ছায়া_সঙ্গিনী #পর্ব-১৪,১৫

0
695

#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-১৪,১৫
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
১৪

ইমরান ভাইয়া আমাকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে রেখে তার মা’কে ডাকতে চলে গেছেন। আমি বসে চারিদিকে একবার লক্ষ্য করলাম, খুবই বিলাসবহুল জীবনযাপন তাদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমি ভাবছি ইমরান ভাইয়ার মা’কে যদি বলে দেই যে আমি বিবাহিত, তাহলে নিশ্চয়ই উনি উনার ছেলে কে বুঝিয়ে বলবেন। হুম তাই করবো,,,,
পাঁচ মিনিট পর ইমরান ভাইয়া আসলেন, সাথে ভদ্রমহিলা নিশ্চয়ই উনার মা। ভদ্রমহিলা কে তার বয়স ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা,এই বয়সে মা শা আল্লাহ এতো সুন্দরী! না জানি যৌবনে কতো সুন্দর ছিলেন। ধবধবে ফর্সা, গোলগাল মুখশ্রী।কাঠালি রঙের থ্রিপিস যেন আরো দ্বিগুন সুন্দর্যো বাড়িয়ে দিয়েছে মহিলার।অথচ সেই দিক থেকে স্যারের গায়ের রং কালো। অবশ্য কালো সাদা দিয়ে কি হবে, কালো,সাদা, লম্বা, বেঁটে,কানা,লেংরা সকলেই তো একজনের সৃষ্টি। সৃষ্টিকর্তা তো খুশি মনেই আমাদের সৃষ্টি করেছেন।অথচ আমরা মানুষরাই এর ভেদাভেদ করি। সমাজে কালো বেটে মেয়েরা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। মানুষ অকপটে বলে দেয়, একজন আরেকজনকে কালো বেটে।কেউ একবার ও ভেবে বলে না যে তাকে যে সৃষ্টি করেছে,অপর ব্যক্তিকে সেই সৃষ্টি করেছে। নিজেকে নিজে তো আর সৃষ্টি করে নাই যে এভাবে আঘাত দিয়ে কথা বলতে হবে।তারা একবারও চিন্তা করে দেখে না যে, আল্লাহ তা’আলার সৃষ্টিকে অবজ্ঞা করা মানে শয়ং আল্লাহ তা’আলা কে অবজ্ঞা করা!আস্তাগফিরুল্লাহ। আল্লাহ তা’আলার সৃষ্টিকে ভালোবাসার মধ্য দিয়েই আল্লাহ তা’আলা ভালোবাসা হয়।”সুবহান আল্লাহ”।

যাই হোক,
আমি সালাম দিলাম। উনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন,
– কেমন আছো?

– আলহামদুলিল্লাহ ভালো।আপনি কেমন আছেন আন্টি?

– আলহামদুলিল্লাহ আমিও ভালো আছি।

তারপর আমাকে বসিয়ে তিনিও আমার পাশে বসলেন। বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
– তুমি আসলেই খুব মিষ্টি একটা মেয়ে। ইমরান তোমার কথা সব সময় বলে। নাম কি তোমার?

– জ্বি,আয়রা মেহেনূর।

– তোমার মতো তোমার নামটাও অনেক মিষ্টি। তোমার বাসায় সবাই ভালো আছেন?

– আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

– তুমি কি সব সময় এভাবে পর্দা করে চলো? ইমরান অবশ্য বলেছে তুমি খুব ধার্মিক।

– না আন্টি ভাইয়া ভুল বলেছেন, আমি খুব ধার্মিক তেমন নয়। তবে আমি চেষ্টা করি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আদেশ পালন করে চলার।

– আচ্ছা খুব ভালো, এটাই আজকালকার যুগের মেয়েরা কয়জনে করে বলো?
ইমরান তুই ভিতরে যা, আমি আয়রা’র সাথে কথা বলছি।

ইমরান ভাইয়া বললেন,
– আম্মু আমি থাকিনা কি হয়েছে?

আন্টি তখন হালকা রাগ নিয়ে বললেন,
– আমি যেতে বলছি তোকে?

