প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা,০৪,০৫

0
1014

#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা,০৪,০৫
#আফসানা_মিমি
|চতুর্থ পর্ব|

সকালের হেলানো বাতাসে শরীর হিম শীতল করে তুলে। প্রভাতের প্রথমাংশের বাতাস কিছু মানুষের জন্য আনন্দ বয়ে আনে ঠিক তেমন দুঃখও বয়ে আনে।
ছাদের উপর যেন এক প্রকার ঝড় বইছে। রুপের কাছে এখন মনে হচ্ছে ঝড়ের সাথে সাথে ভূমিকম্পও হচ্ছে। ঝড়ের কারণে রুপের শরীর হিম শীতল হয়ে আসছে। ভূমিকম্পের ফলে রুপের বক্ষঃস্থলের ঠিক বাপ প্বার্শ ধুকপুক করে লাফাচ্ছে।
নাদিফের এখন ইচ্ছে করছে নাদিফের সম্মুখের মেয়েটিকে আচ্ছা মত থাপ্পড়াতে। নাদিফ কিছু একটা ভেবে বুকের উপরে রাখা এক টুকরো রুমাল সরিয়ে নিলো। এক পা দুই পা এগিয়ে এসে রুপের সামনে দাঁড়ালো। নাদিফের ফর্সা বক্ষঃস্থল এখন পুরোপুরি উন্মুক্ত। নাদিফ রুপের একদম কাছে এসে দাঁড়ালো। নাদিফের কাছে আসাতেও রুপের কোন পরিবর্তন হয়নি, আগের ন্যায় হা করে তাকিয়ে নাদিফকে গিলছে।

” কাছে চলে এসেছি। এবার গেলো।”

অতি নিকটে রাগী লোকটার কন্ঠস্বর রুপের কর্ণধারে চলে আসায় রুপের হুঁশ ফিরে আসে। রুপ নাদিফের একদম বক্ষঃস্থলের সমান। রুপের মাথা যদি আরো একটু হেলানো হয় তো নাদিফের ফর্সা বুকে মাথা ঠেকবে। চোখের সামনে ফর্সা বক্ষঃস্থল দেখে রুপ অজ্ঞান হবার উপক্রম। গোলাপি ফ্রেমের চশমার অভ্যন্তরে থাকা মার্বেলের ন্যায় গোল চোখ রুপ এবার শরীরের সমস্ত শক্তি খরচ করে বুজে নেয়। শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে নাদিফকে ধাক্কা দিয়ে এক চিৎকার দেয়।
এদিকে নাদিফ যেন রুপের এহেন কান্ডের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। ছাদে টবে রাখা ক্যাকটাস গাছের উপর নাদিফের হাত গিয়ে পড়ে। এক মুহূর্তের জন্য নাদিফের কাছে মনে হচ্ছিলো কোন ধারালো অ’স্ত্র হাতে ঢুকেছে। নাদিফ হাতের দিকে খেয়াল না করে ক্ষুব্ধ হয়ে রুপের নিকট আসে। রুপ চোখ খিচে বন্ধ করে রাখে যেন রুপ প্রস্তুত নাদিফের শক্ত হাতে আরো দু’ চারটে থাপ্পড় খাবে।
সকালের রোদের সোনালি কিরণ রুপের মুখের উপর আছড়ে পড়ছে। চোখ বন্ধ করে রুপ কি যেন বিড়বিড় করে যাচ্ছে। হলদে ফর্সা রংয়ের রুপ সেই রোদের কিরণে গোলাপি হয়ে যাচ্ছে। রুপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অঙ্গ হচ্ছে ঠোঁট। শুষ্ক গোলাপি ঠোঁটে যেন কত বছর হয় কৃত্রিম সাজসজ্জা ছোঁয়া লাগে না। নাদিফ এই প্রথম কোন মেয়েকে খুঁটিয়ে দেখছে। নাদিফ এসেছিলো রুপকে সত্যি সত্যি’ই আরো একটা থাপ্পড় দিতে কিন্তু এখানে এসে রুপের মায়াময়ী রুপে নিজেই বিলীন হয়ে গিয়েছে। নাদিফ অনুভব করছে সকালের এই অল্প রোদে নাদিফ ঘামছে। নাদিফ নিজের কাজে নিজেই লজ্জিত। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি কোথাও নাদিফ মেয়েদের সংস্পর্শে আসেনি। মেয়েদের দেখলেই বিরক্তি চলে আসে নাদিফের কাছে। নাদিফ ভাবে, মেয়েরা হয় ইমোশনালে ভরপুর। কথায় কথায় নাকে মুখে কান্না করে দেয়। যা নাদিফের একদম অপছন্দ। নাদিফ মাথা হালকা ঝাকিয়ে নিজেকে ঠিক করে নেয়। রুপের নিকট থেকে কিছুটা দূরে সরে চেয়ারে বসে। আড়চোখে রুপের চেহারা আবারও পর্যবেক্ষণ করে নেয়। রুপ এখনও চোখ বন্ধ করা অবস্থায়। নাদিফ মুখে গাম্ভীর্যভাব টেনে এনে বলে,

