মেঘমুখ,পঞ্চম পর্ব

0
474

#মেঘমুখ,পঞ্চম পর্ব
#লেখনীতে সবুজ আহম্মদ মুরসালিন

‘আমার হাতটা ছাড়া যাবে? হাতের তালু ঘেমে গেছে?’ হঠাৎ নীলা অন্য দিকে তাকিয়ে খুব আস্তে করে আমার উদ্দেশ্যে কথাটা বলল।
‘আচ্ছা।’ এই বলে আমি নীলার হাত ছেড়ে দিলাম।
নীলা হাতের তালু মুঁছতে মুঁছতে বলল, ‘অনেকক্ষণ হাত ধরে ছিলে, এই জন্য হাতের তালু ঘেমে গেছে। যা গরম পড়েছে!’

মিনিট পাঁচেক পর। আমি আবার হাত বাড়িয়ে দিলাম। নীলা মুছকি হেসে আমার হাতের তালুর উপর হাত রাখলো। আমি নীলার হাত ধরে রিক্সায় বসে রইলাম। নীলা অন্যদিকে ফিরে হাসছে। আমিও অন্য দিকে ফিরে হাসছি। অদ্ভুত মুহূর্ত। দু’জনে রিক্সা করে ঘুরছি।

জ্বর থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে ছয়দিন লেগেছে। এই প্রথম জ্বর আমাকে ভালই ভুগিয়েছে। আমি কখনো দু’দিনের বেশি অসুস্থ থাকি না৷ কিন্তু এবার পাঁচটা দিন লাগলো সুস্থ হতে। গতকাল মা’কে সিলেটের ট্রেনে উঠিয়ে দিয়েছি। আব্বুকে ফোন করে সময়মত স্টেশনে থাকতে বলেছিলাম। মা বাসায় গিয়ে জানিয়েছে সুস্থ ভাবে পৌঁছেছে।

নীলার সাথে এটা আমার দ্বিতীয় বারের মত সরাসরি দেখা। ওইদিন রাতে নীলা হা হা রিয়েক্ট পাঠানোর পর আর কথা হয়নি। রাতের দিকে আবার প্রচন্ড জ্বর এসেছিলো। পরের দিন দুপুরে একটু সুস্থ হয়ে নীলাকে ফোন দিয়েছিলাম। নীলা ফোন রিসিভ করেনি। পরে ফোন করে জানিয়েছে, নীলা ক্লাসে ছিলো। ক্লাস শেষ করে কল ব্যাক করেছে। সেদিন নীলার সাথে দীর্ঘ সময় কথা হয়। বৃষ্টিতে ভেজে, রাতে জ্বর হওয়া, হাসপাতালে ভর্তি, ফোনে চার্জ না থাকা, সব খুলে বলার পর নীলা আর রাগ করে থাকতে পারেনি। নীলা বারবার বলেছিলো দেখতে আসবে। কিন্তু হাসপাতাল থেকে পরের দিন বাসায় চলে যাই। ডাক্তার বলেছে, ‘বাসায় বিশ্রাম নিন, এবং ঠিকমতো ওষুধ খান, পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমান। খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবেন৷ হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন নাই।’

