#মায়াবন_বিহারিণী?,০৬,০৭
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#ষষ্ঠ_পর্ব
১৫.
বাইরের আকাশ আজ ঝকঝকে পরিষ্কার। জ্বলজ্বলে তারাগুলোর মাঝে পূর্ণ চন্দ্রিমা বিদ্যমান। হাতে কফির মগ নিয়ে বারান্দায় খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে আবেগ। ক্যাম্প থেকে ফিরতে ফিরতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছে তার। ত্রিমোহিণী গ্রামটা বেশ বড়। ক্যাম্প থেকে অনেকটা দূরেই সায়ান আর আবেগের থাকার জন্য বন্দোবস্ত করা হয়েছে। কফিটা শেষ করতেই বেশ কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। শুনেছে এখান থেকে ভোরের দিকে অনেক সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়। অন্যদিকে সায়ান অনেকক্ষণ ধরেই তার প্রিয় মানুষের সাথে ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত।
কিচেনে কফির মগ রেখে রুমে আসতেই পকেটে থাকা ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে আবেগের। ঘড়ির দিকে তাকাতেই খেয়াল করে রাত প্রায় বারোটা বেজে এসেছে। পকেট থেকে ফোন বের করতেই স্ক্রিনে মিস্টার আহিল নামটা চোখে পড়ে তার। চাপা রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে আবেগের। ফোন রিসিভ না করে সাইলেন্ট মোডে রেখে ইজি চেয়ারটাতে বসে পড়ে সে। অতঃপর তিন চার বার এভাবে বাজতে বাজতে একসময় আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়। নিস্তব্ধ পরিবেশে যখন ঘুমের রেশ চোখে এসে জড়ো হয় তখনই ফোন পুনরায় ভাইব্রেশন দিয়ে উঠে।
তবে এবার ভাইব্রেশন কলের না বরং মেসেজের। পরপর তিন চারটে মেসেজ।বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে নেয় আবেগ। ফোনে থাকা মেসেজ গুলো ক্লিক করতেই সেখানে দেখতে পায়,
“আবেগ, বাবা ফোন রিসিভ কর। আমি তোর মা বলছি। প্লিজ তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ কর; জরুরি কথা আছে।”
সন্দিহান চোখে মেসেজ গুলো বিড়বিড় করে পড়ে আবেগ। আসলেই কি মিসেস ইশিতা মেসেজ দিয়েছে নাকি এটাও কোনো ভ্রম। কিন্তু মা তো কখনো এভাবে ম্যাসেজ করে না। জরুরী প্রয়োজন পড়লে বাড়ির ল্যান্ড লাইন থেকেই কল করে। তার চিন্তার মাঝে পুনরায় মেসেজ টোন কর্ণপাত হতেই তড়িঘড়ি করে নাম্বারে ডায়াল করে আবেগ। সেকেন্ড কয়েক পর রিসিভ হওয়ার পর পরই অপর পাশ থেকে থমথমে কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
– “আবেগ!”
মিসেস ইশিতার জায়গায় অন্যকারো কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে বিরক্তিতে চ উচ্চারণ করতে গিয়েও থেমে যায় আবেগ। শীতল কন্ঠে প্রত্যুত্তরে বলে উঠে,
– “মানুষের সাথে ধোঁকাবাজি করার স্বভাবটা গেল না আপনার তাইনা, মিস্টার আহিল শাহরিয়ার?”
– “আবেগ! ভুলে যেও না তুমি তোমার বাবার সাথে কথা বলছো? একজন পিতার দায়িত্ব হলো তার বিগড়ে যাওয়া সন্তানকে সঠিক পথে নিয়ে আসা। আর আমিও সেই দায়িত্বই পালন করছি।”
অপর পাশ থেকে আহিল সাহেবের কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় আবেগ।
– “হাসালেন মিস্টার আবেগ শাহরিয়ার। আপনি পালন করছেন পিতা হওয়ার দায়িত্ব? নাইস জোকস্ অফ দ্যা ইয়ার।
একজনের দুর্বলতা জেনেও সে দুর্বলতায় আঘাত করাকে আপনি আপনার সো কল্ড দায়িত্ব বলছেন মিস্টার আহিল শাহরিয়ার?”
