চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা #পর্ব: ৩৬,৩৭

0
827

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#পর্ব: ৩৬,৩৭
#লেখা: ইফরাত মিলি

_৩৬___________

হলরুমে সবাই উপস্থিত। রেশমী, সাদাত আহমেদ, জায়িন, ক্যামিলা সবাই। রাবার্তা নেই। নিজ বাড়িতে গিয়েছে সন্ধ্যা নাগাদ। রেশমীর সামনে নত মুখে দাঁড়িয়ে আছে জোহান। সাদাত কিছুটা ওদিকে সরে দাঁড়ানো। জায়িনও কিছুটা দূরে। এর মাঝে সবাই চুপ, কেবল রেশমী উচ্চ গলায় কথা শোনাচ্ছে জোহানকে। তার মেজাজ অতিরিক্ত খারাপ। আজকে আবার মারামারি করেছে জোহান। তাও আবার জনবহুল স্থানে। ভাগ্যিস ক্লাবে একজন পরিচিত ব্যক্তি মারামারিটা গুরুতর হওয়ার আগেই ইনফর্ম করেছিল তার কাছে। ক্লাবে মারামারির খবরটা পেয়েই ক্লাবে গিয়ে ক্যামিলা নিয়ে এসেছে জোহানকে। নয়তো এই মারামারির জন্য আজকে পুলিশ স্টেশন পর্যন্ত যেতে হতো। ছেলেটা দিনকে দিন এত উগ্র হয়ে যাচ্ছে যে তার ধৈর্যের বাধ ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে।

মিতুল এখনও সিঁড়ির বাকি ধাপগুলো অতিক্রম করে হলরুমে পা ফেলেনি। সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে আছে। চোখ জোড়াতে ভয়, আতঙ্ক ছেয়ে আছে। আর সেই সাথে মায়ার আনাগোনা। মায়া হচ্ছে ওর জোহানের জন্য। জোহানের মার খাওয়া চেহারা দেখে কষ্ট হচ্ছে ওর। বুকে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। কেন যেন সহ্যই করতে পারছে না। এতক্ষণ জোহানের চেহারাতেই ডুবে ছিল মিতুল। রেশমী আন্টির তির্যক কণ্ঠে জাগতিক হুঁশে ফিরে এলো এবার।

রেশমী আন্টি জোহানকে তিরিক্ষি, ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলছেন,
“তুমি কি শপথ নিয়েছো যে তুমি জীবনেও শুধরাবে না, সারাজীবন উশৃঙ্খল আর উগ্রই থাকবে? আর কত? আর কতবার এমন করবে তুমি? বার বার নিষেধ করেছি তোমায়। তোমাকে বলেছিলাম না ওরা যত যাই করুক না কেন তুমি চুপ থাকবে সব সময়? ওরা মারলে চুপচাপ হজম করবে সেটা? তাহলে ওরা নিজেরাই এক সময় অতিষ্ঠ হয়ে তোমায় বিরক্ত করা বন্ধ করে দেবে। তুমি…”

“তাই মম? এটাই বলেছিলে তুমি আমাকে?”
জোহান মমের কথার মাঝেই কথা বলে উঠলো। নিচু করে রাখা মাথা তুলে মমের দিকে তাকালো সরাসরি।

“নয়তো কী বলেছিলাম? বার বার এটাই বুঝিয়েছি তোমাকে। কিন্তু না, তোমাকে এটা বুঝিয়ে বলেও কোনো লাভ হলো না। তুমি শোনোনি আমার কথা। তুমি তো কথা শোনার ছেলে নও। তুমিও ওদের সাথে তাল মিলিয়ে পাল্টা আক্রমণ করে বেড়াচ্ছ ওদের। তুমি নিজেই একবার ভেবে দেখো জোহান, কতটা উশৃঙ্খল জীবনযাপন করছো তুমি। তোমার এই মারামারির ঝামেলার জন্য পুলিশ স্টেশন পর্যন্ত নিয়ে গেছো তুমি আমাদের। বলো, এত উগ্র, বাজে কেন হয়েছো তুমি? তোমার এমন উশৃঙ্খলতার জন্য একদিন লোকের কাছেই মুখ দেখানো দায় হয়ে পড়বে আমাদের!”

