সিন্দুক রহস্য,পর্ব ২

0
270

#সিন্দুক রহস্য,পর্ব ২
#শেলী ভট্টাচার্য

থানায় ঢুকেই আমরা বাগচীকে তার চেয়ারেই দেখতে পেলাম। আমাদের দেখে ও বিনয়ে চেয়ার ছেড়ে ঝুঁকে উঠে দাঁড়াল। হাসিমুখে বললেন “আরে আসুন আসুন। বসুন।” বলে ডানহাতের ইশারায় টেবিলের উল্টোদিকের চেয়ারগুলো দেখিয়ে দিলেন। আমরা ওর মুখোমুখি টেবিলের এপাশের চেয়ার ঠেলে বসতেই, বাগচী হাঁক দিল এক কনস্টেবলকে। সে প্রায় আড়াই সেকেন্ডের মধ্যে এসে উপস্থিত হলে, তিন কাপ চায়ের অর্ডার দিল বাগচী। এরপর দু চারটে আলাপসূচক কথাবার্তার পরই ফেলুদা ভনিতা না করে সোজা ঘোষাল বাড়ির প্রসঙ্গ তুলল।

“এবার বলুন ঘোষাল বাড়ির ব্যাপারে …।”

“বিচিত্র পরিবার মশাই।”

“কীরকম?” কপালে কটা সামান্য ভাঁজ ফেলে, প্রশ্ন করল ফেলুদা।

“প্রসূন বাবুর ছোটো ছেলের বৌ গত হয়েছেন, বেশ ক’বছর হল। তারপর থেকে দুটো মা মরা বাচ্চাকে বড় বৌ সামলান। তাতে বাচ্চাদের বাবার কোনো কৃতজ্ঞতাবোধ নেই। উলটে দাদার নামে নালিশ জানান যে, দাদাই নাকি প্রসূন বাবুকে মেরে ফেলেছে। বৌদিও নাকি সাহায্য করেছে সেই কাজে। ওরা নাকি সব সম্পত্তি নিজের করতে চায়। এমনকি ওর দুই ছেলে মেয়েকেও বৌদি বশ করে রেখেছেন।”

“বশ করে রেখেছে মানে বশীকরণ? আই মিন ব্ল্যাক ম্যাজিক?”

“সেরকমই তো বলতে চাইলেন।
এদিকে দেখুন, সুমন বাবুর রমরমা বিসনেস। কোটিপতি মানুষ উনি। সুমন বাবু কেন সব সম্পত্তির জন্য এসব করতে যাবে বলুন তো?”

“সুমন বাবুউউউ …” ফেলুদার হাবভাব এমন যেন এই প্রথম শুনল নামটা।

“প্রসূন বাবুর বড় ছেলে। এই অঞ্চলের নামকরা প্রোমোটার।”

“আচ্ছা। তা কী কারণে খুন হতে পারে বলে রমেন বাবু ভাবছেন? না মানে খুনের তো কোনও স্ট্রং মোটিভ থাকবে।”

“হ্যাঁ, মূলত সেটা বলব বলেই আপনাকে আসতে বললাম। সে মোটিভ উদ্ধার করা আমাদের কম্ম নয়। ফরেন্সিকও ফেল পড়বে সে কাজে। আর তা হল প্রসূন বাবুর সিন্দুকের রহস্য উদ্ধার। যেটির মধ্যে নাকি প্রসূন বাবুর গবেষণার কিছু নথি আর কী একটা মূল্যবান সম্পদ ছিল।”

“ছিল মানে? এখন নেই নাকি?”

“আছে কি নেই, সেটা জানতে পারলে তো সমস্যাটা মিটেই যেত। রমেন বাবুর অভিযোগের একটা বিষয় অন্তত প্রমাণ হত। মানে ওর বক্তব্য বাবার সিন্দুকের জিনিস চুরি করে দাদা বাবাকে খুন করেছে।”

“পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কী বলছে? খুন নাকি নর্মাল ডেথ”

“তাতে তো বলছে শ্বাসনালী রুদ্ধ হয়ে শ্বাসকষ্টে মৃত্যু। আরে প্রসূন বাবু ক্রনিক অ্যাজমার পেশেন্ট ছিলেন। শেষের ক’দিন প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। সে কারণে বহুবার ডাক্তারও এসেছিলেন। চিকিৎসা চলছিল। ইনহেলারই ভরসা ছিল। এই বয়সে নর্মালই এভাবে শ্বাসকষ্টে ডেথ তো হতেই পারে। কিন্তু রমেন বাবুর ব্যাখ্যায়, বাবার দরকারের সময় তার হাতের কাছ থেকে ইনহেলারটিকে সরিয়ে নিয়েছিল দাদা। কারণ ইনিহেলারটি প্রসূন বাবুর মৃত্যুর সময় থেকে আর পাওয়া যায়নি। সেই যুক্তিতে এটা একটা খুন। যার জন্য পোস্টমর্টেমও করতে হল। রমেন বাবুর বক্তব্য, প্রসূন বাবু নাকি বড় ছেলের চুরির কীর্তি দেখে ফেলেছিলেন। এসবই ওর কল্পনাপ্রসূত ব্যাপার।”

