#দ্বিতীয়_পুরুষ,পর্ব ২৪,২৫
_নীলাভ্র জহির
২৪
আজ পাত্রপক্ষ রুবিনাকে দেখতে আসবে। রূপকের প্রচেষ্টায় বিয়েতে সম্মতি দিয়েছেন জোসনা বেগম। সকাল থেকেই চলছে রান্নাবান্নার আয়োজন। একটা বড়োসড়ো দেশী মোরগ জবাই করা হয়েছে। মাছ ধরতে বড় জাল নিয়ে পুকুরে নামল রূপক।
আজ সে দোকানে যায়নি। প্রথমবার জাল ফেলে ছোট ছোট কয়েকটা বাটা মাছ উঠে এলো। চিত্রা হাসতে হাসতে বললো এইগুলা খাওয়াইবেন রুবিনার শ্বশুরবাড়ির লোকজন রে?
আরে না। বড় মাছ পামু।
বড় মাছ থাকলেতো পাইবেন। মাছ ছাড়ছিলেন পুকুরে?
মেলা আগে একবার পোনা ছাড়ছিলাম। রুই কাতলা, তেলাপিয়া। অবশ্য খাইছি অনেক। তারপরও মনে হইতাছে দুই-চারটা মাচ পামু।
কপাল ভালো হইলে পাইবেন।
চিত্রা একটা বালতি নিয়ে পুকুরের চারপাশে ঘুরছে আর রূপকের মাছধরা দেখছে। পুকুরে বড় জাল ফেলে যখন রূপক টেনে টেনে তোলে তার খুব উত্তেজিত বোধ হয়। কয়টা মাছ উঠেছে সেটা দেখার জন্য মনটা আকুপাকু করে। সে দৌড়ে এসে যখন জালের সামনে উপর হয়ে বসে দেখে একটাও মাছ ওঠেনি। ময়লা আবর্জনা উঠে এসেছে একগাদা। সেইসঙ্গে কিছু বাজে বাঁশের কঞ্চি। খিলখিল করে হেসে উঠল চিত্রা।
রূপক বলল তুমি হাসতাছো বউ। দেইখো আমি বড় মাছ পামু।
হ, দেখতাছি তো। কত বড় বড় মাছ পাইছেন আপনি।
কথাটা বলেই একটা বড় বাঁশের কঞ্চির উপরে তুলে ধরল চিত্রা। কঞ্চির দিকে তাকিয়ে সে খুব জোরে জোরে হেসে উঠলো। তার বাঁধভাঙা এই খল খল হাসির শব্দে রূপকের বুকের ভিতর কেমন যেন ধুকপুক ধুকপুক করছে। এই মেয়েটা যখন হাসে তার বুকের আকাশ-পাতাল সবকিছু কাঁপিয়ে দেয়। জড়িয়ে ধরে প্রচন্ড ভাবে ভালোবাসতে ইচ্ছা করে মেয়েটাকে।
রূপক বলল, তুমি ঘাটে নাইমো না। অনেক পিছল। উপরে গিয়া খাড়াও। মাছ পাইলে আমি দিয়ে আসমু।
চিত্রা বালতিটা রূপকের কাছে রেখে উপরে উঠে এল। লুঙ্গি ছোট করে বেধে আরো একবার পুকুরে জাল ফেলল রূপক। চিত্রাকে অবাক করে দিয়ে এবার জালে একটা বড় মাছ উঠলো। একটা বড় কাতলা মাছ। বেশ বড় একটা মাথা। খুশিতে চকচক করে উঠলো চিত্রার মুখখানা। রূপক আনন্দে চিৎকার করে বলল, বড়মাছ পাইছি বউ। কাতলা মাছ।
তারপর জোরে জোরে তার মাকে ডাকতে লাগলো, মা ও মা। দেইখা যাও কত বড় মাছ পাইছি। কই দেইখা যাও?
জোসনা বেগম ছুটে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলেন। রান্না ঘরের কাজে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। তবুও ছেলের আনন্দমুখর গলা শুনে আর ভেতরে থাকতে পারেননি। মাছ দেখে তিনি হাসতে হাসতে বললেন, রুবিনার কপালটা মনে হইতেছে ভালই হইবো। প্রথম সাক্ষাতেই হের শ্বশুরবাড়ির লোকজন বড় মাছের মাথা খাইবো।
রূপক মাছটা জাল থেকে বের করতে করতে বলল, মাছের মাথাটা আমার পোলারে খাওয়াইও।
তোর পোলা কই?
পোলা তো আমার বউয়ের প্যাটে। আমার বউরে দিও তাইলে আমার পোলার খাওয়া হইবো।
জোসনা বেগম আড়চোখে চিত্রার দিকে তাকালেন। সেই চোখে রাগ কিংবা বিস্ময় কোনটই ফুটে উঠল না। তার দৃষ্টি পুরোপুরি অনুভূতিহীন। চিত্রা কোনো ভ্রুক্ষেপ করলো না। কেবল মুচকি হাসলো।
আবারো বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলেন জোসনা বেগম। চিত্রা বলল আম্মার সামনে এমন করলেন ক্যান?
কইছি তো কি হইছে?
আমার বুঝি শরম করে না?
