হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে,১৬,১৭

0
470

উপন্যাস : হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে,১৬,১৭
কলমে: চন্দ্রা।
পর্ব:১৬

ক্ষণটা একদম ভর দুপুর যাকে বলে। সূর্যের পৃথিবী ঝলসানো তেজ।শহরের একটি পুরাতন ধরনের আবাসিক হোটেল এর সামনে এসে দাঁড়ালো অটোটা। ভেতর থেকে নেমে এলো অখিলেশ এবং নিরুপমা।অটোর ভাড়া মিটিয়ে সঙ্গিনীর হাত ধরে ব্যস্ত গতিতে গেটের ভেতরে প্রবেশ করলো সে। পরনের ঢিলে ঢলা হাফ হাতা চেক শার্ট আর মাথার এলোমেলো চুল দেখলেই যে কেউ বুঝে যাবে ছেলেটার মধ্যে আধুনিকতার ছোঁয়া অতি মাত্রায় কম। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে এমনভাবে যেনো ভারত বাংলাদেশের বর্ডার ক্রস করছে বিনা পাসপোর্টেই।এখনি হয়তো বিজিবি বা বি এস এফ এর গুলিতে প্রাণ যাবে তার।অপরদিকে সঙ্গিনীটি হেঁটে চলেছে একদমই শান্ত শিষ্ট নিরুত্তাপ ভঙ্গিমায়।পরনে জাম রঙা আটো-সাটো দামী থ্রিপিস।হালকা সোনালী চুল গুলোতে পরিপাটি ভাব।এক কথায় প্রাকৃতিক সুন্দরী সে কিন্তু খানিকটা উদাসীন হলেও শৌখিনতা আর আভিজাত্যের ছাপ বহন করছে প্রতিটি পদক্ষেপে।এভাবে কোনো পাবলিক হোটেলে মিট করা আজই প্রথম ওদের।এতে ঝামেলাও আছে অনেক।চেনা শোনা কেউ দেখলে কেলেঙ্কারির আর শেষ থাকবে না। অখিলেশ এদিক ওদিক ভীত চোখে তাকিয়ে হাঁটতে লাগলো। কিন্তু নিরুপমা নিরুত্তাপ।এমন ভাব যেনো, হাঁটতে হবে তাই হাঁটছে না হলে এক কদমও বাড়াতো না। কিন্তু আজ এই পরিবেশে দেখা করা এবং সময় কাটাতে সেই বাধ্য করেছে অখিলেশকে।না হলে অন্য সময়ের মতো অখিলেশের ম্যাচেই দেখা করতে পারতো। বন্ধুদের সাহায্যের হাত সবসময় বাড়ানোই থাকে ওদের দিকে।আজো হতো কিন্তু একজন রুমমেটের বাবা এসে উঠেছেন ডাক্তার দেখানোর উদ্দেশ্যে ।তিনি থাকবেন দু চার দিন। কিন্তু নিরু কোনো কথাই শুনতে চাইলো না সময় দিতে চাইলো না একটুও। ওর আজকেই দেখা করতে হবে বলে জেদ ধরলো।অখিলেশও হার মানলো কারন তারও নতুন কিছুর চাহিদা বেড়ে চলেছে দিনের পর দিন।নিরু কাছে থাকলে এখন শুধু হাতে হাত রেখে কাঁধে মাথা এলিয়ে ক্ষান্ত হয় না অখিলেশ তার আরো কিছু চাই,অনেক নিষিদ্ধ কিছু চাই যার লোভ নিরুপমা ই প্রথম পাইয়ে দিয়েছে তাকে।আসলে নিষিদ্ধ সবকিছুতেই মানুষের আগ্রহ বেশী থাকে কিন্তু অখিলেশ বা নিরু কখনোই সেটা নিষিদ্ধ হিসেবে মনে করে না।তারা বিশ্বাস করে, ভালো লাগা, ভালোবাসা তখনই প্রেমে পরিণত হয় যখন দুটি মানব মানবীর সেচ্ছায় মন,আত্মা এবং দেহ এই তিনটি জিনিসের মিলন ঘটে।এর যে কোন একটা জিনিসের মিলন না হলে তাকে পরিপূর্ণ প্রেম বলা হয় না।সেটা ভালো লাগা বা ভালোবাসা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে।
রিসিপশনের কার্য সম্পাদন করে চাবি নিয়ে উপরে উঠে এলো দুজনে। চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলো অখিলেশ,,যা ভেবেছিলো তা নয়,হাইফাই লেভেলের বিলাস বহুল হোটেল না হলেও এখানকার পরিবেশ অনেক ভালো।গ্যাঞ্জাম,হাউকাউ একদমই নেই।মনে মনে বন্ধুকে একবার ধন্যবাদ দিলো।সেই একবেলার জন্য ব্যাবস্থা করে দিয়েছে। নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে ঢুকে দরজা এটে দিলো অখিলেশ।ফ্যান চলছে কিন্তু হেঁটে আসায় ঘেমে নেয়ে একাকার সে। এসি নেই রুমে।বুকের উপরের দু’টো বোতাম খুলে মুখ দিয়ে ফু দিলো অখিলেশ।নিরু ততক্ষনে জানালার রেলিংয়ে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে।অখিলেশের স্মরণ হলো অন্য দিনের নিরুপমা আর আজকের নিরুপমার মধ্যে বিস্তর ফারাক। ভীষণ উচ্ছলতার জায়গা দখল করে আছে নিদারুণ নিরবতা।