– “ভুল কি আছে আমার দায়িত্বে? আমি তো শুধু বলেছি তোমার এই ডাক্তারি পেশা ছেড়ে দিয়ে আমাদের বিজনেস জয়েন করো। আমি খুব ভালো করেই জানি যে এসব ডাক্তারি তোমাকে দিয়ে হবে না। এতবড় কোটিপতির ছেলে হয়েও তুমি বোকামি করে চলেছ। কি দরকার ছিল এসব করার? শুনেছি হসপিটাল থেকে নাকি তোমাকে ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে? নিশ্চয়ই সেখানে গিয়ে তুমি কম্ফোর্টেবল নও!”
– “ইনাফ মিস্টার আহিল শাহরিয়ার! ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট। আমাকে নিয়ে আপনার এতটাও চিন্তা বড়ই বেমানান। আ’ম ভেরি কম্ফোর্টেবল উইথ মাই প্যাশন। আর রইলো আপনার বিজনেসের কথা? আপনি খুব ভালো করেই জানেন আমি কেন আপনার বিজনেস জয়েন করি নি। আমি আমার ডাক্তারি লাইফে বেশ ভালোই আছি। এভাবে নেক্সট টাইম আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা ভুল করেও মাথায় আনবেন না, ইটস কোয়াইট লেট!”
আহিল সাহেবকে উত্তরে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন ডিসকানেক্ট করে দেয় আবেগ। বড় বড় দুটো নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সে। পৃথিবীতে যদি কারো উপর সবচেয়ে বেশি রাগ, ক্ষোভ আর ঘৃণা জন্মে থাকে তা হলো নিজ পিতা আহিল শাহরিয়ারের উপর। ফোন নিয়ে রুমে যেতেই খেয়াল করে সায়ান বিছানায় হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে ইতিমধ্যে। সেও আর বিলম্ব না করে লাইট অফ করে পাশেই শুয়ে পড়ে আর পরক্ষণেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায়।
১৬.
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে চারপাশ জুড়ে। পাখিদের আনাগোনা আর কিচিরমিচির ও শোনা যাচ্ছে এর মধ্যে। চোখের উপর আলোর রশ্মি ছুঁয়ে যেতেই চোখ পিটপিট করে তাকায় উপমা। শেষ রাতে কখন যে ঘুমে চোখ লেগে এসেছিল তা খেয়াল নেই তার। ঘড়ির দিকে তাকাতেই খেয়াল করে সকাল ৬:৩০ টা বাজে। নিশ্চয়ই আমেনা বেগম ও উঠে পড়বে একটু পর। অন্যদিকে বিছানায় গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে পূর্ণা। অতঃপর অলসতা বিসর্জন দিয়ে আড়মোড়া ভেঙে দ্রুত উঠে পড়ে উপমা। ঘরের কোণে থাকা লাল পাড়ের শাড়িটা নিয়ে দ্রুত পা বাড়ায় বাড়ির পাশের ঘাটলার দিকে।
কল পাড়ে বেশ কিছু কাজ সেরে আসতেই প্রায় ৭:৩০ টা বেজে যায় উপমার। ততক্ষণে বাড়ির সবাই জাগ্রত ও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাড়িতে গিয়ে এত সকালে উঠোনে ইফতেখার সাহেব সহ আরো দু চার লোককে দেখে ভ্রু কুঁচকে নেয় উপমা। কিন্তু পরক্ষণেই উপস্থিত মানুষের কথোপকথন কর্ণপাত হতেই বুঝতে পারে পুনরায় চেয়ারম্যান পদের নির্বাচন শুরু হবে তাই এত সকালে তাদের এ বাড়িতে আসা। উপমাও আর বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না সেখানে। আমেনা বেগম কথা শোনাতে কমতি না রাখলেও ইফতেখার সাহেবের একদম নিশ্চুপ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা তাকে বেশ ভাবিয়ে তোলে। কে জানে এই নিশ্চুপতা কিসের লক্ষণ?
