চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা,২০,২১

0
770

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা,২০,২১
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ২০
____________

বাইরে রোদ্রজ্জ্বল দিন। যতদূর চোখ যায় সবই যেন রোদদের দখলে। খোলা উইন্ডো দিয়ে সকালের রোদের কিছুটা অংশ এসে মিতুলের মুখখানিতেও বিরাজ করেছে।
ওর মস্তিষ্ক এখন কালকের ঘটনাতে আটকে আছে। চোখের সামনে কালকে রাতের দৃশ্যপট ভেসে উঠছে ঝাপসা করে টানা রংতুলিতে। চুলে ফুল গুঁজে দেওয়া, আর জোহানের মুখ থেকে নির্গত সেই শান্ত-মৃদু কণ্ঠ বাণী! মিতুলের সে সময় মনে হয়েছিল ও কিছুক্ষণের জন্য নিজের হৃদয় হারিয়ে ফেলেছে। ওর হৃদয় ওর বশে ছিল না। হৃদয় অদ্ভুত আচরণ করছিল তখন ওর সাথে।
মিতুল জানে না এর কারণ কী। আর জানে না কী ছিল জোহানের কালকের বলা ওই কথার মানে। কী বুঝিয়েছে জোহান? ওটা কি ওর গানের কোনো অংশ ছিল?
সামান্য একটা বিষয় নিয়ে এভাবে ভাবার জন্য এবার মিতুল নিজের প্রতি নিজে ভীষণ বিরক্ত হয়ে উঠলো। আরে সেই থেকে কী এত ভেবে চলেছে! জোহান তো গান গায়, গান লিখে। ওটা নিশ্চয়ই ওর গানের একটা অংশ ছিল। ওর সেই, ‘ইউ আর মাই লিটল এঞ্জেল’ গানটা থেকেই একটু অংশবিশেষ ছিল বোধহয়। কালকে জোহানের বলা বাক্য গুলোর মাঝে তো এঞ্জেল ব্যাপারটা ছিল।
মিতুল ভাবার চেষ্টা করলো, সেদিন পার্টিতে জোহানের কণ্ঠে যে লিটল এঞ্জেল গানটি শুনেছিল, সেই গানের মাঝে এই অংশটুকু ছিল কি না। মিতুল ভাবলো। কিন্তু গানটার সব কথা ওর মনে পড়ছে না। হবে হয়তো ওই গানেরই। হ্যাঁ, সেটাই হবে। নিজের গানের একটা অংশ তো জোহান বলতেই পারে। সেটা নিয়ে এত ভাবাভাবীর কী আছে? মিতুলের নিজেকেই নিজের বলতে ইচ্ছা হলো,
‘আরে মিতুল, কানাডা এসে এ কি অবনতি হলো তোর! সামান্য কিছু গানের বাক্য নিয়েও তোর এত মাথা ব্যথা? আহারে, তুই কোথা থেকে কোথায় গিয়ে ঠেকছিস? প্রথমে জঙ্গল নিয়ে, এখন আবার এই গান নিয়ে। হায়রে!’

মিতুল নিজের ভাবনাগুলো মৃদুমন্দ হাওয়ার তরে বিলীন করে দিলো। সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে এত ভাবাভাবীর কিছু নেই। বড়ো করে একটা শ্বাস নিয়ে সেই শ্বাসের সাথেই বের করে দিলো ওর এসব বাড়াবাড়ির চিন্তা।
মিতুল হঠাৎ লক্ষ করলো ওর হাতে হেয়ার রাবারটা নেই। কালকে সকালে খুলে রেখেছিল। ও চেয়ার ছেড়ে দিয়ে ওয়ার্ডোবের দিকে এগিয়ে এলো। ড্রয়ার খুলে খুঁজতে খুঁজতে মিহি সুরে বলতে লাগলো,
“হোয়‍্যার ইন মাই কার্ল?”
একটু খুঁজতেই পেল হেয়ার রাবারটা। হাতে পরে নিলো। এখন সুন্দর লাগছে! মিতুল রুমে একা আছে। রেশমী আন্টি সাদাত আঙ্কলের সাথে কোথায় একটা বের হয়েছে। তারা ফিরলে সবাই মিলে ঝুলন্ত ব্রিজ দেখতে বের হবে। মিতুল বিছানার দিকে এগিয়ে এলো। হাতে তুলে নিলো মোবাইল। কার্লকে ম্যাসেজ পাঠাবে। কিন্তু কী লিখবে?
মিতুল টাইপ করতে লাগলো,
‘গুড মর্নিং কার্ল! হোয়াট আর ইউ ডুয়িং?’

সেন্ড করে দিলো ম্যাসেজটা। তারপর রুম থেকে বের হলো। কোথায় যাবে এখন? পুলে যাওয়া উচিত?
মিতুল পুলে চলে এলো। পুলে তেমন মানুষ নেই। মাত্র কয়েক জনকে দেখা যাচ্ছে। কেউ সাঁতারও কাটছে না তেমন। মিতুলের হঠাৎ একটা পুলে চোখ পড়লো। জোহানকে দেখা যাচ্ছে পুলে। সাঁতার কাটছে না ও। পানিতে গা ডুবিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে আছে।
মিতুল চাইছিল জোহান ওকে দেখার আগেই ও এখান থেকে চলে যাবে। যাওয়ার জন্য ঘুরেও ছিল। কিন্তু জোহান ওকে লক্ষ করতেই পিছন থেকে ডেকে উঠলো,
“হেই মিতুল!”

