#গ্যাসবেলুন
#পর্ব_৬,৭
লেখাঃ Nobonita Ferdows
৬
অরণী পিছনে ফিরে তাকাতেই অরূপ অরণীর হাত টেনে তাকে তার ঘরে ঢুকিয়ে দরজার ছিটকিনি ভেতর থেকে লাগিয়ে দিলো!
.
অরণী বুঝতে পারলোনা অরূপ হঠাত তাকে ঘরে ঢুকিয়ে কেনো দরজা দিলো! অরূপ সরাসরি অরণীর চোখ বরাবর তাকালো। সেই দৃষ্টিতে কি যেনো ছিলো, যার দরুণ অরণীর ভয়ে গলা শুকিয়ে আসলো। চোখ বড় বড় করে অরূপের দিকে তাকিয়ে যেন নিশ্চুপ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো সে।
.
“এভাবে ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে তাকানোর কিছু নেই। আপনি ছোটচাচির ভাইয়ের মেয়ে, আমাদের বাড়ির আত্নীয়। এইমাত্র যে কথাটা আপনি আমাকে বলেছেন, সেটার উত্তরে আমি আপনাকে কিছু কথা বলবো। আর আজ আমাদের মধ্যে যা যা কথা হবে, সেগুলো বাড়ির অন্য কারো কানে উঠুক আমি চাইনা। এবার বুঝতে পারছেন, কেনো আমি দরজা লাগালাম?” অরূপ জোরালো কন্ঠে কথাগুলো বলে উত্তরের অপেক্ষায় অরণীর দিকে তাকালো।
.
অরণী উত্তর দিলোনা৷ আগের মতোই ভয়ার্ত দৃষ্টিতে মাথা কাত করে জানান দিলো যে সে বুঝতে পেয়েছে।
.
.
“দেখুন অরণী, আপনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। বাবার আদরের মেয়ে। বাইরের জগৎ, বাস্তবতা সম্বন্ধে আপনার কোনো ধারণা নেই। তাই হয়তো আপনার মনে এমন কিছু এসেছে। আমি আপনার কাছ থেকে এমন কোনোকিছু এক্সপেক্ট করিনা। আশা করি, আপনি এই ব্যাপারটা নিয়ে পরবর্তীতে আর কথা তুলবেন না!” অরূপ খুব ধীরে ধীরে স্পষ্ট উচ্চারণে কথাগুলো বললো।
.
অরণী নাছোড়বান্দা বাচ্চা মেয়ের মতো বললো, “অরূপ, আপনি বিশ্বাস করুন, আমি সত্যি মন থেকেই আপনাকে ভালোবাসি।”
.
অরূপের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। চট করে ধমকে বলে উঠলো, “শাট আপ! আপনি কি দয়া দেখাতে চাচ্ছেন আমাকে? আপনার কি মনে হয়, আমি অসহায়, আমার কাউকে দরকার? আপনি তাহলে ভুল ভাবছেন৷ দেখুন অরণী…”
.
“না না, আপনি ভুল বুঝছেন আমাকে। আমি কেনো দয়া করতে যাবো আপনাকে?” অরূপকে থামিয়ে অস্থির হয়ে বললো অরণী।
.
“শুনুন, আমার কোনো সিমপ্যাথির প্রয়োজন নেই। একটা বিবাহিত ছেলেকে, যার একটা সন্তান আছে, হুট করে এসে কেউ তার প্রেমে পড়েছে বললেই তো আর তা সত্যি হয়ে যাবেনা! আমি আপনাকে অপমান করতে চাচ্ছিনা। আপনি এক্ষুনি আমার ঘর থেকে বেড়িয়ে যাবেন। পরবর্তীতে আমার আশেপাশে যেনো আমি আপনাকে ঘুরঘুর করতে না দেখি!”
.
.
অরণী নিজেকে আর আটকাতে পারলোনা। দরজার ছিটকিনি খুলে ছুটে নিজের ঘরে চলে গেলো। ধরাম করে অরূপের ঘরের দরজা লাগানোর শব্দে অরণীর চেপে রাখা কান্নার বেগ যেনো আর বাঁধা মানলোনা। ঘরে ঢুকে ঘরের দরজা লাগিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো অরণী। সে এখনো মানতে পারছেনা অরূপ তাকে এভাবে মুখের ওপর অপমান করতে পারে।
.
.
