রংধনুর_স্নিগ্ধতা #পর্ব_২৭,২৮

0
816

#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_২৭,২৮
#নবনী_নীলা
২৭

স্নিগ্ধা রুমটার দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আগেই কে যেনো পিছন থেকে রুমাল দিয়ে স্নিগ্ধার মুখ চেপে ধরলো।স্নিগ্ধা প্রথমে মুখ থেকে রুমালটা সরিয়ে ফেলতে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করতে লাগলো। জোরে চিৎকার করতে গিয়েও পারলো না গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না তার। কয়েক মুহূর্ত পরেই নিস্তেজ হয়ে জ্ঞান হারালো সে।

ফাহাদ অজ্ঞান স্নিগ্ধাকে ফ্লোরে বসিয়ে দিলো। তারপর খুব সাবধানে গেস্ট রূমের দরজাটা খুললো। হটাৎ দরজা খোলার আওয়াজে হান্নান চমকে তাকালো। কিন্তু দরজার ওপাশ থেকে যখন সে ফাহাদকে দেখলো তখন সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাড়ালো। কিছু বলে উঠার আগেই ফাহাদ কড়া চোখে তাকিয়ে থেকে তাকে চুপ থাকতে বললো। তারপর কোনো শব্দ না করেই দরজা বন্ধ করে দিল। হান্নানের চোখে মুখে এক আশার আলো ভেসে উঠলো। কিন্তু পরক্ষনেই ফাহাদের কঠিন গলায় সে দমে গেলো। ফাহাদ খুব কম কথার মানুষ কিন্তু যখন যা বলে সেই কথার ভার সে বজায় রাখে।

” এতো কিছু করে তোমাকে এই বাড়িতে পাঠালাম। আর তুমি কি করলে?”, ফাহাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সম্মুখীন হয়ে হান্নান ঘাবড়ে গিয়ে তাকালো। তারপর নিজেকে বাঁচাতে বললো,” আমার কাজ তো হয়ে গেছে। আজ রাতেই পালিয়ে যাবো ভেবেছিলাম।”

ফাহাদ হাতের কালো গ্লাভস গুলো ঠিক করতে করতে বললো,” সেটা তোমার আগে ভাবা উচিত ছিলো। তাহলে এবার বলো তুমি কি চাও? বাঁচতে নাকি মরতে?”

হান্নান ভরকে তাকালো। কথাটা শুনে তার শরীরটা হিম শীতল হয়ে গেলো।সে কাপা কাপা গলায় বলল,” স্যার আমাকে এই বারের মতন ক্ষমা করে দিন। আমি বাঁচতে চাই দয়া করে আমাকে মারবেন না।”

ফাহাদ পকেট থেকে প্যাকেট মোড়ানো একটি ছুরি হান্নানের টেবিলের সামনে রাখতেই হান্নান ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো। ফাহাদ নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” এটা রেখে গেলাম। এরপর তুমি এই বাড়ির বাইরে কি করে বের হবে সেটা সম্পূর্ণই তোমার হাতে। আবরার তোমাকে বাড়ির বাইরে নিলেই তোমার বাঁচা সম্ভব তার আগে নয়।” বলেই পুনরায় দরজা বন্ধ করে দিলো ফাহাদ।

অবাক হলেও সত্যি যে হান্নান এক চুল ও নিজের জায়গা থেকে নড়লো না। কিংবা দরজার কাছে গিয়ে আকুতি মিনতি করলো না তাকে বাঁচানোর জন্যে। ফাহাদকে দেখেই সে ভেবেছিল তার সময় শেষ।এইবার তাকে মরতে হবে। কিন্তু ফাহাদ তাকে কিছু না করে আবার একই রুমে বন্ধ করে রাখার কোনো কারণ সে খুঁজে পেলো না। এতো বছর ধরে ফাহাদের সঙ্গে সে আছে কখনো ফাহাদ তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ বাঁচিয়ে রাখেনি। হান্নান হাত বাড়িয়ে টেবিলে রাখা ছুরিটা হাতে নিলো। প্যাকেট সরিয়ে ছুরিটা আনমনে ধরতেই অসাবধানতায় আঙ্গুলের প্রান্ত ভাগ কেটে গেলো তার।