জোহান ম্লান হাসলো। ওর দৃষ্টি এখনও মমের উপর নিবদ্ধ। লাল হয়ে থাকা চোখ দুটোতে হঠাৎ পানি এসে ভীড় জমালো ওর। বললো,
“আমার এমন জীবন-যাপন করার জন্য তুমি নিজেই কি দায়ী নও মম? উগ্র! বাজে! আমি তো এমন ছিলাম না মম। হয়ে গেছি হঠাৎ করে। নিজ ইচ্ছাতেই হয়ে গিয়েছি।”
বিরতি নিলো জোহান। তারপর বললো,
“…’আমি চুপ থাকলে ওরা এক সময় অতিষ্ঠ হয়ে আমাকে বিরক্ত করা বন্ধ করে দেবে’ হ্যাঁ, এই কথা তুমি বলেছিলে আমায়। কিন্তু সেটা আগের কথা ছিল তোমার। এরপর তো অন্য কিছু বলেছিলে তুমি। তোমার এর পরের কথা ছিল,
“…’নিজের ঝামেলা নিজে মেটাতে পারো না তুমি? তোমার এই ঝামেলা নিয়ে বসে থাকার মতো সময় আমার হাতে নেই। ওরা তোমাকে মারে, তুমি পারো কী? এরপর আর কোনো কমপ্লেইন করবে না আমার কাছে। নিজেরটা নিজে বুঝে নাও’। এটাই তো বলেছিলে তুমি।”

রেশমী ছেলের কথা শুনে বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে গেল। নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। তার ছেলে এগারো বছর আগে তার বলা কথাকে হুবহু অনুকরণ করেছে। এগারো বছর আগে ছেলেকে এই কথাগুলো বলেছিল সে। জোহান এই কথাগুলো এগারো বছর ধরে ঠিকঠাক মনে রেখেছে!

“তোমার ওই কথার জন্যই আমি পাল্টে গিয়েছি মম। অন্যরকম হয়ে গিয়েছি আমি। আগের জোহানের থেকে পুরো ভিন্ন। আগের জোহান কেমন ছিল? শান্ত, নম্র, ভদ্র। সব সময় নীরব শান্তশিষ্ট থাকতো। কারো দিকে তাকিয়ে কথা বলতেও শত বার ভাবতো।
আর আজকের জোহান? তোমার ওই কথার জন্যই আগের সেই শান্ত, নীরব জোহানের থেকে আজকের এই জোহান সৃষ্টি হয়েছে। তোমার ওই কথার পর থেকেই বেশ চঞ্চল হয়ে উঠেছি আমি। তোমাদের ভাষায় ‘উগ্র এবং উশৃঙ্খল’!
ঠিক আছে মম, তোমার পরের কথা না হয় বাদ দিলাম। আগের কথাটাই ধরি। আমি চুপ থাকলে ওরা আমাকে বিরক্ত করা বন্ধ করে দেবে। হ্যাঁ চুপই তো ছিলাম আমি। দিনের পর দিন মার খেয়েও মাথা তুলে একটা কথা বলিনি ওদের। কিন্তু কী হয়েছিল তাতে? ওরা কি আমাকে মারা বন্ধ করে দিয়েছিল? না। বরং আরও সুযোগ পেয়ে বসেছিল। আর সুযোগটা মূলত তুমিই সৃষ্টি করে দিয়েছিলে। প্রথম প্রথম যখন আমি তোমাকে এসে বলেছিলাম, স্কুলের কিছু ছেলেরা বাজে বিহেভ করে আমার সাথে। তখন তুমি গ্রাহ্য করলে না সেসব। বললে, ‘ওরকম হতেই পারে। মানিয়ে নাও।’
ধীরে ধীরে যখন ওরা আরও বাজে হয়ে উঠলো। মারলো আমাকে। তখন বললে, ‘দুই একটা চড়-থাপ্পড়ে কী হয়? চুপচাপ মার খাও। তোমার নীরবতা দেখে বিরক্ত হয়ে ওরা নিজেরাই চলে যাবে।’
বেশ, তোমার কথা মতো থাকলাম আমি চুপ। নিয়ম করে চুপ থাকলাম, নিয়ম করে মার খেলাম, অপদস্থ হলাম, আর নিয়ম করে তোমার কাছে কমপ্লেইন জানাতে থাকলাম। আর তুমিও নিয়ম করে তোমার ধরা বাঁধা কথাগুলো শোনাতে লাগলে বিরক্ত কণ্ঠে।”
এই পর্যন্ত বলে থামলো জোহান।

মিতুলের মাথায় সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কী শুনছে এসব?

