#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_১৯,২০
#নবনী_নীলা
১৯
কলিং বেল বাজতেই উঠে দাড়িয়ে পড়লো স্পৃহা।ভয় তার এখনো কমেনি। কিছুক্ষণ পর পর সে কেপে কেপে উঠছে। ফরিদা আপা খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, তার এইসবে কোনো মাথা ব্যাথা নেই।ঘুমানোর আগে প্রতিদিনের মতন আজও সে মুখে পাউডার মেখে, একদম সাদা বিড়াল সাজতে ভুলেনি। স্পৃহার মাঝে মাঝে মনে হয় এই মেয়ের সঙ্গে জ্বীন থাকে। সে এফএম রেডিওতে এমন গল্প অনেক শুনেছে তাই ফরিদা আপাকে সে সবসময়ই সন্দেহ করে। জ্বীন না থাকলে আপা নিশ্চয়ই মানসিক ভাবে অসুস্থ নয়তো কেউ এতো নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাতে পারে?
স্পৃহা কাপা কাপা গলায় দরজার ওপাশ থেকে বললো,” কে? আপু..?”
ওপাশ থেকে এক পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে এলো,” নাহ্। আমি…. দরজা খুলো।”
স্পৃহা একটু ভয় পেলো। এই কন্ঠটা সে চেনে না নাকি অতিরিক্ত ভয়ের কারণে তার মস্তিষ্ক সব কিছুতেই আতঙ্কিত হয়ে যাচ্ছে।
স্পৃহা ধীর গলায় আবার প্রস্ন করলো,” কে আপনি…? নাম বলুন।”
পুরুষালী কণ্ঠটি আবার বললো,” আমি জিম। তোমার আপু পাঠিয়েছে তোমাকে নিয়ে যেতে। দরজা খুলো।”
স্পৃহা নামটা শুনে ফট করে দরজা খুললো। তারপর এগিয়ে এসে জিমকে সম্পূর্ন অবাক করে দিয়ে জিমের হাত ধরে ফেললো। তারপর তাড়া দিয়ে বললো,” চলুন।” এই বাড়িতে আর কিছুক্ষণ থাকলে হয়তো সে দম আটকে মরেই যাবে।
জিম একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো তারপর দরজার দিকে তাকিয়ে বললো,” এইটা লক করবে না? তোমার বাবা মায়ের কাছে চাবি আছে?”
স্পৃহা চোখ তুলে জিমের দিকে তাকিয়ে হা সূচক মাথা নাড়লো। স্পৃহার দিকে তাকিয়ে হটাৎ জিমের কেনো জানি একটু মায়া লাগলো। মেয়েটা কতটা ভরসা করেই না তার হাত ধরেছে।
_________
স্পৃহা প্রায় রাত দুটো পর্যন্ত জেগে বসে ছিলো। মাঝে একবার একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল তার কিছুক্ষণ পর ভয় পেয়ে উঠে পড়েছে। স্নিগ্ধা পাশেই বসে ছিলো এতক্ষণ। স্পৃহা যতই হাসিখুশি মেয়ে হোক না কেনো ছোটো ছোটো ব্যাপারে সে ভীষন ভয় পায়। অভ্রকে জড়িয়ে ধরে স্পৃহা আপাদত শান্তিতেই ঘুমাচ্ছে। অভ্র মুখ হা করে ঘুমায়, দেখতে কি যে সুন্দর লাগে।
স্নিগ্ধার আজ রাতে আর ঘুম আসবে না। সে স্পৃহার মতন না, চাইলেই নিজের অনুভূতি গুলো প্রকাশ করতে পারে না। নিজের রাগ, দুঃখ, কষ্ট সবকিছুই সে মানুষের চোখের আড়ালে রাখতে ভালোবাসে।
স্নিগ্ধার মন বেশ বিষণ্ণ হয়ে আছে। রুহুল সাহেব লোকটা তাদের খুব পরিচিত একজন ছিলো। স্নিগ্ধার সাথে কখনো তার তেমন কথা হয়নি তবে তিনি দেখলেই খুব আদুরে গলায় ডাকতেন তাকে। স্পৃহাকে বেশ আদর করতেন।
হটাৎ রুহুল সাহেব আত্মহত্যা করতে যাবে কেনো? কি সুন্দর একটা পরিবার ছিলো। কি করে পারলো এদের এইভাবে ফেলে চলে যেতে? আচ্ছা মানুষের জীবনে কি এমন কষ্ট থাকে যে তাকে মৃত্যু বেছে নিতে হয়। যারা অন্ধ, পৃথিবীর আলো কোনোদিন দেখেনি তারাও তো বেচেঁ থাকতে লড়াই করে। আর সেখানে সব পেয়েও মানুষ এত সহজে হাল ছেড়ে দেয় কেনো?