_________________

রাতুলের বাড়ি গিয়ে তাকে পাওয়া গেলো না। রাতুলের বৃদ্ধ মা ছিলেন বাড়িতে। বৃদ্ধ মহিলা বললেন রাতুল কয়েকদিন যাবত বাড়ি ফেরেনি। রাতুল নিখোঁজ, শত চেষ্টা করেও তার খোঁজ মেলেনি। এক মাত্র ছেলের খোঁজ হারিয়ে রাতুলের মা পাগলপ্রায়। আদিলের সন্দেহ ঠিক। রাতুলকে সরিয়ে দিয়েই হান্নানকে এই বাড়িতে পাঠিয়েছে ফাহাদ। ভেবেই মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে আদিলের। মারাত্মক স্প্রিডে ড্রাইভ করে বাড়ি ফিরলো আদিল।

বাড়ী ফিরে প্রথমে সে গেস্ট রুমেই গেলো প্রথমে। তালা খুলে ভিতরে এসে দেখলো হান্নান নামের ছেলেটি বিছানায় উপর হয়ে পড়ে আছে।আদিলের রাগ দ্বিগুণ বাড়লো। হান্নানের হাত ধরে টেনে তুলতেই একটা অবাক হয়ে গেলো সে। ছেলেটির সারা শরীর হিম শীতল হয়ে আছে। এতো জোরে টেনে তোলার পরও তার মাঝে কোনো নড়চর নেই একই ভঙ্গিতে রয়েছে সে। ছেলেটির হাতের নার্ভ চেক করতেই বিষ্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো আদিল। এই ঘণ্টা খানেকের মাঝে এমন অস্বাভাবিক মৃত্যু কিভাবে সম্ভব?

আদিল নিজেকে শান্ত করতেই খেয়াল করলো পুরো বাড়িটা আজ নির্জন। কারোর কোনো শব্দ সে পাচ্ছে না। কোথাও কোনো শব্দ নেই। আদিল ছুটে বেরিয়ে এলো তারপর একে একে সবাইকে ডাকলো। কিন্তু কারোর কোনো সাড়া নেই।
______________________

স্নিগ্ধার জ্ঞান ফিরলো অনেক্ষনপর। জ্ঞান ফেরার কয়েক মুহূর্তেই সে নিজেকে একটি কাঠের চেয়ারে দুই হাত দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা অবস্থায় আবিষ্কার করলো। চোখ খুলেই চারিপাশে এমন অন্ধকারে বুকের ভিতরটা কেপে উঠলো তার। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাউকে ডাকতে গিয়ে দেখলো তার মুখ টেপ দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

স্নিগ্ধা এমন পরিস্থিতিতে অস্থির হয়ে গেলো।ভয়ে ঘামতে লাগলো। ঘড়ির কাঁটার প্রতি সেকেন্ডের সঙ্গে সঙ্গে তার হৃদকম্পন বেড়েই চলেছে। অজানা ভয় তাকে অন্ধকার এই রূমে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে।

স্নিগ্ধা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে প্রচুর চেষ্টা করতে লাগলো। নিজের সর্বস্ব দিয়ে সাহায্যের জন্য শব্দ করতে লাগলো সে। শরীরের সব শক্তি ব্যবহার করে এবার হাপিয়ে উঠেছে সে। এক চুল পরিমান নড়াচড়ার শক্তি নেই তার মধ্যে।

কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই হটাৎ দরজা খোলার আওয়াজ কানে ভেসে এলো স্নিগ্ধার। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে এক ফালি আলো এসে হাতছাউনী দিলো রুমটায়। সামান্য সেই আলো যেনো সূর্যের তির্যক রশ্মির মতন চোখে বিধলো তার। মুখ ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো স্নিগ্ধা।

কিছুক্ষণ পর চোখ খুলতেই কালো টি শার্টের সঙ্গে মোটা ছাই রঙের ট্রাউজার পড়া গৌড় বর্নের সুগঠিত চওড়া কাঁধ আর আকর্ষণীয় চেহারার একজনকে দেখতে পেলো স্নিগ্ধা।সে ক্লান্ত শরীর চেয়ারে হেল দিয়ে তাকিয়ে রইলো লোকটির দিকে।

