অপূর্ব প্রাপ্তি,পর্ব-দশ

0
846

অপূর্ব প্রাপ্তি,পর্ব-দশ
নাফিসা নীলয়া।

রুমা আর সাইফের বিয়ের যাবতীয় সকল কার্যক্রম প্রায় শেষ। দুই পরিবার একসাথে বিয়ের আয়োজন করেছে। গায়ে হলুদ,মেহেদী সব একসাথেই হবে। এজন্য একটা রিসোর্ট ভাড়া করা হয়েছে। নীরা আর মিলা বিয়ের সব কাজ নিজ থেকে করছে। রুমার আত্মীয় স্বজন বেশি একটা নেই। তাই কাজিন সংখ্যাও কম। তার অভাব পূরণ করেছে নীরা আর মিলা। সকাল থেকে নীরা নানা কাজে ব্যস্ত। আজ রুমা আর সাইফের মেহেদী অনুষ্ঠান। এই নিয়েও রুমা আর সাইফের একদফা লেগে গেছিলো। সাইফের কথা মেহেদী অনুষ্ঠান আলাদা করে করার কি প্রয়োজন! গায়ে হলুদের দিনই তো মেহেদী দেওয়া যায়। আবার রুমার কথা হলো জীবনে বিয়ে একটাই হয়।আর সে সেখানে কোনো অপূর্ণতা রাখবে না। মেহেদী আলাদা করেই করা হবে। নীরার ও এতো কিছু পছন্দ না। সে যদি বলতো রুমা একবাক্যে মেনে নিতো। তবে বিয়েটা রুমার। বিয়ে জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর সেখানে বিয়ের কনের শখ আহ্লাদের কোনো ত্রুটি রাখতে নেই। যার বিয়ে তাকেই সব সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া উচিত। নীরা সাইফকেও এই কথা বুঝিয়েছে। যে রুমা তো নিজের বাবা-মা ভাই বোনকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে,সাইফ তো আর নিজের পরিবার পরিজন ছেড়ে যাচ্ছে না। তাহলে বিয়ের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তো ওর শখ পূরণ করতে বাধা নেই। আর তারপর সাইফ ও বিষয়টা মেনে নিয়েছে। নীরা একমনে কাজ করছে এদিকে মিলা কখন থেকে ওকে ডেকেই চলেছে।

-আপা,এই আপা।

-কি হয়েছে মিলা দেখতে পাচ্ছিস না কাজ করছি।

-দেখতে তো পারছিই। খিদে পেয়েছে আমার।

মিলার কথা শুনে নীরা হাতের কাজ থামিয়ে দিলো। বোনের কষ্ট সে তো সহ্য করতে পারে না। আর এদিকে মিলার খিদে পেয়েছে। না জানি কতক্ষন ধরে খিদে পেটে ঘুরছে বেচারি। নীরা তাড়াহুড়ো করে বোনের কাছে আসলো।

-কিহ্! তোর খিদে পেয়েছে আর তুই আমাকে এখন বলছিস? আগে বলবি না? আশ্চর্য মিলা। কতক্ষন ধরে খিদে পেটে ঘুরছিস তুই। চল তাড়াতাড়ি।

বোনের খিদের কথা শুনে অস্থির হয়ে পরলো নীরা। মিলাকে টেনে কিচেনের দিকে নিয়ে যেতে ধরলো। মিলা দেখলো নীরা অস্থির হয়ে পরছে। তাই সে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলো।

-আপা, আমার বেশি খিদে পায়নি। তুই অযথা এতো অস্থির হচ্ছিস।

-কিহ্। এই না বললি তোর খিদে পেয়েছে। চুপ থাক তুই।

বোনকে ধমক লাগিয়ে রান্নাঘরের ভেতরে উকি দিলো নীরা। উকি দিয়ে দেখলো সেখানে রুমার মা কাকীরা সবাই একসাথে নাস্তা বানাচ্ছে। রুমার মা নীরাকে দেখতে পেয়ে কাছে ডাকলেন। নীরা ভেতরে গেল। রুমার মা নীরাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসেন। রুমার চেয়ে কোনোঅংশে কম মনে করেন না উনি নীরাকে।

