উপন্যাস: হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে,৩৫,৩৬
কলমে: চন্দ্রা।
পর্ব:৩৫
চারিদিকে সুনসান নীরবতা। পূর্ণ চাঁদের ভরা জ্যোছনার প্লাবনে ভেসে চলেছেন ধরনী।আমির শেখের ইটভাটার গোপন কক্ষের একটা ছোট্ট কুঠুরি থেকে অসুস্থ কুকুরের গোঙানির মতো আওয়াজ ভেসে আসছে।তবে ভালো করে কান পেতে শুনলেই যে কেউ বুঝতে পারবে সেটা আসলে কোনো কুকুর বা জন্তু জানোয়ারের মুখনিঃসৃত শব্দ নয় বরং মুখ বাঁধা অবস্থায় পরে থাকা কোনো অসহায় মানুষের মুক্তির দাবিতে আকুল ছটফটানি।ভাঙা ইটের গুঁড়ো ছিটিয়ে রাখা লালচে মাটিতে কাত হয়ে পরে আছে এক ব্যাক্তি।হাত দুটো তার পেছন মুড়ে বাঁধা।কন্ঠের স্বর রোধের উপায় হিসেবে পুরোনো গামছা দিয়ে মুখখানি আঁটোসাঁটো করে বেঁধে রাখা হয়েছে তার।চোখ দুটো স্বাভাবিক এর চেয়ে বড়ো।সেটা মরণ ভয়ে নাকি,চরম ক্রোধে তা বোঝার অবকাশ নেই ঐ আবছা আলোয়।কালো কেডস পরিহিত একটা পা ভীষণ ভাবে আঘাত করলো লোকটির বুক বরাবর।ককিয়ে উঠলো ব্যাথায়,,
হারামির বাচ্চা,নেমকহারাম,,তোরে কত্তবার সাবধান করছি না??কথা শুনিসনাই,কাইল তরে ইটের পাঁজার আগুনে পোড়ানো হবে,বুঝিস ঠ্যালা।
কাঠের নড়বড়ে দরজা ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করে লিকু সরদার। ভূলুণ্ঠিত ব্যাক্তি
করুণ চোখে তাকায় সেদিকে।
বৃদ্ধ লিকুর ঘোলাটে চোখে প্রতিহিংসার প্রতিফলন,,
লিকু ভাই এখন কিন্তু বলবা না তোমার পোলারে মাফ করে দিতে। হুমকির মতো শুনায় আসলাম এর বাক্য গুলো।
লিকু নিজের ছোট পুত্র ইকরামের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ডান হাতে তার সোয়েটার এর কলার চেপে ধরে,,খা**র পোলা তরে কইছিলাম না ভালা হইতে,,কথা হুনোস নাই আমার।একটু দম নিয়ে আবার বলে,,
বে***ন্মা কোহানকার মর এইবার জ্বইলা,পুইড়া।
ইকরামের চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।এটা হয়তো নিজেরই জন্মদাতার প্রতি প্রবল ঘৃনায়।
আসলাম তুমি লিকু সরদার রে চেনো নাই।আমি নিজের কাম হাসিল করতে সব পারি।এই নালায়েক নেমকহারামি ডারে এমনেই ধরতে পারছো মনে করছো??হা হা হাহা,,,
উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে লিকু সরদার এর বিদঘুটে হাসি দেখছে। আসলাম তাকায় জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে,, পূণরায় বলে লিকু,,
আমি যহন আমির ভাইর লগে ফোনে কথা কইতে ছিলাম এই হারামির বাচ্চা আড়ি পাতছিলো।ভাবছে আমি ট্যার পাইনাই।
এই কুত্তার***তরে কইছি না,আমার লগে আড়ি দেস না।বাপের আগে হাঁটোস??দালালি করোস চৌধুরীগো?আজ দেখুম কোন বাজানে বাঁচায় তরে।
লিকু সরদার নিচু হয়ে ইকরামের টুঁটি চেপে ধরে দাঁত কিড়মির করে বলে কথা গুলো।
কি ভাবছোস,,তুই আমার পিছে পিছে ধাওয়া করছোস??হা হা হা,হায়রে বোকা ছ্যারা,আমিই তরে লইয়া আইলাম বাঘের গুহায়।অহন তুই বন্দী।
ইকরাম অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দু-পেয়ে জানোয়ারটার দিকে।চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে নামছে তার। নিজের প্রতি ঘৃণা হয় এটা ভেবে যে,আল্লাহ তাকে ক্যানো এই নৃশংস পশুটার মাধ্যমে এই সুন্দর পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন?? অভিযোগ করতে ইচ্ছে হয় উপর ওয়ালার প্রতি,,ক্যানো তিনি এইসব পাষন্ডদের পিতৃত্বের সুখ দেন মুঠো ভরে??
