#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-০৫
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
এ কেমন শর্ত দিলে তুমি? যেখানে আমি ওয়াদা করেছি তোমায় কাঁদতে দিব না, সেখানে তুমি-ই আমাকে দায়িত্ব দিচ্ছ তোমাকে কাঁদানোর? শর্ত টা ফিরিয়ে নাও প্লিজ আয়রা!
রাহাতের কথায় তাচ্ছিল্য ভরা হাসি দিয়ে বললাম,
– পারবে না তাই তো? তাহলে কখনো আমার থেকে নর্মাল বিহেবিয়ার আশা করো না! আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।
– জানো আয়রা তুমি না, সেই ছোট্ট আয়রা আর নেই! অনেক বড় হয়ে গেছ তুমি!
রাহাতের কথায় রেগে, পিছন ফিরে ড্রেসিন টেবিল থেকে একটা মাসকারা হাতে নিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করলাম।যার ফলে হাতে ব্যথা অনুভব হচ্ছে, কিন্তু তাও হাত খুললাম না। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
– যখন একটা ছোট মেয়ের অবহেলা, অপমান, অসহ্য কষ্ট,যন্ত্রনার মুখোমুখি হতে তখন তার মধ্যে আর শিশুসুলভ আচরণ থাকে না।সে বয়সের দিক দিয়ে বড় না হলেও মনের দিক থেকে ঠিকই বড় হয়ে উঠে। তাছাড়া দুটো বছর কম সময় নয় যে আমি এখনো আপনার জন্য ছোট্টটি থাকবো।
রাহাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
– হুম ঠিক বলেছো তুমি।এতো সময় যাবত শাড়ি পরে আছো নিশ্চই কষ্ট হচ্ছে তোমার, তুমি বরং শাড়িটা চেঞ্জ করে নাও। আমি রুমের বাহিরে যাচ্ছি, প্রয়োজন হলে ঢেকো আমায়।
রাহাত চলে যেতেই, মাসকারা টা হাত থেকে একপ্রকার ছুড়ে ফেললাম। এতে কিছুটা শব্দ হলো, তাঁতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই আমার।তার প্রতিটি কথা যে আমার রন্দ্রে রন্দ্রে রাগ ধরিয়ে দেয়! কি করে আমি এই মানুষটার সাথে থাকবো আল্লাহ?যে মানুষটা প্রতিটা মস্তিষ্ক জুরে বিচরণ করতো সে আজকে এতোটাই অপ্রিয় হয়ে উঠেছে যেন তার মৃত্যুতে ও আমার কিছু যায় আসবে না!এ কেমন মানুষে পরিণত হয়েছি আমি?এ যে ভালো লক্ষণ নয়,এ যে শয়তানের প্ররোচনায় ভুল সিদ্ধান্ত।রাগের কারণে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
বদমেজাজি অহংকার থেকে উদ্ভূত। এ ধরনের মানুষ আল্লাহর কাছে ঘৃণিত, মানুষের কাছেও ঘৃণিত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘…নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ সুরা লোকমান : ১৮
হাদিসে এসেছে, হজরত হারিস ইবনে ওয়াহাব (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কঠোর ও রুক্ষ স্বভাবের মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। সুনানে আবু দাউদ : ৪৮০১
হাদিসে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি তোমাদের কি জাহান্নামিদের কথা বলব না? তারা হলো, যারা অনর্থক কথা নিয়ে বিবাদ করে, আর যারা বদমেজাজি অহংকারী।’ মিশকাত : ৫১০৬
হজরত জারির (রা.) নবী করিম (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, যাকে কোমলতা ও নম্রতা থেকে বঞ্চিত করা হয়, তাকে যাবতীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করা হয়। মিশকাত : ৫০৬৯
একবার হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত আয়েশা (রা.)-কে বলেন, ‘কোমলতা নিজের জন্য বাধ্যতামূলক করে নাও এবং কঠোরতা ও নির্লজ্জতা থেকে নিজেকে বাঁচাও। কারণ যাতে নম্রতা ও কোমলতা থাকে তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়। আর যাতে কোমলতা থাকে না, তা দোষণীয় হয়ে পড়ে।’ সহিহ মুসলিম : ২৫৯৪