-কিরে মা খালি কাজই করতে থাকবি? খেতে হবে না নাকি?আয় এদিকে।

নীরা রুমার মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসলো।

-সেজন্যই এসেছি আন্টি মিলাটারও খিদে পেয়েছে।

নীরার কথা শুনে রুমার মা হাহুতাশ করা শুরু করলেন।

-হায় হায় বলে কি। নীরা তুই আমার হাতের মার খাবি এবার। মেয়েটার খিদে পেয়েছে আর তুই আমাকে এখন বলছিস এসব কথা। যা সবগুলো টেবিলে গিয়ে বস। আমরা নাস্তা নিয়ে আসছি।

-আমি সাহায্য করছি আন্টি।

নীরার কথা শুনে রুমার মা নীরাকে কপট ধমক লাগালেন।

-চুপ! যা বলছি। চুপচাপ গিয়ে বস টেবিলে। আর সবাইকে ডেকে বসা।

রুমার মায়ের ধমক শুনে হেসে ফেললো নীরা। বাইরে গিয়ে সবাইকে ডেকে আনলো। সবাই একসাথে খেতে বসলো। রুমা হাই তুলতে তুলতে এলো। বিয়েন কনে দেখে সবাই তাকে এক্সট্রা কেয়ার করছে। সে বেলা পর্যন্ত ঘুমাতে পারছে। সে হেলতে দুলতে টেবিলে গিয়ে বসলো।

-মহারানীর ঘুম ভেঙেছে তাহলে।

রুমাকে হেলতে দুলতে আসতে দেখে কথাটা বললো তার এক কাজিন।

-কি বলো দিনা। আমাদের রুমা তো এই কয়দিন জান প্রান দিয়ে ঘুমাবে। বিয়ের রাতে কি আর ঘুমাতে পারবে বলো। তাই সব ঘুম এখনই ঘুমিয়ে নিচ্ছে। কিরে রুমা ঠিক বললাম না!

রুমার কাজিনের সাথে তাল মিলিয়ে টিপ্পনী কাটলো রুমাদের এক বান্ধবী। এরকম কথা শুনে মুহূর্তেই সবাই হাসিতে ফেটে পরলো। রুমা রেগে গেল। এরকম স্বস্তা রসিকতা তার একদম পছন্দ না। রুমা কিছু বলতে চাইছিলো। নীরা রুমার হাত ধরে ইশারায় কিছু বলতে নিষেধ করলো। রুমা চুপ করে গেল।

-চুপ করো সবাই। এবার নাস্তা তো করে নাও। অনেক কাজ আছে। কাজ শেষে গল্প করা যাবে।

রুমার মায়ের কথায় সবাই চুপ করে গেল। রুমার নিজের হাতে খেতে ইচ্ছে করছে না। রুমার আলসেমি লাগছে। সারা সকাল সে ঘুমিয়েছে। তবুও আলসেমি লাগছে। সে তার মায়ের দিকে তাকালো দেখলো তার মা কাজে ব্যস্ত। এরপর ভাবলো সে নীরাকে বলবে।এদিকে মিলারও হাত দিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে না। মিলা অনেক কাজ করেছে এজন্য তার এখন একদম নিজের হাতে খেতে ভালো লাগছে না। বাসায় থাকলে সে তার আপার হাতে খেতো। সে ভাবলো এখানেও আপাই খাইয়ে দিবে সমস্যা কি আর!

-নীরা খাইয়ে দে ভালো লাগছে না।

-আপা খাইয়ে দাও ভালো লাগছে না।

রুমা আর মিলা একই সাথে বলে উঠলো। ওদের দুজনের কান্ডে আবার সবাই হেসে দিলো। রুমা আর মিলাও হাসলো। নীরা মিষ্টি হেসে চেয়ার নিয়ে সামনাসামনি করে বসলো। তারপর রুমাকে আর মিলাকে একসাথে খাইয়ে দিতে লাগলো। খাওয়ার সময় রুমা তাড়াতাড়ি গিলতে লাগলো। এটা তার স্বভাব।

-আস্তে খা রুমা। গলায় আটকে যাবে। আজব! আমি কি চলে যাচ্ছি নাকি যে তুই এতো তাড়াতাড়ি গিলছিস। মিলাকে দেওয়ার আগেই হা করে থাকিস!