“সিন্দুকটা খুললেই তো সব ক্লিয়ার হয়ে যায়।”

“কিন্তু সে সিন্দুক তো কম্বিনেশনে লকড। সে কম্বিনেশন আবার ২৬ টা অ্যালফাবেটের মধ্যের কিছু নিয়ে। যেটা একমাত্র প্রসূন বাবুই জানতেন। ব্যাপারটা শুনেই প্রসূন বাবুকে আমার ভয়ানক জটিল মানুষ বলে মনে হয়েছিল।”

“জটিল না হয়ে বুদ্ধিমান বলেও তো মনে হতে পারে।” একপেশে হাসি দিয়ে বলল ফেলুদা।

“যাই বলুন মশাই, অতো বুদ্ধির প্যাঁচ খেলাটা ঠিক নয়। জীবনে জটিলতা বাড়িয়ে লাভ হয় কি কোনও?” বাগচীর সাদামাটা বুদ্ধির মন্তব্য।

ফেলুদা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল
“প্রসূন বাবুর যেদিন মৃত্যু হয়েছিল, সেদিন রাতে যে সিন্দুকটা খোলা হয়েছিল, তার প্রমাণ আছে কি?”

“সেদিন রাতে নাকি সঞ্জীব মানে প্রসূন বাবুর বড় মেয়ের ছেলে অনেক রাতের দিকে ও ঘরে আলো জ্বলতে দেখেছিল। ওর বড় মামা মানে সুমন বাবুকে ওই ঘরে যেতেও দেখেছিল। ওর মুখে সেসব শুনেই রমেন বাবুর এসব ধারণা হয়েছিল। সুমন বাবু যতই বলছেন, বাবার শরীর ভালো ছিল না তাই দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওই যে যাকে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা। বড্ড ঘাড় ত্যাড়া মানুষ মশাই রমেন বাবু।
এদিকে সুমন বাবুর নামে এসব রটলে, কে আর বিশ্বাস করে ওর বানানো ফ্ল্যাট কিনবে বলুন তো? যে মানুষটা ঘরের একান্ত নিজের মানুষকে খুন করতে পারে, তার বানানো ঘরের মজবুতি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না?”

কনস্টেবল চা দিয়ে যাওয়ায় বাগচীর একনাগাড়ে বলা কথায় ছেদ পড়ল। বাগচী চায়ের কাপ ডিসগুলোকে এগিয়ে দিলেন আমাদের দিকে।

ফেলুদাকে দেখলাম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর জিজ্ঞেস করল “তাহলে মূলত ভাগিনার কথার ভিত্তিতেই রমেন বাবু অভিযোগ করেছেন? উনি নিজে কিছু দেখেন নি?” চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল ফেলুদা।

“উনি থাকলে তো দেখবেন। সেই রাতে উনি ব্যবসার কাজে বাইরে ছিলেন। সকালে ফিরেছিলেন। তাই বলছেন যে, ওর অনুপস্থিতিটাকেই দাদা কাজে লাগিয়েছিল।”

“হুম, বুঝলাম। আচ্ছা, মৃত্যুর সময় কখন?”

“রিপোর্ট অনুযায়ী ভোর পাঁচটা ছটা হবে।”

“তো এখন মেইন মোটো হল, সিন্দুকের কম্বিনেশনটা বের করা। তাই তো?”

“একদম ঠিক।” আনুগত্যের সুরে বলল বাগচী।

“কোনও হিন্স?”

মাথা দুদিকে নাড়িয়ে ঠোঁট উলটে নেতিবাচক উত্তর দিল বাগচী।

“ফরেন্সিক কী বলছে? কোনও ফিঙ্গারপ্রিন্ট?”

“প্রসূন বাবুর ঘরের খাট, আলমারি, আলনা এমনকি সিন্দুকের উপরও একাধিক বাড়ির লোকের ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে। এগুলো সব ঘরের জিনিসপত্র, সেখানে তো ঘরের লোকের ছোঁয়া থাকবেই। সেটা খুব সাধারণ ব্যাপার নয় কি?”