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই পরিপাটি হয়ে নিয়েছে আবেগ। আজ একটু আগেই বের হয়ে চারপাশের এলাকা ঘুরে পর্যবেক্ষণ করে দেখবে সে। এতদিন ক্যাম্প টু বাসা, বাসা টু ক্যাম্প এ যেতে যেতে কোথাও বের হতে পারে নি সে। সায়ানকেও তার সাথে যেতে বললে কোনো এক কারণে তা নাকচ করে দেয় সায়ান। তাই একাই বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় আবেগ।
ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৮ টা বেজে ১৫ মিনিট। ক্যাম্পে মোটামুটি ১০ টার দিকেই কার্যক্রম শুরু হয়। টেবিলের উপর থেকে ঘড়িটা হাতে নিতে নিতেই রুম থেকে বের হয়ে যায় আবেগ। ঘোরাঘুরি করার পর সোজা ক্যাম্পে যাবে সে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু দূরে যেতেই মেঠো পথের একপাশে সারি সারি ধানের শীষ আর অন্যপাশে হলদে সরিষা ফুলের অসীমতা চোখে পড়ে তার। অনেকদিন পর একটু প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নিতে সফল হয় আবেগ। মৃদু হেসে মেঠো পথ ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। গ্রামাঞ্চলে সকাল সাড়ে আটটা মানে অনেকটাই সকাল। তাইতো রাস্তায় বেশ ক’জনকে চোখে পড়ে তার। বেশ খানিকটা হাঁটার পর মাঝারি আকারের নদী চোখে পড়ে আবেগের। নদীর একাংশ জুড়ে শুধু পদ্মপাতা; তার মাঝে গাঢ় গোলাপি রঙের পদ্ম ফুল ফুটে রয়েছে। অন্যপাশে দু একটা নৌকা বাধা রয়েছে। সাথেই একটা বিশালাকার গাছ। হয়তো এই নদী দিয়ে কারো চলাচল হয় না।
উঁচু মেঠো পথের একপাশ দিয়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে পড়ে আবেগ। অনেকখানি হাঁটার ফলস্বরূপ পা দুটোর একটু বিশ্রাম প্রয়োজন। তাছাড়াও এখানকার নীরব নির্জন স্থানে একটু সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছে বলেও মন ভালো হয়ে যায় তার। মায়ের সাথে খুব ছোট থাকতেই গ্রামে আসা যাওয়া হতো আবেগের; তবে যতই বড় হতে থাকে ততই নিজেকে চার দেয়ালের বন্দী অট্টালিকার শহরে মানিয়ে নিতে হয়েছে তার।
নৌকা দুটো বেশ পুরনো বলেই মনে হচ্ছে। নৌকার অগ্রভাগে থাকা অংশটাতে গিয়ে বসতে নিলেই ভ্রু কুঁচকে নেয় আবেগ। সাথে চমকায় ও। নৌকার মাঝামাঝিতে বেশ কয়েকটি পদ্মফুল রাখা। তবে কি তার মতো এখানে আরো কেউ উপস্থিত রয়েছে? থাকলেও কোথায়? আশেপাশে তো কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। কৌতুহল নিয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল আবেগ। কিন্তু পরক্ষণেই তাকে পুনরায় চমকে দিয়ে কারো গানের গলার স্বর কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই মস্তিষ্ক অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে ওঠে আবেগের। কোনো অদৃশ্য মানবী নেই তো আবার তার দৃশ্যপটের আশপাশে; নাকি সবটাই মনের ভ্রান্তি?…………..
#চলবে ?
#মায়াবন_বিহারিণী ?
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#সপ্তম_পর্ব
১৭.
অদৃশ্য মানবীর গলার স্বর নিয়ে চিন্তিত হতেই আর বসতে পারে না আবেগ। গানের সুর কর্নগোচর হতেই তাতে ধীরে ধীরে বিমোহিত হয়ে পড়ে আবেগ। সুর অনুসরণ করে পাশে থাকা বড় গাছটার দিকে পা বাড়াতেই সুর স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে শুরু করে তার নিকট।
“মেঘের ওপর আকাশ উড়ে
নদীর ওপার পাখির বাসা,
মনে বন্ধু বড় আশা……
মেঘের ওপর আকাশ উড়ে
নদীর ওপার পাখির বাসা
মনে বন্ধু বড় আশা……..
