প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা,১৬,১৭

0
1109

#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা,১৬,১৭
#আফসানা_মিমি
|ষোল তম পর্ব |

বাড়ন্ত বয়স বলে একটা সময় আছে বলা বাহুল্য। অনেক মানুষ আছে হাতে পায়ে বড়ো হলেও আক্কেল জ্ঞানের দিকে ছোট’ই থাকে সবসময়।
রাইসা আজ পরিধান করেছে, কালো রংয়ের শাড়ি। অবশ্যই আয়েশা আজাদ উপহার স্বরুপ প্রদান করেছেন। চলতি মাসে’ই রাইসা নতুন ফোন কিনেছে। স্মার্ট ফোন। যার দ্বারা’ই সকালে রুপ, নাদিফের খুনসুটি ক্যামেরাবন্দী করেছিল। রাইসা আপাতত ব্যস্ত নিজের ছবি তুলতে। মুখশ্রীতে বিভিন্ন ব্যঙ্গ করে ছবি তুলছে রাইসা। আকাশ দূর থেকে রাইসার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করছিল এতক্ষণ। রাইসার ভাবভঙ্গি দেখে না হেসে পারছে না আকাশ। এগিয়ে আসে রাইসার দিকে। খুক খুক কেশে বলে,

” মুখ তো এবার বেঁকে যাবে সুন্দরী! সুন্দরীকে তো শাড়িতে আজ অনেক সুন্দর লাগছে। সুন্দরীর রুপের রহস্য কি?”

রাইসার একটা স্বভাব আছে কারো মুখ থেকে নিজের প্রশংসা শুনলে একেবারে মাথায় চড়ে বসে। আকাশের মুখ থেকে নিজের প্রশংসা শোনার পর রুপের মত লজ্জা না পেয়ে সরাসরি বলে,

” আমার রূপের রহস্য তিব্বত স্নো। আপনি লাগালে আপনিও সুন্দর হয়ে যাবেন আমার মতো। যাই হোক ধন্যবাদ প্রশংসা করার জন্য। ছবি তুলবেন আমার সাথে?

আকাশ রাইসার সরলতায় মুগ্ধ হয়। চলে আসে রাইসার সাথে ছবি তোলার অজুহাতে পরিচিত হতে।

——-

আকাশ বাদলা রুপ ধারণ করেছে। ঠান্ডা বাতাস বইছে। অদূরে কোথাও হয়তো বৃষ্টি ঝড়ছে।
সাথে রুপের আঁখি যুগল থেকেও অশ্রুকণা ঝড়ে যাচ্ছে অনবরত। প্রেম নীড়ের ছাদের চিলেকোঠা ঘরে রুপ বসে আছে। রুপ ভাবছে কিছুক্ষণ আগের কথা,
রুপ নাদিফের নিকট মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। রুপ যা বলতে এসেছিলো তা না বলে ভুলভাল বলে ফেলে নাদিফের সামনে। এদিকে নাদিফ মনে মনে মহা খুশি। নাদিফ ভাবছে রুপ হয়তো নাদিফের ভালোবাসা বুঝতে পেরেছে। নাদিফের চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। নাদিফ শুধু পারছে না সকলের সামনে অপরুপকে বক্ষঃস্থলে আবদ্ধ করতে। কিন্তু পরমুহূর্তে নাদিফের সকল আনন্দ ধূলিসাৎ হয়ে যায় রুপের কথা শুনে,

” আজকের এই দিনে দয়া করে রেগে থাকবেন না। তবুও আবার আমার জন্য। আমি খুব সাধারন মানুষ কারোর ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না। অন্ততপক্ষে আজকের দিনটা আপনি মন খারাপ করে থাকবেন না। আপনার বাবা-মা অনেক আশা নিয়ে আজকে এত বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। আমি চাইনা আমার কারনে অনুষ্ঠানের কোনো কমতি হোক বা তারা কষ্ট পাক। দয়া করে আমার উপর রহম করুন। আমি আপনার ভালবাসা পাওয়ার যোগ্য না। গ্রহণ করতে পারছি না আপনার ভালোবাসা।”

