#গ্যাসবেলুন
#পর্ব_৩
লেখাঃ #Nobonita_Ferdows
অরূপের কোলে বাচ্চা একটা মেয়ে। প্রায় আট-নয় মাস বয়সের বাচ্চা মেয়েটার হাতে একটা ছোট্ট টেডি বিয়ার। একহাতে টেডিবিয়ার ধরে, অন্য হাতে টেডির মাথায় হাত দিয়ে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে! অরূপ মুগ্ধতা ছড়ানো একটা হাসি নিয়ে বাচ্চার দিকে তাকিয়ে আছে!
.
অরণী ছবিটা হাতে নিতে যেতেই পেছন থেকে অন্তু এসে ধরলো।
.
“অরুপু কি করো? মা তোমার চা নিয়ে ঘুরছে। তোমাকে নাকি খুঁজে পাচ্ছেনা। আর তুমি ভাইয়ার ঘরে বসে আছো?”
.
“স্যরি! ভুলেই গিয়েছিলাম চায়ের কথা! আচ্ছা এই বাবুটা কে? তোমার ভাইয়ার কোলে?”
অন্তু কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে অরণীর দিকে মেকি হাসি হেসে বললো, “ও তো আমার একটা ভাস্তি, মাধুর্য! ও তুমি চিনবেনা!”
.
এতটুকু বলেই অরণীকে টানতে টানতে তার ঘরে নিয়ে গেলো!
.
“আসো আসো। তোমার চা বুঝি ফুরিয়েই এলো!”
অরণীর আর প্রশ্ন করা হলোনা, অরূপের ঘর এত পুতুল দিয়ে কেনো সাজানো!
.
.
আজকের দিনটা অরণীর গতদিনের মতো খারাপ গেলোনা। গতদিন বাড়ির জন্য মন খুব কেমন কেমন করছিলো। আজ সারাদিন এতো মানুষের মাঝে তার ভালোই লাগলো।
কাল থেকে তাকে আবার ভার্সিটি যেতে হবে। ভার্সিটি খুব একটা কাছেনা, আবার বেশিদূরও না। আতাহার সাহেব অরণীকে ভার্সিটিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিদিন গাড়ি পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। অরণী নিষেধ করে দিয়েছে। এতদিন যে গণ্ডির ভেতর সে ছিলো, তা তার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে বিধায় এর বাইরে আসতে সে চাচ্ছিলোনা।
কিন্তু একবার যখন গণ্ডি পেরিয়ে প্রথমবারের মতো বাইরে এসেছে, সে একটু অন্যভাবেই এবার চলতে চায়!
.
.
রিকশায় তার ভার্সিটি যেতে মোটে একঘণ্টার মতো লাগে, রিকশাওয়ালা দ্রুত প্যাডেল চালালে তার আগেও কখনো কখনো পৌঁছে যায়!
.
অরণীর আজও সকালে উঠতে উঠতে নয়টা পেরিয়ে গেলো। উঠে নাস্তা সেরে নিয়ে ভার্সিটির জন্য রেডি হয়ে যেই বেড়োতে যাবে, অরূপের সাথে দেখা হলো! গতদিনের মতোই শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গোটাতে গোটাতে নিচে নামছে।
.
অরণী বাসা থেকে বেরোলো সাড়ে দশটায়। বাসার গলির রাস্তাটুকু হেঁটে চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে রিকশা খুঁজছিলো। আজ আকাশের অবস্থা খুব একটা সুবিধার ঠেকছেনা। ঝড় হতে পারে। অরণী দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়তে লাগলো! অরণী ছাতা খুলে মাথায় ধরলো! ভাগ্যিস বেরোনোর সময় ছাতাটা সাথে নিয়েছিলো!
.
এর কয়েক মিনিট পরেই অরূপকে বাইক নিয়ে তার সামনে দিয়ে চলে যেতে দেখলো! অরণীর কেমন মন খারাপ হলো। বাড়ির মেহমান রাস্তায় বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে রিকশা পাচ্ছেনা। তাকে রিকশা ডেকে দেয়াটা তো ভদ্রতার মধ্যেই পড়ে! এতটুকু ভদ্রতাও কি নেই ছেলেটার?!
.
