#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা,পর্ব: ০৭
#লেখা: ইফরাত মিলি
_____________
সকাল সকাল বাড়িতে এক অপরিচিত মুখের আগমন ঘটেছে। অচেনা মুখের ব্যক্তিটির নাম ফ্রেডি। জায়িনের বন্ধু হয়। ছেলেটাকে খুব একটা ভালো লাগেনি মিতুলের। কেমন যেন ছেলেটা! ঠিক কেমন সেটা বোঝাতে পারবে না। ছেলেটা নিজ থেকে পরিচিত হতে এসেছে মিতুলের সাথে। হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে আছে ওর দিকে।
মিতুলের হ্যান্ডশেক করতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এখানে হ্যান্ডশেক না করাটা হয়তো অভদ্রতার সহিত দেখা হয়। মিতুল যখন নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে হ্যান্ডশেকের জন্য কেবল হাত উঠাতে যাবে, ঠিক সেই সময়ে কোত্থেকে যেন উদয় হলো জোহান। ঝড়ের গতিতে এসে হ্যান্ডশেকের জন্য ফ্রেডির বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরে হ্যান্ডশেক করলো জোহান। ফ্রেডিকে বুকে টেনে নিয়ে পিঠে জোরে কয়েকটা চাপড় বসিয়ে দিয়ে বললো,
“হেই ব্রো, হোয়াট’স আপ?”
জোহানের এমন আগমনে অবাক ফ্রেডি, অবাক মিতুলও। জোহান এত শক্ত করে ফ্রেডিকে ধরে রেখেছে যে, ফ্রেডি ব্যথা অনুভব করছে। তাছাড়া জোহানের চাপড়গুলোও ছিল আক্রমণাত্মক। ফ্রেডি দ্রুত নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো জোহানের থেকে। মুখে এক টুকরো বাধ্য হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“এইতো ভালো। তোমার কী খবর?”
জোহানের মুখ থেকে চঞ্চল বুলি ফুঁটলো,
“আমি তো একটি শান্তিপ্রিয় ছেলে। সব সময় ভালোই থাকি।”
“তা যদি ভালোই থাকো তাহলে মুখের ওই দাগগুলো কীসের?”
মিতুল জোহানের মুখের দিকে তাকালো। জোহানের মুখে এখনও মারের দাগ আছে। সেদিনের মতো গাঢ় নেই, হালকা হয়ে গেছে। জোহানকে মারলো কে সেটা এখনও বুঝে উঠতে পারছে না ও। কারো কাছে জিজ্ঞেস করারও সাহস পাচ্ছে না। কথাটা কে কীভাবে নেবে ও জানে না।
জোহান নিজের ঠোঁটের কোণে ক্ষত স্থানটা স্পর্শ করে বললো,
“আরে ব্রো, জানোই তো এগুলো স্বাভাবিক আমার সাথে। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ঘরে গিয়ে বসবে চলো।”
জোহান এক হাত দিয়ে ফ্রেডিকে টেনে নিয়ে যাওয়া দিলে ফ্রেডি হাত ছাড়িয়ে নিলো। বললো,
“জায়িনের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। দেখা হয়ে গেছে ওর সাথে। এই ফাইলটা নেওয়ার ছিল শুধু, পেয়ে গেছি এটা। সুতরাং বসবো না। আমার ইম্পরট্যান্ট কাজ আছে। যেতে হবে আমার। আসছি আমি। পরে দেখা হবে আবার।”
মিতুলকে লক্ষ করে বললো,
“আশা করছি তোমার সাথেও দেখা হবে আবার।”
জোহান এবং মিতুল দুজনের দিকে তাকিয়ে দু বার ‘বাই’ জানালো ফ্রেডি। তারপর দ্রুত পায়ে একরকম পালিয়ে যাওয়ার মতো করে চলে গেল।
মিতুল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ফ্রেডির চলে যাওয়ার দিকে। এমন করে চলে গেল কেন ফ্রেডি? জোহানকে নিশ্চয়ই পছন্দ করে না? মিতুল জোহানের দিকে তাকালো। এই জোহান এমন যে মানুষ এড়িয়ে চলে ওকে?
মিতুলকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জোহান বললো,
“হোয়াট? এমন করে দেখছো কেন?”
“কেন, তোমাকে দেখলেও এত সমস্যা?” কথাটা বলে ঘরের দিকে হাঁটা দিলো মিতুল।
_______________
জোহানের ব্ল্যাক কারটি এগিয়ে চলছে। গাড়ির ভিতর ভীষণ নীরবতা। ড্রাইভিং সিটে বসে রোবটের মতো গাড়ি ড্রাইভ করছে জোহান। আজকে গান-টানও ছাড়েনি। কিন্তু মিতুলের এই সময় গানের খুব প্রয়োজন ছিল। জোহানকে এখনও সেই রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেনি ও। ঠিক কীভাবে বলবে বুঝতে পারছে না। অনেক ভেবে-টেবে বলার একটা রাস্তা বের করলো। জোহানকে প্রথমে সহজ গলায় বললো,
“আমরা কি একটা রেস্টুরেন্টে যেতে পারি?”
জোহান অবাক হয়ে একবার মিতুলের দিকে তাকালো। তারপর আবার চোখ সরিয়ে নিয়ে বললো,
“কেন? রেস্টুরেন্টে কী কাজ আমাদের?”
“আমি ক্ষুধার্ত। ব্রেকফাস্ট করা হয়নি আমার। যখন ব্রেকফাস্ট করতে যাব ঠিক তখনই দেখলাম তুমি ঘর থেকে বের হচ্ছ। তাই ব্রেকফাস্ট না করেই তোমার সাথে দৌঁড় দিতে হলো আমার।”
মিথ্যা বলেছে মিতুল। ব্রেকফাস্ট করেছে ও। রেশমী আন্টি নিজের সাথে বসিয়ে ব্রেকফাস্ট করিয়েছে ওকে। কিন্তু এখন মিথ্যা বলা ছাড়া উপায় ছিল না। যে করেই হোক আজকে সেই রেস্টুরেন্টে যেতেই হবে।
জোহানকে কিছুটা বিরক্ত নিয়ে বলতে শোনা গেল,
“তোমরা বাংলাদেশি মেয়েরা দেখছি আসলেই কোনো কাজের না। ঠিক আছে, তোমাকে এডমন্টনের সেরা একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করাবো আজ। বলো কোন রেস্টুরেন্টে যাবে? আমার মনে হয় আমাদের লা রোনডে’তে যাওয়া উচিত। ওখানের খাবার বেশ ইয়াম্মি হয়।”
মিতুল বাগড়া দিয়ে বললো,
“কেন? আমাদের সেখানে যেতে হবে কেন? আমরা তো সেদিন যে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম সেখানেও যেতে পারি। সেটাও তো একটা সেরা রেস্টুরেন্ট।”
জোহান ভ্রু কুঁচকে সন্দ্বিগ্ন চোখে তাকালো।
“হঠাৎ করে সেখানে যেতে চাইছো কেন? কাহিনী কী?”
জোহানের চাহনি দেখে মিতুলের মনে হলো জোহান ওর মনের কথা সব পড়ে ফেলবে। এই জোহানকে যতটা আহাম্মক মনে করেছিল আসলে ততটা আহাম্মক নয় সে। কিন্তু মিতুলও কম চালাক নয়। মুহূর্তেই একটা মিথ্যা বুঝ দিয়ে দিলো,
“আসলে সেই রেস্টুরেন্টের পিরি পিরি প্রন্সটা সুস্বাদু ছিল খুব। সেই খাবারের স্বাদটা আরেকবার নিতে চাইছি আমি। এর আগে যত খেয়েছি ওই রেস্টুরেন্টের মতো এত টেস্ট ছিল না তাতে।”
মিতুলের কথা ঠিক বিশ্বাস হলো না জোহানের। তবুও মিতুলের কথা মেনে নিয়ে সেই রেস্টুরেন্টের পথ ধরলো।
মিতুলের বাম হাতের হেয়ার রাবারটা খেয়াল হলো জোহানের। ও অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
“এটা কি হেয়ার রাবার না? হেয়ার রাবার হাতে পরে ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন তুমি?”
