#মায়াবন_বিহারিণী ?,১৪,১৫
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#চতুর্দশ_পর্ব
৩৪.
মাঝ থেকে কেটেছে আরো এক দিন। আজ সকালেই বাড়ি ফিরে এসেছেন ইফতেখার সাহেব। বাড়ি পৌঁছানোর পর থেকেই তার মাঝে বেশ অস্থিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ যে তিনি কোনো একটা বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে আছেন। আমেনা বেগম অফিসার আমানের প্রসঙ্গ তুলে ধরতেই তার কপালে চিন্তার ভাঁজ ক্রমশ সরু হচ্ছে যেন কোনো রহস্য উন্মোচন হয়ে যাওয়ার আশংকা। তাছাড়া সকাল বেলাই সজলকে ডেকে পাঠিয়েছেন তিনি। একদিকে অফিসার আমানের নজরদারি আর অন্যদিকে উপমার সবকিছু ফাঁস করে দেওয়ার বিষয় নিয়েই তিনি আজ সিদ্ধান্ত নিতে বসবেন।
নিজের কক্ষে বসে সবটাই জানালা দিয়ে পরখ করে উপমা। বাড়িতে বসে থাকতে মোটেও খুব একটা সুবিধার ঠেকছে না তার নিকট। পূর্ণাও তো বাড়িতে নেই। এমতাবস্থায় ইফতেখার সাহেব, আমেনা বেগম আর সজলের সামনে থাকা ঠিক হবে না বলে ধীরে ধীরে মোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। ঘড়ির দিকে একপলক দেখে নেয় কটা বাজে। ভালোই বেলা হয়েছে। তার উপর হাতে খুব একটা সময় নেই উপমার। মাত্র ৫৩ ঘন্টা বাকি আছে আবেগকে ফেরানোর। গত দিন ও একইভাবে সেই নদীর ধারে অপেক্ষা করতে করতে সন্ধ্যে লেগে আসে উপমার। তবুও সবকিছু ফেলে ক্যাম্পের দিকে ছুটে যায় সে। যে করেই হোক আবেগের অভিমান ভাঙাতে হবে।
কিন্তু উপমার ভাবনার ঠিক উল্টোটাই ঘটে গতদিন। ক্যাম্পে যাওয়ার পর দেখা হলেও কথা বলেনি আবেগ। বরাবরের মতই তাকে দেখেও না দেখার ভান করেছে সে। আবেগের অভিমান ভাঙানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করলেও বিফলে যায় সবকিছু। আবেগের অভিমান যে খুব একটা সহজে ভাঙানো যাবে না তা খুব ভালো করেই জানে সে। অন্যদিকে উপমার এমন আচরণ বারবার ভাবিয়ে তুলেছে আবেগকে। মেয়েটা আসলে কি চায়? খুব কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে উপমাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে সে।
কিন্তু অবাধ্য মনকে চাইলেই বা কতক্ষণ আর আটকানো যায়? উপমা যখন তার বিষন্ন মাখা মুখশ্রী নিয়ে ফেরত পথে চলে যাচ্ছিল তখন আবেগের মনটাও দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। এই মনে হচ্ছিল যদি সে তার প্রেয়সীকে আটকাতে পারত। নিজের বাহুতে আবদ্ধ করে রাখতে পারত তাহলে কতই না ভালো হতো। এ কেমন মায়াজালে আটকে রয়েছে দুজন?