ইমরান ভাইয়া আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন এখান থেকে। আমার এতে সুবিধা হলো, এখন নির্দ্বিধায় বলতে পারবো। ইমরান ভাইয়া চলে যেতেই আমি বলতে যাবো তখন আমার ফোনে কল আসে।কল রিসিভ করে ওপাশের ব্যক্তির কন্ঠস্বর শুনে চিনতে সময় লাগলো না আমার। আজকে দুদিন পর তার কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে অশান্ত মন শান্ত হয়ে গেল আমার। রাহাত বললো,
– বাসায় সবাই কেমন আছেন?

– আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

– তুমি ঠিক মতো গিয়ে পৌঁছেছো?

– হুম আলহামদুলিল্লাহ। আমার ব‌উটা কি করে এখন?

ঠিক এই ভয়টাই এতোক্ষণ পাচ্ছিলাম আমি, এখন কি জবাব দিব?তাই একটু ভেবে বললাম,
– আমি আজকে কলেজে এসেছি রাহাত। তুমি সকালের খাবার খেয়েছো?

– হুম খেয়েছি। আচ্ছা তাহলে তুমি এখন বাহিরে আছো। আমি অবসর হলে রাতে কল দিব, এখন তাহলে রাখি ব‌উ?

– আচ্ছা ঠিক, আল্লাহ হাফেজ।

– আল্লাহ হাফেজ ব‌উ।

মুচকি হেসে কল রাখলাম আমি,দেখি আন্টি উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছেন। আমি কার সাথে এভাবে কথা বললাম হয়তো তাই ভাবছেন। তাকে চিন্তা মুক্ত করতে বললাম,
– আন্টি আমি বিবাহিত!এই মাত্র যার সাথে কথা বললাম সে আমার স্বামী! ইমরান ভাইয়ার পাগলামির ভয়ে এতো দিন কিছু বলার সাহস করে উঠতে পারিনি। তবে আজকে আপনাকে সবটা বলবো বলেই আমার এখানে আসা।যদিও প্রথমে আসতে চাইনি আমি, ইমরান ভাইয়ার জোরাজুরিতে আসা।পরে ভেবে দেখলাম আর না বলে বসে থাকা উচিৎ হবে না আমার। আন্টি আপনি আমাকে মাফ করে দিবেন।

আন্টির ফেইস মুহূর্তেই অন্ধকার হয়ে গেল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
– আমার বোনের মেয়ে ফাইজা খুব সুন্দরী তবে অনেক আধুনিক। আমার ইচ্ছা ছিল তার সাথে ইমরানের বিয়ে দেওয়ার। কিন্তু ইমরান উঠতে বসতে তোমার কথা বলতে বলতে হয়রান। মানে সে তুমি বলতেই অজ্ঞান। তার মুখে এতো এতো প্রশংসা শুনে বললাম, তোমাকে যেন নিয়ে আসে।তাই আজকে হয়তো জোর করেই নিয়ে এসেছে। সত্যি বলতে কি জানো? তোমাকে দেখার পর থেকে আমি বুঝতে পারি, আমার ছেলে এতো দিন বিন্দুমাত্র ও ভুল বা বানোয়াট কিছু বলে নাই। তুমি সত্যি খুব সুন্দরী এবং মিষ্টি একটা মেয়ে মা শা আল্লাহ। তোমাকে দেখে মনে মনে আমি আমার সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তোমার সাথেই আমি আমার ইমরান এর বিয়ের কথাবার্তা বলবো। কিন্তু এ কি বললে তুমি? কবে তোমার বিয়ে হয়েছে? আদৌও কেন ইমরান জানলো না?

একজন অতি সাধারন বেশভূষায় মহিলা শরবত আর নাস্তা নিয়ে আসলেন। আন্টি বললেন,আয়রা শরবত টা খাও গরমে ভালো লাগবে।আমি মাথা নিচু করে অপরাধী গলায় বললাম,
– আমি আবারও মাফ চাইছি আন্টি, আমি আপনার ছেলের ভয়েই বিষয়টা লোকাতে বাধ্য হয়েছি। উনি আমাকে বলেছিলে যেকোন মূল্যেই হোক তিনি আমাকে বিয়ে করবেন।এই ভয়েই আমি বলতে পারি নাই।

– আমার ছেলেটাকে সামলাতে সত্যি বড় কষ্ট হয়ে যাবে। তারপর ও আমি ইমরান কে বুঝিয়ে বলবো।