মিতুল নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ওহ! এটা? আসলে কী বলো তো, মাঝে মাঝে আমি না খুব গরম অনুভব করি। আর গরমে আমি একদমই খোলা চুলে থাকতে পারি না। সে জন্যই এটা সাথে নিয়েছি। যখন-তখন গরম লাগলে যেন নিজের চুল বেঁধে ফেলতে পারি।”
মিতুলের মনে হলো ও বানিয়ে বানিয়ে ভালোই কথা বলতে পারে। মনে মনে ফিচেল হাসলো মিতুল।
রেস্টুরেন্টে এসে পৌঁছে গেছে। মিতুলের মনে উত্তেজনা, উদ্দীপনার ঝড় বইছে। রেস্টুরেন্টে পদার্পণ করেই ওর আঁখি সেই ধূসর চোখ জোড়াকে দেখার পিপাসায় মরিয়া হয়ে উঠলো। এদিক থেকে ওদিক খুঁজে চোখ জোড়া অবশেষে শান্ত হলো। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটলো। ওইতো সে…
একটা টেবিলে খাবার সার্ফ করছে ধূসর চোখের মানুষটি। মিতুলের মনে আনন্দঘন মেঘের আনাগোনা চলছে। শরতের আকাশে থাকা সাদা পেজা তুলোর মতো গাঢ়, ঘনত্ব সেই মেঘ। ছেলেটিকে লক্ষ করতে করতেই জোহানকে অনুসরণ করে মধ্যম সারির একটা চেয়ারে জায়গা করে নিলো মিতুল। এখনও ধূসর চোখাকে দেখে চলেছে চুপি চুপি। সেদিনের মতো একজন ওয়েটার অর্ডার নেওয়ার জন্য এগিয়ে এলো।
জোহানের এখন খাওয়ার মুড নেই, তাই শুধু চিজ কেক অর্ডার করলো। অর্ডার করে মিতুলের দিকে তাকাতে দেখতে পেল মিতুলের ধ্যান-জ্ঞান কিছুই এখন এই টেবিলে নেই। ওর ধ্যান-জ্ঞান সব কিছু এখন ওই দূরে কোথাও নিবেদিত। জোহান মিতুলের দৃষ্টি অনুসরণ করলো। রেস্টুরেন্টের একটা স্টাফের উপর চোখ আটকে গেল ওর। ছেলেটা একজন কাস্টমারের সাথে হেসে হেসে কিছু বলছে। জোহান মিতুলের দিকে তাকালো। মিতুলের চোখে মুগ্ধতার গভীর নলকূপ।
ব্যাপারটা লক্ষ করে জোহান ভীষণ চমকালো। ও একবার মিতুলকে দেখছে আর একবার ওই ছেলেটিকে। ওর বুঝতে বাকি রইল না মিতুলের এখানে আসার আসল কারণ কী! জোহানকে একই সাথে বিরক্তি এবং রাগে চেপে ধরলো। এই মুহূর্তে ভীষণ বিরক্ত বোধ হচ্ছে ওর। এই নাকফুলো মেয়েটা সত্যিই…
জোহান নিজের বিরক্তি, রাগকে সামাল দিয়ে মিতুলকে ডাকলো,
“হেই মিতুল!”
জোহানের ডাকে ধূসর চোখাকে দেখার অশান্ত তৃষ্ণার্ত মনকে জোহানের দিকে স্থির করতে হলো মিতুলের।
“হ্যাঁ, কী হয়েছে?”