কি হলো নিরু হয়েছে কি তোমার?নিজে দেখা করার জন্য পাগল হয়ে নিজেই আনমনা হয়ে আছো?
নিরু নিরুত্তর। অখিলেশ এগিয়ে গিয়ে কাঁধে হাত রাখতেই নিরু সর্ব শক্তি দিয়ে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিলো ।হঠাত এমন ধাক্কা সামলাতে দুই পা পিছিয়ে গেলো অখিলেশ। স্নেহের পরশ দিলো পিঠে।নিরুর ব্রহ্মতালুতে একটি চুমু খেয়ে তুথনী ঠেকিয়ে শুধোলো কোমল স্বরে,,কি হয়েছে আমার নিরু সোনার?
মনটা কি খুবই খারাপ?বাবা বলেছে কিছু আবারো?
বুকের পরেই দুদিকে মাথা নাড়ে নিরু। মুচকি হেসে পুনরায় বলে অখিলেশ,,

তাহলে এমন চুপচাপ ক্যানো হ্যা?

অখিল আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি মানোতো?

মানে কি নিরু?আমি কি তোমাকে ভালোবাসি না?
নিরু মাথা উঠিয়ে অখিলেশের খোলা বুকে ঠোঁট ছোঁয়ায় পরম আবেশে।
আর কোন বাক্য ব্যয় করে না দু’জনে।নিরুর মুখটা দুহাতের আজঁলাতে তুলে নিয়ে তাকায় ওর পদ্মদিঘীর সচ্ছ জলের মতো চোখের গহীনে।কিছু একটার অভাব অনুভব করে অখিলেশ সেখানে। কিন্তু কি সেটা বুঝতে পারে না। নিরুকে জিজ্ঞেস করেও উত্তর মেলে না।ধীরে ধীরে ঘোলাটে হয় অখিলেশের চোখের কুচকুচে কালো মনি দুটি।নিরুর লিপিষ্টিক হীন হালকা গোলাপী আভা যুক্ত ঠোঁটে নিজের অধর ডুবিয়ে দেয়। তারপর দীর্ঘ চুম্বন।তার পর আরো গভীরে,আরো গহীনে। অবশেষে কষ্টসাধ্য পথ অতিক্রম প্রবেশ করে করে নাম না জানা এক সুখের দেশে।

এই অখিল তুই এখানে?আমি তোকে খুঁজে খুঁজে হয়রান।চল চল নিচে ষষ্টী চলছে।

নির্দয় ভাবে পনেরো মিনিটে ছয়টি সিগারেটের দেহ জ্বালিয়েছে অখিলেশ। কিন্তু কই তার অন্তরের দহন তো একটুও শিথিল হয়নি।মন থেকে একবারও মুছে যায়নি ঐ বড়লোকের বাপের বাধ্য গত মেয়েটির কথা। চোখের কার্নিশে জমে থাকা তরল পদার্থ টুকু বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা মুছে নেয় সন্তর্পনে।
বিরূপাক্ষের ডাকেই স্মৃতির ঝাঁপি বন্ধ হয় অখিলেশের।মাইকের মিডিয়াম ভলিউমে পুরোহিত ঠাকুরের স্পষ্ট মন্ত্রাচ্চোরণ ভেসে আসছে।
কি হলো ভাই চল না।দেখ তো ক্যামন ভিজে গিয়েছিস ?এখনো কার্তিক মাসের শুরু হয়নি তাতেই শিশিরের এই ঝরো ঝরো দশা, অগ্রহায়ণ,পৌষে কি হবে কে জানে?একা একাই কথাগুলো বলে গেলো বিরূপাক্ষ।অখিলেশের অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো মন্দিরে তারপর হ্যাচকা টানে বসিয়ে দিলো নিজের পাশে।ষষ্ঠীতে তেমন কেউ উপোস রাখে না তাই উপোবাসীর সংখ্যা নিতান্তই কম। অবশেষে পূজার সমাপ্তি ঘটে সেদিনের মতো।

রাত দশটা নাগাদ পূজা শেষে অনেকেই যে যার বাড়ির দিকে চলে গিয়েছে।রয়েও গেছে অনেকে। মন্দিরে এখন গান চলছে উচ্চ স্বরে।ঢাকের স্বর চাপা পরছে মাইক এবং সাউন্ড বক্সের বিকট শব্দে।ব্যান্ড পার্টির যে দুটো দল এসেছে তারা এখন নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাচ্ছে মন্দিরের পেছনে বৃহৎ হলঘড়ের ছোট্ট রুমটাতে। চারিদিকে ইট সিমেন্টের দেওয়াল আবৃত এ্যাডভেস্টার টিন সেডের বিশাল লম্বা হলঘড়।যেখানে পূজায় দর্শনার্থীদের প্রসাদ সেবনের ব্যবস্থা করা হয়।থরে থরে সাজানো কাঠের তৈরি চেয়ার টেবিল।সেই ঘড়ের এক পাশে দেয়াল উঠিয়ে রুমের মতো করা হয়েছে । পূজায় ঢাক বাজানো ঢাকী এবং অন্যান্য বাজনদারের শোয়ার ব্যবস্থা করা হয় এখানেই।অন্দরমহলে সবাইকে নেওয়া হয় না।