মিতুলের দাঁড়িয়ে যেতে হলো। না চাইতেও কেন যেন পিছন ফিরলো। জোহান ওকে হাত দিয়ে ইশারা করে বললো,
“এদিকে এসো।”

মিতুলের জোহানের কাছে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না, তবুও ও এগিয়ে গেল।
জোহানের গায়ে কোনো শার্ট, টি-শার্ট বা কোনো গেঞ্জি নেই। শুধু পরনে একটা হাফপ্যান্ট। জোহানকে খালি গায়ে দেখে কেমন যেন লাগলো মিতুলের। যদিও এখানে আরও দুই তিন জন ছেলেই আছে যাদের জোহানের মতো এমন গেট আপ। তাদের ব্যাপারটা স্বাভাবিক লাগলেও জোহানের ব্যাপারটা কেমনই যেন লাগলো ওর।
মিতুল কাছে এসে দাঁড়াতেই জোহান পানি ছিটিয়ে দিলো। মিতুল বিরক্ত হয়ে বললো,
“কী করছো!”

জোহান হাত দিয়ে পানি নাড়াচাড়া করতে করতে বললো,
“সুইম করবে আমার সাথে?”

মিতুল মুখ বাঁকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো।

“সাঁতার পারো না তুমি?”

“অবশ্যই পারি।” দৃঢ়তার সাথে বললো মিতুল।

“তাহলে এসো। আমার সাথে প্রতিযোগিতা করো। দেখি কে বেশি সাঁতারে পারদর্শী।”

“দরকার নেই। আমার মাথা খারাপ নয় যে তোমার সাথে সাঁতার কাটবো আমি।”

“এখানে মাথা খারাপের কথা উঠলো কেন? সত্যিটা মেনে নাও। তুমি আসলে সাঁতারে দুর্বল।”

বলে এ মাথা থেকে ও মাথা একবার সাঁতার কেটে এলো জোহান। সাঁতার কেটে মিতুলের কাছাকাছি আসতেই আবারও দুষ্টুমির ছলে পানি ছিটিয়ে দিলো মিতুলের গায়ে।
মিতুল পুলের কাছ থেকে সরে গেল কয়েক পা দূরে। তবুও পানি এসে ওর গায়ে লাগলো ঠিকই। জোহানের এমন আচরণে মিতুল অগ্নিচোখে তাকালো ওর দিকে। জোহান হাসলো।
মিতুল রেগে গেল ভীষণ। বেরিয়ে এলো পুল গ্রাউন্ড থেকে। সাদা টপসের অনেক জায়গা ভিজে গেছে পানিতে। মুখেও পানির ঝাপটা লেগেছে। মিতুল মুখ মুছতে মুছতে এগিয়ে আসছিল। পথে জায়িনের সাথে দেখা। মিতুলের মুখের দিকে কেমন একটা বাঁকা চোখে তাকালো সে। প্রশ্ন করলো,
“কোথায় গিয়েছিলে?”

“পুলে।”

বলে অল্পতেই পাশ কাটিয়ে চলে এলো মিতুল। রুমে এসে দেখলো রেশমী আন্টি এসে গেছে। রেশমী আন্টি ওকে দেখে বললেন,
“রেডি হয়ে নাও। আমরা ব্রিজ দেখতে বের হবো।”

____________

মিতুল লায়ন্স গেইট ব্রিজ নিয়ে ভাবছে। ব্রিজের একদম পাশে মানুষের হাঁটার জন্য আলাদা ওয়াক ওয়ে রয়েছে। ব্রিজের মাঝখান থেকে গাড়ি চলে অহরহ। ব্রিজের মাঝখানের বাম পাশ থেকে লাইন ধরে সুশৃঙ্খল ভাবে গাড়ি আসে। আর ডান পাশ থেকে লাইন ধরে সুশৃঙ্খল ভাবে গাড়ি যায়।
ওয়াক ওয়েতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মানুষজনের চলাচল ছিল। কেউ কেউ নিজেদের ভিতর গল্প করছিল। কারো কারো দৃষ্টি ছিল দূর পাহাড়ে। কারো দৃষ্টি ছিল সমুদ্রের অদূরে। আবার কারো কারো দৃষ্টি ছিল দূরে সমুদ্রের পাশ ঘেঁষে থাকা সবুজ উদ্যানে। ব্রিজ থেকে নিচের পানির দিকে তাকালে দেখা যায় সোনালী রোদ্দুর পড়ে পানি চিক চিক করছে। ব্রিজ ধরে এগোলে ব্রিজ থেকেই দেখা যায় সমুদ্রের তীর ঘেঁষে সবুজে ঘেরা অরণ্যের পাশ কেটে একটা আঁকা-বাঁকা রাস্তা এগিয়ে গেছে। সমুদ্রের সাথের ওই রাস্তা কোথায় গিয়ে মিলেছে মিতুল জানে না। মিতুলের ইচ্ছা ছিল ওই রাস্তায় নেমে খুব কাছ থেকে সমুদ্রপৃষ্ঠ দেখবে একটু। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি। সবাই মিলে লায়ন্স গেইট ব্রিজ থেকে ফিরে গিয়েছিল আবার স্ট্যানলি পার্ক। কারণ, কালকে ১০০০ একরের উপর গড়ে ওঠা বিশাল পার্কটির অনেক জায়গা ভালো করে দেখা হয়নি। ভ্যাঙ্কুভারের বৃহত্তম অ্যাকোয়েরিয়াম স্ট্যানলি পার্কের ভিতরেই। আজকে স্ট্যানলি পার্কে গিয়ে ভ্যাঙ্কুভার অ্যাকুয়েরিয়াম দেখেছে সবার আগে। ওটা ছিল ওর জন্য বেশ মনোমুগ্ধকর। ওখানে সত্তর হাজারেরও বেশি প্রাণী আছে। কাছ থেকে কত জলজ প্রাণী দেখে এসেছে। পার্কের আরও কিছু স্পট ঘুরে দেখেছে। আরও কয়েকটা জায়গা ঘোরার কথা থাকলেও সময় স্বল্পতার জন্য তা হয়ে ওঠেনি। সময় স্বল্পতার কারণ ছিল সাদাত আঙ্কল এবং জায়িন। বিকেলে তাদের ফ্লাইট ছিল। আজকে বিকেল নাগাদ তারা এডমন্টন ফিরে গেছে অফিসিয়াল কাজের জন্য। তাদের ছুটির সময় ছিল কেবল তিনদিন। আজকে এই তিনদিনে পড়েছে। তাই তাদের ছুটতে হয়েছে আবার এডমন্টন। ও এবং রেশমী আন্টি আছে ভ্যাঙ্কুভারে। আরও দুই দিন থাকবে ওরা। জোহানও আছে। রেশমী আন্টি চাইছিলেন জোহানকে ওর ড্যাড এবং ব্রাদারের সাথে এডমন্টন পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু জোহান যেতে নারাজ। ও বলে দিয়েছে,
‘ড্যাড, ব্রাদারের কাজ আছে তাই তারা এডমন্টন ফিরে যাবে। আমি কেন যাব? আমার কি কোনো কাজ আছে? আমি তো মুক্ত পাখির মতো। এখানে মুক্ত হয়ে ঘুরতে পারি শত শত দিন। আমি ফিরবো না তাদের সাথে।’

