মায়াবন_বিহারিণী ?,পর্ব-২১(অন্তিম ২য়),পর্ব:২১(অন্তিম ৩য়)

0
1113

#মায়াবন_বিহারিণী ?,পর্ব-২২(অন্তিম ২য়),পর্ব:২৩(অন্তিম ৩য়)
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#দ্বাবিংশ_পর্ব (অন্তিম খন্ডাংশ-২)

৫৬.
তড়িঘড়ি করে রুমটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় উপমা। বাইরে থেকে বারবার অফিসার আমান ডেকে চলেছে। কিন্তু হাতে যে সময় একদমই নেই। বড়জোর আর পাঁচ সাত মিনিট রয়েছে। এরই মাঝে পূর্ণাকে নিরাপদে এখান থেকে বের করতে হবে তার। ভেবেই দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে উপমা। চারপাশে মাকড়সার জাল বাজেভাবে বিশালাকারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তার উপর ধুলোর গন্ধ তো আছেই। অনেক বছর বন্ধ থাকায় ভেতরে যেতেই একটা উটকো গন্ধ এসে নাকে বিঁধলো উপমার। এই জায়গায় পূর্ণাকে‌ খুঁজে পাবেই বা কি করে। একে একে পুরো আলমারি, পুরনো দিনের মটকা, খুঁজে পেলেও পূর্ণাকে আর খুঁজে পেল না উপমা। এবার সত্যিই কান্না পাচ্ছে তার। বেশি দেরি হলে যে অয়ন্তিকার মতো পূর্ণাকেও‌ হারিয়ে ফেলবে সে। এরই মাঝে হঠাৎ করে কোনো বস্তুর নড়াচড়ার শব্দ কর্ণগোচর হতেই কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে সে। আওয়াজটা তো একদম কর্ণার থেকে আসছে। ভয় না পেয়েই আওয়াজ অনুসরণ করে সেদিকেই পা বাড়ায় উপমা। একটা বস্তার ভেতর কিছু একটা নড়ছে। পূর্ণার কথা মনে পড়তেই ভয় পেয়ে যায় সে। বিলম্ব না করে দ্রুত বস্তার গিট খুলতেই ভেতর থেকে পূর্ণার দেহ বেরিয়ে আসে। মেয়েটা ঘেমে নেয়ে‌ একাকার হয়ে গিয়েছে। তার উপর হাত পা, মুখ বেঁধে রেখেছে। সাথে সাথে সেগুলো খুলে ফেলতেই আতঙ্কে ভরপুর হয়ে থাকা পূর্ণা উপমাকে জড়িয়ে ধরে। পুরো শরীর ভয়ে কাঁপছে তার। নিঃশ্বাস নিতেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তাকে।
– “পূর্ণা তুই ঠিক আছিস?”
উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় উপমা। পূর্ণাও খুব কষ্টে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। উপমাও পূর্ণাকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতে থাকে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে যায় ইফতেখার সাহেবের বলা সেই ভয়ঙ্কর কথা। এ বাড়িতে বোমা আছে! আর তা যেকোনো সময় ফেটে যেতে পারে ইফতেখার সাহেবের ইশারায়। পূর্ণাকে সুরক্ষিত ভাবে বের অফিসার আমানের কাছে তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে নাহলে ইফতেখার সাহেব যেকোনো সময় তার ক্ষতি করে দিতে পারে।
– “পূর্ণা চল তাড়াতাড়ি, এইখানে বোমা আছে যা যেকোনো সময় ফাইটা যাইতে পারে।”

উপমার কথা শুনে ভয় পেয়ে যায় পূর্ণা। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে উপমার হাত ধরে উঠে দাঁড়ায় সে। তাৎক্ষণিক রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে পৌঁছাতেই পা দুটো থমকে দাঁড়ায় উপমার। পাশের রুমটা তো তারই। আর এখানেই তো রয়েছে তার প্রয়োজনীয় সবচেয়ে প্রিয় সামগ্রী যা তার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিছু একটা ভেবেই সে পূর্ণার হাত ছেড়ে দেয় সে মুহুর্তেই।

