মায়াবন_বিহারিণী ?,১৬,১৭

0
660

#মায়াবন_বিহারিণী ?,১৬,১৭
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#ষোড়শ_পর্ব

৪০.
রুমের মধ্যে সেই কখন থেকেই এসে বিছানায় এককোণে গুটিসুটি মেরে বসে আছে উপমা। ভয়ে আর আতংকে শরীর বারবার কেঁপে উঠছে। সেই দৃশ্য, সেই রক্ত মাখানো দা এর কথা মনে পড়তেই গা শিউরে ওঠে তার। উপমার এমন পরিবর্তিত করুণ অবস্থা পরিলক্ষিত হতেই পূর্ণা দ্রুত এগিয়ে যায় উপমার নিকট। বেশ কয়েকবার এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেও তেমন কোনো ভাবান্তর ঘটে না উপমার মাঝে। হঠাৎ কাঁধে জোরে ঝাঁকুনি পড়াতে হকচকিয়ে উঠে উপমা। ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে আসে। সামনে মাথা তুলে তাকাতেই খেয়াল করে পূর্ণা তার দিকেই ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।
– “কি হইছে বুবু? তোর মুখখানা এমন শুকাইয়া গেছে ক্যান? একটু আগেও তো সব ঠিক ছিল। আর তুই এমন দরদর‌ কইরা ঘামতে‌ছিস ক্যান?”

আসলেই তো। পুরো শরীর ঘর্মাক্ত হয়ে গিয়েছে উপমার। কি করে পূর্ণাকে বলবে যে একটু আগে ঠিক কি দেখে এসেছে সে? আজ এতগুলো বছর পর অয়ন্তিকার মৃত্যুর এত বড় একটা বিষয় খোলাসা হওয়ার মতো ঘটনার সম্মুখীন হতেই অনেকটাই শক খেয়েছে সে। আর অন্যদিকে ইফতেখার সাহেব এসব কিছু জানা সত্ত্বেও ঠিক এমন ভাবখানা ধরে বসে আছেন যেন এর কোনোকিছুই তিনি জানেন না। অথচ এসব করার পেছনে ইফতেখার সাহেবের হাত যে আছে সেটা খুব ভালো করেই জানে উপমা। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে না এখনি সবটা পূর্ণাকে সবটা জানানো যাবে না।
এমনিতেই ইফতেখার সাহেব আর আমেনা বেগম মোটেও সুবিধার নয়। যখন নিজের স্বার্থের জন্য অয়ন্তিকাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে তাকে এতিম করে দিতে দ্বিধাবোধ করেননি তখন এর কোনো নিশ্চয়তা নেই যে তাকে আর পূর্ণার কোনো ক্ষতি করবেন না ইফতেখার সাহেব। তার এই সব অপকর্ম ফাঁস করতে হলেও সুনির্দিষ্ট কিছু প্রমাণ প্রয়োজন আর এ সময়ে এসব প্রমাণ যোগাড় করতে একজনই সহায়তা করতে পারে উপমাকে; অফিসার আমান!

ঘড়ির কাঁটায় রাত সাড়ে এগারোটা ছুঁই ছুঁই। রুমের মধ্যে জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে উপমা। চোখে ঘুম নেই তার। কালকের দিনের মধ্যে যা করার তাই করতে হবে। জল বেশিদূর গড়িয়ে পড়লে নিজেরই বিপদ। তখনই বাইরে থেকে ইফতেখার সাহেবের কর্কশ কন্ঠস্বর কানে ভেসে আসতেই পিলে চমকে উঠে উপমা। এমন অসময়ে তাকে হাঁক ছেড়ে ডেকে পাঠানোর কারণ খুঁজে পায় না সে। আচ্ছা একটু আগেই যে সে ইফতেখার সাহেবের রুমে গিয়ে তল্লাশি করেছে তা কোনোভাবে টের পাননি তো তিনি? ভাবতে ভাবতেই গলা ক্রমশ শুকিয়ে আসে উপমার। ইতোমধ্যে দ্বিতীয় বার ডাক পড়ে গিয়েছে ইফতেখার সাহেবের। আমেনা বেগম ও একই সুরে ডেকে যাচ্ছেন। ঘুমন্ত পূর্ণাও যেন ধড়ফড় করে উঠে পড়ে বিছানা হতে।
সদর দরজায় কড়া নাড়তেই এগিয়ে গিয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে দেয় উপমা। বাইরেই আমেনা বেগম সরু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। উপমার দরজা খুলতেই তার মুখ ছুটে।
– “কি রে‌ মুখপুড়ি‌; কানে কি তালা মাইরা বইসা আছোস? সেই কখন থেইকা তোর বাপে হাঁক পাই‌ড়া ডাকতে‌ছে। নবাবজা‌দীর মতোন ধীরে সুস্থে উঠতেছি‌স যেন কানেই শুনি‌স না।”