জোহান আবার বলতে শুরু করলো,
“একটা বাচ্চা স্কুল বুলিংয়ের স্বীকার হলে তার পাশে সবার আগে কে থাকে? তার পরিবার থাকে। তুমি কি আমার পাশে ছিলে মম? তুমি সব কিছু জানার পরেও কি কোনো দিন জানতে চেয়েছিলে আমার স্কুলে থাকাকালীন সময়গুলো কীভাবে পার হয়? তুমি কি কোনো দিন বুঝতে চেষ্টা করেছিলে আমার মানসিক অবস্থা? তুমি কি কখনো একটু খোঁজ নিয়েছিলে, আমি ভালো আছি কি না? বুলিংয়ের জন্য তুমি কি কোনো দিন স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেছিলে? কোনো টিচারের সাথে কথা বলেছিলে এ ব্যাপারে? আমি ছোটো হয়েও এটা বুঝতাম যে, স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে এটা জানানো উচিত। বার বার তোমাকে অভিযোগ করতে বলতাম আমার স্কুলে। এই প্রব্লেমটা সলভ করে দিতে বলতাম তোমাকে। কিন্তু তুমি কিছুই করোনি! কিছু করবে কীভাবে, তুমি তো আমার সাথে হওয়া বুলিংয়ের ব্যাপারটাকে কোনো দিন গুরুত্বই দাওনি! এমনকি এ ব্যাপারে আমার ড্যাডকে জানাতেও নিষেধ করে দিয়েছো আমায়। ড্যাড তো অফিস নিয়েই ব্যস্ত থাকতো সারাদিন। খুব কমই সে অবসর সময় কাটাতো। রাতে ড্যাড বাড়িতে ফিরতো। আর তুমি বিকেলেই নিষেধ করে দিতে যেন ড্যাডের কানে আমার স্কুল সম্পর্কিত কিছুই না পৌঁছায়। আমিও বলতাম না কিছু ড্যাডকে। চাইতাম না ড্যাড সারাদিন কাজ করে এসে আবার এই বিষয় নিয়ে চিন্তা করুক। ড্যাড আমার মুখে আঘাতের চিহ্ন দেখে কিছু জিজ্ঞেস করলে নানা ভাবে মিথ্যা বলে আমি কাটিয়ে নিতাম ব্যাপারটা। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, আমি চাইতাম না আমার এই ব্যাপারটা ড্যাড সলভ করুক। আমি সবসময় সব কিছুতে তোমাকে আমার পাশে চাইতাম। চেয়েছিলাম তুমি সলভ করো এই ব্যাপারটা। কিন্তু তুমি বড্ড উদাসী ছিলে আমার প্রতি। আমার কোনো কিছুতেই আগ্রহ দেখাতে না তুমি। গ্রাহ্য করতে না! আমি বলেছিলাম যদি আমার স্কুলে এই ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা না করো, তবে অন্য একটা স্কুলে ট্রান্সফার করো আমায়। তুমি সেটাও করোনি। তুমি ছোটোবেলা থেকেই খুব উদাসী ছিলে আমার প্রতি! কেন মম? কেন এরকম করতে তুমি আমার সাথে?”

জায়িনের আর সহ্য হলো না জোহানের এসব। ও বিরক্ত হয়ে এগিয়ে এলো জোহানের কাছে। বললো,
“এনাফ জোহান। যথেষ্ট বলেছিস। অভদ্রতা বাইরে গিয়ে দেখা। মমের সাথে এমন উচ্চ গলায় কথা বলার অধিকার কে দিয়েছে তোকে?”

হঠাৎ করে ওর এবং মমের মাঝে জায়িনের আগমন জোহানেরও সহ্য হলো না। ও প্রায় গর্জে উঠে বললো,
“তুমি চুপ করো ব্রাদার! আমি আমার মমের সাথে কথা বলছি। এমন একটা ভাব করো না যেন, মম শুধু তোমার একার!”

রেশমী এতক্ষণে কথা বলে উঠলো।
“বড়ো ভাইয়ের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় জানো না সেটা? সেটাও কি ভুলে গেছো তুমি?”

জোহান বললো,
“বাহ, মম! ব্রাদারকে এইটুকু বললাম দেখেই তোমার গায়ে লেগে গেল? আর আমি? ব্রাদার যখন আমায় কিছু বলে তখন তো তুমি কিছু বলো না! যেন কিছু শুনতেই পাও না তখন।”

রেশমী ক্ষুব্ধ গলায় বলে উঠলেন,
“জোহান, ইউ ডোন্ট ক্রস ইওর লিমিট।”

“কী করবো মম? আমি মানুষটাই যে এমন। কিছু বললেই লিমিট ক্রস হয়ে যায়!”

রেশমী স্বামীর দিকে তাকালেন।
“দেখলে সাদাত, তোমার ছোটো ছেলে কীভাবে কথা বলছে আমার সাথে? এরপরও কি তুমি বলবে তোমার ছেলে খারাপ হয়ে যায়নি?”
রেশমী স্বামীর থেকে উত্তরের আশায় বসে থাকলেন না। জোহানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“সত্যি সত্যি জঘন্য হয়ে গেছো তুমি। ছি! ভাবতে পারিনি এতটা অধঃপতন হবে তোমার।”

জোহান চিৎকার করে বলে উঠলো,
“হ্যাঁ, আমি জঘন্য। আর এভাবেই ভালো আছি আমি। স্বস্তি অনুভব করছি। যখন আমি ভালো ছিলাম তখন তো তুমি ফিরে তাকাওনি। তাই জঘন্য হয়ে নিজের ভালো থাকার রাস্তাটা খুঁজে নিয়েছে আমি। সারাজীবন এ রাস্তাতেই চলবো আমি।”

