প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা,০৬,০৭

0
1039

#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা,০৬,০৭
#আফসানা_মিমি
|ষষ্ঠ পর্ব |

গ্রীষ্মকালীন সময়ে রোদের পর বৃষ্টির আগমন যেন অমাবস্যার চাঁদ। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে যাওয়া মানুষদের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠে। কিন্তু কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। বৈকালীন শেষ সময়ে সূর্য্যিমামা যখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে ঠিক সেই সময়ে প্রকৃতির মান হয়েছে। পুরো আকাশ জুড়ে শুধু মেঘের ভেলারা খেলা করছে।
রুপ দুঃখি মনে কোচিং সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রুপের হাতে একশত টাকা রয়েছে অবশিষ্ট। রুপ ভেবেছিলো সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে যাবে। কিন্তু প্রকৃতির যা অবস্থা! দেখে মনে হচ্ছে এখন বের হলে মাঝপথে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে হবে।

” ম্যাম বাসায় যাবেন না?”

গভীর ভাবনায় বিভোর ছিলো রুপ। কারোর ডাকে পিছনে ফিরে তাকাতে’ই দেখে রুপের ছাত্র ফয়সাল হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে আর তাঁর পাশেই মিষ্টি মেয়ে ফাল্গুনী।

” হ্যাঁ যাবো। তোমরা আগাও। আমার কিছু কাজ আছে।”

ফয়সাল আরো কিছু বলবে তাঁর আগেই ফাল্গুনী ফয়সালকে এক প্রকার টেনে সাম্মুখে নিয়ে যাচ্ছে। চার পাঁচ কদম আগানোর পর ফয়সাল ফাল্গুনীর হাত ঝেড়ে আবারও রুপে সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখে কিছুটা লাজুক হাসি এনে বলে,

” আপনি কি আপনার বয়ফ্রেন্ডের জন্য অপেক্ষা করছেন?”

রুপ অবাক, বিমূঢ়। চঞ্চল দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। এমন লজ্জাকর পরিস্থিতিতে যে ছাত্রের সামনে পড়তে হবে তা ভবঘুরে বুঝতে পারেনি রুপ।
এদিকে ফাল্গুনীর মাথায় হাত। ফয়সাল যে এতোটা ঠোঁট কাঁ’টা স্বভাবের হবে তা আগে বুঝার উচিত ছিলো ফাল্গুনীর।

” বাসায় যাও তোমরা।”

ফয়সালকে ফাল্গুনী এক প্রকার জোর করে রুপের সামনে থেকে নিয়ে যায়।
এদিকে রুপ কোচিং সেন্টার থেকে বের হয়ে আসে। বলা তো যায় না! কখন যেন আবার কোন ছাত্র এসে বলবে,

” ম্যাম আপনার জামাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছেন?”

রুপ আর ঝুঁকি নিতে চায় না। এমনিতেও আসার সময় রাগী লোকটা নিয়ে এসেছে। ভাগ্যিস কেউ দেখেনি। এ নিয়ে চিন্তার শেষ নেই রুপের।

বন্ধু মহলে আড্ডায় মেতে আছে সকলে। একসাথে তিনটে মোটরবাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মজা মাস্তি করছে। সকলের হাতে চায়ের কাপ। হালকা করে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে আর কথা বলছে। প্রায় পাঁচজন বন্ধুর মধ্যে আড্ডার আসর জমলেও শুধু একজন গভীর ভাবনায় ব্যস্ত। নাদিফ পরপর নিকোটিনের ধোঁয়া আকাশে উড়িয়ে যাচ্ছে আর কি যেন চিন্তা করছে। বন্ধুমহলের মধ্যে একজনের নাম আকাশ। খুবই দুষ্টু প্রকৃতির। নাদিফের উদ্দেশ্যে বলে,

” কি মামা! প্রেমে পড়েছো নাকি? ভাবসাব ভালো ঠেকছে না।”

সিগারেটে শেষ ফুক দিয়ে আকাশের পিঠে চাপড়ে নাদিফ উওর দিল,

” ভালোবাসা আমার দ্বারা সম্ভব না। এসব ভালোবাসা করার সময় আমার নেই। মেয়ে মানুষ মানে ঝামেলার বস্তু।”

” তাহলে স্মোক করছিস কেন?