উপমার আর মন চাইল না আমেনা বেগমের বলা কড়া কথাগুলোর জবাব দিতে। তাকে পাশ কাটিয়ে সামনে যেতেই চোখ পড়ে ইফতেখার সাহেবের উপর। বারান্দায় মোড়া পেতে তামাক খেতে ব্যস্ত তিনি। এমন সময়ে উপমা সামনে এসে উপস্থিত হতেই মাথা তুলে তাকান ইফতেখার সাহেব।

– “আইজকাল দেখতেছি তোর পা‌খ একটু বেশিই গজায় গেছে। সারাদিন বাড়ির বাইরে এদিকে সেদিকে, ক্যাম্পে কিসের কাম? আর শুনলাম হৈমন্তীর ভাই আমজাদ নাকি তো‌গোর লাইগা বড় পড়াশোনার ফরম আনছে? তয় কান খুইলা শুইনা রাখ তুই শহর ক্যান এই গ্রাম তন ই বাইর হইতে পারবি না। শুধু তখনই বাইর হইবি যখন এই বাড়ি থেইকা তোর বিয়ার পালঙ্ক যাইব।”
ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে চোখ দুটো ভারী হতে শুরু করে উপমার। ভাগ্যের কি এমন চক্র যে আজ তাকে এই অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে। তবে এই মুহূর্তে সামনে থাকা মানুষটির সামনে দুর্বল হলে চলবে না।

৪১.
– “তোমার কাছে‌ এইস‌বের জবাবদিহিতা দিতে আমি বাধ্য না যে সব তোমারে কইতে হইব। আর‌ রইলো আমার পড়ালেখার কথা? তাইলে শুইনা রাখ আমি আমার স্বপ্নের মধ্যে কোনো সম্পর্ক মানব না। আমার পড়ালে‌খাও হইব আর স্বপ্ন ও পূরণ হইব। তাতে বাধা দিতে যাইয়া নিজের বিপদ ডাইকা আনবেন না আশা করি।”
উপমার তীক্ষ্ণ প্রশ্নোত্তর। ইফতেখার সাহেব কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন উপমার দিকে। বৈশিষ্ট্য, কথাবার্তা, চালচলন ইত্যাদি দিক থেকে যেন দ্বিতীয় অয়ন্তিকা। আর অয়ন্তিকার এমন কিছু বোকামি‌র জন্যই তাকেও প্রাণ হারাতে হয়েছে। এখন সেই পুনরাবৃত্তি যাতে উপমার সাথেও না ঘটে তাই মনে মনে চিন্তা করেন ইফতেখার সাহেব।
উল্টো মুখে ঘরের দিকে পুনরায় চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ইফতেখার সাহেব পুনরায় গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠেন,

– “দাবা গুটির খেলায় নিজের অপর খেলোয়াড়ের কৌশলরে ভুল কই‌রাও দুর্বল ভাইবা তুচ্ছ করন লাগে না বুঝলি উপমা? যদি প্রাণে বাঁচতে চাস তাইলে সবকিছু আমার মোতাবেক চলতে হইব আর না হইলে সেই বাড়ির পেছনের নর্দমা আবার ও রক্তাক্ত হইব। তয় এইবার সেইখানে অয়ন্তিকার জায়গায় থাকব অন্য কেউ। হয় তুই আর না হয় পূর্ণা।”