নীরার এমন কথা শুনে মিলাসহ সবাই হাসিতে ফেটে পরলো। আর রুমা মুখ গোমড়া করে নিলো।

-আজও বকবি? দুদিন পর তো চলেই যাচ্ছি।

মুখ ফুলিয়ে কথাটা বললো রুমা।

-হয়েছে আর ইমোশনাল হতে হবে না। আস্তে আস্তে খাবার গিল।

মিলা আর রুমাকে খাইয়ে ওদের ঘরে পাঠিয়ে দিলো নীরা। মিলাকে বললো রুমাকে সবকিছুতে সাহায্য করতে। সে একটু পরেই আসবে। নীরার ভালোমতো খাওয়া হয়নি। তাই রুমার মা ওকে খেয়ে নিতে বললো। নীরা খেতেই বসেছিলো। তখনই কিছু মহিলার কথা তার কানে আসলো।

-দেখো এটা রুমার ওই প্রতিবন্ধী বান্ধবিটা না? কতো বয়স হলো এখনো বিয়ে হলো না।

-আরে প্রতিবন্ধী মেয়েদের বিয়ে হয় নাকি। যতোই পড়ালেখা করুক। এদের জীবনে সংসার হয় না। কোনো ছেলে এরকম মেয়ে বিয়ে করে নিজের জীবন নষ্ট করে নাকি!

নীরার গলায় খাবার আটকে আছে। সে গিলতে পারছে না। এরকম কথা তার আজীবনের সঙ্গী। ছোট থেকেই এসব কথা সে শুনে এসেছে। বড় হবার পর এর যথাযথ জবাব ও সে দিতো। তবে আজ দিতে পারছে না। সে চাইছে না তার প্রানের বোনসম বান্ধবির বিয়েতে কারো মধ্যে মনোমালিন্য হোক। সে নিঃশব্দে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। সফল ও হলো। রুমা আর মিলা থাকলে এতক্ষনে কুরুক্ষেত্র হয়ে যেতো ভাবলো নীরা। ভেবেই হাসলো। খেয়ে উঠে আস্তে আস্তে হেটে রুমার ঘরে চলে গেল সে।

-ছোট ভাই কি করছোটা কি তুমি?রেডি হওনি কেন এখনো? আশ্চর্য আজ যে রুমা আপু আর সাইফ ভাইয়ের মেহেদী সেরেমনি মনে নেই তোমার?

তিতলি একগাদা জামাকাপড় নিয়ে রেহানের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কথাগুলো বললো। রেহান তৈরিই হতে যাচ্ছিলো। তিতলির একগাঁদা জামাকাপড় নিয়ে ঘরে ঢোকা দেখে থেমে গেল। নিজেই এখনো তৈরি হয়নি। আর ওকে তাড়া দিতে এসেছে আজব কিসিমের মেয়ে তার বোন।

-তুই নিজেই তো তৈরি হসনি। আবার আমাকে বলছিস। আশ্চর্য!

-হবো বেশি সময় লাগবে না। দেখ তো কোনটা পরলে মানাবে আমাকে?

রেহান দেখলো তিতলি একগাঁদা জামাকাপড় থেকে তাকে চুজ করতে বলছে। সে এতো গুলো থেকে কিভাবে চুজ করবে। তাও করতে তো হবেই নইলে ভাই ভাই করে বিচার দিতে যাবে তার বোন। মেহেদী অনুষ্ঠান যেহেতু রুমা তাকে বলেছিলো সব মেয়েরা জলপাই রঙের শাড়ি পরবে। ছেলেরা পরবে মেরুন পাঞ্জাবি। তাই অনেকগুলো ড্রেস থেকে সে একটা জলপাই রঙের শাড়ি তুলে দিলো তিতলির হাতে।

-শাড়ি পরবো?, সিরিয়াসলি?