ওরে আমার শরম রে। পোলার মা হইতেছ এখনো শরম রাখলে হইব। দুইদিন পর পোলার বউ আইবো বাড়িতে।
চুপ থাকেন তো। সারাক্ষণ মশকরা। মাছটা বালতির মধ্যে রাখেন। আমি লইয়া বাড়িতে যাই। কুইটা ধুইয়া রান্নার আয়োজন করতে হইবো।
চিত্রা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে দেখলো একটা বেশ উৎসব উৎসব ভাব। পাশের বাড়ি থেকে চাচি এসেছেন। নারকেল কোড়াচ্ছেন তিনি। নারকেল দিয়ে পুলি পিঠা ভাজা হবে। আতপ চাল আর খেজুর গুড় দিয়ে বানানো হয়েছে ক্ষীর। এ বাড়ির সবাই মানুষকে খাওয়াতে খুব পছন্দ করে। আর মেয়ের বাড়ির পাত্রপক্ষ মানে তো আরও বিশেষ কিছু। রান্না ঘরের পাশে বটি ছাই নিয়ে বসলেন এক দাদি। তিনি মাছ কাটবেন। চিত্রা দাওয়ায় হেলান দিয়ে দাড়াল। তার এখন কোন একটা কাজ করা কর্তব্য। কিন্তু জোসনা বেগম এখন পর্যন্ত তাকে কোনো কাজ করতে দেয় না। যদিও গত কয়েকদিন ধরে তার আচরণে মোটেও মনে হয়নি যে তিনি রেগে আছেন। তবুও চিত্রা রান্না ঘরের আশেপাশে এলেই তিনি বলেন, তোমার কিছু করতে হইবো না।
বাজারের ব্যাগ এর পাশেই পলিথিনে অনাদরে পড়ে রয়েছে এক বিরা পান। চিত্রা পান নিয়ে গেল ধোয়ার জন্য। গামলা ভরে পানি নিয়ে খল খল করে পান ধুয়ে রাখলো। শাশুড়ীর ঘরের মাচা থেকে নিয়ে এলো সুপারি। টুলের ওপর বসে ধীরে ধীরে সুপারি কাটতে লাগল সে। কিছুক্ষণ পরে আবার ও রূপকের উচ্ছ্বসিত কন্ঠ শুনতে পেল, মা দেইখা যাও। চিত্রা কই গেলা? এই দেখো আবার একখান পাইছি।
এতগুলো মানুষের সামনে থেকে উঠে যেতে চিত্রার লজ্জা লাগছিল। তাই বসে বসে সুপারি কাটতেই মনোযোগ দিয়ে রাখল সে। মোরগের মাংস কষানোর কড়া সুঘ্রান আসছে। ঘ্রাণে খিদে পেয়ে যাচ্ছে চিত্রার। কিন্তু লজ্জায় বলতে পারল না।
রূপক মাছ নিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল। বলল, যা পাইছি তাতেই ম্যালা হইবো। এবার একখান বড় কার্ফু মাছ পাইছি। ছোট ছোট কিছু পুটি মাছ ধরছে। এগুলা কড়া কইরা ভাজি কইরো।
মাছের বালতিটা রান্নাঘরের পাশে রেখে রূপক পুকুর ঘাটের দিকে চলল গোসল করতে। চিত্রাকে বলল আমার লুঙ্গি টা দিয়ে যাও তো?
মনে মনে এমন একটা সুযোগ খুঁজছিল চিত্রা। সে সুপারি রেখে ঘরে গেল লুঙ্গি ও গামছা নিতে। মাচার একপাশ থেকে নিল তার গোসল করা সুগন্ধি সাবান। অনেকক্ষণ ধরে তার স্বামী পুকুরে মাছ ধরেছে। গায়ে পানি ও কাদার গন্ধ। এখন তাকে সুগন্ধি সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে দিতে পারলে ভালো হয়। চিত্রা গামছা ও সাবান নিয়ে পুকুর ঘাটে এসে দাঁড়ালো। রূপকের গোসল করা প্রায় শেষ। উঠে এসে গামছাটা হাত থেকে নিতে লাগল সে।
চিত্রা বলল, খাড়ান । আগে উইঠেন না। সাবান মাখেন।
আরে সাবান লাগাইতে হইব না।
একটু মাখেন।
আমি সাবান মাখলে তুমি খুশি হইবা?
