রংধনুর_স্নিগ্ধতা #পর্ব_৩৯,৪০ শেষ

0
1264

#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_৩৯,৪০ শেষ
#নবনী_নীলা
৩৯

আদিল কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে আছে। অন্যমনস্ক হয়েই সে গাড়ি চালাচ্ছে, একটা চিন্তা তার মাথায় এমনভাবে বসে আছে সে কিছুতেই তা বের করতে পারছে না। ফাহাদ নিশ্চয়ই ডায়রিটা পড়ার পর অভ্র কথা জেনে গেছে। এরপর ফাহাদ যদি আরও হিংস্র হয়ে ওঠে তাহলে? যদি অভ্রকে নিয়ে যেতে চায়? আদিল কোনোভাবেই সেটা হতে দিবেনা। অভ্রর ভবিষ্যৎ নিয়ে হেলাফেলা করার কোন অধিকার নেই কারোর। আদিল মানছে তার বাবা ফাহাদের সাথে অন্যায় করেছিল, কিন্তু সেই ভুলের মাশুল তার বাবাকে এখনো গুনতে হচ্ছে।

কিন্তু একথাও তো কোন ভাবে অস্বীকার করা যায় না যে ফাহাদ এতদিন যা অন্যায় করেছে যেসব হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে সবকিছুই তার নিজের ইচ্ছায় ।তাই পিছনের কথা ভেবে বর্তমানকে ভুলে যাওয়া যায় না।

আদিল মনেপ্রাণে চাইছে হাসপাতালে গিয়ে যেন ফাহাদ কে তার দেখতে না হয়। আদিলের জানামতে কাল রাতে ফাহাদের পালানোর কথা ছিল। ফাহাদ যদি পালিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে আদিলের ভয় কিছুটা কমবে। তাই সে সবটা জানা সত্ত্বেও পুলিশ কে কিছুই বলেনি। কিন্তু ফাহাদ যদি পালিয়ে গিয়ে না থাকে তবে তার উদ্দেশ্য একটাই অভ্র কি কেড়ে নেওয়া। সবকিছু যেন আদিল হাসপাতালের দিকে রওনা হয়েছে শুধুমাত্র স্নিগ্ধার অনুরোধে। স্নিগ্ধাকে আর কোন কষ্ট দিবে না আদিল। সে চায়না স্নিগ্ধা তাকে হৃদয়হীন বলে ভাবুক। তাই জীমকে বলে আদিল আগে থেকে সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।

হাসপাতালের সামনে সংখ্যাধিক পুলিশ দেখে আদিল ভ্রু কুঁচকে গাড়ি থামালো। স্নিগ্ধা অভ্র কোলে নিয়ে বসে ছিল এত ভিড় দেখে সেও আগ্রহ নিয়ে বাইরে তাকালো। আদিল দেরি না করে সিট বেল্ট খুলে গাড়ি থেকে বের হলো। স্নিগ্ধাও নামতে চাইলো কিন্তু আদিল বলল,” একদম না; তুমি গাড়িতে বসো আমি দেখছি কী হয়েছে।”

স্নিগ্ধা নামে যাওয়ার সাহস পেলো না।সে গাড়িতে বসেই বাইরে কি হচ্ছে তা বোঝার চেষ্টা করলো। আদিল এগিয়ে যেতেই তাদের পিছনের গাড়ি থেকে জিম নামলো।

হাসপাতালের সামনে যেতেই পুলিশ অফিসার শফিকুল ইসলামের সাথে দেখা হলো আদিলের। বেটে মোটা ও মাথায় টাক পড়া খুবই ভীতু চেহারার লোক অফিসার সাহেব। আদিলকে দেখেই তিনি একটু সতর্ক হলেন। আদিল চিন্তিত মুখের চারপাশে একবার তাকিয়ে অফিসার কে বলল,” কি ব্যাপার! এত অফিসার এখানে কেনো?”