রেশমী আক্রোশ নিয়ে তাকিয়ে আছে। জোহানের সাথে কথা বাড়াতেও ঘৃণা হচ্ছে তার।

“ছোটো বেলা থেকেই দেখে এসেছি তুমি ব্রাদারের প্রতি যত্নশীল, আর আমার প্রতি উদাস। আমাকে ঘিরে তোমার যা আছে তা সবই উদাসীনতা, আর কিছুই নয়। তুমি ব্রাদারকে প্রচণ্ড ভালোবাসো, অথচ আমার প্রতি তোমার ভালোবাসার ব্যাপক ঘাটতি।”

রেশমী রাগে চিৎকার করে উঠলেন,
“শাট আপ জোহান! বেয়াদবির একটা সীমা আছে। মুখ বন্ধ করো এখন।”

জোহানও ফের চিৎকার করে উঠলো,
“না, করবো না। বলো কেন? কেন তুমি আমার প্রতি এত উদাস? ব্রাদারকে তুমি এত ভালোবাসো, অথচ আমার দিকে তাকানোরও যেন সময় হয় না তোমার। ব্রাদার বড়ো হয়ে গেছে তারপরও তুমি এখনও ব্রাদারকে যত্ন করে খাইয়ে দাও। আর আমার মনেও পড়ে না ছোটো বেলায় তুমি শেষবার কবে খাইয়ে দিয়েছিলে আমায়। কেন মম? কেন? কেন তুমি আমার প্রতি এত কেয়ারলেস? কেন তুমি ভালোবাসো না আমাকে? আমি কি তোমার আসল ছেলে নই?”

জোহান কথা শেষ করতে না করতেই একটা ভারী হাতের থাপ্পড়ে ওর মুখ হেলে গেল।

সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আঁতকে উঠলো মিতুল। জেগে জেগে কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখছে না কি ও?

জোহান মুখ তুলে তাকালো।
জায়িনের রাগে রক্তিম হয়ে যাওয়া মুখ ফুঁটে ওঠে জোহানের জল থলথলে চোখে। ইতোমধ্যে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছে ওর চোখ থেকে। জোহান তীব্র রাগ, অভিমান নিয়ে বললো,
“আমার গায়ে হাত তোলার অধিকার শুধু আমার ড্যাডের। আর কারো নেই। না তোমার আছে ব্রাদার, আর না মমের।” বলতে বলতে জোহান একবার মমের দিকে তাকালো। তারপর দ্রুত পা ফেলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

রেশমী স্বামীর দিকে তাকালেন। বললেন,
“দেখেছো সাদাত, তোমার ছেলে কতটা উশৃঙ্খল হয়ে গেছে!”
বলে রেশমীও রুমে যাওয়ার জন্য সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। মিতুলের পাশ কাটিয়ে উপরে চলে গেলেন তিনি।
সাদাতও রাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। দাঁড়িয়ে রইল মিতুল, জায়িন এবং ক্যামিলা। মিতুল কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। কী থেকে কী ঘটলো আজকে! রেশমী আন্টি, জোহান… মিতুল ঘরের প্রবেশ দরজার দিকে তাকালো। অস্থির লাগছে ওর। বার বার ঢোক গিলছে। কোথায় বেরিয়ে গেল জোহান? মিতুল সিঁড়ি বেয়ে হলরুমে নামলো। দরজার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। জোহানের জন্য কষ্ট হচ্ছে ওর। হৃদয় কষ্টে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। কোথায় গেছে জোহান? মনে হচ্ছে টাইম হাউজে গেছে। মিতুল জোহানের কাছে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে এগোতে লাগলো। দরজার কাছাকাছি আসতেই পিছন থেকে জায়িনের কণ্ঠ শুনতে পেল,
“ওর কাছে যাওয়ার দরকার নেই। নিজের রাগ, জেদ নিয়ে ওর টাইম হাউজেই পড়ে থাকুক ও।”

জায়িনের কথা কানে আসতেই দাঁড়িয়ে পড়লো মিতুল। জায়িনের প্রতি হঠাৎ ঘৃণা হলো ওর। নিজের ছোটো ভাইয়ের গায়ে হাত তুলেছে! ছোটো ভাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। আর সে এখনও এরকম কথা বলছে? কেমন মানুষ জায়িন? মিতুল শুনলো না জায়িনের কথা। দ্রুত বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

(চলবে)