– ধন্যবাদ আন্টি, আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো। আজকে তাহলে আমি উঠি, আব্বু আবার দুশ্চিন্তা করবে।

– সেকি দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে তবেই যাবে। না খাইয়ে ছাড়বো না আমি।

– না আন্টি অন্য কোন দিন খাবো, আজকে নয়। আপনি আমাদের বাসায় আসবেন একদিন।এখান থেকে আমাদের বাসা পনেরো মিনিটের রাস্তা। আপনি আসলে আমি খুব খুশি হবো।

– এটা কোন কথা? তুমি এসে না খেয়ে চলে যাচ্ছ আর আমি কিনা যাবো তোমাদের বাসায়?

-আচ্ছা এই দেখুন আমি খাচ্ছি।

তারপর শরবত টা খেয়ে নিলাম। খেয়ে আন্টি কে সালাম দিয়ে বেড়িয়ে গেলাম। আজকে খুব হালকা লাগছে নিজেকে। এতো দিনে একটা বোঝা যেন কাদ থেকে নামলো। আন্টি যখন বলেছেন তখন ইমরান ভাইয়া কে ঠিক বুঝিয়ে বলবেন। আন্টি মানুষটা অনেক ভালো।
_______
রাতের বেলা টেবিলে বসে পড়ছি আর ফোনের দিকে বার বার চোখ বুলাচ্ছি । কখন রাহাত কল দেবে ভেবে। এরকম করে পড়াশোনায় মনোযোগ ও হচ্ছে না।তাই সাড়ে এগারোটা বাজতে খাটে এসে শুয়ে পড়লাম।এর দুই মিনিটের মধ্যে রাহাত কল করলো। বললাম,
– এতোক্ষণে সময় হলো?

সে ক্লান্ত ভড়া কন্ঠে বললো,
– অনেক কাজের চাপ ব‌উ। এখন এসে ফ্রি হলাম। সারাদিন একটু বসার টাইম পাই না।খেয়েছো রাতে?

– আলহামদুলিল্লাহ হুম। তুমি খেয়েছো?

– হুম।

– কি খেয়েছো?

– সবজি,ডাল,ভাত।

খুব কষ্ট লাগলো ওর খাবার খাওয়া শুনে, আমি কতো ভালো কিছু দিয়ে খেয়েছি অথচ ও??আমার নিরবতা দেখে রাহাত বললো,
– আমার বউ’টা হঠাৎ চুপ হয়ে গেল ব্যাপার কি?

– তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে এসো।

– আচ্ছা এই ব্যাপার, আমার বউ কি আমাকে খুব মিস করছে?

– এতো কিছু জানি না তুমি আসবে ব্যাস।

– কাজ শেষ করতে পারলেই চলে আসবো প্রমিজ করছি। আচ্ছা অনেক রাত হয়েছে এবার ঘুমিয়ে পরো ঠিক আছে?

– আচ্ছা ঠিক আছে, তুমিও ঘুমিয়ে পরো।
আল্লাহ হাফেজ।

– আল্লাহ হাফেজ মিষ্টি বউ।

তার শেষাক্ত কথায় হেসে দিলাম, কথায় কথায় ব‌উ বলা। মনে হয় যেন তার‌ই একটা ব‌উ আছে আর কারো ব‌উ নেই।
_______
কলেজে এসেছি আজকে,স্যার ক্লাস নিচ্ছেন।এর ফাঁকে তুলি জিজ্ঞাসা করলো গতকাল কি হয়েছে? আমি কিছুটা বলতেই স্যার দেখে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো।তাই চুপ করে ক্লাসে মনোযোগ দিলাম। তারপর অফ ক্লাসে সবটা বললাম। সবটা শুনে তুলি বললো,
– এটাই ভালো হয়েছে, না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেত। যেহেতু ইমরান ভাইয়া তার মা অবধি চলে গেছেন।