” আমার হাত কেঁ’টে সেখানে দাঁড়িয়ে কি করছো মেয়ে?”

রাগী লোকটার কন্ঠস্বর দূর থেকে শোনা যাওয়ায় রুপ চোখ খুলে। নাদিফের হাত থেকে ফোঁটা ফোঁটা র’ক্ত পড়ছে। রুপ আল্লাহ্ বলে চাপা আর্তনাদ করে উঠে।
নাদিফ এবার চরম বিরক্ত। এমন বোকা মেয়ে নাদিফ এই জন্মে দেখেনি। একজন মানুষ ব্যাথা পেলে যে এগিয়ে আসতে হয় তা হয়তো এই মেয়ের অজানা।

” এখনও চোখ দ্বারা আমাকে ধ’র্ষ’ণ করেই যাচ্ছো? কাছে এসো।”

কাছে এসো শুনে রুপ আরো দুই কদম পিছিয়ে গেলো। ছাদের এদিক সেদিক তাকিয়ে বিড়বিড় করতে লাগলো। নাদিফের এখন বিরক্ত, চরম বিরক্ত। রুপকে ধমকে দেয় নাদিফ।

” আমার সাথে প্রেমলীলা করতে ডাকছি না। হাতের ক্ষ’তটায় কাঁটা বিধেছে তা উঠিয়ে দিতে বলেছি।”

রুপ যেন আজ বোবা প্রাণী হয়ে গিয়েছে। কন্ঠনালী হতে কোন স্বর বের হচ্ছে না। এরুপ হয়ে থাকে নাদিফের সামনে রুপের। কাঁপা কাঁপা পায়ে রুপ নাদিফের নিকট আসে। হাত ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলে,

” কাঁটা আছে দুইটা।”

এই প্রথম নাদিফ রুপের স্বর শুনে। রুপের কন্ঠস্বর ভাঙা কন্ঠস্বর। হয়তো কথা কম বলে তাই! নাদিফের কানে এই দুইটা শব্দ বারবার বেজে চলছে।

” জমিনে যে রুমাল পড়ে আছে সেটা দিয়ে কাঁটা দুটো উঠিয়ে দাও।”

রুপ ভদ্র বাচ্চার ন্যায় তাই করলো। রুমাল নিয়ে এসে নাদিফের সামনে দাঁড়ালো। চেয়ারে বসা অবস্থায় নিদিফ স্পষ্ট করে রুপকে দেখতে পাচ্ছে। ভয়,লজ্জায় মেয়েটার নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। চার চোখ দিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে কাঁটা তুলছে। পরপর দুইটা কাঁটা উঠিয়ে আনায় নাদিফ ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠে। এদিকে রুপ নাদিফের আর্তনাদ শুনে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। ভয়ে রুমাল হাতে নিয়ে’ই ভোঁ দৌড়। রুপের চলে যাওয়া দেখে নাদিফ চিৎকার করে বলে উঠে,

” থাপ্পড়ের জন্য প্রতিশোধ নিলে মেয়ে তাই না! আরেকবার তোমাকে হাতের কাছে পাই, আমাকে ব্যাথা দেয়ার জন্য দ্বিগুণ পরিমাণে ফেরত দিবো তোমাকে।”

————–

প্রতিশোধ নেয় কীভাবে তা রুপের জানা নেই। কিন্তু বর্তমানে মনে মনে রুপ বেজায় খুশি রাগী লোকটাকে আঘাত করতে পেরে। সিঁড়ি বেয়ে মুচকি হেসে নামছিলো রুপ। গন্তব্য নতুন বাড়ির নতুন ঘর।
আয়েশা আজাদ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছেন উপরে সিঁড়ি বেয়ে। ছেলের আর্তনাদ যে কানে এসেছে আয়েশা বেগমের।
রুপকে দূর থেকে কিছুক্ষণ আগে দেখেছেন। ছেলের হবু বুউ হিসেবে বেশ পছন্দ করেছেন। রুপকে ছাঁদ থেকে হাসিমুখে নিচে নামতে দেখে আয়েশা আজাদেরর মনে লাড্ডু ফুঁটে উঠে। বাড়ির মালকিনকে দেখে রুপ বিনম্রতার সহিত সালাম দিলো।

” আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”

রুপকে আয়েশা আজাদের এতটা’ই পছন্দ হয়েছে যে সালমান খানের সিনেমা কিক্ সিনেমার সালমান খানের মায়ের চরিত্রের ড্রামা শাশুড়ির মত রুপকে বউ সাজে কল্পনা করছেন। এদিকে রুপ পড়েছে মহা ফ্যাসাদে। আয়েশা আজাদ পুরো সিঁড়ি আটকে রুপকে দেখে যাচ্ছে। যার দরুন রুপ নিচে আগাতে পারছে না।

” আন্টি আপনার ঘরে মশা ঢুকেছে।”

রুপ মশা মুখে বলেছে না ঘরে বলেছে তা না শুনে আয়েশা আজাদ ওয়াক ওয়াক করা শুরু করে দেয়। আয়েশা আজাদ ভেবেছে মশা হয়তো মুখে ঢুকেছে। এদিকে আজাদ সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী যে একই প্রকৃতির মানুষ তা বুঝে এসেছে রুপের। তাইতো এই কথা বলা! আয়েশা আজাদ রুপের মুখে এত হাত রেখে বলে,

” মাশাআল্লাহ! কি নাম তোমার?”
রুপের মিষ্টি উওর,

” রিনিঝিনি রুপ।”

আয়েশা আজাদ আরো কিছু বলতে চাচ্ছেন কিন্তু রুপকে উনার এত’ই পছন্দ হয়েছে যে ইমোশনাল হয়ে কন্ঠনালী থেকে স্বর বের হচ্ছে না। এক প্রকার লাজুক হেসে রুপের সামনে থেকে প্রস্থান নিলেন।
——–

সময় এখন মধ্যাহ্নভোজের। প্রেম নীড়ে আজ বাহারি খাবারে ভরপুর। আজাদ সাহেব কিছুক্ষণ পর পর রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে যাচ্ছেন খাবারের সুগন্ধি পেয়ে। পরপর আয়েশা আজাদের চোখ রাঙানি দেখে ভয়ে আবার চলেও যাচ্ছেন আজাদ সাহেব। নাদিফ, নাবিল আজ বাসায়। ফাহিমা মুখ ফুলিয়ে কাজ করছে। অন্য সময় হলে দেখা যেতো কথা বলে বলে শাশুড়ির মাথা খাচ্ছে কিন্তু আজ নীরব। ফাহিমার নীরবতাটা আয়েশা আজাদকে ভীষণ ভাবাচ্ছে।

” ঐ বেটি, মুখে কি আজ আঠা দিয়ে রেখেছিস? কথা বলছিস না কেন?”

ফাহিমা যেন শাশুড়ির আগে বাড়িয়ে কথা বলার জন্য অপেক্ষায় ছিলো। আয়েশা আজাদের কথা শেষ হতেই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না করে দেয়।

” কান্না করছিস কেন? নাবিল কি বকেছে? আমাকে একবার বল নাবিলের শরীর থেকে মাথা আলাদা করে ফেলবো।”

ফাহিমার কান্না শুনে আজাদ সাহেবও দৌঁড়ে আসেন। আদরের বউমার চোখে পানি দেখে আয়েশা আজাদকে বকে দেন,

” ললিতা, কেন বকছো মেয়েটাকে। প্রেম নীড়ে শুধু ভালোবাসা থাকবে কান্না নয়। তুমি কি জল্লাদ শাশুড়ি সাজতে শুরু করেছো? সোনা ময়না জাদুর পাখি! ঐসব চিন্তা বাদ দাও। ভালো শাশুড়ি হয়ে যাও।”

আয়েশা আজাদ হতভম্ব। তাঁর স্বামী কোন কথাকে কোথায় নিয়ে গেলেন তা ভাবছে।
” কি বললে! আমি কখন বকলাম? পারো তো শুধু আমার পিছনে লাগতে। তুমি মনে হয় সাধু!”