স্নিগ্ধা করিডোরে এসে দাড়ালো। মধ্যরাতে চাঁদের আলোয় আকাশটা কি সুন্দর লাগছে। কিন্তু এই সুন্দর রাতে কত মানুষ যে তার প্রিয়জন হারিয়ে অসহায় হয়ে গেছে। প্রতিটা রাত যে কারো না কারো জীবনে অভিশাপ হয়ে আসে সেটা আজ স্নিগ্ধা উপলদ্ধি করতে পারছে। আজ এমন বাতাস বইছে কেনো? কেমন এক হিম শীতল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে।
স্নিগ্ধা চোখ বন্ধ করে একটা নিশ্বাস নিলো। তারপর চোখ খুলে আকাশের দিকে তাকালো পরক্ষনেই এক তপ্ত নিশ্বাস ঘাড়ে এসে পড়তেই শিউরে উঠলো স্নিগ্ধা। পিছনে তাকাতেই দেখলো আদিল কিছুটা ঝুকে এসে দৃষ্টি সামনে রেখে দাড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধা পিছনে তাকাতেই চোখাচোখি হলো দুজনের। কয়েক মুহূর্তেই স্নিগ্ধা দৃষ্টি সরিয়ে ফেললেও আদিল একই ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
স্নিগ্ধা একটু অবাক হয়ে বললো,” আপনি এখনো জেগে আছেন?”
আদিল রেলিংয়ের দুপাশে হাত রেখে একটু ঘনিষ্ট হয়ে এসে বললো,” আমার প্রিয় কারোর মন খারাপ থাকলে আমি ঘুমাতে পারি না।”
স্নিগ্ধা আড় চোখে তাকাতেই আদিলের শীতল চাওনির শিকার হলো। স্নিগ্ধার কেনো জানি কান্না পাচ্ছে। তার সবসময় কান্না পায় না। খুব কাছের কেউ যদি তার মন খারাপের সময় তার পাশে এসে দাঁড়ায় কেনো জানি তখন খুব কান্না পায়।
কিন্তু এখন তার কেনো কান্না পাচ্ছে? আদিল কি তার কাছের কেউ হয়ে উঠেছে, তার নিজের অজান্তেই?
স্নিগ্ধা মাথা নুইয়ে রাখলো। চোখ ভিজে এসেছে তার। হটাৎ এই নিরবতায় কিছুই যেনো আদিলের দৃষ্টিগোচর নয়। তার কাছের মানুষটি প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজের অনুভূতি তার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে। তার সামনে কেঁদে ফেললে হয়তো লজ্জায় পড়ে যাবে এই মেয়েটি। তার কি উচিত না এই মেয়েটিকে এমন লজ্জার হাত থেকে বাঁচানো?
