দ্বিতীয়_পুরুষ,পর্ব ১৮,১৯

0
333

#দ্বিতীয়_পুরুষ,পর্ব ১৮,১৯
_নীলাভ্র জহির
১৮

গর্ভের শিশুর দুশ্চিন্তায় চিত্রার অবস্থা ত্রাহি ত্রাহি। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে সে নিজের মনের অবস্থা কাউকে বোঝাতে পারছে না। সবাইকে বোঝার মানুষ থাকে না। যেমন চিত্রার নেই। বাড়িতে এসে বিছানায় শুয়ে পড়েছিল চিত্রা। কিছুক্ষণ পর জোসনা বেগম এসে তাকে একটা কাজের কথা বললেন। কিন্তু চিত্রা বিছানা ছাড়িনি। সে ঠিক করেছে আগামী দুইদিন শুয়ে থাকবে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর জোসনা বেগমের গলা শোনা গেল,তোমার একটা কাম করতে কইছিলাম বউ।
চিত্রা উত্তর দিল, এখন পারুম না আম্মা। ডাক্তার আপায় কইছে আমার একটু বিশ্রাম নিতে।
কতক্ষণ বিশ্রাম নিতে হয়? সে দুপুর থাইকা শুইয়া রইছো। এখনো ওইটা একটু হাঁটাহাঁটি করো। দুনিয়াটার আলো-বাতাস দেখো। কাম কাজ না করলে শরীরে নুনা ধরবো।
আম্মা দেখ ডাক্তার আপা কইছে আগামী কয়েকদিন আমারে বিছানায় রেস্ট নিতে। জরুরী দরকার ছাড়া উড়তে মানা করছে।
এটা আবার কেমন কথা? এমন কথা তো জীবনেও শুনি নাই বাবু। পোলাপাইন তো আমারও হইছে। সবারই হয়। সারাদিন কে বিছানায় শুইয়া থাকে?
আম্মা আমার একটু সমস্যা আছে। রুবিনা আমার সঙ্গে গেছিল। ওরে জিজ্ঞেস করেন, ও কইবো।
হইছে । আজকালকার মাইয়াগো কত যে সমস্যা।

বিড়বিড় করতে করতে জোসনা বেগম সেখান থেকে চলে গেলেন। এরপর তিনি হয়তো রুবিনা সঙ্গে নিয়ে কথা বলেছিলেন। চিত্রা আশা করেছিল জোসনা বেগম তাকে বুঝবে। নিজের মেয়ের মত পরম আদর-স্নেহে ভরিয়ে রাখবে তাকে। কিন্তু সবকিছু জানার পর হিতের বিপরীত হলো। তিনি আরো ভয়ঙ্কর রেগে গেলেন। ঘরের কাজ করতে করতে সমস্ত রাগ করতে লাগলেন জিনিসপত্রের উপর। সবকিছু জোরে জোরে ফেলতে লাগলেন আর মুখে বললেন, গোবর পোড়া কপাল রে। মাজায় ব্যথা হওয়ার আর টাইম পাইলো না। সারা জীবন সংসার কইরা আইলাম। এই দুই দিনের জন্য কেন আমার এই মরার অসুখ হইলো। জমিদারের বেটি রে কাম করতে কইছিলাম। কেন যে করতে কইছিলাম? বহুৎ বড় ভুল কইরা ফেলছি। কাম কাজ করলে কি হয়? শরীর ভালো থাকে। তার কামের কথা কইয়া নাকি আমি তার সর্বনাশ কইরা দিছি। আরে কিছুই হইব না। স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মানুষজন একটু বেশি কথা কয়?
পাশের বাড়ির একজন মহিলা জানতে চাইলেন কি হইছে ভাবি।
আরে আর কইও না। রূপকের বউর একটু কাম করতে কইছিলাম। এই কাম করনের লাইগা নাকি তার শরীর খারাপ হইয়া গেছে। ডাক্তার নাকি তারে কইছে সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে। কোন কাম কাজ না করতে।
মহিলা বললেন ডাক্তার এই কথা জীবনেও কইবো না। কাম কাজ করলেতো শরীরের আরো উপকার হয়। তোমার বউ এগুলা কইতাছে কারণ সে খালি সুযোগ খুজতাছে। তারে দেখলেই বোঝা যায় দুনিয়ার আইলশা। ঘরের কাজ কামে মন নাই।