এদিকে ফাহিমার কান্নার কথা যেন দুজন ভুলে গিয়েছে এবং নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করছে। শ্বশুর শাশুড়ির ঝগড়া দেখে ফাহিমা আরো জোরে কান্না করতে থাকে।

” আমি কান্না করছি, আমাকে দেখো। ঝগড়া করো না তোমরা।”

ফাহিমার কথা শুনে চুপ হয়ে গেলো দুজন। আজাদ সাহেব এবার নরম স্বরে প্রশ্ন করলেন,

” কেন কাঁদছো মা! কেউ কিছু বলেছে? বলো আমাকে একবার! তাঁর মাথা আজ’ই টাক করে ফেলবো।”

শ্বশুরের কথায় ফাহিমা পিটপিট চোখ করে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে শ্বশুরের উদ্দেশ্যে বলল,

” আগে টাক হয়ে আসো বাবা। তারপর বলবো।”

আজাদ সাহেব থতমত খেয়ে গেলেন। বিস্ময়করদৃষ্টিতে তাকালেন ছেলের বউয়ের পানে।
” আমি টাক হয়ে আসবো। মানে আমি তোমাকে কিছু বলেছি? কিন্তু কখন? কোথায়?”

ফাহিমা এবার ছলছল চোখে শ্বশুরকে বলল,

” তুমি না গতকাল রাতে বললে, আমি পোয়াতি। কিন্তু আমি তো পোয়াতি না! তারমানে তোমাদের ছেলে আরো একটা বিয়ে করেছে আমার আড়ালে আর তা তোমাদের জানা। আমি এই কষ্টে কান্না করছি।”

আয়েশা বেগম খুন্তি হাতে ফাহিমার দিকে তেড়ে আসলেন। কিন্তু মারলেন না বরঞ্চ মাথায় গাট্টি ভিরে বললেন,
” ওরে গাঁধী রে! তোর শ্বশুরের মাথায় যে পোকা ধরেছে তা তুই জানিস না? ফোনে নিজেকে বাচানোর জন্য কাকে না কাকে মিথ্যা বলেছে। আর তুই সেটা ভেবেই! ইয়া আল্লাহ! আমি কোথায় আছি!”

আজাদ সাহেব বিড়ালের ন্যায় চুপসে গেলো। মিনমিন করে বলল,

” খিদে পেয়েছে। খাবার আনো বউমা।”
———

খাবার টেবিলে রুপ মলিন মুখ করে বসে আছে। এদিকে রাইসার মুখে আনন্দের হাসি। চোখের সামনে এত এত সুস্বাদু খাবার দেখে গাপুস গুপুস করে এক নিমিষে সব খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। রুপ এবং রাইসাকে এক প্রকার জোর করে আয়েশা আজাদ খাবার টেবিলে নিয়ে আসেন। স্বল্প পয়সায় এই বাড়িতে থাকছে এই ব্যাপারটা রুপের অন্তরকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। এখন আবার খাবার! রুপ বিনা পয়সায় বিলাসিতা করতে ইচ্ছুক না।
নাবিল, ফাহিমা একসাথে নিচে নেমে আসে। ফাহিমার মুখ থেকে নতুন দুই মেয়ের কথা শুনেছে নাবিল। নাবিলের মেয়েদের নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। খাবারের টেবিলে এসে বসে পড়েন।
আজাদ সাহেব রুপকে খাবারের টেবিলে দেখে খুবই আনন্দিত হলেন। হবু ছেলের বউয়ের পাশে বসে খোশ গল্প করবেন বলে ইচ্ছে পোষণ করলেন। খাবারের টেবিলের চেয়ার টেনে হাসিমুখে রুপকে কিছু বলবেন তাঁর আগেই ঝড়ের বেগে কোথায় থেকে নাদিফ চেয়ারে বসে পড়লো।
ছেলের কান্ডে আজাদ সাহেবের মুণ্ডু আক্কেল গুরুম। মুখ ফসকে আজাদ সাহেব বলে ফেলল,

” এটা কি হলো?”

নাদিফ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,

” তোমার বউ ঐখানে বসেছে, এখানে না। যাও নিজের বউয়ের পাশে গিয়ে বসো।”

চলবে………..