রুপের কথার প্রত্যুওরে নাদিফ কিছু বলেনি। উল্টো রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। এরপর থেকেই রুপ এখানে এসে বসে আছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি নেমে আসে পুরো পৃথিবীতে। রুপ চোখের পানি মুছে জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। রুপের কাছে এখন নিজেকে অনেক অসহায় মনে হচ্ছে। নাদিফের চোখে আজ রুপ কিছুক্ষণের জন্য হলেও আনন্দ দেখেতে পেয়েছে। কিন্তু রুপের না বলায় মানুষটা খুব কষ্ট পেয়েছে, চলে গিয়েছে বাড়ি থেকে।

” ম্যাডাম ভিজে যাচ্ছেন তো? আপনাকে নিচে আন্টি ডাকছে।”

ফাল্গুনীর ডাকে রুপের স্তম্ভিত ফিরে। চোখের পানি মুছে রুপ ফাল্গুনীর দিকে তাকিয়ে ফিচেল হাসে।

” তুমি কি ফয়সালকে ভালোবাসো?”

ফাল্গুনী এই মুহূর্তে ভাবতে পারেনি নিজের শিক্ষকের মুখে এমন কথার। ফাল্গুনী এদিক সেদিক নজর ঘুরিয়ে সময় নিয়ে উওর দেয়,

” তেমন কিছু না, বন্ধু মাত্র।”

ফাল্গুনের উত্তরের রূপ মুচকি হাসি থেকে নামতে নামতে উত্তর দেয়

“ভালোবাসা অনেকে পায় কিন্তু সে ভালোবাসার পূর্ণাঙ্গ মর্যাদা দিতে পারে না। আবার অনেকে ভালোবাসা পেয়েও সেই ভালোবাসাকে উপলব্ধি করতে পারে না। কখনও ভালোবাসাকে ঠুকনো মনে করবে না।”

ফাল্গুনী রূপের কথার মানে বুঝতে পেরেছে কিনা তা জানেনা রুপ। ফাল্গুনীকে নিয়ে চলে যায় অনুষ্ঠানে।
———

আয়েশা আজাদ খুবই বিরক্ত স্বামীর উপর। এত সুন্দরী স্ত্রীকে রেখে কোথায় যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে। সদর দরজা দিয়ে নাদিফকে আসতে দেখে আয়েশা আজাদ ভ্রু যুগল কুঁচকে নিলেন। ছেলের চোখ মুখের থমথমে অবস্থা দেকে আয়েশা আজাদের অন্তর কেঁপে উঠে। এগিয়ে গিয়ে ছেলের উদ্দেশ্যে বলল,

” কি হয়েছে আমার বাবার?”

মায়ের দিকে তাকিয়ে নাদিফ মলিন স্বরে বলে,

” ভালোবাসায় এতো কষ্ট কেন বলতে পারো মা?”

আয়েশা আজাদ কিছু বলবেন তাঁর আগেই নাদিফ অন্য প্রান্তে চলে গেলো। আয়েশা আজাদ গভীর ভাবনায় পড়ে গেলেন। ছেলেকে যে প্রেম নাশক অসুখে ধরেছে বুঝতে পারলেন।

” বুঝলে ললিতা! এই বয়সে তরুন ভাব জন্মাচ্ছে মনে। চারদিকে সব মৌমাছি যেন আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। তোমার তো আমার দিকে কোন নজর নেই।”

আয়েশা আজাদ ছেলের বিরহে কাতর। স্বামীর কথায় কোন প্রতিক্রিয়া করলেন না। আজাদ সাহেব তৈরি হয়ে এসেছিলেন প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখের কয়েকটা বাণী শুনবেন কিন্তু স্ত্রীকে গভীর ভাবনায় বিভোর হতে দেখে বললেন,

” তুমি ঠিক আছো ললিতা?”