– হুম।জানিস ইমরান ভাইয়ার আম্মু অনেক সুন্দরী এবং অনেক ভালো।

– ইমরান ভাইয়ার পোরা কপাল, তার থেকে তার মাকে পছন্দ হলো তোর।হা হা হা,,,

এই বলে তুলি হাসতে লাগলো।
______
সেদিনের পর থেকে, কয়েক মাস হলো ইমরান ভাইয়া’কে কলেজে দেখতে পাইনি আমি। মনে হয় এখন আমি সবচেয়ে ঘৃণিত মানুষ তার কাছে।যাই হোক এতে আমার ভালোই হয়েছে। আমি আমার মতো করে নির্দ্বিধায় চলাফেরা করতে পারি।
বাসায় থেকে থেকে বোরিং হয়ে গিয়েছি,তাই ভাবলাম শ্বাশুড়ি মায়ের সাথে কিছুদিন কাটিয়ে আসি। তাছাড়া রাহাতের আসার ও সময় হয়ে এসেছে। এবার একটা সারপ্রাইজ না দিলেই নয়। মা’কে বলবো, রাহাত কে যেন বলে ছুটি হলেই যেন মায়ের সাথে দেখা করতে আসে। আমি জানি ও মায়ের কথা ফেলতে পারবে না।তাই আগে মায়ের কাছেই যাবে।আব্বু’কে বলাতেই খুশি হয়ে অনুমতি দিয়ে দিল। ভাবী কে বললাম,সেও কতো গুলো জ্ঞান দিয়ে বললো যাও। ছোট ভাই কে বললাম,সেও চললো আমার সাথে শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
তারপর,
যেই ভাবা সেই কাজ কাপড় চোপড় গুছিয়ে ট্রলি নিয়ে চললাম শ্বশুর বাড়ি।
অতঃপর,
শ্বাশুড়ি মা আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন।ভাইকে কিভাবে আপ্যায়ন করবেন, না করবেন এ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেলেন। তারপর ভাই দু’দিন থেকে নারায়ণগঞ্জ ফিরে গেল।

আজকে দুপুর থেকে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি,মা তার ভাইয়ের বাড়ি গিয়েছেন। বলেছেন বিকালে ফিরবেন, কিন্তু বৃষ্টির জন্য আসতে পারছেন না। এদিকে প্রচুর বৃষ্টি সাথে বিদ্যুৎ চমকানো, আমি একা ঘরে ভয়ে চুপসে যাচ্ছি। তার‌উপর টিন সেট ঘর বলে, শব্দ গুলো তিনগুণ বেশি। বিল্ডিং এ এতোটা বোঝা যায় না।যতটা টিন সেট ঘরে শব্দ শুনা যাচ্ছে।এর মধ্যে হঠাৎ দরজায় কড়াঘাত শুরু করে কে যেন! ভয়ে অবস্থা নাজেহাল আমার।একা একটা মেয়ে আমি, আল্লাহ না করুক কোন খারাপ মানুষ হলে,,,,

#চলবে,,,ইনশা আল্লাহ।

#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-১৫
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

একটু পর পর বাজ পরার শব্দ, তাছাড়া শিলাবৃষ্টির কারণে টিনের চালে ধরাম ধরাম শব্দ হচ্ছে। এদিকে কারেন্ট নেই,সৌর বিদ্যুৎ এর বাল্ব জ্বলছে ঠিকই কিন্তু মিনমিন করে। বাল্ব গুলো কালো হয়ে গেছে,যার কারণে আলো অনেক কম, চেঞ্জ করা প্রয়োজন।
ভয়ে শিউরে যাচ্ছি,ইয়া আল্লাহ আমাকে হেফাজত করুন আমীন। এরকম পরিস্থিতিতে কখনো মোকাবেলা করতে হয়নি আমাকে। বাসায় কেউ না কেউ সাথে ছিল। মা যে কেন আজকেই গেল? অবশ্য যাবেই না বা কেন? মামা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।ভাই যদি এতো অসুস্থ হয় তাহলে কোন বোন কি শান্ত হয়ে বসে থাকতে পারে? একদম ই পারে না। মোবাইল টাও অন করতে পারছি না যে মাকে কল করবো।আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে মোবাইলের
সুইচ বন্ধ করে দেওয়া বা এরোপ্লেন মোড করে দেওয়া উচিত। কারন মোবাইল এবং বজ্রপাত দুটোই বিদ্যুৎ সম্পর্কিত। বিদ্যুৎ লাইনের মধ্যে দিয়ে বজ্রপাতের ফলে সৃষ্টি উচ্চমাত্রার কারেন্ট প্রবাহের ফলে টিভি, ফ্রিজ, মোবাইল ইত্যাদি নষ্ট হয়ে যেতে পারে অনেকক্ষেত্রে পুড়েও যেতে পারে।তাই বন্ধ করে রেখে দিয়েছি মোবাইল, হয়তো মা ও আমাকে কল করে চলেছে।
ভয়ে জড়সড় হয়ে খাটের মধ্যখানে বালিশ জড়িয়ে ধরে বসে আছি আর জিকির করছি।
রাসূল (সা:) যখন বৃষ্টি হতে দেখতেন তখন বলতেন,
– “আল্লাহুম্মা সাইয়েবান নাফিআ”
অর্থ- হে আল্লাহ মুষলধারে উপকারী বৃষ্টি বর্ষাও।
(বুখারী-১০৩২)