– “পূর্ণা তুই বাইরে যা! বাইরে গিয়ে সোজা অফিসার আমানের কাছেই যাবি আর কোনোদিকে তাকাবি না; পেছনে তো ভুল কইরাও না।”
উপমার কথা ভাবার্থ হলো না পূর্ণার‌। সে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে বোনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। কি বলছে উপমা? সে চলে গেলে উপমার কি হবে?
– “না বুবু আমি তোরে ছাড়া যামু না। তুই ও আমার সাথে চল।”
একপ্রকার জেদ ধরে বসে পূর্ণা।
– “বলছিনা তোরে এখান থেকে যেতে। আমি ঠিকই পেছনের দরজা দিয়া বাইর হইয়া যামু তুই চিন্তা করিস না। হাতে সময় নাই পূর্ণা। তাড়াতাড়ি বের হ এইখান থেইকা। আর কোনো কথা বলবি না তোরে আমার কসম যা এইখান থেইকা।”

উপমার দৃঢ় কথার সামনে দমে যায় পূর্ণা। কিছু বলতে পারে না সে। শুধু একপলক উপমার দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। অতঃপর উপমার কথা অনুযায়ী বারান্দায় দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে। এই সুযোগে উপমাও‌ নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। মায়ের, নিজের ডায়েরীর সঙ্গে তার ভালোবাসার মানুষটির দেয়া আমানত তার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। জিনিসটা যে শুধু তার নয়; লকেটটির‌ সঙ্গে আবেগের মায়ের স্মৃতিও জড়িয়ে রয়েছে। দ্রুত গতিতে সেই ভাবনা নিয়েই এগিয়ে যায় উপমা।

৫৭.
অফিসার আমান সেই কখন থেকেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এই আশায় উপমা আর পূর্ণা কখন আসবে। ইফতেখার সাহেবের উপর ও আলী সাহেবকে দিয়ে কড়া নজরে রাখা হয়েছে। তিনি যে সবার আড়ালেও এত বড় মারাত্মক পরিকল্পনা তৈরি করে ফেলবেন তা জানা ছিল না অফিসার আমানের। তবুও বেশ কয়েকবার চালাকি‌র সঙ্গে ইফতেখার সাহেবের হাত থেকে রিমোট টা বিচ্যুত করতে চেয়েছেন কিন্তু পারেন নি। এত এত প্রমাণাদি থাকা সত্ত্বেও তিনি যেন কিছুই করতে পারছেন না। কেননা দু দুটো নিষ্পাপ প্রাণ ইফতেখার সাহেবের হাতের মুঠোয় বন্দী আপাতত। অপেক্ষার প্রহর গোনা ছাড়া আর কোনো কিছুই যে করার নেই।
অফিসার আমানের সুক্ষ্ম ভাবনার মাঝেই পদার্পণ করে পূর্ণা। অনেকটা হাঁপিয়ে সদর দরজায় আসতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ান আমেনা বেগম সহ সজল। দুজনের চোখেমুখে আতংকের ছাপ। একটু আগেই পানি নিয়ে আসার বাহানা করেই পূর্ণাকে বস্তাবন্দি করে সেই রুমটায় ফেলে রেখে এসেছিলেন আমেনা বেগম। কারণ একটাই ইফতেখার সাহেবের করা পরিকল্পনার বেশ খানিকটা অংশ পূর্ণা আড়ালে শুনে ফেলেছিল। কিন্তু উপমা যে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই পূর্ণাকে খুঁজে বের করবে তা কে জানত? ইফতেখার সাহেব ও একই আশংকায় ভুগছেন। তবে তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।