পা দুটো থমকে যায় সেখানেই উপমার। পুরো শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। ইফতেখার সাহেবের আচরণ দেখে না যতটা অবাক হচ্ছে তার চেয়ে বেশি অবাক হচ্ছে তার কথা শুনে। কি নিদারুণ ভাবে সে তার স্ত্রীর হত্যার বর্ণনা দিয়ে চলেছে; তার উপর দ্বিতীয়বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করার হুমকিও দিচ্ছে! ভাবা যায় এসব? ক্ষমতার লোভে নিজ সন্তানকে ও হত্যা করতে বোধহয় পিছপা হবেন না তিনি।

না এভাবে চলতে দেয়া যাবে না। পূর্ণা আর তার উভয়ের জীবনই এখন সংকটে আছে। আর যতদূর বোঝা যাচ্ছে তার এ লড়াই খুব একটা সহজ হবে না। আচ্ছা ইফতেখার সাহেবের মুখোশ সে সবার সামনে টেনে খুলতে পারবে তো? অন্যদিকে দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে সবটাই শুনে নেয় পূর্ণা। বারো বছর বয়সী মেয়েটার মনেও বাবা নামক শব্দটার প্রতি একরাশ ভয় আর ঘৃণা সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। আর এক পা ও দাঁড়ায় না উপমা সেখানে। দ্রুত বড় বড় পা ফেলে রুমের দিকে চলে যায় সে; যা পরিলক্ষিত হতেই মৃদু হাসেন ইফতেখার সাহেব যার অর্থাৎ তার তৈরি করা পরিকল্পনা সঠিক ভাবেই এগোচ্ছে।

৪২.
বারান্দায় বিনা বিরতিতে একপাশ থেকে অন্যপাশে হেঁটে চলেছে আবেগ। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ চোখে ঘুমের রেশ নেই বললেই চলে। ভেতরে ভেতরে কেমন যেন অস্থিরতা বিরাজ করছে। কিন্তু সেটার কোনো নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পায় না সে। তার ক্রমশ হাঁটার মাঝেই ছেদ পড়ে ডক্টর সায়ানের‌ কথা শুনে।
– “কি ব্যাপার ডক্টর আবেগ? আজ আপনাকে একটু বেশিই স্ট্রেসড‌ দেখাচ্ছে। কেন প্রেমিকাকে নিজের মনের কথা বলতে গিয়ে ব্লাড প্রেশার আবার হাই হয়ে যায় নি তো?”

লাস্টের বাক্য কিছুটা মজার ছলেই বলে উঠে ডক্টর সায়ান। আবেগ ও মৃদু হাসে তার কথায়। অতঃপর মাথা খানিকটা চুলকে ইতস্তত স্বরে বলে উঠে,
– “আসলে আপনি যা ভাবছেন তেমন কিছুই না ডক্টর সায়ান। ঘুম আসছিল না তাই একটু হাঁটাহাঁটি করছিলাম।”

আবেগের কথায় সায়ান না হেসে পারে না। অতঃপর আবেগের কাঁধে হাত রেখে বলে উঠে,
– “আরে ইয়াং ম্যান ডোন্ট ওয়ারি! এমনটা হয় এসময়। প্রেমে পড়লে সারাদিন ভেতরে অস্বস্তি লাগবে, প্রেয়সীকে চারপাশে অনুভব করবেন সবসময়। তবে ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে।”
আবেগের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলেই সেখান থেকে প্রস্থান করে সায়ান। আবেগ ও কিছু একটা ভাবতে ভাবতেই সেখানে রাখা ইজি চেয়ারটাতে বসে পড়ে এবং বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে যেন প্রকৃতির রূপ অতি দ্রুতই পরিবর্তন হতে চলেছে।