নাছোড়বান্দার মতো ভ্যাঙ্কুভার থেকে গেল জোহান।
মিতুল এখন লবিতে দাঁড়িয়ে আছে। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ানো। এই শহর এবং রেডিসন এখন রাতের সৌন্দর্যে আছে। চারিদিকে বাহারি আলোক সজ্জা। নিচে দেখা যাচ্ছে অনেকের চলাচল। কেউ জোড়ায় জোড়ায় চলছে, কেউ বা একাকী! মিতুলের মনে হলো ও নিজেও একা। কেউ নেই ওর সাথে। রেশমী আন্টি রুমে। রেশমী আন্টিকে বলেই ও হোটেল দেখতে বের হয়েছে। মিতুলের একাকিত্ব দূর করে দিতে হঠাৎ আগমন ঘটলো জোহানের।
যদিও জোহানের এই আগমনের থেকে ওর একাকী থাকাই ভালো ছিল। জোহান এসে ওর পাশে দাঁড়িয়েই নিজের হাতে থাকা মোবাইলের দিকে তাকাতে ইঙ্গিত করলো ওকে। মিতুল দেখতে পেল মোবাইলে সেই মেয়েটা। যে মেয়ের গুণকীর্তন গেয়ে বেড়ায় জোহান ওর কানে কানে। নিশ্চয়ই আবারও এসেছে আগের মতো গুণকীর্তন গাইতে। জোহান মোবাইল স্কিনে তাকিয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো,
“দেখো, সান্ডা আমার কাছে পিক পাঠিয়েছে। একটু আগে ভিডিয়ো কলে কথা হচ্ছিল ওর সাথে। তখন ও বললো আমাকে ওর তোলা নিউ পিক পাঠাবে। দেখো পাঠিয়েছে। মনে হচ্ছে যেন কোনো অপ্সরীর ছবি দেখছি মোবাইলে!”

মিতুল অবাক হয়ে দেখছে জোহানকে। জোহান ওকে ছবি দেখতে বলে নিজেই গভীর চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। হাসছেও আবার মিটিমিটি। এই মেয়েটার জন্য এত পাগল জোহান? এই মেয়েটার জন্য পাগল হয়ে মরছে ও! অথচ যে মেয়েটা ওকে সত্যি ভালোবাসে তাকে বুঝতে পারছে না ও? ও কি লেনির মনের অনুভূতি একটুও বুঝতে পারেনি?

মিতুল দেখতে পেল জোহান মেয়েটার ছবির দিকে ফ্লাই কিস ছুঁড়ছে। মিতুলের দেখে রাগ হলো। আস্ত একটা গাধা এই জোহান। লেনির আসল ভালোবাসা বুঝতে পারছে না, অথচ এই মেয়েটার জন্য পিরিত গলে গলে পড়ছে ওর। অসহ্যকর আহাম্মক একটা!

জোহান মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো। রেলিংয়ে সাথে হেলান দিয়ে মিতুলের দিকে মুখ করে দাঁড়ালো। তারপর বলতে লাগলো,
“সান্ডার ব্যাপারে টুকিটাকি সব জানা হয়ে গেছে আমার। সান্ডা একটা বেসরকারি কোম্পানিতে জব করে। ওর বাবা টিচার এবং ওর মা ডক্টর। ওর ছোটো একটা ভাই আছে। ওর ভাইয়ের বয়স উনিশ এবং ওর বয়স সাতাশ। ও…”

জোহান পুরো কথা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই মিতুল বিস্ময় কণ্ঠে বললো,
“সাতাশ?”

জোহান স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“হ্যাঁ, সাতাশ। এতে এত অবাক হওয়ার কী আছে? বয়সে বড়ো যে কারো সাথে রিলেশন করাই যায়। ইট’স অল রাইট। আর সান্ডা তো আমার থেকে মাত্র তিন বছরের বড়ো। এটা খুবই স্বাভাবিক।”
বলতে বলতে নিজের কাঁধ নাড়ালো।

“তোমরা কি রিলেশনশিপে আছো?”