হ,
তাইলে তো দেখি মাখাই লাগে। দেও সাবান টা দেও।
চিত্রা হাসিমুখে সাবান এগিয়ে দিল রূপকের দিকে। গায় বেশি করে ফেনা তুলে দুই হাত দিয়ে রূপক কচলাতে থাকল। মন ভরে সেই দৃশ্য উপভোগ করতে লাগল চিত্রা। তার মনে হচ্ছে আজকের দিনটা ভীষণ সুন্দর। সবার মনোভাব দেখে মনে হচ্ছে দুই পরিবার মোটামুটি রাজি এই বিয়েতে। আজকে আনুষ্ঠানিকভাবে রুবিনা কে দেখতে আসবে পাত্রপক্ষ। তারপর নিশ্চয়ই বিয়ের দিন তারিখ নিয়ে পাকা কথা হবে। সবকিছু ভালোভাবে শেষ হবে কিনা সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকা সত্ত্বেও আজকের দিনটা চিত্রার কাছে একটি বিশেষ দিন। আজকের দিনের সব কিছুই সুন্দর।
মেহমানরা আসতে আসতে বিকেল গড়িয়ে গেল। জোসনা বেগম পোলাওয়ের চাল ধুয়ে রেখেছেন। মেহমান আসার পর তিনি সেটা রান্না করবেন বলে। আগেভাগে পোলাও রান্না করে রাখলে ঠান্ডা হয়ে যাবে। খেতে ভালো লাগবে না। কিন্তু তারা ভীষণ দেরী করে এলেন।
সবাইকে অভ্যর্থনা জানিয়ে আঙিনার মাঝখানে গোল করে রাখা চেয়ারে বসতে দেয়া হলো। কাচের জগ ভর্তি করে এক জগ শরবত বানিয়েছে চিত্রা। শরবতের জগ ও গ্লাস টেবিলের মাঝখানে এনে রাখলো। ধীরে ধীরে সবার হাতে শরবত তুলে দিয়ে সালাম জানাচ্ছিল চিত্রা। মুরুব্বী এসেছেন বেশ কয়েকজন। অল্প বয়সী মেহমান খুব কমই এসেছেন বলা যায়। শিমুলের ভাই ও ভাবিরা আছেন। ভাবিদেরকে নিয়ে ঘরের ভেতরে চলে গেল চিত্রা।
রূপক লেগে পড়ল সবাইকে নাস্তা দিতে। চিত্রার বিয়ের সময় কেনা একটা গোলাপী রঙের শাড়ি পড়ানো হয়েছে রুবিনাকে। নিজের সাজসজ্জা নিজেই করেছে রুবিনা। গালে ফেস পাউডার লাগিয়ে গাল দুটো লাল টকটকে বানিয়ে ফেলেছে। ঠোঁটে দিয়েছে লাল লিপিস্টিক।
তাকে নিয়ে যাওয়া হল সবার সামনে। ভয়েই রুবিনার আত্মা শুকিয়ে কাঠ। কী যে হবে, সেই ভাবনায় আচ্ছন্ন মনে ব্যকুল সে।
একজন মুরুব্বি জানতে চাইলেন,
তোমার নাম কি মা?
রুবিনা ভয় ভয় গলায় উত্তর দিল। অন্য একজন জানতে চাইলেন তার পড়াশোনা কতদূর, কোন কোন কাজ করতে পারে, রান্নাবান্না জানে কিনা, হাদিস কোরআন পড়া আছে কিনা ইত্যাদি।
হাদিস-কোরআনের প্রসঙ্গ আসতেই অন্য একজন মুরুব্বী বললেন, সূরা কদর পইড়া শুনাইতে কও।
রুবিনা মনে মনে সূরা পড়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে শিমুলের বড় ভাই বললেন, থাউক পড়া লাগব না। তার জানাশোনা তার মধ্যে থাকবো। সূরা কিরাত তার নামাজে লাগবো। আমরা শুইনা কি করমু?
উত্তরটা ভালো লাগলো রুবিনার। মনে মনে বড় ভাইয়ের প্রতি তার শ্রদ্ধা জেগে উঠলো। মুচকি হাসি চেপে রাখলো রুবিনা। মুরুব্বী হয়তো শিমুলের ভাইয়ের কথায় খানিকটা দমে গেলেন। চেয়ারে হেলান দিয়ে গম্ভীর মুখে বসে রইলেন তিনি। ভাবটা এমন যে আজকালকার পোলাপান কে তিনি এই কারণেই পছন্দ করেন না। মুরব্বিদের মুখের উপর কথা বলার কারনে।
তখন আর একজন বললেন, তাইলে আর জিজ্ঞেস করার কি আছে। আর কোন কিছু জানার দরকার নাই। এখন আপনি তাইলে ঘরে যান।
রুবিনা কি করবে বুঝতে পারলো না। স্থিরভাবে বসে রইল। শিমুলের বড় ভাই চিত্রাকে ইশারা করে বললেন, নিয়া যান।
ঘরের ভেতর যেতে যেতে রুবিনার মনে হচ্ছিল এই পথ যেন অনন্তকাল ধরে জ্বলছে। কারণ সেই মুহূর্তে সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। সবার চোখ তখন তার হাটা চলা নিয়ে কথা বলছিলো নিশ্চয়ই। অনেকটা আরষ্ঠ বোধ করছিল রুবিনা। তাকে নিয়ে কে কী ভাবছে সেসব তাকে চিন্তিত করছে। শেষ পর্যন্ত সবার সম্মতিতে বিয়েটা ভালোভাবে হবে তো? শিমুলের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। সে পড়ে রয়েছে সূদুর ঢাকা শহরে। সবকিছু কিভাবে হবে কে জানে? মনে কেবলই অজানা আশঙ্কা।
রুবিনা ঘরে চলে গেলে দু একজন মুরুব্বী বলাবলি করছিল মাইয়া ভালো আছে। ভদ্র, শিক্ষিতা। নামাজী ও মনে হয়। এখন যেহেতু পোলা আগে থেইকা মাইয়ারে পছন্দ করে, আমাদের তো এখানে আর কিছুই বলার ছিল না। তারপরও সমাজের একটা নিয়ম আছে। আমরা দেখতে আইছি। মাশাল্লাহ মাইয়া পছন্দ হইছে আমার। বাকিদের যা মতামত থাকুক না কেন বিয়ে তো দিতেই হইবো। নয়তো আমাগো নাতি আবার খুব কষ্ট পাইব মনে। তয় আমার মনে হয় কারোই মাইয়ারে অপছন্দ হয় নাই।
মুরুব্বী কথাটা বলে সবার মতামতের জন্য প্রত্যেকের মুখের দিকে একবার করে তাকালেন। মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন সবাই। তখন মুরুব্বী বললেন, তাইলে এখন আপনারা একদিন আমাদের বাড়িতে আসেন। আমাদের পোলা যেহেতু ঢাকায় আছে। দুই দিনের ছুটি লইয়া পোলারে আইতে কই। আপনারা পোলারে দেখেন। একটা আলাপ পরিচয় হোক। তারপর যেহেতু পোলায় চাকরি করে, যে দিন আইবো তারপরের দিন বিয়ে-শাদির একটা ব্যবস্থা করা যায়। এখন আপনাগো কি মতামত?