গতকাল মা সিলেটে ফিরে যাবার পর রাতে নীলাকে ফোন করে আজ দেখা করতে বলি। নীলা সাথে সাথে হ্যাঁ বলে। নীলা বলেছিলো, কাল আমার ক্লাস আছে। ক্লাস শেষে দেখা করবো। তুমি একটু আগে এসে বাইরে অপেক্ষা করো। আমি নীলার কথামতো অনেক আগে এসেছি। চারটায় ক্লাস শেষ হবে। ক্লাস শেষ করে বাইরে আসতেই নীলার সাথে আমার দেখা হয়ে যায়। নীলা একটা হাসি দিয়ে বলল,
”এই যে অভ্র, কথামতো আগেই চলে এসেছো দেখছি। কখন এসেছো?’
‘মিনিট তিরিশ হবে।’
‘আমি কি এতো আগে আস্তে বলেছি। আর একটু দেরি করে আসলে সমস্যা হত না।’
‘এই যে আজ আগে আসলাম। যখন দেরি করে আসবো সেদিন রাগ করবে না। তাহলেই হবে।’
‘বাহ, আগে থেকে দেরি করে আসবে বলে রাখছো।’
‘কি করবো বলো, আজকার দেরি করে এসে যদি সত্যি কথাও বলি তাহলে মানুষ বিশ্বাস করে না। ভাবে এক্সকিউজ দিচ্ছি।’
‘আমি এরকম না। আমি তোমাকে অনেক বিশ্বাস করি। এই বিশ্বাস টুকু রাখলেই হবে। আচ্ছা একটা রিক্সা ঠিক করো। আজ রাত পর্যন্ত রিক্সায় ঘুরবো।’

সেই থেকে দু’জনে রিক্সায় ঘুরছি।

‘তুমি কিন্তু এখনো উত্তর দেও নি?’
নীলা আমার দিকে ফিরে বলল, – কোন প্রশ্নের উত্তর?
‘যে প্রশ্নটা যতবার মেসেজ এ জিজ্ঞাসা করেছি ততবার হা হা রিয়েক্ট পেয়েছি। যতবার ফোনে জিজ্ঞাসা করেছি ঠিক ততবার শুধু নিশ্বাসের শব্দ শুনেছি। তুমি প্রতিবারই নিশ্চুপ ছিলে। সেই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাই। এখন বলো।’
নীলা বাচ্চা শিশুর মত অবুঝ হবার ভঙ্গিতে বলল,
‘কি বলবো?’
‘যেটা আমি শুনতে চাই।’
‘তুমি কি শুনতে চাও? সেটা তুমি জানো। আমি কি করে জানবো।’
আমার অল্প অল্প রাগ হচ্ছে।
‘আমি কি শুনতে চাই তুমি জানো না?’
‘না জানিনা। তুমি আবার বললে হয়তো মনে পড়বে৷’
‘আচ্ছা, থাক। তোমার মনে করার দরকার নাই। আমি আর শুনতে চাই না। কখনো বলতেও চাই না।’

নীলা খুব জোরে হাতে চিমটি কাটলো। রাগি রাগি কন্ঠে বলল, ‘তুমি শুনতে চাও না? সত্যি শুনতে চাও না?’
‘না, আমি শুনতে চাই না। আমি বলতেও চাই না।’ আমিও সামান্য রাগ করার ভাব নিয়ে নীলাকে কথাগুলো বললাম।

নীলা মন খারাপ করে অন্য দিকে ঘুরে তাকালো। কিছুটা সরে গিয়ে বসলো। হাত ধরা ছিলো। ছেড়ে দিলো। এভাবে কেটে গেলো নৈশব্দে কিছুক্ষণ।

নীলা রিক্সা চালক কে বলল, ‘মামা, রিক্সা উত্তরার দিকে ঘুরান। আমি বাসায় যাবো।’
‘এখনি চলে যাবে। মাত্র সন্ধ্যা হলো। কফিশপে গিয়ে কফি খেতে খেতে কিছুসময় গল্প করি।’
‘আমার ভাল লাগছে না অভ্র। আমি বাসায় যেতে চাই৷ এখনি। মামা, রিক্সা ঘুরান।’

আমি আর বাঁধা দিলাম না। রিক্সা উত্তরার দিকে যাচ্ছে। এক ঘন্টার মত সময় লাগলো আসতে। পৌঁছে গেলে নীলা বলল, ‘মামা, এখানে রিক্সা থামান। ভিতরে যাওয়া দরকার নাই। আপনি রিক্সায় থাকা এই ভদ্র লোককে পৌঁছে দিন।’