কাকডাকা ভোর। চারপাশে সবে মাত্র ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। চোখে কিছু টা আলোর রেশ এসে লাগতেই চোখ দুটো পিটপিট করে তাকায় উপমা। মাথাটা বেশ ঝিমঝিম করে উঠেছে। গত রাতে শেষের দিকে কখন যে চোখ জোড়া লেগে এসেছিল তা খেয়াল নেই তার। অন্যদিকে বিছানায় এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছে পূর্ণা। একপলক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দ্রুত উঠে পড়ে উপমা। জানালার এক প্রান্ত অতি সন্তর্পণে খুলে উঠোনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে। চেয়ারম্যান প্রার্থীর কাজ নিয়ে আজও বেশ কয়েকজন বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে। হয়তো বা দু তিন দিনের মধ্যেই তিনি নির্বাচনে দাঁড়াবেন। আর এসব কাজে ইফতেখার সাহেব ব্যস্ত থাকায় উপমার করা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একটু বেশিই সুবিধা হবে। দ্রুত গোছগাছ করে রুম থেকে বাইরে বের হতে যাবে তখনই চোখ পড়ে টেবিলের উপর পড়ে থাকা ডায়েরির উপর। এটা তো গতরাতে টেবিলের ভেতরে রাখাই হয়নি। কেউ দেখে ফেললে সে আবার এক বিরাট সমস্যা।
দ্রুত সেটা টেবিলের উপর রেখে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে সবার লোকচক্ষুর আড়ালে। যে করেই হোক আজ সবটার হিসেব নিকেশ করতেই হবে।

– “এই একমাত্র ক্ষমতার লোভই আপনার ভরাডুবির কারণ হইব চেয়ারম্যান সাহেব।”
ইফতেখার সাহেবের দিকে একপলক তাকিয়ে বিড়বিড় করে উপমা। অতঃপর আড়ালেই বেরিয়ে পড়ে চৌকাঠের ওপারে।…………..

#চলবে ?

#মায়াবন_বিহারিণী ?
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#সপ্তদশ_পর্ব

৪৩.
পথিমধ্যে হেঁটে চলেছে উপমা। যেই পরিকল্পনা মোতাবেক বাড়ি থেকে সে বেরিয়ে ছিল তাতে কিছুটা হলেও হৈমন্তীর প্রয়োজন ছিল। গ্রামের শেষ মাথায় অফিসার আমানের দারোগা অফিস। এতদূর পথ একা একা চললে ফিরতে বেশ বেলা হয়ে যাওয়ার আশংকায় হৈমন্তীর বাড়িতে গিয়ে জানতে পারে হৈমন্তী আজ তার ভাইয়ের সঙ্গে সদরে গিয়েছে বেশ আগেই। পরিবারের একজন অন্যতম সদস্য অসুস্থ হওয়ার ফলস্বরূপ পুরো বাড়ি জনশূন্য বললেই চলে। তাই একরাশ মন খারাপ করেই সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে সে। ইশ্ এমন যদি হতো এখন হুট করেই অফিসার আমানের সাথে দেখা হতো তাহলে?
সেই ভাবনায় পুনরায় উত্তরের সুদূর পথ ধরে পা বাড়ায় উপমা।

আজকে বেশ সকালে উঠেই আবেগ বের হয়েছিল হাঁটতে। আজকেই তো এখানে তার শেষ দিন। কাল ভোরের পূর্বেই চলে যেতে হবে এই প্রিয় জায়গাটির মায়া কাটিয়ে আবারো সেই যান্ত্রিকতার শহরে। তবুও এই কয়েকদিনের সফর চির স্মরণীয় করে রাখার মত। এই অল্প কয়েকদিনেই ত্রিমো‌হিনীর আবহাওয়ার সাথে সে মিশে গিয়েছে। সাথে করে প্রাপ্তির খাতায় ও যোগ হয়েছে সবচেয়ে মূল্যবান উপহার। তার প্রেয়‌সী। হ্যাঁ, উপমাকে তো সে পেয়েছে এই ত্রিমোহিনী‌র মাধ্যমেই। আচ্ছা এখান থেকে যখন চলে যাবে তখন তার প্রেয়সীর দেখা পাবে কি করে? সেই চঞ্চলতা, মায়াবী চোখজোড়া, মৃদু হাসির রেখা এসব তো আর রোজ রোজ দেখতে পারবে না সে। এসব কল্পনা করতেই হৃদয় ধীরে ধীরে বিষন্নতার রূপ নেয় আবেগের। ততক্ষণে সে সায়ানের সাথে ক্যাম্পে পৌঁছে গিয়েছে। আজ উপমা আসবেনা? চোখ জোড়া আশপাশে একবার ভালো করে বুলিয়ে নেয় আবেগ। না উপমার কোনো হদি‌সই নেই। হয়ত এখন আর দেখা পাওয়া যাবে না চঞ্চল রমণীর।