আদিল স্নিগ্ধার দুই বাহু ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো। স্নিগ্ধা নিজের অনুভূতির উপর থেকে কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলছে। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই আদিল নিজের দুই বাহুতে আগলে নিলো স্নিগ্ধাকে। আজ আর স্নিগ্ধার অভিযোগ করার সুযোগ নেই। সত্যি তার কাউকে প্রয়োজন ছিলো। যে তাকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে একটুখানি উষ্ণতা দিবে।
স্নিগ্ধা কেঁদে ফেললো কিন্তু খুব নিরবে। আদিলের পিঠের শার্ট তার মুষ্টিবদ্ধ। মিনিট কয়েক পরেই সে নিজেকে সামলে নিলো যখন এক হৃদ কম্পন অনুভব করতে লাগলো সে। স্নিগ্ধা কান পেতে রইলো, হটাৎ এতো জোরে জোড়ে হার্ট বিট করছে কেনো আদিলের? স্নিগ্ধা সেই ধ্বনিতে যেনো হারিয়ে গেলো। আচ্ছা আজকে এই ছেলেটা এতো চুপচাপ কেনো? আজ কেনো সে হাজারটা কথা বলছে না? যদিও এই নিরবতা স্নিগ্ধার ভীষন ভালোলাগছে। এভাবেই থাকতে ইচ্ছে করছে। যেনো কোনো এক নেশা গ্রাশ করে নিয়েছে তাকে এইভাবেই কাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে এই রাত।
কিন্তু তার এই ইচ্ছে বাধাপ্রাপ্ত হলো।নিজেকে সামলে নিয়ে বাধন ছাড়িয়ে সরে দাঁড়ালো সে।সঙ্গে সঙ্গে তীব্র লজ্জা তাকে ঘিরে ধরলো। এখন তার মনে হচ্ছে সে কেনো এই কাজ করলো।হটাৎ লোকটার এতো কাছে যাওয়ার কি খুব প্রয়োজন ছিলো? কিভাবে করলো সে এইটা?
স্নিগ্ধা আড় চোখে আদিলের দিকে তাকিয়ে খেয়াল করলো আদিল তার বুকের কাছে শার্টের ভেজা অংশের দিকে তাকিয়েছে। তারপর না জানার ভান করে মৃদু হেসে বললো,” আমি সত্যিই কিছু দেখিনি।” বলেই স্নিগ্ধার দিকে তাকালো।
স্নিগ্ধা লজ্জায় ঠোঁট কামড়ে ফেললো। এইযে মুখ খুলেছে, এইবার তাকে লজ্জা দিয়ে মেরে ফেলবে। স্নিগ্ধা নিজের এ মুখ এইবার কোথায় লুকাবে? গর্ত খুঁড়ে মাটিতে লুকিয়ে পড়তে পারলে মন্দ হতো না। এই সবের মাঝে তার মন খারাপের কারণটাই যেনো কোথায় হারিয়ে গেছে।
______________
সকালে ঘুম ভাঙলো স্নিগ্ধার। ভোর বেলায় তার ঘুম এমনিতেই ভেঙে যায়। আজ একটু দেরী হলো। ঘুম ভাঙতেই চোখ আস্তে আস্তে খুললো সে। চোখ খুলে তাকাতেই আদিলের ঘুমন্ত মুখটা তার একদম সামনে। স্নিগ্ধা কিছুক্ষণ তাকালো আদিলের ঘুমন্ত মুখটির দিকে। ঘুমালে তো কি ভদ্র আর নিষ্পাপ লাগে আর জেগে উঠলেই হয়েছে। স্নিগ্ধার হটাৎ কাল রাতের ঘটনাটা মনে পড়লো। মনে পড়তেই স্নিগ্ধা চোখ মুখ কুচকে ফেললো। ইস কি একটা লজ্জা! জীবনে কিছু ঘটনা থাকে যেগুলো হটাৎ ঘুমাতে গেলে মনে পড়ে আর তখন লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে। কাল রাতের ঘটনাটা স্নিগ্ধার কাছে অনেকটা এমনই।
স্নিগ্ধা শব্দ না করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। নিজেকে সে গুছিয়ে নিয়েছে। জীবন মানেই লড়াই করে বাঁচতে হবে হোক সেটা নিজের অনুভূতির সাথেই।
স্নিগ্ধা যতোটুকু শুনেছে যে, এক লোকের কাছে থেকে রুহুল সাহেব টাকা নিয়েছিলেন। কিন্তু সঠিক সময়ে টাকা ফেরত দিতে পারেন নি। কয়েক মাস ধরে নাকি সে ভীষন মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিলেন। ডাক্তারের ধারণা মানসিক চাপের কারণে রূহুল সাহেব আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।
স্নিগ্ধা প্রতিদিনের অভ্যাস মতন কিচেনে গেলো। আজ ভাবছে সবার জন্যে চা বানাবে। পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে তার মানসিক অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, কিছুটা সস্তি দরকার তার। কিচেনের শেফ দুইজন বরাবরের মতন একপাশে দাড়িয়ে মনোযোগ নিয়ে স্নিগ্ধার চা বানানো দেখছে। তারা ভেবে পায় না তাদের বানানো চা স্নিগ্ধা কেনো পছন্দ করে না। তারা কি এতো জঘন্য চা বানায়?