মুরুব্বী তাকালেন রূপকের বাবার দিকে। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা তিনি। মুখভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছেন। এই দিন হয়ত প্রত্যেকটা বাবাকেই দেখতে একই রকম লাগে। খানিকটা মুষড়ে পড়েছেন তিনি। জোসনা বেগম দূরে দাওয়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। লম্বা ঘোমটা টেনে দিয়ে মুখে আঁচল গুঁজে তিনি চোখ পিটপিট করে খেয়াল করছেন কি কি বলছেন? তিনি সেখান থেকে মৃদু স্বরে বললেন, আমাগো কোন আপত্তি নাই।
তখন মুরুব্বী উত্তর দিলেন, আলহামদুলিল্লাহ । তাইলে আমরা পোলারে আইতে কই?
সবার মুখে ফুটে উঠল হাসি। কারন বিয়ে মোটামুটি পাকা হয়ে গেল। শিমুল যেদিন আসবে তার পরের দিন পড়িয়ে দেয়া হবে বিয়ে। বিয়ের সব আয়োজন তাহলে এখন থেকেই শুরু করতে হবে। দিনক্ষণ নির্ভর করছে এখন পুরোটাই শিমুলের ওপর।
জোসনা বেগম খাবারের আপ্যায়নে লেগে গেলেন। মেহমানদের সামনে যে বড় টেবিলটা বসানো হয়েছে সেখানেই দেয়া হল খাবার। রূপক নিজহাতে পরিবেশন করছে। পানির জগ দৌড়াদৌড়ি করে এনে দিচ্ছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। রূপকের চাচাতো ভাইয়েরা এনে দিচ্ছে তরকারির বাটি। খাবারের আয়োজন দেখে মুরুব্বিদের চোখে মুখে তৃপ্তির হাসি। আয়োজনের কোন কমতি রাখেননি রূপকের পরিবার। খাবার খেয়ে পান মুখে দিয়ে যে যার মত আরাম করে বসলেন। কেউবা হাঁটতে গেলেন বাইরে। কেউ আবার রূপকের বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তাদের ঘরের ভিতরে গিয়ে বসলেন। পুরুষ লোকদের খাওয়া শেষ হয়ে গেলে চিত্রার ঘরের ভেতর জোসনা বেগম মহিলা অতিথিদেরকে খেতে দিলেন। তাদেরকে আপ্যায়ন করছিলেন তিনি নিজেই। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে সবার জোরাজুরি থাকা সত্বেও তিনি কিছুই মুখে দিতে পারছিলেন না। মেয়ে হারানোর শোকে যেন আজ থেকেই তিনি মুষরে পড়েছেন। সকলে তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে এই এই দেখে তার চোখ ছল ছল করছে। অন্যদিকে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। এক ধরনের হাহাকার গ্রাস করেছে। এই শূন্যতা কিসের তিনি বুঝতে পারছেন না। জগতের শুধুমাত্র কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতাই এই অনুভূতি উপলব্ধি করবেন।
চলবে..