-হ্যা তো? এমন ভাব করছিস যেনো জীবনে শাড়ি পরিসনি।

-পরেছি, তবে আজকে পরতে ইচ্ছে করছে না।

-রুমা আপুর সাথে কথা হয়েছিলো। উনি বললেন সব মেয়েরা জলপাই রঙের শাড়ি পরবে। তো তুইও শাড়িই পর।

-আচ্ছা ঠিক আছে। তুইও তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। আমি যাই আর ভাইকে ফোন করে তাড়াতাড়ি আসতে বলি।

-আচ্ছা ঠিক আছে। আমাকে বলে নিজেই দেরি করে ফেলিস না আবার।

-করবো না।

তিতলি তাড়াহুরো করে তৈরি হতে গেল। রেহানও তৈরি হতে লাগলো।

তিতলি ঘরে এসে আগে শিহাবকে ফোন করলো। তিন বারের সময় শিহাব ফোন রিসিভ করলো।

-এতক্ষন লাগে তোর ফোন রিসিভ করতে? কি করছিলি ভাই? তাড়াতাড়ি আয় আমাদের তো যেতে হবে নাকি!

শিহাব কি বলবে বুঝতে পারছে না। সে তো শুধু বিয়েতে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু সব প্রোগ্রামে এটেন্ড করা কেমন যেনো লাগছে তার। সে যেতে চাচ্ছে না।

স্বল্প পরিচয় হলেও সাইফের সাথে তার চমৎকার একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়েছে। সাইফের ক্যাফে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা আছে। সেখানে কয়দিন আগে ভীষণ লসে পরে গিয়েছিলো সাইফ। শিহাবের সাথে সাইফের প্রায়ই যোগাযোগ হতো। সাইফ নীরার কাছের বন্ধু তাই শিহাবও সাইফের সাথে খুব আগ্রহ নিয়ে যোগাযোগ করতো। যেটা অন্য কেউ হলে বোধ হয় সে করতো না। এরপর কথায় কথায় সাইফ তাকে সমস্যার কথা জানায়। শিহাব তৎক্ষনাত সাইফকে সাহায্য করে। সাইফ সাহায্য নিতে চাইছিলো না। কিন্তু নিজের বিয়ের খরচের জন্য তার কাছে এক্সট্রা টাকা ছিলো না। নীরার কাছেও চাইতে পারেনি সে। কারন নীরা আর সাইফ দুজনই এনজিওর কাজে বিভিন্ন স্পেশাল চাইল্ডদের জন্য বড় এমাউন্ট খরচ করে ফেলেছে কিছুদিন আগেই। সাইফের কাছে বাদবাকি যা ছিলো তা সে বিয়ের খরচের জন্য রেখেছিলো। তাই শিহাব এতো করে রিকুয়েষ্ট করার পর সে আর না করেনি। তারপর থেকে তাদের দুজনের সম্পর্ক চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে।

সাইফ বারবার করে তাকে কল করে বলেছে সে যেনো প্রত্যেকটা প্রোগ্রাম এটেন্ড করে। নইলে সে ভীষণ মন খারাপ করবে। শিহাব ও কথা দিয়েছে যে সে সব প্রোগ্রাম এটেন্ড করবে। আর সেখানে নীরা ও থাকবে এ তো সোনায় সোহাগা। আর এখন তার কেমন আনইজি লাগছে। এর আগে এতো ঘটা করে কোনো প্রোগ্রামে যাওয়া হয়নি তার।

-তিতলি না গেলে হয় না? তোরা যা আমি বিয়েতে যাবো।

-একদম না! তুই না গেলে আমি যাবো না,না মানে না। ছোট ভাইকেও যেতে দিবো না। তুই এখন আসবি। আসবি মানে আসবি আমি কিচ্ছু জানি না।

শিহাবের কথা শুনে চেঁচিয়ে কথাগুলো বললো তিতলি। শিহাব কান থেকে ফোন দূরে সরিয়ে রাখলো। তার বোন তো খুব নাছোড়বান্দা এখন কি করবে সে! ধুর। সে কোনোরকম ফোন রেখে দিলো। এখন সে অফিসেই থাকবে। তারপর কোনো একটা বাহানা নিশ্চয়ই দেওয়া যাবে। এই ভেবে চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসলো সে। তখনই তার ফোন আবার বেজে উঠলো। সে ভাবলো তিতলি আবার কল করেছে। প্রথমে সে দেখলো ও না ধরলো ও না। তারপর অনবরত ফোন বাজায় সে ফোন হাতে নিতে বাধ্য হলো। সে দেখলো রুমা তাকে ফোন করেছে। এখন কি করবে সে। আজব ঘটনা! নিশ্চয়ই তিতলি রুমাকে ফোন করে বলে দিয়েছে। এটাই হবে। সে দোনামোনা করে ফোন ধরলো।

-হ্যালো শিহাব ভাই আপনি নাকি আসবেন না? আপনি এটা করতে পারলেন শিহাব ভাই? সেদিন বলেছিলেন আমি আপনাকে ভাই বলতে পারি। আমি আপনাকে সত্যিই ভাই ভেবেছি আর আপনি কি করলেন!