” আমার মনে হচ্ছে নাদিফকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রুপের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করা উচিত। ছেলে আমার কোন মেয়ের কাছ থেকে ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে আসছে।”
————-

রজনীর শেষ বেলায় দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে যায় রুপের। এটা নতুন কিছু না, রুপের ঘুম রাইসার মতো এতটা গভীর না। আবছা আলোতেই রাইসার ব্যাঙের ন্যায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা রুপের চোখে এড়ালো না। অন্ধকারে হাতিয়ে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিলো রুপ। রাইসার নতুন ফোন নিয়ে পর পর কয়েকটা ছবি তুলে রাখলো রুপ। সকালে রাইসাকে দেখাবে বলে। রুপের ঘুম ভেঙে গিয়েছে বিধায় ঘর থেকে বের সয়ে গেলো। উদ্দেশ্য ছাদের চিলেকোঠা ঘরে যাবে। সেখানে বসে ব্যস্ত শহরের দালানের চূড়ায় সূর্যের আগমন দেখবে।

ছাদে যাওয়ার পথে আজাদ সাহেব এবং নাদিফের কামরা পাড় হতে হয়। রুপ আস্তেধীরে এগিয়ে যাচ্ছে যেন কোন শব্দ না হয়। আজাদ সাহেবের কামরার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় রুপের কর্ণধারে আজাদ সাহেব এবং আয়েশা আজাদের কন্ঠস্বর শোনা যায়। আজাদ সাহেবের কামরার দরজা কিছুটা উন্মুক্ত। সেখান দিয়েই দেখা যাচ্ছে আজাদ সাহেব এবং আয়েশা আজাদ বিছানায় বসে এই রাতে লুডু খেলছে। রুপ দু’জনের অবস্থা দেকে ললাটে হাত ধরে। এই দু’জন মানুষকে রুপের মাঝে মাঝে জুকারের ভাই-বোন মনে হয়। যখন,তখন তা ইচ্ছে তাই করে বেড়ায় এরা।

” নাদিফের বাবা, আমার গুটি কা’ট’লে আগামীকাল পাট শাক আর শুঁটকি ভর্তা খাওয়াবো কিন্তু বলে দিলাম।”

রুপ খেয়াল করলো খেলার এক পর্যায়ে আয়েশা আজাদ স্বামীকে ভয়ানক হু’ম’কি দিচ্ছে। কিন্তু আজাদ সাহেব স্ত্রীর হু’ম’কি পরোয়া না করে চারের ঘরের গুটি কেঁটে দিলো। তা দেখে আয়েশা আজাদ ভীষণ ক্ষেপে। আজাদ সাহেব হেসে বললেন,

” সুযোগ যখন আসে তখন তাঁর সদ্ব্যবহার করা উচিত। পরে যা হবার হবে। বর্তমানে তুমি কি করে আনন্দ পাও তাই করো।”

রুপ চলে আসলো আজাদ সাহেবের কামরার সামনে থেকে। অন্যের ঘরে উঁকি ঝুঁকি দেয়া ঠিক না। নাদিফের কামরার দরজা খোলা কিন্তু অন্ধকার। হয়তো ঘুমের ঘোরে দরজা লাগাতে ভুলে গিয়েছে। রুপ আর কিছু ভাবলো না। আস্তে ধীরে ছাদে চলে গেলো। ছাদের দরজা চাপিয়ে পূর্ব প্রান্তে চলে এসে লম্বা নিশ্বাস ত্যাগ করলো রুপ। যেন এই নিঃশ্বাসের সঙ্গে জীবনের সকল কষ্ট বের করে দিয়েছে।

” এতো রাতে ভুতের সাথে প্রেম বিনিময় করতে এসেছো বুঝি?”