নাদিফ এবার কিছুই নড়েচড়ে উঠলো। ললাটে সূক্ষ্ম ভাজ ফেলে বলল,

” আজকাল মনে হচ্ছে আমার অগোচরে কিছু একটা হচ্ছে। কেউ একজনের দিকে মন ঘুরে যাচ্ছে। যা আমি চাই না, তাই হতে যাচ্ছে।”

আকাশ হতভম্ব। বন্ধুমহলের সবসময় সবচেয়ে নিরামিষ খেতাব পেয়ে এসেছে নাদিফ। আর সেই নাদিফের মনে কিছু একটা ঘটছে। ভেবেই আনন্দ লাগছে। আকাশ মনে মনে দোয়া করছে যেন কোন মেয়ে আসে নিরামিষের জীবনে। আকাশ কিছু বলবে তাঁর আগেই নাদিফ অদূরে কাউকে দেখে বলে উঠে,

” আকাশ মেঘলা হয়ে আছে। তোরা থাক আমার কাজ আছে।”

নাদিফ আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। বাইকে চড়ে আড্ডামহল থেকে আড়ালে চলে গেলো।

ব্লক সি এখনও অনেকটা পথ দূরে। প্রবল বাতাস বইছে চারপাশে। হয়তো কোথাও ঝড় হচ্ছে! রুপ ওড়না দিয়ে শরীরে ভালোভাবে পেঁচিয়ে নিলো। বলা তো যায় না যদি ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টিধারা নেমে আসে!
রুপের এখন প্রকৃতির উপর বেশ অভিমান হচ্ছে। কেন এই অসময়ে মন খারাপ করতে হবে প্রকৃতির! মাঝে মাঝে তো রুপের মত অসহায়দের কথাও ভাবতে পারে তাই না!

” এই ঝড়ের মধ্যে কোথায় যাচ্ছো মেয়ে? ঐ পাড়া তে কি তোমার প্রেমিক থাকে?”

একদিকে বাতাস আরেকদিকে ধুলো ময়লা। চোখ খুলে রাখা দায়। রাগী লোকটার কথা কানে আসায় রুপ দাঁড়িয়ে যায়। এদিক সেদিক নজর ঘুরিয়ে সময় নিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। বাতাসের কারণে রাগী লোকটাও ঠিক মতো তাকাতে পারছে না।

” বাসায় যাচ্ছি।”
” তা কার বাসায় যাচ্ছো। প্রেমিকের বাসায় বুঝি?”

রুপের এখন ইচ্ছে করছে রাগী লোকটার গাল ফাটিয়ে দিতে। কথায় কথায় অপমান রুপের আর সহ্য হচ্ছে না। রুপ ভাবছে, “এই লোকটা কি মেয়েদের সহ্য করতে পারে না! পরমুহূর্তে মনে পড়লো এক ঘন্টা আগের ফোনকলের কথা। হয়তো প্রেমিকাকে ফোন করতে গিয়ে আমাকে ফোন করেছে। এই রাগী লোকটা আমাকেই সহ্য করতে পারে না। রাগী লোকটা ভাবে আজাদ আঙ্কেলের সহিত আমার,,, ছিহ ছিহ কথা’ই বলবো না লোকটার সাথে।”

রুপ পাল্টা উওর না দিয়ে প্রবল বাতাসে আবারো হাঁটা শুরু করে দিলো। এদিকে মেয়েটা নাদিফকে আবারও ইগনোর করায় নাদিফ ভীষণ রেগে যায়। নাদিফ এসেছিল পড়শি ভেবে সাহায্য করতে কিন্তু এই মেয়ে করলো কি।

” কথা না শুনলে কিন্তু প্রেম নীড়ে জায়গা হবে না। আর প্রেম নীড় যাওয়ার সঠিক রাস্তাও বলে দিবো না।”

রুপ বুঝতে পারছে লোকটা মিথ্যা বলছে। রুপকে অপমান করার নতুন বুদ্ধি আটছে। রুপ থামলো না। নিজের মতো আগাতে লাগলো। এদিকে রুপের ত্যাড়াবাঁকা কাজে নাদিফ অবাক। রুপ যে ভুল রাস্তায় আগাচ্ছে শুনেও কোন পতিক্রিয়া করলো না। কিন্তু নাদিফ তো আর এটা হতে দিবে না। যতই হোক পড়শি তো! নাদিফ মোটরবাইক চালু করে শা শা করে রুপের সামনে এসে দাঁড়ালো। আচমকা মোটরবাইক থামায় রুপ ভয় পেয়ে যায়। রাগান্বিত কন্ঠস্বরে কিছু বলবে তার আগেই নাদিফের রাগান্বিত চেহারা দেখে ভয় পেয়ে যায়। নাদিফের নজর পুরোপুরি রুনের দিকে নিবদ্ধ।