চিত্রার বুক ফেটে কান্না আসতে চাইল। নিজের পরিস্থিতিতে সে কখনো কাউকে বোঝাতে পারবে না। তাকে বোঝার মতো কেউ নেই। একমাত্র রূপক তাকে বুঝতে পারে।

রূপক বাড়ি ফিরলে চিত্রা সব কথা তাকে খুলে বলল। রূপক বললো আচ্ছা ঠিক আছে আমি আম্মারে বুঝাই কমু।
চিত্রার খুব বলতে ইচ্ছা করছিল তাতে আমার অশান্তি আরো বাড়ব। কিন্তু স্বামীর সামনে শাশুড়ির বদনাম করতে ইচ্ছে করলো না। তাই বিষয়টাকে এড়িয়ে গেল চিত্রা।

পাখি ডাকা এক নতুন ভোরের সূচনা। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে ঘরের বাইরে বের হয়েছে চিত্রা। সবেমাত্র অন্ধকার কেটে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। এই আলোয় হাঁটতে খুব ভালো লাগে। বাড়ির সামনের কাঁচা রাস্তায় কয়েক মিনিট চিত্র হাঁটাহাঁটি করে উঠোনে এসে দাঁড়ালো। জোসনা বেগম আড়চোখে তাকে দেখছে। গরু গুলোকে গোয়াল ঘর থেকে বের করেছিলেন উনি। চিত্রা নিজেও গোয়াল ঘরে গিয়ে দুটো গরুর রশি ধরে বাইরে বের করার চেষ্টা করলো। এমন সময় একটা গরুর গুতা খেয়ে রীতিমতো পড়ে যাওয়ার জোগাড় হল তার। জোসনা বেগম এর তাতে কোনো সহানুভূতি হলো না। বরং তিনি আরো ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, তোমারে এইখানে আইতে কে কইছে? মরতে আইছিলা? পেটের মধ্যে একটা গুতা লাগলে তখন কইতা আম্মা লাগাই দিছে। এইখান থাইকা যাও।
চিত্রার মন খারাপ হয়ে গেল। রান্নাঘরে এসে ভাতের পাতিল ধুয়ে পানিসহ চুলায় তুলে দিলো চিত্রা। ভাতের চাল ধুতে গেছে এমন সময় আবারো শোনা গেল জোসনা বেগমের গলা, আবার ওইখানে গিয়ে কি করতাছো ? রাইখা দাও। কাম আমি করমু। তোমার কিছু করা লাগবো না। ঘরে গিয়া শুইয়া থাকো।

চিত্রা জোসনা বেগমের কথায় ভ্রুক্ষেপ করলো না। সে স্পষ্ট বুঝা গেছে শ্বাশুড়ীর কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিতে হবে। কানের ভেতর রাখতে গেলে কষ্ট হবে তার। উনার প্রত্যেকটা কথা হৃদয়টাকে পুড়িয়ে বের হয়। এই বাড়ির বউ হয়ে থাকতে চাইলে আরো অনেক বেশি সহ্য ক্ষমতার অধিকারী হতে হবে তাকে।

চিত্রা চুলার পাড়ে বসে ভাত জাল দিতে লাগলো। জোসনা বেগম এসে বললেন যাও ঘরে যাও। কাম কাজ কিছু করতে হইবো না। তোমার ডাক্তার কইছে সারাদিন শুয়ে থাকতে। তুমি শুইয়া থাকো। পারলে আমার পোলারে ও সারাদিন ধইরা রাখ।

চিত্রা কোন প্রত্যুত্তর’ করল না। জোসনা বেগম তাকে এক প্রকার জোর করে রান্না ঘর থেকে বের করে দিলেন। অগত্যা বাধ্য হয়েই চিত্রা নিজের ঘরে চলে এলো।

আজ চিত্রার সারাটা দিন কাটলো শাশুড়ির খিটিরমিটির কথাবার্তা শুনে। শাশুড়ি তাকে কোনো কিছুতে হাত দিতে দিচ্ছিলেন না। পরে রূপকের কাছে জানতে পারল গতরাতে রূপক তার মায়ের সঙ্গে চিত্রাকে নিয়ে কথা বলেছিল। রূপক নিজেই অনুরোধ করেছিল যাতে মা চিত্রাকে কোন কাজ করতে না দেন। এ কারণেই তার ওপর প্রচণ্ড রেগে আছেন জোসনা বেগম। বিষয়টাকে নিয়ে চিত্রাহার মাথা ধামাল না। সবকিছু যত বেশি এড়িয়ে যেতে পারবে ততোই সুখে থাকতে পারবে সে।