আসলামের কুঞ্চিত ভ্রু-দ্বয় মসৃন হয়। ইকরাম বন্দী হওয়ায় হয়তো লিকুকে বাহবা দেওয়ার দরকার ছিলো কিন্তু হিতে বিপরীত হলো,,এই বৃদ্ধ লোকটির প্রতি একরাশ ঘৃণা পর্যবশিত না করে পারে না আসলাম।তার মধ্যকার ভালোমানুষী সত্ত্বাটা এখনো সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায় নি।
********
চারিদিকে ভারী হিম কুয়াশার প্রলেপ। খেসারি, মটরশুটি আর সরষে ক্ষেতের আইলে নরম ঘাসের ডগায় ঠান্ডা ঠান্ডা স্যাঁতসেঁতে অনুভূতির আলোড়ন।সে ঘাসের আদ্রতায় নগ্ন পায়ের পাতা সিক্ত করিয়ে ছুটে চলেছে বিরূপাক্ষ।অনতিদূরে রায় চৌধুরী মহলের সর্বোচ্চ চূড়াটা আবছা দৃষ্টিতে দেখে মরনপণে ছুটছে সে। স্নিগ্ধ চাঁদের চাঁদোয়া ঝলমল করছে শিশিরের ধোঁয়ার মতোকুন্ডলী ছাপিয়ে। বুকের মাঝে হালকা শিহরণ।বনলতা এই রাত্রি দ্বি-প্রহরে তার অপেক্ষায় আছে তাদেরই চৌধুরী মহলের সামনে। কিন্তু এই অসময়ে, এমন অনাকাঙ্ক্ষিত আগমন ক্যানো বুঝতে পারছে না বিরূপাক্ষ।। ভেতরের দ্বি-সত্ত্বার তর্কে বিতর্কের উত্তেজনা বাইরের হাড় কাঁপানো জাড় অতিক্রম করেছে তার দেহ, শুধুমাত্র একটা পাতলা শার্টে আচ্ছাদিত শরীরে অবলীলায় দৌড়ে চলেছে উত্তরের হিমেল হাওয়া এবং কুয়াশার ঠান্ডা কাটিয়ে।
একমুহুর্ত হেলায় নষ্ট করতে চায়না বিরূপাক্ষ।ধরা দিতে দিতে যদি আবার নাগালের বাইরে চলে যায় বনলতা?পা দুখানি চলছে রেসের ঘোড়ার মতো কিন্তু মনের কোনে ভাবনা গুলো গতি বিধি পাল্টাচ্ছে তার চেয়েও চতুর্মাত্রিক বেগে।কত কিছুই না ভেবে চলেছে তার অন্তরাত্মা। একবার ভাবছে,এই রাতে বনলতা তাকে নির্ঘাত ঠকাচ্ছে মিথ্যে বলে। পরমুহূর্তেই আবার উৎকন্ঠায় ভাবছে,, বনলতার উদ্বেগপূর্ন গলাতে মিথ্যার কোন আভাস তো ছিলোই না। যদিও ফোনে বনলতার আহ্বান খুব তেজের সাথে প্রত্যাখ্যান করেছে বিরূপাক্ষ কিন্তু মনকে প্রবোধ দিয়ে লাইনটা কেটে ঠিকই ছুটছে সেদিকে। অস্থিরতার কারণে ফোনটাও ফেলে এসেছে বিছানাতেই।
কিছুক্ষণ আগে,,
আচমকা রিতির ফোন থেকে কল আসে বিরূপাক্ষের হ্যান্ডসেটে।দুবার কেটে যাওয়ার পর পুনরায় রিং হতেই রিসিভ করে বিরূপাক্ষ।গলায় তার জোর করে টেনে আনা রুক্ষতা।সে রুক্ষতা আমলে না নিয়ে অবিরত উৎকন্ঠার ফোয়ারা ছুটিয়ে বললো রিতি,,রূপ দা তুমি খামার বাড়ি থেকে বাড়িতে ফিরে যাও এখনি।আর একমূহুর্ত ওখানে থেকো না তুমি প্লিজ।
আমার ফোনে কল দিয়েছিস কোন সাহসে?আর তুই কে আমাকে হুকুম করার?গনগনে আগুনের আঁচ ঝরে বিরূপাক্ষের স্বরে।
প্লিজ রূপদা কথা শোনো আমার। এক্ষুনি বেরিয়ে পরো ওখান থেকে। খামার বাড়িতে এখন তুমি সেইভ না।পায়ে পরি,কথাটা শোনো আমার।জীবনে আর কিচ্ছুটি বলবো না।কোনো অনুরোধ করবো না।
এক পা ও নড়বো না আমি দেখি তুই কি করতে পারিস?তুই না আমার বিপদ খন্ডনকারীনী?তো আমার বিপদ, মৃত্যু যোগ রোধ কর,,এক বিকৃত হাসি ফোঁটে বিরূপাক্ষের ঠোঁটে।রিতিকে একটু হলেও জব্দ করতে পারছে সে।টের পেয়েছে রিতির অধীর ছটফটানি। কিন্তু রিতি যদি তাকে না চাইবে,তাহলে এই ছটফটানির তাৎপর্য কি?? নিজের মনে ভাবে বিরূপাক্ষ।
আরো কিছুক্ষণ বিভিন্ন ভাবে অনুরোধ করে রিতি কোনো কাজ হয়নি তাতে অবশেষে শেষাস্ত্র ছেড়ে নিরাশ হয়,,
রূপদা তুমি যদি এখনি ওখান থেকে না যাও তাহলে আমার মরা মুখ দেখবে বলে দিলাম।যাওনা প্লিজ,,একটি বার আমার কথাটা শোনো,,গলা ধরে আসে রিতির।
বিরূপাক্ষ মনে মনে বিচলিত হলেও রুক্ষতা বজায় রেখে নিজের মুখে সবচেয়ে কঠিন এবং অনাকাঙ্ক্ষিত কথাটা উচ্চারণ করে বসে,,
তোর মরা মুখ দেখলে আমার কি হবে রে??
মর তুই,,যন্ত্রণা পেয়ে পেয়ে সবচেয়ে করুণ মৃত্যু হোক তোর।তাতেও আমার মতো যন্ত্রণা হবে না তোর।যে যন্ত্রণা তোর জন্য আমি পাচ্ছি।আর কখনো আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করবি তো আমিই তোকে খুন করবো অসভ্য, ধান্দাবাজ মেয়ে কোথাকার।। খালি ভালো সাজার নাটক তাই না??ওতে আমি ভুলবো না রে,,
আচ্ছা তাহলে থাকো তুমি ওখানে,আমি আসছি,, অসহায়ের মতো বললো রিতি।দৃঢ় গলায় বললো রিতি।
বিরূপাক্ষের এমন কথায় বুকটা ভেঙে আসে তার।প্রাণের রূপদা তার মৃত্যু কামনা করে??এ ও সম্ভব??কান্নারা বাঁধন হারা,অশ্রুর সমুদ্র ঢেউয়ে নিমজ্জিত। কিন্তু বসে শুয়ে কেঁদে কুটে দুঃখ প্রকাশ করলে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে।পুরু শালটি গাঁয়ে জরিয়ে অসুস্থ দুর্বল শরীরে ছুটে চলে মথুরাপুরের উদ্দেশ্যে। শর্টকাট পথ ধরে।ঝোপ ঝাড় ভেঙে দ্রুত পৌঁছে যাবে গন্তব্যে।পায়ে স্যান্ডেল পরার সময়টুকুও নেই, নদীর পাড়ের জংলি কাঁটাতে পা ছড়ে রক্ত ঝরছে। সেদিকে হুঁশ নেই মেয়েটার।হাতে ছোট বাটন ফোনটা। এবার হবে শেষ চেষ্টা।কাজ নিশ্চয়ই হবে,,রিতি হারবে গো হারান। কিন্তু বনলতা তো জিতবে। পরিশেষে, বেঁচে তো থাকবে রিতির রূপদা।
***
ফার্মের মুরগিগুলোর খাবার দিয়ে বেশ রাতেই ঘুমিয়ে ছিল প্রদীপ, অনেক রাতে ঘুম ভেঙ্গে ফোনে চোখ রাখতেই দেখলো পনেরোটা ব্যার্থকল। ঘুম ছুটে যায় তার।ফোন সাইলেন্ট থাকায় টের পায়নি।এতরাতে রিতির নম্বর থেকে এতগুলো কল?? ভাববার সময় নেই কল ব্যাক করে প্রদীপ,, কিন্তু বারকয়েক দিয়েও ওপাশ থেকে রিসিভ হয়না।
অস্থির হয়ে সুমিকে কল করে প্রদীপ।মনটা কু গাইছে তার।সুমি হয়তো গভীর ঘুমে। বিরক্ত হয়ে,নিরাশ হয়ে শীতের পোশাক পরে মটরবাইক্ নিয়ে বেরিয়ে পরে সে।এত রাতে নিশ্চয়ই কোন জরুরী কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছিলো রিতি।উথাল পাথাল চিন্তা ভাবনা আসছে মস্তিষ্কে। পাশের গ্রামে পৌষের মেলা বসেছে। তিন দিন যাবত হবে।সেখান থেকে ভেসে আসছে হালকা পাতলা গম গম আওয়াজ। গ্রামের অধিকাংশ যুকব ছেলেরা হয়তো মেলার মাঠে আছে, তারমানে মথুরাপুর, চন্ডীনগর গ্রাম তো প্রায় ফাঁকা আজ,, প্রদীপের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় লাফিয়ে উঠে।সে দ্রুত বাইকের গতি কমিয়ে বিরূপাক্ষের ফোন নম্বর এ ডায়াল করে।নাহ রিসিভ হয়না। প্রদীপের হাত কাঁপছে,,তবে কি কোনো বিপদ সত্যিই হলো?? রঘুনাথ এর ফোন নম্বরটা বের করে ডায়াল করে প্রদীপ,,
*******
রিতির কলটা কেটে দেওয়ার সাথে সাথেই নিজের বলা কটু বাক্য গুলো স্মরণ করে মরমে মরছিলো বিরূপাক্ষ।রিতির মৃত্যু তো দূরের কথা, সামান্য অসুস্থতার কথা শুনলেও যে তার বুকে তুফান আসে, কষ্টের ঢেউ গুলো আছড়ে পড়ে মনের দু-কূল বরাবর ।বার বার নিজের বাক্য খন্ডন করে চলেছে বিরূপাক্ষ। কিন্তু ধনুক থেকে তীর,আর মুখ থেকে যে কথা একবার মুক্ত হয় তা কি আর বন্দী করা যায়??