আজ আর এদিক সেদিক সময় নষ্ট না করে গোসল সেরে পরিপাটি হয়ে সোজা হৈমন্তীদের বাড়ির পথের দিকেই পা বাড়ায় উপমা। পথেই দীর্ঘদিন পর দূরসম্পর্কের এক চাচীর সাথে দেখা হয় তার। প্রথমে না চিনতে পারলেও কিয়ৎক্ষণ সময়ের ব্যবধানে মুখশ্রী মনে পড়ে তার। গুটিকয়েক আলাপচারিতায় হঠাৎ করেই জমেদা বেগম হতাশার সুরে বলে উঠেন,
– “আইজ যদি তোর বাপ টা ঠিক থাকত তয় অয়ন্তিকারে এমনে মরণ লাগত না। ফুলের মতোন মাইয়াডার লগে কি হইয়া গেল? তয় আইজ আমি যাই উপমা; বেলা হইয়া যাইতাছে। তোর চাচায় মাঠ থেইকা আইয়া পড়ছে মনে হয়।”
বলেই নিজের বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করেন জমেদা বেগম। অন্যদিকে উপমা কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে জমেদা বেগমের যাওয়ার দিকে। কি বলে গেল সে? অয়ন্তিকার মৃত্যুর সাথে ইফতেখার সাহেবের সম্পর্ক কি? কোনোভাবে এই মৃত্যুর পেছনে ইফতেখার সাহেবের হাত নেই তো? ভাবতেই তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হতে শুরু করে।
৩৫.
জনমানবহীন ক্লান্ত দুপুর। চারপাশে কোনো মানুষের ভীড় ভাট্টা নেই বললেই চলে। আর সে সময়ই হৈমন্তীকে নিয়ে ক্যাম্পে উপস্থিত হয় উপমা। আজ সে ঠিক করেছে আবেগের মুখোমুখি হয়ে সবটা পরিষ্কার ভাবে জিজ্ঞেস করবে তাকে। কেন এই দূরত্ব? কেন এই অবহেলা? সবটার উত্তর আজ আবেগের কাছ থেকেই জেনেই নিবে। এই উদ্দেশ্য অনুসরণ করেই ক্যাম্পের ভেতরে প্রবেশ করে সে। আশপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে নেয় সে একবার। কোথাও আবেগের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। ঐ তো কর্ণারটায় বসে ডক্টর সায়ান কিছু ফাইলপত্র চেকআপ করছে। এদিক সেদিক চোখ বুলিয়ে নিতেই পেছন থেকে হৈমন্তী ফিসফিস আওয়াজে বলে উঠে,
– “কি ব্যাপার? এইখানে তো তোর ডাক্তার মশাইয়ের কোনো খোঁজ ই নাই। তয় কি সত্যি সত্যিই তুই তোর ডাক্তার মশাইরে হারাইয়া ফেললি উপমা?”
হৈমন্তীর কথা কর্ণগোচর হতে দেরী কিন্তু উপমার আঁতকে উঠতে দেরি নেই। ভীতি দৃষ্টে হৈমন্তীর দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ গলায় বলে উঠে,
– “না এইরকম হইতে পারে না। ডাক্তার মশাই তো শহরে যাওয়ার আরো দুইদিন বাকি। এত তাড়াতাড়ি তিনি কিভাবে যাইতে পারে? আর আমার বিশ্বাস আমারে না জানাইয়া সে কোথাও যাইব না।”
উপমার চোখে মুখে ভয় স্পষ্ট। এই বুঝি তার ডাক্তার মশাই কে হারিয়ে ফেলবে। তার ভাবনার মাঝেই পেছন থেকে কোনো পুরুষালি কন্ঠে ডাক পড়ে।
– “আপনারা? এখানে?”