পূজা শেষে বাড়ির পুরুষেরা খেতে বসেছে ডাইনিংয়ে‌।রিতি সারাদিনে জল ছাড়া কিছুই খায়নি মাথাটা ঘুড়ছে, দুর্বলতা আছে কিছুটা।মুখটা শুকিয়ে গেছে একদিনের অনাহারে। অন্নপূর্ণা দেবী বুঝলেন সবটা সরলা,কাজলকে তাড়া লাগালেন সবাইকে খাবার দিতে আর নিজে ডাইনিংয়ের অদূরে মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে খেতে দিলেন রিতি সহ বাড়ির সকল মেয়েদের।রিতি এমন জায়গায় বসেছে বিরূপাক্ষ স্পষ্ট দেখছে তার পাতের দিকে।অল্পদুটো ভাত একটু আলু ভাজি আর সামান্য ডাল নিয়ে খেয়ে উঠলো রিতি। অন্নপূর্ণা দেবী বা জয়া হাজার অনুরোধ কিংবা শাসিয়ে ও আর একটা দানা মুখে দেওয়াতে পারলো না।

এতটুকু খেয়ে বাঁচে কিভাবে মেয়েটা?সাধে কি আর অমন তাল পাতার সিপাহি হয়েছে?মনে মনে ভাবলো বিরূপাক্ষ।অখিলেশ হালকা করে কনুই মারলো বিরূপাক্ষের গায়ে। হকচকিয়ে খাওয়ায় মনযোগ দিলো বিরূপাক্ষ। একসাথে সব পদ মেখে খেয়ে সেও উঠে গেলো সবার আগে।এমন জগাখিচুড়ি খাওয়া দেখে ভিমরী খাওয়ার অবস্থা অখিলেশ ও রঘুনাথের। বিরূপাক্ষ সবটা মিলিয়ে একসাথে খেলো বিশ্বাসই হলো না তাদের। নিশ্চয়ই ওর ঘাড়ে কোনো ভূত ভর করেছে, নির্ঘাত মেয়ে ভূত!মনে মনে কথাগুলো ভেবে একচোট হাসলো রঘুনাথ ।

অনেক রাত,দরজা খুলে নিজের শয়নগৃহে প্রবেশ করলো বিরূপাক্ষ। ডিনার সেরে অখিলেশ এর সাথে যখন একটু হাঁটতে গিয়েছিলো বাইরে তখন দেখেছিলো মন্দির প্রাঙ্গণে কয়েকটা চেয়ার বৃত্তাকারে সাজিয়ে গল্পে,হাসি ঠাট্টায় মেতেছিলো তিতলি,অহনা, রাহুল এবং রিতি পরে অবশ্য যোগ দিয়েছিলো জয়া।আড়চোখে দেখেছিলো বিরূপাক্ষ রিতির ক্লান্তিতে ঢুলু ঢুলু চোখ দুটো।মনে মনে বিরক্ত হয়ে বলেছিলো,গল্প খোরের শিরোমণি হয়েছে একটা। সারাদিনের অভুক্ত এখন গিয়ে ঘুমাবে তা না গল্প করছে। গল্প করার উপযুক্ত লোক পেলে কি আর শরীরের চিন্তা থাকে?
এখনো গল্প চলছে সেখানে কিন্তু রিতিকে অনুপস্থিত দেখে দ্রত পদে ঘড়ে ফিরেছে সে।মা ভেবেছিলো তাই হয়েছে।মেঝেতে গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে রিতি। পরনের সেই সাজ সজ্জা আর নেই। সাধারণ একটা সুতির শাড়ি পরেছে তাতেই যেনো অপরুপ লাগছে।
শাড়িটা সামান্য উপরে উঠে ফর্সা সুগঠিত পায়ের গোড়ালির খানিকটা দেখা যাচ্ছে। বিরূপাক্ষ ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে হাঁটু ভেঙ্গে বসে পরে রিতির হালকা ঘুচিয়ে রাখা পায়ের কাছে।রিতির পায়ের কাছে নিজের একটা হাত নামিয়ে এনে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে একদৃষ্টে।অনেকটা ব্যাবধান দুজনের গায়ের রঙে।মৃদু হাসি ফুটিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে বিরূপাক্ষ,,আমি ভূল বলেছিলাম বুড়ি।তুই আমার থেকে অনেক ফর্সা।তুই নোস আমিই কালো রে।অপলক চেয়ে থাকে রিতির ঘুমন্ত মুখের দিকে।তিরতির করে কাঁপছে চোখের পাতা দুটো।গভীর ঘুমের ভারী নিঃশ্বাসের সাথে নাকের পাটা দুটো উঠছে নামছে।এক অপরিসীম মুগ্ধতায় ভরে যায় বিরূপাক্ষের সমগ্র হৃদয়।সেই অমোঘ মুগ্ধতার রেশ কাটে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা ফোনে ম্যাসেজ আসার টুং টুং শব্দে।ঘোর কাটে বিরূপাক্ষের।দোনা মোনা করে ফোনে হাত রাখে।তখনো ডিস্পেলেতে আলোটা জলছে।বিরূপাক্ষের চোখ জ্বালা করে ওঠে ফোনের উপর ইংরেজি অক্ষরে রাহুল নামটা দেখে।অন্যের ফোন তার অনুমতি ব্যতিত ঘাটা অপরাধ জেনেও নিজের আঙুল ছোঁয়ায়।না বিশেষ কোন লক দেওয়া নেই।ওকে করতেই রাহুলের পাঠানো মেসেজটা ভেসে আসে।
সে লিখেছে,,”আমার পছন্দের তারিফ করতে ভুলোনা যেনো,শাড়িটাতে দারুন মানিয়েছে কিন্তু।আমি ধন্য যে তুমি ঐ শাড়িটাই পূজার প্রথম দিনে পরলে”
লেখার শেষে একটা লাভ ইমুজি দেওয়া।
বিরূপাক্ষের ভেতর প্রলয় বয়ে যায়।স্ক্রল করতে থাকে নিচ থেকে উপর।কত এস এম এস তার হিসাব নেই।রিতির প্রত্যেকটা লেখাতে রাহুলকে বাংলাদেশে আসার জন্য অনুরোধ।আর পড়তে পারে না বিরূপাক্ষ। হাতের মুঠোয় ফোনটা যেনো মিশিয়ে দিতে চাইছে ভেঙেচুরে। কিন্তু তাতে শুধু জড়বস্তুটার উপর অন্যায় অবিচার করা হবে আর কিছুই নয়।হাত থেকে ফোনটা রেখে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে যায় ঘড় থেকে।এমন রাগের মানে সে বের করতে পারে না।রিতি কাউকে চাইলে তাতে ওর কি?
দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় চিলেকোঠার ছাদের দিকে। সেখানে শুয়ে তাঁরা গুনবে এলোমেলো ভাবে কিন্তু শেষ হবে না সেই গননা।আজ গা ভেজাবে শিশিরের জলে।দেহটা একসময় শীতলতায় ভরে উঠবে কিন্তু মনের মধ্যে যে অচেনা অজানা দহন জ্বালা তার কিঞ্চিত পরিমাণ কি খর্ব হবে?