দশ মিনিট গত হয়েছে কি হয়নি,, পুনরায় ফোনটা বেজে উঠতেই রিসিভ করে বিরূপাক্ষ,,ভেবছিলো রিতি কিন্তু না, ওপাশ থেকে ভেসে আসে বনলতার কন্ঠস্বর,,
বনলতা ফোনে কথা বলেছে বিরূপাক্ষের সাথে। কিন্তু বিরূপাক্ষ কোনো কথা শুনতে নারাজ। গভীর অভিমানে কোনঠাসা হয়েছে হৃদয় তার।বনলতার আকুতি মেশানো কন্ঠস্বর তার বুকে বিঁধলো ভীষণ ভাবে।
বনলতা অপেক্ষা করছে তাদের বাড়ির সামনে। ভীষণ বিপদে পরেছে সে।এখনি যদি বিরূপাক্ষ সেখানে না যায় তাহলে আর কোনদিন হয়তো দেখা হবে না। কিন্তু বিরূপাক্ষ বিশ্বাস করতে চায় না বনলতার কথা। একবার ঠকিয়েছে,, পুনরায় যদি ঠকায়??
ফোনে যতই না না করুক ঠিকই ছুটেছে সেদিক পানে, যেদিকে তার মনের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তার জন্য।
****
ভেজা ক্ষেতের আইল পেরিয়ে সবে পিচঢালা পথে উঠেছে বিরূপাক্ষ,, মনের মধ্যে জানা, অজানা হাজারো অনুভূতির মেলা।আর কয়েক মিনিটের ব্যাবধান মাত্র। ভাগ্য প্রসন্ন হলে বনলতার দর্শন পাবে সে।সামনেই রাস্তার পাশে বিশাল পুরোনো কাঠবাদামের গাছটির অসংখ্য ডাল পালা সুবিশাল আকাশের মতো ছড়িয়ে আছে পথের উপরে।এ যেনো এক প্রশস্ত ছাদ। পায়ের গতি খানিকটা শিথিল হয়ে এসেছে তার।আর একটু,,, তারপর,,,
আর ভাববার অবকাশ পায় না,বাদাম গাছটি ক্রস করেছে কি করেনি,,কানে আসে এক বজ্র কঠিন শব্দ।বিরূপাক্ষের মাথার উপর বাদাম গাছে বসবাসরত হাজারো পাখির নিদ্রা ভঙ্গ হয় সে উদ্ভট শব্দে।পতপত শব্দে ডানা ঝাপটে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে তারা।
বিরূপাক্ষ থমকে দাঁড়ায়,,হুট করেই হৃদপিন্ডটা প্রচন্ড বেগে বিট করছে তার,ক্যামন যেনো হাঁসফাঁস করে উঠেছে ভেতরটা।মনে পরে,,এমন অনুভূতি আরো একবার হয়েছিলো, যেদিন দাদুভাই মারা যান। দেহের সকল ইন্দ্রীয় যেনো ক্রিয়া কর্ম বন্ধ করে অবসর নিয়েছে তার,, পুনরায় গুলির শব্দ হতেই সেগুলো আবার সজাগ হয়ে ওঠে।
শ্রবণ ইন্দ্রীয় জানান দেয় তৎক্ষণাৎ, খামার বাড়ি থেকেই গুলির শব্দ দুটো এলো।
বিরূপাক্ষ উদ্ভ্রান্তের মতো উল্টো দিকে ছুটতে শুরু করেছে,, মনের মধ্যে,মাথার মধ্যে, সমস্ত দেহে শুধু রিতির বলা একটা কথাই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে,,”থাকো তুমি ওখানে ,আমি আসছি”
আর ভাবার কিছু নেই। খামার বাড়িতে গিয়েই ভাববে সে।অকারনেই চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে বিরূপাক্ষের।কি দেখবে সেখানে গিয়ে?সইতে পারবে তো?