তড়িৎ গতিতে পেছন ফিরে তাকায় উপমা। এ তো ডাক্তার সায়ান। ডক্টর সায়ানকে দেখে আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা হৈমন্তী সজাগ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “এইখানের আরেকজন শহুরে ডাক্তার কোথায়? নামটা যেন কি? হ্যাঁ, ডাক্তার আবেগ; তারে তো দেখতে পাইতেছি না।”
উপমাও উৎসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সায়ানের দিকে তার উত্তর জানার আশায়। সায়ান ও বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় প্রত্যুত্তরে বলে উঠে,
– “ডক্টর আবেগ? সে তো এখানে নেই। ইভেন আর আসবেন ও না। তিনি তো কাল রাতেই ঢাকার ট্রেনে ব্যাক করেছেন।
এমনিতে কোনো প্রয়োজন ছিল? উনি ছাড়াও এখানে আরো বেশ কয়েকজন ডক্টর রয়েছে। আপনারা চাইলে তাদের দিয়ে চেকআপ করাতে পারেন।”
সায়ানের বলা শেষোক্ত কথাগুলো কর্ণপাত হয় না উপমার। তার পূর্বেই সে থমকে গিয়েছে। চারপাশ কেমন যেন বর্ণহীন শূন্য শূন্য লাগছে। উপমাকে আবেগের ইনফরমেশন দিয়ে পুনরায় ভেতরে চলে যায় সায়ান। অন্যদিকে মাত্রাতিরিক্ত আশ্চর্যিত হওয়ায় শরীর ভারবিহীন হতে থাকে ক্রমশ উপমার। এ কি বললো ডক্টর সায়ান? আবেগ চলে গিয়েছে? কিন্তু কেন? তাকে একটি বারও বলে যেতে পারল না? অসাড় শরীর নিয়ে ক্যাম্পের দরজা দিয়ে গুটি গুটি পায়ে বের হয়ে যায় উপমা। হৈমন্তী ও দ্রুত পিছু নেয় তার। ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে বাইরে ভাঙা মোটা ডালটার উপর চুপচাপ বসে পড়ে উপমা। সবটা এখনও কেমন যেন ঘোরের মতো লাগছে।
– “দেখলি তো, আমার কথাই সত্য হইলো। বলছিলাম তোরে শহুরে ডাক্তারের অভিমান ভাঙা, নাইলে নিজের মনের কথা বইলা দে গিয়া। এখন তো চইলাই গেল সে সবকিছু ছাইড়া। রাখতে পারলি না তারে আটকাইয়া। কি হইত যদি বইলা দিতি সবটা তারে?”
হৈমন্তীর কথা কর্ণপাত হলেও তেমন কোন প্রতিক্রিয়া নেই উপমার মাঝে। আবেগ কি আসলেই তার কাছে আর নেই? তবে কি আর কোনোদিনই পাওয়া হবে না তাকে? বলা হবে না তাকে মনে জমে থাকা অনুভূতির কথা?
৩৬.
– “উপমা হইলো এই খেলার মূল গুটি। তয় যদি এই খেলায় উপমা কোনো হেরফের করে তয় অয়ন্তিকার মতোন ওরেও দুনিয়া থেইকা সইরা যাইতে হইব।”
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে উঠেন ইফতেখার সাহেব। অন্যদিকে ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে একে অপরের মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করেন আমেনা বেগম এবং সজল। ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে তো মনে হচ্ছে কোনো অতীতের ঘটে যাওয়া ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে।
– “কিন্তু উপমা যদি তার আগেই সুযোগ বুইঝা অফিসাররে সব কইয়া দেয়?”
সজলের প্রশ্ন শুনে মাথা তুলে তাকান ইফতেখার সাহেব। চাহনি তার ক্ষিপ্ত, হিংস্র। চাপা কন্ঠে প্রত্যুত্তরে বলে উঠেন,
– “পারব না কইতে! তার আগেই উপমা নিশ্চিহ্ন হইয়া ধুলায় উইড়া যাইব।”
ইফতেখার সাহেবের কথায় শুকনো ঢোক গিলেন আমেনা বেগম। এ তো দেখি ভয়ঙ্কর কিছুর পূর্বাভাস।
নৌকার পাটাতনে বসে সামনের বিশাল জলরাশির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উপমা। হাতে থাকা ছোট ছোট নুড়ি পাথরগুলো বিশাল জলরাশির মাঝে ছুড়ে মারতেই তা মিলিয়ে যাচ্ছে অতলে। হৈমন্তী ও ছিল এখানে। কিন্তু কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই হৈমন্তীর বড় ভাই আসায় তার সঙ্গে বাধ্য মেয়ের মতোন চলে গিয়েছে সে। আজ দিনটাই কেমন যেন অগোছালো, বিষাদময় লাগছে উপমার নিকট।
“দূর হতে আমি তারে সাধিব,
গোপনে বিরহডোরে বাঁধিব।
দূর হতে আমি তারে সাধিব,
গোপনে বিরহডোরে বাঁধিব।
বাঁধন-বিহীন সেই, যে বাঁধন অকারণ;
মায়াবন বিহারিনী।
মায়াবন বিহারিনী হরিণী
গহন-স্বপন-সঞ্চারিণী,
কেন তারে ধরিবারে; করি পণ অকারণ।
#মায়াবন_বিহারিণী ।”
হঠাৎ করেই সুর তোলে উপমা। গলা ধরে আসছে ক্রমশ অজান্তেই। চোখ দুটোও অশ্রুসিক্ত। এই বুঝি বিরহের বেদনা?
