#দ্বিতীয়_পুরুষ,পর্ব ১৬,১৭
_নীলাভ্র জহির
১৬
একজন পুরুষ মানুষের জীবনে বাবা হতে পারাটা সবচেয়ে গৌরবের। সে যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন বাবা হওয়ার খবরে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হয়। রূপকের হৃদয়টা আনন্দে টইটুম্বুর। সে বাড়ি ফিরল দুই কেজি মিষ্টি নিয়ে। চিত্রা সবেমাত্র চুলা থেকে গরম গরম তরকারি নামিয়েছে। রূপক বাড়িতে পা দিয়েই চিৎকার করে বলতে লাগল, মা তুমি কই? এই রুবিনা নাজমা তোরা কই? সাইদুল কইরে। সব এখানে আয় দেখ কি লইয়া আইছি। আজকে তোরা মিষ্টির শিরা দিয়া গোসল করবি।
রূপকের চিৎকার-চেঁচামেচিতে সবাই এসে হাজির হলো। ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন রূপকের বাবা। বাবাকে দেখে খানিকটা সংকোচ হলো রূপকের। সে আর আগের মত হইচই করতে পারলো না। মিষ্টির প্যাকেট গুলো রুবিনার হাতে তুলে দিয়ে বলল, সবাইরে মিষ্টি দে। যে যতটা খাইতে পারে তারে ততটাই খাওয়া।
জোসনা বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, রুবিনা তুই এই পাগলের কথা শুনিস না। এক প্যাকেট মিষ্টি ঘরে রাইখা আয়। আর এক প্যাকেট থাইকা সবাইরে দে।
রূপক বলল, আরে মা কিপটামু করতাছো কেন? সবাইরে মিষ্টি দিয়ে আজকে স্নান করামু।
তুই চুপ থাক। তোর মাথার তার ছিইড়া গেছে। দুইটা গরম ভাত খাইয়া তুই দোকানে যা।
আইজ এক্কেরে দুপুরের ভাত খাইয়া তারপর দোকানে যামু।
কথাটা শুনে মনটা আনন্দে নেচে উঠল চিত্রার। রূপক আশে পাশে থাকলেই তার পৃথিবীটাকে স্বর্গ মনে হয়। রূপক দুপুরবেলা দোকানে যাবে। তারমানে পুরোটা সময় তারা দুজন কাটাতে পারবে একসঙ্গে। সে তড়িঘড়ি করে রান্নাঘর থেকে উঠে পুকুর পাড়ে যায় হাত মুখ ধুতে। চুলার আঁচে তার গা ভিজে উঠেছে। ভিজে গেছে শাড়ির নিচে থাকা ব্লাউজ। চিত্রা ভালো করে পুকুরে নেমে হাত মুখ ধুয়ে ফেলল। পুকুর থেকে ওঠার সময় রূপক এসে দাঁড়াল তার সামনে। রূপকের চোখের দিকে তাকাতে লজ্জা করছিল চিত্রার।
রুপক বলল, বউ তোমার লাইগা একখান জিনিস আনছি।
কি জিনিস?
আনছি একখান জিনিস। ঘরের আসো তোমারে দেখামু।
আপনি এইখানে ক্যান আইছেন?
তোমারে দেখতে আইছি। আমার পোলারে পেটে ধইরাই তুমি দেখি সুন্দর হইয়া গেছো।
চিত্রা লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। বলল, আপনার খালি ঢং এর কথা। এখন এখান থাইকা যান। সবাই দেখলে আমারে নিয়া হাসাহাসি করব। ঘরে যান আমি আসতাছি।
হাসাহাসি ক্যান করব। তুমি আমার বউ না?