স্পৃহা ঘুম থেকে উঠেই কিচেনে চলে এলো। ঘুম থেকে উঠেই এই মেয়ের চা লাগবে। স্পৃহা কিচেনে এসে হাজির। চায়ের ট্রে থেকে এক পেয়ালা নিয়ে বললো,” ধন্যবাদ আপু।” স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। কি সুন্দর তিনটা কাপ নিয়ে উপরে যাবে ভেবেছিলো এখন দুটো কাপ নিয়ে যেতে হবে।
স্পৃহা ঘুম ঘুম চোখে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলো সে রুমে গিয়ে জানালার পাশে বসে চা খাবে তাই যাচ্ছিল। রূমের দিকে যাওয়ার সময় বেখেয়ালে জিমের সাথে ধাক্কা লেগে চায়ের কাপ ফ্লোরে পরে চূর্ন বিচূর্ণ হয়ে গেলো। এক ধাক্কায় যেনো স্পৃহার ঘুম উড়ে গেলো। মাথায় রক্ত ওঠে গেলো তার। রাগে ফুলতে ফুলতে বললো,” আপনি কি বলুন তো? আপনি আর কাউকে পান না ধাক্কা খাওয়ার জন্যে? মানে খুঁজে খুঁজে আমাকেই ধাক্কা দিতে হয় আপানার।”
জিম তীব্র বিরক্তি নিয়ে তাকালো। মানে এখন সব দোষ তার? বলার ভাষাই সে খুঁজে পাচ্ছে না। স্নিগ্ধা পিছনেই ছিলো। ট্রে হাতে উপরে এসে বললো,” একি এই অবস্থা হলো কি করে?”
স্পৃহা কোনো কথা বললো না। স্নিগ্ধার ট্রে থেকে এক পেয়ালা চা নিয়ে মুখ কালো করে বললো,” সকাল সকাল মেজাজটাই খারাপ করে দিলো।” তারপর বলেই রূমের দিকে চলে গেলো।
জিম বিষ্ময় নিয়ে তাকালো। কি আশ্চর্য! এইখানে তার দোষ কোথায়? স্নিগ্ধা কিছুই বুঝলো না। জিম আর স্পৃহা যে কি করে বেড়ায় সে বুঝতে পারে না। স্পৃহা চায়ের শেষ পেয়ালাটা জিমের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,” তোমরা এতো ঝগড়া করো কেনো?”
জিম নিরাশ চেহারায় পেয়ালে হাতে নিয়ে বললো,” আমারও একই প্রশ্ন।” জিম কঠিন গলায় করলেও স্নিগ্ধা ঠোঁট চেপে হাসি থামলো। স্নিগ্ধার হাসিতে জিম অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো। তারপর বললো,” আমি স্টাফকে বলে দিচ্ছি জায়গাটা ক্লিন করে দিবে।” বলেই স্নিগ্ধাকে পাশ কাটিয়ে নিচে নেমে গেলো।
স্নিগ্ধা ফোঁস করে হেসে ফেললো। তারপর পা বাড়িয়ে রূমের দিকে যেতেই মনে হলো কিছু একটা তার পায়ে বিধেছে। স্নিগ্ধা খুব আস্তে আর্তনাদ করে উঠলো। ইশ না দেখে পা বাড়ালো কেনো সে? পা ফেলতেই ভীষন যন্ত্রণা হচ্ছে। স্নিগ্ধা পায়ে বিধে যাওয়া কাচের টুকরো বের করতে গিয়ে বসে পড়লো।
কিন্তু হটাৎ কারোর শক্ত বাহুতে নিজেকে আবিষ্কার করে অবাক হয়ে তাকালো স্নিগ্ধা। আদিলের দিকে তাকিয়ে চোখ কপালে উঠে গেলো তার। শুধু একটা ট্রাউজার পড়ে আছে সে। আদিলের মাত্র গোসল সেরে বেরিয়েছে যার কারণে শরীর বিন্দু বিন্দু পানি স্নিগ্ধার শরীর স্পর্শ করছে। স্নিগ্ধা চোখ বন্ধ করে বললো,” কি করছেন? ছাড়ুন।”
[ #চলবে ]
#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_২০
#নবনী_নীলা
স্নিগ্ধা চোখ বন্ধ করে বললো,” কি করছেন? ছাড়ুন।” আদিল স্নিগ্ধাকে বিছানায় বসিয়ে দিলো তারপর বেশ রেগে গিয়ে বললো,” তুমি নিজের খেয়াল রাখো না কেনো?”