– “কেন ডাক্তার মশাই? কেন ছাইড়া চলে গেলেন আমায়? আমি ঠিকই বলছিলাম, চাইলেই কাউরে মায়ার বাঁধনে আটকান যায় না।”
একা একাই বিড়বিড় করে বলে উঠে উপমা। নিস্তব্ধ কোলাহলহীন প্রকৃতি। একটু পরেই ঘোর অমানিশা নেমে আসবে ঐ আকাশে। মৃদু কোলাহলহীনতার মাঝেই কারো আগ্রাসী কন্ঠস্বর কর্ণগোচর হয় উপমার।
– “আর আমি যদি বলি চাইলেই কাউকে নিজের মায়াতে আটকানো যায়? চাইলেই তাকে নিজের করে সারাজীবনের জন্য রাখা যায়?”
পিলে চমকায় উপমা। তড়িৎ গতিতে ঘুরে তাকায় সে। এটা কি কোনো কল্পনা নাকি পুরোটাই বাস্তব? ছুঁয়ে দিলে তা কর্পূরের ন্যায় মিলিয়ে যাবে না তো?…………………
#চলবে
(কেমন হয়েছে জানাবেন।)
#মায়াবন_বিহারিণী ?
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#পঞ্চদশ_পর্ব
৩৭.
– “আর আমি যদি বলি চাইলেই কাউকে নিজের মায়ার বাঁধনে আটকানো যায়? চাইলেই তাকে নিজের করে সারাজীবনের জন্য রেখে দেয়া যায়।”
আগ্রাসী সেই কন্ঠস্বর। পিলে চমকে উঠে উপমা। তড়িৎ গতিতে ঘুরে তাকাতেই কিছুটা থমকে যায় সে। এটা কি কোনো কল্পনা নাকি যা দেখছে তার সবটুকুই বাস্তব? ছুঁয়ে দিলে তা কর্পূরের ন্যায় মিলিয়ে যাবে না তো? সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা অবয়বের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উপমা। তার ভাবনার মাঝেই ছেদ পড়ে অবয়বটির দ্বিতীয় মুখ নিঃসৃত বাক্যে।
– “কি ব্যাপার এভাবেই একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার পরিকল্পনা করে বসে থাকবে নাকি নিজের ডাক্তার মশাইকে একটু ছুঁয়েও দেখবে?”
নিসংকোচ আবেদন তার। আবেগের কথায় ভাবনার ঘোর কাটে উপমার। তাহলে তার ডাক্তার মশাই আসলেই যায় নি? দ্রুত পাটাতন থেকে নেমে পড়ে সে। তার থেকে ঠিক পাঁচ ছয় হাত দূরেই নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে আবেগ। মুখশ্রী জুড়ে তার তৃপ্তির হাসি। দুদিনেই চেহারা, চুল উস্কখুস্ক দেখালেও তার মাঝেও আবেগকে অদ্ভুত আকর্ষণীয় লাগছে উপমার নিকট; যেন এই মুহূর্তে আবেগের চেয়ে সুদর্শন পুরুষ উপস্থিত এখানে আর কেউ নেই। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে আবেগের সামনে দাড়াতেই আবেগ মুচকি হাসে। চোখের ইশারায় তাকে ছুঁয়ে পরখ করে নিতে বললেই আচমকা হালকা শব্দ করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে উপমা। আকস্মিক ঘটনায় কিছুটা হকচকিয়ে যায় আবেগ। ব্যাতি ব্যস্ত হয়ে পড়ে উপমার কান্না করার কারণ খুঁজতে। উপমার চিবুকে আলতো হাতে স্পর্শ করতেই আবেগের হাত তড়িৎ গতিতে সরিয়ে দেয় উপমা। অতঃপর চাপা অভিযোগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠে,
– “ছুঁবেন না আমারে। কেন আসছেন এইখানে? চইলাই তো গিয়েছিলেন; ফেরত আসছেন ক্যান আবার? একবারও মনে পড়লো না আমার কথা? কিভাবে পারলেন না জানাইয়া চইলা যাইতে?”