ছোটবেলায় অরণী বাবার মুখে মা-বাবার প্রেমকাহিনী শুনেছিলো। তাদের প্রেমের শুরু হয়েছিলো বিয়ের পর৷ সেইযুগে বিয়ের আগে ছেলেমেয়ের প্রেম যেনো বিশাল অপরাধ ছিলো। বাবা-মা দুজনেই ছিলেন রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান; বিধায় কোনোদিন প্রেমের সম্পর্কে জড়ানোর কথা ভাবতেও পারতেন না তারা। পারিবারিক সিদ্ধান্তে বিয়ের পর বেশ কয়েকমাস তাদের মধ্যে সম্পর্কটা ছিলো শুধুই বন্ধুত্বের; একছাদের নিচে থাকতে হলে মিলেমিশে যতটা থাকা প্রয়োজন ততটাই। বিয়ের পর একসময় দুজনেই দুজনকে বুঝতে শুরু করে; প্রথম প্রেমে পড়াটা তখনই। দুজন দুজনকে জেনে প্রথম অনুভব করা!
.
.
অরণী তেমন কাউকেই খুঁজে এসেছে বরাবর। প্রথম যাকে দেখলেই মনে হবে, “এই মানুষটাকেই আমি ভালোবাসি।” আর তখন সেই মানুষটার রাগ, বিরক্তি, অবজ্ঞা, খারাপ-ভালো সবকিছু মিলেই ভালোলাগাটা রয়ে যাবে৷ মানুষটার কোনোকিছুর জন্যই ভালোলাগা কমবেনা, বরং বেড়েই যাবে।
.
অরণী অরূপকে দেখে তেমনটাই ভেবেছিলো৷ তাই হয়তো, অরূপের বিয়ের কথা, ডিভোর্সের কথা, মাধুর্যের কথা, কোনোকিছুই অরণীর ভালোলাগার লাগাম টানতে পারেনি। অরূপের এমন ব্যবহারে অরণীর সকল আশা, আকাঙ্ক্ষা যেন ধূলিসাৎ হয়ে গেলো; কিন্তু মনের মধ্যে সুপ্ত ভালোবাসাটুকু এতটুকুও কমলোনা।
.
অরূপের জীবনেও কেউ এসেছিলো। নয়-নয়টা বছরের প্রেম, সাংসারিক জীবন, প্রথম সন্তান, সবকিছুর অসম্ভব সুন্দর মুহূর্তের সাথে সাথে তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে। এতকিছুর পর দ্বিতীয়বার কাউকে ভালোলাগা, কাউকে জীবনসঙ্গী করার মানসিকতা তার হয়তো হয়ে ওঠেনি; কিংবা সে বিশ্বাসই করতে পারছেনা, কেউ তাকে এভাবেও পছন্দ করতে পারে!
.
অরণী নিজেকে নিজেই বোঝালো। সে আর অরূপকে এসব নিয়ে কোনো কথা বলবেনা। নিজের ভালোলাগাটুকু নিজের কাছেই সুপ্ত করে গোপন বাক্সে তালাবদ্ধ করে রাখবে!
.
.
এরপরের কয়দিন অরণী অরূপের সামনেই গেলোনা। নানান অজুহাতের বাহানায় বারবার এড়িয়ে গেলো অরূপকে। অরূপও নিজের মতোই চুপচাপ রইলো।
.
সেদিন সন্ধ্যেবেলা আতাহার সাহেব ফোন করতেই অরণী বললো, “বাবা, আমার এখানে আর ভালো লাগছেনা! আমি বাড়িতেই ভালো ছিলাম!”
.
“কেনো মা? ওখানে এত মানুষের মাঝে তো মন খারাপ হওয়ার কথা না! কিছু হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?”
.
“না। কে কি বলবে? আমার একা একা থাকার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। এত মানুষ ভালো লাগেনা!”
.
“একা একা থাকলে চলবে? আমি থাকিনা… তোকে একা রাখতে তো ভয় হয়! তাছাড়া তোর খেয়াল রাখার তো কেউ নেই!”
.
“কিসের ভয়? আর আমি নিজের খেয়াল নিজে রাখতে পারি!”
.
“তোর কি সমস্যা হচ্ছে রেনুর বাসায়, সত্যি করে বলতো?”
.
“কিছুনা। আচ্ছা, থাক, এখানেই থাকবো!”