নামাজ পড়তে পড়তে কপালে কালো দাগ হয়ে গেছে। রোজা কখনোই ছাড়েননি, যৌবন আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত পর্দা করে আছেন মাশাআল্লাহ। এত ইবাদতের পরও হাশরের ময়দানে জান্নাত থেকে বঞ্চিত হয়ে যেতে পারেন শুধু বদমেজাজি ও অশ্লীলভাষী হওয়ার কারণে! স্পষ্টভাবে হাদিসে এসেছে, বদমেজাজি ও অশ্লীলভাষীরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। জান্নাত নম্র ও বিনয়ী মানুষদের জন্য। তবে ‘আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব ও আল্লাহর জন্য শত্রুতা’ এই নীতির আলোকে মেজাজ প্রয়োগ করা যাবে। যেমন কেউ আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে, ইসলামের অকাট্য বিষয় নিয়ে বেয়াদবি করলে সে ক্ষেত্রে রাগ প্রযোজ্য। কোনো জালেমকে দুর্বলের ওপর জুলুম করতে দেখলে সে ক্ষেত্রে মেজাজ প্রয়োগ করতে হবে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল। তার সহচররা কাফেরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল…।’
সুরা ফাতহ : ২৯
সুতরাং কারও ভালো কিংবা মন্দ কথায় হুট করে রেগে না যাওয়া, চিল্লাচিল্লি না করা। রাগী আচরণ কোনো সমাধান নয়, সুন্দর ও কোমল ভাষায় শান্তভাবে কথা খুব কঠিন কিছু নয়। দরবেশ আলেমরা বলেছেন, মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করুন, দুনিয়ায় মেজাজ দেখিয়ে জান্নাত হারাবেন না। একজন মুমিন কখনো বদমেজাজি ও অশ্লীলভাষী হতে পারে না। নবী করিম (সা.)-এর হাদিসটি মনে রাখুন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘…তিন শ্রেণির মানুষ জান্নাতি হবে। এক প্রকার মানুষ তারা, যারা রাষ্ট্রীয় কর্ণধার, ন্যায়পরায়ণ, সত্যবাদী এবং নেক কাজের তাওফিক লাভে ধন্য। দ্বিতীয়ত, ওইসব মানুষ, যারা দয়ালু এবং আত্মীয়স্বজন ও মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি কোমলচিত্ত। তৃতীয়ত, ওই শ্রেণির মানুষ, যারা পূতপবিত্র চরিত্রের অধিকারী, যাচ্ঞাকারী নয় এবং সন্তানাদি সম্পন্ন লোক।’
সহিহ মুসলিম : ৭০৯৯
ইয়া আল্লাহ আমাকে হেফাজত করুন আমিন!
হাতের ব্যান্ডেজ টা লাল রঙা ধারন করেছে!তাই খুলে ফেললাম। রক্ত গড়িয়ে না পারলেও হাতটা ভরে গেছে,ক্ষত স্থানে পুনরায় চোট পাওয়ার কারণে। রাহাত কি মনে করে রুমে ফিরে এসে দেখে আমার হাতে ব্যান্ডেজ নেই,তাই কাছে এসে হাতের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
– আমি আগামীকাল ফিরে যাচ্ছি,ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। কখনো আমার কোয়ার্টারে যাওয়ার ইচ্ছা হলে বলো। তাছাড়া তুমি স্বাধীন! তোমার কোন কাজ কর্মে বাঁধা প্রদান,হস্তক্ষেপ কোনটাই করবো না আমি। তা-ও দয়া করে নিজেকে আঘাত করো না।
_________
মাগরিব নামায পড়ে সাফা আর মারওয়া কে খাবার খাইয়ে দিচ্ছি। দুটো দুষ্টুমি করে আমাকে সারা ঘর ঘোরাচ্ছে!এক লুকমান খায় তো দশ মিনিট পর গিয়ে আরেক লুকমান। পাগল করে ছাড়ছে আমাকে,আপু তখন বললো,
– দেখ তোর ভাগ্নিদের কি করে সামলাতে হয় আমাকে। এরপর যখন তোর ভাইয়া অফিস থেকে রাতে বাসায় ফিরে, তখন আর আমাকে চিনে না তারা। তখন তাদের বাবাই সব।
আপুর কথায় হেসে বললাম,
– মেয়েরা এমনি প্রচুর বাবা ভক্ত হয়।আর ছেলেরা মা ভক্ত হয়। তুমি আমাদের ই দেখো না, আমরা আব্বু বলতে পাগল।অথচ সাজিদ ভাইয়া আর সামিরের সাথে কোন না বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি লেগেই থাকতো আব্বুর।
মনি সাফা খাবে না।
আম্মু আমি খাবো না।