প্রায় পনেরো মিনিট দাঁড়ানোর পর অরণী রিকশা পেলো। বৃষ্টির দিন রিকশাওয়ালাগুলোরও যেন ভাব বেড়ে যায়! কোথাও যেতেই চায়না, গেলেও দ্বিগুন, তিনগুণ ভাড়া চেয়ে বসে!
.
অরণীর ক্লাস শেষ হলো আড়াইটায়! বাইরে তখনো বৃষ্টি হচ্ছে; সকালের তুলনায় বৃষ্টির বেগ বেড়েছে এখন! অরণী ভার্সিটির ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিলো পাঁচটা পর্যন্ত। এর আগে কখনো এতসময় সে ভার্সিটিতে বসে আড্ডা দেয়নি। আগে দুপুর দুটা বাজতে না বাজতেই গেটের সামনে গাড়ি এসে দাঁড়াতো। আজ কেউ তাকে নিতে আসবেনা ভাবতেই নিজেকে স্বাধীন মনে হচ্ছিলো অরণীর। পাঁচটার দিকে ছাতা মাথায় সে কলেজ থেকে বেরোলো।
.
সকালে তবুও দুএকটা রিকশা দেখা যাচ্ছিলো রাস্তায়। এখন তাও দেখা যাচ্ছেনা। অরণী অপেক্ষা করতে করতে শেষে বাধ্য হয়ে ভার্সিটির সামনে থেকে কিছুদূর ছাতা মাথায় হেঁটে গেলো। হঠাত কাছের চায়ের টঙে সকালের সেই কালো শার্ট দেখে ভালো করে লক্ষ্য করলো।
.
চোখের চশমাটা ভিজে যাওয়ায় সবকিছু ঝাপসা দেখছে সে! ঝাপসা চোখেও সে অরূপকে স্পষ্ট দেখতে পারলো। কালো শার্ট ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে! বৃষ্টির মধ্যেও বামহাতের ঘড়িটা অরূপ খুলে রাখেনি। অরণীর মনে হলো, সে ডেকে বলবে, “আপনার ঘড়িটা তো ভিজে যাচ্ছে!”
.
সে বললোনা! রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। অরূপ চা শেষ করে চায়ের বিল মিটিয়ে স্টল থেকে বেড়িয়ে সামনে তাকালো। অরণীর দিকে একবার খেয়াল করে যেন তাকে না চেনার ভান করে বাইকে চেপে স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো! অরণী তাজ্জব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। অরূপ কি সত্যিই অরণীকে চিনলোনা? নাকি গুরুত্বই দিলোনা!
.
অরণী বাড়ি ফিরলো সন্ধ্যা সাতটায়; পুরোপুরি সিক্তকাপড়ে।
.
ছোটফুপু খুব রাগ করলেন। এরপর থেকে এতটা সময় বাড়িতে না জানিয়ে বাইরে থাকতে নিষেধ করে দিলেন বারবার করে। আতাহার সাহেবও ফোন করে বকা দিলেন… অন্তুর মা নিজে টাওয়েল এনে মাথা মুছে দিলেন অরণীর।
.
অরণী রাতেরবেলা ডিনার শেষ করে তার ঘরে বসে অন্তুর গল্পের বইগুলোর পাতা ওল্টাচ্ছিলো। অন্তুও তার পাশে বসে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে ফোন টিপছে! হঠাত দরজায় নক শুনে মুখ তুলে তাকালো অরণী।
.
“অন্তু এতরাতে ফোন টিপছিস কেনো? পড়া না থাকলে ঘুমিয়ে পড়!”
.
অন্তু খেয়াল করেনি! অরণী ধাক্কাদিতেই সামনে তাকিয়ে তড়িৎ কান থেকে ইয়ারফোন খুলে ফোন বালিশের নিচে ঢুকালো।
“ভাইয়া, কিছু বলবা?”
.
“ফোনে কি? লুকালি কেনো ওভাবে? দে তো দেখি ফোনটা!”
অন্তুর মুখটা পুরোপুরি চুপসে গেলো!
.
“কি হলো? দে ফোনটা?”
.
অন্তু কাঁচমাচু চেহারায় বালিশের নিচ থেকে ফোনটা বের করে দিলো। অরূপ এতক্ষণ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো। এখন ফোনটা নিতে ঘরে ঢুকলো। ফোনটা হাতে নিয়ে ফোনের স্ক্রিনে স্ক্রল করতে করতে বললো,
“ফেসবুক আইডি খুলেছিস, বলিসনি তো আমাকে? মা জানে?”