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#পর্ব: ৩৭
#লেখা: ইফরাত মিলি

____________

আজকে এই রাতের বেলা জঙ্গল পেরিয়ে জোহানের টাইম হাউজে আসতে মিতুলের ভয় করেনি। ভয় যে কী জিনিস সেটাই ওর খেয়ালে ছিল না। ওর মস্তিষ্ক জুড়ে ছিল কেবল জোহান। টাইম হাউজের দরজা খোলাই পেল এসে। মিতুল ভিতরে প্রবেশ করলো। ওর পদধ্বনির চাপা শব্দ হলো ফ্লোর জুড়ে। বাতাসের সাথে ফ্রিসিয়াস ফুলের মিষ্টি সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। ফ্রিসিয়াস ফুলগুলো যে জানালার কাছে রাখা, সেই জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে জোহান। মুখ সম্পূর্ন জানালার দিকে ঘোরানো। দেখতে পাচ্ছে না মিতুল। জোহানের চোখ থেকে যে অনর্গল জলের ধারা নামছে নীরবে, তা দৃষ্টির অগোচরে ওর। মিতুল বুঝতে পারছে না প্রথমে কী বলবে জোহানকে। কী বলে সান্ত্বনা দেবে। দ্বিধায় ভুগছে ও। মিতুল যখন কিছু বলবে বলবে করেও বলে উঠতে পারছিল না, তখন জোহানকেই বলতে শুনলো,
“আমার এখানে এই টাইম হাউজ উঠানোর কারণটা আমি তোমাকে বলিনি মিতুল।”

