মায়াবন_বিহারিণী ?,পর্ব:২৪(অন্তিম ৪র্থ),২৫ শেষ পর্ব

0
1960

#মায়াবন_বিহারিণী ?,পর্ব:২৪(অন্তিম ৪র্থ),২৫ শেষ পর্ব
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#চতুর্বিংশ_পর্ব (অন্তিম খন্ডাংশ-৪)

৬১.
হঠাৎ পেছন থেকে প্রত্যাশিত কারো কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়ায় অবন্তী‌। ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই খেয়াল করে আবেগ তার দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। সেকেন্ড কয়েক বাদেই আবেগ এসে অবন্তীর পাশে দাঁড়ায়। আসবে আবেগ এসেছে বলে অবন্তীও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
– “যাক বাঁচা গেল। আমি তো ভেবেছিলাম আপনি আসবেনই না। আপনাকে আসার জন্য অনেক ধন্যবাদ স্যার।”
অবন্তীর কথার বিনিময়ে সৌজন্যমূলক হাসি দেয় আবেগ।
– “চলুন তাহলে এখানে বসে বাকি গল্পটুকু শোনা যাক।”
বলেই অবন্তী পাশে থাকা বেঞ্চে বসতে নিলেই আবেগ স্বাভাবিক গলায় বলে উঠে,
– “উহু, এখানে না।”
– “তাহলে কোথায়?”
ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে অবন্তী।
– “চলো তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।”
বলেই সোজা পথ ধরে হাঁটা শুরু করে দেয় আবেগ। অবন্তী ও দেরি করে না; আবেগের পথ অনুসরণ করে দ্রুত চলা শুরু করে। মিনিট বিশেকের রাস্তা পার হতেই অবন্তী খেয়াল করে চারপাশের পরিবেশ নিস্তব্ধ অনেকটাই আগের তুলনায়। মনে একরাশ ভয় জন্ম নেয় তার। আবেগ তাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে? কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে আবেগ গিয়ে একটা নদীর সামনে দাঁড়ায়। ঠিক সেই গাছ, সেই দুটো নৌকা বাঁধা তবে পার্থক্য শুধু এইটুকু যে সময়ের বিবর্তনে তা মৃত। গাছের পাতা ঝরে গিয়ে শুধু শিকড় আগলে একটি কাঠ দন্ডায়মান; আশেপাশে তার শুকনো ডাল পালা আছে অবশ্য। আর প্রখর রোদ তাপে নৌকা দুটোর গায়ের পাটাতনের কাঠে ফাটল ধরেছে; সাথে করে জন্মেছে শৈবাল ও। আশেপাশে একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিল আবেগ। সবকিছু পাল্টে গেলেও এই জায়গায় তেমন কোন পরিবর্তন ঘটেনি। অন্যদিকে চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখছে অবন্তী।‌ আসলে সে বোঝার চেষ্টা করছে যে আবেগ আসলে তাকে কোথায় নিয়ে এসেছে। কিন্তু পরক্ষণেই আবেগের বর্ণণাতীত‌ সব বৈশিষ্ট্য মিলে যাওয়ায় তার বুঝতে বাকি থাকে না যে আবেগ তাকে নিয়ে ব্যাখ্যায়িত সেই নদীর পাশেই নিয়ে এসেছে। বেশ কিছুক্ষণ সময় ব্যায়িত হবার পর ও আবেগকে চুপ থাকতে দেখে অবন্তী গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠে,
– “আচ্ছা তারপর কি হয়েছিল? ইফতেখার সাহেব, পূর্ণা, উপমা কোথায়?”
অবন্তীর প্রশ্নে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আবেগ। অতঃপর ধরা গলায় বলা শুরু করে,
– “মাঝখান থেকে কেটে গিয়েছে দশদিন। এই দশদিনে হসপিটালের ব্যস্ততায় সময় হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে ক্রমশ। তাতে অবশ্য ভালোই হয়েছে একদিক থেকে। সময় গুলো দ্রুত চলে যাচ্ছে। হসপিটালের কেবিনে বসে একদৃষ্টে বাইরের দিকে তাকিয়ে উপমার কথাগুলো ভাবছিল আবেগ। মেয়েটা কি অদ্ভুতভাবে নিজের মায়ায় ফেলে দিয়েছে; যে সময়ে অসময়ে তার কথাই শুধু মনে পড়ে। হঠাৎ করে কেবিনের দরজায় টোকা পড়তেই টনক নড়ে ওঠে আবেগের। দ্রুত গলা ঝেড়ে অপর পাশের থাকা মানুষটিকে ভেতরে আসতে বললেই ডক্টর সায়ান হেলেদুলে ভেতরে প্রবেশ করেন। হাতে তার একগাদা ফাইল।
– “ডক্টর সায়ান, আপনি?”
– “হ্যাঁ, এখন তো লাঞ্চ টাইম। তাই ভাবলাম আপনার কেবিনে চলে আসি। লাঞ্চ করাও হয়ে যাবে আর সাথে করে আপনাকে ইনভাইটেশন ও দেয়া হয়ে যাবে।”
– “ইনভাইটেশন? কিন্তু কিসের?”
ডক্টর সায়ানের দিকে খানিকটা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে উঠলো আবেগ।