#দ্বিতীয়_পুরুষ
পর্ব ২৫
_নীলাভ্র জহির
রুবিনার বিয়ে নিয়ে পুরো বাড়ি জুড়ে উৎসাহ-উদ্দীপনার আমেজ। তবে শেষ বেলায় ঝামেলা হল যৌতুক নিয়ে। মুরুব্বীরা যৌতুক হিসেবে দাবি করলেন ঘরের সব আসবাবপত্র এবং নগদ এক লক্ষ টাকা। সেইসাথে ধুমধাম করে বিয়ের অনুষ্ঠান করার একটা ব্যাপার তো রয়েছেই। মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল জোসনা বেগম ও তার স্বামীর। এত টাকা যৌতুক দিয়ে কিছুতেই তিনি মেয়ের বিয়ে দেবেন না। ছেলেকে তিনি বিনা যৌতুকেনল বিয়ে করিয়ে এনেছেন। শুধুমাত্র একটা সাইকেল চেয়েছিলেন সেটাও পাননি। মেয়েকে তিনি কিছুতেই এত টাকা যৌতুক দিতে পারবেন না। দেয়ার সক্ষমতা নেই এমন নয়। তিনি চাইলেই জমা-জমি কিছু বিক্রি করে টাকা দিতে পারবেন মেয়েকে। বাড়ির বাগানের গাছ কেটে ঘরের আসবাবপত্র বানিয়ে দিতে পারবেন। আসবাবপত্র তো দেয়াই যায়। কিন্তু তাই বলে নগদ এক লক্ষ টাকা দাবি করাটা নিতান্তই অমূলক। মুরুব্বিদের দাবি তাদের ছেলে দেখতে-শুনতে বেশ ভালো। ঢাকায় ভালো বেতনে চাকরি করে। তাই তাদের দাবি-দাওয়া বেশ বড়। এটা নিয়ে বাড়িজুড়ে বেশ একটা কোন্দল বেধে গেল। জোসনা বেগম ও রুপক আলোচনা করছেন তারা কিছুতেই এই যৌতুক দিতে রাজি হবেন না। এতে হয় বিয়ে হবে না হয় না হবে। কিন্তু কথাটা কানে যেতেই ভেঙে পড়ল রুবিনা। এটা কিছুতেই হতে পারে না। কথা ছিল বিয়ের জন্য পাত্রী দেখা হবে, বিয়ের কথা পাকা হবে। কিন্তু যৌতুকের ব্যাপারটা নিয়ে তো কোনো কথা হয়নি। হঠাৎ করে এই পরোক্ষভাবে এই জিনিসটা চলে আসলো কিভাবে? রুবিনা চাইলেও এই মুহূর্তে শিমুলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। কাজেই তাকে চুপ করে থাকতে হলো।
চিত্রা ঘরে ঢুকে রুবিনার পাশে এসে বসে। মৃদু স্বরে বলল, শিমুল এটা কি করলো? তোমার লগে প্রেম করার সময় সেতো যৌতুক চায় নাই। বিয়ার সময় কেন যৌতুক চাইব?
– ট্যাকা শিমুল চায়নায় ভাবি। আমার মনে হয় ওর বাড়ির লোকজন চাইতাছে। পোলা বিয়া করার লাইগা পাগল হইয়া গেছে তো। তাই শিক্ষা দিতাছে ওর বাড়ির মানুষজন।
– যাই করো না কেন তোমার শিমুলের লগে কথা কওন দরকার।
– এখন কেমনে কথা কমু?
– পরে কইবা । তারা যা কওয়ার কইয়া যাক। তারপর কি করা যায় আমরা দেখতাছি?
– আমার খুব চিন্তা হইতেছে ভাবি।
রুবিনা খপ করে তার হাতটা ধরে ফেলল। চিত্রা ওকে আশ্বস্ত করে বলল চিন্তা কইরো না। এতদুর আইসা সবকিছু শ্যাষ হইয়া যাইতে পারেনা। একটু ধৈর্য ধরো।
পাত্রপক্ষ তাদের দাবি-দাওয়া উত্থাপন করলে রূপকের বাবা বললেন, আমি ঘরের আসবাবপত্র দিমু। আর নিজে দিল খুশি কইরা যা দিতে মন চায় দিমু। কিন্তু কোন টাকা পয়সা দিতে পারমু না। এতে যদি আপনারা রাজি থাকেন তাইএ যোগাযোগ কইরেন আর নয়তো করতে হইবো না। আমার মাইয়া আমার ঘরে থাকুক। তারে বিয়া দেওয়ার জন্য আমার এত তাড়াহুড়া নাই।
এই কথা শুনে ফিরে গেল পাত্রপক্ষ। বাবার মুখের উপর রূপক কিছু বলার সুযোগ পেল না। সে বলতে চেয়েছিল কিছু টাকা-পয়সা হলেও তারা দেবে। কারণ তার একমাত্র আদরের বোন ভালোবাসে ওই ছেলেকে। বাবার কথা বলার পর সেখানে আর কোন কিছু বলার অবকাশ রইল না। পাত্রপক্ষ ফিরে গেলে অন্ধকার হয়ে গেল রুবিনার মুখ। সত্যি তো তাদের কোন দায় পড়েনি। তার পরিবার কেনই বা তার কথা চিন্তা করবে। কেউ তো জানেনা কতটা দায়বদ্ধতা নিয়ে বসে আছে রুবিনা। শিমুলকে না পেলে বেঁচে থাকার কথা চিন্তাও করতে পারছে না।
রুবিনাকে রূপকের মোবাইলটা এনে দিল চিত্রা । শিমুলকে কল দিয়ে বিষয়টা জানান রুবিনা। শিমুল তাকে আশ্বস্ত করেছে। সে কোন যৌতুক নিবে না। এমনকি ঘরের ফার্নিচার পর্যন্ত না। নেয়ার মত একমাত্র রুবিনাকেই নিয়ে যাবে।