শফিকুল সাহেব একটা ঢোক গিলে আদিলের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে বললেন,” খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা বুঝলেন এর আগে এমন কেস দেখি নাই।
সিআইডি ও আসছে ওনারাও কিছু বলতে পারে না।”

অফিসার সাহেব কথা বলতে বলতেই জিম এসে উপস্থিত হলো। আদিল ভীষণ বিরক্ত নিয়ে অফিসার কে বলল,” আপনি নিজেই বুঝতে পারছেন না, তাহলে জনগণকে কিভাবে আপনি সাহায্য করবেন?”

শফিকুল সাহেব সৌজন্যমূলক হাসলেন তারপর বললেন,” ঘটনায় কি সেটা তো আগে শুনেন তারপর বলবেন যে আপনি বুঝছেন কিনা? আপনি যদি বুঝেন ঘটনা শুনে তাহলে আমার একটু বুঝায় দিয়েন ভাই।”

আদিল আর জিম এক অপরের দিকে তাকালো অফিসারকে এখন তাদের দুজনেরই বিরক্তিকর লাগছে। লোকটা কেমন হেলাফেলা করছে বিষয়টাকে নিয়ে।

অফিসার দুলতে দুলতে বললেন,” শোনেন, কালকে মধ্যরাতে হাসপাতালের একজন নার্সের ফোন পাই। আমাদের একজন অফিসার এখানে ছিলেন, তিনি মধ্যরাতে ঘুমিয়ে পড়ছিলেন। তো আমি কল করার পর তখনি ছুটে হাসপাতালে আসি। এসে তো মনে করেন যে পুরা অবাক। হাসপাতালে পিছনের দিকে একটা মাল ভর্তি ট্রাক অনেকক্ষণ যাবৎ নাকি ছিল সন্দেহজনক কয়েকজনকে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে। খবর শুনে আরো অফিসার আনলাম, আমরা যেরকম হুট করে এসে পড়বো ওরা তো বুঝতে পারেনি তারপর নানান কথা বলে পালাবার চেষ্টা করে যাই হোক আমরা ধরলাম তাদেরকে।

তখন কিছুটা সন্দেহ হয় আমরা উপরে আসি।ফাহাদ রেজওয়ানের রুম ভেতর থেকে বন্ধ। অতিরিক্ত পুলিশ ফোর্স এনে হাসপাতালে চারিপাশ ঘেরাও করলাম তৎক্ষণাৎ, যাতে পালাতে না পারে। দরজা ধাক্কাধাক্কি করলাম পরে উপায় না পেয়ে দরজা ভেঙে ফেললাম। দরজা ভাইঙ্গা আমরা নিজেরাই ব্যাক্কল হইয়া গেছি। লোকটা রুমের ভিতরে একটা ডায়রি কোলে নিয়ে আকাশ দেখেন। না মানে আপনারাই বলেন রাতের তিনটা চারটা বাজে এরকম ফাইজলামির কোন মানে আছে? এরপর আমাদের সহকারী অফিসার মনে করলেন যে ডায়রিটাতে কোন সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যেতে পারে। এরপর ডায়েরীটা নিতে গিয়ে কিযে সর্বনাশটা আজ ঘটে গেলো! আগে জানলেতো ডায়েরিতে হাতই দিতাম না। উন্মাদের মতো লোকটা যে কি করলো শুধু ডায়েরিতে হাত দেওয়ার পরপরই ভাঙচুর শুরু করে। তারপর আরো অস্থির হয়ে পরে। ডাক্তার এসে লোকটারে কত কিছু করে শান্ত করার চেষ্টা কিন্তু শত চেষ্টা করেও আমরা হাত থেকে ডায়রিটা নিবার পারলাম না। বলেই অফিসার থামলেন। চুপ করে সামনে তাকালেন। অফিসারের দৃষ্টি লক্ষ্য করে আদিল কঠিন কন্ঠে বলল,” কি দেখছেন আপনি?”

অফিসার হেসে উঠে বললেন,” আপনার ওয়াইফ এসেছেন? ওনাকে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করতাম আর কি। গতকাল রাতে তো উনি এসে দেখা করে গেছেন। সিসিটিভিতে তো আমরা অনেকেই দেখেছি দেখা করতে গতকাল।তাই জিজ্ঞাসা করার ছিলো।”

আদির বিরক্তি নিয়ে বললো,” আপনি থামুন। আপনার সিনিয়র অফিসার কোথায় আমি তার সাথে কথা বলতে চাই?”