– “সিঙ্গেল থেকে চিরদিনের জন্য মিঙ্গেল হয়ে যাওয়ার ইনভাইটেশন‌। আপনিও তাড়াতাড়ি বিয়েটা করে ফেলুন, বুঝলেন ডক্টর আবেগ?”
সায়ানের কথা শুনে মৃদু হাসলো আবেগ। তবে এ বিষয়টা নিয়ে বিগত কয়েকদিন ধরেই চিন্তা করছিল সে। মাকে আর বড় ভাইকে অন্তত একবার সবটা জানানো উচিত। উপমাকে একবার বিয়ে করে এখানে আনতে পারলেই তার যাবতীয় পড়াশোনা সহ সকল কিছুর দায়িত্ব সে শান্ত মনে পূর্ণ করতে পারবে। না হলে উপমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় কোথাও না কোথাও থেকেই যায়। তাই খুব শীঘ্রই ইশিতা বেগমকে উপমার ব্যাপারে জানানোর সিদ্ধান্ত নেয় আবেগ।‌
যথারীতি দিনক্ষণ পার হয়। দেখতে দেখতে সায়ান আর উশানীর বিয়ের দিন চলে আসে। আজ তেমন একটা ক্রিটিক্যাল কেস না থাকায় সন্ধ্যার পর পরই সায়ানের বাড়ির দিকে রওনা দেয় আবেগ। এমনিতেই গতকাল হলুদ রাতে পেশেন্টের জন্য অনুষ্ঠানে জয়েন করতে পারে নি। যার ফলস্বরূপ আজকে আগেই যেতে হচ্ছে তাকে। হসপিটাল থেকে বেরিয়ে মিনিট চল্লিশেক পার হতেই সায়ানের‌ বাড়িতে পৌঁছে যায় আবেগ। পুরো বাড়ি সুন্দর করে লাইটিং দিয়ে ডেকোরেশন করা। ভেতরে মানুষের ভীড়ভাট্টা ঠেলে সায়ানের রুমে প্রবেশ করে আবেগ এবং সেখানেই সায়ানের‌ সাথে দেখা করে নিজেও রেডি হয়ে নেয়। ঘন্টাখানেক বাদেই সায়ান এবং উশানীর বিয়ে পড়ানো শুরু হয়ে যায়। হসপিটালের অনেকেই এসেছে উশানী আর সায়ানের বিয়েতে। সব আয়োজন শেষ হতে হতে প্রায় রাত দুটো বেজে যায়। ঢাকা শহরের খোলা রাস্তা তখনও আলোকিত। সায়ানের বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছে আসতেই ফোন তার নিজস্ব রিংটোনে বেজে ওঠে। পকেট থেকে ফোন বের করতেই আবেগ খেয়াল করে ইশিতা বেগমের নম্বর থেকে মোট ৫ টা মিসড‌ কল এসেছে; হয়তো ভেতরে থাকা আওয়াজের কারণে শুনতে পায়নি। কিন্তু কল ব্যাক করতে গিয়েই ঘটে আরেক বিপত্তি। ফোনে চার্জ ডেড লাইন ক্রস করে ফেলেছে। রিং হতে হতে মাঝপথেই ফোন বন্ধ হয়ে যায় আবেগের। ফলস্বরূপ ফের ইশিতা বেগমকে কল ও করা হয় না তার। পার্কিং এরিয়া থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিজ বাসার দিকে রওনা দেয় সে।

৬২.
– “দাড়াও আবেগ।”
ঘরে ঢুকে নিজের রুমের দিকে ক্লান্ত শরীরে সবেমাত্র পা বাড়িয়েছিল আবেগ। মিস্টার আহিলের কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে না চাইতেও থমকে দাঁড়ায় সে।
– “তোমার ফোন কোথায়? তোমার ফোনে আমি কতবার কল করেছি জানো? জরুরী কোনো কথা কিংবা কাজেই তোমাকে পাওয়া যায় না।”
– “ব্যাটারি ডেড হয়ে গিয়েছিল। বলুন কি বলবেন মিস্টার আহিল শাহরিয়ার!”
স্বাভাবিক কন্ঠেই প্রত্ত্যুতরে বলে উঠে আবেগ।

– “ঠিক আছে, আমরা আগামী সপ্তাহেই তোমার জন্য মেয়ে দেখতে যাচ্ছি আর সেখানেই বিয়ের ডেট ফিক্সড করে আসব। আমার বন্ধুর মেয়ে আনিশা, ইউকে থেকে এবার বিডিতে‌ ফিরছে। ও আসলেই আমি তোমাদের দুজনের বিয়েটা সেরে ফেলতে চাই। সো মেন্টালি প্রিপেয়ার্ড হও।”
আহিল সাহেবের কথা কর্ণপাত হতেই চোয়াল শক্ত হয়ে আসে আবেগের। কোনো সাজেশন নেই, জিজ্ঞাসাবাদ নেই; ডিরেক্ট বিয়ে! এর কোনো মানেই হয় না। চাপা রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠে,
– “আপনি এসব কি বলছেন মিস্টার আহিল? কিসের বিয়ে? বলা নেই কওয়া নেই বললেই কোনো সম্পর্ক হয়ে যায় না। আর সবচেয়ে বড় কথা আমি কখনোই আনিশাকে বিয়ে করতে পারব না; কেননা আমি একজনকে ভালবাসি আর তাকেই বিয়ে করব।”