তাই আমিও এই দো’আ পড়লাম “আলহামদুলিল্লাহ”।
হঠাৎ দরজায় কড়াঘাত শুরু করে কে যেন! ভয়ে চুপসে গেলাম আমি,কে হতে পারে? এতো ঝর ঝাপটার মধ্যে মা কি আসতে পারে?যদি মা না হয় তাহলে তো সর্বনাশ! আমি একা একটা মেয়ে, না না কিছুতেই দরজা খুলা যাবে না।যদি চোর হয়ে থাকে?ওরে বাবা।ইয়া আল্লাহ রক্ষা করো আমাকে আল্লাহ।

কিছুক্ষণ বন্ধ ছিল দরজা ধাক্কানো। এখন আবার শুরু হয়েছে। কোন সময় জানি দরজাই ভেঙে ফেলে! তখন আমি কি করবো?
আইডিয়া খাটের নিচে লুকিয়ে থাকবো! আগে নিজে সেইফ থাকবো, তারপর ঘরের জিনিসপত্র নিয়ে ভাববো। আচ্ছা দরজার সামনে কাঠের চেয়ার টা টেনে দিলে কেমন হয়? হুম তাই করি তাহলে আরেকটু জোড়ালো হবে দরজাটা।যেই ভাবা সেই কাজ, কাঠের ভারি চেয়ার টা খুব কষ্ট করে বয়ে নিয়ে গেলাম দরজার সামনে। তখন কানে এলো,
– মা’গো দরজা খুলো ভিজে যাচ্ছি!

বহু পরিচিত সেই কন্ঠস্বর! মুহূর্তেই শরীরে ভালো লাগার শিহরণ খেলে গেল। নিজের কান কে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যেন। তাড়াতাড়ি করে চেয়ারটা সরাতে নিলে পায়ে লেগে ব্যাথা পেলাম। সে দিকে তোয়াক্কা না করে দ্রুত পায়ে দরজা খুলে সাইটে সরে দাঁড়ালাম। সে যে এতো সময় যাবত কাকভেজা হয়ে গেছে। কি সব আবোল তাবোল চিন্তা ভাবনা করে মানুষটাকে এতোক্ষণ কষ্ট দিলাম দূর এখন নিজের প্রতি নিজের রাগ হচ্ছে, প্রচুর পরিমাণে। হাতে একটা মাইর দিতে পারলে রাগটা কমতো! কিন্তু সেই উপায় তো নেই।যাই হোক, রাব্বুল আলামীন আমার বিপদের দিনে, আমার প্রিয় মানুষ’টাকেই
পাঠিয়ে দিয়েছেন”আলহামদুলিল্লাহ”। রাহাত ভেজা সার্ট খুলে মাথার চুল গুলো নেড়েচেড়ে পানি ফেলছে। আমি দরজা বন্ধ করে, আলমারি খুলে রাহাতের গামছা আর লুঙ্গি বের করে নিয়ে আসলাম। রাহাত পিছন ফিরেই বললো,
– প্রায় পনেরো মিনিট যাবত দরজার কড়াঘাত করেছি। দরজা কেন খুলছিলে না মা? আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, একলা ঘরে থাকো। দুশ্চিন্তা হয় না বলো?