রুপের শরীর কাঁপছে ভয়ে। যদি কোন মানুষ গভীর ভাবনায় বিভোর থাকে তখন আচমকা কারোর আওয়াজে ভয় পায়, মস্তিষ্ক অচল হয়ে যায়। নাদিফ রুপের কাছে এসে রুপের মাথায় হাত রাখে। আশ্বাসের স্বরে বলে,

” ভয় পেয়েছো কি? আমি ভুত না, মানুষ। তোমার ভাষ্যমতে রাগী লোক। ঘুম আসছিলো না তাই ছাদে এসেছিলাম।”

রুপ স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। মাথায় লোকটার ভরসার হাত পেয়ে চোখের কোণা ভিজে আসলো। নাদিফ ততক্ষণে রুপের মাথা থেকে হাত সরিয়ে নেয়। নাদিফের যে অনুমতি নেই রুপের সংস্পর্শে আসার। রুপ রে অধিকার দেয়নি তাঁর জীবনে দখলদার করার।

” এতো রাতে ছাদে কেন?”
” ঘুম ভেঙে গিয়েছে তাই চলে এসেছি।”
” ভয় লাগছে না আমাকে?”
” না।”

দুজনের মধ্যে নীরবতা। রুপের কেমন অস্থিরতা কাজ করছে নিজের মধ্যে। একজন পুরুষের সন্নিকটে আসা সত্যিই অস্বস্তিকর। রুপ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই নাদিফ বলে উঠে,

” আরেকপু সময় থেকে যাও। একসাথে সূর্যোদয় দেখবো।”

রুপ নাদিফের কথা অগ্রাহ্য করতে পারলো না। নাদিফের পাশে কিছুটা দুরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে রইলো।
অদূরের দালানের কোণ ঘেঁষে লাল সূর্য উদয় হচ্ছে। রুপ অবাক চোখে সে দৃশ্য দেখছে। আর নাদিফ! সে তো লাল আভায় অপরুপকে দেখতে ব্যস্ত। আকস্মিক নাদিফের কি যেন হলো, রুপকে রেখে হুড়মুড় করে নিচে চলে গেলো। রুপ নাদিফের চলে যাওয়া দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। এবার রুপ ছাদে ঘুরবে। মনের সুখে গান গাইবে, পাখিদের সাথে তাল মিলিয়ে আকাশে উড়াল দিবে, ভেসে যাবে মেঘের ভেলাতে।

ফুলে ফুলে ঢ’লে ঢ’লে
বহে কিবা মৃদু বায়,
ফুলে ফুলে ঢ’লে ঢ’লে
বহে কিবা মৃদু বায়,
তটিনী হিল্লোল তুলে
কল্লোলে চলিয়া যায়
পিক কিবা কুঞ্জে কুঞ্জে
পিক কিবা কুঞ্জে কুঞ্জে
কুহূ কুহূ কুহূ গায়,
কি জানি কিসের লাগি
প্রাণ করে হায় হায়!
ফুলে ফুলে ঢ’লে ঢ’লে
বহে কিবা মৃদু বায়!

রুপ মনের সুখে গান গাইছে। আশেপাশের কোন খেয়াল নেই। হঠাৎ হাতে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে স্তম্ভিত ফিরে আসে। নাদিফ রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুপের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে রুপের উদ্দেশ্যে বলল,

” এই মেয়ে, আমাকে যন্ত্রণায় ফেলতে খুব ভালো লাগে তোমার তাই না? গান গাইছিলে কেন? তোমার কাছ থেকে যতই দূরে সরে যেতে চাইছি তুমি ততই কাছে ডেকে নিচ্ছো। কি চাও তুমি? আমি উন্মাদ হয়ে যাই! রাস্তা ঘাটে ঘুরে বেড়াই?”

রুপ নিশ্চুপ। কোন কথা বলছে না। রুপের নজর আপাতত নাদিফের পাঞ্জাবীর বক্ষঃস্থলে বাম পাশের কারুকার্যের দিকে। কি সুন্দর ময়ূরপঙ্খী আঁকা পকেটে। রুপের ইচ্ছে করছে কারুকার্যের উপর হাত বুলিয়ে দিতে। তাই করলো রুপ। আপনমনে বক্ষঃস্থলে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিলো। নাদিফ রুপের কাজ দেখে চোখ বন্ধ করে নেয়। নিজেকে সংযত করে রুপের থুতনিতে হাত রেখে মুখ উপরে তুলে। রুপের চোখে চোখ রেখে বলতে শুরু করে,

” এভাবে ছুঁয়ে দিয়ে আমাকে আর প্রমত্তের দিকে ধাবিত করো না অপরুপ! আমি আর সইতে পারবো না।”

চলবে………..