সবার ঘরে বউ আছে। সবাই আপনের মত এত ঢং করে না।
এইডা কি কথা কইলা বউ? আমি ঢং করি? আমিতো তোমার লগে একটু পিরিতি করি।
পুকুরঘাটে পিরিতি করতে হইবো না তো। পিরিত যা দেখানোর ঘরে দেখাইয়েন। এখন এখান থাইকা যান।
ঘরে চলে এলো রূপক। তার পিছুপিছু চিত্রা ঘরে ঢুকতেই রূপক এসে দরজা ভেজিয়ে দিল। তারপর পকেট থেকে বের করল একটা লাল প্লাস্টিকের কৌটা। ভেতরে জ্বলজ্বল করছে একটা গলার চেইন। বাজারের মোড়ে জুয়েলের কসমেটিকের দোকান থেকে ইমিটেশনের একটা চেইন কিনে এনেছে রূপক। অন্য পকেট থেকে বের করল আরও একটা গোল কৌটা। সেখান থেকে বের করল দুইটা হাতের চুরি।
চিত্রার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আনন্দে ঝলমল করতে করতে লাগলো চিত্রা বললো, এগুলো ক্যান আনছেন?
আমার বউয়ের জন্য আনছি। বউটারে তো কিছুই দিতে পারিনা।
আমার কিছুই লাগবো না। সবই তো আছে। আগের চুড়িগুলান এখনো নতুন আছে। আইজ আবার ক্যান আনছেন?
তাতে কি হইছে? রাইখা দাও। সামনে তো আর একটা দাওয়াত আছে। তখন হাতে পইড়া যাইবা।
চিত্রা খাটের নিচ থেকে তার কাপড়-চোপড়ের সুটকেস বের করল। সেখানে পরম যত্নে রাখা আছে তার বিয়েতে পাওয়া সাজসজ্জা সামগ্রী। চুরি ও চেইনটা সেখানে ঢুকিয়ে রাখল চিত্রা।
রূপক বলল, আরে করতাছো কি? একটু গলায় পইরা আমারে দেখাও।
এখন না। সবাই কি ভাববে?
যা ইচ্ছা ভাবব।
চিত্রা এই প্রথম রূপকের চোখে চোখ রেখে খুব আবেগী গলায় একটা কথা বলল ,আপনি এত ভালো মানুষ ক্যান?
কথাটা হৃদয় স্পর্শ করল রূপকের। সে চিত্রার কোমল মুখটাকে দুই হাতে ধরে চোখে চোখ রেখে বলল, ভালা বউয়ের স্বামী কি খারাপ হইবো?
চিত্রার মুখটা হঠাৎ করে অন্ধকারে ছেয়ে গেল। ভালো বউ! সেকি ভালো বউ? তার শাশুড়ির কাছে সে এখনো পছন্দসই মেয়ে হয়ে উঠতে পারেনি। জানেনা কিভাবে ভালো বউ হয়ে ওঠা যায়। স্বামীর মুখ থেকে কথাটা শুনতে তার ভিষণ ভালই লাগলো। তবে একই সঙ্গে কষ্ট হতে লাগলো। স্বামী কি খারাপ হইবো কথাটা তার বুকে আঘাত করেছে। সে তো পূর্বেও ভালো বউই হতে চেয়েছিল। সোহরাব উদ্দিন তাঁকে কার হাতে তুলে দিয়েছিল সে সব কিছুই ভাবেনি চিত্রা। বাবা তাকে যার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল তার হাত ধরেই বাড়ি ছেড়েছিল সে। অথচ সেই মানুষটা তাকে বিক্রি করে দিয়েছিল এক শয়তানের কাছে। একজন মানুষ কতটা খারাপ হলে নিজের কুমারী স্ত্রীকে পর পুরুষের কাছে বিক্রি করে দিতে পারে। অবশ্য লোকটা বিক্রি করার জন্যই বিয়ে করেছি। চিত্রার মন গ্লানিতে ভরে গেল। ভালো বউয়ের স্বামী কখনো খারাপ হয় না। তবে সে কি ভাল ছিলনা? নাকি তার কপালটা খারাপ ছিল। চিত্রা আর কপালকে কোনো দোষারোপ করবে না। তার জীবনে রূপক এসেছে। এখন থেকে ওকে ঘিরেই তার সমস্ত কিছু আবর্তিত হবে। সে একেবারেই দুর্ভাগা নয়। রুপক তার সৌভাগ্য।