পূর্ণার দিকে চোখ যেতেই সজাগ হয়ে উঠেন অফিসার আমান। তার মানে উপমা সঠিক সময়েই পূর্ণাকে খুঁজে পেয়েছে। দারোগা আলীকে চোখের ইশারা দিতেই আলী সাহেব ইফতেখার সাহেবের উপর নজরদারি করতে শুরু করেন যাতে তিনি উল্টাপাল্টা কিছু করতে না পারে। অন্যদিকে অফিসার আমান ও এগিয়ে গিয়ে দ্রুত পূর্ণাকে সামলে নেন। মেয়েটা বড্ড বেশি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। পূর্ণাকে চোখে পড়লেও উপমাকে আশপাশে চোখে পড়ে না তার। গুনে গুনে আর মাত্র ১:০৩ মিনিট রয়েছে। এই অসময়ে আবার উপমা কোথায় গেল?
– “উপমা কোথায় পূর্ণা?”
প্রশ্ন করে বসেন অফিসার আমান।
– “ভেতরে। বুবু ভেতরেই আছে। সে নাকি পেছনের দরজা দিয়া বাইর হইব।”
আস্তে করে বললেও পূর্ণার কথাটা সে মুহূর্তে ইফতেখার সাহেবের কানে গিয়ে পৌঁছায়। অফিসার আমান এবার একটু ভীত হন। উপমা সঠিক সময়ে বের হতে পারবে তো?

উপমাকে খুঁজে বের করার জন্য ভেতরে পা বাড়াতেই পেছন হতে ইফতেখার সাহেবের কর্কশ কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
– “আহা অফিসার সাহেব ভুল কইরাও‌ পা রাইখেন না ভেতরে। এতে কইরা লোকসান আপনেরই‌। এ কূলও হারাইবেন‌ ও কূলও হারাইবেন‌।”

ড্রায়ারের ভেতর হাতড়ে হাতড়ে ডায়েরী সহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী বের করে আঁচলে লুকিয়ে নেয় উপমা। যাক মনে তাও একটা প্রশান্তি পেল সে। দ্রুত এখন কক্ষ ত্যাগ করে যেতে হবে। আর ভুল করে সামনের দরজা দিয়ে বের হওয়াই যাবে না। রুম থেকে বেরিয়ে সিড়িঘরের‌ পাশ দিয়ে পেছনের দিকে চলে যায় সে। উদ্দেশ্য পেছনের দরজা দিয়ে সাবধানে বাইরে বের হয়ে যাওয়া। কিন্তু সেখানে গিয়ে ঘটলো আরেক বিপত্তি। দরজা বেশ কয়েকবার ধাক্কাধাক্কি করার পরও খোলা যাচ্ছে না। বোধহয় কেউ বাইরে দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছে। ভয়ে ঘাম ঝরছে তার। তবে কি রূপকথার গল্পের মৃত্যুপু‌রীর মতো উপমার জীবন গতিও এই মৃত্যুপুরীতে আটকে গেল?

ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে আর ভেতরে প্রবেশ করে না অফিসার আমান। তবে উপমাকে সতর্ক করার জন্য গলা বাড়িয়ে বলে উঠেন,
– “উপমা তাড়াতাড়ি বের হও ভেতর থেকে। হাতে সময় নেই একদমই আর ২৫ সেকেন্ড বাকি।”
আর অফিসার আমানের বলা এ কথাই যেন সবচেয়ে বড় কাল হয়ে দাঁড়ায় উপমার জীবন স্রোতে।
– “লাভ নাই অফিসার সাহেব। আমার ক্ষমতার খেলায় শেষ গুটি হিসেবে তো উপমার প্রাণটাই যাইব!”
বলেই বিদঘুটে হাসি দেন ইফতেখার সাহেব। হিংস্রতার সঙ্গে হাতে থাকা রিমোটের বাটনে চাপ দিতে গেলেই ভয় পেয়ে যান অফিসার আমান।
– “ওহ্ নো শিট!”
দ্রুত পূর্ণাকে নিয়ে দৌড়ে খানিকটা দূরে দাড়াতেই বিকট শব্দের সূত্রপাত হতেই থমকে দাঁড়ান তিনি। আশপাশে আগুনের জ্বলন্ত শিখা আর ধুলোর গন্ধে পরিবেশ নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে মুহূর্তেই।