স্নিগ্ধা হতভম্ব হয়ে তাকালো।হুট করে রেগে গেলো কেনো লোকটা? আদিল রাগী চোখে স্নিগ্ধার দিকে এক পলক তাকালো তারপর স্নিগ্ধার পাশে বসে পায়ে হাত দিতেই স্নিগ্ধা ব্যাস্ত হয়ে বললো,” তেমন কিছু হয়নি….” এইটুকু বলতেই আদিলের অগ্নিদৃষ্টি তার চোখে পড়লো। স্নিগ্ধা চুপ করে গেলো। বাপরে এমন রাগের কি হয়েছে?
_________________
স্পৃহা এই বাড়ির পেন্টিং গুলো দেখে কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে কেনো স্নিগ্ধা তাকে খোঁজ নিতে বলেছিলো। সে খোঁজ নেয়নি এমন না। খোঁজ নিয়েছে তবে তেমন কিছু সে খুঁজে পায় নি। পেইন্টিংগুলোর নিচে খুব পেচিয়ে লেখা আছে একটি নাম। নামটা হলো আরোহী। কিন্তু এই নামের কোনো আর্টিস্ট সে খুঁজে পায় নি। পেইন্টিং গুলো তুলনা মূলুক অসাধারণ হলেও যিনি এই ছবিগুলো একেছেন তিনি খুব সাধারণ কেউ। কিন্তু তার বোনের হটাৎ এই মানুষটিকে খুঁজে বের করার এতো আগ্রহ কেনো? কে এই আরোহী? আপুকে তো নামটাই বলা হয়নি। স্পৃহা রুম থেকে বের হয়ে স্নিগ্ধার রুমে এলো।
রুমে এসে স্পৃহা অবাক হয়ে তাকালো। ডাক্তার কি করছে এইখানে? কারোর কি শরীর খারাপ হয়েছে। স্নিগ্ধা কপাল দুই আঙ্গুলে ধরে বিছানায় মুখ কালো করে বসে আছে। স্পৃহা ব্যাস্ত হয়ে স্নিগ্ধার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,” আপু, কি হয়েছে তোর? শরীর খারাপ করেছে?”
স্নিগ্ধা বিরক্তি নিয়ে এক পলক আদিলের দিকে তাকালো তারপর স্পৃহাকে বললো,” জানি না।” স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। জানি না আবার কেমন কথা? এর মাঝেই আদিল ডাক্তারকে বললো,” ইনফেকশন হওয়ার কি কোনো চান্স আছে?”