“বেশ। এবার বলুন আমি ও বাড়িতে কীভাবে ঢুকব। মানে কী পরিচয়ে? কেননা ও বাড়িতে না ঢুকলে তো সিন্দুকটা দেখা বা বাড়ির হালহকিকত বোঝাটা মুশকিল হবে।”

এমন সময় বাগচী “একটু বসুন, আসছি” বলে হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। আর বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

ওর বাকরুদ্ধ দৃষ্টিকে অনুসরণ করে আমরাও চাইলাম ওর পদসঞ্চারের দিকে। দেখি একজন মধ্য বয়স্ক মাঝারি উচ্চতার মানুষ ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে এক কনস্টেবলের সঙ্গে কথা বলছেন।
বাগচী তৎপর হয়ে লোকটাকে বলল “আপনি আবার থানায় এসেছেন রমেন বাবু?” শেষে নামটা যেন কতকটা আমাদের শোনানোর জন্যই জোরে উচ্চারিত হল। আমি আর ফেলুদা এবার ভালোভাবে দেখলাম লোকটাকে। চোখেমুখে সাধারণ চাউনি। মাথার চুলে উষ্কখুষ্ক ভাব।

“না এসে কী করব? আপনাকে দুদিন ধরে কতবার ফোন করলাম, তুললেন কোথায়?” রমেন বাবু অভিযোগের সুরে বললেন। বাগচী আমাদের আড়াল করে কতকটা ঢোক গিলে বললেন “আমার হাজারো কাজ থাকে। কখন কোথায় ব্যস্ত থাকি। সবসময় ঘরের ফোনই তুলতে পারি না। আর আপনি এতো অস্থির হচ্ছেন কেন? বলছি তো তদন্ত চলছে। তেমন কোনও দরকার হলে আপনাকে ডেকে পাঠাব। এখন আসুন।”

আবছা শুনলাম কী একটা কথা বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে গেলেন রমেন বাবু।

বাগচী ফিরলে ফেলুদা উঠে দাঁড়িয়ে বলল “দেখি একটা পরিচয়ের কথা ভাবি। তারপর কাল না হয় ঘোষাল বাড়িতে ঢু মারব।”

এরপর আমরা থানা থেকে বাইরে বেরিয়ে কিছুটা যেতেই আমি কিছু বলার আগে ফেলুদা বলল
“বুঝলি তোপসে, ঘুষের একটা ঘুষঘুষে গন্ধ পাচ্ছি যেন।”

“সুমনবাবু বাগচীকে হাত করেছে তো?” আমার দিকে সাবাসিসূচক দৃষ্টি বুলিয়ে পিঠ চাপড়ে মুচকি হেসে বলল ফেলুদা “সাবাস তোপসে।”

“তাহলে বলছো সুমন বাবু খুন করেছেন?”

“তা নাও হতে পারে।”

“তাহলে ঘুষ দিতে যাবেন কেন?”

“হয়তো এলাকায় ওর সুনাম চলে যাচ্ছে, তাই। যেকোনও ব্যবসায়, বিশেষত এই ব্যবসায় গুড ইউলটা খুব দরকার হয়।”

কথা বলতে বলতে আমরা সবে রাস্তা পার হওয়ার জন্য এদিকওদিকের গাড়ির দিকে নজর বোলাচ্ছিলাম, ঠিক সেসময় আমাদের সামনে প্রায় ধূমকেতুর মতো এসে দাঁড়ালেন রমেন বাবু। আমাদের কিছু বলবার অবকাশ না দিয়েই রমেন বাবু অতর্কিতে বলে উঠলেন ” আপনি প্রদোষ মিত্র না? প্রাইভেট ডিডেক্টিভ প্রদোষ মিত্র।”

ফেলুদাকে দেখলাম কিছুক্ষণ অবিচলভাবে চুপ করে থেকে সেই একপেশে হাসিটা দিল। তারপর হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে পুনরায় নিজের পরিচয় দিল।
“প্রদোষ মিত্র, প্রাইভেট ডিটেক্টিভ।
এ আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট শ্রী তপেস রঞ্জন মিত্র।”

ফেলুদার কথার শেষে আমিও হাত জোড় করে নমস্কার জানালাম।

রমেন বাবুকে দেখে মনে হল যেন, না চাইতেই হাতে আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছেন। বসে যাওয়া চোখেমুখে ঈষৎ উজ্জ্বলতা এনে রমেন বাবু ফেলুদার উদ্দেশ্যে বললেন “থানার বাইরে কনস্টেবল বলল, এখন দেখা হবে না। একজন গোয়েন্দা এসেছে ভেতরে। আমি তাই তখন থেকে ওৎ পেতে এখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তা আমাদের কেসে নাকি?”

“সেরকম স্পেসিফিক কিছু নয়। ওই আর কী! এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম দুজনে, তাই ভাবলাম চারপাশে কী রহস্য রোমাঞ্চ ঘটছে, একটু জেনে যাই …” ফেলুদা সাবলীলভাবে কথা বলে অশ্বত্থামা হত ইতি গজ ইঙ্গিত দিল।

“আমার এই মুহূর্তে আপনাকে খুব দরকার। আপনার সাথে কিছু কথা হতে পারে কি?” রমেন বাবুর কথায় ফেলুদার পক্ষে ঘোষাল বাড়িতে ঢোকার একরকম পথ খুলে গেল।

(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here