আবেগের এমন কথায় ভ্রু কুঁচকে নেন মিস্টার আহিল। অতঃপর মুখশ্রীতে গম্ভীর ভাব এনে বলে উঠেন,
– “আবেগ, তুমি তোমার লিমিট ক্রস করে যাচ্ছো! তোমার সাহস হয় কি করে এ কথা উচ্চারণ করার? নিশ্চয়ই তোমার এই চিপ প্রফেশনের‌ মত তোমার ভালোবাসা ও চিপ হবে। আর আমি একবার যা বলেছি তাই হবে। শুনে রেখে এ বাড়িতে আমার কথাই চলবে। অনেক বাড় বেড়েছ তুমি; যা বলেছি তাই করো। তুমিও যাবে আমাদের সাথে আগামী সপ্তাহে এন্ড দ্যাটস ফাইনাল।”

– “তাহলে আপনিও শুনে রাখুন মিস্টার আহিল, আমি উপমাকে ভালোবাসি আর ওকেই বিয়ে করব। কোনোকিছুর বিনিময়ে আমি তাকে হারাতে পারব না।”

– “তাহলে বেরিয়ে যাও এ বাড়ি থেকে। এ বাড়িতে কোনো জায়গা নেই তোমার।”
শেষোক্ত‌ কথাটির সময়েই ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হন ইশিতা বেগম। আহিল সাহেবের কথা শুনে বেশ বড়সড় ধাক্কা খান তিনি। কি বলছে এসব তার স্বামী! আর আবেগকেই বা কেন বেরিয়ে যেতে বলছে?

– “কি যা তা বলছেন আপনি, আবেগ বেরিয়ে যাবে কেন? কি করেছে ও? এত রাতে ছেলেটা কোথায় যাবে?”
– “কি করেছে সেটা তোমার ছেলেকেই জিজ্ঞেস করো, সে কিনা আনিশাকে বিয়ে করবে না! কোন এক রাস্তার চিপ মেয়েকে ভালবেসে ফেলেছে!”
আহিল সাহেবের কথা শুনে চুপ হয়ে যান ইশিতা বেগম। অবিশ্বাস্য চোখে একবার আবেগের দিকে তাকান তিনি। তার আবেগ কাউকে ভালোবাসে?

– “ঠিক আছে, আমি বেরিয়ে যাচ্ছি এ বাড়ি থেকে।”
বলেই ইশিতা বেগমের দিকে এগিয়ে যায় আবেগ। অতঃপর ইশিতা বেগমের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিচু গলায় বলে উঠে,
– “আ’ম সরি মা, আমি তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি এটা ভেবো না। আমি আমার শীঘ্রই ফিরে আসব আমার ভালোবাসাকে নিয়ে। আর ততদিন পর্যন্ত আমি তোমার থেকে দূরেই থাকব কারণ মিস্টার আহিল এবার আমার ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আর আমি সব সহ্য করলেও এটা সহ্য করতে পারব না।”
ইশিতা বেগমের চোখের কোনে জল জমে তা উপচে পড়তেও শুরু করেছে ইতোমধ্যে। তবে তিনি মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলেন না স্বামী আহিল শাহরিয়ার এর সামনে। আবেগের চোখের কোণেও জল জমেছে তবে সেটা কারোও দৃষ্টিগোচর হলো না। সে ধীর পায়ে রুম থেকে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়লো রুম থেকে। আবেগের মায়ের এবং বড ভাবীর আহত দৃষ্টি ও আটকাতে পারলো না আবেগকে। সে চুপচাপ বেরিয়ে পড়ে বাসা থেকে। আবেগ বেরিয়ে যেতেই আহিল সাহেবের দিকে শান্ত‌ দৃষ্টিতে তাকান ইশিতা বেগম।
– “এইযে দেখতে পারছেন যে এই বাড়ি থেকে একটা প্রাণ চলে গেল; শূধুমাত্র আপনার এই দাম্ভিকতার কারণে। আর আপনার এই দাম্ভিকতার পতন হিসেবে একদিন এই প্রাণহীন বাড়িতে শুধু আপনার একাই থাকতে হবে। সেদিন আপনি আপনার আপনজনদের পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে উঠবেন কিন্তু কাছে পাবেন না!”
বলেই নিজের রুমের দিকে কান্না করতে করতে চলে যান ইশিতা বেগম।…..…..