৫৮.
জানালার পাশে বসে একদৃষ্টে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন ইশিতা বেগম। সেই কখন থেকেই অপেক্ষায় আছেন যে আবেগ এসে তার সঙ্গে দেখা করবে। কিন্তু না সন্ধ্যে হয়ে এল তবুও আবেগের কোনো হদিস নেই। ছেলেটাকে কতদিন ধরে ভালো করে আদর করে খাইয়ে দেননি তিনি। এসবের মাঝেই হঠাৎ করে বাসার কলিং বেল বেজে উঠতেই তিনি পেছন ফিরে তাকান‌। বাসার কাজের মেয়ে লিজা আওয়াজ শুনে দ্রুত দরজা খুলে দেয়। ইশিতা বেগম ও উঠে গিয়ে দরজার কাছে যান কে এসেছে তা দেখতে। দরজার অপর পাশে আবেগকে লাগেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খুশিতে ইশিতা বেগমের চোখজোড়া চিকচিক করে উঠে। মাকে দেখে আবেগও মৃদু হেসে এগিয়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে।
– “আমি ফিরে এসেছি মা।”

ঘড়ির কাঁটায় রাত ১১:০০ টা বাজে। একটু আগেই রাতের খাবার খেয়ে রুমে ফিরে এসেছে আবেগ। শরীরটা একটু বেশিই ক্লান্ত। খাবার টেবিলে অবশ্য‌ মিস্টার আহিলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ও বটে কিন্তু কথা হয়নি। রুমে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বাইরের আবহাওয়া উপভোগ করতে ও উপমার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো স্মৃতিচারণ করতে ব্যস্ত ছিল তখনই তার ফোনটা বেজে উঠে। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে হসপিটাল থেকে ফোন এসেছে। কল রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে ডক্টর ঈশানের পরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে আসে,

– “Hey, doctor Abeg! How was the journey?”
– “It was a great journey doctor Ishaan.”
এভাবেই কিছুক্ষণ আলাপচারিতায় কেটে যায় আবেগের সময়। ডক্টর ঈশান ও জানিয়ে দেয় ঠিক কবে থেকে আবেগ হসপিটালে জয়েন করতে পারবে।
কথা বলা শেষে আবেগ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নেয় ঠিক কটা বাজে। পরে এগিয়ে গিয়ে ট্রাভেল ব্যাগ থেকে উপমার দেয়া সেই রুমালটা বের করে নেয় সে। মেয়েটা যে এই অল্প সময়ের মাঝেই তার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে যাবে তা ভেবেই মাঝেমধ্যে অবাক হয় আবেগ। রুমালটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বিড়বিড় করে নিজেই বলে উঠে,
– “ভালোবাসি মায়াবনের‌ মায়াবতী!”……………….

#চলবে

#মায়াবন_বিহারিণী ?
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#ত্রয়োবিংশ_পর্ব (অন্তিম খন্ডাংশ-৩)