******
খামার বাড়ির বাঁশের বেড়া ডিঙিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছে বিরূপাক্ষ।কোনো সাড়া শব্দ নেই। এখানে কিছু হয়েছে বলেও মনে হচ্ছে না।তবে কি তার আন্দাজ ভুল হলো। গ্রামের দিকে অনেক মানুষের শোরগোল শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ গুলির শব্দে মানুষ জন হতবিহ্বল হয়ে পরেছে হয়তো।সে খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে যায় নিজের বসবাসরত ঘড়খানার দিকে,রিতি আসেনি ভেবেই শান্তি পেলো।ফোনটা নেবে এবার।
হঠাৎ করেই লাউ মাচার আড়াল থেকে কেউ এসে জাপটে ধরে প্রাণপনে।স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিরূপাক্ষ। খামারের মূল দরজায় কোলাহল স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিছু লোক খামারের ভেতরেই আসছে। আবার গুলির শব্দ। এবারে কানে তালা লাগে বিরূপাক্ষের। শুধু বুঝতে পারে বুকের উপরের বোঝাটা প্রবল বেগে যেনো ধাক্কা দিলো তাকে। সেটাকে আঁকড়ে ধরে বিরূপাক্ষ। পিঠের কাছটা আঠালো স্যাঁতসেঁতে কিন্তু উষ্ণতায় ভরপুর।দূর থেকে ভেসে আসছে প্রদীপ এবং দাদাভাইয়ের কান্নাজড়িত গলার স্বর,,রূউউউপ,
সব কিছু ছাপিয়ে কানের একদম চুল পরিমান দূরত্বে আরেকটা নিথর মলিনকন্ঠ,,,
রূ–প–দা,,,,
মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে বিরূপাক্ষের, দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো,, দাদাভাই,,,,,
সে আর্তনাদের সুর ছড়িয়ে পড়লো জনহীন প্রান্ত পেড়িয়ে জনবহুল লোকালয়ে। শিশিরে, জোছনায় মিলে মিশে রাতের আঁধারে সে সুর ছড়িয়ে পড়লো দিগন্তের সীমান্তে।রিতিকে বুকে জড়িয়ে হাত পা ভেঙ্গে সেখানেই বসে পরলো সে।
উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলোতে নিজের হাতের তালুতে দেখলো কালচে আবরণ।রিতির পিঠ থেকে রক্ত ছুটছে।
ক্যানো করলি এটা বুড়ি??এত পাকনামো করতে কে বলেছে তোকে?এই তুই কি করলি রে? এভাবে প্রতিশোধ নিতে আছে বল??আর কত জ্বালাবি আমায়??আর কত,,আর কত,,, চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে বিরূপাক্ষ,রিতির রক্ত ভেজা গালে নিজের গালটা মিলিয়ে কাঁদছে সে,,
রিতি এখনো সজ্ঞানে, নিজের প্রায় অবশ হয়ে আসা ডান হাতটা বিরূপাক্ষের বাম গালে মেলে ধরে বলে মৃদু স্বরে,, তোমার বিপদ কেটেছে রূপদা,,, আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই। কিন্তু আফসোস যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু আমার হবে না গো,, তোমার বুকে মৃত্যু,,সেতো আমার স্বর্গসম সুখ হবে,,
তোর কিচ্ছু হতে দেবো না রে আমি,,রূপ দা আছি তো।আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে নেয় রিতিকে,যেনো ছেড়ে দিলেই পালাবে দুষ্টু মেয়েটা,,
তোমার বনলতা যে অপেক্ষা করছে,,ভাঙা ভাঙা শব্দের উচ্চারণ রিতির। সবকিছু যেনো অকেজো হয়ে আসছে। চোখ জুড়ে অন্ধকার।মনের মধ্যে একটাই কষ্ট,, চিরচেনা রিতি হারলো আর অজানা, অচেনা বনলতাকেই জিতিয়ে দিলো বিরূপাক্ষ।কষ্টে যন্ত্রণায় সর্বাঙ্গ নীল হয়ে যাচ্ছে রিতির।
কাউকে চাইনা,কিচ্ছু চাই না আমার,,শুধু তুই থাক না বুড়ি,, কে থাকবে না থাকবে জানি না,তবে তোকে যে থাকতেই হবে,, থাকতেই হবে কিন্তু,,কারো হাতের টর্চ লাইটের এক চিলতে আলো পড়লো রিতির মুখে,দেখলো বিরূপাক্ষ,, ধীরে ধীরে আঁখি মুদে যাচ্ছে রিতির কিন্তু মুখে কোনো ব্যাথা বেদনার চিহ্ন পর্যন্ত নেই,,
হ্যা রিতির ঠোঁটের কোনে প্রশান্তির হাসি,,সে জিতেছে,রূপদা তাকেই জিতিয়ে দিয়েছে।এমনি এমনি কি আর এত ভালো বেসেছে মানুষটাকে। চোখের পাতা রুদ্ধ হলো।
কানে শো শো কিছু উদ্বিগ্নতা মেশানো শব্দের মিছিল,,
*****
পুষ্প রথের মনিমুক্তা খচিত সিংহাসনে রাজ-রাজেষ্যরীর বেশে বসে আছে রিতি। সম্মুখে স্বর্গরাজ্যের সিংহদ্বার,,, কিন্তু রথ তো চলছে না।মুখে ভুবন মোহিনী হাসি নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে রিতি,,
কি হলো রূপদা,, এবার তো ছাড়ো তোমার সোনার শিকল। আমাকে যে যেতে হবে। কঠিন মুখে তাকিয়ে বিরূপাক্ষ সেই আগের মতো শাসনের সাথে বললো,,
কি বোকা হয়েছিস তুই রিতি!একা একা কোথায় ছাড়বো তোকে?পথের মাঝেই পথ হারিয়ে কাঁদবি শেষে। নেমে আয় বলছি,সাথে করে নিয়ে যাবো আমি, সময় আসুক আগে।
রথের সাথে বেঁধে রাখা শিকল বিরূপাক্ষের দুহাতে। কোনোকিছুর বিনিময়ে তা ছাড়বে না।রিতি একবার তাকালো স্বর্গাভিমুখে আর একবার রূপ দার কাঠিন্য মেশানো করুন চোখের দিকে।কি করবে সে ,নেমে যাবে নাকি ছুটে যাবে অফুরন্ত সুখ,সমৃদ্ধি ও শান্তির দেশে????