তখন মধ্যরাত। চিত্রাকে একবার বাইরে যেতে হবে। এ বাড়ির পায়খানা (টয়লেট) ঘর থেকে অনেক দূরে। এখন রাত্রিবেলা বেশ কয়েকবার চিত্রাকে বাইরে যেতে হয় চিত্রার রূপককে ঘুম থেকে ডেকে তুললো। রূপক ঘুমের ঘোরে ডুবে গেছে। বলল, দরজা খোলা রাইখা যাও। আমি জাইগা আছি। ভয় পাইও না।
আপনিও চলেন আমার লগে। একা একা যাইতে ডর লাগে।
আচ্ছা, তুমি যাও আমি দুয়ারে দাঁড়াইয়া আছি।

চিত্রা বাইরে বেরিয়ে এলো। সারাদিন পরিশ্রম করে রূপক বাসায় ফেরার পর রাত্রিবেলা তাঁর ঘুম ভাঙ্গাতে ও চিত্রার ভালো লাগেনা। মনে সাহস করে সে এগিয়ে গেল পুকুর ঘাটের দিকে। বদনায় পানি নেই। হাতের টর্চ লাইট জ্বালিয়ে সামনে এগোচ্ছিল চিত্রা। হঠাৎ কি মনে করে এসে পুকুর ঘাটের চারিদিকে ও বাড়ির আশেপাশে একবার লাইট দিয়ে পরখ করলো। তার মনে হলো পিছনের বাগানে কেউ একজন দৌড়ে পালিয়ে গেল। গাছের আড়ালে লুকিয়ে গেছে সে। এত রাতে এখানে কারো থাকার কথা নয়। দৌড়ানো মানেই তো বিষয়টা সন্দেহজনক। চিত্রা ঘাট থেকে পানি নিয়ে পায়খানায় গেল। পায়খানা থেকে বের হয়ে ঘরে যেতে যেতে টর্চ বন্ধ করে ফেলল। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কৌতুহল তার সমস্ত ভয় দূর করে দিয়েছে। কেন যেন মনে হলো সে রুবিনার ওড়না রং দেখেছে। এত রাতে বাগানে রুবিনার দৌড়াদৌড়ি করার কথা নয়। একদিকে তার মনে ভয় অন্যদিকে কৌতুহল। চিত্রা লাইট বন্ধ রেখে গুটি গুটি পায়ে। চিত্রা লাইট বন্ধ রেখে গুটিগুটি পায়ে পিছন দিকটা এসে দাঁড়ালো। কোন সাড়াশব্দ নেই। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল চিত্রা। অনেকক্ষণ পর শোনা গেল পাতার মর্মর শব্দ। খসখস আওয়াজ তুলে কেউ একজন যেন হেঁটে যাচ্ছে। তবে আওয়াজটা এমন সে খুব সতর্কভাবে হাঁটছে যেন শব্দ না হয়। সেদিকে লাইট জ্বালালো চিত্রা। দেখতে পেল গ্রামের পরিচিত এক ছেলেকে। লাইটের আলো ধরতেই দৌড়ে ছেলেটা দ্রুত আড়াল হয়ে গেল। চিত্রা দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। তার মনে হচ্ছিল গাছের আড়াল থেকে হয়তো রুবিনা বের হয়ে আসবে। কিন্তু রুবিনাকে আসতে দেখতে না পেয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হতাশ হয়ে চিত্রা ঘরে ফিরে এলো। এসে দেখলো বিছানায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে রূপক। রূপককে কথাটা বলবে কিনা চিত্রা বুঝতে পারল না। তবে বাগানে রুবিনার উড়নার মত কিছু একটা দেখতে পেয়েছিল সে। এখন তার মনটা উসখুস করছে। কেন যেন মনে হচ্ছে রুবিনা ঐ ছেলেটার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল।
ঘরে থাকতে না পেরে চিত্রার ঘর থেকে বেরিয়ে রুবিনার ঘরের দরজায় এসে টোকা দিল। দরজা ভেজানো। খোলা মাত্রই দেখল ভিতরে কেউ নেই। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বিছানার উপরে বসে রইল চিত্রা। রুবিনার এখনো ফেরার কোনো নাম নেই। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর দরজা খোলার আওয়াজ হলো। ঘরের ভেতর চিত্রাকে বসে থাকতে দেখে ভুত দেখার মত চমকে উঠল রুবিনা। চিৎকার করতে করতে ও নিজেকে সামলে নিল। তারপর দৌড়ে এসে চিত্রার পা দুটো জড়িয়ে ধরল, ভাবি তুমি কাউরে কিছু কইও না। আমি ভাবছিলাম তুমি আম্মারে জাগাইছ। আইসা দেখি সবাই ঘুমে। তুমি কাউরে কিছু কও নাই। দোহাই লাগে তুমি কাউরে কিছু কইওনা। তুমি যা কইবা আমি তাই শুনুন ভাবি। আমার ভুল হইয়া গেছে।