ডাক্টার সাহেব ঠোঁট চেপে একটু হাসলেন।অল্প একটু কাঁচ গেঁথে যাওয়ায় আদিলের এমন অস্থিরতা দেখে যেনো তার নিজের কথাই মনে পড়ে গেলো।
কোনো সমস্যা নেই জেনেও ডাক্তার সাহেব বললেন,” আপাদত ইনফেকশন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে ওনার প্রতি একটু খেয়াল রাখবেন।”
স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে ডাক্তারের দিকে তাকালো।খেয়াল রাখতে বলার জন্যে আর ভালো মানুষ পেলেন না উনি। কি হয়েছে এমন? এর জন্যে এই লোক আবার ডাক্তারকে বাসায় নিয়ে এসেছে। তারপর ডাক্তারের উদ্দেশ্য বললো,” আমি ঠিক আছি। আমার খেয়াল আমি নিজেই রাখতে পারি।”
আদিল তীক্ষ্ণ গলায় বললো,” নিজের খেয়াল রাখতে পারো বলেই তো পায়ের এই অবস্থা করেছো।” স্নিগ্ধা দাতে দাঁত চিপে তাকালো।
ডাক্তার সাহেব যাওয়ার জন্যে উঠে দাড়ালেন তারপর স্নিগ্ধাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,” বিয়ের পর ছেলেরা বউকে নিয়ে এমন একটু আকটু পাগলামি করে।” বলেই হেসে তাকালেন।
স্নিগ্ধা ডাক্তারের এমন কথায় অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। পাশেই স্পৃহা বসে আছে এই মেয়ে তো আরো পাকনা। আদিল কথাটায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখলো না কিন্তু স্পৃহা উঠে বললো,” আপনিও বিয়ের পর পাগলামি করেছিলেন,বুঝি?”
ডাক্তার সাহেব জোরে হো করে হেসে উঠলেন। স্নিগ্ধা স্পৃহার হাত ধরে টেনে নিজের পাশে বসালো। মুখে যা আসে বলে ফেলে এই মেয়ে। ডাক্তার সাহেব বললেন,” ভালোবাসা মানেই তো পাগলামি। শোনো মেয়ে! ভালোবাসলে পাগলামি করতে হয়।”
ডাক্তারের কথায় আদিল মৃদু হাসলো।কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে স্পৃহা ফিক করে হেসে ফেললো। স্নিগ্ধা কড়া চোখে তাকালো। তার বোনটা এমন ডানপিঠে হয়েছে কেনো?
ডাক্তার সাহেব চলে গেলেন। ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে আদিল নিচে নেমে গেলো। ডাক্তার চলে যেতেই স্নিগ্ধা স্পৃহার কান টেনে ধরে বললো,” এতো পাকনা কেনো তুই? মাকে বলবো তোর জন্যে ছেলে খুঁজতে?”
স্পৃহা আর্তনাদ করে উঠে বললো,” আপু ছাড় লাগছে।” অভ্র দৌড়ে রুমে আসতেই স্নিগ্ধা স্পৃহার কান ছেড়ে দিলো। অভ্র লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসলো তারপর বললো,” তোমরা মারামারি করছো কেনো?”
স্পৃহা কান ডলতে ডলতে বললো,” তোমার আম্মু কতো পচা দেখেছো?”
অভ্র না সূচক মাথা নাড়ল তারপর ভ্রু কুঁচকে বললো,” ও আম্মু না ও মামোনি। ওকে আম্মু বলছো কেনো?” স্পৃহা আর স্নিগ্ধা দুজনেই হতবাক হয়ে তাকালো। স্নিগ্ধার মুখ মলিন হয়ে গেলো। অভ্রর কথাটা তার কেমন যেনো লাগলো। স্পৃহা স্নিগ্ধার দিকে তাকালো এক পলক তারপর অভ্রর কাছে গিয়ে বললো,” তাহলে তোমার আম্মু কে?”
স্নিগ্ধা একটা ঢোক গিলে তাকালো।
অভ্র চোখের পাতা ফেলে বললো,” আরুহি।” স্নিগ্ধার বুকের ভিতরটা হটাৎ কেমন এক তোলপাড় শুরু হলো। অভ্র কি তাহলে নিজের মায়ের নাম বলছে?