শফিকুল সাহেব থমথমে মুখ করে সেখান থেকে চলে গেলেন। আদিল দুই হাত কোমরে রেখে ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। জিম এসে বলল,” আপনি কোনো চিন্তা করবেন না আমি কথা বলে পুরো বিষয়টা জেনে আপনাকে জানাচ্ছি।” বলেই জিম এগিয়ে গেলো।

স্নিগ্ধা আর অপেক্ষা করতে পারছে না। গাড়িতে বসে সে স্পস্ট দেখতে পাচ্ছে আদিল বেশ চিন্তিত। স্নিগ্ধা অভ্রকে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। অভ্র এত ভিড় দেখে অনায়াসে চুপ করে গেলো।

স্নিগ্ধাকে প্রশ্ন করলো,” এইখানে পুলিশ কেনো?” পুলিশ জিনিসটার সাথে মাত্র কয়েকদিন আগে অভ্রর পরিচয় হয়েছে। পুলিশ মানেই খুব বড় কোনো ব্যাপার এইটুকু সে বুঝতে পারে।

স্নিগ্ধা অভ্রর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,” কিছু না। এমনিই, একটু পর ওনারা চলে যাবে।” অভ্র স্নিগ্ধার কাধে মাথা ফেলে আগ্রহ নিয়ে সবাইকে দেখছে।
স্নিগ্ধাকে এগিয়ে আসতে দেখে আদিল বললো,” আমি তোমাকে বারণ করেছি না। কেনো আমার কথা শুনতে চাও না?” স্নিগ্ধা আদিলের কাছে এসে দাড়ালো তারপর ভয়ার্ত গলায় বললো,” কি হয়েছে? এত পুলিশ কেনো?”

আদিল স্নিগ্ধার হাত ধরে তার কাছে নিয়ে এলো তারপর অভ্রর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,” সবটা জানতে একটু সময় লাগবে।” স্নিগ্ধা অজানা ভয়ে আদিলের হাত আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। স্নিগ্ধাকে ভরসা দিতেই আদিল হাতের বাঁধন আরো শক্ত করলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই জিম এগিয়ে এলো।চোখ মুখ বিষণ্ণ তার। জিম এগিয়ে আসতেই আদিল বললো,” কি হলো? জানতে পারলে কিছু?”

জিম হতাশ গলায় বললো,” ফাহাদের মানসিক অবস্থা বেশ খারাপ। কিছুক্ষন আগ পর্যন্ত ভাঙচুর করেছে। ডাক্তাররা তেমন কিছুই বলতে পারছে না। তাই আপাদত ফাহাদের পার্সোনাল ডাক্তারকে আনা হয়েছে। এখন উনি দেখছেন।”

সবকিছু শুনে স্নিগ্ধা বিস্ময় নিয়ে বললো,” হটাৎ এত ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠার কারণ?”

আদিল এক পলক স্নিগ্ধার দিকে তাকালো তারপর তাকিয়ে থেকে বললো,” ডায়রি..।”

” একটা ডায়রি ওনাকে এত উত্তেজিত করবে কেনো? কিভাবে সম্ভব?”, স্নিগ্ধার প্রশ্নের মাঝেই সিনিয়র অফিসার আর একজন ডাক্তার ওদের কাছের দিকে এগিয়ে এলো। সিনিয়র অফিসার এগিয়ে এসে আদিলের উদ্দেশ্যে বললো,” আমাকে তুমি ভালোই ঝামেলায় ফেলেছো, বুঝলে?”

আদিল একটু চিন্তিত হয়ে বললো,” অবস্থা কি খুব খারাপ?”