#চলবে

#মায়াবন_বিহারিণী ?
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#পঞ্চবিংশ_পর্ব (অন্তিম পাতা)

৬৩.
রাত বাজে প্রায় সাড়ে চারটা। আরেকটু পরেই ভোরের আলো ফুটতে শুরু করবে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে ফ্লাটের দরজা খুলে ভেতরে গুটি গুটি পায়ে প্রবেশ করলো আবেগ। লাইট অন করতেই চারপাশ ঝকঝকে পরিষ্কার ও আলোকিত হয়ে উঠে। বেশ কয়েকদিন হয়ে গিয়েছিল এখানে আর আসা হয়নি আবেগের। অবসর সময়ে হাত খরচার টাকা সেভিংস করে শখের বশেই ফ্ল্যাটটা কিনেছিল আবেগ। অবশ্য এটা সম্পর্কে তার মা ইশিতা বেগম এবং বড় ভাই জানে। শুধু জানেন না আহিল সাহেব; আসলে তাকে‌ কখনো ইচ্ছে করে জানায়নি আবেগ। কোনোমতে দরজা আটকে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে বেডরুমে প্রবেশ করে সে। অতঃপর শরীরের ক্লান্তি আর চোখের ঘুম কোনটাই সায় দেয় না তার। শরীর বিছানায় এলিয়ে দিতেই চোখে নেমে আসে রাজ্যের ঘুম।
সকাল সাড়ে আটটার মতো বেজেছে। তখনই এলার্ম তার যথারীতি সময়ে বেজে ওঠে। আবেগের ঘুম ও সাথে সাথে হালকা হয়ে আসে। তাছাড়া বাইরে থেকে আসা সূর্যের আলো চোখে পড়ার ফলস্বরূপ চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়ে সে। আড়মোড়া দিয়ে উঠে ফ্রেশ হয়ে হসপিটালের জন্য একেবারে রেডি হয়ে নেয় আবেগ; যদিও মাথাটা অবশ্য এখনও ঝিমঝিম করছে। শাহরিয়ার ভিলা থেকে বেরিয়ে এসেছে আজ তিনদিন পার হলো আবেগের। এর মাঝে অবশ্য মায়ের সাথে প্রতিদিনই কথা হয় তার। তবে আহিল সাহেবের এমন রুঢ় আচরণ প্রত্যাশা করে নি আবেগ। আজ‌ রাতে বাড়ি ফেরার পথে হসপিটালের বাইরেই আহিল সাহেবের সাথে দেখা হয় আবেগের। আবেগকে হসপিটাল থেকে বের হতে দেখে আহিল সাহেব ও গাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন। হুট করে এই অসময়ে হসপিটালের সামনে আহিল সাহেবকে দেখে কিছুটা ভড়কে যায় আবেগ। তবে মুখে কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই পেছন থেকে আহিল সাহেব বলে উঠেন,
– “Stay there, Abeg!”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও থমকে দাঁড়ায় আবেগ। মনে মনে ভাবতে থাকে ঠিক কি কারণে আহিল সাহেব এখানে এসেছেন। তৎক্ষণাৎ আহিল সাহেব ও এগিয়ে গিয়ে আবেগের সামনে দাঁড়ান।
– “বাড়ি চলো আবেগ।”
আহিল সাহেবের কথায় খানিকটা ভ্রু কুঁচকে নেয় আবেগ।‌ তার কথা বলার ভাবমূর্তি ঠিক কি বোঝাতে চাইছে বুঝতে পারে না আবেগ। তাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আহিল সাহেব স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠেন,

– “এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে না থেকে বাড়ি চলো আবেগ। অনেক হয়েছে তোমার মন মতো চলা। যখন যা মনে আসছে তখন তাই করছো। কি পেয়েছটা কি আমাকে? এখন থেকে এসব চলবে না; তুমি আমার কথা অনুযায়ী
চলবে। তোমার জন্য দিনকে দিন আমার রেপুটেশন খারাপ হয়ে যাচ্ছে যা আমি মোটেও সহ্য করব না।”

আবেগ ভেবেছিল আহিল সাহেব হয়তো তাকে বুঝবেন এবং সবটা মেনে নিবেন। কিন্তু এখানে তো ঘটলো তার উল্টোটা। শুধুমাত্র যশ খ্যাতির পেছনে ছুটতে গিয়েই তিনি এখানে এসেছেন? নিজের সন্তানের ভাবনার কোনো মূল্যই নেই তার কাছে? কথাটা নিজের আত্মসম্মানে লাগলো আবেগের। তাই মুখের ভাবভঙ্গি যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে উঠলো,

– “শুধু শুধু এসব কথা বলে টাইম নষ্ট করার কোনো মানে হয় না মিস্টার আহিল শাহরিয়ার। আপনি খুব ভালো করেই জানে আপনার এই রেপুটেশনের কথা ভেবে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসিনি। যতদিন পর্যন্ত আপনি আমার ভালোবাসাকে না মেনে নিবেন ততদিন এভাবেই চলতে থাকবে।
আর হ্যাঁ, আপনার জন্য একটা গুড নিউজ আছে মিস্টার আহিল শাহরিয়ার। আমি খুব শীঘ্রই যাচ্ছি আমার ভালোবাসাকে ফিরিয়ে আনতে এন্ড আপনার চোখের সামনেই আমি উপমাকে বিয়ে করব। সি ইউ সুন!”
বলেই আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না আবেগ। বড় বড় পায়ে পার্কিং এরিয়া থেকে গাড়ি ইউটার্ন নিয়ে চলে যায় নিজ গন্তব্যে। অন্যদিকে আহিল সাহেবের শরীর রাগে গজগজ করছে। ছেলেটার দিন দিন সাহস বেড়েই চলেছে; কি করে পারলো তার কথার অবাধ্য হতে? এই ক্ষোভে তিনিও আর দাঁড়িয়ে থাকেন না, গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন হসপিটালের এরিয়া থেকে।