জোহান ফিক করে হেসে দিয়ে বললো,
“এই না না। রিলেশনশিপে নেই আমরা। তবে ভাবছি ওরকম কিছু একটা হতেও পারে। মনে হচ্ছে খুব শীঘ্রই আমরা রিলেশনে যাব।”

মিতুলের আর সহ্য হলো না। এই অন্ধ জোহানের চোখ খুলে দিতে ওকে বলতেই হলো,
“লেনি যে তোমাকে পছন্দ করে, ভালোবাসে, সেটা কি তুমি বোঝো না?”
বেশ তেজি শোনালো মিতুলের কণ্ঠ।

জোহান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কোন বিষয়ে কথা বলছো তুমি?”

“আমি তোমার আর লেনির ব্যাপারে বলছি। লেনি মেয়েটা যে তোমাকে পছন্দ করে সেটা তো সুস্পষ্ট। আমি একদিন দেখে বুঝে গেলাম ও তোমায় পছন্দ করে। আর তুমি? তুমি এত কাল ধরে কাছে থেকেও সেটা বুঝতে পারোনি? কেমন মানুষ তুমি? হুট করে ক্লাবে একটা মেয়ে দেখে পাগলামো শুরু করেছো। অথচ যার তোমার জন্য সত্যিকারের ফিলিংস আছে, তাকে একবার বোঝার চেষ্টা করলে না? কেমন মানুষ তুমি?”

জোহান ফোঁস করে বিরক্তিকর নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর মিতুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“লিসন, আমাকে এবং লেনিকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তুমি তোমার…”

“কেন ভাবতে হবে না? লেনি তোমাকে মুখ ফুঁটে হয়তো বলতে পারেনি নিজের পছন্দের কথা। কিন্তু তুমি? তোমার তো বোঝা উচিত। এত বছরের ফ্রেন্ডশিপ, অথচ এটা বোঝো না?”

জোহান ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে বললো,
“মুখ ফুঁটে বলতে পারেনি?” হেসে উঠলো জোহান।
মিতুল বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। জোহান বললো,
“লিসন, শি প্রপোজড টু মি।”

মিতুলের এতক্ষণের চিন্তাধারা সব মুহূর্তে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল জোহানের একটা কথায়। চোখ কপালে উঠলো ওর। প্রপোজ মানে?

“ও প্রপোজ করেছিল আমাকে। আমি একসেপ্ট করিনি। বিকজ, আমি মুসলিম। আমি বিয়ে করলে কোনো কানাডিয়ান মুসলিম মেয়েকেই করতে চেয়েছি। তো যখন আমি একটা মুসলিম মেয়েকেই বিয়ে করবো, তখন ওর সাথে কিছুদিনের জন্য রিলেশনে জড়ানোর মানে কী? আছে কোনো মানে? নেই। তাহলে শুধু শুধুই এসব…”

জোহান এবার লবি ছেড়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো।

মিতুল পিছন থেকে বলে উঠলো,
“তাহলে সান্ডা? সান্ডা কি মুসলিম? ওর জন্য তো ঠিকই তোমার পিরিত উপচে উপচে পড়ছে! দিশেহারা প্রেম তোমার।”

জোহান কয়েক পা দূরত্বে এসে আবার থামলো। মিতুলকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“সান্ডা! হ্যাঁ, এই সান্ডা শুধুই একটা অহেতুক জিনিস ছাড়া আর কিছুই নয়। এক-দুই দিনের অহেতুক ব্যাপার। তোমাকে তো আগেই বলেছি, দিনে অনেক মেয়ের প্রোপোজ আসে আমার কাছে। ভাবলে কী করে যে এত এত মেয়ের মাঝে আমি এই ক্লাবে দেখা সান্ডাকে পছন্দ করবো? বোকা না কি তুমি?”

মিতুল শুধু ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল। জোহান চলে গেল।
মিতুলের দিশেহারা লাগছে। পাগল হয়ে যাবে বোধহয়। এটা কী করলো ও? লেনির হয়ে কেন ওকালতি করতে গেল ও? না কিছু জানে লেনির ব্যাপারে, আর না জানে জোহানের ব্যাপারে। তাহলে এরকম করে কেন বলতে গেল জোহানকে? কেন? দেখো না, কীরকম ভাবে কথা শুনিয়ে গেল জোহান ওকে! বোকা পর্যন্ত বলে গেল! জীবনে এরকম ভাবেও অপমান, লাঞ্ছিত হওয়া বাকি ছিল? ছি ছি ছি।
আর সান্ডার ব্যাপারটা? কী হলো এটা? জোহান এই দুদিন ধরে সান্ডার গুণকীর্তন গাইলো। আর এখন কীসব বলে চলে গেল? মিতুলের সত্যিই দিশেহারা লাগছে। সত্যি সত্যিই লাগছে। এতটাই দিশেহারা লাগছে যে, ইচ্ছা করছে খুব জোরে একটা চিৎকার করতে। কিন্তু সেই চিৎকার ওর ভিতরেই গুমরে-মুচড়ে নেতিয়ে পড়লো।

(চলবে)