মিতুল চোখ তুলে তাকালো। জোহানের মুখ জানালার দিকেই ঘোরানো এখনও। জোহান ওর দিকে না তাকিয়েই বলতে লাগলো,
“এই ঘরটা আমার তেরো তম জন্মদিনের উপহার ছিল। পেয়েছিলাম পনেরো তম জন্মদিনে। পনেরো তম জন্মদিনে প্রথম পা রেখেছিলাম এই ঘরে।
আমার জন্মদিনে সবাই আগে থেকেই আমার জন্য গিফট কিনে রাখতো। শুধু আমার ড্যাড কিনতো না। ড্যাড আমাকে জিজ্ঞেস করে নিতো আগে। কেক কাটার সময় বলতো, ‘জোহান, কী চাই তোমার?’।
আমি সব সময় একটা উত্তরই দিতাম, ‘মম’স লাভ’। মমের ভালোবাসাই একমাত্র চাওয়া ছিল আমার। কিন্তু তেরো বছর থেকে আমার সেই চাওয়া পাল্টে যায়। আমার চাওয়াগুলো হয়ে ওঠে বিলাসবহুল। কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার প্রতি মমের ভালোবাসা খুবই ঠুনকো। ওটা কোনোদিন গাঢ় হবে না আর। আমি যতই চাই না কেন মম আমায় বেশি ভালোবাসুক, সে বাসবে না। কারণ, আমার মমের ভালোবাসার বিস্তর জায়গা জুড়েই আমার ব্রাদার বিরাজ করে। মম যে আমায় ভালোবাসে না সেটা নয়। ভালোবাসে আমায়। তবে সেটা খুবই কম। আমার ব্রাদারকে যদি দশ পার্সেন্ট ভালোবাসে, তাহলে আমাকে ভালোবাসার পরিমাণটা বোধহয় সেখানে দুই কী তিন। এর বেশি নয়। যেটা আমার কাছে খুবই তুচ্ছ। এত তুচ্ছ ভালোবাসায় আমার মন ভরছিল না। আমি চাইতাম আমার প্রতি মমের এই তুচ্ছ ভালোবাসা আরও কিছুটা গাঢ় হোক। কিন্তু হচ্ছিল না। বুঝতে পেরেছিলাম আর হবেও না। তাই এই ঠুনকো ভালোবাসার প্রতি ছোটা বন্ধ করলাম। পরিবর্তন করে ফেললাম আমার চাওয়া-পাওয়া সব কিছু। তেরো তম জন্মদিনে আমি প্রথম আমার চাওয়ায় ভিন্নতা এনেছিলাম। ড্যাড যখন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী চাই তোমার?’, আমি প্রথম মমের ভালোবাসা না চেয়ে অন্য কিছু চেয়েছিলাম। দৃঢ়তার সাথে বলেছিলাম, ‘অ্যা হাউজ!’।”
জোহান একটু থামলো।
তারপর আবার বলতে লাগলো,
“ওই দিনটায় কী ছিল আমি জানি না। কোনো এক অদম্য শক্তি লুকানো ছিল বোধহয় দিনটায়। যা আমাকে ওই দিনের পর থেকে পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে। আর ওই অদম্য শক্তিটা মূলত আমার মমের কথাতেই জড়িয়ে ছিল। ওই দিন আমার তেরো তম জন্মদিনের আগের দিন ছিল। স্কুল থেকে ফেরার পথে আমার চারজন সহপাঠী…মানে ওই চারজন। যারা একদিন রাস্তায় আমাদের গাড়ি আটকে ছিল। সাথে তুমি ছিলে। তোমার সামনে রাস্তায় মেরেছিল আমাকে। ওদের ব্যাপারে তোমায় সত্যিটা আগে বলিনি আমি। কেন মেরেছে, কারা ওরা, কিছুই না। বলেছিলাম আমি হ্যান্ডসাম বলে হিংসা করে মারে ওরা। মজা করে বলেছিলাম ওটা। ওরা হিংসা করে নয়। আমাকে মেরে মনে তৃপ্তি, আনন্দ পায় বলে মারে। আমাকে মেরে, হেনস্থা করে ওদের মনে তৃপ্তি, মজার এই ঘনঘটার প্রথম সৃষ্টি হয় স্কুল জীবন থেকে। যেটা এখনও রয়ে গেছে ওদের মাঝে। শুধু পার্থক্য হয়েছে এটাই যে, আগে ওরা মারতো, আর আমি চুপচাপ মার খেতাম। আর এখন মার খেয়ে সাথে সাথে ওদের মার দেওয়ারও ব্যবস্থা করি।
তো সেদিন স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে ওরা জোর করে একটা নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল আমায়। মেরেছিল খুব। ওই দিনের মারটাই সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণাদায়ক ছিল। সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছিল। তবুও ওদের কিছুই বললাম না। শুধু হৃদয়ে দহন হচ্ছিল। মমের জন্য। কারণ, মম বিষয়টা জানার পরও আমার জন্য কিছুই করছিল না। মার খেয়ে বাড়ি ফিরলাম। নোজ ব্লিডিং হচ্ছিল। এমতা অবস্থায়ই মমের কাছে গেলাম। মম তখন বারান্দায় ছিল। ভীষণ রেগে ছিলাম সেদিন আমি। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। মমের কাছে গিয়েই পিঠের ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেললাম ফ্লোরে। মম দাঁড়িয়ে যায়। আমি সেদিন কোনো দিক কোনো কিছু বিবেচনা না করেই মমকে চেঁচিয়ে বলেছিলাম,
‘আমি আর সহ্য করতে পারছি না মম। প্লিজ! কিছু করো। এরকম চলতে থাকলে একসময় আমি মারা যাব। প্লিজ কিছু করো। কথা বলো আমার স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। কথা বলো ওদের অভিবাবকদের সাথে। প্লিজ মম! ডু সামথিং। যদি এগুলো না পারো তবে আমাকে অন্য স্কুলে ট্রান্সফার করো। প্লিজ মম!’
মম শোনেনি আমার কথা। মম বুঝতে পারেনি আমার কষ্ট। সে তীব্র বিরক্ত, রাগ নিয়ে বলেছিল, আমার এই ঝামেলা নিয়ে বসে থাকার মতো সময় তার হাতে নেই। এরপর আর কোনো কমপ্লেইন যেন না করি তার কাছে। আমার নিজেরটা নিজেকেই সামলে নিতে বলেছিল মম। মমের ওই কথাগুলো আমার পাল্টে যাওয়ার চাবিকাঠি ছিল। ওইদিন আরও অনেক কথা কাটাকাটি হলো মমের সাথে। ড্যাড সেদিন বাড়িতে ছিল। সব জানলো সে। মম এবং ড্যাডের মাঝে তর্কাতর্কি হলো খুব। ড্যাড সিদ্ধান্ত নিলো আমাকে অন্য স্কুলে ভর্তি করাবে। কিন্তু ড্যাড যতক্ষণে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তার অনেক আগে আমার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ওই স্কুলেই থাকবো আমি। যারা আমার সাথে অমন করে তাদের সাথে টেক্কা দিয়ে ওই স্কুলেই টিকে থাকবো আমি। ঠিক তাই করলাম। মাথা উঁচু করেই দাঁড়ালাম ওদের সামনে। আগে আমি এমন ছিলাম না মিতুল। একাকী স্বভাবের ছিলাম। কারো সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারিনি। আলাভোলা বাচ্চা টাইপ ছিলাম আমি। ভীতু প্রকৃতির ছিলাম। মূলত মমের কারণেই অমন ছিলাম আমি। চোখের সামনে মমকে দেখতাম সে ব্রাদারকে আদর করছে, যত্ন করছে, খাইয়ে দিচ্ছে। অথচ আমি? আমার প্রতি তার ভীষণ উদাসীনতা। আমাকে দেখভাল করার সময় হতো না তার। এমন হওয়ার কারণেই আমি মানসিক ভাবে ভীষণ বিষাদগ্রস্ত ছিলাম। আশেপাশের কোনো কিছুতেই মনোযোগ ধরে রাখতে পারতাম না। আমার মাথায় শুধু ঘুরতো মম। মম আমাকে ভালোবাসে না। এসবের সাথে আবার যোগ হয়েছিল স্কুল বুলিং। সবকিছু মিলিয়ে মানসিক ভাবে আরও বেশি ভেঙে পড়েছিলাম আমি।
