূরে।
– “আমার কাজে বাধা দেয়ার ফল ভালো হইব না উপমা। আর তার জন্যে যদি তোরে আমার রাস্তা দিয়া সরায় দিতে হয় তাও করমু আমি।”
ইফতেখার সাহেবের বিড়বিড় করে বলা কথায় যেন গভীর কোনো ষড়যন্ত্র লুকায়িত।

উপমা। পুরো নাম হলো অনিন্দিতা নওরিন উপমা। আপন বলতে মা অয়ন্তিকা ছিল যে চার বছর আগেই মা’রা গিয়েছে অদ্ভুত ভাবে। উপমা প্রায়শই মায়ের মৃত্যুর কারণ চিন্তা করে। এটা কি আদৌও স্বাভাবিক মৃত্যু্ নাকি পূর্ব পরিকল্পিত কোনো ঘটনা। অয়ন্তিকার মৃত্যুর পর পরই ইফতেখার সাহেব দ্বিতীয় বিবাহ করে স্ত্রী হিসেবে আমেনা বেগমকে নিয়ে আসেন এবং তার পর থেকেই শুরু হয় উপমার জীবনের দুরবস্থা। মাত্র ষোল বছর বয়সী উপমার সাথে এত কিছু ঘটে যাবে তা তার কল্পনার বাইরে ছিল।

ঘড়ির কাঁটায় রাত প্রায় নয়টা বাজে। বাস স্টেশনে টিকেট কাউন্টারে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। তার ই একপাশে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত আবেগ। একটু আগে বাসা থেকে বের হওয়ার পর পরই মিসেস ইশিতা অনবরত কল দিয়েই যাচ্ছে আবেগকে। পরে একপ্রকার বাধ্য হয়েই মিসেস ইশিতার নাম্বারে ডায়াল করে সে। মিনিট দশেক কথা বলতেই পেছন থেকে ডক্টর সায়ানের ডাক পড়ায় টুক করে কল কেটে দেয় আবেগ।
অপর পাশে থাকা ইশিতা বেগম ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ছেলেটা তার এমন অদ্ভুত কেন? বছর পাঁচেক আগেও তো আবেগ এমন ছিল না। কিন্তু হুট করেই আবেগের এমন গম্ভীর হয়ে যাওয়ার বিষয়টা ঠিক তিনি মেনে নিতে পারেননি। অবশ্য এখানে আবেগকে দোষারোপ করা মোটেও ঠিক হবে না; কেননা আবেগের এই পরিবর্তনশীল রূপ তার বাবার কারণেই হয়েছে। ছেলেট কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে।

– “ডক্টর আবেগ, বাইরে বাস এসে পড়েছে। চলুন কাউন্টার থেকে যাওয়া যাক।”
ডক্টর সায়ানের‌ কথায় মাথা নাড়িয়ে লাগেজ নিয়ে হাঁটা শুরু করে আবেগ।
এসি বাসের সিট নাম্বার মিলিয়ে মাঝের দিকটায় গিয়ে বসে পড়ে ডক্টর সায়ান এবং আবেগ। হসপিটাল থেকে ডক্টর সায়ান এবং আবেগকে ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে ঢাকা থেকে বহুদূরে সিলেটের ত্রিমোহিনী গ্রামে। বাসের সিটে বসতেই মাথা এলিয়ে দেয় আবেগ। একটু পরেই হয়তো বাস ছেড়ে দিবে। পকেট থেকে ফোনটা বের করে কানে হেডফোন গুঁজে নেয় সে। ঢাকা টু সিলেটের এই জার্নিটুকু প্রশান্তির বানাতে পছন্দের প্লেলিস্ট থেকে মিউজিক অন করতেই সেখান থেকে প্রিয় লিরিক্স ভেসে ওঠে,

“আমার কল্পনা জুড়ে,,,,যে গল্পেরা ছিল!
আড়ালে সব লুকোনো‌!
সেই গল্পেরা সব,,,,,রঙিন হলো পলকে!
তোমাকে হঠাৎ পেয়ে যেন,,

প্রেম তুমি আসবে এভাবে,,
আবার হারিয়ে যাবে ভাবিনি!
আজও আছে সে পথ, শুধু নেই তুমি
বলো কোথায় আছো অভিমানে?(২)

সব থেকেও কি যেন নেই,,
তোমাকে তাই খুঁজে যাই প্রতি ক্ষণে।
আমার ভালোলাগা গুলো সব;
তোমায় ভেবে সাজে রোজ রোজ এ মনে!