চলবে,,,,
ভুল ত্রুটি মার্জনীয় ।
ভালো থাকবেন সবাই।

উপন্যাস: হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে।

কলমে: চন্দ্রা।

পর্ব:১৭

****
প্রভাতী সুরে সানাই বাজছে মন্দির চত্বরে।সেই সুর মূর্ছনা ছড়িয়ে পরছে রায় চৌধুরী মহলের আনাচে কানাচে। বাইরের সুর যতই শ্রুতিমধুর হয়ে মানুষের কর্ণকুহরে প্রবেশ করুক না ক্যানো,ভেতরে যাওয়ার পর সেই সুরের আন্দোলনে সবার মন কি আন্দোলিত হতে পারে?হয়তো পারে হয়তোবা পারে না। ঘুন পোকার কাঠ খাওয়া দেখেছেন কেউ?পোকা গুলো আস্তে আস্তে ছিদ্র করে কাঠের পুরো শরীরটিকে খেয়ে ফেলে কিন্তু কাঠ ততদিন ঘড়েটিকে সাপোর্ট দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে যতদিন না সে ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। তেমনি এমন অনেক মানুষ আছে,যাদের ভেতরটা যতই ঘুন পোকার মতো অদৃশ্য পোকাড়া খেয়ে নিক না ক্যানো বাইরে তারা সদাই হাসি খুশি থাকে নিজের ভেতরের ক্ষয়ে যাওয়াটা না কাউকে দেখতে দেয় আর না কাউকে বুঝতে দেয়।রিতি এমন একটি মেয়ে যার ভেতরটা যতই মলিন,বাহিরটা ততই উজ্জ্বল। নিজের মতো আরেকজন কে পেয়েছে কালরাতে এ বাড়িতে।তিনি জয়া বৌদিদি। এতদিনে একবারের জন্যও মনে হয়নি জয়ার ঐ হাসি খুশি মুখটা শুধুমাত্র মুখোশ একটা।
গতকাল রাতে,,,
সারাদিনের দূর্বলতায় রিতির ঘুম তো এসে গিয়েছিল বালিশে মাথা ঠেকানোর সাথেই।কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো অনেক রাতে।খুব শীত অনুভূত হওয়ায় ঘুম থেকে জেগে যায় সে।ঘড়ের আলোটা জ্বলছিলো পূর্ণ তেজে। বিছানায় বিরূপাক্ষ কে না পেয়ে অবাকই হলো,কারণ আর যাই হোক সারারাত নির্ঘুম কাটানোর অভ্যেস বিরূপাক্ষের নেই।ঘড়িতে রাত আড়াইটা তখন।রিতি ধীরপদে বেড়িয়ে আসে ঘড় থেকে কোথায় গেলো মানুষটা?ঘুম উড়ে গিয়েছে আগেই।দাদাভাইয়ের শয়নকক্ষের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কানে ভেসে এলো আবছা ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ। কৌতুহল বশত পা দুটো থেমেই যায়,একটাই জিজ্ঞাসা মনে,,এত রাতে কে কাঁদছে বৌদিদির ঘড়ে?আর বৌদিদি ক্যানো কাঁদবে?
হঠাৎ করেই রঘুনাথের আওয়াজ আসে।টুকরো টুকরো কিছু কথা কানে ভেসে আসতেই বৌদিদির কান্নার মর্মার্থ বুঝতে একটুও দেরী হয়না রিতির। রঘুনাথ চাপা স্বরে তার স্ত্রীকে মানানোর চেষ্টা করছে।শিড়দারা বেয়ে এক উষ্ণ স্রোত বয়ে যায় রিতির‌।মাথাটা যেনো ফাঁকা হয়ে আসে।তার দাদাভাই কিছুতেই এমন কাজ করতে পারে না।কিছুতেই না।
বর্তমানে,,
আনমনে মাথায় চিরুনির আচর দিয়ে চলেছে রিতি।আরশিতে তাকিয়ে দেখলো, তার মধ্যে বিরূপাক্ষের ঘুমহীন ক্লান্ত দেহখানি।কাল সন্ধ্যের পোশাকটাই পরে আছে।অমন পরিপাটি মানুষটার আলু থালু চেহারা দেখে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো রিতির।এক ফাঁকে দুজনের চোখাচোখি হলো একবার।রিতি ফিরে তাকায় বিরূপাক্ষের পানে।তখনো একবার চার চোখের মিলন ঘটলো।রিতি স্পষ্ট দেখতে পেলো তার নিজের পায়ে পরা আলতার রঙ আর বিরূপাক্ষের চোখ দুটোতে কোন তফাৎ নেই।উঠতে উঠতে বললো,, তুমি হাত, মুখে জল দাও আমি কফিটা নিয়ে আসি।তুমি যদি এভাবে রাত বিরেতে বিনুদার তেল চিটচিটে বিছানায় ঘুমাতে যাও লোকে দেখলে ভালো বলবে বলো?আমি এ ঘড়ে থাকলে যদি খুব সমস্যা হয় তো আমাকে সরাসরি বলে দেবে আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেবো।
সোফায় বসে পরেছে বিরূপাক্ষ।রিতির কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না তার মধ্যে।শুধু বললো নির্লিপ্ত ভাবে,,
আমি খামার বাড়িতে ঘুমিয়েছি তোকে কে বললো?