চলবে,,,,
উপন্যাস :হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে।
কলমে: চন্দ্রা।
পর্ব:৩৬
আকাশের পাখোয়াজে নিঃসঙ্গ বিধুর শূন্য ঘরে-ঘরে ওড়ে গন্ধময় সুর,,,,,
(বিষ্ণু দে)
গাছে গাছে আমের মুকুলে মৌমাছির গুন গুন গুঞ্জরণে যখন চারপাশটা মুখরিত ছিলো তখন বিরূপাক্ষ এসে ঢুকেছিল রিতির পরিত্যক্ত শূন্য কক্ষটিতে।এ কক্ষটি কয়েকমাস আগ পর্যন্তও শূন্যই থাকতো,আর আজও শূন্য, কিন্তু তখনকার শূন্যতা আর এখনকার শূন্যতার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান।গমগমে চৌধুরী বাড়িটাতে যেনো সুনসান নিঃশব্দ শ্মশান পুরীর নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে।কোন টু শব্দটি পর্যন্ত নেই।সন্ধ্যায় সাঁঝবাতির মোলায়েম আলো জ্বলছে ঠিকই কিন্তু সেই উজ্জ্বল আভা কারো নজর কাড়তে ব্যার্থ,ধুপকাঠি নিজেকে জ্বালিয়ে বাতাসে ভুরভুর গন্ধ ছড়াচ্ছে ঠিকই কিন্তু তা কারো ঘ্রাণেন্দ্রীয়ের অন্দরকে হয়তো আন্দোলিত করতে পারছে না।সেই দুপুর থেকে রুদ্ধ দাঁড়ের ওপাশে বিরূপাক্ষ কি করছে জানে না জয়া।তারও শরীরটা ভালো নয়।মনটা তো খারাপের চরম পর্যায়ে। কেঁদে চলেছে থেমে থেমে। গর্ভাবস্থায় এমন কান্নাকাটির ফল যে সুখকর হবে না,তা ভালোই জানে জয়া কিন্তু কি করবে মনকে যে মানাতে পারছে না।বর্ষাস্নাত পুষ্পের ন্যায় সতেজ, নবজাতকের মতো নিঃস্পাপ ফুটফুটে মেয়েটার যে এমন পরিনতি হবে তা কি কেউ স্বপ্নেও ভেবেছিলো?জয়া বার কয়েক এসে ডেকেছে বিরূপাক্ষকে, কিন্তু সাড়া শব্দ পায়নি।ছেলেটা এই কটা দিন নাওয়া খাওয়া ত্যাগ করেছে। রঘুনাথ বারবার ফোনে বলছে ওকে কিছু খাইয়ে দিতে কিন্তু কি করবে জয়া,সে যে দরজার ওপাশ থেকে সাড়াটি পর্যন্ত দিচ্ছে না। দুপুরের দিকে বন্ধু অখিলেশ এর সাথেই বাড়িতে পা রেখেছে বিরূপাক্ষ এতদিন বাদে।অখিলেশ এর কোনো খবরও পাচ্ছে না জয়া।
****
রাত ঠিক ক’টা বাজে খেয়াল নেই বিরূপাক্ষের,ঠান্ডায় হাত পা অবশ হয়ে আছে। এই কক্ষের পাশ ঘেঁষে উত্তরের জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন আম গাছটি থেকে সদ্য প্রস্ফুটিত মুকুলের ঘ্রাণ আসছে হাওয়ার তোড়ে,, মৌমাছির গুঞ্জনের বদলে সেখানে এখন বাদুড়ের ডানা ঝাপটানোর শব্দ। ঠান্ডা মেঝে থেকে উঠে বসেছে বিরূপাক্ষ।হতবিহ্বলের মতো এদিক ওদিক তাকিয়ে অন্ধকারে চোখের দৃষ্টি অভ্যস্ত করে নিতে সময় লাগছে খানিক।গায়ে জড়ানো রিতির রক্ত মাখা হালকা রঙের শার্ট টা। রক্তের দাগ শুকিয়ে শক্ত হয়ে আছে জায়গায় জায়গায়।উঠে গিয়ে আলো জ্বালাতে ই চোখ জ্বলে ওঠে।যেদিকে চোখ যায় মনে হয় রিতি বসে আছে,,সেই চার বছর বয়সের শিশু রিতি থেকে এই পূর্ণ যৌবনা রিতির প্রতিচ্ছবি সর্বত্রই, কিন্তু কিশোরী রিতির প্রতিচ্ছবি গুলো তো নেই সেখানে। কখনো সে প্রতিচ্ছবি ব্যাথা পেয়ে কাঁদছে আবার কখনো উচ্ছ্বলা তটীনির মতো খলখলিয়ে হাসছে।না বিরূপাক্ষের আর সইছে না।পাগল পাগল লাগছে তার কিন্তু পাগলামি করার শক্তি, মনোবল কোনোটাই যে নেই।এই অস্থির পাগলামি কে দেখবে?কে দেবে আস্কারা?কে মেনে নেবে করুন নয়নে নির্দ্বিধায়?তার স্বচ্ছ দীঘির মতো চোখ দুটোতে যে আজ আঁধার নেমেছে। শতবার চাইলেও সেথায় বন্দী করতে পারছে না প্রাণের রূপ দা কে।
বিছানায় চোখ যায় বিরূপাক্ষের।সেখানে অবহেলিত হয়ে পরে আছে সেই নীল মলাটে বাঁধা অফিসিয়াল ফাইলটা।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হানে বিরূপাক্ষ। আজকের এই নির্মম পরিণতির সকল দ্বায় যেনো ফাইলটির।কাল এঘড়ের আলমারি খুলে রিতির কাপড়, চোপড়ের সাথে এটাও পেয়েছে সে। মালিকের সাক্ষর এর স্থানটিতে রিতির নিজ হাতের সিগনেচার জ্বল জ্বল করছে সূর্যের আলোর মতো। কিন্তু বিস্মিত হয়ে দেখে বিরূপাক্ষ,এই কোম্পানির একমাত্র অংশীদার এর স্থানটিতে লেখা, বিরূপাক্ষ রায় চৌধুরী। কিন্তু সেখানে তার কোনো সাক্ষর নেই।যবে থেকে এই ফাইল টির কাজ শুরু হয়েছে,তবে থেকেই জায়গাটা ফাঁকা।এটাই নেওয়ার কথা সেদিন রাহুলকে ফোনে বলছিলো রিতি।না হলে যে ব্যবসাটা দেশের বাইরে নেওয়া যাবে না।আইনি ব্যবস্থায় দুজন মালিকের ই সম্মতি থাকতে হবে।এমনি নিয়ম লেখা আছে।
নজরের তীক্ষ্ণতা পাল্টে মুহূর্তেই সেখানে বেদনার রংহীন চিহ্ন ভেসে ওঠে। বুকে আঁকড়ে ধরে ফাইলটি। সেখানে যে রিতির ছোঁয়া আছে।কত শত সহস্র বার রিতি ছুঁয়েছে এটাকে। বিরূপাক্ষ এক লহমায় বুঝে নেয় অন্নপূর্ণা বুটিক এন্ড তাঁতের মালকিন রিতি নিজেই।বড়োমার স্নেহের ঋণ শোধ করতে তাঁর নামেই করেছে।শত শত দরিদ্র পরিবারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে।
শ্রদ্ধা এবং গর্বে বুকটা ভরে ওঠে বিরূপাক্ষের।টনটনে ব্যাথাটা যে বেড়েই চলেছে।
***
কি হলো রূপদা এবার তো ছাড়ো লক্ষীটি!সময় যে বয়ে যায়।ঐযে দ্যাখো স্বর্গদ্বার রুদ্ধ হওয়ার সমাপ্তির শঙ্খনাদ বেজে উঠল।না গেলে যে আর সুযোগ হবে না আমার।রিতির চোখে করুন আর্তি।
কে নিষেধ করেছে তোকে?যা দেখি ক্যামন পারিস? একফোঁটা নড়ে দেখা বুড়ি?