স্নিগ্ধা অবাক করে দিয়ে ফাহাদ তার দিকে তাকিয়ে হাসলো। সে হাসি দেখে মারাত্মক রাগ হলো স্নিগ্ধার। বেধে রাখা হাত দুটি পরক্ষনেই মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেলো তার। ফাহাদ সাবলীল ভাবে রূমের বাতি গুলো জ্বেলে দিয়ে আরেকটি চেয়ার নিয়ে এসে ঠিক স্নিগ্ধার বরাবর বসলো। তার সামনে বসা সুন্দর মেয়েটির চোখে তার প্রতি সে তীব্র ঘৃনা দেখতে পাচ্ছে সে। যদিও এইটা তার জন্যে নতুন কিছু না সবাই তার দিকে ঘৃণার চোখেই তাকাবে স্বাভাবিক।

ফাহাদ হাত বাড়িয়ে স্নিগ্ধার মুখের বাঁধন খুলতে গিয়েও আবার হাত সরিয়ে এনে বললো,” নাহ্ এই মুহূর্তে তোমার মুখের বাঁধন খুলে দেওয়া ঠিক হবে না। তোমাকে কেনো তুলে এনেছি। কি জন্যে এনেছি। সেসব আগে তোমাকে জানাই। তারপর তোমাকে বলার সুযোগ দিবো।”

স্নিগ্ধা তীক্ষ্ম চোখে তাকালো। সামনে বসে থাকা লোকটিকে তার এক মুহূর্তের জন্যেও সহ্য হচ্ছে না।

ফাহাদ চেয়ারে বেশ আরাম করে বসলো তারপর চিবুকের নিচে হাত রেখে বললো,” তোমার আমাকে ভয় পাওয়ার কারণ নেই আমি নারী আর শিশুদের কোনো ক্ষতি করি না। তোমাকে আনার একটি কারণ। আর সেটা হচ্ছে আবরার ফাইয়াজ কে বুঝিয়ে দেওয়া যে আমার ক্ষমতা ঠিক কতোদূর। যদিও আমাকে কম করতে হয় নি। কিন্তু তোমার ছোটো বোনকে সিড়ি থেকে ফেলে দেওয়ার জন্যে খারাপ লাগছে। তবে জিমকে বাড়ি থেকে বের করার এই একটি মাত্র উপায় ছিলো। তবে চিন্তার কারণ নেই, আমি খোঁজ নিয়েছি তোমার বোন ভালোই আছে।”

স্নিগ্ধা বিস্ফারিত চোখে তাকালো। তার মানে স্পৃহা সত্যি বলেছে ওকে সিড়ি থেকে কেউ ফেলে দিয়েছে। মানুষ এতটা জঘন্য হয় সেটা স্নিগ্ধার জানা ছিলো না। রাগ তার আকাশ ছুঁয়েছে।

ফাহাদ আরো বললো,” এইটা তোমার সাথে আমার প্রথম আলাপ না তাই ভয় পাওয়ার একদমই কোনো কারণ নেই। ফাহাদ রেজওয়ান নামটা ভুলে যাও নি নিশ্চই?”

স্নিগ্ধা অগ্নী দৃষ্টিতে তাকালো। সামনে বসে থাকা এই লোকটি সেই ফাহাদ রেজওয়ান? স্নিগ্ধার হাতের মুষ্টি আরো শক্ত হলো। ফাহাদ বিষয়টা খেয়াল করে বললো,” আচ্ছা, আমাকে দেখি তুমি একদমই সহ্য করতে পারছো না। তোমার সাথে তো আমার কোনো ঝামেলা নেই। নাকি সেদিনের বলা সত্যি কথা গুলো তোমার ভালো লাগে নি?” বলেই ফাহাদ হাত বাড়িয়ে স্নিগ্ধার মুখের বাঁধন খুলে দিলো।

মুখের বাঁধন খুলতেই স্নিগ্ধা দ্রুত কয়েকবার মুখ দিয়ে নিশ্বাস নিলো তারপর কড়া গলায় বললো,” কি চাই আপনার? আমাকে এইখানে এনেছেন কেনো? আপনার মতো জঘন্য লোক আমি একটাও দেখি নি। কতো বড় সাহস আপনার আপনি আমার বোনের ক্ষতি করতে গেছিলেন।”