জোহান জোরপূর্বক একটু হাসার চেষ্টা করে বললো,
“পিরি পিরি প্রন্সের স্বাদ নিতে এসে এখানে আবার কোন মধুর স্বাদে হারিয়ে গেলে? অর্ডার করবে না কিছু?”
“ওহ হ্যাঁ হ্যাঁ…” মিতুল অযথা একবার মেনু কার্ড হাতে তুলে নিয়ে এক ঝলক দেখে বললো,
“আমি পিরি পিরি প্রন্স এবং কোল্ড ড্রিঙ্কস চাই।”
ওয়েটার হালকা মাথা নিচু করে সম্মতি জানিয়ে অর্ডার নিয়ে চলে গেল।
মিতুলের মন এখন আর এই টেবিল অথবা জোহানকে ঘিরে থাকতে চাইছে না। ওর মন এখন ধূসর চোখার দিকে। ওর চোখও বার বার চলে যাচ্ছে তার উপর।
জোহান কিছু বলছে না, বিরক্ত মনে শুধু মিতুলকে দেখছে। এই মেয়েটা এত পাগল সেটা আগে জানা ছিল না ওর।
খাবার চলে আসে। মিতুল খাচ্ছে সেটা ঠিক, কিন্তু ওর মন পড়ে আছে ধূসর চোখের পিছনে। খাওয়ার পাশাপাশি শুধু চুপিসারে তাকেই দেখে গেল। এত ভালো লাগে কেন তাকে? কখনো সেই ধূসর চোখের মানুষটা সদৃশ্যমান হচ্ছে চোখের সামনে, আবার কখনো বা হারিয়ে যাচ্ছে।
খাওয়া শেষ হয়ে গেল। এবার যেতে হবে। মিতুলের যেতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু এখানে পার্মানেন্ট থাকার তো কোনো উপায় নেই! মিতুল ব্যথিত মন নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার জন্য জোহানের পিছু পিছু দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দরজার কাছাকাছি এসে গেলে কেউ একজন পিছন থেকে ডেকে উঠলো। কণ্ঠটা পরিচিত লাগলো মিতুলের। তাৎক্ষণিক দাঁড়িয়ে গেল ও।
মিতুলের সামনে হাঁটতে থাকা জোহানও থেমে যায়।
মিতুল পিছনে ফিরে যা দেখলো তা আশা করেনি। দেখলো ওর প্রথম প্রেম, মানে সেই ধূসর চোখা ওর দিকে এগিয়ে আসছে। মিতুল অগাধ বিস্ময় এবং সেই সাথে মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে। ভালোবাসার কিছু রঙিন প্রজাপতি মিতুলের আশেপাশে ছড়িয়ে পড়লো।
ছেলেটা একেবারে মিতুলের সামনে এসেই থামলো। মিতুলকে মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বললো,
“তুমি সেই মেয়ে না? যাকে হেয়ার রাবার দিয়ে সাহায্য করেছিলাম আমি?”
ছেলেটার কণ্ঠ মিতুলের মনে শিহরণ বইয়ে দিলো। যে মানুষটাকে এতক্ষণ চুপি চুপি দূর থেকে দেখছিল, সেই মানুষটা এখন হাস্যোজ্জ্বল মুখে ঠিক ওর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে! খুব কাছ থেকেই দেখছে তাকে। মিতুল মনে মনে বললো,
“আহ, আমার প্রথম প্রেম!”
জোহানের ভ্রু জোড়া কুঁচকে উঠলো। মিতুলের চুলের দিকে চাইলো ও। মিতুল খাওয়ার আগে নিজের চুল বেঁধে নিয়েছিল হাতের সেই রাবার দিয়ে। তাহলে এই রাবার এই ছেলে দিয়েছে? আর সে জন্যই তাহলে এটা হাতে পরে রাখা!