চিত্রার কাছে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে গেল। সে রুবিনার হাত ধরে বলল, তোমার সম্মান মানে আমার সম্মান। আমি তোমার সম্মান নষ্ট করতে চাই না বোন। তোমার গা কাঁপতাছে। উইঠা বস। আমার পা ছাইরা দাও।

না, ভাবি। আপনি আগে কোন কাউরে কিছু কইবেন না।
কাউরে কিছু কমু না। তুমি উঠো। শান্ত হইয়া বস। এখন আমার ওই পোলার ব্যাপারে বিস্তারিত কও।

ওরে তো আপনি চেনেন। ওর নাম শিমুল।
হ, তার লগে তোমার কি ব্যাপার সেইটা কও।
ওর লগে আমার সম্পর্ক চলে। অনেকদিনের রিলেশন। আইজ রাইতে আমি ওর লগে দেখা করতে চাই নাই। শিমুল খুব জোর করতে ছিল। কইসিলো আজ দেখা না করলে আমার লগে রাগ করবো। ও রাগ করলে আমি সইতে পারিনা। আমার অনেক কষ্ট হয়। তাই ঘরের বাহির হইছিলাম।
তোমাদের রিলেশন কেমন?
কেমন মানে?
ও তোমারে ভালোবাসে?
হুম ।
রিলেশন কতদূর গড়াইছে? খালি দেখা করছ নাকি দেখা কইরা অন্য কিছু করছ?
রুবিনা চুপ করে রইলো। তার মাথাটা নিচু করা। থুতনি বুকের সঙ্গে লাগানো। দ্রুত ঠোঁট কামড়াচ্ছে।
চিত্রা বলল আমি কাউকে কিছু কমুনা। তোমার ভাইরেও কমু না। আমারই শুধু কও সম্পর্ক কতদূর?
রবিনা লাজুক শ্বরে আমতা আমতা করে বলল, মেইন জিনিস টা বাদে বাকি সব হইয়া গেছে।
বুকে হাত দিছে?
রবিনা আসতে করে মাথা নাড়ালো, হু ।
ওই জিনিস বাদ দিয়া সব হইয়া গেছে?
হ ভাবি।
প্রতিদিন দেখা করলে মেলামেশা করো?
মাঝে মাঝে দেখা করি। যেদিন দেখা করি সেদিনই কাছে আসে।
ওকি তোমারে বিয়া করব?
ও তো বলে করব।
ওর লগে যদি তোমার বিয়ে না হয়?
না, হইলে আমি তো কিছুই করতে পারুম না। আমি ওরে বিশ্বাস করি। শিমুল ভালো ছেলে। আমি আপনার লগে ওরে কথা বলাইয়া দিমু ভাবি।
তোমার ভাইয়ের এক মাইয়ার লগে প্রেম ছিল। আমি শুনছি। তার লগে তোমার ভাইয়ের বিয়া হয় নাই। তোমার ভাই কিন্তু ভালো ছেলে । তোমারও তো এমন হইতে পারে। বিয়া না হইলে কি এই স্মৃতিগুলো ভুলতে পারবা।
কি আর করবো ভাবি? ভালোবাসি ওরে । প্রেম যখন করি কাছে পাইতে তো মন চাইবো। আপনি তো সবই বুঝেন।
আচ্ছা, ঠিক আছে। এখন ঘুমাইয়া পড়ো। কালকে তোমার লগে কথা কমু। তোমার ভাই আবার জাইগা গেলে আমারে খুজবো।
ভাবী আপনি কিন্তু কাউরে কিছু কইবেন না।
আরে পাগলি আমি তো কইছি কমু না। আমারে বিশ্বাস করো। টেনশন কইরো না। এখন মেলা রাইত। ঘুমাইয়া পড়ো।

চিত্রা তার নিজের ঘরে চলে এলো। বেরিয়ে আসার সময় শুনতে পেল রুবিনার দরজা আটকে দেয়ার শব্দ। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করে অনেক রাত পার হয়ে গেল। আর কিছুতেই ঘুম এলো না তার নীরব দুটি চোখে।

চলবে..