#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা
#আফসানা_মিমি
|সতেরো তম পর্ব|

আজকের প্রভাতী যেন ভিন্নরুপ নিয়ে এসেছে ধরণীতে রুপের জন্য। রুপ আজ খুবই আনন্দিত। কারণটা রুপের আজানা। সকাল সকাল চলে এসেছে বাগানে পানি দিবে বলে। গাছে পানি দিচ্ছে আর হাসছে আপনমনে রুপ। ইতিমধ্যেই রুপের কর্ণধারে আসে রাইসার গলা ফাটানো চিৎকার। রুপ এবার নিজের কর্ণধারে হাত রেখে খিলখিল করে হেসে দেয়। রুপ জানে রাইসার এমন চিৎকারের কারণ। শেষ রাতে যে রুপ রাইসার ছবি তুলেছিলো সেটা হয়তো রাইসা এতক্ষণে দেখে নিয়েছে। এদিকে পানির পাইপ গিয়ে পড়লো একটা গর্তের মধ্যে। যাই গর্ত কিছুদিন আগে খনন করা হয়েছিলো।
ইতিমধ্যে রাইসা রেগে বোম হয়ে রুপের দিকেই এগিয়ে আসছে। রাইসার হাতে ফোন। প্রেম নীড়ের দরজার সামনে থেকে রাইসা এক প্রকার চিৎকার করে রুপের উদ্দেশ্যে বলে এগিয়ে আসছে,

” তুমি আস্তো একটা দুষ্টের বাক্সো রুপ! এ কেমন ছবি তুললে আমার। এখন যে এই ছবি কয়েকজনের কাছে চলে গিয়েছে।”

রুপ কানে হাত দিয়ে রাইসার কথার প্রত্যুওরে বলে,

” আপাতত আমি রঙিন দুনিয়ায় অবস্থান করছি। তোমার কথা কর্ণধারে আসছে না।”

রাইসার রুপের উওরে রেগে তেড়ে আসে। রুপকে ধরতে না পারলেও পড়ে যায় সেই গর্তের মধ্যে যা এখন কাদায় ভর্তি। রুপ রাইসার অবস্থা দেখে আবারও হেসে দেয়। রাইসার ঘারে, পেটে সুড়সুড়ি দিতে শুরু করে।

আয়েশা আজাদ এবং আজাদ সাহেব গভীর ঘুমে ছিলেন। বাহিরের শোরগোলে উনাদের ঘুম ভেঙে যায়। বাহিরে এসে আজাদ সাহেবের চোখ ছানাবড়া।
চোখের সামনে বাচ্চাদের ন্যায় দুইজন দৌঁড়াচ্ছে বাগান জুড়ে। রুপ সামনের দিকে আর রাইসা তার পেছনে। রাইসার সারা শরীরে কাঁদায় মাখামাখি। রুপের হাসি যেন সরছেই না মুখ থেকে। এদিকে আজাদ সাহেবের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি আটছে প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে। আড়চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমির হাসি দেন তিনি।
আজাদ সাহেবের মনে যেন রং লেগেছে। রুপ, রাইসার দুষ্টুমি দেখে প্রিয়তমা স্ত্রীকে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেন। এতেও যেন আজাদ সাহেব ক্ষান্ত হলেন না। কিছুদিন আগে বাগানে মাটি খনন হয়েছিলো। সেখানে পানি জমে কাঁদা হয়ে আছে। ভাগ্যক্রমে রাইসা সেই গর্তে দৌঁড়ে এসে পড়ে যায়। আজাদ সাহেব হাতির ন্যায় মোটা স্ত্রীকে তো আর সিনেমার নায়কদের মতো কোলে উঠাতে পারবেন না তাই আয়েশা আজাদকে টেনে হিঁচড়ে সেই গর্তে ফেলে দেয়।
এদিকে রুপ আয়েশা আজাদের করুণ অবস্থা দেখে দুঃখের মধ্যেও হেসে ফেলে। রাইসা এসেছিলো রুপকে কাদায় ফেলতে। বুড়ো বুড়ির এই বয়সে বাচ্চামো দেখে হেসে ফেলে। আয়েশা আজাদ যেন এমন কিছুর জন্য একদম প্রস্তুত ছিলেন না। আজাদ সাহেবও হেসে যাচ্ছেন সমান তালে। আয়েশা আজাদ একা কাদায় গড়াগড়ি খাবে তা তো মানা যায় না। আজাদ সাহেবকে ধরে কাদায় ফেলে দেন। এরপর তিনজন মিলে রুপকে কাঁদা লাগাতে দৌঁড়াতে শুরু করেন।