অরণী জানে, সে বাবাকে রাজি করাতে পারবেনা।
.
.
“অরুপু, মা খেতে ডাকছে। চলো নিচে যাই!”
অরণী যাচ্ছি বলে নিচে নামলো। অরূপ বসে আছে টেবিলে। অরণী থমকে দাঁড়িয়ে পিছনে ঘুরে ওপরে যেতে চাইছিলো। হঠাত ছোটফুপু ডেকে বললো, “কিরে, আবার যাচ্ছিস কেনো উপরে?”
.
“ফুপু, একটা ফোন করতে হবে আমাকে। মনে ছিলোনা; কেবল মনে পড়লো। আমি পড়ে এসে খাবো!”
.
“চাচি, আপনার আত্নীয়কে বলে দিবেন, এবাড়িতে খাওয়ার সময় সবাই একসাথেই খায়।”
.
ছোটফুপু বললেন, “আচ্ছা থাক না, ওর হয়তো সত্যিই দরকারী ফোন করতে হবে!”
.
“পরে ফোন করে নিবো।”
অরণী পুরোপুরি অনিচ্ছায় টেবিলে এসে বসলো।
.
অরূপ নিজের মতো চটপট খেয়ে উঠে চলে গেলো। অরণীর খাওয়া হলোনা। আনমনে খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকলো।
.
পরদিন ভার্সিটিতে এক্সট্রা ক্লাস করতে করতেই তিনটা বেজে গেলো। অরণী ক্লাসশেষে বন্ধুদের সাথে গল্প করতে করতে ভার্সিটি থেকে বেরোচ্ছিলো। সবাই যে যার মতো চলে যাওয়ার পর অরণীর ব্যাচমেট সাদিক আর অরণী থেকে গেলো। সাদিক অরণীর স্কুলফ্রেন্ড ছিলো, বন্ধুত্বটা ছোটবেলা থেকেই অনেক ভালো। এই একটা ছেলেবন্ধুর সাথেই অরণী একটু মিশুক। দুজনে একই দিকেই যাবে বিধায় একটা রিকশাতেই দুজনে উঠে বসলো।
.
সাদিক অরণীকে ফুপুবাড়ির গলির মাথায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। অরণী হেটে এসে বাড়িতে ঢুকলো। বাসায় ফিরতে ফিরতে চারটা পেরিয়ে গিয়েছে।
ছোটফুপুকে খেতে দিতে বলে গোসল করতে বাথরুমে ঢুকে গেলো সে। শাওয়ার নিয়ে ভেজাচুল টাওয়েলে পেঁচিয়ে লং টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরে বের হলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল মুছতে গিয়ে আয়নায় চোখ পড়তেই ভয়ে চমকে উঠলো অরণী। অরূপ অরণীর ঘরের বন্ধ দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অরণীর চিৎকার করতে ধরতেই অরূপ এসে তার মুখ চেপে ধরলো।
.
অরণীর কানের কাছে ঠোঁট এনে বললো, “ছেলেটা কে?”
.
অরণীর মুখের ওপর থেকে হাত সরালো অরূপ।
“মানে? কোন ছেলে?”
.
“যে ছেলেটার সাথে কলেজ থেকে এক রিকশায় ফিরলেন?”
.
“সেটা আমি আপনাকে কেনো বলবো?”
.
অরূপ যেনো একথায় কিছুটা দমে গেলো।
একটু থেমে আবার বললো, “ছেলেটা কে তাতে আমার কোনো যায় আসেনা! কিন্তু আমাদের বাড়ির মেয়েরা ভাই কিংবা স্বামী ছাড়া পরপুরুষের সাথে এক রিকশায় ঘুরে বেড়ায়না।”
.
“আমি তো আপনাদের বাড়ির মেয়ে না!”
.
“কিন্তু এখন আপনি আমাদের বাড়িতেই আছেন। আর তাই বাড়ির নিয়ম কানুন আপনাকে মানতে হবে। বুঝেছেন?”
.
অরূপ অরণীর উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে যাওয়ার জন্য পিছনে ঘুরলো। দরজাটা খুলে দাঁড়িয়ে অরণীর দিকে না ঘুরেই বললো, “ভবিষ্যতে ওই ছেলেকে যেনো আপনার আশেপাশে না দেখি!”
অরূপ বেড়িয়ে গেলো। অরণী গিয়ে ঘরের দরজা ভিতর থেকে লাগিয়ে এসে বিছানার ওপর বসলো।
.