– “উপমা তো বাড়িত নাই। যদি আসলেই কিছু কইরা বসে? চালচলন তো অয়ন্তিকার মতোনই। সবখানে নাক গলা‌নির স্বভাব আর উড়ু উড়ু ভাব।”
ইফতেখার সাহেবের দিকে সরু দৃষ্টিতে চেয়ে সন্দিহান গলায় বলে উঠেন আমেনা বেগম। ঘরে বসে সবে মাত্র মুখে একটা পান পুরে ছিলেন ইফতেখার সাহেব। আমেনা বেগমের কথায় তিনি তুখোড় দৃষ্টে আমেনা বেগমের দিকে তাকান। অতঃপর বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলে উঠেন,
– “তোমরা মাইয়া মাইনষের জাতটাই খারাপ। সব বিষয়েই বা হাত ঢুকাইয়া নিজের নির্বুদ্ধিতার কারনামা‌ দেখাও। যা যেমন চলতেছে তারে তেমনই চলতে দাও।”
এটুকু বলেই থামেন তিনি। পুনরায় কিছু একটা ভাবতেই তার ঠোঁটের কোণে পৈশাচিক হাসির রেখা ফুটে ওঠে।
– “বাদবাকি রইলো উপমা? অয়ন্তিকার উড়ু উড়ু ভাব যেমন তার ডানা ছাটতে‌ই চইলা গিয়াছি‌ল প্রয়োজনে উপমার পরিণতি ও একই হইব।”

আমেনা বেগম ও ইফতেখার সাহেবের কথায় ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসেন। ততক্ষণে রুমের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পড়ে গিয়েছে। সামনে চোখ তুলে তাকাতেই খেয়াল করে সজল হাতে একটা ব্যাগ এবং প্রয়োজনীয় কিছু সামগ্রী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইফতেখার সাহেব চোখের ইশারা দিতেই দাঁত কেলিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে সজল। বাঁকা চোখে একবার আমেনা বেগমের দিকে তাকাতেই তিনি পানের বাক্স নিয়ে রুম থেকে হুড়হু‌ড় করে বেরিয়ে যান। আর পরক্ষণেই শুরু দুজনার মধ্যবর্তী আলাপ আলোচনা।

৪৪.
– “আপনাগো বড় সাহেব, লম্বা, ফর্সা কইরা থাকা বড় স্যা‌রটা কি এহন আছে?”
চঞ্চল চোখ দুটো আশপাশে ভালো করে বুলিয়ে নিয়ে সামনে থাকা দারোগা‌কে উদ্দেশ্য করে বলে জিজ্ঞাসা করে উঠে উপমা। থানায় নতুন ট্রান্সফার কৃত দারোগা কুদ্দুস একবার ভালো করে পরখ করে নিলেন উপমা কে।
মেয়েটার উৎসুক কন্ঠ মোটেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। আর এখানে এত পুলিশ থাকতে অফিসার আমানকেই প্রয়োজন কেন তার। তাই স্বাভাবিক ভাবেই তিনি বলে উঠলেন,