” অবস্থা কেমন? সেটাই তো বুঝতে পারছি না। হুট করে এখন আবার কেমন শান্ত হয়ে গেছে।আবার কখন উৎপাত শুরু করবে কে জানে? যাই হোক।” বলেই পাশে দাড়ানো ডাক্তারের দিকে তাকালো।তারপর বললো,” যা বলার উনি বলবেন।উনি রেজওয়ান সাহেবের পার্সোনাল ডাক্তার।”

সবাই কৌতূহল নিয়ে ডাক্তারের দিকে তাকাতেই তিনি স্নিগ্ধার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন,” আপনি কি ওনাকে ডায়রিটা দিয়েছিলেন?”

স্নিগ্ধা হা সূচক মাথা নাড়তেই ডাক্তার বললেন,” কিসের ডায়রি ওটা? কোনোভাবে কি আরোহীর কোনো অস্তিত্ব আছে সেখানে?”

স্নিগ্ধা একটা ঢোক গিলে আবারো হা সূচক মাথা নাড়লো।

ডাক্তার সাহেবের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। তিনি বললেন,” ফাহাদকে আমি তিন চার বছর ধরে দেখছি। আমার জানা মতে আরোহী মানে ওনার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকেই ওনার মানসিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। এর আগে তো উনার মাকে হারিয়েছেন। সব মিলিয়ে ডিপ্রেসন অঞ্জাইটি এইসবে ভুগতে ভুগতে একটা সময়ে উনি নিজেকে তালা বন্ধ করে রাখতেন। সে বন্ধ ঘরে কয়েকদিন পর্যন্ত থাকতো। এমন ও হয়েছে ওনাকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করেছি। রিহ্যাবে আর ওষুধে ভালোই ছিলেন গত বছর ধরে। সমস্যা করছে আপনার এই ডায়রিটা। ওনার ট্রিগারড পয়েন্ট হচ্ছে আরোহী। আমার ধারণা এই কারণে ওনার এই অবস্থা। কিন্তু হটাৎ এত এক্সট্রিম রিয়াকশনের কারণ আমি ধরতে পারছি না।”

সব কথা শোনার পর কেউই কোনো কথা বলতে পারলো না।
অফিসার ডাক্তার সাহেবকে বললেন,” আমাদের সঙ্গে কো অপারেট করার জন্যে ধন্যবাদ ডাক্তার। আপাদত উনি যেহেতু এইমুহুর্তে শান্ত আছেন তাই ট্রিমেন্তের জন্যে আমরা অন্য কোথাও নিয়ে যাবো। আপনার আবার প্রয়োজন পড়তে পারে।”

ডাক্তার সাহেব সব প্রয়োজনে এগিয়ে আসবেন বলে আশ্বস্ত করে চলে গেলেন। সিনিয়র অফিসার আদিলের কাধে স্নেহ সুলভ হাত রেখে বললেন,” চিন্তা করো না, বুঝলে পালাতে পারবে না।” বলেই চলে গেলেন।

সবাই নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে রইলো। জীবন কি অদ্ভুত তাই না। কাউকে দেখে বোঝার উপায় নেই মানুষটা ঠিক কতটা কষ্টে আছে। সবাই শুধু ভালো থাকার অভিনয় করে যায় প্রতিনিয়ত।

হঠাৎ নিস্তব্ধতায় পুলিশের জিপের আওয়াজ শোনা গেলো। হাপাতালের গেইট দিয়ে হ্যান্ডকাফ হাতে বের করে নিয়ে আনা হলো ফাহাদকে । নিশ্চুপে সে বের হয়েছে। হ্যান্ডকাফে বন্ধী হাত দুটো দিয়ে বুকের কাছে শক্ত করে আকড়ে ধরে আছে আরোহীর সেই ডায়রিটা। আশেপাশে ভিড় জমা হয়েছে। চারিদিকে কতো কৌতূহল। সবাই বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। সাধারণ মানুষের চোখে একটা পাগলকে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে এই দৃশ্য বেশ দুর্লভ।

আদিলের এই প্রথম মনে হচ্ছে সত্যি লোকটার সাথে অন্যায় হয়েছে। কিন্তু এখন তার করার কিছুই নেই। এই ভিড়ের মাঝে তাকেও দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখতে হবে।