দেখতে দেখতে কেটে গেল দুটো মাস। রূপকের পরম আদরে ও যত্নে মাখামাখি হয়ে আছে চিত্রা। প্রতিদিন দোকান থেকে ফেরার সময় কোন না কোন খাবারের জিনিস নিয়ে ফেরে রূপক। কখনো বা মাথার তেল, চুল বাঁধার হেয়ার ব্যান্ড, কিংবা কখনো নিয়ে ফেরে দোকানের সবথেকে সুন্দর শাড়ি।
আজকাল জোসনা বেগম রীতিমত ঈর্ষান্বিত বোধ করেন ছেলের এই আদিখ্যেতা দেখে। কোন এক অজানা কারণে এসব সহ্য হচ্ছে না ওনার। তাই তিনি সবসময় খেমটা মেরে কথা বলেন চিত্রার সঙ্গে। সাইকেলের বিষয়টা পুরোপুরি ধামাচাপা পড়ে গেছে। রুপক সাইকেলটা কিনেছে সেটা নিয়ে সে দোকানে যাতায়াত করে। গত দুই মাসে একবারের জন্যও খোঁজ নেয়নি চিত্রার ফুপাতো ভাই কিংবা ভাইয়ের বউয়েরা। চিত্রা বেশ বুঝতে পারছে সাইকেলের আশায় বসে থাকলে এতদিনে তার সংসারে অশান্তির আগুন জ্বলত। ভাগ্যিস তার স্বামী নিজে থেকেই কিনে ফেলেছে সাইকেলটা। নয়তো কি যে হত তার কপালে? সকাল থেকে চিত্রা এই কথায় ভাবছিল।
হঠাৎ করে সে শুনতে পেল জোসনা বেগম একজনের সঙ্গে রীতিমতো জোর গলায় কথা বলছে, কি আর কমু রে বইন। জনমভরা দুঃখ। এত ভালো পোলা আমার। নায়কের মত চেহারা। বাপের দোকান নিজেই সামলায়। এখন আবার দর্জির কাম শিখছে। একবার দোকান দেখে একবার দর্জির কাম করে। এত কামাই রোজগার করে আমার পোলায়। এক ফকিরের বেটিরে বউ কইরা আনছি। আমার পোলারে একটা সুতা পর্যন্ত দিল না। অন্য কোথাও বিয়ে দিলে আমার পোলারে যেমন সাজাইয়া দিত পোলার ঘরদোর সব সাজাইয়া দিত। এত বড় টিনের ঘর তুলছে আমার পোলায় অথচ ঘরটা পুরা ফাকা। ফুটবল খেলার মাঠ হইয়া গেছে ঘর। কোন জিনিস পাতি নাই। পোলা আমার দুইটা টাকা কামাই কইরা নিজের আয় করব না ঘরের জিনিস করব? অন্য কোথাও বিয়া দিলে কতইনা জিনিস পাইতো আমার পোলাডা।
চিত্রার কানে কথাগুলো আসতেই তার বুকের ভিতর চিনচিন করে বেজে উঠলো। আজ এতদিন পর তার শাশুড়ি মা আবার যৌতুকের বিষয়ে কথা বলছেন। তবে এই কথাটা হয়তো সে শুনতে পারছে তার আড়ালেও নিশ্চয়ই সবাইকে তিনি এসব বলে বেড়ান। এসব ভেবেই ভয়ে তার বুক কেঁপে উঠতে লাগলো।
চিত্রা আড়াল থেকে দেখার চেষ্টা করল তিনি কথাগুলো কাকে বলছেন। দেখতে পেল পাশের বাড়ির দু জন মহিলা। ওনারা অবাক হয়ে রূপকের মায়ের কথা শুনছেন। ওনারা মৃদুস্বরে কি বলল চিত্রা তা শুনতে পেল না। সে দূর হতে দেখল তার শাশুড়ি মা বিড়বিড় করে তাদেরকে কি যেন বলতে লাগলো।
চিত্রার মন খারাপ হয়ে গেল। জোসনা বেগম তার ব্যাপারে দুর্নাম করছে না তো?