” একটা কথা বারবার বলতে পছন্দ করি না অপরুপ! তুমি আমাদের বাসায় আমাদের দায়িত্বে আছো। মাঝপথে এভাবে ফেলে চলে যেতে পারি না। উঠে এসো।”

রুপ যেন আকাশ থেকে টপকে পড়লো। কন্ঠনালী থেকে আপনা আপনি স্বর বের হয়ে আসলো ‘অপরুপ!’ নাদিফের দিকে তাকিয়ে দেখলো নাদিফ নির্বিকার যেন মাত্র কিছুই বলেনি। কোন উপায়ান্তর না পেয়ে রুপ আবারও রাগী লোকটার পিছনে মোটরবাইকে চড়ে বসলো।

প্রেম নীড়ের গেইটের সামনে মোটরবাইক এসে থেমেছে। কুদ্দুস মোল্লা মোটরবাইকের আওয়াজ শুনে বুঝতে পেরেছে ছোট মালিকের আগমন ঘটেছে। মাথায় টুপি পরিধান করে হাথে ছোট লাঠি নিয়ে ছুটে আসে গেইট খুলে দেয়ার জন্য।
ছোট মালিকের পিছনে কোন রমণীর বসতে দেখে অবাক হয়ে যায় কুদ্দুস মোল্লা। ততক্ষণে ছোট মালিকের মোটরবাইক ভবনে প্রবেশ করেছে। কুদ্দুস মোল্লা উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখে ছোট মালিকের মোটরবাইকের পিছনে বসারত রমণী আর কেউ না, এ বাড়ির নতুন ভাড়াটিয়া। কুদ্দুস মোল্লার মুখ তিন ইঞ্চি পরিমান হা হয়ে যায়। পকেটে হাত দিয়ে রুপের কাছ থেকে নেয়া টাকায় হাত বুলিয়ে নেয়।

—————

” আরেকটু সস দিবো কি মা?”

” না আন্টি! এতটুকু’ই হবে।”

সদর দরজা দিয়ে রুপ নাদিফ একসাথে প্রবেশ করেছে মাত্র। রুপের মন ভীষণভাবে খারাপ। আসার সময় বাতাসের কারণে রাইসার জন্য কিছু খাবার আনতে পারেনি। ভবনে প্রবেশ করতেই রুপের কর্ণধারে আসে আয়েশা আজাদের কন্ঠস্বর। আড়চোখে নাদিফের চলে যাওয়া দেখে আয়েশা আজাদের দিকে তাকায়। আয়েশা আজাদ রাইসা দ্যা খাদকের ভাণ্ডারকে বসিয়ে খাওয়াচ্ছে। কারোর আগমনের আভাস পেয়ে আয়েশা আজাদ তাকায়। রুপ নাদিফকে একসাথে দেখে বলে উঠে,

” তোমরা দুজন একসাথে যে এলে?”

নাদিফ উপরে চলে যাচ্ছিলো। মায়ের কথা শুনে যেতে যেতে প্রত্যুওরে বলে উঠে,

” এক অভাগী পথ হারিয়ে অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। দয়া হলো তাই সঠিক পথে নিয়ে এসেছি। এ নিয়ে আবার কোন ড্রামা শুরু করিও না মা!”

আয়েশা আজাদ মনে মনে বেজায় খুশি। ছেলে যে নিরামিষ থেকে আমিষে পরিণত হচ্ছে এটাই বেশি।

রাইসা খাচ্ছে তাও আবার আয়েশা আজাদের হাতের খাবার। রুপ ভ্রু কুঁচকে নিলো রাইসার কাজে। বিনা পয়সায় শুয়ে বসে খাওয়া রুপের একদম অপছন্দনীয়। কিন্তু রাআস্ এই কাজ করে সর্বদা। যেখানে খাবার পায় সেখানে’ই হামলে পড়ে। রুপ রাইসার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। রুপকে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখে আয়েশা আজাদ বলে উঠলেন,

” আহা আমার বউমা টা কত কষ্ট করে এসেছে!”