তার এই কথা মুরুব্বিদের কাছে কতটা গুরুত্ব পেল সেটা বোঝার উপায় নেই। কারণ দেখতে দেখতে তিনটা দিন কেটে গেল। কোনরকম খবর এলো না ওই বাড়ি থেকে। এদিকে রুবিনার বাবা-মা ভুলেই গিয়েছেন যে তার মেয়েকে কেউ দেখতে এসেছিল। ওই বাড়িতে বিয়ে না দিলেও তাদের চলবে। যাদের এত বেশি চাহিদা থাকে, এমন লোভী পরিবারে মেয়েকে বিয়ে দেয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। ভীষণ মুষড়ে পড়েছে রুবিনা। ধীরে ধীরে সে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। সারাদিন বিছানাতে শুয়ে শুয়ে কাটছে তার। চরম হতাশা ঘিরে ধরেছে তার জীবনে। এই মুহূর্তে মৃত্যুই একমাত্র সমাধান তার কাছে। কিন্তু মৃত্যুটাও কখনো এত সহজ নয়। কখনো কখনো বেঁচে থাকার থেকে মরে যাওয়া টা অনেক কঠিন।
চিত্রা ঘরে ঢুকে দেখল চোখমুখ ফোলা রুবিনার। মেয়েটা যে অনেক কান্নাকাটি করেছে সেটা তাকে দেখেই অনুমান করা যাচ্ছে। চিত্রা বলল, তুমি কাইন্দ না বইন। আমি আজ শিমুলের লগে কথা কমু। সে যদি নিজের পরিবাররে রাজি করতে না পারে তাইলে তোমারে যেন ঢাকায় লইয়া যায়। পলাইয়া বিয়া করবা তোমরা। এছাড়া আর কোন উপায় তো দেখিনা।
হ, ভাবি। সেইটাই করতে হইবো। তুমি শিমুলরে কইবা বাড়িতে রাজি না হইলে আমারে যেন তাড়াতাড়ি জানাইয়া দেয়। আমি আর এইভাবে থাকবার পারতাছিনা। মনে হইতাছে কখন জানি দম বন্ধ হইয়া মইরা যামু।
সুযোগ বুঝে সাবিনার ফোন থেকে শিমুলকে আবারো কল দিলো চিত্রা। যতটুকু সম্ভব অনুরোধ করলো শিমুলকে। তারা যা করেছে ভালোবেসে আবেগের বশে করে ফেলেছে। সেই আবেগ এখন চরম বাস্তবতা হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তাদের। এই বাস্তবতার মুখোমুখি তাদেরকে হতেই হবে। নয়তো ঝরে যাবে একটা জীবন। আর নষ্ট হয়ে যাবে দুইটি পরিবারের সম্মান। পুরো গ্রামবাসীর কাছে তারা কতটা অসম্মানিত হবে সেসব আরো একবার শিমুলকে বুঝিয়ে বলল চিত্রা। তবে শিমুলের কন্ঠ শুনে সে বুঝতে পারলো ছেলেটা ভীষণ মানসিক চাপে রয়েছে। একদিকে তার কোনো চাকরি হয়নি। অন্যদিকে বাসায় রাজি করানোর প্রেসার।
সূর্য ডুবে গেছে অনেকক্ষণ আগে। পশ্চিম আকাশে লাল আভা যেন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত আকাশ জুড়ে। লাল রঙে ছেয়ে গেছে পৃথিবীর আলো। জোসনা বেগম ধীরে ধীরে তার হাঁস মুরগি গুলোকে ঘরে তুলছেন। ভ্যাপসা গরমে জানালা খুলে দিয়ে বসে রয়েছে চিত্রা। বাড়ির সামনে সাইকেলের ক্রিংক্রিং আওয়াজ শোনা গেল। চিত্রা জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি মেলে দেখল সাইকেলের পেছনে থেকে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে একজন যুবক নামছে। যুবককে চিনতে তার অসুবিধা হলো না। শিমুল এসেছে। ধক ধক করছে চিত্রার বুক। এই সন্ধ্যাবেলায় ব্যাগ কাঁধে নিয়ে সরাসরি তাদের বাড়িতে শিমুল কেন এসেছে?
চিত্রা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। শিমুলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করছেন জোসনা বেগম। স্বাভাবিক কথাবার্তা। শিমুল চিত্রাকে বলল কেমন আছেন ভাবী?
ভালো আছি।
জোসনা বেগম দাওয়ায় একটা চেয়ার বের করে দিলেন। চেয়ারে বসতে বসতে শিমুল বলল, আমি রুবিনার লগে দুইটা কথা কইতে আইছি। ওরে একটু ডাইকা দেন। বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছেন জোসনা বেগম। এই ছেলেটা কি কথা বলতে চায় তার মেয়ের সঙ্গে। উনার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। পাছে লোকজন নানান কথা ছড়ায়। তিনি ভীত সন্ত্রস্ত্র মুখে তাকিয়ে আছেন।
রুবিনা বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।
শিমুল বলল, কেমন আছ রুবিনা?