“মগের মুল্লুক নাকি? উনার আশেপাশে আমার থাকা যাবেনা, আবার আমার আশেপাশে অন্য কোনো ছেলের থাকা যাবেনা! সব কি ওনার কথামতোই হতে হবে নাকি? যত্তসব!”
.
.
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিচে নেমে অরণী দেখলো, ছোটফুপু, ছোটফুপা, আন্টি, আংকেল, অরূপ সবাই ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে কোনো বিষয়ে কথা বলছে৷ সবার মুখে থমথমে একটা ভাব। অন্তু সিড়ির মাথায় লুকিয়ে শোনার চেষ্টা করছে, কি নিয়ে কথা হচ্ছে। অরণীকে দেখেই অরণীর হাত টেনে ধরে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বললো, “অরুপু, তুমি কি কিছু জানো কি হয়েছে?”
.
“নাতো! কি হয়েছে?”
.
“আমিও তো জানিনা৷ মনে হয়, ভাইয়াকে নিয়ে কোনোকিছু!”
.
অরণীর বুকটা ধ্বক করে উঠলো। তবে কি অরূপের বিয়ে নিয়ে কোনো কথা হচ্ছে? অরূপ যদি বিয়েতে রাজি হয়ে যায়?
.
অরণীও অন্তুর সাথে সাথে কান পাতলো কিছু যদি শোনা যায়। সেই আশায় পানি ঢেলে ছোটফুপু ড্রয়িংরুম থেকে অন্তুর উপস্থিতি বুঝতে পেরে খেঁকিয়ে উঠলো, “কি রে অন্তু, কি করিস তুই ওখানে?”
.
অরণী সাথে সাথে দৌড়ে দোতলায় উঠে গেলো। অন্তু চোখমুখ কাঁচুমাচু করে অরণীর দিকে তাকিয়ে বললো, “কিছুনা চাচি। খিদা পাইছে৷ তাই বলতে আসছিলাম!”
.
ছোটফুপু অরণীকে খেয়াল করেনি। তিনি উঠে এসে নাস্তা গরম করে দিলেন অন্তুকে। তারপর সবাইকে খেতে ডাকলেন; অরণীকেও ডাকলেন। অরণী কিছুই জানেনা, এমন ভাব নিয়ে দোতলা থেকে নেমে এসে খেতে বসলো। অন্তুর চোখে চোখ পড়তেই ফ্যাকাসে হাসি হাসলো।
.
অরণীর সারাটাদিন খারাপ কাটলো। বাড়িতে খুব বড় ধরণের কোনোবিষয় নিয়ে কথা চলছে। তাকে কেউ কিছু বলছেনা। অন্তু বারবার আড়ি পেতেও কাহিনির কোনোকিছুই অনুধাবন করতে পারেনি।
.
রহস্য উন্মোচন হলো এর দুদিন পরেই। অরণী বিকালবেলা ছাদের রেলিংএ হেলান দিয়ে কানে এয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনছিলো। অরণী ছাদের এমন একটা অবস্থানে দাঁড়িয়েছে, যেখান থেকে বাসার সামনের বিরাট আমগাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে রাস্তার লোকজনকে দেখা যায়, কিন্তু কেউ তাকে দেখতে পায়না; বিশাল আমগাছ তাকে আড়াল করে রাখে।
.
অরণী স্পষ্ট দেখতে পেলো, অরূপ বাইকে এসে বাসার গেটে দাঁড়ালো। তারপর যা খেয়াল করলো তা দেখার জন্য অরণী প্রস্তুত ছিলোনা। অরূপের সামনে…..
.
.
চলবে….
#গ্যাসবেলুন
#পর্ব_৭
লেখাঃ Nobonita Ferdows
.
অরূপের বাইকের সামনে মাধূর্য বসে আছে। অরূপ বাসার সামনে বাইক থামিয়ে নিজে নামলো। তারপর মাধূর্যকে কোলে নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেলো। অরণী হতেম চোখে যতদূর হেলা যায়, ছাদের রেলিং ঘেষে হেলে দেখলো। কিছুক্ষণ সময় লাগলো না বুঝে উঠতে। তারপরই ছুটে ছাদ থেকে নিচতলায় নেমে এলো।
.