গভীর ঘুমে যখন ছিলাম তখন স্বপ্ন দেখলাম যে।রসিকতা করে রিতি।
বিরূপাক্ষের গা জ্বলে ওঠে।রিতির সাথে কথাই বলতে ইচ্ছে করছে না তার।
আচ্ছা এবার ওঠো তো।ফ্রেশ হয়ে নাও আমি কফি আনছি।খেয়ে ঘুম দাও।সারারাতে তো মশাদের কীর্তন শুনলে।

এত ভাবতে কে বলেছে তোকে?আমার জন্য কিছু করতে হবে না তোর।আমি নিজেরটা নিজে বুঝে নেবো।যা এখান থেকে।
রিতি এতক্ষণ নিজেকে যে উচ্ছলতার খোলশে মুড়িয়ে নিয়েছিল সেটা খসে পরে বিরূপাক্ষের কাঠখোট্টা ঝাঁঝালো জবাবে।

রাহুল শুধু মাত্র আমার বন্ধু সেটা তোমাকে আগেও বলেছি এখনও বলছি।আর অন্যের ফোন ঘাঁটা ঘাঁটি করা কি ঠিক বলো রূপদা?থমথমে গলা রিতির।

বিরূপাক্ষ চরম অবাক হলো রিতির এমন বুদ্ধিমত্তা দেখে।কানে খট করে লাগলো রিতির বলা রূপদা কথাটা।আবার ধরা পরার লজ্জায় অস্বস্তি ও হলো খানিকটা।রিতি আর কিছু না বলেই বেড়িয়ে এলো ঘর থেকে। আজকাল বড্ডবেশী ন্যাকা হয়েছে সে।একটু কটু কথা শুনলেই চোখে জল আসে। ভীষণ অসহ্য লাগে নিজেকে নিজের কাছে।

রিতি যেতেই বিছানায় চোখ পরেছে বিরূপাক্ষের চন্দন রঙের পাঞ্জাবিটার সাথে খয়েরি রঙের হালকা সোনালী রঙ পাড়ের কোঁচান ধুতি। বিরূপাক্ষ হাতে তুলে দেখলো ও দুটোকে।একটা ভাঁজ খুলতেই একটা ছোট্ট চিরকুট উড়ে পরে।মনোযোগ সহকারে দেখলো লেখাটা। মেয়েলি ধাঁচের স্পষ্ট গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,,অতীব ক্ষুদ্র মানুষের সামান্য প্রণামী।গ্রহন করো প্লিজ।

কফির মগ সমেত খাটি গাওয়া ঘিয়ে ভাজা পরোটা আর কয়েকটা সবজির মিশ্রনের ভাজি ট্রেতে করছ ঘড়ে ঢুকলো তিতলি। চিরকুটের হাতের লেখা আর পাঞ্জাবির সৌন্দর্যে ঠোঁটের কোনে স্মিত হাসি হয়তো ফুটে উঠছিল কিন্তু সেই হাসি প্রদীপটা নিভতে বেশি দেরী হলো না যখন দেখলো রিতি নয় তিতলি ওর জন্য ব্রেকফাস্ট এনেছে।
একহাতের মুঠিতে পাঞ্জাবির অন্য হাতের মুঠোয় ধুতি খানি হয়তো দুমড়ে মুচড়ে ফেলতো কিন্তু অতটা হাতের ভেতর ধরলে তো।আধা কোঁকড়ানো ধুতি পাঞ্জাবি সবেগে বিছানায় ফেলে দাঁড়ায় তিতলির দিকে ফিরে।ট্রেতে পরোটা দেখে মেজাজের দফারফা প্রায় শেষ পর্যায়ে তখনি তিতলি বললো হাসি মুখে,,

মুখটা এমন বেজার করে রেখেছিস ক্যানো রে?