কিন্তু ওইদিনের পর থেকে অন্যরকম হয়ে গেছি। আগে বাসা থেকে স্কুলে যাওয়ার জন্য বাইরে পা রাখতেই ভয় ঘিরে ধরতো আমাকে। কিন্তু ওই দিনের পর থেকে এক উদ্যমী মন নিয়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিলাম। ভয় লাগতো না কোনো কিছুতে। আমি ধীরে ধীরে স্কুলের অনেকের সাথে বন্ধুত্ব গড়তে লাগলাম। এর মাঝে আমার অন্যতম প্রিয় বন্ধু হচ্ছে রিকার্ডো। রিকার্ডো অনেক আগে থেকেই আমার সাথে ভাব জমাতে চাইতো, কথা বলতে চাইতো। কিন্তু আমিই ওর সাথে মিশতে পারতাম না। তবে ওই দিনের পর আমি নিজে গিয়েই ওর সাথে ফ্রেন্ডশিপ করেছি। ও-ই ছিল আমার প্রথম বন্ধু। ওর সাথে বন্ধুত্ব করার কারণে জীবন আরও কিছুটা পাল্টে যায়। বলতে গেলে ভালো ভাবেই পাল্টে যায়। আমি ভালো থাকার রাস্তা খুঁজে পাই। ধীরে ধীরে আরও অনেক বন্ধু হয় আমার। বন্ধুরা সব সময় পাশে ছিল আমার। এখনও আছে। ওই রাবিশগুলো আমার সাথে বেয়াদবি করলে, আমার বন্ধুরাই তা মোকাবেলা করতো। শুরু হলো আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ। সেই যে শুরু হলো তা এখন পর্যন্ত চলছে।”
বলে জোহান বড়ো করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চুপ থাকলো কয়েক সেকেন্ড। তারপর আবার বললো,
“মাঝে মাঝে আমি খুব কষ্ট অনুভব করি মিতুল। আমার কাছে সব আছে। ড্যাডের কাছে যখন যা চাই তাই পাই। আমি ইচ্ছা খুশি মতো চলাফেরা করতে পারি। ঘুরে বেড়াতে পারি যেখানে খুশি সেখানে। সব কিছুই আমার ইচ্ছা। তবুও মাঝে মাঝে ভীষণ কষ্ট অনুভব করি। প্রায়ই একটা প্রশ্ন জেগে ওঠে মনে, ‘মম কেন আমাকে ব্রাদারের মতো ভালোবাসে না?’। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি মমের আসল ছেলে নই। এডপ্ট এনেছে আমায়। কিন্তু এই ভাবনা আমি বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারি না। কারণ, আমি দেখতেই যে মমের মতো। আমি জানি মমই আমার আসল মম। আমার মম, আমার ড্যাড, আমার ব্রাদার, এরা সবাই-ই আমার আসল আপনজন। আমি মমের আপন। ব্রাদার যেমন মমের আপন, তেমনি আমিও আপন। কিন্তু তারপরও মম কেন এত কেয়ারলেস আমার প্রতি সেটা সত্যিই জানি না আমি। মম নিজেও এই ব্যাপারটা জানে কি না সন্দেহ। ছোটো বেলা থেকেই মম আমার প্রতি উদাসী। মম ব্রাদারের সব কিছু নিজ হাতে করে দিলেও আমার একটা দুটো কাজও করে দিতো না। সব মেইডদের উপর ছেড়ে দিতো।
এদিক থেকে আমার ভাগ্যটা খুব ভালো যে, আমাদের বাসার মেইডগুলো খুব ভালো ছিল। যে সময় আমি খুব ছোটো ছিলাম, সে সময় মিসেস রুবি ছিলেন আমাদের বাসার মেইড হিসেবে। তিনি খুব আদর করতেন আমায়। খেয়াল রাখতেন আমার। এরপর আমার যখন এগারো বছর বয়স, সে সময় মিসেস রুবি চলে যাওয়ার পর এলো ক্যামিলা। ক্যামিলার বয়স তখন কম ছিল। মাত্র আঠারো। ক্যামিলা খুব ভালোবাসতো আমায়। খুব কেয়ার করতো আমার। আমিও আস্তে আস্তে ক্যামিলাকে নিজের বড়ো বোনের মতো ভাবতে শুরু করি। মমের কারণে আমার মন হুটহাট করে খারাপ হয়ে গেলে ক্যামিলা এসে মন ভালো করার চেষ্টা করতো। বলতো, ‘মন খারাপ করো না। মম তোমায় ভালোবাসে না তো কী হয়েছে? আমি তো বাসি। তোমার ড্যাডও বাসে। তুমি কি জানো তোমার ড্যাড যে কোনো কিছুর থেকে তোমায় সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে?’
ক্যামিলা বার বার এটাই বোঝাতে চাইতো যে, ড্যাড আমায় খুব বেশি ভালোবাসে। আমিও জানি ড্যাড আমায় খুব ভালোবাসে। ড্যাড বোধ হয় পৃথিবীতে সবার থেকে বেশি ভালো আমাকেই বাসে। কিন্তু ড্যাডের একার ভালোবাসা নিয়ে যে আমি সন্তুষ্ট ছিলাম না। ড্যাডের ভালোবাসার পাশাপাশি মমের ভালোবাসাও চাইতাম আমি। বরং ড্যাডের ভালোবাসার থেকেও মমের ভালোবাসা বেশি করে চাইতাম। ব্রাদারের ভালোবাসাও চাইতাম আমি। কিন্তু মমের সাথে সাথে ব্রাদারের ভালোবাসাও পাইনি। মমের ভালোবাসা যা পেয়েছি, আর যা পাই, ব্রাদারের ভালোবাসা পাইনি তার তিন ভাগের এক ভাগও। বুঝতে পারি না ব্রাদারের এমন করার মানে! বুঝতে পারি না মমের এমন করার মানে! শুধু যেটুকু বুঝতে পারি সেটা হলো…”
থেমে গেল জোহান। বলতেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর। কষ্ট নিয়েই বললো,
“শুধু যেটুকু বুঝতে পারি সেটা হলো, আমি এখনও মমের ভালোবাসা পেতে চাই। আমার মন খুব গোপনে এখনও এটাই চেয়ে যাচ্ছে।”
বলতে বলতে চোখ বুজে ফেললো জোহান। পুরোনো কষ্ট যেন তরতর করে আরও বেশি বেড়ে যাচ্ছে। সে চোখ বুজে রইল খানিক ক্ষণ।
এর মাঝে পিছন থেকে চাপা কান্নার মিহি সুর ভেসে আসায় চোখ খুলে ফেললো আবার।
পিছনে তাকিয়ে দেখতে পেল ফুঁপিয়ে কাঁদছে মিতুল। ওর কান্নার চাপা সুর ধীরে ধীরে ভারী হয়ে ঘরময় ছড়িয়ে পড়লো। জোহান বললো,
“আরে, তুমি কাঁদছো কেন? আমি তো আমার কথা বললাম। কাঁদা তো উচিত আমার। তুমি কেন কাঁদছো?”