চিত্রা মন খারাপ করে শুয়ে রইলো। রাতে রূপক বাসায় ফিরলে জিজ্ঞেস করল, আপনারে একটা কথা জিগাই।
হ বউ কও।
আপনের কি মাঝে মাঝে মনে হয় অন্য কোথাও বিয়ে হইলে অনেক জিনিসপাতি পাইতেন?
এই কথা জিগাইতাছ ক্যান ?
আমারে বিয়া কইরা আপনি কিছুই পান নাই । জামাইয়ের খাতির সম্মানটুকুও পান নাই ।
আমি কি কখনো তোমারে সেসব কথা কইছি?
কন নাই । কিন্তু মনে মনে কি দুঃখ পান না?
না পাই না । আমি তোমারে নিয়ে খুশি আর তাছাড়া এই রূপক মানুষের জিনিস আশা করেনা।
চিত্রা ভীষণ আশ্বাস পায়। রূপকের এই ধরনের কথাগুলো তাকে শান্তি দেয়। তখন নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হয়। ইচ্ছে করে হাজার বছর বেঁচে থাকতে রূপকের বুকে।
চিত্রা সব সময় ভয় পায় এত সুখ তার কপালে সইবে তো? তার এই শঙ্কা বাস্তবে রূপান্তরিত হতে আর খুব বেশি দেরি নেই। সে ধারণাও করতে পারছে না ভবিষ্যতে কি অপেক্ষা করছে তার জন্য!
চলবে..
#দ্বিতীয়_পুরুষ
পর্ব ১৭
_নীলাভ্র জহির
জোসনা বেগম আজ সকাল থেকে দাওয়ায় পাটি বিছিয়ে শুয়ে আছেন। তাকে দেখে মোটেও অসুস্থ মনে হচ্ছে না। একটু বারবার পান খেয়ে পান এর পিক ফেলে তার পাশের জায়গাটা লাল করে ফেলেছেন। চোখ বড় বড় করে এদিক সেদিক তাকাচ্ছেন। কখনোবা রুবিনা কিংবা নাজমাকে পাশে ডেকে গল্পগুজব করছেন। কিন্তু বলছেন তার কোমরে ব্যথা। শরীরে অস্বস্তি হচ্ছে। এক বালতি কাপড়-চোপড় বারান্দায় বের করে রেখেছেন ধোয়ার জন্য।
চিত্রা কি করবে বুঝতে পারছে না। এই অবস্থায় এতগুলো কাপড় ধোয়া তার হয়তো উচিত হবে না। কিন্তু জোসনা বেগমকে সরাসরি কিছু বলতে পারছে না চিত্রা। সংসারের টুকিটাকি কাজ শেষ করে সে দাওয়ায় শাশুড়ির পাশে এসে বসলো।
আজকের দিনটা রৌদ্রোজ্জ্বল। গাছের পাতায় ঝলমল করছে রোদ। উঠোনে খেলা করছে পাশের বাড়ির দুটো বাচ্চা। ওদের খেলা করতে দেখে চিত্রার কেমন মন উচাটন হয়ে যায়। একদিন তার বাচ্চা ঐ উঠানে খেলা করবে। চোখের সামনে এক অপূর্ব দৃশ্য ভেসে ওঠে চিত্রার। একটা ফুটফুটে বাচ্চাকে দৌড়ে খেলা করতে দেখছে সে।
জোসনা বেগম বললেন, গরুর খড় কাইটা দিছো।
হ আম্মা। কাইটা দিসি।
বেলা হইয়া গেছে। আমার কাপড় গুলা এখন ধুইয়া দিতা। শুকাইতে সময় লাগবে তো। গা গোসল দিয়া আবার কি গায়ে দিমু।
চিত্রা ইতস্তত করতে করতে বলে ফেলল, কাপড় ধোয়া কি ঠিক হইবো আম্মা।
ঠিক হইবো? বুঝলাম না তোমার কথা।
না আম্মা কইতেছিলাম যে এই অবস্থায় কাপড় ধোওয়া কি ঠিক হইব। পেটের উপর চাপ পড়ব না?