এই ব্রেকফাস্ট কে পাঠালো?সকাল বেলা আমি এইসব ঘি,তেলে ভাজা কিছু খাইনা জানিস না তুই? স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করে বিরূপাক্ষ।
আমি তো জানি। কিন্তু মাসিমা যে বললো,তুই নাকি নিজেদের ঘড়ে তৈরি ঘিয়ে ভাজা পরোটা পছন্দ করিস?তাছাড়া রাহুলবাবু বললেন আজ সবার জন্য পরোটা করতে।

তো যা না গিয়ে মাকে বল রাহুল বাবুকে খাওয়াতে এসব অয়েলি খাবার আমি খাবো না। রাহুলের নাম উঠতেই অধৈর্য হয়ে পড়ে বিরূপাক্ষ।তিতলি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে।

তাহলে কফিটা নে।ওটা তো আর অয়েলি নয়।মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে তিতলি।

বিরূপাক্ষ চরম অসন্তোষ জনক কাজ করে বসে,কফির মগটা ধরে উপুড় করে ঢেলে দেয় পরোটার উপরে তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলে,,নে এবার গিয়ে খাওয়া গে তোদের রাহুল বাবুকে। গলা দিয়ে নামবে ভালো।আমার জন্য আলগা দরদ কেউ দেখাতে আসবিই না বলে দিলাম।
অপমানে মুখটা থমথমে হয়ে ওঠে তিতলির তথাপি সে গায়ে মাখে না।বিরূপাক্ষের কাছে থেকে প্রাপ্ত অপমান,কষ্টও যে সুখের।
তিতলির চোখের কোণে চিকচিকে জল দেখে হঠাৎ করেই যেনো ছেলেমানুষীর ঘোর কাটে বিরূপাক্ষের। নিজের ক্রোধের আগুনে মেয়েটাকে শুধু শুধু জ্বালিয়ে ফেললো,
তিতলির হাত থেকে ট্রে টা বিছানায় নামিয়ে রাখে।দুহাতের তালুর মধ্যে তিতলির গোলগাল মুখটা তুলে নিয়ে বলে নরম সুরে,,

সরি রে দোস্ত।অন্যের রাগ আমি তোর পরে ঝেরে ফেলেছি।আসলে আমার মাথাটা ঠিক লাগছে না। তুই দেখে নিস আর কটা দিন এখানে এইভাবে থাকলে নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবো।আবেগ উথলে ওঠে তিতলির।সেও নিজের দুহাতে বিরূপাক্ষের দুই গালে রাখে,,
কিচ্ছু হবে না তোর।আমি আছি না?এমন আচরন তোর স্বভাবের সাথে মোটেও মেলাতে পারছি না।ক্যানো করছিস এমন? নিজেকে স্থির কর।দু নৌকায় পা দিয়ে বেশিদূর চলা যায় না রে।যা করার ভেবে চিন্তে কর নইলে যে পস্তাবি। নিজের মাথাটা বিরূপাক্ষের বুকে এলিয়ে দিয়ে চোখের জল ছেড়ে দেয় তিতলি।বিরূপাক্ষের চোখের কার্নিশে জল জমেছে কিন্তু পুরুষ মানুষের যে কাঁদতে মানা।ভেতরে দুজন সমব্যাথি নিজেদের সান্তনা দিতে এতটাই নিমগ্ন ছিলো, কেউ উপলব্ধি ও করতে পারলো না ঘড়ের বাহিরেও সান্তনাহীন বিরোহী চোখে বাঁধ ভাঙা প্লাবন,এক তাপিত প্রাণের নামহীন রক্ত ক্ষরণ।

****
সে বেশ কয়েক বছর আগের কথা।বিরূপাক্ষের প্রবাসে জীবন যাপনের তিন মাস গত হয়েছে তখন। আগস্টের মধ্যভাগ।প্রায় প্রত্যেক দিনই কম বেশী বৃষ্টিপাত হচ্ছিলো।সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পরে তুমুল বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে নিজের গন্তব্যে পৌঁছোলো বিরূপাক্ষ। ওখানকার একটা কোম্পানিতে পার্ট টাইম জব জুটিয়ে নিয়েছিল তিন মাসের মধ্যেই।সেই সুবাদে চেনা পরিচিত দুটি ছেলের সাথে একটা পাঁচতলা আবাসিক ভবনের তিনতলার দুই কক্ষের বাসায় শেয়ারে ভাড়া থাকতো বিরূপাক্ষ।কি একটা কারনে সকাল থেকে লিফ্ট বন্ধ ছিলো।শীতে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে যখন নিজেদের রুমের সামনে দাঁড়ালো বিরূপাক্ষ তখন অতি বিস্ময়ে শীত ভস্মীভূত হয়েছে।বড়ো সাইজের ট্রলি ব্যাগ নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে তিতলি।সেও খানিকটা ভীতসন্ত্রস্ত। অচেনা অজানা জায়গায় একা একটা মেয়ে ভয় পাওয়াটাই যে স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু ভালোবাসা যার মনের গভীরে খুঁটি গেড়ে বসে তার কাছে বাইরের ভয়টা কি মুখ্য?হতেও পারে কিন্তু তিতলির বিরূপাক্ষকে দেখার জন্য যে তৃষ্ণা জন্মেছিলো সে তৃষ্ণার কাছে বিদেশ বিভূঁইয়ে জায়গায় বিপদাপদ এর সম্মুখীন হওয়া ছিলো নস্যি মাত্র।