রুমার এমন ইমোশনাল কথাবার্তা শুনে একটু খারাপই লাগলো শিহাবের। তবুও সে বললো।

-বিয়েটাই তো মেইন রুমা। আমি তোমার বিয়েতে যাবো তো ইনশাআল্লাহ।

রুমা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে নীরাকে ডাকলো।

-নীরা শিহাব ভাই নাকি আসবে না। ধর তুই বল একটু যেনো আসে প্লিজ।

ফোনের এপাশ থেকে শিহাব সবই শুনতে পেলো। তার বুক ধরাস করে উঠলো। নীরা যেতে বলবে নাকি এখন তাকে।

এদিকে নীরা রুমার মাথায় গাট্টা মারলো। ফিসফিস করে বললো।

-বিয়ে তোর নাকি আমার? যে আমি বলবো আশ্চর্য রুমা। আমি পারবো না বলতে।

-আরে বল না প্লিজ। মানুষকে কনভেন্স করার দারুন ক্ষমতা আছে তোর। প্লিজ একবার বলে দেখ তুই।
তোর কথায় রাজি হয়ে যাবে।

রুমার এমন অনুরোধে নীরা ফোন হাতে নিলো। রুমা নিশ্চিন্ত মনে মিলার কাছে গিয়ে বসলো। মিলাকে বললো তার চুলের জট ছাড়াতে। মিলা হাসতে হাসতে জট ছাড়াতে লাগলো।

নীরা ওদের থেকে একটু দূরে গিয়ে ফোন কানে ধরলো।

-হ্যালো শিহাব?

নীরার কন্ঠ শুনে শিহাবের মনে হলো তার বুকের মরুভূমিতে এক পশলা বৃষ্টি নেমেছে। সে কোনো জবাব দিতে পারলো না। চুপ করে রইলো। এদিকে নীরা ক্রমাগত হ্যালো হ্যালো বলতে লাগলো। শিহাবের চুপ করে শুনতে ভালো লাগছে কিন্তু এমনভাবে তো চুপ করে থাকা চলে না।

-হ্যা নীরা বলুন।

অনেকক্ষন পরে জবাব দিলো শিহাব।

-আপনি এতক্ষন কথা বলছিলেন না কেন শিহাব? ব্যস্ত আপনি? তাহলে পরে কল করবো?

-নাআ।

নীরার কথায় চিৎকার করে না বলে উঠলো শিহাব। নীরা হতভম্ব হয়ে গেল।

-কি হয়েছে আপনার? এনিথিং রং? ঠিক আছেন?

উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করলো নীরা। নীরার উদ্বিগ্ন কন্ঠও ভালো লাগছে শিহাবের।

-হ্যা ঠিক আছি। আমি ব্যস্ত নই একদম। আপনি বলুন।

-আপনি নাকি আসবেন না? দেখুন আপনি না আসলে রুমা আর সাইফ মন খারাপ করবে আপনি আসলে ওরা সবাই খুব খুশি হবে।

-আর আপনি খুশি হবেন না?

শিহাবের কথায় হকচকিয়ে গেল নীরা

-মানে?

-না কিছু না,আমি আসবো।

-শিওর আসবেন?