মিতুল কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“কেন বলোনি তুমি? তোমার জীবনে এত কষ্ট কেন বলোনি আগে? এত কষ্টে আছো তুমি, সেটা কেন বলোনি?”

“তোমাকে বলবো? বললে কী করতে তুমি?”

মিতুল সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলতে পারলো না। একটু সময় নিয়ে কেঁদে কেটে বললো,
“তোমার ভিতরে এত কষ্ট লুকিয়ে আছে আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি জোহান।”

“ওহ তুলতুল, কান্না থামাও। বোকা মেয়ের মতো কাঁদছো কেন? কান্না থামাও।”

মিতুল ধীরে ধীরে নিজেকে ধাতস্থ করলো। তারপর জোহানের দিকে তাকালো ভালো করে। মুখে জায়গায় জায়গায় লাল গাঢ় দাগ। দুই এক জায়গায় কেটে গেছে সামান্য।
মিতুল কিছু না বলে জোহানকে হাত ধরে এনে কাউচের উপর বসিয়ে দিলো। তারপর বেডরুমে গিয়ে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এলো। জোহানের ক্ষত স্থানগুলো পরিস্কার করতে লাগলো আস্তে আস্তে।
জোহান গভীর চোখে তাকিয়ে আছে মিতুলের দিকে। তাকিয়ে থেকে এক সময় বললো,
“আমি আঘাত পাওয়ার পর আমার মম কখনো এরকম কেয়ার করেনি আমাকে।”

জোহানের কথায় আবারও কেঁদে উঠলো মিতুল। জোহান বললো,
“আরে, তুমি আবারও কাঁদছো কেন?”

মিতুল অনেক কষ্টে নিজের কান্না সংযত করলো।
একটু সময় পর বললো,
“তুমি তো বলেছিলে তোমাকে দশ গুণ বেশি বোনাস দেবে ওরা। তোমার হাত ভাঙা হবে, পা ভাঙা হবে, সাথে আরও কী কী ভাঙা হবে তুমি জানো না। তাহলে শুধু এই একটুখানি আঘাত পেয়েছো কেন?”

জোহান অবাক হয়ে বললো,
“মানে কী তুলতুল? আমার হাত-পা ভাঙা হলে তুমি খুশি হতে?”

“ছি, কী বলছো তুমি? তোমার হাত-পা ভাঙা হলে আমি খুশি হবো কেন? আমার ভীষণ কষ্ট লাগবে।”

“তাই?”

মিতুল আর কিছু বললো না। শুধু কান্না কান্না একটা ভাব উগড়ে উঠতে লাগলো ওর মাঝে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here