#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা
#আফসানা_মিমি
|পঞ্চম পর্ব |

আমারা বাঙালিরা সাধারণত মধ্যাহ্নভোজের পর পর বিশ্রাম নামক নিদ্রায় আচ্ছাদিত হতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। মধ্যাহ্নভোজের পর নরম তুলতুলে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেই নিদ্রা ভর করে আসে আঁখি পল্লবে।
পুরো মহল্লার মানুষেরা যেখানে শয়নকক্ষে বিশ্রাম নিচ্ছে সেখানে রুপ কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বের হচ্ছে প্রেম নীড় থেকে। উদ্দেশ্যে দর্পণ নামক কোচিং সেন্টার। যেখানে দুই থেকে চার ঘন্টা রুপ ক্লাস করাবে। রুপ ভার্সিটির ছাত্রী। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে রুপ। পাবলিক ভার্সিটি হওয়ায় ক্লাস মিস দিলে তেমন একটা সমস্যা হয় না রুপের। এতদিন এতিমখানায় থেকে পড়াশোনা করতো রুপ। এতিমখানার মালিক পরিবর্তন হওয়ায় নতুন নিয়ম চালু করা হয়েছে যেখানে বিশ বছর বয়সী মেয়েরা নিজ উপার্জনে চলতে হবে। তাদের দায়ভার এতিমখানার মালিক নিবে না। রুপের সাথে রাইসাও এতিম। রাইসাকে এতিমখানার পুরোনো মালিক রাস্তা থেকে কুঁড়িয়ে এনে আশ্রয় দেয়। ছোট বেলা থেকেই রাইসা রুপের পাগল। রুপ ছোট বোনের ন্যায় স্নেহ করে বড়ো করেছে রাইসাকে। রাইসার বয়স এখন একুশ। পড়াশোনায় কাঁচকলা। টেনে টুনে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়িয়েছে রুপ। বর্তমানে একটি কফি শপে চাকরি করে। পরিধানের জন্য জামা কাপড় নেই রাইসার। রুপের কাপড় পরিধান করে করেই চাকরিতে যায় রাইসা।

প্রেম নীড় থেকে বের হতেই রুপের মুখোমুখি হতে হয় দারোয়ানের। দারোয়ান কুদ্দুস মোল্লা দাঁত কেলিয়ে হাসছেন রুপকে দেখে।

” কই যাইব মাইয়া? মার্কেটে নাকি?”

দারোয়ানের কথা বুঝতে যেন রুপের কয়েক মুহূর্ত লেগে গেল। পিটপিট চোখে দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে কথার মানে বুঝতে চেষ্টা করলো রুপ। অবশেষে বুঝতে সক্ষমও হলো।

” কোচিংয়ে যাচ্ছি। সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবো।”

কুদ্দুস মোল্লা একটু হাত পাতা মানুষ। যার তাঁর কাছে টাকা চাইতে তাঁর বিবেকে বাঁধে না। রুপকে নতুন পেয়ে হাত চুলকোতে চুলকোতে বলে,

” তা তুমি কি আদব কায়দা কিছুই জানো না?”

রুপ দারোয়ানের মুখে এমন কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। রূপের যতটুকু মনে পড়ে এই লোকের সাথে খারাপ আচরণ করে নি। রুপ যথেষ্ট বড়োদের সম্মান করে। রুপ প্রশ্নবোধক চাহনিতে দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকে। এদিকে দারোয়ান কুদ্দুস মোল্লা মনে মনে বেজায় খুশি। এমন বোকা মেয়ের কাছ থেকে প্রতিদিন পকেট ভর্তি টাকা নিতে পারবে।

” এই বাড়ির হগ্গলে আমারে মেলা ভালাবাসে। আসতে যাইতে দোয়া দিয়ে যায়। তুমি তো কিছু দোয়া দিলা না?”

দারোয়ানের কথা শুনে রুপ প্রত্যুওরে বলল,

” আমি তো সকলের জন্য’ই দোয়া করি।”
দারোয়ান যেন এবার বিরক্ত হলো। এমন বোকা মেয়ে দারোয়ানের জীবনে এই প্রথম দেখছে।

” আরে দোয়া মানে বুঝো না! হাতে কিছু গুঁজে দোয়া দেয়া। ”

এতক্ষণ পর রুপের বোধগম্য হলো কুদ্দুস মোল্লা কোন দোয়ার কথা বলছে। কিন্তু রুপের নিকট এখন মাত্র একশত পঞ্চাশ টাকা আছে। মাসের শুরু হলেও পাঁচ বা ছয় তারিখে কোচিং থেকে টাকা পাবে। অগত্যা রুপ মলিন হেসে ব্যাগ থেকে টাকা বের করে পঞ্চাশ টাকার নোট দারোয়ানের হাতে তুলে দেয়।
দারোয়ান পঞ্চাশ টাকার নোট পেয়ে খুশি হলো না যেন। মুখটাকে ভোঁতা করে গেইট খুলে দেয়।