#দ্বিতীয়_পুরুষ
পর্ব ১৯
_নীলাভ্র জহির

গতরাতে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ঘটনাটি সারাদিন চিত্রার মনকে প্রভাবিত করে রইল। সকালে রান্নাঘরে এলে জোসনা বেগম চিত্রাকে বসার সুযোগ দিলেন না। ছেলের ওপর হওয়া ক্ষোভ তিনি এখনো ভুলতে পারছেন না।
সারাদিনে বেশ কয়েকবার বললেন, অন্য জায়গায় বিয়া হইলে আমার পোলায় কত জিনিস পাইতো!
মনে অশান্তি চিত্রার। প্রতিদিন এই এক ঘটনার পুনরাবৃত্তি তার আর ভালো লাগছে না। রূপককে কথা দিয়েছিল বলেই সে শাশুড়ীর মুখের ওপর কোনো জবাব দিতে পারেনা।

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। রান্না ঘরের চালার নিচে ভাত জ্বাল দিচ্ছেন জোসনা বেগম। চিত্রা উঠোনে হাঁটাহাঁটি করছে । সন্ধ্যা হলেও আশেপাশের ঝাউ জঙ্গলে জোনাকির আনাগোনা বেশ প্রকট । ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক জানান দিচ্ছে নেমেছে রাত্রি । এই রাতের অন্ধকারে দখিনা বাতাসে চিত্রার মনটা কেমন যেন ছটফট করে । সে মনে মনে বলছিল যদি এই মুহূর্তে রূপক বাড়ি ফিরত তবে অনেকক্ষণ সে রূপককে জড়িয়ে ধরে থাকতো । মাঝে মাঝে রূপকের কথা খুব মনে পড়ে । সারাদিন মানুষটা কেমন করে কাটায় খুব জানতে ইচ্ছে করে চিত্রার । হাঁটতে হাঁটতে আবছা অন্ধকারে একটা ছায়া দেখে চমকে উঠলো । অন্ধকার কাটিয়ে বের হয়ে আসছে মানুষটা । কাছাকাছি আসতেই চিত্রা বুঝতে পারল সেটা আর কেউ নয়, তার রূপক। মাঝে মাঝে তার মনের আশা গুলো এভাবে পুরণ হয়ে গেলে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হয় ।
রূপক চিত্রার সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বলল, কি গো বৌ এইখানে কি করতাছো ?
একটু হাটতে ছিলাম ।
তুমি কি জানবার পারছিলা আমি আসতাছি ?
না তো ।
চিত্রা মনে মনে রূপককে খুব করে কামনা করছিল সেটা অপ্রকাশ্য রাখল । নিজের অনুভূতি গুলো সব সময় প্রকাশ করতে চিত্রার ভালো লাগেনা ।
রূপকের হাতে দুটো ব্যাগ। একটা ব্যাগ রান্নাঘরে মায়ের কাছে রেখে আরেকটা ব্যাগ হাতে নিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলো। জোসনা বেগম তাকিয়ে রইলেন দরজার দিকে। চিত্রা ঘরে ঢুকে ভেজিয়ে দিল দরজা। বুকের ভেতরটা কেমন যেন জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিল জোসনা বেগমের। তিনি এত আদিখ্যেতা সহ্য করতে পারেন না। এই ভরসন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দরজা আটকে দেয়ার ঘটনা টা তাকে যতটা না কষ্ট দিয়েছে তার চেয়ে বেশি তিনি কৌতুহলী হয়ে উঠেছেন রূপকের ব্যাগে কি আছে সেটা জানার জন্য। বউ এর জন্য কি নিয়ে এসেছে সে?