ফাহাদ ঠোঁট ভিজিয়ে শব্দ করে হাসলো। হাসির সেই প্রতিধ্বনি পুরো রুমটায় ভেসে বেড়াচ্ছে। যা স্নিগ্ধার রাগ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিলো। নিজের সবটা দিয়ে আবারও হাতের বাধন খোলার চেষ্টা করতে লাগলো সে। ফাহাদ স্নিগ্ধাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,” শুধু শুধু চেষ্টা করে নিজেকে দুর্বল করছো তুমি। সামনে পুরো ঘটনা শোনার মতন শক্তি তো শরীরে রাখতে হবে, তাই না? তোমাকে আমি তুলে আনতাম না। কিন্তু আবরার ফাইয়াজ আমার বিরুদ্ধে এমনভাবে উঠে পড়ে লেগেছে যে বাধ্য হলাম। আর আমার কিছু প্রশ্ন আছে যার উত্তর এক মাত্র তুমিই দিতে পারবে।”

স্নিগ্ধা দাতে দাঁত চিপে তাকালো। মাথা তার যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে। এর মাঝেই ফাহাদ একটু সিরিয়াস হয়ে বললো,” অভ্র মানে ওই ছোটো ছেলেটি কে? মিডিয়া না হয় জানে যে ছেলেটি তোমার আর আদিলের কিন্তু আমি নিশ্চিত বাচ্চাটি তোমার না। আর তোমাদের ডিএনএ রিপোর্ট বলছে বাচ্চাটি তোমার বা আদিল কারোরই নয়।”

স্নিগ্ধা এবার বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললো,” কি অজে বাজে বলছেন? ডিএনএ রিপোর্ট মানে? আপনি কোথায় পেয়েছেন এইসব? ”

ফাহাদ মুচকি হাসলো তারপর বললো,” আমার লোক জোগাড় করেছে। তারপর বলো মিস স্নিগ্ধা তাসনিম তুমি আর আবরার ফাইয়াজ মিলে ঠিক কি আড়াল করার চেষ্টা করছো?” স্নিগ্ধা রাগ আর বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। আদিলের সন্তান অভ্র না? কথাটি তাকে চিন্তার গভীর সাগরে ফেলে দিয়েছে।

কোনোকিছু ভেবে উঠার আগেই ফাহাদ বললো,” আমি ভেবে পাই না এই গল্পে তোমার চরিত্র কি? হটাৎ মিডিয়ার সামনে একটি বাচ্চাকে বাঁচাতে গিয়ে মুখোমুখি হলে আবরার ফাইয়াজের। তারপর সেই বাচ্চাটির আসল পরিচয় সবার আড়াল করতে গিয়ে এক রাতের মাঝে বিয়েও হয়ে গেলো তোমাদের। অথচ ফ্যামিলির মান সম্মান গেলো তোমার, কটু কথা শুনতে হলো তোমাকে। কিন্তু এই সবে তোমার সার্থটা কোথায়? অভ্র যে আবরার ফাইয়াজের সন্তান না এইটা পর্যন্ত তুমি জানো না। সম্পূর্ণ মিথ্যের এক বেড়াজালে আবদ্ধ তুমি।”

স্নিগ্ধা মুহূর্তেই থমকে তাকালো।চিন্তার অতল গভীরে চলে যেতেই মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন জাগলো তার। সে যতটুকু জানে তার সবই কি মিথ্যে? সবটা মিথ্যে!আনমনেই বলে উঠলো,” তাহলে আরোহী অভ্রর মা এই কথাটি ও কি মিথ্যে?”

কথাটা শুনা মাত্র ফাহাদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তারপর শুকনো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,” কি নাম বললে?”

[ #চলবে ]

#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_২৮
#নবনী_নীলা

কথাটা শুনা মাত্র ফাহাদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তারপর শুকনো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,” কি
নাম বললে?”

আরোহী! নামটা কি ঠিক শুনেছে ফাহাদ? নামটা মনে পড়তেই ভিতর থেকে কেমন নড়ে উঠলো সে। নামটা তার জীবনে কতটুকু বিস্তার করে আজও সেটা একমাত্র সে জানে। ফাহাদ একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলো।

ফাহাদের প্রশ্নের উত্তরে স্নিগ্ধা কিছু বললো না। কথার জট খুলতে খুলতে ব্যাস্ত হয়ে গেছে সে। তার মাথা আর কাজ করছে না। তার ইচ্ছে করছে কোথাও ছুটে পালিয়ে যায়। এই মায়া জালে তার আর থাকতে ইচ্ছে করছে না। তার ভীষন ক্লান্ত লাগছে।

ফাহাদের দিকে তাকিয়ে নিস্তেজ গলায় বললো,” আপনি আমাকে কেনো এভাবে তুলে এনে বেধে রেখেছেন? আপনি কেনো ক্ষতি করতে চান আমাদের?”

ফাহাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সরিয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসলো তারপর বললো,” আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি চাই না। আমি চাই শুধু একজনের ক্ষতি। এই নাটকটা যে শুরু করেছে তার শেষ চাই। যার নাটকে তোমারা নিজের অজান্তেই দিনের পর দিন অভিনয় করে যাচ্ছো।”

স্নিগ্ধার মাথা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে। অনেক কষ্ট করে সে তাকিয়ে আছে।ফাহাদের বলা কথাগুলো সে শুনছে ঠিকই কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না। বাধ্য শ্রোতার মতন শুধু শুনেই যাচ্ছে।

কিন্তু এবার সে আর চুপ থাকতে পারলো না বিষাদময় চোখে তাকিয়ে বললো,” আপনার কোনো কথাই আমি বুঝতে পারছি না। আর এটাও বুঝতে পারছি না যে আপনি কেনো আমাকে এভাবে বেধে রেখেছেন। আমার সাথে তো আপনার কোনো বিরোধ নেই।”

ফাহাদ কিছুক্ষন চুপ করে রইলো তারপর বললো,” তোমার প্রতি সত্যি আমার কোনো রাগ নেই । কারণ আমিও একটা সময় তোমার মতই এমন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে ছিলাম। এবং আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতন আমিও প্রেমে পড়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কালীন আমার জীবনে প্রথম প্রেমের ভ্রমর এসেছিলো। তাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম নতুন জীবন শুরু করবো বলে।” এইটুকু বলেই ফাহাদ থেমে গেলো।

স্নিগ্ধা এতক্ষণ ফাহাদের প্রতি বিষাদ নিয়ে তাকালেও ফাহাদের এমন কোমল কণ্ঠে তার কপালে ভাঁজ পড়লো। কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাতেই ফাহাদ ছোটো করে একটা দম ফেলে বললো,” যতোটা খারাপ মানুষ আমি আজ হয়েছি এতোটাই নিষ্ঠাবান আমি একদিন ছিলাম। কিন্তু প্রতি পদে পদে আমাকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। আমার চরিত্র আমার সততার উপর প্রশ্ন উঠেছে। আর এক সময় আমার ভালোবাসার মানুষটাও আমাকে ভুল বুঝেছে।”

স্নিগ্ধা বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। লোকটাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না সে মিথ্যে বলছে। তার চোখে মুখে বিষণ্ণতার এক ছাপ স্পষ্ট। হটাৎ ফাহাদ তাকে এতো কথা বলছে কেনো? আর হটাৎ এতো জঘন্য মানুষ হওয়ার কি প্রয়োজন পড়লো তার? স্নিগ্ধা বিনা বাক্যে তাকিয়ে রইলো উদ্বিগ্ন চোঁখে।

ফাহাদ শান্ত ভঙ্গিতে বললো,” তোমার নিশ্চই মনে হচ্ছে হটাৎ আমি এতো খারাপ হলাম কি করে? আমি খারাপ হই নি আমাকে খারাপ প্রমাণ করা হয়েছে। আর সেটা কে করেছে জানো?”

স্নিগ্ধা অপলকে তাকিয়ে আছে। কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না। সবকিছু হটাৎ এতো জটিলতায় ভরে উঠেছে যে তার বোঝার কোনো ক্ষমতা নেই সে শুধু শুনেই যাচ্ছে।

ফাহাদ চুপ করে থেকে চোয়াল শক্ত করে ফেললো তারপর তীব্র ঘৃনা নিয়ে বললো,” আবরার আনোয়ার! মানে যে এখন সম্পর্কে তোমার শ্বশুর।”

এতোক্ষণ চুপ করে থাকলেও স্নিগ্ধা এইবার ভীষন রেগে গেলো তারপর কড়া গলায় বললো,” একদম আজে বাজে কথা বলবেন না। আমি চুপ করে আপনার কথা শুনছি তার মানে এই না আপনার যা খুশি আপনি বলবেন। আসলে কি বলুন তো আপনি নিজে জঘন্য যে তাই আশেপাশের সবাইকে আপনার নিজের মতন মনে হয়।”