রাস্তায় নেমে প্রেম নীড় থেকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে রুপ টাকা হিসেব করছে। ব্লক সি থেকে কোচিং সেন্টারে যেতে হলে আসা যাওয়া চল্লিশ টাকা ভাড়া প্রয়োজন। এদিকে রাইসা আজ ওভারটাইম করবে শপে। সন্ধ্যায় কিছু নিয়ে না আসলে অভুক্ত থাকতে হবে মেয়েটার। রুপ কোন উপায়ান্তর না পেয়ে হাঁটা শুরু করল।

কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে দু’তলা থেকে নাদিফ এতক্ষণ সকল কিছুই পর্যবেক্ষণ করছিলো। ইদানিং দারোয়ানের জিহ্বা যে বেড়ে গিয়েছে তা ছোট করতে হবে। আর এই কাজটা সুযোগ বুঝে নাদিফ করবে। কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে গায়ে পাতলা টি-শার্ট জড়িয়ে বাইকের চাবি নিয়ে বের হয়ে আসে ঘর থেকে।
কুদ্দুস মোল্লা এই অসময়ে ছোট সাহেবকে বের হতে দেখে অবাক হয়ে যায়। কুদ্দুস মোল্লার ছোট সাহেব এই সময়ে ঘরে’ই থাকেন।সন্ধ্যায় বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে ফেরত আসে রাতে।
নাদিফের বাইক চালিয়ে গেইটের কাছে আসার আগেই দারোয়ান গেইট খুলে দেয়। হাত দিয়ে স্যালুট জানিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কুদ্দুস মোল্লাকে দেখে নাদিফ থেমে যায় গম্ভীর কন্ঠস্বরে বলে,

” চোরের দশদিন, আর গিরোস্তির একদিন। কথাটা মনে রাখিস বাচাধন!”

দারোয়ান নাদিফের কথার মানে বুঝলো না। কপাল থেকে হাত নামিয়ে কিছু বলবে তার আগেই নাদিফ পারাপার।

” এই মেয়ে, জানের ভয় নেই নাকি? এই অসময়ে বাহিরে কি?”

রুপ হেঁটে হেঁটে প্রেম নীড় থেকে অনেকটাই দূরে চলে এসেছে। আচমকা রাগী লোকটার কন্ঠস্বর শুনে শুকনো ঢোক গিলে। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে রাগী লোকটা ঠিক রুপের পাশাপাশি বাইক নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নজর তাঁর সম্মুখে। রুপ ভাবছে হয়তো অন্য কাউকে বলছে তাই রুপ কোন উওর না দিয়ে আবারও হাঁটতে থাকে। এদিকে নাদিফকে রুপ ইগনোর করাতে নাদিফ রেগে যায়। মোটরবাইকে বসেই রুপের হাত শক্ত করে ধরে,

” কানে কি তুলা দিয়ে রেখেছো?”
” ব্যাথা পাচ্ছি।”
” ব্যাথা পাওয়ার জন্যই এত জোরে ধরেছি। আমাকে ইগনোর করো তাই না?”
” মোটেও না।”
” তাহলে আমার কথার উওর দিচ্ছো না কেন?”

রুপের এখন ইচ্ছে করছে হাত পা ছড়িয়ে কান্না করতে। রুপ যত চায় এই রাগী লোকটার থেকে দূরে সরে থাকতে তত’ই এই লোকটা কোথায় থেকে যেন এসে রুপের সামনে টপকে পড়ে।

” হাত ছাড়ুন। আমি আপনাকে ইগনোর করছি না। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমাকে যেতে দিন।”

রুপের কান্নামাখা কন্ঠস্বর শুনে নাদিফ শান্ত হয়। রেগে গেলে নাদিফের মাথা ঠিক থাকে না। কখন যে কি করে বসে নিজেও জানে না। আর এই মেয়ে যদি এখন কান্না শুরু করে দেয় তো দেখা যাবে নাদিফ লোকসম্মুখে’ই থাপ্পড় দিতে শুরু করেছে।
নাদিফ চোখ বন্ধ করে লম্বা নিশ্বাস ত্যাগ করে নিজেকে শান্ত করে নিলো। রুপের উদ্দেশ্যে কিছুটা নরম স্বরে বলল,

” গাড়িতে উঠে বসো।”

রুপ যেন আকাশ থেকে টপকে পড়লো। চোখ বড়ো বড়ো করে সুন্দর রাজপুত্রের মতো ছেলেটাকে দেখতে লাগলো। রুপের নড়চড় না দেখে নাদিফ ভ্রু যুগল কুঁচকে বলল,

