#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_৪
#নবনী_নীলা
স্নিগ্ধা কথা না বাড়িয়ে রেজিস্ট্রি মেরিজের কাগজে সই করে দিলো। নিয়তির এই লিখন সে মেনে নিয়েছে। তবে তার মা বাবা যে তাকে ভুল বুঝে নেই এতেই সে খুশি। সে মেয়ে হয়ে এই পরিবারের সম্মান কিছুতেই নস্ট হয়ে যেতে দিয়ে পারে না। স্নিগ্ধা কোমল মনের মেয়ে ঠিকই তবে বাস্তববাদী। বাস্তবতা মেনে নিতে সে খুব ছোট বেলা থেকেই শিখেছে।
কে জানতো এমন লম্বা, বেশি কথা বলা একটা ছেলে সাথে তার বিয়ে হবে যাকে দেখলে অধিকাংশ মেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। মেয়েরা এই ছেলেটির মাঝে কি খুঁজে পায় কে জানে? বিশেষ কিছু তো এখনো তার নজরে পড়েনি। বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত হবার মতন মেয়ে সে না।
পাড়া প্রতিবেশীর এমন বাড়াবাড়ি তার অসহ্য লাগছে। কিছুক্ষন আগে একগাদা লোক এসে ভিড় করেছে। কোনো মানে হয় এইসবের?
বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে দুপুরের নাগাদ। বিকেলের পর তাকে নিয়ে যাওয়া হবে। কি নাটকীয়তা এ জীবনে। শুধু একটি দিনের ব্যবধানে পুরো জীবনটাই বদলে গেছে তার। এখন সে সত্যি মিসেস আবরার ফাইয়াজ। গতকাল ছেলেটির এই কথা যে আজ সত্যি হবে সেটা তার কল্পনার বাইরে ছিলো।
জিম তখন থেকে খেয়াল করছে এ বড়ির কাজের মেয়ে ফরিদা কেমন জ্বল জ্বল চোখে তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আছে। বিষয়টিতে জিম বেশ বিরক্ত বোধ করছে। বিষয়টা আদিলের নজর আড়াল করলো না। আদিল মৃদু হেসে বললো,” কি করেছ বলতো? চোখই সরাতে পারছেন না।”
জিম কপাল ভাজ করে করুন কণ্ঠে বললো,” স্যার, এমন রসিকতা করবেন না। বাহিরে মানুষের ভিড় দেখেছেন। এদের মাঝে ম্যাডামকে নিয়ে যাবো কি করে?”
” সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমার বউ,আমি বুঝে নিবো।”, ফোনের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখে বললো আদিল।
জিম নিচু স্বরে বললো,” প্রথম দেখায় এতো গভির প্রেম?”
আদিল ফোনটা একপাশে রেখে মৃদু হেসে বললো,” হুম! সেদিন আমি মিটিং সেরে আর এইচ এন্টারপ্রাইজের বাইরে এসেছি। হটাৎ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আকাশ কালো হয়ে মেঘের গর্জনের বৃষ্টি নয়। রোদ্দুরে যেনো মুক্তোর ফোঁটা টপ টপ করে পড়ছে। ব্যাস্ততার এই শহর ,এই শহরের রাস্তা নিমিষেই ফাঁকা হয়ে গেলো। আমি গাড়িতে উঠে বসেছি। জানালা বন্ধ করার জন্যে পাশে তাকাতেই একটি মেয়েকে দেখলাম। মেয়েটি হাত বাড়িয়ে পড়ন্ত মুক্ত গুলোকে ছুইছে। সেদিন প্রথম দেখেছিলাম। সেই চোখ,সেই হাসি আমার মনে এমন ভাবে জায়গা করে নিয়েছে,আমি ভুলতে পারিনি। তাই দ্বিতীয়বার দেখার পর আর আর হারিয়ে যেতে দেই নি।”
জিম অবাক হয়ে আদিলের কথা শুনছে। এদের ভাগ্য যেনো একে অপরের সাথেই জড়িয়ে আছে। নয়তো হাজারো মেয়ের মাঝে আবরার ফাইয়াজের একটি মেয়েকেই ভালো লাগলো। আর এমন নাটকীয় ভাবে বিয়েও হয়ে গেলো।
অভ্র এই বাড়িতে ছুটছে, দৌড়ে এই প্রান্তে যাচ্ছে আবার ওই প্রান্তে। আদিল ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ অভ্রর দৌড়াদৌড়ি দেখলো তারপর হাত বাড়িয়ে টেনে নিজের কোলে তুলে নিলো। অভ্র সঙ্গে সঙ্গে গাল ফুলিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। আদিল ঝুঁকে এসে বললো,” বাহ্ একদিনে আমাকে ভুলে গেছো, তাই না?”