-হ্যা অবশ্যই।

-আচ্ছা ঠিক আছে রাখছি।

নীরা ফোন কেটে দিলো। রুমা আর মিলা নীরার দিকে উৎসুক হয়ে চেয়ে রইলো।

-আসবে বললো।

নীরার কথা শুনে রুমা আর মিলা হাসলো।

-আমি জানতাম তুই বোঝাবি আর কেউ বুঝবে না, এটা হতেই পারে না।

হাসতে হাসতে বললো রুমা। তারপর মিলা আর রুমা তৈরি হতে লাগলো। আর এদিকে নীরা ভাবলো সে তো কিছুই বোঝালো না। বোঝানোর দরকারই পরেনি। শিহাব তো এমনিতেই রাজি হয়ে গেল। রুমার কথাতেই তো রাজি হতে পারতো। কি জানি মাঝে মাঝে যে কি হয় শিহাবের। কেমন বিহেভ করে বসে নীরার সামনে।

-তুমি ডাকবে আর আমি আসবো না। এটা হতেই পারে না নীরা। তুমি যেখানেই ডাকো পৃথিবীর যেই প্রান্তেই ডাকো, আমি কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে সেখানেই যেতে প্রস্তুত।

মনে মনে ভেবে হাসলো শিহাব। তারপর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

বাড়িতে এসে দেখলো তিতলি আর রেহান তৈরি হয়ে তার জন্য বসে আছে। তিতলিকে দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল শিহাবের। তার বোনটা কি সুন্দর দেখতে। চোখ একদম জুড়িয়ে যায় দেখলে। সে তিতলি আর রেহানকে দেখে হাসলো।

-তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও ভাই ফাস্ট। নইলে পেত্নী তোমার ঘাড় মটকানোর জন্য বসেই আছে।

তিতলির দিকে আড়চোখে তাকাতে তাকাতে বললো রেহান। তিতলি এতে রেগে গেল। জ্বলন্ত চোখে রেহানের দিকে তাকিয়ে রইলো।

-ভাই জলদি যা। আমি তোর বিছানার ওপর সব রেখেই এসেছি। তুই শুধু একটু তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিবি।

তিতলির কথায় শিহাব তাড়াতাড়ি তার ঘরে চলে গেল। তিতলি এবার উঠে দাড়ালো উদ্দেশ্য রেহানের সুন্দর চুলের বারোটা বাজানো। এতক্ষন সে রেহানকে কিছু বলেনি কারন এতে শিহাবের ওদের দুজনকে থামাতে থামাতে লেট হয়ে যাবে। তাই সে এখন রেহানের বারোটা বাজাবে। রেহান ও বুঝে গেছে তার সাথে এখন কি হবে। তাই সে দৌড় দিলো। তিতলিও দৌড় দিলো। রেহান দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। তিতলি জোরে জোরে দরজায় বারি মারলো। যখন দেখলো কাজ হচ্ছে না। তখন সে হার মেনে নিলো।

-ছোট ভাই বের হ। তোকে আমি কিছু করবো না। আমাদের লেট হয়ে যাচ্ছে বের হ তুই।

তিতলির কথা বিশ্বাস হচ্ছে না রেহানের।

-সত্যিই কিছু করবি না তো?

তিতলি ভীষণ বিরক্ত হলো।

-না কিছু করবো না বের হ তুই। এক জায়গায় যাচ্ছি আমরা মনে রাখিস। বের হ।

তিতলির কথায় রেহান বের হয়ে আসলো। তিতলি রেহানকে সত্যিই আর কিছু বললো না। ততক্ষনে শিহাব ও তৈরি হয়ে গেছে।
মেরুন রঙের পাঞ্জাবি তার শ্যাম বর্ণের দেহে দারুন মানিয়েছে। রেহানকেও দারুন লাগছে তিতলি তার দুই রাজকুমার ভাইকে দুচোখ ভরে দেখলো। তার দুই রাজকুমার ভাইযের জন্য সে দুইটা রাজকুমারী আনবে ভাবলো। তার ভাবনার মাঝেই রেহান তার হাতে চিমটি কাটলো। সে আবার রেহানের দিকে চোখ গরম করে তাকালো।

-কই হারিয়ে গেলি শুনি এখন দেরি হচ্ছে না?