‘বউমা!’ স্টার জলসা সিরিয়ালের মত রাইসা রুপ একসাথে বলে উঠে। যাকে বলে চিৎকার করে। আয়েশা আজাদ থতমত খেয়ে যান। আজাদ সাহেবের সাথে থাকতে থাকতে আয়েশা আজাদের মুখ যেখানে সেখানে ফসকে যায়। আয়েশা আজাদ ডিব্বায় কামড় কেঁটে বলেন,

” আরে কি বলে কি বলে ফেলি! বলতে চেয়েছিলাম রুপ মা কত কষ্ট করে এসেছো। ফ্রেস হয়ে আসো নাস্তা দেই।”

রুপ স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। এদিকে রাইসা তো আয়েশা আজাদের কথা শুনে বসা থেকে উঠে গিয়েছিল। এখন আরামে বসে অসমাপ্ত খাবার সমাপ্ত করবে। রুপের ইচ্ছে করছে না নাস্তা করতে। আবার আয়েশা আজাদের মুখের উপর কিছু বলবে তার উপায় ও নেই।
” আন্টি নাস্তা করবো না। আমি ঠিক আছি। আঙ্কেল কোথায়?”

রুপের অমত করায় আয়েশা আজাদ কিছুটা আহত হলেন। রুপ যে তাঁদের আপন ভাবতে পারছে না এটা ভেবে কষ্ট পেলেন।

” উপরে’ই আছে। বই পড়ছে। কেন কিছু বলবে?”

আয়েশা আজাদের সরাসরি জিজ্ঞেস করায় রুপের অস্বস্তি অনুভব হচ্ছে। রুপ ভাবছে, মুখের উপর নাবলে দেয়া কেমন দেখাবে। মনে অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে আয়েশা আজাদের উদ্দেশ্যে বলে,

” আমি আজ’ই চলে যাবো প্রেম নীড় ছেড়ে।”

চলবে…….

#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা
#আফসানা_মিমি
|সপ্তম পর্ব |

ঝড় থেমে গিয়েছে অনেক অগেই। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির সাথে শিলা পড়ছে গগনে। টিনের চালের উপর শিলা প্রতিফলিত হওয়ার সাথে সাথে বিকট আওয়াজ হচ্ছে। প্রেম নীড়ে নিশ্চুপ পরিবেশ। বাহিরের শিলা বৃষ্টির আওয়াজ খুব ভালো ভাবে’ই কর্ণধারে আসছে সকলের। চৈত্র মাসের শেষে শিলা বৃষ্টির আগমন মোটেও ভালো না। আম গাছের ছোট আম ঝড়ে যাবে শিলা বৃষ্টিতে। নবান্ন উৎসবে মাঠে উঠানো আমন ধান নুয়ে যাবে সর্বক্ষণে। কৃষকদের আজ মন খারাপ শিলা বৃষ্টির অগমনে।

আজাদ সাহেব সোফায় মনমরা হয়ে বসে আছেন। আয়েশা আজাদ হতাশ দৃষ্টিতে প্রিয় স্বামীর মনমরা মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করে আছেন। আয়েশা আজাদের সেই চঞ্চল, দুরন্তপনা স্বামীকে’ই পছন্দ। মনমরা হয়ে বসে থাকা আজাদ সাহেবকে দেখে অন্তরে পীড়া দিচ্ছে।

” কি বলেছে মেয়েটা? থাকবে তো? আমার কিন্তু বেশ লেগেছে রুপকে।”

আয়েশা আজাদ স্বামীর পাশে বসে নরম স্বরে কথাগুলো বললেন। আজাদ সাহেব লম্বা নিশ্বাস ত্যাগ কর স্ত্রীর কথার প্রত্যুওরে বললেন,

” মেয়েটা কোন কারণে ভয় পেয়েছে। আজ এই বৃষ্টি বাদলের দিন থেকে আগামীকাল চলে যাবে বলেছে।”

” তুমি না করোনি?”
“করেছি। লাভ হয়নি।”

সন্ধ্যার নাস্তা করতে নাদিফ নিচে নেমে আসে। মা-বাবার দুঃখিভরা মুখখানা দেখে এগিয়ে যায় সেখানে। মা-বাবার মাঝে বসে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। এদিকে আচমকা আদরের ছেলের আগমনে আয়েশা আজাদ চমকে উঠে। ছেলে যে মা-বাবার আদর পেতে চাচ্ছে তা বুঝতে পারে আয়েশা বেগম।

” আমার আব্বাটার কি হয়েছে হঠাৎ? কিছু কি লাগবে?”