বসার ঘরের সোফার ওপর মাধূর্যকে বসিয়ে রেখে আন্টিকে ডেকে এনেছে অরূপ। আন্টি মাধূর্যকে দেখেই ছুটে গিয়ে কোলে নিয়ে আদর করতে শুরু করলো!
.
“বুবু, আমার ছোট্ট বুবু, তুমি এসেছো আমার কাছে? আমি তোমার জন্য কত্ত কান্না করেছি। তুমি তো ভুলেই গিয়েছো আমাকে!”
.
বাচ্চা মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে। আন্টির গলার চেইনটা টেনে ধরে আধো আধো বুলিতে “বু.. বু… বু…” বলেই যাচ্ছে।
.
“মা, মাধূর্য এখন থেকে আমার কাছেই থাকবে!” অরূপ এতটুকু বলেই গলার টাই টেনে ঢিলা করতে করতে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলো।
.
বাড়ির কেউ এই নিয়ে কোনো কথা বললোনা। ছোটফুপু আন্টির পাশে গিয়ে বসলো।
.
“ভালোই হলো ভাবি। অরূপটা কেমন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলো। মাধূর্য এবাড়িতে থাকলে যদি একটু স্বাভাবিক হতে পারে।”
.
আন্টি নাতনীকে কোলে নিয়ে খেলা করতে করতে হাসছিলো। হঠাত হাসি থামিয়ে বিড়বিড় করলো, “রেনু, মাধূর্যকে সবসময় সামনে দেখলে পুরোনো কথা না ছেলেটার মনে পড়ে যায়!”
.
“আরে ভাবি, তুমি দুশ্চিন্তা কোরোনা। এখন মাধূর্য্যের জন্যেই দেখো অরূপ আবার বিয়ে করতে রাজি হবে।”
.
অরূপ সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললো, “সেই আশায় থেকোনা ছোটচাচি। আমি আমার মেয়ের খেয়াল একাই রাখতে পারবো। মায়ের অভাব হবেনা ওর!”
.
অরূপ কথাগুলো অরণীর দিকে তাকিয়েই বললো। অরণী ব্যাপারটা খেয়াল করে যেনো বসার ঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো।
.
অরূপ উৎফুল্ল মনে এসে মাধূর্যকে কোলে নিয়ে বললো, “আমার মায়ের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করো তো চাচি। তোমাদের কলকাতার সিরিয়াল টাইপ আলোচনা এখন বাদ দাও।”
.
“সিরিয়ালের কি পাইলি তুই এখানে?” মুখ কালো করে বললো চাচি।
.
“এই যে তোমাদের মাথায় সারাদিন বিয়ে বিয়ে ঘুরে। আম্মা তো এখন সিরিয়ালের মহিলাগুলার মতো কান্না শুরু করে দিবে।”
.
অরূপের কথাকে সত্যি করে অন্তুর মা সত্যি সত্যি মুখে আঁচল চেপে কান্না শুরু করলো।
“তোরা তো বুঝবিনা মায়ের কষ্ট। সব মায়ের কত শখ থাকে, ছেলের বউ নিয়ে সংসার করবে। এই বয়সে সংসারের হাল ছেড়ে নাতি নাতনিকে নিয়ে সময় কাটাবো; তা না, আমাকে এই বয়সেও একা এই সংসারের হাল টেনে যেতে হচ্ছে!”
.
অরূপ ঠাট্টার স্বরে বললো, “ছোটচাচি শোনো, তোমার ভাবি তোমাকে ইন্ডাইরেক্টলি কিভাবে অপমান করলো। তুমি নাকি সংসারের জন্য জন্য কিছু করোনা। ছি ছি ছি, চাচি, অপমান… অপমান….”
.
“তুই কিন্তু মার খাবি, অরূপ। মা কাঁদতিছে, আর তুই ফাজলামি করতিছিস?”
.
“আচ্ছা আচ্ছা, যাও তুমি খেতে দাও। আমি আম্মাকে নিয়ে যাচ্ছি।” হাসতে হাসতে বললো অরূপ।
.
“মধুমা, দেখোতো বুবু কাঁদতিছে। ভালো মেয়েরা কাঁদে বলো? যাও তো বুবুকে আদর করে দিয়ে আসো।”
অরূপ কোল থেকে নামিয়ে দিলো মাধূর্যকে। মাধূর্য গুটিগুটি পায়ে হেঁটে তার বুবুর কাছে গিয়ে ছোট্ট ছোট্ট হাতে বুবুর চোখ মুছে বললো, “তাঁদে না, বু..বু.. তাঁদেনা!”