কথাটা বলতে গিয়ে লজ্জায় ঠোঁট কাঁপছিল চিত্রার। সে শ্বাশুড়ির দিকে তাকাতে পারেনি। উঠোনের বাচ্চা দুটির দিকে তাকিয়ে আপন মনের কথাটা বলে ফেলেছিল। কিন্তু জোসনা বেগম ফ্যালফ্যাল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে বিস্ময়। তিনি বললেন, এগুলো আবার কেমন কথা কইতাছো। তোমার কি আট মাসের পেট হইছে যে প্যাটে চাপ পড়ব। কাপড় ধুইতে পারবা না। আমরা যখন পোয়াতি ছিলাম বড় বড় কলসিতে কইরা ওই মাদবর মিয়ার বাড়ি থাইকা পানি আনছি। তোমার তো সেইটা করতে হইতাছে না। বাড়িত টিউবয়েল পাইছো। আমরা ঢেঁকিতে বারা বানসি। মনে মনে ধানের কাম করছি। তোমারে তো সেই সব করতে দেই নাই বাপু। কাপড়ও ধুইতে কইতাম না। বিয়ের পর তোমারে কোনদিনও কইছি আমার একটা কাপড় একটু ধুইয়ে দাও? কই নাই। আজ আমার একটু মাজায় ব্যথা। ব্যথার জন্য উঠবার পারতাছিনা। কিন্তু কাপড়গুলো ময়লা হইয়া গেছে। নামাজ কালাম পড়মু। এজন্যেই তোমারে কইতাছি একটু ধুইয়া দিতে। আজকালকার পোলাপাইন কত রকমের কথা. তোমার ধুইতে মন না চাইলে দেও, না চাইলে রাইখা দেও। মাজার ব্যাথা যেদিন সারবে সেইদিন ধুমু।
চিত্রা কোনো প্রতিউত্তর করতে পারল না। কথাটা তো সত্যিই, তার শাশুড়ি কোনদিনও তাকে নিজের একটা ব্লাউজ পর্যন্ত ধুয়ে দিতে বলেনি। আজ উনি অসুস্থ বলেই ধুতে দিয়েছেন। চিত্রার উচিত কাপড়গুলো ধুয়ে শুকাতে দেয়া। এক বালতি কাপড় নিয়ে সে পুকুর ঘাটের দিকে রওনা দিল।
ঘাটের পাশে টংয়ের উপর বসে আছে রুবিনা। পাশের বাড়ির দুজন ভাবি ও মেয়েদের সঙ্গে সে গল্প করছে। গাছ থেকে পেয়ারা পেরে ছোট ছোট করে কুচি করে লবণ মরিচ দিয়ে মেখে খাচ্ছে সবাই মিলে। চিত্রাকে দেখে বললো ভাবী এইখানে আসো।
চিত্রা দাঁড়ালো তাদের পাশে। কয়েক টুকরা পেয়ারা মুখে দিতেই তৃপ্তির স্বাদ পেল সে। বলল , দারুন মজাতো খাইতে।
রুবিনা বলল, হ ভাবি। খাও । তোমার এখন ভালো ভালো খাবার খাইতে হইবো।
কথাটা বলেই মুখ টিপে হাসলো রুবিনা। দখিনা হাওয়া গায়ে লাগছে। গাছের ছায়ায় টং এর উপর বসে চিত্রা বেশ কয়েক টুকরা পেয়ারা খেয়ে ফেলল। এক ভাবী বলল, ভাবি তোমার একখান কতা কইতাম। এত তাড়াতাড়ি পোলা মাইয়া নিলা কিল্লাইগা। বিয়া তো সবে হইছে। অন্তত একটা বছর পরে নিবার পারতা।