বুঝলাম তিনি এখনো তার ব‌উ’কে দেখেন নাই।তাই দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় আসতেই, পিছন থেকে হাত বাড়িয়ে লুঙ্গি গামছা দিলাম।সে হাতে নিয়ে যেই ঘুরবে, অমনি আমিও ঘুরে তার পিছনে চলে গেলাম। এরকম কয়েকবার হ‌ওয়ার পর সে স্থব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি ভাবনায় পরে গেলাম,ও এরকম স্থব্দ হয়ে গেল কেন?
আমার ভাবনার মাঝেই ও ঘুরে গেল,যার ফলে আমি পিছন যাওয়ার সুযোগ পেলাম না। তবে মজার ব্যাপার হলো ও আমাকে দেখে কোমায় চলে গেছে! মানে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে।ভুত দেখলেও হয়তো কেউ এভাবে চমকাবে না,ও যেভাবে চমকে গেছে।যাই এখানেই আমার সার্থকতা খুঁজে পেয়েছি।এ দিনটার জন্যই তো অপেক্ষা করে ছিলাম আমি।ও বাড়ি আসবে আর আমাকে দেখে চমকে যাবে।সব কিছু বাদ দিয়ে ওকে নরমাল করতে ঠান্ডা শরীর টাকে আঁকড়ে ধরলাম আমি। তারপর বললাম,
– কেমন দিলাম বলো?

– আমি কখনোই ভাবিনি তুমি আমার এই ভাঙ্গা ঘরে আসতে পারো?

– আমার নয় বরং আমাদের। ছায়া সঙ্গিনী আমি তোমার এমনি এমনি তো বলিনি। তোমার ঘরেই যদি না থাকি তাহলে কি আর ছায়া সঙ্গিনী হ‌ই বলো?

তুমি দূর্গম পথে চললে,
সেই পথের পথিক আমিও।
তুমি ফুলে ফুলে সজ্জিত পথে চললে,
সেই পথের পথিক আমিও।
কজ আমরা একে অপরের ছায়া সঙ্গিনী?

আমার বউ’টা আমাকে এত্তো ভালবাসে! আমি তার সম ভালোবাসা দিতে পারবো তো?

আমি মাথা তুলে তাকিয়ে বললাম,
– আমি জানি তুমি নিজের থেকেও বেশি আমায় ভালোবাসো।তাই এই নিয়ে কোন দুশ্চিন্তার কারণ নেই অকে? এবার তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে নাও। আমার জন্য তোমাকে এতো সময় ভিজতে হলো। আসলে আমি ভয়ে দরজা খুলার সাহস পাইনি। ভেবেছিলাম যদি কোন চোর ডাকাত হয়ে থাকে।

– তুমি তোমার দিক থেকে ঠিক‌ই আছো। সত্যি ই তো আমার জায়গায় অন্য কেউ ও তো হতে পারতো। আচ্ছা মা কোথায়? তুমি বাড়িতে একা কেন?

– মামা অসুস্থ বলে মা দেখতে গিয়েছে, হয়তো বৃষ্টির জন্য আসতে পারছেন না।
এখনো মাগরিব এর আযান হয়নি, আমি একা আছি ভেবে বৃষ্টি একটু কমে আসলেই হয়তো র‌ওনা হবে।আমি কল করে বলে দিচ্ছি আজকে যেন কষ্ট করে না আসে।

– হুম তাই করো, বৃষ্টিতে রাস্তা ঘাট পিচ্ছিল হয়ে আছে।পরে আবার ব্যাথা পাবে।

রাহাত ভিজে কাপড় চেঞ্জ করেছ, আর আমি মাকে কল করে বলে দিলাম আজকে যেন কষ্ট করে না আসে। রাহাত এসেছে শুনে মা যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলেন। কথা শুনেই বুঝতে পারলাম এতোক্ষণ আমার জন্য খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন।
_______
বৃষ্টির বেগ কমে এসেছে এখন, ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পরছে। চারিদিকে অন্ধকারে ডুবে আছে, কোন মানুষের গতানুগতি নেই। সবাই সবার ঘরে অবস্থান করেছে। আমার এখন বিন্দু মাত্র ভয় নেই কারণ সবচেয়ে ভরসার হাতটা যে আমার হাতে আছে। “আলহামদুলিল্লাহ”।

আলহামদুলিল্লাহ অর্থ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার।তাই বান্দা যখন আলহামদুলিল্লাহ বলে আল্লাহ তা’আলা অনেক খুশি হন।আমরা যেই পরিস্থিতিতে থাকি না কেন, আলহামদুলিল্লাহ বলবো ইনশা আল্লাহ।১২৪