৬৪.
বাসায় ফিরেই লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হয় আবেগ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো মুছতে মুছতেই হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ কানে যায় তার। রুম থেকে বেরিয়ে দরজা খুলতেই খেয়াল করে একটা অল্পবয়সী ছেলে একটা ব্যাগে গ্রোসারি আইটেম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তখনই মনে পড়ে সে তো এসব অর্ডার দিয়েছিল। অতঃপর বিল পেমেন্ট করে সেগুলো নিয়ে সোজা কিচেনে এগিয়ে যায় আবেগ। প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বের করে রাতের জন্য বেশ কিছু খাবার বানিয়ে খেয়ে নেয় সে। এভাবেই কেটে যায় অনেকটা সময়। রাত বাজে একটা। রুমে এসে কাবার্ড থেকে তার ব্যবহৃত কাপড় আর কয়েকটা ফাইল বের সুন্দর করে লাগেজ প্যাকেজিং করে নেয় আবেগ।‌ আগামী দুইদিন হসপিটালের সেমিনারের আয়োজন করায় দুদিনের বিশ্রাম পেয়েছে আবেগ।‌ অবশ্য হসপিটালে আরো বেশ কিছু হার্ট সার্জন আর কার্ডিওলোজিস্ট থাকায় ভোগান্তি পোহাতে হয় নি তাকে। এই দুদিনেই যা করার করতে হবে। তাই দেরি না বিকেলেই একটা টিকিট বুকিং দিয়ে দেয় আবেগ।

সকালের আলো ফোটার পরপরই কিছু ফাইলপত্র চেকআপ করে লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে আবেগ। দীর্ঘদিন পর প্রেয়সীকে দেখতে পাওয়ার, তাকে ছুঁয়ে দেয়ার বাসনা ফের পূর্ণ হবে ভাবতেই খুশি লাগে তার। অতঃপর দেখতে দেখতে সাড়ে চার ঘন্টার জার্নি শেষে প্রায় দুপুরের দিকে আবেগ পৌঁছে যায় সিলেট নগরীতে। সেখান থেকে পিকআপ ভ্যানের মধ্যে বোঁচকা নিয়ে নিজেও উঠে পড়ে সে। এখান থেকে ত্রিমোহিনীতে পৌঁছাতে পৌনে এক ঘণ্টা কিংবা এক ঘন্টা লেগে যাবে। তাই চুপচাপ আশেপাশে প্রকৃতি আর সতেজতা উপভোগ করতে করতেই গাড়ি এগিয়ে চললো সামনের দিকে। সূর্য তখন মাথার উপর তীর্যকভাবে তার রশ্নি নির্গত করছে। গাড়ি এসে থামলো ত্রিমোহিনী গ্রামের প্রবেশপথে। তবে এখান থেকে বেশিদূর রাস্তা চিনে না আবেগ। ক্যাম্প আর টুকটাক জায়গাতেই আসা যাওয়া তার। মালপত্র নিয়ে সেখান থেকে এগিয়ে সামনের দিকে কিছুটা হাঁটা শুরু করে সে। উপমার কাছ থেকে যতদূর শুনেছিল সে চেয়ারম্যান বাড়ির মেয়ে; তবে চেয়ারম্যান বাড়িটি ঠিক কোনদিকে সেটা তার অজানা। এসব ভাবতে ভাবতেই অদূর থেকে হেঁটে আসা দুজন মধ্যবয়স্ক লোকের উপর চোখ পড়ে আবেগের। তাদের কাছে জিজ্ঞেস করার এগিয়ে যেতেই লোক দুটো কপাল কুঁচকে থমকে দাঁড়ায়।
– “এখানে চেয়ারম্যান ইফতেখার সাহেবের বাড়ি কোথায় বলতে পারবেন?”
আবেগের প্রশ্নোক্ত কথাটি শুনে লোক দুটো অদ্ভুত দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকালো। সে দৃষ্টিতে কিছুটা ভীতি লুকিয়ে আছে। তারা দুজন আবেগের প্রশ্নের উত্তর তো দিলই না বরং কিছু না শোনার ভান করে আবেগকে পাশ‌ কাটিয়ে চলে যায়। লোক দুটোর এহেন কান্ডে হতবাক আবেগ। এভাবে তাকে দেখেও না দেখার ভান করার মানে কি? সে কি গুরুতর কোনো বিষয়ে রহস্য উদঘাটন করেছে নাকি যে লোক দুটো এমন অদ্ভুত ব্যবহার করলো? এসব চিন্তা নিয়ে আবেগ ফের চলতে শুরু করে। পথিমধ্যে আরো তিনজনকে একই প্রশ্ন করে সে একই ব্যবহার পেয়েছে। গ্রামবাসীর এমন অদ্ভুত আচরণ তাকে ভাবিয়ে তুলেছে বেশ।