– “বড় সাহেব এখন নাই। আলী মিয়ার লগে পাশের গঞ্জের এক জায়গায় গেছে তদন্ত তল্লাশি করবার জন্যে। তয় আপনে এহেনে? কোনো মামলা, মোকাদ্দমা করতে হইলে এহেনে আরো বড় স্যার রা আছে।”
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার কথা শুনে মুহুর্তেই মনের মধ্যে থাকা আশাগু‌লোকে দূর দূর করে পালিয়ে যেতে দেখলো উপমা। হাতে তো একদমই সময় নেই। এতদূর সাহস করে চলে আসাটা কি তবে বিফলে গেল? অফিসার আমানের সাথে এত জরুরি কথা এখন বলবে কি করে তাহলে সে!
তবুও নিরাশ ভঙ্গিমায় সেই কুদ্দুস দারোগা কে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “না থাক, দরকার নাই। তয় বড় স্যার আসতে কতক্ষণ সময় লাগব।”

উপমা ভেবেছিল এবার আশানুরূপ কোনো উত্তর পাবে সে। কিন্তু তার ধ্যানধারণায় পানি দিয়ে কুদ্দুস দারোগা বলে উঠেন,
– “সঠিক জানি না। কিন্তু মনে হয় না বড় সাহেব বিকেলের আগে ফেরত আসব। শুনছি কোন বাড়িতে জানি খুন খারাবি‌ নিয়া মামলা হইছে। সেইখা‌নেই গেছে সে।”
এবার উপমা পুরোপুরি হতাশ হলো। এখন প্রায় মধ্যদুপুর। বিকেলে যদি অফিসার আমান আসে তবে বাড়ি ফিরতে ফিরতে নিশ্চিত রাত হয়ে যাবে। আর ইফতেখার সাহেবের মতো তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ যদি একবার সন্দেহ করে বসে তার উপর তাহলে আর রেহাই নেই। অবশ্য এসবকে বুদ্ধির আওতায় আনা যায় না। এসবকে বড়জোর কুবুদ্ধির খাতায় হস্তান্তর করা যাবে।
তাই কুদ্দুস দারোগার‌ কথা শুনে একপ্রকার মন খারাপ নিয়েই থানা হতে বের হয়ে পড়ে উপমা। আজকের তৈরি করা এত সুন্দর একটা পরিকল্পনা যে এভাবেই নষ্ট হয়ে যাবে তা কে জানতো? তবে যাই হোক না কেন অফিসার আমানকে এসব সম্পর্কে খুব শীঘ্রই অবগত করা প্রয়োজন।
গ্রামবাসীর সবাইকে ঘুরে ঘুরে প্রার্থী পদের ভোটের পেপার বিলা‌চ্ছেন ইফতেখার সাহেব। গ্রামবা‌সীও তেমন একটা আগ্রহ না দেখালেও একপ্রকার বাধ্য হয়েই তা গ্রহণ করছে। তারা খুব ভালো করেই জানে ইফতেখার সাহেবের ক্ষমতা সম্পর্কে। এবারও বিভিন্ন অসৎ উপায় অবলম্বন করে তিনিই চেয়ারম্যান পদে জয়ী হবেন এটা সম্পর্কে অবগত গ্রামবাসী।
অন্যদিকে সূর্য মাথার একপাশে হেলে পড়েছে অনেকটা। রৌদ্রের প্রখরতা কমে গিয়ে মৃদু শীতল বাতাস বইতে শুরু করেছে আশপাশ জুড়ে। উত্তরের রাস্তা ধরে পুনরায় একই পথে হেঁটে আসে উপমা। কিন্তু তার মাঝেই একটা বাড়ির সামনে থাকা বাঁশঝাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে দেখতে পেয়েই থমকে দাঁড়ায় উপমা। চোখ দুটো যেন বিশ্বাস করতে চাইছে না। তবুও এ অবিশ্বাসের মাঝে মৃদু হাসির রেখা ফুটে তার হতাশায় নিমজ্জিত মুখশ্রীতে।