আয়েশা আজাদ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন। নাদিফ বাবার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আঁকিবুঁকি করছে।

” নাদিফ! এভাবে আর কতদিন শুয়ে বসে কাটাবি? নাবিলের সাথে অফিসে জয়েন করে নে এবার? পড়াশোনা শেষ করেছিস দুই বছর তো হলো।”

নাদিফ নিশ্চুপ। মায়ের কোলে মাথা রেখে যেন অনেক শান্তি পাচ্ছে। আজাদ সাহেবের আদরের পুত্র নাদিফ। নাদিফের জন্মের সময় বাঁচা মরা নিয়ে সংশয় ছিলো সকলের মাঝে। আজাদ সাহেব তো ফুটফুটে ছেলেকে দেখে খুবই আনন্দিত ছিলেন কিন্তু পর মুহূর্তে ডাক্তার যখন বলল যে আজাদ সাহেবের ফুটফুটে ছেলে সন্তানের গাঢ় জন্ডিস হয়েছে যা শরীরের নব্বই পার্সেন্ট ছড়িয়ে গিয়েছে। নাদিফের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছিলো মাত্র দশ পার্সেন্ট। আজাদ সাহেব পাগর প্রায় বাচ্চার অসুস্থের কথা শুনে। এই মসজিদ সেই মসজিদে দান, দোয়া করতে থাকেন অনবরত। দীর্ঘ দুইমাস আই সি ইউ তে থাকতে হয় নাদিফকে। অবশেষে আল্লাহর অসীম রহমতে নাদিফ সুস্থ হয়ে আসে। সেই সময় থেকে আজাদ সাহেবের প্রধান দুর্বলতা হচ্ছে নাদিফ। ছোট থেকে বড়ো হওয়া পর্যন্ত নাদিফের উপর ভুল ক্রমেও হাত তুলেনি আজাদ সাহেব। এই যে! এখন নাদিফ কোন কাজ কর্ম করে না, ঘোরাফেরা করে এতেও আজাদ সাহেবের কোন সমস্যা নেই। কিন্তু বাবা হয়ে যতটুকু বলার তা বলেছেন আজাদ সাহেব।

” মন খারাপ কেন তোমাদের?”

আজাদ সাহেব যেমন নাদিফকে ভালোবাসে তাঁর চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণ নাদিফ বাবা-মাকে ভালোবাসে। বাবা-মায়ের মুখের হাসি যেন নাদিফের জন্য সব। এক নিমেষেই বাবা-মায়ের মন খারাপ বুঝে গিয়েছে।

” রুপ চলে যাবে বলছে। তাই মন খারাপ।”

আয়েশা আজাদের কথা শুনে নাদিফ মায়ের কোল থেকে উঠে বসলো। কপালে সূক্ষ্ম ভাজ বিদ্যমান। নাদিফ ভাবছে, নাদিফের গতকালকের ব্যবহারের জন্য কি রুপ চলে যাবে! পরক্ষণে আবার ভাবছে, চলে গেলে যাক তাতে কার কি!
নাদিফ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে আবারও মায়ের কোলে শুয়ে পড়লো। আজাদ সাহেব প্রথমে খব খুশি হয়েছিলো ছেলের প্রতিক্রিয়া দেখে কিন্তু পরমুহূর্তে নাদিফের শুয়ে পড়া দেখে হতাশ হলেন।

” চলে যেতে চাইছে চলে যাক। তাতে তোমাদের মন খারাপ কেন? আসলো’ই তো গতকাল। আজ চলে যাবে বললেই কি যেতে পারবে?”