ছেলেটা আবার বললো,
“সেদিন তোমার সাথে পরিচিত হওয়া হয়নি। ভেবে রেখেছিলাম এরপর তোমার সাথে আবার দেখা হলে পরিচয় পর্বটা সেরে নেবো। আমি কার্ল জোনাস।”
মিতুল যেন বসন্তের হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে এখন। আহা! আজকের দিনটা এত সুন্দর কেন? ধূসর চোখার নাম শুনেও মিতুলের অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। নামটা যে খুব বেশি সুন্দর তা নয়। কিন্তু এই নাম যেন মিতুলের আজ পর্যন্ত শোনা সব নামের থেকে শ্রেষ্ঠ এখন। মিতুল মিষ্টি হেসে মৃদু কণ্ঠে বললো,
“আমি মিতুল দিলরাবা।”
“মি…মি…হোয়াট?” কার্ল মিতুলের নাম উচ্চারণ করতে পারলো না মোটেই।
মিতুল আবার কার্লের বোধগম্যতার জন্য বললো,
“মি…তুল দিল…রা…বা।”
“রা…রাবা?” কার্ল কোনো রকম উচ্চারণ করলো। তারপর নামটাকে কয়েকবার মনে মনে আওড়িয়ে বললো,
“তোমার যদি কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে আমি কি তোমাকে ‘রাবা’ বলে ডাকতে পারি?”
মিতুল ভাবতে লাগলো, কেন ওকে সবাই মিতুল বলে ডাকে? এই রাবা নামটা কেউ কখনো বের করতে পারলো না কেন? এই রাবা ডাকটা কী সুন্দর! ওর নাম মিতুল দিলরাবা না হয়ে শুধু রাবা হলে কত ভালো হতো! এই ডাক এত মিষ্টি কেন? মিতুল প্রশস্ত হেসে বললো,
“অবশ্যই তুমি আমাকে ‘রাবা’ বলে ডাকতে পারো। আমার কোনো আপত্তি নেই।”
কার্লও একটু হাসলো।
জোহান এতক্ষণ পিছনে দাঁড়িয়ে সব সহ্য করছিল। কিন্তু কেন যেন আর পারলো না। মিতুলকে টেনে পিছনে এনে নিজে কার্লের সামনে এসে দাড়ালো। চওড়া হেসে কার্লের সাথে হ্যান্ডশেক করতে করতে বললো,
“হাই ব্রো, আই অ্যাম জোহান।”
কার্ল উজ্জ্বল হেসে বললো,
“ওহ, নাইস টু মিট ইউ।”
জোহান একটু মাথা দোলালো। তারপর বললো,
“আসলে আমরা ব্যস্ত মানুষ। এত ডিটেইলসে পরিচিত হওয়ার সময় আমাদের নেই। আসছি আমরা। তুলতুল লেট’স গো।”
কথাটা শেষ করে জোহান মিতুলের একহাত শক্ত করে চেপে ধরলো। কাউকে আর একটা শব্দও উচ্চারণ করতে না দিয়ে মিতুলকে জোরপূর্বক টেনে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে এলো।
________________
“তুমি এটা কেন করলে?” গাড়িতে বসে ক্ষুব্ধ গলায় প্রশ্ন করলো মিতুল। রাগে ফুঁসছে ও। রেস্টুরেন্ট থেকে প্রায় অনেক দূর চলে এসেছে ওরা। জোহানের এমন বেয়াদবি মিতুলকে শান্ত রাখার বৃথা চেষ্টা পর্যন্ত করতে পারছে না।
“কী করেছি আমি?” নির্বিকার ভাবে জানতে চাইলো জোহান।
মিতুল গর্জে উঠলো,