৫৯.
– “আচ্ছা তারপর কি হলো?”
অল্পস্বল্প উৎসুক কন্ঠস্বর। চোখ দুটোও তার উত্তর খুঁজতে মহাব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মেয়েটির এমন আগ্রাসী কন্ঠস্বর অনুসরণ করে তার দিকেই দৃষ্টি ফেরালো‌ আবেগ। মেয়েটাও তার দিকেই চেয়ে আছে উত্তর জানার আশায়। কিন্তু এ উত্তর তো বিভীষিকাময়, ভয়ঙ্কর! কিভাবে মুখ ফুটে বলবে সে এরপর কি হয়েছিল? কিভাবে বলবে সে তার প্রিয়তমার হারিয়ে যাওয়ার বেদনা সম্পর্কে।
সময় গড়িয়েছে বহুদূরে। মুখে আগের মতো খুব একটা মলিনতা‌ নেই, নেই কোনো উজ্জ্বলতা। চোখের নিচে কালসিটে দাগ স্পষ্ট, আগের চশমার বদলে যুক্ত হয়েছে নতুন মোটা ফ্রেমের চশমা। বয়স ও তার পঁচিশ পেরিয়ে চল্লিশের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছে। তবুও এসবের সাথে আবেগের ডাক্তারি জীবনের কোনো বিশেষ যোগসূত্র নেই বললেই চলে।
ডাক্তারি ক্যারিয়ারে একের পর এক সফলতা আর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সে আজ বিখ্যাত এক কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে পরিচিত হয়েছে আজ সবার কাছে। তবে আজকে নতুন করে অবন্তীর‌ সাথে পরিচয়টা তার জীবনের পুরনো পাতাগুলোকে তার সামনেই মেলে ধরেছে।
মাঝখান থেকে পেরিয়ে গিয়েছে পনেরো বছর। বদলেছে প্রত্যেকটি মানুষের জীবন গতি। আজ এত বছর পর আবারও একই প্রসঙ্গে কথা উঠবে তা ভাবেনি আবেগ। সেই ঘটনার পর থেকে আবেগ প্রতিবারই তার একান্ত কিছু অবসর সময়ে ত্রিমোহি‌নীতে এসে কাটায়। আবার কখনো বা অফিশিয়াল কিছু কাজ হলেও আসে। এবার ও ত্রিমোহিনীতে‌ এসেছে পাঁচদিন হলো সবেমাত্র। এরই মধ্যে তার পরিচয় অবন্তী নামক মেয়েটার সঙ্গে। মেয়েটার স্বভাব একটু বেশিই কৌতুহলী। শুনেছে মেয়েটা নাকি কোনো প্রচলিত পত্রিকার জার্নালিস্ট এবং এখানে কোনো স্টোরি কভার করতে এসেছে। তবে স্টোরি কভার করার বদলে গত তিনদিনদিন যাবৎ তার পেছনেই পড়ে রয়েছে মেয়েটা। দেখা গেল খুব ভোরে হাঁটতে বের হয়েছে আবেগ তখনও রাস্তায় শাল জড়িয়ে কোথা থেকে যেন মেয়েটা তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আবার কখনো বা খোলা টংয়ের‌ চায়ের দোকানে। দুদিন কোনো না কোনোভাবে এড়িয়ে চললেও আজকে মেয়েটা সরাসরি বলেই ফেলেছে তার আগ্রহ সম্পর্কে। আরশান‌ শাহরিয়ার আবেগের টোটাল লাইফস্টোরি সম্পর্কে অবন্তীর জানার আগ্রহ দেখে আবেগ ভ্রু কুঁচকায়। তার নিজস্ব ভাষ্যমতে সে কোনো বিখ্যাত লেখক কিংবা সুপারস্টার কিংবা কোনো বড় জ্ঞানী মনীষীও নয় যার জীবনী সম্পর্কে জানতেই হবে। তবুও মেয়েটার জেদের কাছে হার মানতে হয়েছে তাকে। আজ দুপুরের দিকেই বের হয়েছিল আবেগ, পূর্ণার আজ শ্বশুড়‌বাড়ি থেকে আসার কথা। হয়তো এতক্ষণে এসেও পড়েছে। পথিমধ্যে পুনরায় অবন্তী‌র সঙ্গে দেখা হয় তার। আর তখন থেকেই এ পর্যন্ত আবেগের পিছু পিছু অনেকটা পথই হেঁটে এসে পড়েছে অবন্তী। সাথে করে জেনেছেও‌ অনেক কিছু। আবেগের কথা শুনে মাঝে মাঝেই চমকে উঠেছিল সে কেননা আবেগের মতোন এমন গুরুগম্ভীর মানুষকে দেখলে বোঝাই যাবে না তার পেছনে এত এত কাহিনী লুকিয়ে আছে।