চিত্রা চুপ করে রইলো।
ভাবি আবারও বললো, খেলাধুলা যে ভালোই হইছে সেটা তো বুঝাই যাইতাছে।
মুখ টিপে হাসলো সবাই। লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো চিত্রা। কিন্তু সবার সামনে নিজেদের অপমান সইতে পারল না। বলল, আপনার ভাইয়ের খুব ছোট পোলা মাইয়ার শখ। ছোট ছোট পোলাপান দেখলে নাকি হের খুব ভালো লাগে। প্রথমদিকেই আমারে কইছিল সে তাড়াতাড়ি পোলার বাপ হতে চাই। পোলারে সে অনেক আদর করবো। এইজন্য আমি আর ওষুধ দাওয়াই খাই নাই।
আরেকজন ভাবি মুচকি হেসে বললেন, এটা তো ভালো কথা। কিন্তু একটা কথা কইয়া রাখি মনে রাইখো। নতুন বিয়া করছো। শইল্যের জোয়ার এখনো কমে নাই। পুরুষ মানুষ কিন্তু যখন-তখন শইল্যের উপরে লাফায়া পড়ব। পোলার কথা ভাইব। যখন তখন ঐ কাম করতে দিওনা।
চিত্রার মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। এই কথাটা উনি সত্যি বলেছেন। তার পেটে এখন রূপকের সন্তান। সন্তানের কথা ভেবেও অন্তত এখন চিত্রাকে কিছুদিন ছাড় দেয়া উচিত ছিল রূপকের। কিন্তু রূপকের আচার-আচরণে কখনোই মনে হয় না চিত্রা সন্তানসম্ভবা। প্রায় প্রতি রাতেই চিত্রার শরীরকে কাছে টেনে খেলায় মেতে ওঠে। পুরুষ মানুষ মানেই হয়তো শরীর শরীর খেলা। তাদের কাছেই স্ত্রী মানে শুধু ভোগের পণ্য। স্ত্রীদের যে বিশ্রামের প্রয়োজন আছে সেটা তারা মুহূর্তের জন্য মনে করে না। এই দিক থেকে দুনিয়ার প্রত্যেকটা পুরুষ মানুষ হয়তো এক। মেয়েদেরকে তারা মানুষ মনে করে না’।
চিত্রা টং থেকে উঠতে উঠতে বলল আমি যাই কাপড়গুলো ধুয়ে দেই।
এতগুলা কাপড় ধুইতে নিছো কি জন্য । গোসলের পরে দুইটা কাপড় ধুয়ে দিবা । কাপড় ধুইতে গেলে শরীর নাজেহাল হইয়ে যায় ।
আম্মায় ধুইতে দিল । ওনার শরীলটা ভালো নাই ।
ভাবি রুবিনাকে বললেন, কিরে রুবিনা। তোর মায়ের কাপড় দুটো তো ধুয়ে দিতে পারোস। তোর ভাবিরে এ অবস্থায় এতগুলা কাপড় ধুতে দিছে।
রুবিনা বলল, আমি কাপড় ধুলে আম্মার পছন্দ হয় না। কয় আমার ধোয়া কাপড় নাকি সাফ হয়না?