যাও পাখি যারে উড়ে,,,
তারে কইয়ো আমার হয়ে,
চোখ জুড়ে যে দেখব তারে
মন চলে যায় অদূর দূরে!
যাও পাখি বলো তারে,,
সে যেন ভোলে না মোরে।
সুখে থেকো ভালো থেকো; মনে রেখ এই আমারে।”
আবেগ অন্যমনস্ক হয়ে গাছটার দিকে এগোতে থাকে ঠিক যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার সেই অজানা সুর তাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করছে। হঠাৎ শুকনো পাতার মধ্যে কারো পদধ্বনি শোনা যেতেই গুনগুন করা থামিয়ে দেয় উপমা। আশপাশে কেউ আছে নাকি? অতি সন্তর্পণে নিশ্চুপ হয়ে অপেক্ষা করে আগন্তুকের জন্য। কিন্তু পরক্ষণেই হৈমন্তীর কথা মনে পড়তেই কিছুটা নড়েচড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। একরাশ খুশি নিয়ে দ্রুত ভাঙা গাছের ডালের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। অন্যদিকে হঠাৎ করে সেই অজানা সুর থেমে যাওয়ায় ধ্যান ভেঙে যায় আবেগের। সুর তো গাছের পেছন থেকেই আসছে। তবে কি পেছনে কেউ রয়েছে? আর থাকলেও কি তাকে দেখা একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে আবেগের নিকট?
ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ তার সামনে কোনো মানবী গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতেই হকচকিয়ে যায় আবেগ। সাথে করে সামনে থাকা মানবীও। হৈমন্তীর বদলে অন্য কাউকে মোটেও আশা করে নি উপমা। গোলগোল চোখে ভালো করে তাকাতেই বলিষ্ঠ যুবকের মুখশ্রী চেনা চেনা লাগে তার। মস্তিষ্কে একটু জোর দিতেই মনে পড়ে যায় সেদিনের ক্যাম্পে থাকা ডাক্তারের কথা। নামটা যেন কি ছিল? হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আবেগ; এ ব্যক্তি তো আর কেউ নয় বরং ডক্টর আবেগ।
হুট করেই কারো সামনে এসে পড়াতে বেশ খানিকটা বিস্মিত হলেও পরক্ষণে মেয়েটির দিকে ভালো করে তাকায় আবেগ। কাজল কালো দুটো চোখ, চুলগুলো বেশ লম্বা এবং কোঁকড়ানো। কানের কাছে ছোট আকারের একটা পদ্মফুল গুঁজে রাখা। পড়নে লাল পাড়ের শাড়ি; আঁচলটা কোমরে গুঁজে রাখা। ঠিক যেন গ্রামীণ কিশোরী। আবেগকে এভাবে নিজের দিকে ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে নেয় উপমা। সরু চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় আবেগের দিকে,
– “এইযে ডাক্তার মশাই, এভাবে ভ্যাবলা কান্তের মতোন তাকাইয়া আছেন কেন শুনি? পলকও দেখি ফেলতে ভুইলা গিয়েছেন।”
উপমার এমন প্রশ্নে কাশি উঠে যায় আবেগের। ছোট কিশোরী হলেও প্রশ্ন যেন তার বিরাট। কি উত্তর দিবে এখন সে? এই যে সে এতক্ষণ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে মগ্ন ছিল। তার ভাবনার সুতো কাটে উপমার দ্বিতীয় প্রশ্নে।
– “কি হলো এখনো ভাবনার সুতো কাটে নাই বুঝি? আপনি তো দেখি আসলেই ভ্যাবলা কান্ত মশাই। বাহ্ জীবনে কোনো ডাক্তার ও ভ্যাবলা কান্তের খাতায় যোগ হবে ভাবিনাই।
তা এইখানে চুপিচুপি দাঁড়াইয়া কি করতেছিলেন শুনি? কোনো রোগীর খোঁজে এসেছিলেন নাকি?”
– “না! আমি তো এখানে তোমার গান শুনে,,”
আর কিছু বলতে পারে না আবেগ। তার পূর্বেই তার মস্তিষ্ক তাকে জানান দিয়ে দেয় সে কি বলতে যাচ্ছিল। অন্যদিকে আবেগের মুখশ্রীর ভাব দেখে ফিক করে হেসে দেয় উপমা। প্রথমে খানিকটা ইতস্তত বোধ করলেও পরবর্তীতে আবেগও মৃদু হাসে তার নিজ কান্ডে।
১৮.