” হ্যা,”, বলেই সে মাথা নাড়ল তারপর টেনে টেনে বললো,” জানো, কালকে রাতে আমরা অনেক গল্প করেছি। মিষ্টি অনেক ভালো।”,
আদিল ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তারপর বললো,” মিষ্টি? কে মিষ্টি? ওয়াইট এ মিনিট। আজকে তোমার কি নাম?”
অভ্র এক গেল হেসে বললো,” পিকাচু।” আদিল না হেসে পারলো না। অভ্র কিছুদিন হলো এই নতুন একটা খেলা শুরু করেছে। নিজের নাম বদলে কখনো সিঞ্চান, ডোরেমন কখনো নিনজা হাতুড়ি এইসব রাখছে। এই নামেই তাকে ডাকতে হবে নইলে সে কারোর সাথে কথা বলবে না। তারপর ইচ্ছে মতন নাম বদলে ফেলবে। শুধু নিজের বদলাবে তা না সবার নামও বদলে নিজের ইচ্ছে মতন রাখবে।
আয়েশা খাতুন মেয়েকে নিজের হাতে সাজালেন। লাল টুকটুকে লেহাঙ্গায় কি দারুন লাগছে দেখতে। তিনি একটু কাজল এনে মেয়ের কানের পিছনের ছুঁইয়ে দিলেন। তারপর মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,” মাশাল্লাহ।”
স্নিগ্ধার বাবা মেয়েকে ডাকতে এসে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তার ছোট্ট মেয়েটিকে আজ কত বড় না লাগছে। তিনি হেসে বললেন,” বাহ্, বেশ লাগছে।” তারপর বললেন,” জলদি নিয়ে এসো।” বলেই চোখের জল গড়িয়ে পড়ার আগেই তিনি বেড়িয়ে গেলেন।
স্নিগ্ধা নিজের ছোট বোনটাকে বড্ড মিস করছে। সে গেছে মামা বাড়িতে ঘুরতে। আর এমন হুট করে সব কিছু হয়ে গেলো তাকে নিয়ে আসাও সম্ভব হয় নি। স্নিগ্ধার মা মেয়ের হাত ধরে তাকে নিচে নিয়ে এলেন।
আদিল বসে বসে অভ্রর সাথে দুষ্টামি করছিলো। সামনের তাকাতেই থমকে গেলো সে। মুগ্ধতার সীমা রইলো না। অভ্রকে নামিয়ে সে উঠে দাড়ালো। অভ্র স্নিগ্ধাকে দেখেই ছুটে তার দিকে গেলো। আদিল বধূ বেশে স্নিগ্ধার এমন রূপে বিমোহিত হয়ে তাকিয়ে রইল।
⭐ আবরার ফাইয়াজ যেমন নাম তেমনি তাদের বিলাসিতা। তিনতলা একটি বাড়ি। নীচের ফ্লোরটা ড্রয়িং আর ডাইনিং স্পেস। নীচের তলায় থাকার কোনো রুম নেই। নিচ তলার একপাশ পুরোটা কাচের দেয়াল যাতে অন্ধকার না লাগে।
দোতলায় বিশাল তিনটি বেড রুম। আর সঙ্গে একটি গেস্ট হাউস। অন্য রূমের কথা স্নিগ্ধা জানে না। এখন সে যেই রুমটায় বসে আছে সে রুমে দুটি লাম্প জ্বলছে আর পুরো রুমটা সুঙ্গন্ধি ক্যান্ডেল জ্বালিয়ে সাজানো। দুপাশে তাজা লাল গোলাপের ফুলদানি যেনো এক্ষুনি গাছ থেকে ছিঁড়ে এনেছে। বিছানায়ও লাল গোলাপ দিয়ে বিরাট আকারের একটা ভালোবাসা আকা।
স্নিগ্ধা রুমে এসেই ভ্রু কুঁচকে ফেললো। রুমটা সুন্দর করে সাজানো কিন্তু তার বিরক্তি লাগছে। এমনিতেই নতুন একটা বাড়িতে এসেছে, সম্পূর্ণ অচেনা একজনের সাথে তাকে এক রুমে থাকতে হবে। এইসবের মধ্যে এতো রোমান্টিক করে ঘর সাজিয়ে অসস্তি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। রুমটা দেখে তার নিজেরই কাউকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে।
আবরার ফাইয়াজের কি ইচ্ছে হবে আবার কে জানে? মশাই একবার কাছে আসার চেষ্টা করুক তখন মজা টের পাবে। তার নামও স্নিগ্ধতা তাসনিম। সে ভালো মেয়ের মতন বিয়ে করেছে মানে কি সব মেনে নিবে,নাকি?