ফাহাদ মাথা হেলিয়ে অট্টহাসি দিয়ে বললো,” মিস স্নিগ্ধা তুমি কিন্তু ভুলে যাচ্ছো রতনেই কিন্তু রতন চেনে। আশা করি বাংলা এই প্রবাদের অর্থ তোমার জানা আছে। আবরার আনোয়ার যে কেমন মানুষ আগে সেটা জানো, জানবার পর তুমি নিজেই বিচার করে নিও।”

স্নিগ্ধা হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজেকে শান্ত করলো। আনোয়ার সাহেবের মতন একজন মানুষকে নিয়ে কি করে এতো কনফিডেন্ট নিয়ে নেগেটিভ কথা বলে যাচ্ছে এই লোকটা। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে স্নিগ্ধার।

ফাহাদ আজ ভেবেই এসেছে এতদিন যে সত্য সে নিজে জানতো আজ সেটা এই মেয়েটিকে জানাবে।

ফাহাদ ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,” আমি বলেছিলাম না আমার জীবনে প্রেম ভ্রমর এসেছিলো। মেয়েটির নাম আরোহী। আবরার পরিবারের বড় মেয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় যদিও তার এই পরিচয় আমার জানা ছিলো না। আমি শুধু জানতাম আর্ট ক্লাসে একটা মেয়ে খুব সুন্দর ছবি আঁকে নাম আরোহী। প্রায় আর্ট এক্সিবিশনে সবচেয়ে চমৎকার ছবিগুলোর নিচে খুব পেচিয়ে এই নামটাই লেখা থাকতো। মেয়েটিকে দেখার তীব্র ইচ্ছা জাগতো তখন সেই তরুণের মনে। ভাগ্যক্রমে সেই মেয়েটির প্রেমেই তাকে পড়তে হলো। ভার্সিটির পড়া শেষে আরোহীর জন্যে বড় ঘরের প্রস্তাব আসতে শুরু হয়। একজন বেকার প্রেমিকই জানে কতোটা অসহায় সে তখন। আমাকেই মায়ের খেয়াল রাখতে হতো একমাত্র সন্তান আমি। টিউশনের টাকায় আমার আর মায়ের সংসার চলতো।
হটাৎ একদিন আরোহী বেইলি রোডের ফুলের দোকানের সামনে দেখা করে বললো, সে নাকি আজই আমাকে বিয়ে করবে। আজ রাতে নাকি তার বিয়ে ফাইনাল করতে পাত্রপক্ষ আসবে। দুজনেই বিয়ে সেরে ফেললাম কাজী অফিসে গিয়ে। আবরার আনোয়ার ভালোই ঝামেলা করলেন। আমার মতন একটা বেকার ছেলেকে উনি মেয়ের জামাই হিসেবে মানতে পারলেন না। আমার নামে মামলা টামলা করে আমাকে এক রাত জেল পর্যন্ত খাটালেন। কিন্তু আরোহীর জেদের কাছে তিনি সাময়িক হার মানলেন।লোকটা ঠিক কতটা খারাপ তখনো আমি আন্দাজ করতে পারিনি। আমি যে কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছিলাম সেখানে তিনমাস পর টাকা চুরির দায়ে আমার উপর মামলা হয়। পড়ে জেনেছি সব নাকি আমার শ্বশুরের চাল। কিন্তু এখানেই থেমে যায় নি সে, আরোহীর সামনে আমাকে একজন প্রতারক হিসাবেও প্রমাণ করেছে।”,

বলতে বলতে কণ্ঠ থেমে এলো ফাহাদের। সে থেমে গিয়ে দাতে দাঁত চিপে তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বললো,” তোমার আমার মতন মানুষরা কি নিয়ে বাঁচে বলো তো? আত্মসম্মান! সে অপমানে আমার বৃদ্ধ মাও সারাজীবনের জন্যে আমাকে ছেড়ে চলে যায়। আমি তখনো জেলে, যার হয়ে আমি কাজ করছি সেই মানুষটার জন্যেই সেদিন আমি আমার মায়ের কবরে মাটি দিতে পেরেছিলাম। বুক ভরা কষ্ট নিয়ে আমার মা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে।”

স্নিগ্ধা থমকে তাকিয়ে আছে। তার পুরো শরীর শিউরে উঠেছে। হটাৎ নিজের মধ্যে প্রচন্ড রাগ অনুভব করছে সে। ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলতে লাগলো।