” আমি ইটালিয়ান ভাষায় কথা বলিনি, শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলেছি। গাড়িতে উঠে বসো মেয়ে, নয়তো এখানেই থাপ্পড়াতে শুরু করব।”

নাদিফের এমন কঠোর কন্ঠস্বর শুনে রুপ আর এক মিনিটও ব্যায় করলো না। হুড়মুড় করে বাইকে চড়ে বসলো। এদিকে রুপের ভয় পাওয়া দেখে নাদিফ বাঁকা হাসলো। এই মেয়েকে শায়েস্তা করতে নাদিফের বেশ লাগে।

” কোথায় যাবে?”
” দর্পণ কোচিং সেন্টারে।”
” পড়াশোনা করতে?”
” পড়াশোনা করাতে।”
” বাব্বাহ! ম্যাডাম দেখি।”

নাদিফের মুখে দুষ্টু হাসি। স্বচ্ছ মোটরবাইকের দর্পণ দিয়ে দেখতে পারছে রুপের লাজুকরাঙা মুখশ্রী। নাদিফের এখন ইচ্ছে করছে রুপের এমন লাজুকরাঙা মুখশ্রীতে একটা নাম দিতে। নাদিফ মনে মনে রুপের নামের পাশে দুইটা অক্ষর বসিয়ে দিলো। রুপের লাজুকরাঙা মুখশ্রীতে ঘায়েল হয়েছি ‘অপরুপ’!

দর্পণ কোচিং সেন্টারের সামনে এসে মোটরবাইক থামায় নাদিফ। রুপ মোটরবাইক থেকে নেমে এদিক সেদিক নজর ঘুরিয়ে সময় নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলো।
রুপের এহেন কান্ডে নাদিফ রুপকে পিছন থেকে ডেখে উঠে,

” এই মেয়ে শুনো?”

এগিয়ে গিয়েও রুপ আবার পিছন ফিরে তাকায়। প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকিয়ে থাকে নাদিফের দিকে।

“আমার বাবার কাছ থেকে দশ হাত দূরে থাকবে, বুঝেছো?”

নাদিফের এমন মিষ্টি হু’ম’কি পেয়ে রুপের মাথা আপনা আপনিই হেলে যায়। নাদিফ এবার জোরে মোটরবাইক চালিয়ে চলে যায় চোক্ষের আড়ালে।
————-

” ললিতা তুমি করো শুধু ভনিতা।
কাছে আসো না, পাশে বসো না।
করো যে শুধু বাহানা।”

বৈকালীন সময়ে আয়েশা আজাদ ঘরে বসে কাপড় ভাঁজ করছিলেন। আজাদ সাহেব মনের আনন্দে বারান্দায় ফুলের গাছে পানি দিচ্ছেন আর মনের সুখে প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে গান গাইছেন। স্বামীর কন্ঠস্বরে গান শুনে আয়েশা আজাদ মুচকি হাসছেন। বোঝা’ই যাচ্ছে শেষ বয়সে এসে স্বামীর অঘাত ভালোবাসা পেয়ে আয়েশা আজাদ বেজায় খুশি।

এদিকে ফাহিমা নিজের ঘরে অনেকক্ষণ যাবত আয়নার সামনে বসে কেশব গুছিয়ে যাচ্ছে। মুখে যেন পুরো রাজ্যের আধার নেমে এসেছে। নাবিল স্ত্রীর কান্ডে খুবই মর্মাহত। সপ্তাহে এই একটা দিন বাসায় থাকে নাবিল। কই স্ত্রী এসে স্বামীর সহিত দুই একটা মিষ্টি কথা বলবে! তা না করে মুখ ভার করে বসে আছে। নাবিল বুঝতে পারছে যেকোন কারণে ফাহিমার মন খারাপ। নাবিল বিছানায় আয়েশ করে বসে বলে,

” কি হয়েছে আমার ফামুটার?”