স্নিগ্ধা বিছানার একপাশে পা তুলে বসলো। এইটা লেহেঙ্গা এতো ভারী কেনো? আর কতক্ষন এইসব পরে বসে থাকতে হবে কে জানে? পিকাচু টা সঙ্গে থাকলে ভালো হতো। তাকে ভুলিয়ে কোথায় ঘুরতে নিয়ে গেছে কে জানে?। সে নিশ্চিত সব ওই আবরার ফাইয়াজের বুদ্ধি।
আদিল নিজের রুমে এসেই প্রথমেই একটু থমকালো। লাইটস অন করতে গিয়েও করলো না। সবচেয়ে বেশি চমকে গেলো স্নিগ্ধাকে বিছানায় পা তুলে ঘোমটা ফেলে বসে থাকতে দেখে। আদিল গরমের কারনে শার্টের তিনটা বোতাম খুলে ফেলেছিলো। প্রথম দুইটি রেখে তিন নাম্বারটা লাগিয়ে নেইভী ব্লু রঙের ব্লেজারটা একপাশে রাখলো।
আদিল কিছুতেই বুঝতে পারছে না, স্নিগ্ধা নিজে থেকে গিয়ে এমন ঘোমটা টেনে বসে আছে কেনো? ধানি লঙ্কা শান্ত আছে ব্যাপারটা তার ঠিক হজম হচ্ছে না। হয়তো মন খারাপ, বাবা মাকে রেখে নতুন পরিবেশে এসেছে। হুম্, এটাই হবে।
আদিল এগিয়ে এসে পাশে বসলো। ভেবেছিলো পাশে বসলে রাগ দেখানোর জন্যে স্নিগ্ধা ঘোমটা তুলে তাকাবে। কিন্তু না সেটাও হলো। আদিল এবার চিন্তিত মুখে তাকালো, কাদঁছে নাকি?