ফাহাদ চোখ বন্ধ করে চেয়ারের পিছনে মাথা হেলিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। তারপর চোখ মেলে মাথা সোজা করে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে বললো,” এখন হয়তো এই কথাগুলো তোমার বিশ্বাস হবে না। তাতে অবশ্য আমার কিছু যায় আসে না। আমি শুধু তোমাকে সতর্ক করে দিলাম। আবরার আনোয়ার প্রয়োজনে তোমাকে আজ ব্যাবহার করছে কাল ছুড়ে ফেলে দিতেও তার সময় লাগবে না। আদিলের কাছেও তখন তুমি আর ভালোবাসার কেউ থাকবে না। কারণ আদিল তার বাবাকে অন্ধের মতন বিশ্বাস করে। যার ফল তো তুমি দেখতেই পাচ্ছো সে উঠে পড়ে লেগেছে আমাকে শেষ করবার জন্যে।”

স্নিগ্ধা সব কথা শুনলো। তার হার্ট বিট প্রচন্ড বেড়ে গেছে। রীতিমতন ঘামতে শুরু করেছে সে। তবুও নিজেকে শান্ত করে কাপা কাপা গলায় বললো,” আরোহীর কি হয়েছিলো?”

ফাহাদ চুপ করে রইলো। এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা তার কণ্ঠে নেই। ফাহাদ ব্যাথিত হয়ে তাকালো তারপর বললো,” বাকিটা না হয় আদিলকেই জিজ্ঞেস করো। অবশ্য তোমাকে বলবে কিনা জানি না। আরোহী বলতো ওর ভাইটা বড্ড জেদী। তার প্রমাণ তুমি আমি দুজনেই পাচ্ছি।” বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো ফাহাদ।

স্নিগ্ধা কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই ফাহাদ বললো,” কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমার লোকেশন ওরা পেয়ে যাবে। ততক্ষন তোমাকেই এই বন্ধি অবস্থায় থাকতে হবে। আর হ্যা তোমার চোখে অনেক প্রস্ন কিন্তু এর উত্তর আমি দিবো না। তোমাকেই খুঁজে নিতে হবে।”

স্নিগ্ধা ব্যাস্ত হয়ে নিজের সবটুকু দিয়ে গলা উচিয়ে ফাহাদকে থামতে বললো কিন্তু ফাহাদ একবারো পিছনে তাকালো না। নির্বিকার ভঙ্গিতে বেড়িয়ে গিয়ে স্নিগ্ধাকে আবারো রুমটায় বন্ধ করে দিলো। স্নিগ্ধা নিজের সর্বশক্তি দিয়ে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। দড়ির শক্ত বাঁধনে তার হাত বার বার ঘর্ষণে হাতে ক্ষত হয়ে যাচ্ছে তবুও সে থামছে না। বার বার চেষ্টা করতে করতে হটাৎ মাথাটা কেমন করে উঠলো।চারিপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভরে গেলো।

_______________

স্নিগ্ধা আস্তে আস্তে চোখ মেললো। তার শরীরটা ভীষন দুর্বল লাগছে। সম্পূর্ন চোখ খুলতেই মনে হলো সে নরম কোথাও শুয়ে আছে।চোখ মেলে একটু তাকাতেই চারপাশ দেখতে পেলো স্নিগ্ধা। জায়গাটা চিনতে প্রথমে একটু কষ্ট হলো কিন্তু ভালো করে তাকাতেই খেয়াল করলো সে আদিলের রুমে। প্রথমে বিশ্বাস হলো না তার। স্বপ্ন ভেবে হুড়মুড়িয়ে উঠতে গিয়ে তার শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলো। আদিল পাশেই ছিলো ব্যাস্ত হয়ে সে হাত বাড়িয়ে স্নিগ্ধাকে বসালো। স্নিগ্ধার মাথাটা এখনো ধরে আছে।ব্যালেন্স হারিয়ে পরে যাওয়ার ভয়ে আদিলের হাত শক্ত করে ধরলো তারপর দ্রুত নিশ্বাস নিতে লাগলো। হটাৎ হার্ট বিট বেড়ে গেছে তার।

আদিল স্নিগ্ধার এই অবস্থা দেখে একহাতে স্নিগ্ধার গাল স্পর্শ করে অস্থির কণ্ঠে বললো,” কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখেছো? শান্ত হও, কোনো ভয় নেই। আমি আছি তোমার কাছে।”

[ #চলবে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here