আমার কথার মাঝেই সাফা,মারওয়া দু’জনেই অনুরোধের কন্ঠে বললো তারা আর খাবে না। তাই আপু বললো,হাত ধুয়ে নিতে।ওরা যখন বলেছে খাবে না তখন আর জোর করে খাওয়াতে পারবে না কেউ।তাই হাত ধুয়ে এসে বসতেই আপু বললো,
– এখন আব্বুর ঠিক করা মোহরানা ই পরিশোধ করবে রাহাত! তবে বলেছে ধীরে ধীরে পরিশোধ করবে। মোহরানা নগদে পরিশোধ করা সুন্নাত। তবে বাধ্যগত অবস্থায় মোহর কিছু বাকী রেখে বিবাহ করা জায়েয (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩২০২)।
দূরে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা প্রাকৃতিক পরিবেশের পেন্টিং টার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,
– এই কাজ গুলো প্রথমবার করলে কি হত আপু? এখন কেন এতো ত্যাগের বিনিময়ে আমাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তার? আমি তো অল্পতেই সুখের সন্ধান চেয়েছিলাম।
আপু আমার পাশে বসে, আমাকে তার বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– আমি জানি তুই যথেষ্ট জ্ঞান রাখিস হাদীস সম্পর্কে।তাও বলছি,
রাগ’ ধ্বংস করে দিতে পারে জীবন, সম্পদ, সম্মান এবং পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক। জীবনে নেমে আসতে পারে বিপর্যয়। এ কারণেই নবীজি (সা.) এটাকে বলেছেন, ‘আদম সন্তানের অন্তর একটি উত্তপ্ত কয়লা’ (তিরমিজি)। আল্লাহর ক্ষমা পেতে হলে তাঁর বান্দাকে ক্ষমা করতে হবে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে ছুটে যাও, যার সীমানা হচ্ছে আসমান ও জমিন, যা তৈরি করা হয়েছে পরহেজগারদের জন্য। যারা সচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষকে ক্ষমা করে, বস্তুত আল্লাহ সৎকর্মশীল দিগকেই ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৪)।
আমি কিন্তু রাহাত কে মাফ করে দিয়েছি,পারলে তুইও মাফ করে দিস। দরকার হলে সময় নে নিজেকে ধাতস্থ করতে, তবুও মাফ করে দিস।জানিস তো বিয়ের পর স্বামী একমাত্র আপন হয়। আমি আর তোর ভাইয়া তো কিছুদিন পর চলে যাবো বিদেশে। আব্বু অসুস্থ হয়ে পড়েছে,আর ভাইদের কথা কি বলব? একজন বিদেশে থাকেন, দেশে তার বউ কর্তিগিরী করে!আর আছে ছোট ভাই সেও বিয়ে করলে বুঝবি। তাই নিজের সংসার গুছিয়ে নিয়ে সুখী হ এটাই চাই আমি।
আপুর কথা গুলো নিরবে শুনে যাচ্ছি, কারণ আমার কোন উপযুক্ত উওর নেই। সত্যি আপু চলে গেলে আমি আবার একা হয়ে পরবো।
________
আপুদের বাগানে হাঁটছি,
সকালের ঠান্ডা শীতল পরিবেশ খুব ভালো লাগছে। হাঁটতে হাঁটতে একটা মেহগনি গাছের কাছে আসলাম, খুব ছোট ছোট ফুল গুলো গাছটার চারিপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।মাটি থেকে কয়েকটা ফুল কুড়িয়ে নিলাম। ছোট বেলায় এই ফুল গুলো দিয়ে খাতায় রং করতাম! এতে খুব সুন্দর করে রং করা যেত।যার জন্য গাছের নাম পাল্টে নাম দিয়েছিলাম “রং পেন্সিল গাছ” হা হা হা। ছোট বেলাটা কতো মধুময় ছিল, এখন প্রতিটি মূহুর্তে তা অনুভব করি।
হাতে তুলে নেওয়া ফুল গুলো ঘ্রাণেন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করলাম, এগুলো থেকে সুভাস ছড়াচ্ছে। আঁখিপল্লব দুটো বন্ধ করে সুভাসে নিতে মগ্ন আমি। তখন শুকনো পাতার মরমর শব্দ কানে আসতেই, দ্রুত পাশ ফিরে তাকাতেই যা দেখলাম আমার শরীরের প্রতিটি লোম দাঁড়িয়ে গেছে মূহুর্তেই! ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে এলোমেলো ভাবে পা ফেলে দৌড়াতে শুরু করলাম আমি। দৌড়াতে দৌড়াতে কারো প্রশস্ত বুকে আশ্রয় খুঁজে পেলাম,,,,,
#চলবে,, ইনশা আল্লাহ।