.
অরূপ হেসে ফেললো মেয়ের কান্ড দেখে। অরণী দোতলার সিড়ির মাথায় রেলিং এর ওপর হাত রেখে নিচের সবাইকে দেখছে। এবাড়িতে আসার পর থেকে সে এই বাড়ির মানুষগুলোকে এত হাসিখুশি কখনো দেখেনি। মানুষগুলোর মধ্যে এতদিন যেনো প্রাণ ছিলোনা! সে সবচেয়ে বের অবাক হচ্ছে অরূপকে দেখে। এই মানুষটাও যে পরিবারের সবার সাথে এত হাসিখুশি থাকতে পারে তা তার ধারণার বাইরে ছিলো।
.
.
“আম্মাজান উঠেন এখন। সিরিয়ালি কান্না বন্ধ করে খাইতে আসেন!”
.
“তুই যা। খেয়ে নে। আমি মাধূর্যকে খাওয়ায় দেই আগে।”
.
অরূপ খেতে চলে গেলো। এই ভরদুপুরে বাসায় তেমন কেউ নেই। অরূপ একাই খেতে বসলো। অরণী বাড়িতেই ছিলো; ওর কথা যেনো সবাই ভুলেই গেলো।
.
.
পরদিন সকালে অরণীর ঘুম ভাঙলো সাড়ে দশটায়৷ নিচে নেমে দেখলো ডাইনিং রুমে, বসার ঘরে, রান্নাঘরে কোথাও কেউ নেই। অরণী ছোটফুপুকে খুঁজতে খুঁজতে পুরো একতলায় কাউকে না পয়ে দোতলায় উঠে এলো। অরূপের ঘর থেকে খিলখিল হাসির আওয়াজ আসছে। অরণী অরূপা ঘরের সামনে এসে কিছুটা ইতস্তত করে দরজায় ধাক্কা দিতেই ভেজানো দরজা খুলে গেলো। অরূপের ঘরের মেঝেতে আন্টি আর মাধূর্য বসে আছে। মেঝের ওপর নানান খেলনা পুতুলের, বলের ছড়াছড়ি। মাধূর্যের সাথে খেলতে খেলতে আন্টিও যেনো বাচ্চা হয়ে গিয়েছেন। অরণীকে খেয়াল করে আন্টি বললো, “ঘুম হলো, মা? বাসায় কেউ নেই আজ। সবাই সবার কাজে চলে গিয়েছে। আর রেনু গেলো পাসপোর্ট অফিসে; কি যেনো দরকার আছে ওর!”
.
“জি আন্টি, আমি নিচে কাউকে খুঁজে না পেয়ে এখানে এলাম।”
.
“নাতনি এসেছে তো মা, আর কোনোদিকে খেয়াল নেই। তুমি বসো একটু ওর কাছে, আমি তোমার নাস্তা এখানে নিয়ে আসছি।”
.
আন্টি উঠে দাঁড়াতেই মাধূর্য্য আন্টির শাড়ি টেনে ধরে ঠোঁট উল্টে ফেললো। এটা হলো কান্নার প্রস্তুতি।
“তোতায় যাও?”
“আমি একটু খেতে দেই এই আন্নিটাকে! তুমি আন্নির কাছে বসে থাকো। কান্না কোরোনা আবার!”
.
মাধূর্য গোলগোল চোখে মাথা তুলে অরণীর দিকে তাকিয়ে একবার দেখলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বুবুর হাত ধরে বললো, “আমিও যাবো তোমার সাতে!”
.
অরণী আধো আধো বুলি শুনে হেসে ফেললো। মাধূর্যের কাছেই মেঝের ওপর বসে বললো, “কেনো মা, আমাকে তোমার ভালো লাগেনি? তুমি খেলবেনা আমার সাথে?”
.
“না।” ডানে-বায়ে জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলো সে।
.
অরণী বাচ্চাদের মতো করে বললো, “তাহলে তো আমি কান্না করবো।।। ভ্যাএএএএএ… ভ্যাএএএ… মাধূর্য খেলেনা আমার সাথে… ভ্যাএএএ… ” দুহাতের আঙ্গুল মুটিয়ে চোখ ঘষতে ঘষতে কান্নার ভাব করলো অরণী।
.