সেই পুরোনো জেদ বিরূপাক্ষ’র কন্ঠে।
রিতি একবার তাকালো বিরূপাক্ষের হাতে পেঁচিয়ে থাকা সোনার শিকল এর দিকে।
দাও না যেতে রূপদা।আমি যে পৃথিবীর অযোগ্য। মানানসই নই তোমাদের মাঝে।আর দ্যাখো ওখানে মহাকাল নিজে স্বয়ং ক্রোড় পেতে রেখেছেন।আমি যাই,,
বিরূপাক্ষের অশ্রু গড়িয়ে পড়লো এবার।মুক্ত করলো হাতের শিকল। কিন্তু এ কি?রিতির যে এবার বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে,,রূপদা তাকে একা একা ছেড়ে দিলো?সে কি জানে না রিতির একা চলতে কত কষ্ট হয়?
নিজের মনকে বুঝায় রিতি, যে সকল স্বত্ত্ব ত্যাগ করে,প্রাপ্য অধিকার হেলায় হারায় তার কাছে আর কিইবা আশা করা যায়?
রথের পেছনের শিকল হস্তমুক্ত করে সামনে ছুটে আসে বিরূপাক্ষ,রিতির আলতা পরানো রাতুল চরণ যুগল বক্ষে তুলে নেয় গভীর আবেগে,,
তুই আমাকে ছেড়ে যাসনে বুড়ি।আমি থাকতে পারবো না রে একা একা।কখনো শুনেছিস,হৃদপিন্ড ছাড়া মানুষ বাঁচে?
ত্ররিতি ছাড়া যে তার বিরূপাক্ষও শূন্য,আধুরা।স্বর্গ থেকে অধিক সুখে রাখবো তোকে,একটি বার বিশ্বাস করে দেখনা সোনা।নেমে আয়।বিরূপাক্ষের চোখের জলে রিতির পায়ের আলতা ধুয়ে যাচ্ছে।আর স্থির থাকতে পারে না রিতি। কাঁদছে সেও।রূপদার কান্না তার বুকে তুফান তোলে নিমেষেই।উঠে দাঁড়ায় সিংহাসন ছেড়ে। তাচ্ছিল্য ভরে একবার তাকালো স্বর্গদ্বারের দিকে মনে মনে বললো, তোমার মতো লক্ষ,কোটি স্বর্গের সুখও আমার রূপদার চোখের জলের চেয়ে দামী নয়।কখনোই নয়।
****
বিভাগীয় শহরের স্বনাম ধন্য হাসপাতালের আই,সি,ইউ তে বিভিন্ন যন্ত্রপাতির সাথে দিন কাটছে রিতির।দুটো রাত কেটে গেল কিন্তু জ্ঞান ফেরেনি তার।এদিকে রিতির হাই ফিবার,প্রচুর রক্তক্ষরণ, শরীরের অত্যধিক তাপমাত্রা কর্মরত চিকিৎসকদের অত্যধিক চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। অপারেশন সাকসেসফুল হলেও বিপদ থেকে মুক্তি পায়নি রিতি। একবার জ্ঞান ফিরলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন চিকিৎসকরা।
দুটো গুলির ক্ষত স্থান থেকেই রক্ত ঝরেছে অবিরত ভাবে।জেলা শহরের নামকরা ক্লিনিক থেকে প্রাথমিক সেবা দিয়ে রেফার করা হয়েছে বিভাগীয় শহরে।টাকা থাকলে এখানে যথোপযুক্ত চিকিৎসার অভাব হয় না।বাকী টুকু উপর ওয়ালার কারসাজি। ভাগ্য ভালো, যে গুলিটা পিঠে লেগেছে সেটা একেবারেই বাঁ পাশের মাংস পেশী ছিঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল না হলে, এতক্ষণে হয়তো বেদনায় মুহ্যমান হৃদয়টা তার নিজের ক্রিয়াকর্ম বন্ধ করে রিতির আন্তেষ্ট্যিক্রিয়ার ব্যবস্থা করে ফেলতো। গুলিবিদ্ধ ডান হাঁটুতে অস্ত্র পচারের মাধ্যমে বুলেট বের করা হয়েছে অভিজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা।এখন শুধু অপেক্ষা দুচোখ মেলে তাকাবার।
আই,সি,ইউ এর দরজায় কয়েক জোড়া স্নেহ ব্যাকুল সজল আঁখি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভেতরের মুমূর্ষু দেহটির দিকে। কাছে আকুল প্রার্থনা তাদের ঐ নিথর দেহটা একবার একটু নড়ে উঠুক।স্থির পদ্ম দীঘিতে ঢেউ জেগে উঠুক অবিলম্বে।
বড়োমা,, ঐদিকে গিয়ে বসবে চলো।ম্লান কন্ঠে বললো প্রদীপ।ভেতরে দৃষ্টি রেখেই ডানে বামে মাথা নাড়েন অন্নপূর্ণা দেবী। বললেন বাষ্প রুদ্ধ কন্ঠে,,
না বাবা,,আর এক পা ও নড়বো না আমি। অনেক করেছিস সেবা শুশ্রূষা। এবার একটু একা ছেড়ে দে আমায়।দেখি প্রাণ ভরে। আমার সামনে কিছুতেই আমাদের ছাড়তে পারবে না ও।অত টুকু মেয়ে এত বড়ো সাহস দেখাতে পারবে না বাবা,,
সুমিতা দেবীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন অন্নপূর্ণা দেবী। অতিরিক্ত টেনশন এবং কান্নাকাটির ফলে নিজেই মরতে বসেছিলেন। সারাদিন তাঁকে অন্য কেবিনে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছিলো।একটু সুস্থ হতেই ছুটে এসেছেন এখানে।
প্রদীপ ডান হাতের চেঁটোয় চোখ মুছে বলে,
বড়ো মা,, জানোই তো কেমন দস্যি মেয়ে ওটা। জেগে যদি দেখে তুমি অসুস্থ আর আমরা কিছু করিনি তাহলে আস্ত রাখবে আমাদের?