রুবিনা মাথা নিচু করে রইল। মায়ের সামনে কথা বলতে সে লজ্জা পাচ্ছে।
শিমুল রুবিনাকে সাক্ষী রেখে জোসনা বেগম কে বলল, আন্টি আমি আপনার মেয়েকে পছন্দ করি। আমি ওরে বিয়ে করতে চাই। আমি ঢাকা থাইকা আইছি। এখনও বাড়ি যাইনি। আগে রুবিনার লগে দুইটা কথা কইয়া তারপর যামু। রুবিনা শুনো। আমি বাড়িত গিয়ে সবার লগে কথা কমু। কোন রকম টাকা পয়সা ছাড়াই এই বিয়েতে রাজী হইতে হবে। ওদেরকে যেমনে পারি আমি ম্যানেজ করুম। কিন্তু তুমিও তোমার বাপ মায়েরে ম্যানেজ কইরা রাইখো। আমি জানি তুমিও আমারে পছন্দ করো।
জোসনা বেগম এর সামনে কথাগুলো শুনতে রুবিনার খুব লজ্জা লাগছিল। মাথা নিচু করে রইল রুবিনা। জোসনা বেগম বললেন দেখো বাবা। তোমরা এমনে কথা কইলে তো হইবো না। সমাজের একখান নিয়ম কানুন আছে। তারপরও তুমি যদি তোমার বাপ মায়েরে ম্যানেজ করতে পারো। তাইলে আমাদের কোনো আপত্তি নাই। কিন্তু বাবা বিয়ার পরে তোমার বাপ মা আমার মাইয়ারে জ্বালাইবো সেইটা তো হইবো না।
জ্বালাইতে পারবনা আন্টি। বিয়া কইরা আমি ওরে নিয়া ঢাকায় চইলা যামু। আর আপনার মেয়ে রে দেইখা রাখার দায়িত্ব আপনি আমারে দিবেন। ওর কোন অসুবিধা হইলে আপনি আমারে কইবেন।
সেইটাই। তোমার মুখের দিকে তাকাইয়া আমি রাজি হইছি। আমি তোমার পরিবারকে দেখতাছি না। এখন আমারে বিশ্বাস তোমারে রাখতে হইবো।
জ্যোৎস্না বেগমের নরম গলায় বলা কথাগুলো শুনে ভীষণ অবাক হলো রুবিনা ও চিত্রা। মেয়ের পছন্দকে এভাবে তিনি সম্মান জানাবেন এটা তারা কল্পনাও করেনি। জোসনা বেগম মুড়ি চানাচুর মাখিয়ে শিমুলের জন্য নিয়ে আসলেন। এই সুযোগে শিমুল রুবিনার কাছাকাছি এসে বললো, বাড়িত যামু। গিয়ে সবাইরে কমু আমি তোমারে বিয়া করতে আইছি। দুই দিনের মধ্যে তোমার লগে আমার বিয়া দিতে হইব। যদি না দেয় আমি ঢাকায় চইলা যামু আর কোনোদিন বাড়িতে আর আসমু না। আমার কথা শুইনা সবাই নিশ্চয়ই রাজী হইবো বিয়া দিতে। তাও যদি রাজি না হয় দুইদিন পর ঢাকায় যাওয়ার সময় আমি তোমারে লইয়া যামু। যে কাউরে দিয়া তোমারে খবর দিবার পারি। তুমি রেডি থাইকো।
রুবিনা ছলছল চোখে শিমুলের দিকে তাকালো। তার হাতটা খপ করে ধরে ভরসা দিল শিমুল। ছলছল চোখে তাকিয়ে রুবিনা দেখতে পেল এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বীর পুরুষকে। এই বীর পুরুষ তার প্রেমিক। তার ভালোবাসার মানুষ। তার জীবনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত একজন। যাকে ভালোবেসে কোনো ভুল করেনি। এই মুহূর্তে সমস্ত দুঃখ কষ্ট ধুয়ে মুছে ম্লান হয়ে গেল। রুবিনার হাত ছেড়ে দিয়ে আবারও চেয়ারে গিয়ে বসলো শিমুল। জোসনা বেগম ছোট বাটিতে করে নিয়ে এসেছেন মুড়ি চানাচুর। সামান্য মুড়ি মুখে দিয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে এসে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটছিল রুবিনা ও চিত্রা। তবে এই উৎকণ্ঠা আর বেশিদিন রইল না। একদিন পরেই সাইকেল নিয়ে শিমুল ও শিমুলের বড় ভাই এলো। শিমুলের মুখে বিজয়ীর হাসি। শিমুলের এই বড় ভাইকে প্রথমদিন দেখে খুব ভাল লেগেছিল রুবিনার। ভাই বাসায় ঢুকে হাসিমুখে জানতে চাইলেন, কেমন আছেন আপা?