– “কারে খুজতেছেনে আপনে?”
পেছন থেকে হঠাৎ কারো কন্ঠস্বর পেয়ে পিলে চমকে উঠে আবেগ। তড়িৎ গতিতে পেছনে তাকাতেই একজন বয়স্ক বৃদ্ধ নারীকে চোখে পড়ে তার।
– “আসলে এখানে চেয়ারম্যান ইফতেখার সাহেবের বাড়িটা খুঁজে পাচ্ছি না। তার সাথে আমার একটু জরুরী দরকার ছিল।”
কথাটি শুনে বাদবাকি মানুষের মতো মহিলাটিও যে অবাক হয়েছে তা বুঝতে বাকি থাকে না আবেগের। তবে সবার ব্যবহারের ব্যাতিক্রম ঘটিয়ে মিনিট কয়েক পরেই মহিলাটি বলে উঠেন,
– “আইচ্ছা ঠিক আছে বাজান। আমার পেছনে আইসো। আমি তোমারে নিয়া যামু চেয়ারম্যান বাড়ি।”
এ কথা শুনে আবেগ খুশিতে আপ্লুত হয়ে বৃদ্ধ মহিলা টির পিছু নিল। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় অনেকখানি পথ চলে এসেছে তারা। এ জায়গা গ্রামের সামনের জায়গা থেকে বেশ শুনশান ও বটে। আধভাঙা প্রাচীর তোলা একটি জায়গার সামনে এসেই বৃদ্ধ মহিলা থমকে যায়।
– “এই লও চেয়ারম্যান বাড়ির চৌকাঠ।”
মহিলাটির কথায় বিলম্ব করে না আবেগ। মাথা তুলে দ্রুত ভেতরের দিকে পা বাড়াতে গিয়েই থেমে যায় সে। কোথায় নিয়ে এসেছে মহিলাটি তাকে? এটাতো কোনো দিক দিয়ে চেয়ারম্যান বাড়ির মতো লাগছে না। এ তো‌ আস্ত একটা পোড়াবাড়ী যার বিভিন্ন ধ্বংসস্তুপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আশপাশ জুড়ে।
– “একি আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছেন? এখানে তো কোনো মানুষই নেই!”
আবেগের কথার প্রত্তুতরে মহিলাটি কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই পেছন থেকে বাচ্চা কন্ঠস্বর ভেসে আসে,

– “ছিল এইখানেও মানুষ ছিল! হাসিখুশি, প্রাণবন্ত একটা মানুষ ছিল। কিন্তু কিছু খারাপ মানুষের জন্য সেই মানুষটাও নিঃশেষ হইয়া গেল এই ধ্বংসস্তুপের মতো!”

৬৫.
আবেগ চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট মেয়েটার দিকে। মেয়েটার চুল, পোশাক আশাক উস্কখুস্ক।
– “এটা চেয়ারম্যান বাড়ি হতে পারে না! উপমা, সে কোথায়? তার ভাষ্যমতে তো এখানেই তার বসবাস।”
মেয়েটির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে আবেগ। মেয়েটিও আহত দৃষ্টিতে একবার পোড়া বাড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে নেয়। অতঃপর কিছুটা ভেতরের দিকে যেয়ে বলে উঠে,
– “হ্যাঁ ঠিকই কইছেন আপনে! এখানেই ছিল উপমা বুবুর বসবাস।‌ কিন্তু মানুষটা যে আমারে রাইখা ঐ দূর আকাশের বাসিন্দা হইতে চইলা যাইব তা কে জানত?”
মেয়েটির কথা কর্ণগোচর হতেই পিলে চমকে উঠে আবেগ। কি সব হাবিজাবি বকছে সে?

– “এই মেয়ে কি সব বলছো তুমি? উপমা কোথায় গিয়েছে? উপমা, উপমার পরিবার কোথায়? তারা কি এই জায়গা ছেড়ে চলে গিয়েছে?”
প্রত্তুতরে কিছু বললো না মেয়েটি। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাশ দিয়ে বৃদ্ধ মহিলাটি কাটকাট গলায় বলে উঠেন,
– “ঠিকই কইতাছে পূর্ণা! এই মাইয়াই হইলো উপমার বইন। আর উপমা? সে তো বহুদিন আগেই পরপারে চইলা গেছে। মা মরা মাইয়াডা সংসারের হাল জন্য কম করে নাই। তার পরেও ক্যান যে ক্ষমতার লোভে আইসা বাপে মাইয়াডার এত বড় ক্ষতি করলো!”

পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়ার উপক্রম হলো আবেগের। শরীর ক্রমশ অসাড় হয়ে আসতে শুরু করলো তার। চোখ দুটোও মুহুর্তে কেমন যেন ঝাপসা হয়ে উঠে। আচ্ছা কিছুদিন আগেও তো সব ঠিক ছিল।‌ মাঝখানে কি এমন হয়ে গেল যে তার প্রেয়সীই আজ তার থেকে অনেক দূরে। পূর্ণাকে মলিন গলায় জিজ্ঞেস করতেই কাদো কাদো কন্ঠে সবটা বলে উঠে পূর্ণা। ইফতেখার সাহেবের এমন নির্মমতা আর নিষ্ঠুরতার কথা শুনতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে আবেগের। কিছুটা বিরতি নিয়ে আবেগের উদ্দেশ্যে পূর্ণা ফের বলে উঠে,

– “সেইদিন যখন বোমা ফাটলো তখন চারপাশ অন্ধকার হইয়া গেল। বাড়ির কয়েকটা অংশও ছিটাইয়া পড়লো আশপাশে। জানেন আমি বুবু বুবু বইলা অনেক বার চিল্লাইছি, ডাকছি কিন্তু বুবু শোনে‌ নাই।‌ সেইখান থেইকা উইঠা আইসা আমারে জড়াইয়া ধরে নাই। কেন করলো বুবু এমন?”

এটুকু বলেই থামে আবেগ। তার অশ্রু‌ আর উত্তপ্ত শ্বাসে মোটা ফ্রেমের চশমাটা ঝাপসা হয়ে উঠেছে বেশ। অবন্তীর চোখের কোণেও কিছুটা পানি জমেছে। আবেগ থামতেই অবন্তী ধরা গলায় বলে উঠলো,
– “কিন্তু ইফতেখার সাহেব? তার কিছু হয়নি? যে তার নিজের আপন মেয়ের সাথে এমন করলো!”

অবন্তীর কথায় বাস্তব জগতে ফিরে আসে আবেগ। দ্রুত চশমাটা ঠিক করে নিয়ে চোখের পানিটুকু মুছে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠে,
– “হ্যাঁ হয়েছে তো। পূর্ণার ভাষ্যমতে সেইদিন সেই ঘটনার পরমুহূর্তেই নাকি ইফতেখার সাহেব আরো পৈশাচিক হয়ে উঠেছিলেন।‌ উপমার পর নাকি তিনি অফিসার আমান সহ পূর্ণার উপর ও ক্রোধের অনলে পুড়ে আক্রমণ করতে চেয়েছিলেন। যার ফলস্বরূপ অফিসার আমান ইফতেখার সাহেবকে সেখানেই ইনকাউন্টার করতে বাধ্য হন। আর বাদবাকি সবাইকে এরেস্ট করে নিয়ে গিয়েছিল।
তবে হ্যাঁ আ’ম প্রাউড অফ মাই উপমা। নিজের মায়ের খুনিকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে সে পেরেছিল। মেয়েটা একবারও নিজের জন্য, আমার জন্য ভাবেনি‌। মৃত্যু নিশ্চিত ছিল জেনেও বোনের জন্য পিছপা হয়নি। অবশ্য মেয়েটা আগে থেকেই বোধহয় এসবের আচ করতে পেরেছিল। তাইতো তার ডায়েরির পাতা জুড়ে শুধুই আমি ছিলাম। খুব ইচ্ছে করছিল উপমাকে যদি একবারের জন্য ছুঁয়ে দিতে পারতাম, বলতে পারতাম তাকে কতটা ভালোবাসি!”
অবাক হয় অবন্তী। ডায়েরি মানে? উপমা তো সেখানেই মারা গিয়েছিল; তাহলে ডায়েরিটা আসলো কোত্থেকে?

– “ডায়েরিটা আমি পাইনি। পূর্ণা আমাকে এনে দিয়েছিল। সেটাও ছিল ঐ বাড়িটার মতো আধপোড়া। কোনো কোনো পৃষ্ঠা অর্ধেক পুড়ে গিয়েছে আবার কোনোটা পুরোটাই। আমি শুধু শেষের কয়েক আধপোড়া পাতাই পেয়েছিলাম যেখানে গুটি গুটি অক্ষরে লিখা ছিল,

‘জানেন ডাক্তার মশাই, এই দুনিয়াটা খুবই অদ্ভুত। কেউ ভালোবাসা পাওয়ার জন্য হাহাকার করে; আবার কেউ সবটা পাইয়াও অবহেলা করে। তবে আমি পাইছি; যতটুকু‌ পাইছি, যাই পাইছি ঐটুকু দিয়াই এক যূগ কাটায় দেয়া সম্ভব! তয় কিছু মহাজনরা বলে সুখ নাকি ক্ষণিকের বস্তু; জীবনে‌ আইসা তা কিছুক্ষণ পরেই নাকি কর্পূরের মতো মিলাইয়া যায়। আমার সাথেও কি তাই হইলো বুঝি? আপনি আমার জীবনে আসলেন, প্রেম হইলো, ভালোবাসা হইলো কিন্তু আপনারে? আপনারে আমার পাওন হইলো না।
জানেন আমাদের গল্পটা কেমন? একদম পরিণীতার মতোন‌। পরিণীতা গল্পের পরিণীতা যেমন ভালোবাইসাও তার বাবাই দারে পায় নাই তেমনি ও আমি আপনারে পেলাম না। তবে আফসোস নাই; আমি না হয় আনুভবেই আপনার পাশে থাকব। জানি এই লেখাগুলো হয়তো কোনোদিন ও আপনার কাছে পৌঁছাইব না। তবুও বলব, ভালোবাসি ডাক্তার মশাই!’