রূপক চিত্রার জন্য নিয়ে এসেছে একটা নতুন শাড়ী, ব্লাউজ পিস, নারিকেল তেল ও এক কেজি আপেল।
খুশিতে ঝলমল করতে করতে চিত্রা জিনিস গুলো নাড়াচাড়া করছিল। হারিকেনের টিম টিমে আলোয় ওর মুখে লাল আভা পড়েছে। রূপক সেই গোলগাল লাল গাল দুটো টেনে দিয়ে বলল এত খুশি হইছো বউ? তোমারে এমন সব সময় হাসি খুশি দেখতে আমার খুব ভালো লাগে।
আপনার মত মানুষরে পাইলে হাসিখুশি না থাকলে উপায় নাই।
আম্মায় তোমারে কিছু কইছে?
না,
কাম করনের লাইগা কিছু কয় নাই?
চিত্রার মুখটা অন্ধকারে ছেয়ে গেল। একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আপনি ক্যান কইছেন আমারে কাম না করতে দিতে। সে আমার উপর রাগ কইরা আছে। আমারে কোন কামে ধরতে দেয় না।
কাম কাজ না করতে দিলে তো আরো ভালো । শুইয়া বইসা কাটাও ।
আমার শুইয়া বইসা থাকতে ভালো লাগে না । আর তাছাড়া ওনারে দিয়া কাম করাইয়া আমি বইসা থাকমু সেটা কেমনে হয় ?
মন খারাপ কইরো না। দুইদিন পর ঠিক হইয়া যাইবো। তুমি এই এক কেজি আপেল আমার আম্মারে দিয়ে আসো। কইবা আপনার পোলায় এক কেজি আপেল আনছে। আপনারা খান। আমারে এইখান থাইকা দুইটা দিয়েন। তাইলে দেখবা তোমারে বেশি কইরা দিব। পোয়াতি হইলে একটু ফলমূল খাওয়াইতে হয় শুনছি। কিন্তু তুমি তো আর এক কেজি আপেল একা একা খাইতে পারবা না। আমার আম্মারে দিয়া দাও সে তোমারে খাইতে দিবো।
চিত্রা বললো, আচ্ছা ঠিক আছে। আমি যাইতাছি।
এখনই যাইতে হইবো না। একটু কাছে আসো। আজ আব্বা দোকানে বইছে। বেচাকেনা নাই। কইলাম তাইলে তাড়াতাড়ি বাড়ি যাই।
জামা কাপড়ের অর্ডার কেমন আসে?
প্রতিদিন দুই একটা অর্ডার থাকেই। দর্জিগিরি কাজ শিইখা ভালো করছি। রমজান মাসে আমার কাম বাইড়া যাইবো।
হ, আপনার লাইগা আমি সব সময় দোয়া করি।
বউ নতুন কাপড়টা একটু পড়ো। তোমারে মন ভইরা দেখি। তুমি পোয়াতি হওয়ার পর তোমারে আরো বেশি সুন্দর লাগে।
কি কন। আমারও তো এখনো পেটই বাইর হয় নাই।
পেটের জন্য না। তুমি এমনি খুব সুন্দরী হইয়া গেছ।
হইছে আর কইতে হইবো না।
দুইহাত বালিশের উপর দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল রূপক। টর্চ লাইট নিয়ে পুকুর ঘাটে হাতমুখ ধুতে গেল চিত্রা। সন্ধ্যার অন্ধকার কেটে এখন রাত নেমেছে। ঝিঁঝির ডাক আর পুকুর ঘাটে ভেসে আসা শীতল বাতাসে তার মনটা ফুরফুরে লাগে। তার স্বামীর কাপড়ের ব্যবসা। চিত্রা আগে শুনেছে যাদের স্বামীর কাপড়ের ব্যবসা থাকে তারা বউকে খুব একটা কাপড় এনে দেয় না। তার স্বামী সবার চাইতে আলাদা। কয়েকদিন পরপর দোকানের সবথেকে সুন্দর শাড়িটা বউয়ের জন্য নিয়ে আসে রূপক। শরীরে হাওয়া লাগছে শিরশির করে। ঠান্ডা পানি দিয়ে চিত্রা হাত মুখ ধুলো। বাসনা সাবান মুখে ডল ফেনা তুলে মুখ ধুয়ে ফেলল। তারপর গামছায় মুখ মুছতে মুছতে বাড়ির ভিতরে চলে এলো সে।
কয়েকদিন আগে কিনে দেয়া ক্রিম গালে মেখে তার ওপর পাউডার মাখল। মাথায় দিল সুগন্ধি তেল। চোখে মোটা করে কাজল টেনে দিয়ে কপালে দিল একটা ছোট্ট কালো টিপ। তারপর নতুন শাড়ির ভাঁজ ভেঙে পেটিকোটের ওপরে একটু একটু করে কুঁচি করতে লাগলো। চিত্রার শাড়ি পরা দেখতে দেখতে অন্য ঘোরে ডুবে যাচ্ছিল রূপক। তার বউয়ের পূর্ণযৌবনা শরীর। সুতীক্ষ্ণ নাভি। নাভির উপরের ব্লাউজের ভেতর থেকে ফেটে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে হৃষ্টপুষ্ট বক্ষ। শুধু পেটিকোট ও ব্লাউজে চিত্রাকে বড়ই রূপবতী লাগে। রূপকের খুব ইচ্ছা করল উঠে এসে চিত্রাকে একটু দলাই মলাই করে দিতে। কিন্তু সে উঠলো না। আজকাল বউয়ের জন্য তার খুব মায়া হয়। কামনার তীব্রতা বোধহয় ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাচ্ছে।
চিত্রা শাড়ি পড়া শেষ করে বুকের ওপর আঁচল তুলে দিল। তারপর লাজুক মুখে এসে বসল রূপকের সামনে। তার মাথায় হারিকেনের আলোয় জবজব করছে তেল। রূপক বলল তোমারে খুব সুন্দর লাগতাছে বউ।
লজ্জায় অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চিত্রা মিটিমিটি হাসলো।