-রেহান তিতলি এখন আর কোনো ঝগড়া করিস না এবার চল।

শিহাবের কথায় তিতলি রেহানকে আর কিছু বললো না। তিন ভাই বোন বেড়িয়ে গেল রিসোর্টের উদ্দেশ্যে।

-মিলা তোর একটা বিউটি পার্লার খোলা উচিত। কি সুন্দর তোর সাজানোর হাত। আমি বলে দিচ্ছি বেস্ট বিউটিশিয়ানের এওয়ার্ড আমি তোকেই দিবো।

মিলার প্রশংসায় পঞ্চমুখ রুমা। সে মেক আপ করতে পছন্দ করেনা। পার্লারে যেতে তার ভালো লাগে না। সে আর নীরা এই দিকটাতে একই ক্যাটাগরির। তাই মিলাই তাকে সাজিয়ে দিয়েছে। মিলার সাজনোর হাত খুব ভালো। সে সাজতে আর সাজাতে খুব ভালোবাসে। রুমার প্রশংসা শুনে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার।

নীরা রুমার দিকে তাকালো। জলপাই আর রানী গোলাপি কম্বিনেশনের জামদানি শাড়ি মাথায় বেলি ফুলের টিকলি হাতে বেলি ফুলের চুড়ি। চুলগুলো খোপা খরা। আর মুখে হালকা প্রসাধনীর সাজ। মিলা খুব সুন্দর করে হালকাভাবে সাজিয়ে দিয়েছে রুমাকে। এতেই অপ্সরী লাগছে রুমাকে। নীরা এগিয়ে গিয়ে রুমাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর থুতনি ধরে বললো

-মাশাআল্লাহ,কি অপরূপ লাগছে রুমা। একদম ঝলসে যাচ্ছে চারদিক।

নীরার প্রশংসা শুনে খুশিতে বাকবাকুম অবস্থা রুমার। সে হাসতে হাসতে মিলাকে বললো।

-তোর সাজানো স্বার্থক মিলা। নীরার কাছ থেকে প্রশংসা পেয়েছি। তারমানে আমাকে সত্যিই বিউটি কুইন লাগছে।

রুমার কথায় তাল মেলালো মিলা।

-একদম রুমা আপা। আজ সাইফ ভাই একদম ঘায়েল হয়ে যাবে।

মিলার কথা শুনে একটু লাজুক হাসলো রুমা।

-মিলা এখন তুই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে আমাদের বেড়োতে হবে। সাইফরা রওনা দিয়ে দিয়েছে। তাড়াতাড়ি কর।

-আপা তুমি শাড়ি পরবে না?

-না মিলা আমার শাড়ি পরতে ভালো লাগে না এছাড়া হাটতে অসুবিধা হবে।

-আচ্ছা থাক নীরা জলপাই রঙের থ্রি-পিস টা পর আমাদের সবার ম্যাচিং হলেই হলো।

নীরার অসুবিধা হবে ভেবে বললো রুমা। মিলা চুপ করে গেল। তার আপাকে শাড়িতে সে খুব কম দেখেছে। তার কতো ইচ্ছে করে আপাকে শাড়িতে দেখতে। সেই কোন ছোটবেলায় দেখেছিলো। নীরা শাড়ি পরতে ভালোবাসতো। কিন্তু এতেও কিছু মানুষের সমস্যা ছিলো। প্রতিবন্ধী মেয়ে এই পা নিয়ে শাড়ি পরবে কেন। শাড়ি পরলে নীরার হাটতে যতোটা না অসুবিধা হতো তার চেয়ে বেশি অসুবিধা হতো মানুষের কথায়। তাই সে শাড়ি পরাই ছেড়ে দিলো। এখন অবশ্য তেমন করে কেউ বলে না যুগ পাল্টেছে।

-আচ্ছা মিলা একটু কম সময় নিয়ে রেডি হ। তোর তো অনেকক্ষন লাগে। আমিও তৈরি হয়ে নিচ্ছি। রুমা চুপ করে বসে থাক তিড়িংতিড়িং করিস না বেশি।

হাসতে হাসতে কথাগুলো বললো নীরা। তারপর নিজেই মিলাকে শাড়ি পরাতে উদ্যোগী হলো। মিলা তখন দেখছিলো তার আপার ছলছল চোখের হাসি মুখ। যেই চোখে আছে একসমুদ্র হাহাকার যা কখনো প্রকাশ পায় না। পাবে ও না। মিলা মন থেকে দোয়া করলো তার আপার জীবনে এমন কেউ আসুক যে এই হাহাকার বদলে এক সমুদ্র খুশিতে রূপান্তর করতে পারবে।

–চলবে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here