চোখ জোড়া দিয়ে অশ্রু ক্রমাগত গড়িয়ে পড়ছে উপমার। আবেগও উপমার অভিযোগের কারণ বুঝতে পেরে মুহূর্তেই মুখটাকে চুপসে ফেলে। অতঃপর ক্ষীণ কন্ঠে উপমাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– “যেতে আর পারলাম কই? শ্যামবতীর মায়ায় কেউ যদি একবার ভুল করেও আটকে যায় তাহলে তাকে রেখে ছুটে পালানো যায়?
যেতে তো চেয়েছিলাম সবকিছু পেছনে ছেড়ে; স্টেশন পর্যন্ত চলেও গিয়েছিলাম। তবে কি জানো তো শুধু এই ত্রিমোহিনী না এই ত্রিমোহিনীর চঞ্চল শ্যামবতীর মায়ায় ফিরে আসতে হয়েছে আমাকে। আর যদি নাই বা যেতাম তাহলে বুঝতাম কি করে যে এই ডাক্তার মশাইয়ের প্রেয়সীও ডাক্তার মশাইয়ের প্রেমে পড়ে গিয়েছে?
তো বলো এই ডাক্তার মশাইকে কি নিজের মায়ায় আটকে রাখবে না? রাখবে না নিজের করে চিরদিনের জন্য?”
আবেগের কথা মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকে উপমা। শেষোক্ত আবেদনটি আর নাকোচ করতে পারে না সে। তার অর্থাৎ ডাক্তার মশাই আসলেই তাকে ভালোবেসে। আপ্লুত হয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই আবেগ বিশ্বজয়ের হাসি দেয়। নিজের বাহু দুটো উপমার উদ্দেশ্যে প্রসারিত করে দিতেই উপমাও সংকোচ না করে এগিয়ে গিয়ে আবেগের বক্ষে নিজের মাথা অতি সন্তর্পণে গুঁজে দেয়। আবেগও যত্নে আগলে নেয় নিজ প্রেয়সীকে।
৩৮.
গোধূলির শেষ লগ্ন। পশ্চিমা আকাশে লাল সূর্য প্রায় নিশ্চিহ্ন। পাখিদের আনাগোনা আর কিচিরমিচির নেই বললেই চলে। সবুজ ঘাসের উপর থাকা বড় গাছের ডালের উপর পাশাপাশি বসে আছে উপমা আর আবেগ। দুজনের দৃষ্টিই সামনে থাকা নদীর স্রোতে আবদ্ধ। বাতাসের তীব্র শো শো বাতাসের মধ্যে খোলা এলোকেশী চুলগুলো কপাল হতে সরিয়ে নিয়ে মৃদু কন্ঠে নীরবতা ভাঙে উপমা।
– “তাইলে কবে ফিরতেছেন শহরে?”