সাফ হইলে হইব না হইলে হইব না। তোর ভাবিরে এত কাপড় ধুইতে দিস না। তুইও যা ওরে একটু সহযোগিতা কর।
তারপরও ঠায় বসে রইল রুবিনা। চিত্রা মনে মনে আশা করলো রবিনা হয়তো এই কথা শুনে তাকে সহযোগিতা করতে উঠে আসবে। তাই সাহস করে পুকুর ঘাটে নেমে সবগুলো কাপড় সাবান পানিতে ভিজিয়ে রাখলো। কিন্তু একটা একটা করে ধীরে ধীরে সব কাপড় ধোয়া হয়ে গেলেও রুবিনার আসার কোন নাম গন্ধ নেই। চিত্রা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে রুবিনার দিকে তাকায়। দেখতে পেলেও টং এর উপর শুধু ভাবীরা বসে আছে রুবিনা নেই। ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল চিত্রার। সব কাপড় ধোয়া শেষ করে সে আরো একবার তাকালো। রুবিনা এখনও নেই। কাজ করার ভয়ে নিশ্চয়ই পালিয়েছে এখান থেকে। অন্যের কাছে কোন কিছু আশা করা বৃথা। চিত্রা এক বালতি ভেজা কাপড় শুকাতে দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। জোসনা বেগম দাওয়ায় নেই। চিত্রা কোন দিকে না তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। শরীরটা খুব নাজেহাল হয়ে গেছে। পুকুর ঘাটে কাঠফাটা রোদ। সেই রোদে এতগুলো কাপড় কাচতে গিয়ে খুব পরিশ্রম হয়েছে তার। সে বিছানায় শুয়ে পড়ল। ক্লান্তিতে ঘুম চলে এসেছে চোখে। ঘুম ভেঙে গেল জোসনা বেগম এর ডাকে। তিনি বললেন, মাজার ব্যাথায় কিছুই তুলতে পারতাছিনা। ও বউ, গরু গুলারে একটু পানি দিয়ে আসো না।
চিত্রা ধীরে ধীরে উঠে পড়ল। দুই বালতি পানি নিয়ে এসে দিল গরুকে খেতে। তারপর কাপড় নিয়ে গোসল করতে চলল সে।
গোসল করার সময় ঘাটে অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়। এই যেমন আজ দেখা হলো পাশের বাড়ির রুনা ভাবির সঙ্গে । ভাবী অনেক ফেনা তুলে গা ঘষছেন। পরনে শুধু একটা পেটিকোট যেটা বেঁধে রেখেছেন বুকে। তার সাদা ধবধবে গায়ে সাবানের ফেনা গুলো চিকচিক করছে।
চিত্রা গোসল করতে নামল।
ভাবী বললেন, বমি টমি করিস না?
ভাত খাওয়ার সময় বমি হয়। খাইতে পারি না ভালো কইরা।
আয়রন ট্যাবলেট খাইতেছস?
না,
তোর শাশুড়ি তোরে কয় নাই এখন আয়রন ট্যাবলেট খাইতে হইবো?
চিত্রা তাকিয়ে রইল মহিলার দিকে। আয়রন ট্যাবলেট এর কথা কেউই তাকে বলেনি। তার বিভ্রান্তি চোখ দেখে মহিলা বললেন, কিলিনিকে যাস। স্বাস্থ্য কেন্দ্রের আপা কিছু আয়রন ট্যাবলেট দিয়ে দিব।
টাকা নিব না?
না, সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র। কোন টাকা নিব না। আয়রন ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট দিয়ে দিব।
আচ্ছা, ঠিক আছে। কিন্তু আমিতো স্বাস্থ্যকেন্দ্র চিনিনা।
রুবিনা অথবা নাজমারে নিয়ে যাবি।
আচ্ছা, দেখি।
রাত্রিবেলা রূপকের কাছে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যাওয়ার কথাটা বলল চিত্রা। রূপক তাকে আশ্বস্ত করে বলল আমি রুবিনারে কইয়া দিমু। ও তোমারে নিয়া যাইবো।
পরপর আরো দুদিন চিত্রার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়া হলো না। জোসনা বেগম এর শরীর খারাপ। তিনি মাজার ব্যাথায় নড়াচড়া করতে পারছেন না। ঘরের সব কাজ চিত্রাকে করতে হচ্ছে। দুদিন পর জোসনা বেগমের শরীর কিছুটা ভালো হলে চিত্রাকে তিনি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।
স্বাস্থ্য কেন্দ্রের আপা চিত্রাকে আয়রন ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট দিলেন ঠিকই। সঙ্গে বলে দিলেন খাওয়া দাওয়া করবেন ঠিকমতো। বেশি বেশি পুষ্টিকর খাবার খাবেন। মাছ মাংস ডিম দুধ শাকসবজি খাবেন বেশি করে। আপনার হাসবেন্ড কে বলবেন এখন আপনার বেশি বেশি ভালো খাবার খাওয়া দরকার।
চিত্রা মাথা দুলিয়ে বলল আচ্ছা ঠিক আছে আপা।
আর বাসার কোন ভারী কাজ করবেন না। ছোট ছোট কাজগুলো করবেন। একটানা কাজ করবেন না। অল্প করে কাজ করবেন, একটু বিশ্রাম নেবেন আবার একটু কাজ করবেন।
চিত্রা কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইল, ভারী কাম কোনগুলা?