জ্বী ভাইয়া ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
রুবিনার দুশ্চিন্তা কমে গিয়েছিল। কারণ ও শিমুলের হাসি মুখ দেখেই সে বুঝতে পেরেছে বিয়েতে রাজি হয়েছে তার পরিবার। তবে নতুন কোনো শর্ত জুড়ে দিয়েছে কিনা সেটা জানতে তার আর দেরি করতে ইচ্ছা করছিল না।
শিমুলের বড় ভাই জোসনা বেগমকে ডেকে নিয়ে বসলেন। বিনয়ের সঙ্গে তিনি জানালেন শুরু থেকেই যৌতুক নেয়ার কোনো ইচ্ছা ওনার ছিল না। পুরোটাই মুরুব্বি মহলের ইচ্ছা। তবে শিমুলের বাবা-মা ও বড় ভাই মুরুব্বীদের কথার বাইরে গিয়ে কোনো রকম যৌতুক ছাড়া ছেলেকে বিয়ে দেবেন। এতে হয়তো মুরুব্বিদের মনঃক্ষুন্ন হবে তবে তাতে কিছু করার নেই। শিমুল যেহেতু এই মেয়েকে বিয়ে করতে চায় তাই ভাইয়ের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেবে শিমুলের পরিবার। জোসনা বেগমের কাছে বিনয়ের সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে নিল শিমুলের ভাই। জোসনা বেগম বিস্কুট চানাচুর ও পান-সুপারি দিয়ে নাস্তার ব্যবস্থা করলেন। হাসি ফুটে উঠেছে রুবিনার মুখে। বিয়েটা হয়ে গেলেই সমস্ত দুশ্চিন্তার অবসান হয়।
সেদিন রাতেই রূপক ও তার বাবা প্রথমবারের মতো শিমুল দের বাড়িতে গেল। পরের দিন বিয়ের দিন ধার্য করা হলো। কারণ শিমুলের হাতে ছুটি নেই। ঘরোয়াভাবে বিয়ে হবে। শুধুমাত্র কাছের আত্মীয় স্বজনদেরকে দাওয়াত করে বিয়ে পরিয়ে দেয়া হবে। ধুমধাম করে আয়োজন করার কোনো ইচ্ছে নেই শিমুলের পরিবারের। অথচ শুরুতে তাদের দাবি ছিল অনেক বড় আয়োজন করে মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে।
পরদিন সকালে শিমুল বাজার থেকে ভাবিদেরকে সঙ্গে নিয়ে বিয়ের কেনাকাটা করে ফেলল। বিকেল বেলা রওনা দিলো তারা। শিমুলদের নিয়ে আসা শাড়ি ও সাজ-সজ্জার সামগ্রী দিয়ে রুবিনাকে সুন্দর করে বউ সাজানো হলো। ওভারি থেকে মাত্র একজন মুরুব্বী এসেছেন। বাকিরা যে রাগ করে আসেন নি সেটা ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে। তবে সবমিলিয়ে মেহমান এসেছেন প্রায় বিশ জনের মত। তাদের সবাইকে সাধ্যমত আপ্যায়ন করল রূপকের পরিবার। খাওয়া শেষে কিছু মেহমান বাড়িতে ফিরে গেলেন। মাত্র কয়েকজন আত্মীয় স্বজনকে সঙ্গে নিয়ে বিয়ের আসরে বসলো শিমুল ও রুবিনার পরিবার।
কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই বিয়েটা নির্বিঘ্নে সেরে গেল। বিয়ে পড়ানোর পর নিজের ঘরে বসে সবকিছুকে স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছিল রুবিনার। সন্ধ্যা পেরোলেই তাকে বিদায় দিয়ে দেয়া হবে। সে ভেবেছিল শিমুলকে আদতে জীবনে পাবে না সে। শেষ পর্যন্ত তাদের বিয়েটা হয়ে যাবে এটা এখন পর্যন্ত তাঁর বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। আজকে খুব ব্যস্ত দিন কেটেছে চিত্রার। এখনো অতিথিদেরকে সেবাযত্নে ব্যস্ত রয়েছে সে। রুবিনা এক ফাঁকে চিত্রাকে কাছে ডেকে নিয়ে এসে কান্না করে ফেলল। চিত্রা কে জড়িয়ে ধরে বলল, ভাবি তুমি আমার জন্য যা করছ তা নিজের বোনের জন্যও কেউ করেনা। তোমার এই ঋণ আমি কোনদিনও শোধ করতে পারুম না।
ঋণের কথা কেন কইতাছো? তোমার সম্মান মানে তো আমার সম্মান। তোমার পরিবার আমার পরিবার।
তুমি বড় ভালো মানুষ গো ভাবি। তোমার মত মানুষ হয় না।
রুবিনা চিত্রাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। চিত্রার নিজেরও কান্না পেয়ে গেল। তথাপি চোখের জল মুছে সে ননদ কে বলল, তোমারে আজকে খুব সুন্দর লাগতাছে। লাল টুকটুকে বউ।
অনেক ধুমধাম কইরা বিয়া করনের শখ আছিল গো ভাবি। তাই বিয়েটা যে হইছে এটাই আমার কাছে অনেক। আমিতো ভাবছিলাম শেষপর্যন্ত বিয়েটা আর হইব না।
এগুলো আর কইও না। সাবধানে থাইকো। নিজের দিকে খেয়াল রাখবা। আর গোপন কথা যতটুকু সম্ভব গোপন রাখতে চেষ্টা করবা। কেউ যেন কোনদিন ওই কথা জানতে না পারে।
কেউ জানবোনা ভাবি। যে কথা আমার তোমারে কওন দরকার ছিল তুমি আমারে কইতাছো। তুমি যে একটা কত বড় ভাল মানুষ এটাই তার প্রমান।
হইছে হইছে। এখন চোখের জল মুছো। ভালোবাসার মানুষরে পাইছো। হাসিখুশি থাকো। সুখে জীবন গড়ো।
রুবিনা মুচকি হাসলো। সত্যিই আজ তার সুখের দিন। শেষ পর্যন্ত শিমুল কে আপন করে পেয়েছে। এই সুখ যেন তার জীবনে চিরস্থায়ী হয়ে আসে। চিত্রার বুকে মাথা রেখে পরম মমতায় সে বলল, তুমি আসলেই আমার বইন। আমার বড় বইন।
আজকের পর্ব বড় করে দিয়েছি। রমজানে অফিস, ঘুম ইত্যাদি টাইমিং খুবই এলোমেলো। তাই একদিন পর পর গল্প দেই।
প্রিয় শুভাকাঙ্ক্ষীরা নেক্সট না লিখে অবশ্যই সুন্দর একটি অনুভূতি প্রকাশ করে যাবেন মন্তব্যের ঘরে। আর ভুলত্রুটি ধরে দেবেন।
চলবে..