মাগরিব এর আযান হতে, দু’জনে মিলে নামায পড়ে এসে বসে রইলাম।ওর মাথায় হাত রাখতেই বুঝলাম পানি আছে এখনো।তাই গামছা নিয়ে এসে ভালো করে মুছে দিতে লাগলাম। তখন ও বললো কবে এসেছো তুমি?
– আজকে তিন দিন হলো।

– আচ্ছা সেই জন্যই মা বললো আমি যেন ছুটি হলেই বাড়ি আসি।

আমি রাহাতের গলা জড়িয়ে ধরে বললাম,
– আমিই মাকে বলেছি, তোমাকে যেন এখানে আসতে বলে। নতুবা তুমি যদি নারায়ণগঞ্জ চলে যাও তখন আমি তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে পারতাম না।

– আচ্ছা তাহলে আমার দুষ্টু ব‌উ আগেই পরিকল্পনা করে রেখেছে।

– ইয়েস আর্মি সাহেব।

– আচ্ছা এশার এর আযান হতে তো আর সময় আছে তাই না?

– হুম, কিন্তু কেন?

– খুব ক্লান্ত আমি,একটু ঘুমাবো।চলো?

– আমি কেন! তুমি ঘুমাও।

– না তুমি সহ।

তারপর আর কি আমাকে তার সাথে মিশিয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লো।তার ডান হাতে আমার মাথা রাখলো, বললাম ব্যাথা পাবে তা-ও শুনলো না।তার লোমশ বুকে আঁকিবুঁকি করছি আমি, তখন সে বললো,
– জানো আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না তুমি গ্রামে আসতে পারো।

আমি মাথা তুলে তার দিকে তাকিয়ে বললাম,
– আমি কিন্তু গ্রামের মেয়ে ভুলে যেওনা। গ্রামের মতো এতো শান্তি আর কোথাও আছে নাকি। তুমি যদি আমার পাশে সবসময় থাকতে তাহলে আমি গ্রামেই সারাজীবন কাটিয়ে দিতাম। কিন্তু তুমি ছাড়া থাকতে পারবো না আমি।

– তো ম্যাডাম গ্রামে থাকতেন ভালো কথা, মাটির চুলায় রান্না করতে পারবেন তো?

– পারি কিন্তু খুব ঝামেলা। বিশেষ করে কালি গুলো একদমই ভালো লাগে না। পুরো শরীর কালি মাখিয়ে ফেলি। গতবার এসে যখন রান্না করেছিলাম তখন মুখে কালি লেগেছিল বলে তোমার চাচাতো বোন রোজিনা হাসতে হাসতে শেষ। আমি তো প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না ও এভাবে হাসে কেন পরে,,,

– এক মিনিট! গতবার মানে? তুমি কি এর আগে আমাদের বাড়িতে এসেছিলে নাকি?

– আর্মি সাহেব শ্বশুরবাড়ি না আসলে কোথায় আসবো বলেন?

– ক‌ই আমাকে তো একবার ও বললে না।মা ও তো কিছু বললো না।

– মাকে আমি বলতে নিষেধ করেছিলাম তাই বলে নাই। এখানে আসার পর ই তোমার এক্সিডেন্ট হয়, তারপর আমরা সবাই যাই তোমার কাছে।

– আমার অগোচরে এত কিছু হয়ে গেল অথচ আমি কিছু জানি না, দুষ্টু মেয়ে।সরি দুষ্টু ব‌উ আমার,,,,

তারপর,,,

নিজের অধরে অধৈর্য অধরের স্পর্শ পেতেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি।
________
আমার চুলে বিলি কাটতে কাটতে রাহাত বললো, আমার সাথে কোয়ার্টারে যাবে আয়রা মেহেনূর? তোমাকে সবসময় আমার সাথে মিশিয়ে রাখবো। কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু পর পর এসে তোমাকে মন ভরে দেখতে পারবো আমি।যাবে আমার সাথে?পারমানেন্টলি আমার সাথে থাকবে তুমি, তবে মাঝে মাঝে বাবা’র বাসায় বা এখানে বেড়াতে আসবে।

রাহাতের কথা শুনে একটু ভেবে বললাম,
– এর জবাব টা অন্য ভাবে প্রকাশ করি?,,,,

#চলবে,,, ইনশা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here