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ২১
____________

রেডিসন হোটেলের রেস্টুরেন্টে অনেক মানুষ ইতোমধ্যে ব্রেকফাস্ট করার জন্য জড়ো হয়েছে। চলছে অর্ডার, চলছে খাওয়া।
মিতুলও একটা টেবিলে এসে বসেছে। তবে কিছু অর্ডার করেনি। রেশমী আন্টি আসলে তারপর অর্ডার করা হবে। রেশমী আন্টি এখনও এসে পৌঁছয়নি রেস্টুরেন্টে।
মিতুল একবার সামনে চোখ তুলে তাকালো। ওর চেয়ার বরাবর সামনের চেয়ারে জোহান বসা।
জোহান কিছু বলছে না। এদিক-ওদিক তাকিয়ে রেস্টুরেন্ট দেখছে।
মিতুলের হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল। এই ব্যাপারে জোহানকে জিজ্ঞেস করবে কি না ভাবছে। মিতুল শেষমেশ জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
“শুনেছি এই ভ্যাঙ্কুভারে না কি একটা পাঞ্জাবি মার্কেট আছে?”

মিতুলের কণ্ঠ কানে আসতে জোহান মিতুলের দিকে তাকায়। খুব কষ্টে উচ্চারণ করে,
“পা-পা-পাজবি?”

মিতুল দুই পাশে মাথা নেড়ে বললো,
“পাজবি নয়। পাঞ্জাবি। পাঞ্জা-বি। তুমি জানো না পাঞ্জাবি বাজার সম্পর্কে?”

“ওহ পানজবি! পানজবি বাজার কোথায় সেটা আমি জানবো কী করে? আর পানজবি দিয়ে তুমি কী করবে? তোমার কি পোশাকের অভাব পড়েছে? পানজবি কিনে পানজবি পরবে তুমি?”

মিতুল কিছু বলার আগে জোহান নিজেই আবার বললো,
“একটা কাজ করা যায়। আমার কাছে অনেক পানজবি আছে। প্রত্যেক ইদে আমার ড্যাড আমাকে গিফট করে। তুমি চাইলে আমি সেখান থেকে তোমাকে একটা, দুটো পানজবি গিফট করতে পারি। চাই তোমার?”

জোহানের কথা শুনে মিতুলের মেজাজ খারাপ হওয়ার অবস্থা।
“আমি ওই পাঞ্জাবির কথা বলছি না। আমি বলছি পাঞ্জাবির কথা। ইন্ডিয়ার একটা রাজ্য এটা। যার নাম পাঞ্জাব। তুমি কি এটা জানো না? মানে, কোনো দেশ সম্পর্কে কি ধারণা নেই তোমার? এই কানাডাই চেনো না কি শুধু?”

“ইন্ডিয়া সম্পর্কে জেনে আমি কী করবো? শুনেছি কতগুলো রাজ্য আছে। এখন সেই রাজ্যেগুলোর নাম ঠিকানা কি মুখস্থ করে ফেলতে হবে আমার? কী করবো আমি ইন্ডিয়া সম্পর্কে জেনে? আমি কি সেখানে গিয়ে নিজের বসত গড়বো? আর কী বললে, বাইরের কোনো দেশ সম্পর্কে আমার ধারণা নেই? তুমি জানো, আমি কতগুলো বাইরের দেশ ভ্রমণ করেছি? আইডিয়া আছে তোমার কোনো? স্পেন, সৌদি আরব, আমেরিকা, রাশিয়া, ইংল্যান্ড, চীন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ইত্যাদি অনেক দেশে ঘুরেছি আমি। আর তুমি যে আমাকে বলছো, তোমার নিজের কয়টা দেশ সম্পর্কে ধারণা আছে? আমার তো মনে হয় এই কানাডা ছাড়া আর কোনো দেশ ভ্রমণ করোনি।”

মিতুল খুব দাপটের সাথে বললো,
“না জেনে না শুনে কথা বলবে না একদম। অবশ্যই আমি আরও বাইরের দেশ ঘুরেছি। ইন্ডিয়া, মালদ্বীপ, নেপাল ঘুরেছি আমি। তোমার মতো নই আমি।”

“আমার মতো নও মানে? কী বোঝাতে চাইছো? আমাকে তোমার কী মনে হয়?”

“একটা পাতিহাঁস বৈ কিছুই মনে হয় না।” দ্রুত গতিতে বাংলা বললো মিতুল।

“পে-পেটি-হ্য-হ্যাস? পে-পেটিহ্যাস মানে কী?”

মিতুল ভাবতে পারেনি জোহান তোতলাতে তোতলাতে ‘পেটিহ্যাস’ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে। ও ভেবেছিল, ‘পে-পে’ করতে থাকবে জোহান। কিন্তু না, ভালোই উন্নতি করেছে দেখছে।
মিতুলকে চুপ করে থাকতে দেখে জোহান অধৈর্য হয়ে বললো,
“কী ব্যাপার, বলছো না কেন কিছু?”

“কী বলবো?”

“পেটিহ্যাসের ইংলিশ মিনিং বলো আমাকে।”

“কোনো মিনিং নেই।”

“তুমি বলবে না আমাকে, তাই না? ঠিক আছে বলতে হবে না তোমার। আমি নিজেই বাংলা শিখে পেটিহ্যাসের মিনিং জেনে নেবো। যদি খারাপ কোনো মিনিং বের হয়, তবে তোমার কপালেও খারাপ আছে।”
জোহান চেয়ার ছেড়ে উঠে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গেল।