উপমার হঠাৎ প্রশ্নে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আবেগ। উপমার চোখে মুখে কেমন যেন অদ্ভুত বিষন্নতা পরিলক্ষিত করে সে। বিষন্ন হওয়ারই কথা। প্রিয় মানুষটির থেকে দূরে থাকার মতো বেদনা জগতে আর কোথাও নেই। তবুও ভারাক্রান্ত মন নিয়ে প্রত্যুত্তরে বলে উঠে,
– “এইতো পরশুদিন ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই ঢাকার ট্রেনে চলে যাব।”
আবেগের কথায় পরক্ষণেই উপমার মন মিইয়ে যায়। কি হতো যদি এমন কোনো উপায় থাকত; যা দিয়ে দুনিয়ার বাদবাকি সব নিয়মের উর্ধ্বে গিয়ে ভালোবাসার দুটো মানুষ একসঙ্গে থাকতে পারত আজীবন।
– “আর আসবেন না এইখানে? আসবেন না নিজের প্রেয়সীরে দেখতে? আর কি দেখা হইব না আমাদের?”
উপমার সন্দিহান প্রশ্ন আবেগের হৃদয়কে আরো একধাপ বিষন্ন করে তুলে। ছোট এই তিনটি বাক্যের মধ্যেও যেন রাজ্যের বিশাল দুঃখ লুকিয়ে রয়েছে।
– “চিন্তা করো না, আমি শীঘ্রই ফিরে আসব। ফিরে আসব আবারো তোমার কাছে। কিছুদিন সময় লাগবে; তবে তোমার ভালোবাসার উপর বিশ্বাস রাখো। তোমার ডাক্তার মশাই তার প্রেয়সীর কাছে ফিরে আসবেই এবং তাকে সাথে করেও নিয়ে যাবে।”
আবেগের কথায় উপমা এক দৃঢ় বিশ্বাস খেয়াল করে। কিন্তু মন তার অজানা কু গাইছে। তবুও আবেগকে কোনো কিছু বুঝতে না দিয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই বিনিময়ে মৃদু হাসে আবেগ।
– “সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে তো চঞ্চল শ্যামবতী; চলো যার যার নীড়ে ফিরে যাওয়া যাক।”
আবেগের কথায় খিলখিল করে হেসে উপমা। আবেগকে মাঝেমধ্যে তার নিকট হাস্যরসাত্মক মনে হয়। তবে তার বলা কথাও ঠিক। বেশ দেরি করে ফিরলে বাড়িতে যে আমেনা বেগমের হাজারটা কটু কথা শুনতে হবে তা ভালো করেই জানে সে। শাড়ির আঁচল গুটিয়ে উঠে দাড়াতেই আবেগ খপ করে উপমার বাম হাত ধরে বসে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলেও তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় উপমা।
শার্টের পকেট হতে একটা পেন্ডেন্ট বের করে উপমার দিকে এগিয়ে দিতেই অবাক হয় সে।
– “এটা আমার মায়ের। মা যখন আমার কাছে থাকে না তখন এটা আমার সাথে সবসময় থাকে। আর এটা থাকলে মনে হয় যে মা আমার আশেপাশেই রয়েছে।
তাই এটা তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি, যে কদিন আমি থাকব না ততদিন এটা তোমার কাছে থাকবে। আর এটা থাকলে নিশ্চয়ই আমার জন্য অতটাও মন খারাপ হবে না।”
আবেগের দিকে কৃতজ্ঞতা মূলক দৃষ্টিতে তাকায় উপমা। একটা মানুষের কাছে ঠিক এতটাও গুরুত্ব পাওয়ার মতো সৌভাগ্য হয়েছে বলেই মন খুশিতে আপ্লুত হয় তার। বিনিময়ে নিশ্চুপ ভাবেই সেটা গ্রহণ করে সে। খানিকটা সামনে এগিয়ে যেতেই দুজনের পথ ক্রমশ আলাদা হতে থাকে। দুজন দুদিকে। মাঝখানের এই দূরত্ব কি আদৌ কমবে নাকি কে জানে?
৩৯.