মহিলা হেসে বললেন, ভারী কাজ কোনগুলো বুঝেন না আপা? এই ধরুন বাড়িতে বেশি মানুষের ভাত রান্না হয় । আপনি ভাতের হাড়ি চুলা থেকে নামাবেন না। আবার ধরুন পানির কলস, পানির বালতি এগুলো তুলবেন না। ধানের গামলা একদমই তোলা যাবে না। যে কাজগুলো করতে বেশি ভর লাগে সেগুলো করা যাবে না। ছোট ছোট কাজগুলো করতে পারবেন।
চিত্রা জানতে চাইল, গরুকে পানি দেওয়া যাইবো না?
আপনি যদি এক মগ করে কয়েক মগ পানি দেন তাহলে দেয়া যাবে। কিন্তু আপনি যদি একসঙ্গে একটা বড় বালতি ভরে গরুকে পানি দিতে চান তাহলে তো সেটা করা যাবে না।
চিত্রার মুখটা শঙ্কায় কালো হয়ে গেল। সে জানতে চাইলো, ধরেন আমি ভুল কইরা একটা বালতি তুইলা ফেলছি। তাইলে কি হইব?
এই ভুল তো করা যাবে না আপা। আপনাকে সব সময় মাথায় রাখতে হবে আপনার পেটে একটা সন্তান আছে। কোন রকমের রিস্কি কাজ আপনাকে একদমই করা যাবে না।
ধরেন যদি কইরা ফালাই তখন কি হইব?
বাচ্চা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
বুক কেঁপে উঠল চিত্রার। সে তো বালতি ভরে গরুকে পানি দিয়েছে। এমনকি বাড়ির সব ভারী ভারী কাজ তাকে করতে হয়েছে। যদি তার বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গিয়ে থাকে! ভয়ে ও আতংকে তার চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল।
মহিলা বললেন, কি হয়েছে আপা? কোনো সমস্যা? আপনাকে কি ভারী কাজ করতে হয়?
হুম।
মুখ গম্ভীর চিত্রার।
মহিলা বললেন, আর করবেন না।
পোলার যদি কোনো ক্ষতি হইয়া থাকে?
হলে হয়ে যেত ‘এতক্ষণে। তারপরও আপনি এখন থেকে খুব সতর্ক থাকবেন। দিনে দুই ঘন্টা শুয়ে বিশ্রাম নেবেন। বেশি কাজ করবেন না।
জি আপা। আমার জন্য দোয়া রাইখেন।
অবশ্যই আপা।
আর একটা কথা জিগাই। আমি তো আইজ সকালেও দুই বালতি পানি তুলছি। আমার পোলার কিছু হইব না তো?
হতেও পারে। সেটা তো বলা যাচ্ছে না। আপনি বাসায় গিয়ে সারাদিন শুয়ে থাকুন। প্রয়োজন ছাড়া উঠবেন না।
– শুইয়া থাকলে কি হইব?
এতে রিস্কটা কম থাকবে। আগামী কয়েকদিন আপনি শুয়ে বসেই থাকুন। যদি এরমধ্যে খারাপ কিছু না ঘটে তাহলে আর টেনশন থাকবে না। তবে এরপরে আর কখনো এ ধরনের কাজ করবেন না।
চিত্রা বাড়ির পথে রওনা দিলো। রুবিনাও তার সঙ্গে ছিল, কথাগুলো রুবিনাও শুনেছে। সে নিশ্চয় জোসনা বেগমকে ভালো করে সবকিছু ব্যাখ্যা করবে। দুশ্চিন্তায় মরার দশা হল চিত্রার। তার বাচ্চাটার কিছু হয়ে গেলে সে মরেই যাবে।
চলবে..