আগে উঠতে তো বল,,সব দস্যিপনা মেনে নেবো। কিচ্ছু বলবো না,শাসন করবো না।শুধু একবার উঠে বড়োমা বলে ডাকতে বল বাবা,,
প্রদীপ আর সইতে পারে না। রঘুনাথ আসতেই সরে পরে কান্না চাপাতে।রিতিকে নিজের আপন বোনের চেয়ে বেশি ছাড়া কম ভাবে না সে।তাইতো মায়াটা একটু বেশি পরিমাণে।
****
অদ্রিকা কে কোলে নিয়ে বসে আছে অখিলেশ।সামনের বারান্দায়। দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিরুপমা।চোখে বিন্দু বিন্দু জল।
কি হতে কি হয়ে গেলো বলোতো?অমন ফুটফুটে মেয়েটার এমন পরিণতি ভাবা যায়? আমাদের রূপটাও ভেঙে পড়েছে খুব তাই না? নিরুপমার কন্ঠে আক্ষেপ।
সময়েরটা সময়ে না বুঝলে কে কি করবে বলো?আমি তো জানি রূপের একটু সুদৃষ্টি পাওয়ার জন্য মেয়েটা কি কি করেছে! এখন কেঁদে কি হবে বলো?অমন মন প্রাণ দিয়ে ভালো বাসতে কজনে পারে? বুঝলোই না বোকা রূপ।
তোমরা পুরুষ জাতি টাই এমন। নারীর প্রেম ভালোবাসার মূল্য দিতে জানো না।যখন আর কিছুই করার থাকে না তখন দেবদাস হয়ে প্রেম দেখাতে পারো শুধু। তাজমহল গড়তে জানো ভালোবাসার তীব্রতা জাহির করতে।আসলে সবই শুভংকরের ফাঁকি।ভেতরে কিছু নেই।
নিরুপমার ঝাঁঝালো কন্ঠে সংকুচিত হয়ে পরে অখিলেশ।কি বলবে সে। কাঁদা টুকু যে তার গায়েও পরলো।
এখন এসব না বললেই নয় নিরু?মনটা যে বড্ড অশান্ত।
নিরু দমে যায়। মানুষটাকে দেখেই বিভ্রান্ত লাগছে।খেয়েছে কি না কে জানে।
সরি অখিল। কিন্তু একটা কথা,কবে বুঝবে তুমি,তোমরা নারীদের ক্ষত বিক্ষত হৃদয়ের যন্ত্রণা?
অখিলেশের চোখে বেদনা ঘনিয়ে আসে।রিতির পরিনতি তাকে ভেঙে দিয়েছে ভেতরে ভেতরে।সেকি পারবে কখনো নিরুর ঐভাবে নিথর হয়ে পড়ে থাকা দেখতে?
না না পারবে না।অদ্রিকাকে বুকের সাথে চেপে ধরে সে। এখানে যে আরো একজনের বক্ষ চাই তার।
****
থানার কর্মকর্তার নিজস্ব টেবিলের অপরপ্রান্তে চেয়ারে বসে রঘুনাথ। পাশের চেয়ারে তার সহযোগী টুকটাক বাক্যালাপ করে চলেছে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে।সামনে গরম চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই রঘুনাথের। অপেক্ষা করছে সে গারদের ওপাশের আসামীর জন্য।
দূর্ঘটনার পরে কেটে গেছে তিনটি দিন।সেই রাতে ঘটনা স্থল থেকে ধরা পরেছিলো লিকু সরদার সহ আরো দুজন।আমির শেখকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।বাদ পরেনি আসলাম।আজই বিকেলের দিকে ধরা পরেছে মেইন কালপ্রিট। বেনাপোল বর্ডার থেকে ধরা হয়েছে তাকে।
কনস্টেবল এসে স্যালুট জানাতেই উঠে দাঁড়ায় অফিসার। রঘুনাথ নড়ে ওঠে।
রঘুনাথ বাবু আপনার কাজ হয়ে গেছে। কিন্তু অনুরোধ একটাই প্লিজ কন্ট্রোল হারাবেন না।আমাদের ও কিছু দ্বায়বদ্ধতা আছে বোঝেন,,,ই,,, তো।
কঠোর দৃষ্টি হানে রঘুনাথ। অফিসারের গলাটা মিইয়ে আসে।মাঝে মধ্যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের কাছে তাদের হাত পা অদৃশ্যভাবে বাঁধা থাকে। তোষামোদ করতে হয় নিজের অবস্থান ঠিক রাখতে।নইলে বদলী হয়ে যেতে হবে রাঙামাটি, বান্দরবান।
ভয় নেই অফিসার। আপনি এখানেই থাকুন আমি একাই কথা বলবো আপনার আসামীর সাথে।আর রক্তের দাগ লাগানোর হলে আপনার পুলিশ ভ্যানেই লেগে যেতো এতক্ষণে।এ অব্দি অক্ষত শরীরে যখন আসতে পেরেছে তখন আর কিছু চিন্তা নেই।
অফিসার যেনো ভরসা পায়না রঘুনাথকে। রঘুনাথ এর আদ্যোপান্ত জানে সে। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসে রঘুনাথ, অফিসার এর কুন্ঠিত চোখের দিকে তাকিয়ে বলে অবজ্ঞা ভরে,,একদম ভাববেন না অফিসার,, রঘুনাথ সব নোংরা ছোঁয় না।
*****
তোমার ঐ নোংরা শার্ট প্যান্ট নিয়ে বার বার এখানে আসো ক্যানো বলোতো? সেপ্টিক হয়ে যাবে না বলো?
তুমি কি চাও আমি সেপ্টিক হয়ে মরি?
বিরূপাক্ষ একটু সরে দাঁড়ায় রিতির বেড থেকে।
সুমিতা পিসি মৃদু তিরস্কার করে রিতিকে এভাবে কথা বলার জন্য। অন্নপূর্ণা দেবী রুখে দাঁড়ান,,
রিতি তো ঠিকই বলেছে দিদি।দ্যাখো তো ছেলের চেহারা? রাস্তার পাগলের মত হয়েছে। এ কটা দিন অন্তত পাঁচশত বার সকলে বললাম কাপড় পাল্টে চান করে নিতে শুনলো কথা?