বসন্ত প্রায় শেষের দিকে। গাছের সব পাতা ঝরে পড়ার সূচনা ঘটেছে। সূর্যের প্রখর রৌদ্রতাপও দুপুর বেলা উপলব্ধি করা যায়। ক্যাম্পে আজ গত দিনের তুলনায় বেশ কম লোকজন ই উপস্থিত হয়েছে। সকাল থেকে বেশি ভীড়ভাট্টা না থাকায় বেশ খানিক সময় পরপর দু একজন রোগীর দেখা পাওয়া যাচ্ছে। সকাল ৯:৩০ নাগাদ ক্যাম্পে এসে হাজির হয় আবেগ। সকালের ঘটনার পর আর এক মুহূর্তও দেরি করে নি সে। এমন বিব্রতকর অবস্থায় আগে কখনো পড়েছে বলে মনে হয় না তার।
– “কি ব্যাপার ডক্টর আবেগ, আজ আপনার মুখশ্রী একটু বেশিই উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। ত্রিমোহিনীর আলো, বাতাস বোধহয় আপনাকে খুব ভালো করেই ছুঁয়ে দিয়েছে।”
সায়ানের কথায় প্রেসক্রিপশন থেকে মাথা তুলে তাকায় আবেগ। প্রত্যুত্তরে মাথা নেড়ে বলে উঠে,
– “না ডক্টর সায়ান, ত্রিমোহিনীর আলো বাতাস না বরং ত্রিমোহিনীর কিছু স্মৃতি বোধহয় আমাকে খুব ভালো করে ছুঁয়ে দিবে। এখানের সবকিছুই যেন অদ্ভুত সুন্দর।”
সায়ানও মুচকি হেসে তার নিজ কার্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
– “আচ্ছা বুবু অয়ন্তিকা মা কোথায়?”
কল পাড়ে বসে কাঁচা আমগুলো পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে ব্যস্ত ছিল উপমা। বাড়ির পাশের আম গাছটা অন্য সব গাছের চেয়ে ভিন্ন। নির্দিষ্ট মৌসুমের পূর্বেই সে গাছে মুকুল আসে এবং ফল ধরে। পেছন থেকে হঠাৎ পূর্ণার এ প্রশ্ন শুনে থেমে যায় উপমা। অয়ন্তিকার কথা মনে পড়তেই গলা শুকিয়ে আসে তার। হাত পা ও ক্রমশ অসাড় হতে শুরু করে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে পূর্ণার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
– “পূর্ণা তুই? এই সময় কল পাড়ে কি করছিস? কাইল না তোর পরীক্ষা; যা গিয়ে পড়তে বস।”
– “উফফ বুবু একটু আগেই তো তোর সামনে পড়া শেষ কইরা উঠলাম। আর তুই উল্টাপাল্টা জবাব দিচ্ছিস কেন? আমি তো জিগ্গেস করছি অয়ন্তিকা মা কোথায়? সে আমাগো সাথে থাকে না কেন?”
– “পূর্ণা তোরে কতবার বলব যে অয়ন্তিকা মারে নিয়া আমার কাছে কিছু জিগ্যেস করবি না। আমি সত্যিই জানি না অয়ন্তিকা মা কোথায়; দেখি আমারে যাইতে দে। ঘরে মেলা কাজ পইরা আছে।”
পূর্ণাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কল পাড় থেকে উঠে ঘরের দিকে চলে যেতে নিলেই উপমার আঁচল ধরে থামিয়ে দেয় পূর্ণা।
– “আমি জানি বুবু তুই সব জানিস। বল না অয়ন্তিকা মা কোথায়? আব্বা তারে কোথায় রাখছে?”