– “আচ্ছা তারপর কি হলো স্যার? উপমা, পূর্ণা ওরা কোথায়? আর ইফতেখার সাহেবের ই বা কি হলো?”
এতক্ষণ যাবৎ পুরনো অতীত ঘেঁটে তা বর্তমানে ফের নিয়ে আসার মধ্যে ব্যস্ত ছিল আবেগ। তবে অবন্তী‌র শেষোক্ত‌ প্রশ্ন শুনে তার টনক নড়ে ওঠে। মেয়েটাকে প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটাই বলে ফেলেছে। সেজন্য প্রসঙ্গ এড়াতে সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠে,
– “তুমি তো এখানে স্টো‌রি কভার করতে এসেছ তাই না? তাহলে আমার লাইফ সম্পর্কে এত জেনে কি হবে? কোনোভাবে কি তুমি আমার স্টোরিই‌ কভার করতে আসো নি তো?”
আবেগের প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে যায় এক মুহূর্তের জন্য অবন্তী। সাথে সাথেই মাথা দুদিকে নাড়িয়ে বলে উঠে,
– “নো স্যার। ইউ আর টোটা‌লি রং। আমি এখানে স্টোরি‌ই কভার করতে এসেছি বাট সেটা আপনার নয়। আমি তো এসব জানতে চাচ্ছি কারণ পার্সোনালিভাবে আমি আপনার ব্যক্তিত্বের অনেক বড় ফ্যান।”

এটুকু বলেই একটু থামে অবন্তী। অতি পরিমাণে নার্ভাসনেস কাজ করছে তার মাঝে। এই স্টোরি‌টা যদি কভার না করতে পারে তাহলে জার্নালিস্টের চাকরিটা হয়তো আর বেশিদিন স্থায়ী হবে না তার কপালে। যে করেই হোক এত বড় একটা সুযোগ পেয়েছে সে; তাহলে সেটা হাতছাড়া করে কিভাবে? তবুও আবেগ সন্দিহান চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে।
– “ঠিক আছে। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। এখন ওঠা যাক। আমার পার্সোনাল কিছু কাজ আছে।”

বলেই বসা থেকে উঠে পড়ে আবেগ। ত্রিমোহিনীর‌ রূপ রং ও আগের চেয়ে বেশ খানিকটা পাল্টিয়েছে। আশেপাশের চিত্র, যোগাযোগ ব্যবস্থা আগের থেকে হয়েছে উন্নত। আবেগ উঠে চলে যেতে নিলেই অবন্তী হন্তদন্ত হয়ে উঠে গিয়ে আবেগের সামনে দাঁড়ায়।
– “কিন্তু স্যার, বাকিটুকু? বাকিটুকু বললেন না যে!”
– “সরি মিস অবন্তী। আজকের মতো এতটুকুই। বাকিটুকু না হয় কাল শোনা যাবে।”

বলেই আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না আবেগ। বড় বড় পা ফেলে সোজা পিচঢালা রাস্তায় হাঁটা শুরু করে সে। আর তার যাওয়ার পানে ড্যাবড্যাব করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল অবন্তী। অতঃপর একপ্রকার চিল্লিয়েই বলে উঠলো,
– “ঠিক আছে স্যার! মনে থাকে যেন; আগামীকাল এই জায়গাতেই বিকেলে আমি অপেক্ষা করব।”
আবেগ শুনলো অবন্তীর কথা। কিন্তু কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া না করেই হাঁটতে থাকলো নিজের মতো করে।