.
অন্তু ক্ষীণস্বরে বললো, “হ্যাঁ জানে!”
.
অরূপ ফোন টিপতে টিপতে বললো, “পড়া নাই তোর? মানুষের ঘরে কেনো বসে আছিস এতোরাতে?”
.
অন্তু চুপ করে আছে!
.
অরূপ ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে বললো, “রাতে যেনো আর ফোন ধরতে না দেখি। এসবে বেশি সময় নষ্ট করিসনা! আর এখন যা, নিজের ঘরে যা!”
.
তারপর ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে বললো, “তোর মেহমান আপুকে বলে দিবি, আমাদের বাড়ির মেয়েরা ভার্সিটির শেষে ক্যান্টিনে এতক্ষণ আড্ডা দেয়না। রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালোনা; আজকাল আবহাওয়াও তেমন ভালো যাচ্ছেনা! বেশি বৃষ্টি হলে যেনো ভার্সিটি না যায়। এক-দুদিন মিস দিলে এমন কিছু ক্ষতি হয়ে যাবেনা।”
.
অরণী হা করে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকলো! উনি যদি জানেনই রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালোনা, তবে ওভাবে ফেলে এলো কেনো!
.
অন্তু বললো, “তুমি কিছু মনে করিওনা, অরুপু। ভাইয়া একটু অমনই; মুখের ওপর কথা বলে দেয়!”
.
“হুম। বুঝতেই পারছি। তোমার ভাইয়ার মুখে কথা আটকায়না!”
.
“ভাইয়া কিন্তু খুব চাপা স্বভাবের, কম কথা বলে।”
.
“তোমার ভাইয়া যতটুকু কথা বলে, সব কি এমন রাগ হয়েই বলে? ভালো করে কথা বলতে পারেনা?”
.
অন্তুর হঠাত ফোন বেজে উঠলো। ও ফোনে কথা বলতে বলতে বারান্দায় চলে গেলো। অরণীর এত তাড়াতাড়ি ঘুম আসেনা। আজও আসছেনা; জ্বরজ্বর লাগছে! বৃষ্টির মধ্যে বাইরে যাওয়া আসলেই ঠিক হয়নি!
.
অরণী শুয়ে শুয়ে এলোমেলো অনেক চিন্তা করতে থাকলো। অন্তু বারান্দা থেকে ফিরে বললো, “অরুপু, আজ আমি তোমার কাছে ঘুমাই?”
.
“আন্টি রাগ হবে না তো?”
“আরে না!”
.
“তোমার গোমড়ামুখো ভাইয়া যদি রাগ হয়?”
.
“হলে হবে! হুহহ!”
.
অরণী হাসলো! তার সকালে দেখা ছবিটার কথা মনে পড়লো। কি দারুণ হাসি ছেলেটার; এমন হাসির জন্য তো হাজারো মেয়ে প্রেমের জলে ডুবে মরতে পারে। তাহলে এই ছেলেটা হাসে না কেনো? সারাদিন কেমন রামগরুড়ের ছানার মতো মুখ করে থাকে।
.
“আচ্ছা অন্তু, তোমার সাথে তোমার ভাইয়ার বয়সের পার্থক্য কত?”
.
“পনেরো বছর! জানতাম তুমি এটা প্রশ্ন করবা! প্রায় সবাই আমাকে এই প্রশ্ন করে!”
.
“এতবড় তোমার চেয়ে! দেখে তো মনে হয়না!”
.
“ভাইয়াকে দেখলে বয়স বোঝাই যায়না, এটাও বলে সবাই!”
.
“বিয়ে করেনি কেনো তোমার ভাইয়া?”
.
“করতে চায়না। মা এতো বলে, কিন্তু ভাইয়া রাজিই হয়না!”
.
“কেনো?”
.
“জানিনা!”
.
“ও। আচ্ছা ঘুমাও তুমি। সকালে স্কুল আছে তো তোমার!”
.
অরণী পাশ ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করতে থাকলো।
.
.
মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেলো অরণীর। উঠে বসে অস্থির হয়ে এদিকওদিক তাকালো। তারপর বিছানা ছেড়ে নেমে বারান্দায় গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো! একই স্বপ্ন সে প্রায়ই দেখে। সবগুলো স্বপ্নে মা জীবিত থাকে, আর কেউ তার মাকে তার সামনেই খুন করে মেরে ফেলে! এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা অরণী জানেনা। অরণীর মায়ের দুইটা কিডনীই নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। তার মৃত্যু হয় হাসপাতালের বিছানায় ছটফট করতে করতে। এই স্বপ্নে অরণী টগবটে যুবতী, অথচ তার মা যখন মারা যায়, তখন অরণী কেবল ক্লাস ফাইভে পড়তো! স্বপ্নের সাথে বাস্তবের আকাশ-পাতাল ব্যবধান। অরণী প্রতিবার এই স্বপ্ন দেখে লাফিয়ে ওঠে। সারারাত তখন আর তার ঘুম হয়না! বাইরে ঠান্ডা বাতাস। অরণী ঘরে ঢুকে আলমিরা থেকে চাদর বের করে গায়ে মুড়ে নিয়ে ঘর থেকে বেরোলো।
.
অরূপের ঘরে নীল আলোর বাতি জ্বলছে! ঘরের ভিতর থেকে গিটারের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে! দরজা পুরোপুরি বন্ধ না, হালকা ভেজানো। অরণী দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। ভিতরে গেলোনা। ভেজানো দরজার আড়াল থেকে ভেতরটা অস্পষ্ট হলেও বোঝা যাচ্ছে! অরূপ দেয়ালে হেলান দিয়ে বিছানায় বসে গিটারে সুর তুলছে! আচমকা গলা ছেড়ে গান ধরলো।
.
অরণী মুগ্ধ হলো। একটা মানুষের কন্ঠ এতটা আলোড়ন তুলতে পারে?! অরণী দাঁড়িয়েই রইলো স্থিরভাবে! হঠাত করেই গানটা থেমে গেলো। অরূপ দ্রুতপায়ে ঘর থেকে বেড়িয়েই বললো,
“আপনি? আপনি এখানে কি করছেন?”
.
অরণী থতমত খেয়ে বললো, “জি মানে, আমি পানি খেতে উঠেছিলাম! আওয়াজ শুনে…..”
তারপর একটু থেমে আবার বললো,
“আপনার গানের গলা বেশ ভালো”
.
অরূপ কন্ঠে যথেষ্ট কাঠিন্য এনে বললো, “মাঝরাতে কোনো ছেলের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকাটা বোধহয় তেমন শোভা পায়না!”
.
অরণী কি বলবে বুঝতে পারলোনা! কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অরূপের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
.
অরূপ আর দাঁড়ালোনা! অরণীর মুখের ওপর শব্দ করে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।
.
অরণীর চোখে পানি এসে গেছে। এতবড় মেয়ের মানুষের কথা শুনে কেঁদে ফেলাটা হয়তো বেমানান। কিন্তু অরণী কেঁদে ফেললো। এভাবে যে কেউ তাকে অপমান করতে পারে, সেটা তার ধারণারও বাইরে ছিলো। অরণী নিচে গিয়ে রান্নাঘর থেকে মামপটে করে পানি এনে মাথার কাছে রাখলো। সারারাত আর তার ঘুম হলোনা!
.
.
অরণী এরপরের দুদিন আর কলেজ গেলোনা। বাড়িতেই থাকলো। অরূপের সামনে সেদিনের পর থেকে সে পারতপক্ষে যাওয়া বন্ধ করে দিলো! অন্তু বলেছিলো, অরূপ বিয়ে করতে চায়না; অরণীর মনে হলো, অরূপকেই কোনো মেয়ে বিয়ে করতে চায়না!
.
আজরাতেও অন্তু অরণীর কাছে ঘুমাতে এলো! হঠাত ফোন টিপতে টিপতে বললো, “অরুপু, তোমাকে একটা কথা বলি, তুমি কাউকে বলবেনা তো?”
.
“না। বলবোনা।”
.
“আমি তোমাকে বলেছি শুনলে, ভাইয়া খুব রাগ করবে আমার ওপর!”
.
“আরে বোকা মেয়ে, তোমার ভাইয়াকে আমি কেনো বলতে যাবো?”
.
অন্তু বললো, “আসলে তুমি সেদিন যে ছবিটার কথা বলেছিলে, ওটা….
.
.
চলবে….