বাড়িতে বেশ কিছুক্ষণ আগেই ফিরেছে উপমা। আমেনা বেগম ও কটুক্তি শোনাতে কোনো কমতি রাখেন নি। কিন্তু সেগুলো গায়ে মাখেনি সে। একা একাই বিড়বিড় করতে করতে টর্চ লাইট জ্বালিয়ে বাইরের দিকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যান আমেনা বেগম। এই অসময়ে কোথায় যেতে পারে এই নিয়ে ভাবনায় মগ্ন হয়ে পড়ে। টেবিলের উপর বসে বই পড়ায় ব্যস্ত পূর্ণা। পাশেই থাকা ড্রায়ারের ভেতরে থাকা ডায়েরী বের করে নেয় উপমা। কয়েক পাতা উল্টাতেই কিছু শুকনো ফুল আর পায়েল চোখে পড়ে তার। অতি সন্তর্পণে আজকের দেয়া আবেগের সেই লকেটটাও সেটার মধ্যে লুকিয়ে রাখে। দিন দিন প্রিয় জিনিসের তালিকা গুলো ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে কোনো একটা হারিয়ে গেলে বড়ই বিপদ। তাই সেগুলো সাবধানে আবার পুনরায় ড্রয়ারে রেখে দরজার কাছে যেতেই চোখ পড়ে ইফতেখার সাহেবের উপর। গায়ে শাল জড়িয়ে কোথায় যেন চুপিসারে যাচ্ছেন তিনি? কিন্তু কোথায়? একটু আগে তো আমেনা বেগম ও বেরিয়ে গেলেন। কি হচ্ছে আজ এসব? ব্যাপারটা নিয়ে এগোতেই সকালের চাচীর কথা মনে পড়ে যায় তার। আচ্ছা এখন তো কেউ নেই বাড়িতে। একবার যদি ইফতেখার সাহেবের রুমে যাওয়া যায় তাহলে তো একটু খোঁজ করে অয়ন্তিকার মৃত্যুর ব্যাপারে কিছু একটা তো জানাও যেতে পারে।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। ইফতেখার সাহেব বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে যেতেই উপমাও চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে ইফতেখার সাহেবের রুমের দরজায় এসে দাঁড়ায়। অতঃপর আশপাশে একবার তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা অতি সন্তর্পণে খুলে ভেতরে প্রবেশ করে সে। রুমের লাইটটা জ্বালানোই আছে; তাই আর কষ্ট করতে হয় নি। ঘরের কোণে একটা মাঝারি আকারের আলমারি আর অপর পাশে একটা বেশ পুরনো সিন্দুক আছে। প্রথমেই আলমারির কাছে চলে যায় সে। সচরাচর এই রুমে কেউ আসে না বলে আলমারির সাথে চাবি ঝোলানোই রয়েছে। চাবি ঘোরাতেই একপাশ খুলে যায় আলমারির।
ভেতরে একপাশে কয়েকটা দামি কাপড় চোপড়, গয়নার বাক্স আর অন্যপাশে কয়েকটা টাকার বান্ডিল। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ভালো করে খুঁজেও কিছু চোখে পড়ে না উপমার। তাই সেটা দ্রুত বন্ধ করে সিন্দুকের কাছে চলে যায় সে।
সিন্দুকের উপরিভাগ বেশ ভারি হওয়ার প্রথমে একটু কষ্ট হয় উপমার। কিন্তু পরক্ষণেই সেটা উপরে তুলতেই সাদা কাপড়ে বাঁধা গাট্টি বোঁচকা চোখে পড়ে তার। দ্রুত সেগুলো তল্লাশি করার জন্য গিট খুলতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে ভয়াবহ জিনিস যা দেখতেই এক মুহূর্তের জন্য আঁতকে উঠে উপমা।
বিভিন্ন ধরনের ছুরি, বন্দুক, আর প্যাকেটে কিছু সাদা গুঁড়ার অংশ। তবে কি অফিসার আমানের বলা কথা কি সত্যিই?
কম্পিত হাত দিয়ে অপর পাশের বোঁচকায় গিট খুলতেই বেরিয়ে আসে রক্ত মাখা একটি বড় দা, সেখানেই এখনো রক্তের ছাপ লেগে আছে সাথে করে বাঁধা এক টুকরো কাপড়। যা দেখে অস্ফুট স্বরে উপমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে,
– “অ,অয়,অয়ন্তিকা মা!”……………….
#চলবে