এরপর সেখানে দুদিন থেকে ঠিক করলাম পূর্ণাকে আমার সাথে ঢাকায় নিয়ে আসব। ওকে বড় করব, পড়াশোনা করাব। নিজের পায়ে নিজেকে দাঁড়াতে শেখাব। তারপর সে চাইলে তাকে একজন যোগ্য পাত্রের হাতে তুলে দিব। হলো ও তাই। সময় পেরোতে লাগলো; পূর্ণাও কিশোরী থেকে ম্যাচিউরড হয়ে গেল। আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি উপমা! আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি!”

অবন্তীর চিবুক বেয়ে এবার সত্যিই জল গড়িয়ে পড়লো। আবেগ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের বোহেমিয়ান নদীর দিকে। মুখশ্রীতে তার উন্মাদনা। একজন ব্যর্থ প্রেমিকের উন্মাদনা। অবন্তী দ্রুত চোখ মুছে নিল। অতঃপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে জিজ্ঞেস করে উঠে,
– “দ্বিতীয়বার কারো প্রেমে পড়তে মন চায়নি? একটা মানুষের স্মৃতি নিয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দেয়া যায় নাকি?”
অবন্তীর প্রশ্ন শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আবেগ।
– “উহু, এটা ঘোর অন্যায়! তুমি যদি কারো ভালোবাসায় একবার উন্মাদ হয়ে যেতে পারো তাহলে জগতের এইসব বানোয়াট নিয়মকানুন তোমায় ছুঁতে পারবে না। আমিও আমার মায়াবিনীর‌ ভালোবাসায় উন্মাদ। তাইতো কিছু লাগে না আমার আর।
আর স্মৃতি নিয়ে মানুষ বড়জোর এক যুগ পার করতে পারবে। কিন্তু অনুভব? একটা মানুষকে অনুভব করে তুমি সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। এ অনুভব শেষ হওয়ার না। কখনোই না!
আমিও যে আমার মায়াবিনীর অনুভবে আসক্ত। যাকে অনুভব করা যায়, ভালোবাসা যায়; কিন্তু ছোঁয়া যায় না। ঠিক যেন #মায়াবন_বিহারিনী। ভালোবাসি মায়াবিনী, ভালোবাসি!”

বলেই বসা থেকে উঠে পড়ে আবেগ। সূর্যটা অস্তমিত‌। সূর্যের লালিমার আভায় লাল বর্ণ ধারণ করেছে প্রকৃতি।
– “সন্ধ্যে হয়েছে! পাখিরা নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। তুমিও ফিরে যাও।”
বলেই মুচকি হেসে ফিরতি পথে পা বাড়ায় আবেগ। আজ আবারো পুরনো দিনের কথা স্মৃতিচারণ করে মনটা বেশ হালকা হয়েছে। সাথে করে তার মায়াবিণীর‌ হাস্যোজ্জল‌ মুখশ্রীও মনে পড়ছে তার। চঞ্চলা মায়াবতী।

অবন্তীও টলমল পায়ে উঠে দাঁড়ায়। আবেগের অবয়ব অনেকটা দূরে চলে গিয়েছে। সাইড ব্যাগে থাকা রেকর্ডার টা হাতে নিয়ে সেটার দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। হাত তার কাঁপছে। এতক্ষণ বলা আবেগের সব কথাই এখানে রেকর্ড হয়েছে। স্টোরি কভার করার জন্যেই প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল সে। কিছু না ভেবেই চোখ বন্ধ করে রেকর্ডার টা সে ছুঁড়ে মারে বোহেমিয়ান স্রোতে। সেকেন্ড কয়েকের ব্যবধানেই সেটি তলিয়ে যায় অথৈ‌ জলের গভীরে। তার পুরো শরীরটা কাঁপছে। সে খুব ভালো করেই জানে এটা কভার না করলে তার চাকরি আরো একধাপ রিস্কে চলে আসবে। তবুও চায় না সে এটা কেউ জানুক।
– “কিছু গল্প একান্তই নিজের থাক। কেউ না জানুক সেগুলো। কেউ না! গল্পগুলো শুধু অনুভব করা হোক হৃদয় নিংড়ে ঠিক এই মায়াবন বিহারিনীর মতোন‌।”

সীমাহীন খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের সাথে নিজেই বিড়বিড় করে বলে উঠে অবন্তী।

সবার জীবনে পূর্ণতা প্রাপ্তি থাকে না। কিছু কিছু মানুষের জীবনে পরিস্থিতি, প্রেক্ষাপট বিয়োগ যন্ত্রনাও রেখে যায়‌। সেগুলো কাটিয়ে কেউ কেউ এগিয়ে যায় সামনের দিকে আর কেউ কেউ সেগুলো আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকে চিরকাল। ভালোবাসা গুলো হারিয়ে যায় না কখনো সম্পূর্ণ রূপে। হয়তো কখনো বা আড়ালে লুকিয়ে যায়। ভালোবাসা তো হলো উপলব্ধি, অনুভূতি। এসব অনুভব করতে হয়, উপলব্ধি করতে হয়। অমর হয়ে থাকুক ভালোবাসা অনুভবের আড়ালে।

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here