” ওরে আল্লাহ, দিন দুপুরে ভূত আসলো কোথায় থেকে? ভূতরাও বুঝি দৌঁড়াতে পারে?”

ফাহিমা এসেছিলো দারোয়ানকে দিয়ে শলার ঝাড়ু আনাবে বলে। চোখের সামনে তিন কাঁদায় মাখামাখি ভূতদের দেখে ভয় পেয়ে যায়। দালানের পাশে পড়ে থাকা পুরোনো শলার ঝাড়ু দিয়ে এক প্রকার তেড়ে আসে তিন মানুষ নামক ভূতদের দিকে।
” আইদা ঝাড়া, বাইদা ঝাড়া, বিলাই ঘু ছ্যাড়াবেড়া থু থু থু। হুস ভূত ভাগ। দূর হো আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে।”

ঝাড়ু দিয়ে একপ্রকার ঝেড়ে-মে’রে তিনজনের অবস্থা বেহাল করে দিচ্ছে ফাহিমা। তিনজন মানুষ আর কেউ না। আজাদ সাহেব, আয়েশা আজাদ এবং রাইসা।

আজাদ সাহেবের লজ্জায় মাথায় হাত। শেষে কি না পুত্রবধূর হাতে ঝাঁটা পে’টা খেতে হলো এই বয়সে? আয়েশা আজাদ বোকা পুত্রবধূর কাণ্ডে ভীষন রেগে।
আয়েশা আজাদ সজোরে ললাটে আঘাত করে। ফাহিমার হাত থেকে ঝাড়ু নিয়ে সজোরে জমিনে নিক্ষেপ করে।
” মাথার বুদ্ধি কি সব রাস্তায় ফেলে এসেছো ফাহিমা?

শাশুড়ি মায়ের কথা শুনে ফাহিমা এদিক সেদিক তাকায়। আয়েশা আজাদের চারপাশে ঘুরঘুর করে কিছুক্ষণ। ফাসিমার ধারণা, আয়েশা আজাদ মানে ফাহিমার শাশুড়ির কোথাও থেকে কথা বলছে, সামনে যে আছে সে ভূত মাত্র। তাই পুরো বাগানের চারপাশে ঘুরঘুর করে ঘুরে আসে ফাহিমা। অবশেষে শাশুড়িকে না পেয়ে আবারো কাদামাখা শাশুড়ি মায়ের বেশে থাকা ভূতের সামনে চলে আসে। ফাহিমা কোমরে হাত রেখে বলে,

“কি বাটপার ভূতরে বাবা! আমার শাশুড়ি মায়ের কন্ঠ নকল করে ফেলে? এসব ভূতকে ঝাড়ু পে’টা করে কীভাবে তাড়াতে হয় তা আমার জানা আছে। দাঁড়া হতচ্ছাড়া ভূত! কোথায় গেল রে ঝাড়ুটা! ভূতকে পি’টি’য়ে আমাদের বাড়ি থেকে ভাগাই!”