স্নিগ্ধা মলিন চোখে প্রশ্ন করলো,” তোমার আম্মু কো….?” প্রশ্ন শেষ করার আগেই আদিল অভ্রকে কোলে তুলে নিয়ে কপালে চুমু একে দিয়ে বললো,” চলো। আমরা একসাথে খেলবো। তোমার মামোনি রেস্ট করুক।”
কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আদিল অভ্রকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। স্নিগ্ধা বিষণ্ণভরা মুখ নিয়ে বসে রইলো। অভ্রর বলা এই সামান্য কথায় একটু হলেও আঘাত পেয়েছে সে।
স্পৃহা হতবুদ্ধির মত বসে আছে। আরোহী মানে সারা বাড়িতে যার আঁকা ছবি সাজিয়ে রাখা হয়েছে সে অভ্রর মা? স্পৃহা নিজের বোনের দিকে তাকালো। মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তার। স্পৃহা একটু সাহস জুগিয়ে বললো,” আপু।”
স্নিগ্ধা মলিন চোখে তাকালো।তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,” হুম।” স্পৃহা একটা ঢোক গিলে বললো,” যার নাম আমাকে বের করতে বলেছিস আমি নামটা পেয়েছি কিন্তু তোকে বলা হয়ে উঠেনি।”
স্নিগ্ধা হতাশ গলায় বললো,” আচ্ছা, বল।”
” এই বাড়িটির সব কয়টি পেইন্টিং অভ্রর মায়ের আকা মানে আরোহীর।”,বলেই থেমে গেলো স্পৃহা।
স্নিগ্ধা এক মুহূর্তের জন্যে একটু থমকে গেলো কিন্তু পরক্ষনেই মনে হলো হয়তো আদিল খুব ভালোবাসতো সেই মানুষটিকে তাই তো তার প্রতিটি জিনিস এইভাবে আগলে রেখেছে। বুকের ভিতরটা কেমন এক হাহাকার শুরু হয়েছে। স্নিগ্ধা চোখ বন্ধ করে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বললো,” স্পৃহা তুই এখন যা। আমার ভীষন ঘুম পাচ্ছে।”
স্পৃহা কথা বাড়ালো না। সে ভেবেছিল অভ্র হয়তো আদিলের ছেলে না। কিন্তু এখন সবটা আরো অস্পষ্ট লাগছে। স্পৃহা রুম থেকে বেরিয়ে এলো।
স্নিগ্ধা নিজেকে শান্ত করে রাখার চেষ্টা করছে।কিন্তু কিছুতেই সেটা সম্ভব হচ্ছে না। বুকের ভিতরে তোলপাড় শুরু হয়েছে তার। স্নিগ্ধা চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলো। কোনো মানুষকে এখনো ভালো না বাসলে কি তার প্রতিটা জিনিস এত যত্নে রাখে কেউ? আচ্ছা আদিলের আরোহীকে ভালোবাসাটা কি স্বাভাবিক নয়? কিন্তু এই সবকিছুতে স্নিগ্ধার কেনো জানি ভীষন কষ্ট লাগছে। অস্থিরতা ঘিরে ধরেছে তাকে। আদিলের মনে যে কেউ থাকুক তাতে তো তার এতটা কষ্ট পাওয়ার কথা নয়। নিজের মনের সাথে নিজেই লড়াই করে যাচ্ছে সে।
আদিল রুমে ঢুকতেই স্নিগ্ধার মুখটা আরো বিষণ্ণতায় ভরে উঠলো। স্নিগ্ধার এই রুমে আর ভাল্লাগছে না। স্নিগ্ধা গায়ের চাদর সরিয়ে বিছানা থেকে পা নামাতেই আদিল সামনে এসে দাড়ালো। স্নিগ্ধা চোখ তুলে তাকালো। আদিল বুকের কাছে হাত ভাজ করে বললো,” একদম বিছানা থেকে নামবে না।” গম্ভীর কণ্ঠে আদেশের মতন শুনালো কথাটা। স্নিগ্ধা সেই আদেশের পরোয়া করলো না। স্নিগ্ধা উঠে দাড়ালো। আদিল বিনা বাক্যে স্নিগ্ধার দুই বাহু ধরে বিছানায় বসিয়ে দিলো। স্নিগ্ধা তীব্র বিরক্তি নিয়ে তাকালো তারপর তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বললো,” কি চাইছেন আপনি?”