” মেয়েটা কোন কারণে ভয় পেয়েছে।”

নাদিফ নিশ্চুপ। চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভেবে যাচ্ছে। মা-বাবার মন খারাপ সহ্য হয় না নাদিফের।
আচমকা শোয়া থেকে উঠে বলে,

” মেয়েটা কোথায়?”
” নিজের ঘরে হয়তো।”

আজাদ সাহেব যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। আজাদ সাহেবের ছেলে রুপের সাথে কথা বলবে ভেবেই আনন্দ পাচ্ছেন।
নাদিফ আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। উপরে চলে গেলো। এদিকে নাদিফ চলে যেতেই আজাদ সাহেব স্ত্রীকে দাঁড় করিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাচা শুরু করলেন। আয়েশা আজাদ স্বামীর পাগলামিতে লাজুক হাসেন। আজাদ সাহেব গান গাইছেন আর নেচে যাচ্ছেন সহধর্মিণীর সাথে।

” আমি যে তোমার, শুধু যে তোমার!
আমি যে তোমার।”

—————-

প্রকৃতির নিয়ম কি অদ্ভুত। মন খারাপের সঙ্গ দিতে চলে এসেছে নিমেষেই। নিজ কামরায় মন টিকছে না রুপের তাইতো ছাদে চলে এসেছে এই রাতে বৃষ্টি বিলাস করতে। ছাদের কর্নিশে একটা চিলেকোঠার ঘর রেয়েছে। যেখানে বসার জন্য ছোট বড়ো চারটে চেয়ার পাতা আছে। রুপ ছাতা মাথায় দিয়ে এই ঘরে চলে আসে। রাইসা এই ঝড়েও কাজে চলে গিয়েছে। রাইসা যেই শপে কাজ করে সেটার মালিক একজন মহিলা। তাই রাতে ওভারটাইম করাতেও কোন চিন্তা নাই। রাইসা চলে যেতেই রুপ যেন আজ ভীষণ একা হয়ে গিয়েছে। তাইতো ছাদে চলে আসা। একা একা বৃষ্টি বিলাস করবে।
ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি ঝড়ছে। বাতাস বইছে প্রবলভাবে। চিলেকোঠার ঘরের পূর্বপাশে জানালা বিদ্যমান। সেখান দিয়ে বৃষ্টির পানি ঝিরঝির করে ঘরে প্রবেশ করছে। রুপ চোখ বন্ধ করে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো।
ঝিরঝির বৃষ্টির ফোঁটা রুপের মুখশ্রীতে। ভিজে যাচ্ছে রুপের সারা মুখশ্রী। চোখ বন্ধ করা অবস্থায় বৃষ্টির ছোঁয়া উপভোগ করে যাচ্ছে রুপ। এ যেন আলাদা প্রশান্তি। রুপ যেন ছেলে বলায় চলে যাচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজে এতিমখানার বড়ো আম গাছ থেকে লুকিয়ে আম কুড়িয়ে ওড়না ভরতি নিয়ে আসতো রুমে। চুপি চুপি কেউ যেন না দেখে তাঁর আগেই চার পাঁচজন মিলে সেই আম কেঁ’টে লবন মরিচ মিশিয়ে খেতো। কখনো তো গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ঝুমঝুম বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে ময়ূর পঙ্খীর মতো নেচে বেড়াতো রুপ।
রুপ হাসছে। মন খুলে হাসছে। কতদিন পর হাসছে জানা নেই। বৃষ্টিতে রুপের গলায় পেঁচানো ওড়না অনেকটাই ভিজে গিয়েছে। রুপের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। আপনমনে ভিজতে ব্যস্ত রুপ।

হাতে কারোর স্পর্শ পেয়ে রুপের স্তম্ভিত ফিরে আসে। অন্যমনস্ক রুপ আচমকা হাত টান লাগায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে কারোর সুঠাম বক্ষঃস্থলে। শরীর কাঁপছে শীতে, অন্তর কাঁপছে ভয়ে। পিনপতন নীরবতায় শুধুমাত্র বাহিরের ঝুমঝুম বৃষ্টির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

” সারা রাত এভাবে পর পুরুষের সাথে ল্যাপ্টে থাকবে কি? তোমার প্রেমিক কিছু মনে করবে না!”