আয়েশা আজাদের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায় এই মুহূর্তে। আয়েশা আজাদ ফাহিমার মাথার জোরে আঘাত করে বসে। যার দরুন ফাহিমার মাথায় এবং মুখে কাদা লেগে যায়। আয়েশা আজাদ আফসোসের স্বরে বলে,

” এ কোন বোকা মেয়েকে আমার ছেলের জন্য নিয়ে এসেছি গো আল্লাহ? এই মেয়ের মাথায় বুদ্ধি সুদ্ধি বলতে কি কিছুই নেই! আরে আমার মা, আমি তোমার শাশুড়ি মা। আমি নাবিল, নাদিফের মা, আজাদ সাহেবের স্ত্রী। তোমার সাহস তো কম না! তুমি আমাদের ঝাঁটা পে’টা করো?”

শাশুড়ি মায়ের ভরাট কণ্ঠস্বর শুনে ফাহিমা কেঁদে দিলো,

” ও শাশুড়ি মাগো! তুমি আমার সামনে এমন ভূতের মত সেজে আছো যে! আমি তোমাকে চিনতে পারিনি মা! আমাকে মাফ করে দাও। আল্লাহ মাফ করো, আমি এতক্ষণ আমার শ্বশুর শাশুড়িকে ঝাঁটা পে’টা করেছি? নাবিল শুনলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিবে। আমাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিবে। ইয়া আল্লাহ আমি আমার এই দুঃখ কোথায় রাখি?”

আয়েশা আজাদ এবং ফাহিমার কাণ্ড দেখে রুপ হাসে কোমড়ে হাত রেখে।
ইতিমধ্যে নাদিফ মেইন গেট দিয়ে প্রেম নীড়ে প্রবেশ করে। নাদিফকে দেখা মাত্রই রুপ নিজের মনের আনন্দ-খুশি ধরে রাখতে পারলো না। কি যেন ভেবে দৌঁড়ে চলে যায় নাদিফের কাছে। নাদিফের হাত ধরে এক প্রকার বাচ্চাদের মত হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলতে শুরু করে,

” আপনার আসার অপেক্ষায় ছিলাম। জানেন কি হয়েছে? ফাহিমা ভাবি না! আঙ্কেল আন্টিকে ঝাড়ুপে’টা করেছে ভূত ভেবে। আল্লাহ, আমি তো হাসতে হাসতে শেষ। আঙ্কেল আন্টির অবস্থা কাদায় মাখা-মাখি। চেনাই যাচ্ছে না। দেখুন আমার সাথে আসুন।”

রুপ যেন বাচ্চাদের ন্যায়ে হয়ে গিয়েছে। যেন ছোট কোন বাচ্চা বড়োদের হাতে ধরে টেনে মজার গল্প শুনাচ্ছে। এদিকে নাদিফ রুপের হাস্যজ্জ্বল চেহারার দিকে তাকিয়ে আছে। নাদিফ এর আগে রুপকে এভাবে হাসতে দেখেনি।
রুপ নাদিফকে সকলের সামনে দাঁড় করায়। আজাদ সাহেব এবং আয়েশা আজাদের অবস্থা সত্যি হাস্যকর। তিন জনকে দেখে তাই মনে হচ্ছে কাদায় বাস করা ভূত। নাদিফ নিজের হাসি আটকাতে পারলো না। হো হো করে হেসে দিলো বাবা মায়ের কান্ড দেখে।
নাদিফ জানে তার বাবা-মা একটু রোমান্টিক। যখন যা ইচ্ছে তাই করে বসে। নিজের মনে আনন্দ পাওয়ার জন্য যদি মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয় তাও নিতে প্রস্তুত। নাদিফ নিজের বাবা-মাকে এজন্যেই ভীষণ ভালোবাসে। নাদিফ হাসি সংযত করি কন্ঠস্বর কঠোর করে সকলের উদ্দেশ্যে বলল,

” একি অবস্থা তোমাদের? এই অবস্থায় যদি তোমরা তিনজন প্রেম নীড়ে প্রবেশ করেছো তো, তোমাদের হাড্ডি গুড্ডি ভেঙ্গে ফেলবো বলে দিলাম।”