– “মইরা গেছে অয়ন্তিকা মা! হইছে? আর কিছু শুনবি? খবরদার এই ব্যাপারে আমারে আর কিছু জিগ্যেস করবি না।
কাইল তোর পরীক্ষা; ঘরে আইসা খাইয়া পড়তে বস।”
বলেই ভেতরের দিকে গট গট করে হাঁটা শুরু করে দেয় উপমা। অন্যদিকে উপমার এমন রূঢ় আচরণ পূর্ণার মনকে বিষন্ন ও ভারাক্রান্ত করে তোলে।
১৯.
রক্তাক্ত লাশ। চারপাশের স্বচ্ছ পানি লাল বর্ণে ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে। দু তিন দিন পুরনো হওয়ায় তা থেকে মাংস পঁচা গন্ধ ছুটেছে তাও খুব বিশ্রীভাবে। লাশের আশপাশে যেন দাঁড়ানো যাচ্ছে না। গ্রামের কয়েকজন এসে সেই লাশ উঠানোর পর মুখশ্রী দেখানোর দৃশ্যপট মনে পড়তেই পুরো শরীর শিউরে ওঠে উপমার। কপাল বেয়ে দুশ্চিন্তার ঘাম ঝরছে অনবরত। এমন মর্মান্তিক দৃশ্য মনে পড়লে তাই হবার কথা।
– “আচ্ছা উপমা বল তো প্রেম ভালোবাসায় মানুষ কি এমন পায়? কি লাভ এই প্রেম ভালোবাসার? দিন শেষে তো দুইটা মানুষ শুধু শুধুই কষ্ট পায়।”
উপমার সুক্ষ্ম ভাবনায় ছেদ পড়ে হৈমন্তীর প্রশ্ন শুনে। এটা আবার কেমন প্রশ্ন? এর উত্তর কি আদৌ দেয়া সম্ভব? মিনিট কয়েক চুপ থেকে শীতল কন্ঠে উপমা জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “আকাশ ভাইয়ের সাথে তোর আবার কথা কাটাকাটি হইছে তাইতো?”
উপমার প্রশ্ন শুনে হৈমন্তী গোল গোল চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই ছোট্ট করে শ্বাস নেয় উপমা। হৈমন্তী আর আকাশের সম্পর্ক ধরতে গেলে অদ্ভুত রকমের। কয়েকদিন পর পর কথা কাটাকাটি হলেই উপমার নিকট হাজির হয়ে উদ্ভট সব প্রশ্ন ছুঁড়ে বসে হৈমন্তী।
– “শোন হৈমন্তী প্রেম ভালোবাসার ব্যাপারটা হইতাছে গিয়া একটু মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ের মতোন। ব্যাপারটা উপভোগ না কইরা উপলব্ধি করতে হয়। আর যদি ভালবাসা একবার জীবনে আইসা পড়ে তাহলে এটারে আর কোনোভাবেই আলাদা করা যায় না।
তয় যদি কষ্টের কথা আসে সেটা নির্ভর করে দুইটা মানুষের উপর। তাদের একজনের প্রতি আরেকজনের বিশ্বাসের উপর।
আমি খুব ভালো কইরাই জানি তুই আকাশ ভাইরে ভালোবাসিস। আকাশ ভাই ও ভালোবাসে। এইসবের মাঝে টুকটাক কথা কাটাকাটি হয়। ঐসব ব্যাপার না।”
উপমার কথার ভাবার্থ যে হৈমন্তী ঠিক বুঝতে পারে নি তা তার মুখশ্রীতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
– “তোর কথায় মনে হইতাছে যে তুই জন্মের সময়ই কারো প্রেমে পইড়া গেছিলি আর তার তার সাথেও অনেক বছর কাটাইছিস। আজ পর্যন্ত প্রেম ভালোবাসার আশপাশে গেলি না অথচ জ্ঞানভাণ্ডার বিশাল এই বিষয়ে?
তুই ও কি তয় কারো প্রেমে পড়ছিস?”
হৈমন্তীর প্রশ্নে খিলখিল করে হেসে উঠল উপমা। অতঃপর হাসি থামিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে উঠে,
– “পড়িনি তো কি হইছে? একদিন আমিও কারো প্রেমে পড়ব। খুব কইরা পড়ব।কাউরে উজাড় কইরা ভালোবাসব। আর সেই মানুষটাও একান্তই আমার থাকব!”……………….
#চলবে ?
( কেমন হয়েছে জানাবেন।)