মিতুল বাংলাতে বিড়বিড় করে বললো,
“আগে শেখ, তারপর দেখা যাবে।”
___________

ভ্যাঙ্কুভার আর্ট গ্যালারি এবং জন হেনরী পার্ক ঘুরে এইমাত্র হোটেলে ফিরেছে মিতুল’রা। আসার সময় আবার শপিংও করেছে।
রেশমী আন্টি একটা জ্যাকেট এবং একটা লং কোট গিফট করেছে ওকে। মিতুল শপিং ব্যাগগুলো বিছানার উপর রাখলো।
রেশমী আন্টি জ্যাকেট খুলে রাখছে। আজকে বাইরে অনেক শীত। উষ্ণ পোশাক পরে না বেরোলেই বিপত্তি। মিতুলের গায়ে একটা লং কোট। গলায় মাফলার প্যাঁচানো। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে বিছানায় রাখতে গেলেই দেখলো জোহানের ম্যাসেজ এসেছে। মিতুল ম্যাসেজ সিন করলো।
‘এখনই বাইরে এসো। পাঞ্জাবি মার্কেট দেখতে যেতে চাইলে ঝটপট এসে পড়ো। আমি রাস্তায় ওয়েট করছি।’

জোহানের ম্যাসেজ দেখে মিতুল যারপরনাই অবাক। পাঞ্জাবি বাজার? জোহান তো বললো পাঞ্জাবি বাজার চেনে না ও। তাহলে? ব্যাপারটা একবার গিয়ে দেখতে হয় তো।
মিতুল একবার উইন্ডোর দিকে তাকালো, আর একবার রেশমী আন্টির দিকে। এখন শেষ বিকেল। বাইরে রোদের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে না। রেশমী আন্টি চুল থেকে হেয়ার পিন খুলছে। রেশমী আন্টিকে না বলে তো আর যেতে পারবে না। কিন্তু কী বলবে রেশমী আন্টিকে? জোহানের সাথে কোথাও যাওয়ার কথা একদম বলতে পারে না রেশমী আন্টির সাথে। কেমন যেন সংশয় হয়। মিতুল খানিক ইতস্তত করে ডাকলো আন্টিকে,
“আন্টি…”

“হ্যাঁ, বলো।” মিতুলের দিকে তাকাতে তাকাতে বললো।

“বলছি, আমি কি জোহানের সাথে পাঞ্জাবি মার্কেটে যেতে পারি? মানে, ও এইমাত্র ম্যাসেজ করে আমাকে জানিয়েছে পাঞ্জাবি মার্কেট নিয়ে যাবে। এখন আমি কি যেতে পারি ওর সাথে?” মিতুলের বুক ধুকপুক করছে। জানে না কেন রেশমী আন্টির কাছে জোহানের কথা বলতে গেলে ওর এরকম ফিল হয়।

রেশমী আন্টি ওর দিকে তাকিয়ে গভীর ভাবে কী যেন ভাবলেন। ভাবতে অনেক সময় নিলেন যেন। তারপর বললেন,
“গেলে যাও। তবে ওর সাথে না গেলেই ভালো হতো। আমি কালকে নিয়ে যেতাম তোমাকে।”

মিতুলের কেন যেন মনে হচ্ছিল রেশমী আন্টি পারমিশন দেবেন না। কিন্তু রেশমী আন্টি যেতেও তো নিষেধ করেননি। পারমিশন দিয়েছে আবার দেয়নি, এমন অবস্থা।
মিতুল বললো,
“যেহেতু ও বলেছে আমাকে নিয়ে যাবে, সেহেতু আমি এখন ওর সাথে যাই।” কথাটা বলতে বলতে মিতুল নিজের ব্যাগ উঠিয়ে নিলো বিছানা থেকে। রেশমী আন্টির কিছু বলার অপেক্ষা করলো না। দ্রুত বেরিয়ে গেল রুম থেকে।

রেশমী তাকিয়ে রইলেন দরজার দিকে। জোহানের সাথে মিতুলের এত চলাচল মোটেও ভালো লাগছে না তার!

মিতুল হোটেল থেকে বের হতেই জোহানকে দেখতে পেল। জোহানের গায়ে কালো জ্যাকেট। মিতুল কাছে এসে বললো,
“চলো।”

জোহান মিতুলের দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর একেবারে মিতুলের সামনে এসে দাঁড়ালো। কোনো কিছু না বলেই মিতুলের গলায় প্যাঁচানো মাফলারটা খুলতে লাগলো। মিতুল বিস্ময় কণ্ঠে বললো,
“কী করছো তুমি?”

জোহান মিতুলের গলার মাফলারটা খুলে নিজের হাতে নিয়ে এলো। বললো,
“দেখছো না বাইরে কী প্রচণ্ড শীত? এই শীতের ঠান্ডা হাওয়ায় যদি আমার এত সুন্দর গলাটার কোনো ক্ষতি হয়, তাহলে বুঝতে পারছো কত বড়ো সর্বনাশ হয়ে যাবে? তোমার কোনো আইডিয়া আছে?”

জোহান মিতুলের মাফলারটা নিজের গলায় প্যাঁচাতে লাগলো।
মিতুল অনেক রেগে গেল। রাগান্বিত কণ্ঠেই বললো,
“তোমার এত সুন্দর গলা নিয়ে যদি তোমার এতই দুশ্চিন্তা, তাহলে মাফলার ছাড়া বের হয়েছো কেন? আমার গলা থেকে মাফলার খুলে কেন নিলে? আমি পারমিশন দিয়েছি তোমাকে? কেন নিজে সর্বনাশ থেকে বাঁচতে তুমি অন্য আরেক জনের মাফলার চুরি করবে?”