তাই বইলা ওইরকম কইতে আছে দিদি? দুঃখ তো পোলায় কম পায়নাই।কষ্ট পাইও না বাপ আমার।সখেদে বলেন সুমিতা দেবী।রিতি মৃদু হাসে। বিরূপাক্ষ একধ্যানে দ্যাখে সে হাসি।ঠিক যেনো নতুন দিনের নতুন সূর্যের প্রথম আলোক রশ্মি। কয়েকদিনের অসুস্থতার জন্য শুষ্ক হয়ে থাকা ওষ্ঠদ্বয় ও সে আলোক রশ্মির বিকিরণ খর্ব করতে পারে নি।
রাতের মধ্যভাগে জ্ঞান ফিরেছে রিতির। শরীরের তাপমাত্রা নরমাল এখন। কিন্তু ক্ষতস্থানের তাজা ঘা- এর বেদনা কমেনি একটুও। তারউপর রূপদার এমন পাগল পাগল ছন্নছাড়া চেহারা ভেতরে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে বার বার।পরিপাটি, ছিমছাম মানুষটিকে এভাবে নিতে পারছে না সে। অখিলেশ দেখে শুনে মৃদু হাসছিলো।বিরূপাক্ষের আকুল চাহনির অর্থ তার প্রেমিক মনের বুঝতে বাকী রইল না।
মাসিমা চলুন ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নেবেন। সারাটা রাত তো চোখের পলক ফেললেন না। রূপ তুই নাহয় একটু কষ্ট করে থাক এখানে।আমি মাসিমাদের নিয়ে যাচ্ছি।
সুমিতা দেবী সাদাসিধে মানুষ অত কিছু বোঝে না,যেতে চাইলো না কোথাও। অন্নপূর্ণা দেবী সবটা বুঝে নিলেন নিমেষেই।
ফিনাইলের ঝাঁঝালো গন্ধ ভরা নিস্তব্ধ কেবিন। ঘড়ির টিক টিক শব্দ ছাড়া আর কিছুই কর্নগোচর হচ্ছে না।কারো মুখে কোন কথা নেই।প্রথমে মুখ খুললো রিতি,জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো ধীর স্বরে,,
আমার গলা বুক শুকিয়ে আছে। ঠোঁট শুকিয়ে ফেটে গেছে দেখো,
বিরূপাক্ষ উদগ্রীব হয়ে এগিয়ে আসে এক পা।
জল খাবি বুড়ি?তেষ্টা পেয়েছে?
রিতিকে ছুঁতে যাবে অমনি স্যালাইনের ঝ নড়ে উঠলো,, থেমে যায় বিরূপাক্ষ।
খবরদার ছোঁবে না আমাকে?
বিরূপাক্ষ স্তব্ধ রিতির ব্যবহারে।কষ্টের পাহাড় জমলেও কিছুই করার নেই, এরচেয়ে বেশি তার প্রাপ্য।
রিতির শুষ্ক ঠোঁটের ডগায় পূনরায় মৃদু হাসি,,
চান(স্নান) টান করে পরিস্কার হয়ে আসো তো যাও। আমার একটা দীর্ঘ ভেজা চুমু লাগবে।না হলে কিছুই সিক্ত হবে না।বড্ড কাঠখোট্টা হয়ে আছে সবটা।
বিরূপাক্ষ শুষ্ক গলায় বিষম খায়। ভ্রু কুঁচকে তাকায় রিতির দিকে।মাথাটা কি গেলো মেয়েটার? তাকায় মুখের দিকে।
না তো সেখানে কোনো তিরস্কার নেই।আর না আছে এ কদিনের জ্ঞানহীনতার চিহ্ন।
সফেদ এপ্রোন পরিহিত ডাক্তারের কথায় স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বিরূপাক্ষ,,
মিস্টার রায় চৌধুরী, এবার যে পেশেন্টকে ছাড়তে হবে,, উজ্জ্বল হাসি ডাক্তারের ঠোঁটে।সাথে আসা সেবিকা হাসছে।
রসিকতা করতে ছাড়ে না সমবয়সী ডাক্তার,,যান তাহলে ভিজে আসুন,, রোগীনির চাহিদা বলে কথা।
ওহ্ শিওর ডক্টর!আসছি আমি। অপ্রস্তুত হয়ে গেছে বিরূপাক্ষ।এমন মশকরায় অভ্যস্ত নয় সে।
******
গতকাল শেষ রাতের দিকে অখিলেশ এর চিৎকারে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে বিরূপাক্ষ। অখিলেশ হাঁফাতে হাঁফাতে যা বললো তার মর্মার্থ এই যে,
রিতির জ্ঞান ফিরে আবার হারিয়েছে।
এটুকুই যথেষ্ট ছিলো বিরূপাক্ষ’র কাছে।বৌদিদিকে জড়িয়ে ধরে সেকি কান্না।এই কয়টা দিন বিরূপাক্ষের চোখে অশ্রু কেউ দেখেনি।সে কারো সাথে একটা বাক্য ব্যয় করেনি।সবাই শংকিত ছিলো চাপা স্বভাবের ছেলেটা অবশেষে কিছু একটা করে না বসে। অখিলেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তাড়া দেয়।স্নান,আহার দূরে থাক রক্ত শুকানো পোশাক টাও পাল্টানোর সময় ছিলো না বিরূপাক্ষের।বেশ খানিকটা সময় পরে যখন হাসপাতালে পৌঁছোলো তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে।রিতির জ্ঞান ফিরেছে পরিপূর্ণ ভাবে।পালস্ রেট স্বাভাবিক, শরীরের আগুন লাগা তাপমাত্রা ও নেমে এসেছে।
ডক্টর,আউট অফ ডেঞ্জার বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন।
****
রঘুনাথ হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরতেই জয়া আগ্রহভরে এগিয়ে যায় তার দিকে।রিতির জ্ঞান ফিরেছে শুনে সেই যে মন্দিরে পরেছিলো আর একটু আগে উঠেছে। রঘুনাথ ও অনুরূপ ভাবে এগিয়ে যেতেই থমকায় জয়া,কড়া সুরে বলে,,আগে গিয়ে স্নানটা সেরে নাও তারপর আমাকে ছোঁবে। কোথায় যেন যাবে বলেছিলে?
রঘুনাথ হাসে,
কি ভাবো তুমি আমাকে?ঐ নোংরা আমি ছুঁই নি। কিন্তু খুব ভালো ব্যবস্থা করেছি।জীবনেও আর সূর্যের আলো দেখবে না বুঝলে।
আমার ভুলের মাশুল আমার প্রানের মানুষগুলো দিচ্ছে সে অপরাধ বোধ মনটাকে নিচু করে রেখেছে জয়া?
গলাটা ভারী হয়ে আসে রঘুনাথের।জয়া স্বামীর বেদনায় ভীত হয়ে পরে,
এমনটা আর ভেবো না।রিতি ফিরছে সুস্থ হয়ে,ভাই চোখে হারাচ্ছে তাকে এর চেয়ে আর আনন্দের সংবাদ কি হতে পারে। এবার আমাদের সব ভাল হবে। স্বামীকে শান্তনা দেয়।
অর্পিতা নামটা একটা বিভীষিকা আমাদের কাছে।সেটা যেনো ভুলেও আর উচ্চারণ করো না।আর কিন্তু ছাড় পাবে না তুমি।
সে নামটা ভুললেও চলবে না জয়া। আমার কলিজাতে আঘাত করেছে সে।অত সহজে ছাড়লে চলবে?? কঠোর হাসি ফুটে উঠল রঘুনাথের মুখে।
যে দুজন আছে আর যে আসছে তিনজনই আমার আত্মা। তাদের পথ আমি নিজ দায়িত্বে কন্টকমুক্ত করবো জয়া।
চলবে,,,,,