স্নিগ্ধা চুপ করে আছে। ডায়রিটা ফাহাদকে দিয়ে কি সে কোনো ভুল করেছে। সে তো শুধু আরোহীর অপূর্ন ইচ্ছেটা পূর্ণ করতে চেয়েছিল। ফাহাদকে পুলিশের জিপে তোলা হলো। তার সঙ্গে দুজন পুলিশ বসে আছে। এতক্ষন ফাহাদ চুপ করে এক মনে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলেও এবার সে মাথা তুলে ভিড়ের মাঝে তাকালো। মনে হচ্ছে কাকে যেনো খুঁজছে। ভিড়ের মাঝে স্নিগ্ধার দিকে অপলকে তাকিয়ে আছে ফাহাদ।

চারিদিক চুপ হয়ে যাওয়ায় অভ্র মাথা তুললো স্নিগ্ধার কাধ থেকে। তারপর আশেপাশে তাকাতেই পুলিশ জিপে বসে থাকা মানুষটার দিকে তাকালো সে।অভ্রর দিকে তাকিয়ে ফাহাদের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মলিন হাসিতে একবার নিজের ছেলের দিকে তাকালো সে। উপযুক্ত হাতেই তার ছেলে আছে। ফাহাদ রেজওয়ানের ছেলের পরিচয়ের থেকেও আবার ফাইয়াজের ছেলের পরিচয় অভ্রর জন্যে বেশি মঙ্গলজনক।অভ্রকে কয়েক পলক দেখতেই পুলিশের জিপ ছেড়ে দিল। দেখতে দেখতে দূরত্ব বেড়ে গেলে একসময় অভ্রর চেহারা ঝাপসা হয়ে হটাৎ ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গেলো। ফাহাদের মাথার যন্ত্রণা আরো তীব্র আকার ধারণ করতে লাগলো।

( #চলবে )

#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#সমাপ্ত_পর্ব ( ৪০ )
#নবনী_নীলা

স্নিগ্ধাদের বাড়ি আত্মীয় স্বজনে হৈ হৈ করছে। দুপুরের পর বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হবে। স্পৃহাকে তৈরি করতে করতে স্নিগ্ধা শাড়িটাও বদলাতে পারেনি এখনো। স্পৃহাকে সাজিয়ে দিয়ে রুমে এসে গোসল সেরে বের হলো মাত্র। ভিজে চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে রেখে সুন্দর করে শাড়িটা পড়ে নিলো। ঠোঁটে সুন্দর করে লিপস্টিক দিতেই হটাৎ দরজা বন্ধের আওয়াজ পেয়ে পিছনে ঘুরে তাকালো স্নিগ্ধা।

পিছনে ঘুরতেই আদিলের চোখে চোখ পড়লো। পাঞ্জাবিতে আদিলকে এতো সুন্দর লাগে জানা ছিল না স্নিগ্ধার। এর আগে লোকটাকে পাঞ্জাবিতে কখনো দেখেনি সে। স্নিগ্ধা কিছুক্ষন তাকাতেই বুঝতে পারলো আদিলও তার মতনই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধা চোখ নামিয়ে এদিক সেদিক তাকালো তারপর বললো,” কি! ব্যাপার আপনি হটাৎ দরজা বন্ধ করলেন কেনো?”

আদিল দরজায় হেলান দিয়ে বুকের কাছে হাত গুজে স্নিগ্ধার দিকে তাকালো তারপর বললো,”কেনো বন্ধ করেছি বুঝতে পারছো না?” বলেই মৃদু হাসলো সে।

স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তারপর হাতের লিপস্টিকটা টেবিলে রেখে এগিয়ে এসে আদিলের সামনে দাড়ালো। তারপর কঠিন গলায় বললো,”বাড়ি ভর্তি মানুষ কেউ যদি দেখে এইভাবে দরজা লাগানো তাহলে কি ভাববে? আর তা ছাড়া কারোর কোনো প্রয়োজন হলেও তো ডাকতে পারবে না আমাকে।” শাসিয়ে বললো স্নিগ্ধা।