এই বলে নীলা রিক্সা থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলো। মেইন রোড থেকে নীলাদের বাসায় হেটে যেতে মিনিট দশেকের একটু বেশি সময় লাগে। নীলা রিক্সা থেকে নেমে যাওয়ার পর আমি রিক্সা মামাকে বললাম, ‘মামা, এখানে অপেক্ষা করুন৷ আমি আসছি।’

নীলার পিছুপিছু দৌঁড়ে গেলাম। নীলার কাছে আসতেই নীলা ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘কি চাই?’
‘কি চাই মানে?’ নীলা এভাবে কথা বলবে আমি কখনো ভাবিনি। জায়গাটা একদম শান্ত, আশেপাশে কোনো মানুষ নেই। এতো অল্প রাতে এখানে মানুষগুলো কি ঘুমিয়ে পড়েছে? কে জানে।

নীলা আবার বলল, ‘আমার পিছুপিছু দৌঁড়ে এসেছো কেনো? কিছু বলবে?’
আমি নিলার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললাম,
‘কি বলবো?’
নীলার রাগ আরো বেড়ে গেলো। বলল, ‘তাহলে এভাবে পিছুপিছু এসেছো কেনো? আমি কি আসতে বলেছি?
এই বলে নীলা আবার হাঁটতে শুরু করলো। আমি নীলার হাত ধরে কাছে টেনে আনলাম।
‘এভাবে পালাচ্ছ কেনো? পালানো বন্ধ করো?’

নীলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আমি আস্তে করে নিলার কানের কাছ থেকে চুলগুলো সরিয়ে কানের খুব কাছে মুখ নিয়ে কিছুসময় নিয়ে বললাম, ‘তোমার তুলের ঘ্রাণ খুব সুন্দর। কি স্যাম্পু দিয়েছো?’ এই বলে হেসে দিলাম।

রাগে নীলার চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো। নীলা চলে যাবার জন্য হাত ছুটানোর ট্রাই করছে। ছটফট করছে। নীলা চলেই যাবে। আমি নীলার চোখে হাত দিয়ে বন্ধ করে দিয়ে বললাম, ‘শান্ত হও, খুব শান্ত। ধিরে ধিরে নিশ্বাস নেও। শান্ত। একদম শান্ত থাকো।’

নীলা শান্ত হলো। খুব শান্ত হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি নীলার খুব কাছে চলে গেলাম। কিছুটা সময় নিয়ে বললাম, ‘আমি যতটা আকাশ পছন্দ করি, আমি যতটা সাদা মেঘ পছন্দ করি তারচে’ বেশি তোমাকে পছন্দ করে ফেলেছি। তোমাকে অনেকটা ভালোবেসে ফেলেছি। ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি।’

নীলা সাথে সাথে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি ভাবিনি নীলা এটা করবে। এই রাস্তার মধ্যে। আমি অনেকটা অবাক-খুশি। আমিও নীলাকে জড়িয়ে ধরলাম।

হঠাৎ নীলাকে কিছুটা দূরে সরিয়ে দিলাম। নীলা অবাক চোখে বললো, ‘কি হলো?’
দূর থেকে হেটে আসা লোকটাকে দেখিয়ে বললাম,
‘আমরা গলিতে আছি। তুমি এখানে আমাকে জড়িয়ে ধরবে ভাবিনি।’
নীলা অনেকটা লজ্জা পেলো কথাটা শুনে। নীলা কিছুই বললো না। লোকটা পাশ দিয়ে চলে যাবার পর বলল, ‘আমি এখন বাসায় যাবো। তুমি চলে যাও।’
এই বলে নীলা হাটা শুরু করলো।

আমি একটু জোর গলায় বললাম, ‘যেটা শুনতে চাই সেটা বলবে না?’
নীলা যেতে যেতে হেসে উত্তর দিলো, ‘জড়িয়ে ধরার পরেও শুনতে হবে?’

এটা বলে চলে গেলো। কোনো কিছু বলার সুযোগ দিলো না। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাসার দিকে রওনা হলাম।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here