” আমি চাইছি তুমি চুপচাপ বিছানায় বসে রেস্ট নিবে। হাঁটলে পায়ে ব্যাথা বাড়বে।” বলেই আদিল দুপাশে হাত রেখে ঝুকে আসতেই স্নিগ্ধা সরে এসে বললো,” আপনার আমাকে নিয়ে এতো ভাবতে হবে না।” অভিমান ভরাক্রান্ত গলায় বললো সে।
আদিল আরেকটু ঝুকে এসে স্নিগ্ধার দিকে তাকালো তারপর শীতল কণ্ঠে বললো,” আজ আবার বলছি, তুমি নামক এই সম্পূর্ন মানুষটা শুধুই আমার। তাই খেয়ালটাও আমাকেই রাখতে হবে।”
স্নিগ্ধা আদিলের চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। তারপর শান্ত স্বরে অভিযোগ করে বললো,” আমার এতোই যখন খেয়াল রাখতে চান, তাহলে আমার থেকে সব কিছু লুকিয়ে যাচ্ছেন কেনো? নাকি আমাকে শুধু ব্যাবহার করতেই এনেছেন?”
আদিল ছোট একটা নিশ্বাস ফেলে তাকালো। তারপর স্নিগ্ধার হাতের উপর নিজের হাত রেখে বলল,” তোমার থেকে সবটা লুকানোর কোনো ইচ্ছে ছিলো না আমার। সেদিন তো সবটা বলতেই চেয়েছিলাম কিন্তু তার আগেই ফাহাদের বলা কথাগুলো তুমি বিশ্বাস করে বসে আছো। এরপর আমার বলা কথাগুলো তোমার কাছে ঠিক তেমনি শুনবে যেমনটা ফাহাদ চাইছে। তুমি ঠিক কতটা ফাহাদের কন্ট্রোলে হয়ে আছো তুমি নিজেও জানো না। তাই তো এতটা অধৈর্য্য হয়ে উঠেছ। তোমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে সে সফল। কিন্তু ফাহাদ যা চায় সেটা তো আমি হতে দিচ্ছি না।”
স্নিগ্ধা চুপ করে তাকিয়ে রইলো।আদিলের কথাগুলো যে ভুল তা নয়। কারণ ফাহাদের কথাগুলোই প্রতিমুহুর্তে তাকে ভাবিয়ে তোলে। রাগে ক্ষোভে তখন নিজেকে অসহায়ের মতন লাগে। স্নিগ্ধা কয়েকবার চোখের পলক ফেললো তারপর বললো,” শুধু আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিবেন?”
আদিল শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো তারপর শীতল গলায় বললো,” হুম বলো।”
স্নিগ্ধার ভিতরে অস্থিরতা বেড়ে গেলো।কিছুক্ষণ চুপ করে আদিলের দিকে তাকালো। প্রশ্নটা করতে যতটা কঠিন মনে তার চেয়েও বেশি কঠিন হচ্ছে এই প্রশ্নের জবাবটা। স্নিগ্ধা একটা ঢোক গিলে বললো,” আরোহী কে?” এই প্রশ্নের উত্তর শুনার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছে সে। স্নিগ্ধা অসীম কৌতূহল নিয়ে আদিলের দিকে তাকিয়ে আছে। আদিল প্রশ্নটা শুনে থমথমে হয়ে গেলো তারপর বললো,” অভ্র তো বলেই দিয়েছে।”
স্নিগ্ধা না সূচক মাথা নাড়লো। অস্থির মনকে শান্ত করে বললো,” আমি আপনার কাছ থেকে জানতে চাই।”
আদিল মাথা নুইয়ে ফেললো তারপর চোখ বন্ধ করে ফোস করে একটা নিশ্বাস ফেলে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে বললো,” সে আমার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ যাকে আগলে রাখতে আমি ব্যার্থ হয়েছি।”
স্নিগ্ধা অপলকে তাকিয়ে আছে।আদিলের সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ! মানে তার চেয়েও উর্ধ্বে কেউ। এই একটি মাত্র কথায় হটাৎ যেনো সবটা থমকে গেলো তার।
[ #চলবে ]