“শুধু তো মাফলারই চুরি করেছি। মুখ বন্ধ রাখো, নয়তো গায়ের জ্যাকেটও নিয়ে নেবো।”

মিতুল অপমান বোধ করলো। মুখের উপর এমন ভাবে ওয়ার্নিং দিলো? জোহানের সাথে যাওয়ার জন্য এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে। ও নিজের ভুল শুধরানোর জন্য আবার হোটেলে ঢোকা দিলে জোহান পিছন থেকে হাত টেনে ধরলো।
মিতুল রক্তচক্ষুতে তাকালো জোহানের দিকে।
জোহান খুবই শান্ত কণ্ঠে বললো,
“এত রাগ তোমার তুলতুল! এত রাগতে পারো তুমি? যখন তুমি রেগে তাকাও না, মনে হয় তোমার ওই চাহনিতেই খুন করে ফেলবে আমায়। মৃত্যু নামবে আমার জীবনে! আর কখনও ওভাবে অন্য কারো দিকে তাকাবে না। নয়তো মার্ডার কেসে ফাঁসবে তুমি। আমি চাই না তুমি অন্য কাউকে খুন করার অপরাধে শাস্তি পাও। তোমার শাস্তি কেবল আমি লিখবো।”

জোহানের এসব ভারী ভারী কথার কোনো মানেই ধরতে পারলো না যেন মিতুলের ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক। ও শুধু ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল। ওর রক্ত চক্ষু শান্ত থেকে আরও অধিক শান্ততায় হারিয়ে গেছে। জানে না জোহানের এমন ভারী ভারী কথার মানে কী। কিন্তু কেন যেন ওর হৃদয়ের স্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। ঠিক সেদিনের মতো। মনে হচ্ছে ওর হৃদয় ওর নিয়ন্ত্রণে নেই এই মুহূর্তে।
____________

ট্যাক্সি নিয়ে পাঞ্জাবি বাজারে এসেছে ওরা। পাঞ্জাবি বাজারে আছে অনেক কিছু। এটি অনেক বৃহৎ বাজার। এখানে পাওয়া যায় বিভিন্ন ডিজাইনের পোশাক, গয়না, জুতো, চুড়ি, ব্যাগ, শিশুদের জামাকাপড়, আরও অনেক কিছু। পাওয়া যায় বিয়ের আনুষঙ্গিক পোশাক-আশাকও। খাদ্য ও মুদি দ্রব্যাদিও আছে এখানে। সাউথ এশিয়ান খাবার রান্না করতে যা যা প্রয়োজন, তা সবই আছে এই বাজারে।
এই বাজারটি জোহানের পরিচিত নয়। আগে কখনো আসেনি। তাই মিতুলকে সবকিছু ঘুরিয়ে দেখাতে একটু বেগ পেতে হলো।
ইতোমধ্যে এই পাঞ্জাবি বাজার ঘুরে জোহান মিতুলকে শপিংও করে দিয়েছে। একটা সাইড ব্যাগ এবং একটি লেহেঙ্গা। লেহেঙ্গাটির দাম অনেক। মিতুল কিছুতেই জোহানকে এর দাম পরিশোধ করতে দিতে চায়নি। কিন্তু জোহান ওর কথা শুনলো না। মিতুলের এই ব্যাপারটি একদম ভালো লাগেনি। কানাডা ঘুরতে এসে নিজের টাকা ব্যয় করে সবকিছু কিনবে, তা নয়, সবাই ওকে গিফটের উপর রাখছে।

ওরা এখন গহনার দোকানে। এখানে অনেক সুন্দর সুন্দর ডিজাইনের নেকলেস, চুড়ি আছে। মিতুলের মনে পড়লো কার্লকে তো শাড়ি পরে দেখাবে ও। শাড়ির সাথে চুড়ি না পরলে কেমন হবে? শাড়ির সাথে চুড়ি পরলে ভালো লাগবে। মিতুল চুড়ির দিকে এগিয়ে গেল। বিভিন্ন প্রকার চুড়ি আছে এখানে। মিতুল নেভি ব্লু কালারের এক গোছা রেশমী চুড়ি হাতে পরলো। দেখতে চাইছে হাতে কেমন লাগে।

জোহান নেকলেসের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। মিতুলকে হাতে চুড়ি পরতে দেখে ওর কাছে এগিয়ে এলো। মিতুলের চুড়ি পরা হাতটা টেনে নিলো। চুড়ি দেখে ওর কপাল কুঁচকে গেছে।
“এগুলো কী?”

মিতুল অবাক হয়ে বললো,
“চুড়ি চেনো না তুমি?”

“চুইইরি?” জোহান মনে করার চেষ্টা করলো। মনেও পড়লো। বললো,
“ওহ, ইয়াহ। আমি চিনি এটা। বাংলাদেশে দেখেছিলাম।”

“শুধু বাংলাদেশে দেখেছো? রেশমী আন্টির হাতে কখনো দেখোনি?”