*****
মাইকের মাইক্রোফোনে কেউ একজন বার বার এনাউন্সমেন্ট করছে,প্রিয় ভক্ত বৃন্দ আপনারা যে যেখানে থাকুন না ক্যানো অতি সত্বর মায়ের মন্দিরে এসে হাজির হন। মায়ের শুভ সপ্তমী এখনি আরম্ভ হবে। কিন্তু হঠাৎ করেই একটু গোলমাল কানে গেলো তন্দ্রাচ্ছন্ন বিরূপাক্ষের।দ্রুত গতিতে উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলো, নিহার আঙ্কেলের মেয়ে অহনা এবং অভি দুজনেই কথা কাটাকাটি করছে।পাশে বাড়ির অন্য সবাই।অত লোকের গুঞ্জনে নিচের কথাগুলো উপর পর্যন্ত এলো না। বিরূপাক্ষ ছুটে গেলো নিচে।গিয়ে ওদের তর্ক বিতর্কের সারাংশ যা শুনলো তা হলো,,অহনা মন্দিরে উঠতে গিয়েছিলো কিন্তু অভি উঠতে দেয়নি কারন অহনা নাকি মেলার মাঠ থেকে ডিমের চপ খেয়ে এসেছে।আর আমিষ ভোজীদের এই মুহূর্তে মন্দিরে উঠা বারণ।
কিন্তু অহনা অস্বীকার করছে অভির কথা।নিহার রঞ্জন, রাহুল এবং রোহিনী দেবী বুঝাচ্ছে অহনাকে কিন্তু অহনা মন্দিরে উঠবেই।
প্রভাকর রায় চৌধুরী সেখান থেকে সরে পরলেন কারণ নিজের বন্ধু কন্যাটির চালচলন তার পছন্দ নয় এমনিতেই।

অফিস রুমে নিজের চেয়ারে বসে আছে রিতি।একটা বিশেষ নিয়ম প্রচলিত আছে প্রায় প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানে।মালিক যতই স্নেহপরায়ণ হোন না ক্যানো ছুটি কাটানোর সময় হুট করে অফিসে দেখা দিলে কর্মীদের মধ্যে একটা ত্রাস কাজ করে।তেমনি দশা হয়েছে রিতির বুটিক হাউসে।এই কর্মক্ষেত্রে যারা কাজ করেন তারা কেউই পরের প্রতিষ্ঠান ভেবে কাজ করেন না।যে কারনে পূজায় কাজ বন্ধ করে কোন মুসলিম কর্মীই ছুটি কাটায় না। অনুরূপ ভাবে ঈদের সময় কোনো হিন্দু কর্মী ছুটি কাটাতে চায়না।রিতি আজকের রেজিষ্ট্রার খাতাটায় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলো। দরজাটা আস্তে খুলে সেখান থেকে একটা পুরুষ কন্ঠ ভেসে আসে,,,

আসবো দিদি?

হ্যা বেলাল ভাই আসুন।বসুন।এক জোয়ান তাগড়া বিশাল দেহী সুপুরুষ প্রবেশ করে অফিস ঘড়ে।রিতির নির্দেশিত চেয়ারে বসে বিনয়ী ভঙ্গিতে। রঘুনাথ যে কয়জন ছেলেকে তাঁতকলে নিযুক্ত করেছিলো তাদেরই একজন।বলতে গেলে রঘুনাথ এর একান্ত বিশ্বস্তভাজন এরা।রঘুনাথের অনেক ভালো মন্দ কাজের সাক্ষী।রিতি কোনো ভনিতায় না গিয়ে সরসরি কাজের কথা তুললো,,,

বেলাল ভাই সকালে যে ব্যাপারে বললাম তার সত্যিই কিছু জানেন না আপনি? আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন?
পঁয়ত্রিশোর্ধ বেলাল ক্যানো জানি এই বিশোর্ধ পুঁচকে মেয়েটাকে খুব সমীহ করে চলে।আমতা আমতা করে বললো,,সত্যি বলছি দিদি,আমি বড়দার সম্পর্কে কিছুই জানিনা। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে না তো?

বেলাল ভাই আমার আন্দাজ যদি ভুল প্রমাণিত হয় তো আমার চেয়ে খুশি কেউ হবে না।তার জন্যেইতো আপনার শরনাপন্ন হলাম।
অসহায় বোধ করে বেলাল,,,
এখন আমি কি করতে পারি দিদি।বড়দা যদি কিছু ঘটিয়ে ও থাকে আমি কি ভাবে কি করবো?

কি করবেন মানে?আপনি দাদাভাইয়ের সকল কাজের জায়গা চেনেন। স্পাইগিরি করবেন।একটু ঝাঁঝের সাথে বললো রিতি।

কিন্তু বড়দা যদি জেনে যায়?

জানলে জানবে।আর যাতে না জানে সে ব্যবস্থাও আপনাকে করতে হবে।আমি পূজা শেষ হওয়ার আগে তার সন্ধান চাই যে করেই হোক।প্লিজ বেলাল ভাই না করবেন না। আপনার নিরাপত্তার বিষয়টা আমি দেখবো।কথা দিলাম।

বেলাল কিছুক্ষণ আধো মুখে বসে থেকে সম্মতি দিয়ে দেয়। নিজের প্রভু হিসেবে যার কাজ এতদিন করে এসেছে তার পেছনেই এখন গোয়েন্দা গিরি করতে হবে। কিছুই করার নেই তার।
দরজার বাইরে সুমি অপেক্ষা করছিলো।দরজা বন্ধ তার মানে ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছে। বেলালকে চিন্তাযুক্ত হয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে ভেতরে প্রবেশ করে সুমি।রিতি বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন।,,
বেলাল ভাইয়ের সাথে কি মিটিং ছিলো যে আমার সাথেও দেখা করলি না?ঢুকতে ঢুকতে বললো সুমি।

ওহ্ এসে গেছিস?তোর না ছুটি চলছে।এখানে কি?