নাদিফ কণ্ঠস্বর একটু কঠিন করে সকলের উদ্দেশ্যে বলল যেন ভবিষ্যতে কেউ এমন দুষ্টুমি করতে না পারে। নাদিফের কথা শুনে আজাদ সাহেব একদম নিরপরাধের ন্যায় বলে উঠে,

” আমাদের কোন দোষ নেই বাবা। এই রুপ’ই প্রথম কাদা নিয়ে খেলা শুরু করেছে। এই যে রাইসাকে কাদায় ফেলে কতক্ষণ সুরসুরি দিয়েছে। কিন্তু দেখো! নিজে একদম পুরো পরিষ্কার কাদার কোন ছিটেফোঁটাও নেই। ওদের অবস্থা দেখে আমার মন একটু দুষ্টুমি করতে চাইলো তোমার মাকে নিয়ে। আমিও তোমার মাকে নিয়ে একটু দুষ্টুমি করলাম। কিন্তু রুপকে কাদা মাখাতে পারলাম না।”

আজাদ সাহেবের কন্ঠস্বর আফসোসে ভরা।
বাবার কথা শুনে নাদিফ চট করে রুপকে কোলে তুলে নিলো। রুপা নাদিফের এই কাজের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। রুপ নাদিফের গলা জড়িয়ে ধরে ভয়ে। ওদের দুজনের অবস্থা দেখে সকলে হাততালি দেয়া শুরু করে। এদিকে নাদিফ সকলের উদ্দেশ্যে বলে,

” দুষ্টুমি যেহেতু অপরুপ শুরু করেছে, তাহলে শাস্তি তো তাঁরও পাওয়া উচিত তাই না?”

নাদিফের কথা শুনে সকলে একসাথে হাতে তালি দিয়ে হ্যাঁ বলে উঠে।
রুপ পড়েছে মহা বিপদে। প্রেম নীড়ের সকলকে রুপের শত্রু মনে হচ্ছে। রুপ অসহায় দৃষ্টিতে সকলের পানে তাকালো। রুপের তাকানোতে কারোর মনোভাব বিন্দু পরিমাণ পরিবর্তন হলো না। উল্টো সকলে মিছিমিছি কালা চশমা চোখে লাগিয়ে অন্ধ সেজে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো।

” দয়া করে ঐ কাঁদায় আমাকে ফেলবেন না।”
রুপের করুণ স্বর শুনে নাদিফ ভ্রু যুগল কুঁচকে নেয়। মুখে বাঁকা হাসির রেখা টেনে এনে বলে,

” আমার ভালোবাসা সাদরে গ্রহণ করো। কাঁদায় ফেলবো না, ফুলের বিছানায় ফেলবো।”

রুপ এবার ভীষণ রেগে গেলো। এই লোকটার মুখে কি আর কোন কথা নেই? রুপ রেগে মাথা কাৎ করে নাদিফের শক্ত বাহুতে কামড় দিয়ে বসলো। নাদিফ চোখ বন্ধ করে রুপের আঘাত হজম করে নিলো।

সকলের এক,দুই, তিন গননা করছে। রুপকে হেলিয়ে দুলিয়ে দুইবার ঝাঁকিয়ে কাদায় ফেলে দিলো নাদিফ। সকলের মাঝে হাসির রোল পড়ে যায়। যেন কোন যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে এমন। নাদিফ হেসে সকলের আড়ালে রুপের উদ্দেশ্যে বলল,

” এবার থেকে আর ভালোবাসি বলবো না, সোজা তুলে নিয়ে চলে যাবো।”

রুপও যেন পরাজিত হবে না এই পন করেছে। হাস্যজ্বল নাদিফের হাত ধরে টেনে কাদায় ফেলে দেয়। নাদিফের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,

” আমিও দেখবো কীভাবে আপনি আমায় আপনার ভালোবাসার চাদরে আটকান। আমি এতো সহজে ধরা দিচ্ছি না জনাব!”

চলবে………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here