“মম? দেখেছিলাম হয়তো। মনে নেই আমার।” বলতে বলতে লাল রঙের চুড়ি হাতে তুলে নিলো জোহান। মিতুলের বাম হাতে চুড়ি পরা। ডান হাত শূণ্য। জোহান মিতুলের শূণ্য হাতটা লাল চুড়িতে পরিপূর্ণ করলো। মিতুলের ডান হাতটা ধরে খানিক সময় তাকিয়ে থেকে বললো,
“এই দুটো কালারই নাও।”

জোহান মিতুলকে লাল চুড়ি নিতে বললো কারণ, ও যে লেহেঙ্গা কিনে দিয়েছে তার রংও লাল। লেহেঙ্গার সাথে পরার জন্যই এটা নিতে বললো ওকে।
মিতুল দুই রঙের চুড়িই নিলো। তবে চুড়ির দামও পরিশোধ করলো জোহান। মিতুলের কেন যেন জোহানের মূল্য পরিশোধের ব্যাপারটা খারাপ লাগলো না আর।

পাঞ্জাবি বাজার থেকে ফেরার সময় হঠাৎ স্নো ফল শুরু হলো। ওরা ট্যাক্সিতে ছিল। জোহান ট্যাক্সি থামাতে বললো। মিতুলকে নিয়ে নেমে পড়লো ট্যাক্সি থেকে।
ট্যাক্সি ওদের রেখে চলে গেল।
মিতুল রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে এক হাতে শপিং ব্যাগ ধরে অন্যহাত বাড়িয়ে দিলো স্নো ফল ছোঁয়ার লোভে। রাশি রাশি বরফ কুচি উড়ে পড়ছে। পরনের শীত বস্ত্রকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। মাথার চুলেও নিজেদের জায়গা করছে চুপি চুপি।
জোহান মিতুলের থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়ানো ছিল। এবার মিতুলের কাছে এগিয়ে এলো সেলফি তুলতে। এক ফ্রেমে দুজনের সেলফি তুলবে ও। মিতুলকে হাসতে বললো। মিতুল হাসতেই দুজনের এক সাথে একটা সেলফি তুলে ফেললো। এটাই জোহানের সাথে মিতুলের প্রথম ছবি।
জোহানের সেলফি তোলা হলে মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো। এবার মিতুলের থেকে নেওয়া মাফলারটা গলা থেকে খুলে মিতুলের আরও কাছাকাছি এগিয়ে এলো। মিতুল বিমূঢ় চোখে তাকিয়ে রইল জোহানের দিকে।
জোহান মিতুলের খুব কাছে এসে মাফলারটা পরাতে লাগলো মিতুলের গলায়।
জোহান খুব কাছে থাকায় জোহানের উষ্ণ নিঃশ্বাস এসে মিতুলের মুখে পড়ছে। মিতুলের কেন জানি মনে হচ্ছে ও শ্বাস নিতে পারছে না। ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে। জোহানের একেকটা নিঃশ্বাস ওর নিঃশ্বাস আটকে দিচ্ছে।

মাফলারটা পরিয়ে দিয়ে জোহান সরে এলো মিতুলের কাছ থেকে। ধীরে পা ফেলে হাঁটতে লাগলো সামনের দিকে।
রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো জ্বলছে। খুবই শান্ত আলোর স্নিগ্ধ পরশ বুলাচ্ছে তুষারপাতের সাথে। তুষারপাত এই কালো রঙের রাতটাকে নিজের রঙে রাঙিয়ে ক্রমশ সাদা কালো করে তুলছে প্রকৃতি। রাস্তা থেকে গাড়ি আসা যাওয়া করছে। রাস্তার দুই পাশের শপ, রেঁস্তোরাগুলোয় আলো জ্বলছে। জোহান হেঁটে মিতুলের থেকে কিছুটা দূরত্বে এসে দাঁড়ালো।
মিতুল পিছনে দাঁড়িয়ে জোহানের কণ্ঠ শুনতে পেল,
“তুমি এত বোকা কেন মিতুল? এত বোকা কেন? এতটাই বোকা যে, তুমি নিজেকেই নিজে বোঝো না। এত বোকা হয় কেউ?”

জোহানের কথা শুনে মিতুলের হৃদয় অস্বাভাবিক গতিতে কাঁপতে লাগলো। হৃদয়ের এমন কাঁপন সত্যিই ভয়াবহ। এটা ভালো কিছুর ইঙ্গিত করে না। যার ইঙ্গিত করে তা অপ্রত্যাশিত। মিতুল পিছন থেকে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
“কী বোঝাতে চাইছো তুমি?”

জোহান মিতুলের দিকে ফিরে তাকালো। বললো,
“তুমি নিজেকে বোঝো না। তোমার মন কী চায়, কী না চায়, এসব কিছুই বোঝো না তুমি। তুমি শুধু ঠুনকো জিনিসের পিছনে দৌঁড়াও। তুমি বোঝো না নিজেকে, বোঝো না তোমার মনকে। তোমার মন কী চায় তা জানো না তুমি। আমি জানি। তোমার মন কী চায় আমি ভালো করেই জানি সেটা।”

জোহানের এমন কথা শুনে হৃদয়ের সাথে সাথে সমস্ত শরীরও যেন এবার কাঁপছে মিতুলের। ও দুর্বল হয়ে পড়ছে। হাত থেকে ব্যাগ পড়ে যেতে চাইছে। ও সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরলো ব্যাগ দুটো। ওর শ্বাস ভারী। মস্তিষ্কে চাপ। আশেপাশে কী ঘটছে, না ঘটছে সেদিকে ওর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ওর ফোকাস শুধু জোহান। মিতুল আগের মতোই কাঁপা কণ্ঠে জানতে চাইলো,
“কী চায় আমার মন?”
মিতুলের মনে উদ্দীপনার ঝড় বইছে। কী চায় ওর মন? কী বলবে জোহান?

“তোমার মন…” বলতে গিয়েও আবার থেমে গেল জোহান।

মিতুল তীব্র আক্ষেপ নিয়ে তাকিয়ে আছে জোহানের দিকে। ও জানে না ওর মন কী চায়। সত্যিই জানে না। কিন্তু ও জানতে চায়। ও জানতে চায় ওর মনের কী চাওয়া। ও জানতে চায় ওর মন আসলে ঠিক কী চায়?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here