আদিল হাত বাড়িয়ে স্নিগ্ধার বাহু ধরে দরজা সামনে এনে দাড় করিয়ে দরজার দুপাশে হাত রেখে এক দৃষ্টিতে স্নিগ্ধার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে দেখতে দেখতে বললো,” সবার প্রয়োজনের কথা ভাবছো আর আমারটা? আমারও যে তোমাকে প্রয়োজন।” বলতে বলতে স্নিগ্ধার মুখের সামনের এলোমেলো চুল কানের পাশে গুজে দিলো। স্নিগ্ধা ভরকে গিয়ে তাকালো কিছু বলার আগেই দরজায় মুনিয়া নক করলো। মুনিয়া স্নিগ্ধার ছোটখালার মেয়ে। দরজার আওয়াজে স্নিগ্ধা হুরমুড়িয়ে দরজা খুলতে যাবে তার আগেই আদিল স্নিগ্ধার কোমর জড়িয়ে নিজের কাছে নিয়ে এলো।

স্নিগ্ধা চোখ বড় বড় করে বললো,” কি করছেন কি? ছাড়ুন। ডাকছে তো আমাকে।”

আদিল স্নিগ্ধার গলায় মুখ ডুবিয়ে দিতেই স্নিগ্ধার নিচের ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করলো। শিউরে উঠে আদিলকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেও পড়লো না। মুনিয়া আরো শব্দ করে দরজা ধাক্কা দিতে দিতে বললো,” আপু তাড়াতাড়ি দরজা খুলো। খালা তোমাকে ডাকছে।”

মুনিয়ার কথায় স্নিগ্ধা হুড়মুড়িয়ে কয়েক পা সরে গেল। তারপর দরজা অল্প একটু খুলে মুখটা বের করতেই মুনিয়া রেগে গিয়ে বললো,” কোথায় ছিলে? তোমাকে ডাকতে ডাকতে তো গলা ভেঙে ফেললাম।”

স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে বললো,” তুই নিচে যা। আমি আসছি।” বলেই দরজা চাপিয়ে দিয়ে বুকে হাত রাখলো। ভাগ্যিস মা খালা কেউ আসেনি। স্নিগ্ধা যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু সামনে তাকাতেই আদিলের রাগান্বিত চেহারা দেখে বেশ মায়া লাগলো স্নিগ্ধার। দুদিন এত ব্যস্ততার মধ্যে কাটছে যে, যখনই আদিল কথা বলতে এসেছে কিংবা কথা বলতে চেয়েছে তখন কেউ না কেউ কাবাবে হাড্ডি হয়েছে।

স্নিগ্ধা ঠোঁট চেপে হাসি থামতেই আদিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। স্নিগ্ধা পা টিপে টিপে আদিলের সামনে এসে বললো,” আপনার সাথে আমার কথা আছে একটু এইদিকে আসুন।”

আদিল ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,” আমার সাথে কথা বলতে হবে না। তুমি যাও। তোমাকে ডেকে ডেকে সবাই গলা শুকিয়ে ফেলছে।” বলেই তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। স্নিগ্ধা ভ্রূ কুচকে বললো,” অদ্ভুত লোক তো আপনি। সবাই তো ব্যাস্ত দেখেছেন।”

আদিল তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,” আচ্ছা। তোমার বাড়ির মেয়েরা না হয় ব্যাস্ত আর ছেলেগুলো কিসে ব্যাস্ত?” বোলেই দাতে দাত চিপলো আদিল। স্নিগ্ধা ভ্রূ কুচকে তাকাতেই আদিল রাগে দুই হাত বুকের কাছে ভাজ করতে করতে বললো,” বখাটে একেকটা ।”

স্নিগ্ধা ভ্রূ কুচকে বললো,” একদম আমার পরিবারে কাউকে নিয়ে আজেবাজে কিছু বলবেন না।”

আদিল আরো রেগে গিয়ে বললো,” আচ্ছা। ওরা আজে বাজে কাজ করতে পারে আমি বলতে পারবো না। ঐযে তোমার চাচাতো ভাই নাহিয়ান নাম। কখন যে ওকে মেরে হাসপাতালে পাঠাই।”

স্নিগ্ধা আরেকদফা রাগ দেখিয়ে বললো,” কি আশ্চর্য! আপনি ওকে মারবেন কেনো? কি করে ও?”