৪৫.
ক্যাম্পের অনেকটা কাছাকাছি চলে আসায় উপমার টনক নড়ে ওঠে। মনে পড়ে যায় আবেগের কথা। আজ তো তার সাথে একটিবার দেখা করা ভীষণ প্রয়োজন। আর একটা রাত পরেই তো মানুষটা তাকে ছেড়ে আবার শহরে পাড়ি জমাবে। কতদিন, কতকাল পর দেখা হবে নাকি আর কোনোদিনই দেখা হবে না এই শঙ্কায় পড়ে যায় উপমা। তবুও কেন যেন সেদিকে আর পা বাড়াতে মন চাইলো না তার। একে তো শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই তার উপর মাথা ভর্তি ভারী ভারী চিন্তা। এই নিয়ে আর আবেগের সামনে মুখোমুখি হওয়া সম্ভব নয়। তাই সেদিকে না গিয়ে সোজা বাড়ির রাস্তায় পা বাড়ায় উপমা।

অন্যদিকে চলতি ঘড়ির কাঁটার দিকে বাঁকা চোখে তাকায় আবেগ। সময় তো প্রায়ই শেষ। হাতে গোনা দু একটা রোগী আছে ক্যাম্পে। আজই তার শেষ ডিউটি এখানে। শুধু তার না আরোও বেশ কয়েকজনেরই‌। তাই‌ আজ শেষ দিনে রোগীদের চাপ একটু বেশিই ছিল। কিন্তু এতসব মানুষের মাঝেও তার চোখ জোড়া অন্য কাউকেই খুঁজছিল। কিন্তু বারবার হতাশা তাকে জানান দিয়ে দেয় যে, ‘না তোর প্রেয়সী আসেনি আজ’। আচ্ছা উপমা কি কোনোভাবে ভুলে গিয়েছে যে আজকেই তাদের শেষবারের মতো দেখা হলেও পারত। কিন্তু উপমা তো এমন মেয়ে নয়। ভাবতে ভাবতেই উপমার প্রতি কিঞ্চিৎ পরিমাণ অভিমান জমা শুরু করে আবেগের হৃদয়ে। তার ধ্যানধারণায় ছেদ পড়ে ডক্টর সায়ানের‌ ডাকে।
– “ডক্টর আবেগ, আর ইউ ওকে? চলুন এবার, সময় শেষ আমাদের। বাড়িতে গিয়ে রেস্ট নিয়ে প্যা‌কিং শুরু করতে হবে ফের। কাল ভোরেই ঢাকার ট্রেনে ব্যাক করতে হবে।”

সায়ানের‌ কথা শুনে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় আবেগ। অতঃপর টেবিল ছেড়ে উঠে উপস্থিত সবার সাথে শেষ একবার কুশল বিনিময় করে সায়ানের সঙ্গে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে পড়ে।

বাড়ি ফেরার পর চারপাশের পরিবেশ বেশ শান্ত শীতল দেখে বেশ খানিকটা চমকা‌য় উপমা। গুটি গুটি পায়ে রুমের ভেতরে প্রবেশ করতেই খেয়াল করে আমেনা বেগম সযত্নে বসে পূর্ণাকে‌ খাইয়ে দিচ্ছেন। এমন দৃশ্য পরিলক্ষিত হতেই চোখ কোট‌র থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম উপমার। সাথে করে সন্দেহ আরো এক ধাপ গাঢ় হয় তার। আমেনা বেগম তার ঘরে? তার উপর তিনি নিজ হাতে পূর্ণাকে খাইয়েও‌ দিচ্ছেন! এও কি আদৌ সম্ভব। কেননা পূর্ণার জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায়শই দায়িত্ব উপমা নিজ হাতেই পালন করেছে। অপরদিকে উপমাকে সদর দরজায় মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমেনা বেগম আদুরে গলায় বলে উঠেন,
– “আহা বাইরে দাঁড়ায় আছিস ক্যান? সন্ধ্যা হইয়া গেছে। যা কলপা‌ড় থেইকা হাত মুখ ধুইয়া আয়। আমি খাওন বাইড়া দিতাছি।”
এবার উপমা নিশ্চিত যে এসব কোনো মমতাময়ী মায়ের স্নেহ না বরং কোনো গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ মাত্র। কোনো কথা না বলে রুমে প্রবেশ করে চেয়ারের উপর থাকা একটা শাড়ি আর গামছা নিয়ে দ্রুত চলে যায় বাহিরে।…………….

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here