স্বামীর আহ্লাদে কথা শুনেও ফাহিমার কোন নড়চড় নেই। ঠায় হয়ে বসে রয়েছে আয়নার সামনে। নাবিল এবার শক্ত করে স্ত্রীকে ডাকলো,

” তুমি যদি এক্ষুনি আমার কাছে না আসো, তাহলে কিন্তু প্রেম নীড়ে আরেকটা বউ চলে আসবে।”

নাবিলের এক কথা যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো। এতক্ষণে লতার মতো কেশব আচড়ে দেয়ার চিড়ুনি খানা শব্দ করে টেবিলের উপর রাখলো। রাগে ফোঁস ফোঁস করে বলল,

” হ্যাঁ হ্যাঁ! ঐ একটা কাজ ই তো করতে পারবে। বিয়ে করা ছাড়া তোমাদের ছেলেদের আর কোন কাজ আছে নাকি?”
বর্তমানে নাবিলের কাছে মনে হচ্ছে ফাহিমা যেন আগুনের ফুলকি। যেখানে একটু ছোঁয়া লাগলেই ভষ্ম হয়ে যাবে।

” ফামু! বউ আমার, কি হয়েছে তোমার? আমি তো তোমাকেই ভালোবাসি। মজা করলাম একটুখানি। কাছে এসো বউ কি হয়েছে বলো আমাকে।”

ফাহিমা স্বামীর আহ্লাদ মাখা স্বর শুনে কান্না করে দিলো। নাকে মুখে কান্না করে বলল,

” তোমার কোন বউ পোয়াতি সোয়ামি?”

———
কোচিং সেন্টারে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াচ্ছে রুপ। সাদা বোর্ডে কালো কালি দিয়ে এটা সেটা লিখে জ্ঞান চর্চা করাচ্ছে। প্রায় আধা ঘন্টা যাবত পড়াচ্ছে রুপ। বসারত ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে খুব সুন্দর মনোযোগ। সবার মস্তিষ্কে যেন রুপের বুঝানো পড়া ঢুকে যাচ্ছে খুব সহজে’ই মনোযোগী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে শুধুমাত্র একজন ছাড়া। সে একমনে সুন্দরী শিক্ষিকার ভাবভঙ্গি দেখে যাচ্ছে।

” এভাবে হা করে না গিলে, পড়াটা মাথায় ঢুকা। কাজে লাগবে।”
” উফ তুই চুপ থাক তো মুটি! ম্যাডাম আমার বাল্যকালের ক্রাস। ম্যাডামকে যত দেখি তত মুগ্ধ হই।”

কোচিং সেন্টারের দুই বন্ধু ফাল্গুনী, ফয়সাল। নামের মত তাঁদের বন্ধুত্ব মজবুদ। একাদশ শ্রেণীর ছাত্র তারা। ফয়সালের ক্রাস রুপ। উঠতে বসতে রুপের পাগল যেন ফয়সাল। ফাল্গুনী ফয়সালের ছোটবেলার বন্ধু। ফয়সালকে অনেকবার নিষেধ করার পর ও ছেলেটা রুপের পিছনে পড়ে থাকে।

” ফয়সাল, ফাল্গুনী! পড়াশোনায় মনোযোগ দাও।”

রুপের কথায় দুজন কথা ছেড়ে মনোযোগ দেয়।
এদিকে রুপের ফোনটা অনবরত বেজে চলছে। এই নিয়ে ঊনিশবার কল এসেছে ফোনে। ছাত্র-ছাত্রীদের পাশাপাশি রুপ ও এবার বিরক্ত। কোন রকম ক্লাস শেষ করে বের হয়ে আসে শ্রেণী কক্ষের বাহিরে।

ছোট বাটন ফোনের দেয়ালে অপরিচিত নাম্বার দেখে ভ্রু যুগল কুঁচকে আসে রুপের। বিশবারের মাথায় কল আসায় রুপ ফোন রিসিভ করে। রুপ কিছু বলবে তার আগেই অপরপাশ থেকে কথা ভেসে আসে,

” ঐ তোর মতো কি আমি অযথা বসে থাকি? আমার কি কাজ কর্ম নেই? কেন ফোন দিয়েছিলি আমাকে, প্রেম করতে? তোর প্রেমের উপর আগুনের ফুলকি পড়ুক দোয়া করি। রাত-বিরাতে ছেলেদের ফোন করে চুপ করে থাকা তাই না! আরেকবার যদি আমাকে কল করিস তো তোকে জে’লে ঢুকাবো বলে দিলাম।”

কল কেঁটে গেলো। রুপের এক মুহূর্তও সময় নেয় নাই বুঝতে যে এতক্ষণ কে কথা বলেছে। রুপ ফোন হাতে নিয়ে বিস্ময়কর দৃষ্টিতে ফোনের দিকে নজর দিলো। আপনমনে বলল,

” আমি জে’লে যেতে চাই না। ঐ রাগী লোকটার সামনে আর পড়বো’ই না। আজ’ই চলে যাবো প্রেম নীড় থেকে আজীবনের জন্য।”

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here