তাকে মন ভরে দেখল রূপক। প্রিয় মানুষকে দেখার মাঝে এক স্বর্গীয় আনন্দ বিরাজ করে। রূপক যতই তাকিয়ে আছে চিত্রার দিকে তার হৃদয়টা ভরে যাচ্ছে পুলকে। সদ্য মাড় ভাঙ্গা শাড়িতে চিত্রাকে নতুন বউয়ের মত লাগছে। তার সন্তানের মা হওয়ার পরও কি চিত্রাকে এমন নতুন নতুন লাগবে। নতুন বউ লাগার জন্য মাঝেমাঝে রূপক তাকে একটা করে নতুন শাড়ি এনে দেবে ভাবতে লাগলো।
এমন সময় দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল রুবিনা। হাতে এনেছে বাটি ভর্তি পেঁয়াজ মরিচ ও সরিষার তেল দিয়ে মাখানো মুড়ি। রুপক বিছানার উপর উঠে বসলো। মুড়ির বাটি নিয়ে খেতে শুরু করল সে। একপলক চিত্রার দিকে তাকিয়ে রুবিনা বলল ভাবি তোমারে সুন্দর লাগতাছে। এই কাপরটা কে দিছে?
তোমার ভাইজান একটু আগে নিয়ে আসলো।
ভাবি আমি যাই।
রূপক বলল, রুবিনা দাঁড়া। আমি আপেল আনছিলাম। আপেলের ব্যাগটা নিয়ে যা।
থমকে দাঁড়াল রুবিনা। চিত্রা টেবিলের উপরে থাকা আপেলের পুরো ব্যাগটাই রুবিনার হাতে দিয়ে দিল।
রূপক বলল, ওইখান থেইকা দুইটা আপেল তোর ভাবিরে দিয়া যাস ।
কাইটা নিয়া আসি। তুমি খাইবা না ভাইজান?
তোর ভাবিরে দুইটা গোটা আপেল দিস। ওর এখন পুষ্টি খাবার খাওয়া দরকার আছে।

রুবিনা তাদের সামনেই পলিথিন এর প্যাকেট খুলে দুইটা আপেল বের করে টেবিলের উপর রাখল। হাসিমুখে বলল, ভাবী এই দুইটা তুমি খাইয়ো।
তারপর বাকি আপেল গুলো নিয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সেদিন রাতের ঘটনার পর থেকে রুবিনার আচরণে অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে। চিত্রার প্রতি যেমন তার সম্মানটা অনেক বেড়েছে তেমনি বেড়ে গেছে সহানুভূতি ও ভালোবাসাও। চিত্রা এখন অনেক আপন হয়ে গেছে তার। বিষয়টা খুব ভালো লাগছে চিত্রার কাছে।

কিন্তু ওই দিকে হিতে বিপরীত ঘটলো। জোসনা বেগম আপেলের খোলা প্যাকেট দেখে ভাবলেন ছেলে বউয়ের জন্য অনেক ফলমূল নিয়ে এসেছে। সেখান থেকে মাত্র কয়েকটা আপেল দিয়েছে তার জন্য। তার সামনে আপেল রাখতেই তিনি বললেন, তোর ভাই আনছে?
হ মা । ভাবিরে দুইটা দিয়া আইছি। এইগুলা আমাগো লাইগা দিলো। দুইটা ধুইয়া ভাইজান রে কাইটা দিয়ে আসি?
দিয়ে আয়।