আদিল দাতে দাঁত চিপে এগিয়ে এসে বলল,” তোমার দিকে সারাদিন তাকিয়ে থাকে। দুদিন ধরে আমি সহ্য করছি। বাট নাও অ্যাম লুসিং মাই পেসেন্স। ইডিয়েট একটা।”

আদিলের রাগে কারণ শুনে স্নিগ্ধা ভেবাচেকা খেয়ে গেলো।চোখ পিট পিট করে তাকালো। কি করবে এইবার সে। স্নিগ্ধা একটু কেশে বললো,” শুধু তো তাকিয়েছে। এটা কোনো বড় ব্যাপার না। এত রাগ করছেন কেনো?” বলেই আদিলকে শান্ত করার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিতেই আদিল স্নিগ্ধার হাত শক্ত করে চেপে ধরে নিজের কাছে এনে বললো,” এটা কোনো ব্যাপার না? আমি ছাড়া অন্য কেউ তোমার দিকে তাকালে আমার সহ্য হয় না।” আদিল অবাক করে দিয়ে স্নিগ্ধা এগিয়ে এসে আদিলের বাহু ধরে টেনে পায়ের পাতায় ভর করে আদিলের গালের অধর ছুয়ে দিলো।

তারপর কানে কানে বললো,” সহ্য না হওয়াই ভালো লক্ষণ। বুঝলেন?” বলেই ছুটে পালিয়ে যাওয়ার আগেই, আদিল স্নিগ্ধার কোমর জড়িয়ে ঝুঁকে এসে অধর দুটি মিলিয়ে দিলো। আদিলের হটাৎ কাছে চলে আসায় স্নিগ্ধা স্তম্ভিত হয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। এই মুহূর্তের জন্যে একদমই প্রস্তুত ছিলো না স্নিগ্ধা। কিছুক্ষন পর আদিল সরে আসতেই স্নিগ্ধা জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো আরেকটু হলে ধম বন্ধ হয়ে আসতো তার। আর আদিলকে দেখো সে হাসছে।

স্নিগ্ধা আদিলকে সরিয়ে দিয়ে বির বির করে বললো,” অসভ্য।” বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

স্নিগ্ধা অভ্রকে খুঁজতে গিয়ে দেখলো অভ্র স্পৃহা আর জিমের মাঝখানে বসে আছে। বড়রা ওদের দোয়া করতে এসে যখনই মিষ্টি খাওয়াতে যাচ্ছে অভ্র মুখ হা করে বসে আছে। ফলস্বরূপ জিম আর স্পৃহা মিষ্টি নামক অত্যাচার থেকে মুক্ত। স্নিগ্ধা এক কোণে দাঁড়িয়ে অভ্রর দুষ্টুমি দেখছে। আদিল পাশে এসে বুকের কাছে হাত ভাজ করে দাড়ালো। স্নিগ্ধা আদিলের উপস্থিতি বুঝতে পেরে পিছনে তাকাতেই আদিল এগিয়ে এসে স্নিগ্ধার কাছ ঘেঁষে দাড়ালো। স্নিগ্ধা অভ্রকে দেখতে দেখতে হটাৎ ফাহাদের কথা মনে পড়লো কেনো জানি। শুনেছে লোকটা নাকি উন্মাদের মতন সারাদিন কি সব বলতে থাকে। আপাদত জেলেও আছে। আদিল চেষ্টা করছে যাতে ফাহাদের শাস্তি কিছুটা কমানো যায়। স্নিগ্ধা সঙ্গে সঙ্গে মন ঠিক করে নিলো। এইসব ভেবে মন খারাপের দিন নয় আজকে।