৬০.
রাতের আকাশে আজ নক্ষত্রের দল একটু বেশিই উজ্জ্বল। তার উপর পূর্ণিমা তিথি। সবকিছু মিলিয়ে আজ চারপাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। ব্যালকনিতে বসেই অবন্তী ল্যাপটপে পেনড্রাইভের সাহায্যে রেকর্ড করা ভিডিও প্রসেসিং করায় ব্যস্ত। এবারের কভার টা ঠিকঠাক করে কমপ্লিট করতেই হবে নাহলে বসের সামনে দাঁড়ানো যাবে না। তবে ভিডিও ফুটেজ গুলো পুনরায় একবার ভালো করে শুনে নিল অবন্তী। যেটুকু শুনেছে তাতেই একজন স্বাভাবিক মানুষের শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠবে। ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে দেখতেই খেয়াল করে রাত দেড়টার মতো বাজে। বেশি রাত জেগে থাকার অভ্যেস নেই অবন্তীর‌ তবুও এই জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের সাথে যুক্ত হওয়ার পর থেকেই চোখের ঘুম উবে গিয়েছে।
উঠে গিয়ে কিচেন থেকে এক কাপ কফি নিয়ে পুনরায় ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো সে।
অবন্তী। পুরো নাম জিন্নাত আরা অবন্তী। পঁচিশ বছরের একজন জার্নালিস্ট। ত্রিমোহি‌নীতে আসার মূল উদ্দেশ্য হলো একমাত্র আবেগ। অনেকদিন যাবৎ কোনো স্টো‌রি কভার কিংবা আর্টিকেল না করতে পারায় চাকরি তার এখন হুমকির মুখে। তাই ভালো একটা স্টোরি কভার করার জন্য সার্চ করতেই আবেগের সন্ধান পায় অবন্তী। আর তখন থেকেই উদ্দেশ্য আরশান শাহরিয়ার আবেগের জীবনীর উপর একটি স্টোরি কভার করা যা অনেকটাই পূর্ণ হতে চলেছে।

ওয়াশরু‌ম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দরজায় খটখট শব্দ পড়ে। পাশ ফিরে তাকায় আবেগ। মৃদু গলায় কে এসেছে জিজ্ঞেস করতেই অপর পাশ থেকে পূর্ণার‌ মোলায়েম কন্ঠস্বর ভেসে আসে তার কানে।
– “ভেতরে আসতে পারি ভাইয়া?”
– “পূর্ণা, তুমি? বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এসো।”

পূর্ণা ভেতরে আসতেই আবেগ ইশারায় তাকে বসতে বলে। পূর্ণাও চুপচাপ বসে পড়ে। মিনিট কয়েক পরে আবেগ এসে চেয়ার টেনে বসে পড়ে পূর্ণার সামনে।
– “কেমন আছো পূর্ণা? সবকিছু ঠিকঠাক চলছে তো? রাজীব তোমার আর হৃদির‌ খেয়াল রাখছে তো ঠিকঠাক?”
আবেগের প্রশ্ন শুনে উত্তর দেয় না পূর্ণা। তার চোখের কোণে জল জমা শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে। আর তা পরিলক্ষিত হতেই খানিকটা নড়েচড়ে বসে আবেগ। ব্যাতিব্যস্ত‌ হয়ে পড়ে পূর্ণার কান্নার কারণ জানতে।

– “কি হয়েছে পূর্ণা? সব ঠিক আছে তো? রাজীব কিছু বলেছে?”
তবুও পূর্ণার কান্না থামে না। অনেকটা কান্না করার ফলে হেঁচকি উঠে গিয়েছে। আবেগ কিছু বলতে যাবে তার আগেই ধরা গলায় পূর্ণা বলে উঠে,
– “আইজ যদি উপমা থাকত তাহলে দেখতে পারত তার পূর্ণা কতটা সুখে আছে। তার ও একটা সংসার হইছে, সে পড়াশোনা কইরা অনেক বড় হইছে। উপমা তো এইটাই চাইছিল। তার দেখানো পূরণ হইছে, কিন্তু? উপমা? সে কোথায়? নিয়তি এমন নিষ্ঠুর ক্যান হইলো তার সাথে? কি এমন দোষ করছিল মেয়েটা?”