হাত বাড়িয়ে ঘোমটা তুলতে যাবে এর আগেই স্নিগ্ধা নিজে থেকে ঘোমটা তুলে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। লোকটার মতলব কি সেটা দেখতেই এভাবে বসে ছিলো। স্নিগ্ধা সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললো,” এইযে মিস্টার অবরার ফাইয়াজ একদম আমাকে টাচ করার চেষ্টা করবেন না।”
আবরার ঠোঁট চেপে নিজের হাসি থামালো। সে মনে মনে বলল,” আই ওয়াজ রাইট। এই মেয়ে আমার জন্যে ঘোমটা দিয়ে বসে থাকবে? ইমপসিবল।” তারপর নিজের হাসি থামিয়ে এগিয়ে এসে স্নিগ্ধার দুপাশে হাত রাখতেই, স্নিগ্ধা ভরকে তাকালো। তারপর কড়া গলায় বলল,” মিস্টার আবরার ফাইয়াজ একদম ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।”
আদিল স্নিগ্ধার চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,” আরে, সারাদিন আবরার ফাইয়াজ, আবরার ফাইয়াজ করতে করতে হাপিয়ে যাবে তো। তুমি চাইলে আমাকে আদিল কিংবা আদি বলেও ডাকতে পারো। আই ডোন্ট মাইন্ড। তোমার রাগী গলায় আদি ডাকটা ভালোই লাগবে আমার।”
আদিলের কথায় স্নিগ্ধা এক মুহূর্তের জন্যে থমকে গেলো। আদিলের শীতল কণ্ঠটি কর্ণগচর হতেই যেনো শান্ত হয়ে গেলো সে। তবুও বেশ রাগ দেখিয়ে বললো,” কিন্তু আমার ভালো লাগবে না। পারবো না এইসব নামে ডাকতে। আর বলেছিনা আমার কাছে আসবেন না।”
আদিল আরো কাছে এগিয়ে এসে বললো,” তুমি বলতে চাচ্ছো তোমার থেকে ডিসটেন্স মাইটেইন করবো, রাইট? কিন্তু কতটুকু?” বলে আরো একধাপ কাছে এগিয়ে এলো সে।
স্নিগ্ধা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে। আরেকটু এগিয়ে এলেই তাকে বিছানার সাথে মিশে যেতে হবে। কি সাঙ্ঘাতিক ছেলে! স্নিগ্ধা কড়া চোখে তাকিয়ে বললো,” অনেকটা দুরত্ব বজায় রাখতে হবে। বুঝতে পেরেছেন? সরুন এবার।”
আদিল মৃদু হেসে আরেকধাপ এগিয়ে আসতেই স্নিগ্ধা বাধ্য হয়ে বিছানার সাথে মিশে গিয়ে বললো,” আরে কি আজব আপনি এগিয়ে আসছেন কেনো?”
আদিল দুরত্ব কমিয়ে স্নিগ্ধার কানের কাছে এসে শীতল কণ্ঠে বললো,” ইঞ্জিনিয়ারা শুধু স্কেলের মাপটাই বুঝে। একটু, অল্প, অনেকটা এইসব তারা বোঝেই না। সর্বোচ্চ এতটুকু দুরত্ব বজায় রাখতে পারি আমি। ”
হটাৎ এতটা কাছাকাছি চলে আসায় স্নিগ্ধার ভীতরে অস্থিরতা কাজ করছে। তার সারা শরীর মুহূর্তেই শিউরে উঠেছে।
হটাৎ মনে হলো পিঠে কি যেনো বিধেছে। স্নিগ্ধা চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে রাগী কণ্ঠে বললো,” আপনার মতন পাগল যারা শুধু তারাই বুঝে না। সরুন আমার উপর থেকে।” বলেই আদিলকে দুহাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করতেই আদিল মৃদু হেসে নিজেই সরে এলো। তারপর স্নিগ্ধার এক হাত ধরে টেনে বসালো। স্নিগ্ধা বিস্ফোরিত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আদিলের দিকে। এই লোকটাকে তার সহ্যই হচ্ছে না। আদিল বুকের কাছে হাত ভাজ করে স্নিগ্ধার রাগে লাল মুখটা দেখে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসি থামিয়ে রেখেছে।
স্নিগ্ধা লেহেঙ্গা ধরে উঠে দাড়িয়েছে কোনো ভাবে। এমন ভারী যে ভার সামলানো দায় হয়ে পড়েছে। কিন্তু পরক্ষনেই স্নিগ্ধা পিছনের দিকে পড়ে যেতে নিলো। আদিল এগিয়ে এসে স্নিগ্ধার কোমড় জড়িয়ে ধরলো, তারপর হাত বাড়িয়ে বিছানা থেকে ওড়নার এক প্রান্ত ছাড়িয়ে নিলো।
স্নিগ্ধা এর মাঝেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়তেই। আদিল ব্যাস্ত হয়ে চোখ রাঙিয়ে বললো,” আস্তে!” তারপর শীতল কণ্ঠে বললো,” সবকিছুতেই রাগ দেখাতে হয় নাকি?” স্নিগ্ধা দাতে দাঁত চিপে নিজের রাগ সামলে নিয়ে তাকালো।
চলবে…