বিয়ের অনুষ্ঠান খুব সুন্দর করেই শেষ হলো। স্পৃহাকে গাড়িতে তুলে দেওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলেনি সে। গাড়িটা চলতে শুরু করতেই আস্তে আস্তে তার চোখ ভেসে উঠলো কেনো জানি। জিম প্রথম স্পৃহাকে কাদতে দেখছে। তার বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠলো। কি করবে বুঝতে পারছে না। স্পৃহাকে নিয়ে তো সে পালিয়ে যাচ্ছে না যে এইভাবে কাদতে হবে। জিম হাত বাড়িয়ে স্পৃহার দিকে টিসুএগিয়ে দিল। স্পৃহা টিসুর বক্স নিয়ে আবার মুখ ঘুরিয়ে ফেললো।

জিম খেয়াল করলো অনেক্ষন হয়েছে কিন্তু স্পৃহা কান্না এখনো থামায় নি। তার কিছু বলা প্রয়োজন কিন্তু বলতেও ভয় লাগছে। কি না কি বলে বসবে শেষে না রেগে যায়। যাক রেগে যাওয়াটা খারাপ হবে না আর যাইহোক কান্না তো থামবে। জিম নীচু স্বরে বললো,” কান্না থামাও। কালকেই তো আবার আসবে। ”

স্পৃহা কান্নার মাঝে একবার আড় চোখে জিমের দিকে তাকিয়ে আবার মুখ ঘুরিয়ে ফেললো। জিম স্পৃহার পাশ ঘেঁষে বসতে বসতে বললো,” না মানে তোমার জন্যেই বলছি। কান্না করে তো মেকআপ নষ্ট করে ফেলছো।”

স্পৃহা এবার তীক্ষ্ণ চোখে জিমের দিকে তাকিয়ে বললো,” নষ্ট হোক। তাতে আপনার কি? আপনি কি একবারো আমাকে বলেছেন আমাকে দেখতে কেমন লাগছে? তাহলে এত চিন্তা কেনো আপনার?” অভিমানী সুরে বলল স্পৃহা।

জিম ঠোঁট প্রসারিত করে একটু হাসলো তারপর বললো,” আমি বাদে সবাই তো বলেছে।”

স্পৃহা আরো চটে গিয়ে বললো,” আশ্চর্য। সবার বলা দিয়ে আমি কি করবো? আমি কি সবাইকে বিয়ে করেছি?”

জিম হাত বাড়িয়ে স্পৃহার হাতটা নিজের হাতের ভাজে রেখে বললো,” নিজের মানুষের প্রশংসা কখনো নিজের মুখে করতে হয় না। তাহলে নাকি নজর লাগে। এটা আমার মা সবসময় বলতেন। আমি কুসংস্কারে বিশ্বাস করি না ঠিকই কিন্তু মায়ের মুখ থেকে শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।”

কথাগুলো শুনে স্পৃহা বিস্ময় নিয়ে জিমের দিকে তাকালো। ভালো লাগায় কেনো জানি মনটা আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। স্পৃহা জিমের চোখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে চুপচাপ জিমের কাধে মাথা রাখলো। হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে বললো,” তাহলে আমি কি করে বুঝবো? আমাকে কখন সুন্দর লাগছে? কখন খারাপ লাগছে?”

জিম দুহাতে স্পৃহার মুখটা তুলে ধরতেই স্পৃহা অবাক হয়ে তাকালো। তারপর স্পৃহাকে সম্পূর্ন অবাক করে দিয়ে স্পৃহার কপালে গভীর আবেগে অধর ছুয়ে দিয়ে বললো,” এবার বুঝেছো?”

স্পৃহার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো। বোধহয় একটু লজ্জাও পেলো সে। মুখ নামিয়ে নিয়ে হা সূচক মাথা নেড়ে পুনরায় জিমের কাধে মাথা রাখলো। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে অদ্ভুত এক ভালোলাগা নিয়ে জানালার বাইরে তাকাতেই দেখলো বিকেলের আকাশে এক রংধনু যেনো তাদের নতুন জীবনের শুভেচ্ছা জানতে দাড়িয়ে আছে। বৃষ্টি ভেজা রাস্তা গাড়িটি চলছে আপন বেগে একটি নব দম্পতিকে নিয়ে নতুন এক গল্পে।

[ #সমাপ্ত]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here