পূর্ণার কথা কর্ণপাত হতেই না চাইতেও মুখের রং উড়ে যায় আবেগের। আহত দৃষ্টিতে শুধু পূর্ণার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে। এরই মাঝে আবেগের রুমে এসে হাজির হয় ছোট চার বছর বয়সী হৃদি‌। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে মায়ের সামনে দাড়াতেই পূর্ণার চোখের জল দেখতে পায় সে। কিছু বুঝতে না পারলেও আধো আধো হাত এগিয়ে নিয়ে পূর্ণার চোখের জল মুছে দেয় হৃদি‌। মর্মাহত আবেগের দিকে দৃষ্টি যেতেই পূর্ণা বুঝতে পারে নিজের অজান্তেই সে আবেগের পুরনো ক্ষতে আবারো আঘাত দিয়ে ফেলেছে সে। তাই সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলতে পূর্ণা বলে উঠে,
– “দেখছেন ভাইয়া, কথায় কথায় কটা বাজে সেই খেয়াল ই ছিল না। আমিও যে কি করি না! আইজ আপনের পছন্দের খাবার রান্না করছি। আসেন কয়টা খাইয়া নিবেন।”

– “থাক তোমাকে কষ্ট করতে হবে না পূর্ণা‌। আমার খাওয়ার ইচ্ছে নেই। তুমি বরং হৃদিকে নিয়ে ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। এমনিতেই রাত হয়েছে অনেক।”
পূর্ণাও তেমন কথা বাড়ালো না আর। হৃদিকে নিয়ে উঠে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল রুমের বাইরে। আর অন্যদিকে পূর্ণা বেরিয়ে যেতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবেগ। উপমার কথা মনে পড়তেই মন বিষাদে ভরে উঠে; মনের কোণে শুধু একটা কথাই বারবার বাজতে থাকে,
– “তুমি বড়ই স্বার্থপর মায়াবতী! নিজের মায়ার রেশ লাগিয়ে আবার ফের সেই আমাকে একা করেই চলে গেলে। তুমি বড্ড স্বার্থপর!”

এলার্মের তীক্ষ্ণ শব্দ কানে পৌঁছাতেই ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে হাতড়ে হাতড়ে এলার্মটা বন্ধ করে অবন্তী। ভোরের আলো ফুটেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। তবে চোখে লেগে থাকা ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি। কিন্তু পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে অবন্তী। আজ তো তার আবেগের সাথে দেখা করার কথা। তবে তাতে বেশ খানিকটা সময় আছে। তাই আপাতত উঠে ফ্রেশ হয়ে পুনরায় ল্যাপটপ নিয়ে বসে সে। এরই মধ্যে ফোনে ছয়টা মিসড কল উঠে আছে। সাইলেন্ট থাকায় তা আর খেয়াল করে নি অবন্তী।
ল্যাপটপের ফাইলে নতুন করে আর্টিকেল লেখার জন্য টাইপ করতেই কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায় অবন্তী। এভাবে একজন মানুষের বিশ্বাস ভঙ্গ করে তার অজান্তেই তাকে নিয়ে এতসব লেখার জন্য নিজের মাঝে খারাপ লাগা কাজ করে অবন্তীর‌। তবু সে নিরুপায়; তাইতো এত বড় একটা স্টেপ নিতে চলেছে সে।

গত দিনের মতো আজকেও সেই একই জায়গায় বসে অপেক্ষা করছে অবন্তী এই আশায় যে আবেগ কখন আসবে। যে করেই আবেগের মুখে পুরো কথা শুনতে হবে। কিন্তু বিকেল পেরিয়ে অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। আবেগের আসার কোনো নাম গন্ধ ও নেই। তবে কি আজকে আবেগ আসবে না? ভেবেই বসা থেকে উঠে পড়ে অবন্তী। চায়ের দোকানে বিল পরিশোধ করে সামনের দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে কারো মৃদু কন্ঠস্বর ভেসে আসে তার কানে। পেছনে ঘুরে তাকাতেই আবেগের গাম্ভীর্য মুখশ্রী চোখে পড়ে তার। যাক মানুষটা কথা রেখেছে তাহলে!……………..

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here