তুই তো গিয়ে শশুর বাড়িতে উঠেছিস আমি কোথায় যাবো?বাড়িতে বসে বসে বিরক্ত হওয়ার চেয়ে কাজ করাই ভালো।বললো সুমি।

তাই?তো আমি প্রদীপদাকে ডেকে দিচ্ছি তোকে নিয়ে যাক হবু শশুর বাড়ি? রসিকতা করে রিতি।

থাক,,,অত দয়া দাক্ষিণ্যের দরকার নেই।গাল ফুলোয় সুমি।

যা খুশি কর সমস্যা নেই তবে দশমীর আগে যেনো ওবাড়িতে পাই।না হলে চাকরী তো যাবেই সাথে শশুর বাড়িও কেড়ে নেবো।

খুশিতে চোখ দুটো চকচক করে ওঠে সুমির।সে তো সর্বদাই রিতির পাশ ঘেঁষে থাকতে চায় কিন্তু পারে না শুধু রিতির বারনের জন্য।

কি মিটিং করলি বললি না যে?নাকি নাক গলাতে বারন করছিস? সিরিয়ায় হয় সুমি।
রিতি হেসে ওর পিঠে থাপ্পর মারে।
তুই এতো ছেলেমানুষ হচ্ছিস দিন দিন প্রদীপদার জন্য ভাবনা হয় আমার। বেচারা কি যে করবে তোকে নিয়ে?

তামাশা রাখ তো।যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটা বল।আর একটা কথা কোন ঝুঁকি ঝামেলায় কিন্তু যাবি না।সুমি আরো সিরিয়াস হয়।

না রে সুমি, নতুন কোনো ঝামেলার কি প্রয়োজন, পুরোনো গুলোই তো কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।আছে একটা ব্যাপার আগে আমি কনফার্ম হই তারপর তোকে বলবো।
সুমি আর কথা বাড়ায় না।রিতি একবার যখন বলেছে পরে বলবে তো ওকে দিয়ে এখন বলানোই যাবেনা।

আগে বলতো অখিলেশ দাকে ক্যমন বুঝলি?কথা ঘুরায় রিতি।সুমিও যোগ দেয় তাতে,,

আরে আর বলিস না।ঐ দেবদাস দাদা?মানুষটা ভালো তবে তোর কাজ কতটা ভালো করবে কে জানে?তিনি তো প্রথম দিনে এসেই মালিকের দেখা পেতে চায়।হাসে সুমি।

আচ্ছা আচ্ছা তো তোরা কি বললি?আমোদ বোধ করে রিতি।
তোর প্রদীপ দাদা তো প্রায় ফাঁস করে দিচ্ছিলো আমিই কায়দা করে কথা ঘুরিয়ে বললাম মালিক পূজোর ছুটিতে আছে।কাজ কর্ম জানে বলে তো মনে হলো না।

কিছুই করার নেই সখী?দাদাভাইয়ের ভায়ের রেফারেন্স বলে কথা।দরকার হলে বসিয়ে বেতন দেবো।

ও তাই?
*****
বৌদিদি এককাপ কফি কি হবে? দুপুরের খাওয়ার তো হজম হতে চললো।

কাজলকে সঙ্গে নিয়ে থালা বাসন মুছছিলো জয়া।

হ্যা ভাই তুমি যাও আমি কফি দিচ্ছি সবাই খাবে তো?সরলা পিসি চুলোয় একটু জল চাপিয়ে দাও না?

চার কাপ দিও বৌদিদি আমি গেলাম। বিরূপাক্ষ প্রস্থান করতেই অন্নপূর্ণা দেবী হাজির হন,,খানিকটা উদ্বিগ্ন দেখায় তাঁকে,
এই জয়া,,একটু শোন না মা,,

কি হয়েছে মামিমা?কিছু লাগবে?

না না, তুই একটু ফোন করনা রিতিকে আমার ফোন তো তুলছেই না।সেই দুপুরের আগে কিছু মুখে না দিয়েই চলে গেলো।কি এমন রাজকার্য করছে শুনে দেখতো।কাজ বার করবো একবার আসুক।

মামিমা শুধু শুধু দিব্যি খেয়ে বসো না।সামনে আসলে তোমার কিছুই মনে থাকবে না।পারলে কোলে নিয়ে বসবে।হাসছে জয়া।

অন্নপূর্ণা দেবীর মন ভার হয়।ছেলে মেয়েগুলো তার দূর্বলতা নিয়ে মজা করে,,
তোরা যা হয়েছিস।মারের অভাবে নষ্ট খারাপ হয়ে গেলি সব।

মারছো না ক্যানো মামিমা। তোমার বড়ো খোকাকে দিয়ে শুরু করবে বুঝলে? শব্দ যোগে হাসে জয়া।
বিরূপাক্ষ ধীরপায়ে সিঁড়ি ভাঙে।কফি তো শুধু ছলনা মাত্র। মায়ের কথায় আসল খবরটা পেয়ে যায়।তখনি অন্য চিন্তা ভর করে মাথায়,, রাহুল ছেলেটা তিতলি,অখিলেশের সাথে গল্প করছে তাহলে রিতি গেল কোথায়?
চলবে,,,,

ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
ভালো থাকবেন সবাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here