জোসনা বেগম অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখলেন। তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ছেলে আগে কখনোই বাড়িতে আপেল কমলা নিয়ে আসেনি। ইদানিং বউয়ের জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে অনেক কিছু নিয়ে আসে। সেগুলো মায়ের হাতে দেয় না। সরাসরি নিয়ে যায় বউয়ের কাছে। তারপর বউয়ের দয়া হলে সেখান থেকে দিয়ে যায় তার কাছে কিছু। বিয়ে করতে না করতেই তার ছেলেটা কেমন স্বার্থপর হয়ে উঠেছে। পেটের ছেলে ও কি কখনো আপন হয় না? ওনার বুক ফেটে কান্না আসতে চাইল। হিংসায় জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে লাগলেন তিনি।
তিনটা আপেল কেটে পিরিচে করে কিছু ভাই ও ভাবীর জন্য নিয়ে গেল রুবিনা। সেগুলো দিয়ে এসে জোসনা বেগমকে বলল, তুমি খাইবা না?
না, তুই খা।
কেন খাইবানা?
অত কথার উত্তর তো দিতে পারুম না। খামু না আমি। এগুলা আমার চোখের সামনে থাইকা সরা।
রুবিনা কিছুই বুঝতে পারলো না। সে জানে মা ভাবির উপর রেগে আছে। সেই রাগ এখনো স্থায়ী হবে সেটা রুবিনার জানা ছিল না। সে দাওয়ায় বসে আপেল খেতে খেতে বলল, আম্মা ভাইজান ভাবির লাইগা একটা খুব সুন্দর কাপড় আনছে।
কোন দিন?
আইজই। একটু আগেই একটা কাপড় নিয়া বাড়িতে ফিরছে।
নতুন কাপড় নিয়ে আইছে?
হ মা ।
লগে আর কি আছে?
আমিতো টেবিলের উপরে শুধু আপেল দেখলাম। আর নারিকেল তেল। একটা ব্লাউজের পিস মনে হয়।
ঈর্ষায় আরো জ্বলে গেলেন জোসনা বেগম। তার ছেলে সত্যি সত্যি পর হয়ে গেছে। পরের বাড়ির একটা মেয়ে তার বাড়িতে ঢুকে দুদিনেই হাত করে ফেলেছে তার ছেলেটাকে। সে এখন শুধুমাত্র বউয়ের জন্য কাপড় আনে। ভুল করে কখনো মায়ের জন্য কাপড় আনে না। বউয়ের জন্য নারিকেল তেল নিয়ে এসেছে। ফলমূল নিয়ে এসেছে। আর মাকে দিয়ে গেল মাত্র কয়টা আপেল?

জোসনা বেগম অন্যদিকে মুখ করে আঁচলের আড়ালে নিজেকে ঢেকে ফেললেন। তার চোখ ভিজে আসছে। মনে মনে ভাবলেন আজকে স্বামী ফিরলে এর একটা ব্যবস্থা তিনি করেই ছাড়বেন।

জোসনা বেগম রাতে ভাত খেলেন না। দাওয়ায় ছেলে মেয়ে ও ছেলের বউকে তিনি নিজের হাতে ভাত বেড়ে দিলেন। পুরোটা সময় মুখ গম্ভীর হয়ে রইলো ওনার। রূপক বারবার বলল, আম্মা তুমি খাইবা না?
তিনি উত্তরে বললেন, তোর বাপ আসলে খামু।
জোসনা বেগম মাঝে মাঝেই এমন করেন। স্বামী ফিরলে একসঙ্গে বসে ভাত খান। তাই রূপক এটা নিয়ে কোন বাক-বিতণ্ডা করল না।
কিন্তু রাতে ভাত খেলেন না তিনি। স্বামী বাসায় ফিরতেই তিনি কান্না জুড়ে দিলেন। আহাজারি করা কান্না। তার ছেলে পর হয়ে গেছে। বিয়ে দিতে না দিতেই ছেলেটা আর বাবা মাকে চেনেনা। এখন তার সবকিছু নিজের স্ত্রী। স্ত্রীর জন্য কত কি নিয়ে আসে আর তার কপালে জোটে দুটো আপেল।
স্ত্রীকে তিনি সান্তনা দিতে পারলেন না । তিনি যাই বলতে চান না কেন জোসনা বেগম আরো বেশি হাহাকার করে কাঁদতে থাকেন। তবে সেই কান্নার শব্দ চিত্রার ঘরে পৌঁছালো না। কারণ বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি। রূপক আর চিত্রা অনেকদিন পর শব্দ করে হাসার সুযোগ পেয়েছে। রূপকের কথা শুনে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে চিত্রা। নতুন শাড়ির আবরণ গা থেকে সরিয়ে সে স্বামীর বক্ষে নিজের জায়গা করে নিয়েছে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here