প্রেম তুমি আসবে এভাবে,,
আবার হারিয়ে যাবে ভাবিনি।
আজও আছে সেই পথ; শুধু নেই তুমি
বলো কোথায় আছো অভিমানে?(২)
(বাকিটুকু নিজ দায়িত্বে শুনে নিবেন।)

৯.
খোলা আকাশে পূর্ণ থালার মতো চাঁদ স্পষ্ট দৃশ্যমান। জানালার গ্রিলের একাংশ দিয়ে সেই চাঁদের আলো ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছে। বিছানায় একপাশে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে পূর্ণা। আর খাটের সাথে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে আছে উপমা। শাড়ির আঁচলটা মেঝেতে অগোছালো ভাবে গড়াগড়ি খাচ্ছে। একটু আগেই আমেনা বেগমের সাথে বেশ কয়েকদফা কথা কাটাকাটি হলেও ইফতেখার সাহেবের ইশারায় দমে গিয়েছেন আমেনা বেগম। উপমাও কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ সবাইকে এড়িয়ে চলে এসেছে। ক্ষুধায় পেট চো চো শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে। আজকে যে থালে দুমুঠো ভাত জুটবে না সে বিষয়ে খুব ভালো করেই জানে উপমা।
চোখ দিয়ে নোনা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে অনবরত। কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে শরীর লুটিয়ে দেয় উপমা। কখন যে অশ্রুর বদলে ক্লান্তির ঘুম নেমে আসে চোখে টেরই পায়নি সে।

নতুন সূর্যের উদয়। সাথে একটি নতুন দিনের। চারপাশে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। কাঁধে কারো ঝাঁকুনি দেয়ায় চোখ মুখ কুঁচকে পিটপিট করে তাকায় আবেগ। ডক্টর সায়ান কি যেন বলছেন বিড়বিড় করে,
– “আবেগ, গেট আপ কুইকলি‌। বাস আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছে। উই আর ইন ত্রিমোহিনী নাও।”
ত্রিমোহিনী নাম শুনতেই ঝট করে সব ঘুমের রেশ কেটে যায় আবেগের। শেষ রাতে কখন যে চোখ লেগে এসেছিল খেয়াল নেই তার। একে একে করে বাস থেকে বেরিয়ে পড়ে যাত্রীগণ‌। সাথে আবেগ আর সায়ান ও।
– “ডক্টর আবেগ, এখানে তো একজন লোক থাকার কথা ছিল তাইনা; যে আমাদের ক্যাম্পে নিয়ে যাবে?”
– “হ্যাঁ, ডক্টর সায়ান। বাট এখানে তো তেমন কাউকে দেখতে পারছি না। হয়তো আমরা একটু আগেই এসে পড়েছি।”
সায়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে আবেগ। তখনই পেছন থেকে কারো কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
– “আপনারা কি শহর থাইকা আইছেন? আপনারা কি শহুইরা ডাক্তার যারা আমগো ক্যাম্পে চিকিৎসা করব?”
আবেগ আর সায়ান মুচকি হেসে সম্মতি দিতেই ভদ্রলোক বেশ সম্মান সহিত দুজনকে নিয়ে রওনা দেয় ক্যাম্পের দিকে। আবেগ ও মনে মনে চিন্তা করে এই ত্রিমোহিনীর যাত্রা যেন বেশ স্মৃতিদায়ক হয় তার কাছে।……………

#চলবে ?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here