ভয়ে, লজ্জায় রুপ কাঁপছে। কানে কারোর ফিসফিস কথা শুনে শরীর শীতল হয়ে এসেছে। লজ্জায় ইচ্ছে করছে ম’রে যেতে।
এদিকে নাদিফের অবস্থা করুণ। রপের কামরায় রুপকে না পেয়ে ছাদে চলে আসে নাদিফ। প্রবল বাতাসে একটি কালো ছাতা ছাদের একপাশে উড়ে চলে গিয়েছে। নাদিফ বুঝতে পারে ছাতাটা রুপের। আর রুপ বর্তমানে চিলেকোঠার ঘরে রয়েছে। নাদিফ সঙ্গে ছাতা আনে নি। বৃষ্টির মধ্যেই এক প্রকার দৌঁড়ে চিলেকোঠার ঘরে প্রবেশ করে। অন্যমনস্ক হয়ে বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া কেশব ঝাড়তে ঝাড়তে চোখ যায় জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা বৃষ্টিকন্যার দিকে। নাদিফের পৃথিবী যেন সেখানেই থমকে যায়।
নাদিফ যেন ভুল করেনি সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা বৃষ্টিকন্যার নাম অপরুপ রেখে। ঝিরঝির বৃষ্টির ফোঁটাতে মুখে বিন্দু বিন্দু পানি জমেছে। লতার মত লম্বা মাথার কেশব ভিজে গলার সাথে ল্যাপ্টে আছে। গলায় প্যাঁচানো ওড়না ভিজে শরীরের সাথে মিশে আছে। নাদিফ অনুভব করছে নাদিফের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। চোখের সামনে অপরুপকে দেখে ভারসাম্যহীন হয়ে যাচ্ছে। নাদিফ এই প্রথম কোন মেয়েকে এত কাছ থেকে দেখছে। মনের মধ্যে কেমন অস্থিরতা কাজ করছে নাদিফের। নাদিফ ভাবছে, “এভাবে আর এক মুহূর্তও থাকা যাবে না। মেয়েটাকে থামাতে হবে যে! কালবৈশাখী ঝড়ের উদ্রব যে মেয়েটা। যার রুপে গায়েল হয়ে দূর্বল হয়ে যাবে নাদিফ।”

মুখশ্রীতে কাঠিন্যতা ভাব এনে রুপের হাত টেনে ধরে। নাদিফের এই কাজ না করা উচিত ছিলো। নাহলে এখন আবারও অনর্থক কিছু ঘটতে পারতো না।

রুপ সুঠাম দেহের অধিকারী পুরুষের বক্ষঃস্থল থেকে সরে আসে। নিজেকে ঠিকঠাক করে অপর দিকে ফিরে তাকায়। ভেজা অবস্থায় কোন পুরুষের সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব যে। নাদিফ নিজেকে স্বাভাবিক করে রুপের উদ্দেশ্যে বলে,

” কেন চলে যাবে?”

রুপ এতক্ষণ যেন অন্য জগতে ছিলো। নাদিফের কথায় মনে পড়ে যায় নাদিফের করা বিকেলের ব্যবহারের কথা।

” আপনার জন্য।”

রুপের উওরে নাদিফের ভ্রু যুগল কুঁচকে আসে। নাদিফের জানা মতে নাদিফ এই মেয়ের সাথে স্ব-জ্ঞানে খারাপ কিছু করেনি। বিকেলে এই মেয়েকে সাহায্য করেছে মাত্র। নাদিফের এবার রাগ হলো, চরম রাগ। ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখতে ঘন্টা খানেক।

” আমি কি তোমাকে ছুঁয়ে দিয়েছি? নাকি বাজে ভাবে তাকিয়েছি?”

” বাজে বকেছেন আমাকে।”

নাদিফের রাগ যেন পানি হয়ে আসলো রুপের কথা শুনে। শত চেষ্টাকরেও মনে করতে পারছে না যে কখন বকেছে।

” কখন বকেছি?”

” বলবো না।”

নাদিফের এখন হাসি পাচ্ছে রুপের কথায়। রুপের কন্ঠস্বরে বেজায় অভিমানের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এই অভিমান কিসের তা অজানা নাদিফের।

” যেয়ো না তুমি। বাবা মা কষ্ট পাচ্ছে। আমি আর তোমার সম্মুখে আসবো না। তুমি যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই চলাফেরা করতে পারবে।”

কিছু সময় পিনপতন নীরবতা। রুপ ভেবেছে রাগী লোকটা চলে গিয়েছে। কিন্তু রুপের ধারণা ভুল। রাগী লোকটা যে বৃষ্টি বিলাশ করছে রুপের মত জানালার ধারে ঘেঁসে। চোখ বন্ধ অবস্থায় লোকটার সৌন্দর্য দ্বিগুন লাগছে। রুপ একাকী মনে অসায়, নিচে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নেয়। তখনই নাদিফের কন্ঠস্বর ভেসে আসে রুপের কর্ণধারে,

” ভুলেও আমার সামনে এসো না অপরুপ! ফের সামনে আসলে, প্রেমের জেলে বন্দি করে রাখবো।”

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here