অভিনয় কাজে দিলো। মাধুর্য বুবুর হাত ছেড়ে দিয়ে অরণীর কাছে গিয়ে বসে বললো, “তাদেনা, তাদেনা। আমি তেলবো তো। আমি তেলবো তোমার সাতে।”
.
অরণী চোখ থেকে হাত সরিয়ে হেসে ফেলে মাধূর্যকে টেনে কোলের ওপর বসালো।
.
আন্টি হাসলো। “মেয়ে সারারাত মায়ের জন্য কাঁদছে। নিজেও ঘুমায়নি আমাকেও ঘুমাতে দেয়নি। মা কোথায়, মা কোথায় করে অস্থির হয়ে গিয়েছিলো। পরে এটা ওটা বলে ঘুম পাড়িয়েছি।”
.
অরণী বললো, “ওর মা কি ওকে একেবারে দিয়ে দিয়েছেন? সেদিন মার্কেটে তো দেখলাম, উনার মেয়েকে নিয়ে বেশ দম্ভ ওনার। অরূপের কোলেও দিতে চাচ্ছিলেন না!”
কথাটা বলেই অরণী দাঁতে জিহ্বা কাটলো। অরূপের নাম ধরে বলায় আন্টি না আবার কি মনে করেন ভেবে আন্টির দিকে অস্বস্তি নিয়ে তাকালো।
.
আন্টি হয়তো সেভাবে খেয়াল করেননি। তিনি প্রশ্ন করলেন, “মার্কেটে শ্রেমার সাথে দেখা হয়েছিলো তোমাদের?”
.
“হ্যাঁ আন্টি!”
.
“থাক। যা হইছে ভালোই হইছে৷ বিয়ে করে সংসার করতিছে; মাঝখান থেকে আমার ছেলেটাকে কষ্ট দিয়ে গেলো শুধু শুধু।”
.
“উনি আবার বিয়ে করেছেন?”
.
“না। করবে। যার জন্য ডিভোর্স নিলো, সেই ছেলে নাকি এখন বাচ্চাসহ মেনে নিচ্ছেনা৷ তাই মেয়েকে দিয়ে দিছে।”
.
অরণী চমকে উঠে বললো, “একটা ছেলের জন্য নিজের সন্তানকে দিয়ে দিলো?”
.
“আজকালকার মেয়েরা মা, সম্পর্ক ভাঙ্গতে-গড়তে দ্বিধা করেনা। এদের কাছে নিজের মেয়েরও গুরুত্ব নাই! আমাদের সময় মেয়েরা স্বামীর অত্যাচারে থেকেও সংসার আঁকড়ে পড়ে থাকতো। আর আজকাল…”
আন্টি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
.
অরণী চুপ করে মাধূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কি নিষ্পাপ একটা মুখ। এখনও জীবনের এতসব জটিলতার কিছুই বোঝায় বয়স হয়নি, তাতেই তার জীবনে কতকিছু ঘটে যাচ্ছে।
.
“কিছু মনে করিওনা, মা। ছেলেটাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকি সবসময়। কাউকে কিছু বলতেও পারিনা। তোমাকে নিজের মেয়ের মতোই দেখি। তাই কটা কথা বলে ফেললাম! থাকো তুমি বুবুর কাছে। আমি তোমার জন্য খাবার গরম করে আনি!”
.
অরণী মাধূর্যকে নিয়ে খেলতে শুরু করলো। কেবল জীবনের শুরুতেই মা থেকেও মাকে হারালো মেয়েটা। অরণী মাধূর্যের ডানহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ধীরে ধীরে বললো, “উনাকে নাহয় নাইবা পেলুম, তুই তো আমার মেয়ে হতে পারিস। আমায় মা ডাকবি?”
.
মাধূর্য কি বুঝলো কে জানে! ড্যাবড্যাব করে অরণীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললো, “তুমি জানো মা তোতায়?”
.
অরণী কি বলবে বুঝতে না পেরে বললো, “মা আছে তো। তোমার কাছেই আছে?”
.
“তোতায়? মা তোতায়?”
.
“আমি খুঁজে দেবো তোমার মা কে। চলো আমার পুতুল খেলি! মা চলে আসবে!”
.
মাধূর্য প্লাস্টিকের ছোট্ট চিরুনী দিয়ে পুতুলের চুল আঁচড়ানোয় মনোযোগ দিলো।
.
.
.
চলবে…..