“আমাকে কী মনে হয় তোমার? আমি কি তোমার পোষা প্রাণী? একটা পাবলিক প্লেস থেকে তুমি আমার হাত ধরে টেনে আনলে কেন ওভাবে? আমাকে কি তোমার হ্যান্ডব্যাগ মনে হয়? কী মনে করো কী তুমি নিজেকে? রাজপুত্র? না কি স্বয়ং রাজাই ভাবো নিজেকে? কী মনে করো, এটা তোমার রাজ্য? আর আমি তোমার রাজ্যের অসহায় একজন প্রজা? যার উপর উঠতে-বসতে শাসন চালাবে তুমি? শুনে রাখো একটা কথা, যদি তুমি নিজেকে রাজাই ভেবে থাকো, তাহলে তোমার ওই চিন্তা চেতনাকে রাজার দাস বানাতেও সময় লাগবে না আমার। অহংকারী বদমাইশ কোথাকার! আর হ্যাঁ, কার্লের সাথে এমন বাজে বিহেভ কেন করলে তুমি? হ্যাঁ? কেন করলে?” চাপা গর্জন করে উঠলো মিতুল।
রাগে দপদপ করা শিরা এবার সত্যিই জ্বলে উঠলো জোহানের। রাস্তার পাশে গাড়ি নিয়ে দ্রুত বেগে ব্রেক কষলো। সিট বেল্ট বাঁধা থাকা সত্ত্বেও বড়ো-সড়ো রকমেরই একটা ধাক্কা অনুভব হলো।
জোহানের এহেন কারবারে মিতুল অবাক হয়ে ওর দিকে চাইলো।
জোহান সামনে স্থির দৃষ্টি রেখে চোয়াল শক্ত করে বললো,
“বেরিয়ে যাও।”
“কী?”
“সহজ কথা বুঝতে পারছো না? গেট আউট অফ মাই কার!”
জোহান মিতুলের দিকে একটু ঝুঁকে এক হাত দিয়ে মিতুলের পাশের দরজাটা খুলে দিলো। রাগে জোহানের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস পড়ছে।
দু চোখে জ্বালা, বুক ভর্তি ঘৃণা আর রাগ নিয়ে কয়েক সেকেন্ড জোহানের দিকে তাকিয়ে রইল মিতুল। তারপর নিজের আত্মসম্মান নিজের কাছেই গুটিয়ে রেখে রাগ এবং জেদকে প্রধান্য দিয়ে ফট করে গাড়ি থেকে নেমে গেল।
মিতুল বেরিয়ে যেতেই জোহান দরজাটা টেনে বন্ধ করে নিলো। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দ্রুত বেগে চলে গেল বহুদূর।
মিতুল অদৃশ্যপ্রায় গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইল পলকহীন। অপমান, রাগে শরীর থেকে আগুন ছড়াচ্ছে। এই জোহান এত খারাপ, এত খারাপ, এত খারাপ যে তার প্রমাণ আজ ভালো করে পেল। এই কদিনে মনে হয়েছিল জোহান একটু ভালো হয়েছে। কিন্তু না, ভালো তো দূরের থাক বরং আরও বেশি পাজি শয়তান হয়েছে।
রেস্টুরেন্টে কার্লকে ইনসাল্ট করে ওকে টেনে নিয়ে আসলো! কার্লের সাথে একটু ভালো করে কথা বলতে দিলো না! এখন আবার মাঝপথে এত বড়ো অপমান করে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিলো!
আজকে জোহানের সাথে বাইরে বের হওয়া ছিল জীবনের আরও একটা সবথেকে বড়ো ভুল। একারই বের হওয়া উচিত ছিল। মিতুল এই মুহূর্তে একটা শপথ নিলো, যে কদিন এই কানাডায় আছে তার মধ্যে একদিনও ওই অহংকারী ফ্যামিলির কারোর সাথে বাইরে বের হতে চাইবে না। বিশেষ করে ওই জোহানের সাথে। বয়কট করলো আজ থেকে জোহানকে! বয়কট জোহান!
(চলবে)