সমর্পণ,দ্বিতীয় পর্ব

0
697

#সমর্পণ,দ্বিতীয় পর্ব
#মুক্তা_রায়

সারাটা দিন ঘোরের মধ্যে কেটে গেল অপুর।এক অদ্ভুত নতুন অনুভূতি।আনমনে ওই অদ্ভুত ছেলেটার কথাই শুধু ভাবছে।সাথে সকালের সেই ঘটনার কথাটা যতবার ভেবেছে লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে। © মুক্তা রায়
বিকেলে বাড়ি ফিরে চিঁড়ে ভাজতে বসেছে,শুনলো পাশেই গাজনের মাঠে ভলিবল টুর্নামেন্ট হচ্ছে।হঠাৎ মনে হল,বাপ্পা এখানে খেলতে আসেনি তো?তাড়াতাড়ি সব ভেজে তুলে দৌড়ায় মাঠের দিকে।এসে বাকি কাজগুলো সারবে।গিয়ে দেখে সত্যি তাই।সর্টস-গেঞ্জি পরে কাদা মেখে ভূত হয়ে ভলিবল খেলছে ছেলে।দারুণ খেলে!খেলা শেষ হতেই দৌড়ে এল অপুর কাছে।ঠিক দেখেছে তাকে।
– এই মেয়ে,তোমার বাড়ি এখানে?
– হ‍্যাঁ-
– তবে প্লিজ, আমাকে তোমাদের বাড়ি নিয়ে চল,একটু স্নান করব-
– চলুন-
– আরে অপু,ওকে তুই চিনিস?
পাড়ার দু’চারজন জিজ্ঞেস করল অপুকে।
– হ‍্যাঁ, আমার স‍্যারের ছেলে।ওর সম্বন্ধে শুনলে অবাক হবে, কাল বলব।
বলেই বাপ্পাকে নিয়ে বাড়িতে ঢোকে অপু।বালতিতে জল উঠিয়ে দিতে চায়,কিন্তু ছেলেটা তার হাত চেপে ধরে।
– দরকার নেই।ওটুকু পারবো।বাবুগিরি নেই আমার-
বলেই কুয়োর থেকে জল তুলে গায়ে ঢালে বাপ্পা।অপু গামছা আর সাবানটা দিয়ে সরে আসে।
একটু পরেই ছেলে ফেরে শার্টপ‍্যান্ট পরা বাবু হয়ে।অপু বাপ্পাকে একবাটি চিঁড়েভাজা ছোলাভাজা, নুন,তেল, শশা, পেঁয়াজ, আদা,লঙ্কাকুচি দিয়ে মেখে দেয়।সঙ্গে আদা দিয়ে দুধ চা।সিমেন্টের চলতা ওঠা দাওয়ায় বেঞ্চে বসে খাচ্ছে বাপ্পা। © মুক্তা রায়
– এত সুন্দর জিনিস খাইনি কখনো।দারুণ লাগছে!
– আর একটু দেবো?ঘরে ভাজা, একটু আগেই ভেজেছি-
– তুমি এগুলো তৈরি করতে পারো?
-ছোটর থেকেই করে আসছি।আমার বাবা বাসে বাসে হকারী করেন।আমি সব ভেজে দেই।বাবা সন্ধ্যায় বসে প‍্যাকেট করেন।পরদিন সকালে বাসে বাসে ফেরি করেন।এতেই সংসার চলে আমাদের।
বাপ্পা অপুর বাড়িতে ঢুকেই বুঝেছিল নিম্ন মধ‍্যবিত্ত বাড়ি।কিন্তু ওরা যে এত গরীব ধারণা করতে পারেনি।মেয়েটাকে কত কষ্ট করতে হয়!তাই নিয়েও ইংরেজি অনার্স পড়ছে!শ্রদ্ধায়-বিস্ময়ে ভরে ওঠে মন।গ্রামবাংলার এই অভাবী-মেধাবী ছেলেমেয়েগুলোই সবচেয়ে খাঁটি মানুষ।দুনিয়াটাকে ওরা লড়ে জিতে নেয়।উচ্চ মধ‍্যবিত্ত ও ধনীর ঘরের ছেলেমেয়েদের সীমাহীন চাহিদা, জাঁক, আলস‍্য, পরমুখাপেক্ষী মনোভাব এদের নেই।এদের দারিদ্র্যই এদের শক্তি, এদের অস্ত্র।তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে মেয়েটা কী সুন্দর করে ঝেড়ে ঝেড়ে চিঁড়ে আর ছোলাভাজাগুলো উঠিয়ে রাখছে।টিনের চারচালা বড় একটা ঘর,মাঝখানে পার্টিশন।সামনে বড় একটা বারান্দা।বারান্দার একপাশে কাঠের উনুনে ছোলা আর চিঁড়েভাজার কাজ হয়।পুরনো পাকা বাড়ি।চলতা ওঠা মেঝে,কিন্তু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন-ঝগঝগে।বাপ্পা দেখেছে কুয়োতলার পাশে ঘেরাদেওয়া সুন্দর একটা বাগান।পেছনে বাঁশঝোপ।সব মিলিয়ে বেশ ভালো লাগে জায়গাটা।বেশ লক্ষ্মীশ্রী আছে বাড়িটায়।তবে অপুর মা,ভাইবোন কাউকে দেখতে পায়নি।
– বাড়ির আর সবাই কোথায় অপু?আর কাউকে দেখছি না-
– নেই।বাবা আর আমি থাকি।বাবা সকালে চা খেয়ে ভাত নিয়ে বেরিয়ে যান সেই সাড়ে সাতটায়।আমি ভোরে উঠে রান্না বসাই।বাবার ফিরতে ফিরতে কোনদিন বিকেল,কোনদিন সন্ধ্যা।আজ হাটবার, দেরী হবে।ফেরার পথে হাটে কেনাবেচা করে সওদা নিয়ে ফিরবেন।মা মারা গেছেন সাড়ে ছ’বছরের ওপর হল।ঘর আমাকেই সামলাতে হয়। © মুক্তা রায়
মেয়েটার কথা শুনে আরও অবাক হয় বাপ্পা।সন্ধ‍্যে লেগেছে।দেখে মেয়েটা উঠে গেল কুয়োরপাড়ে।ফিরে এসে ঘরে ঢুকে গেল।বারান্দায় টিমটিম করে চল্লিশ ওয়াটের বাল্ব জ্বলছে।একটু পরে হাতে প্রদীপ আর ধূপকাঠি নিয়ে বেরিয়ে আসে অপু।পুরনো সুতীর লালপেড়ে শাড়ি সাধারণভাবে পরা,গলায় আঁচল।তুলসিতলায় প্রদীপ দিয়ে ঘরে ঢুকে গেল আবার।বারান্দায় বসা বাপ্পার দিকে তাকিয়ে হাসলো একটু।ছবিটা চিরকালের জন্য বাপ্পার মনে বাঁধা পড়ে গেল।
– আমি আসছি অপু।রোববার মাছধরতে আসবো এদিককার পুকুরে।তখন আসবো।কাকুর সাথেও পরিচয় হবে।
বাপ্পার কথায় ঘর থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে অপু।সেই শাড়িই পরা।আবার দুচোখ ভরে ওকে দেখে বাপ্পা।তারপর বেরিয়ে যায়।বাস ধরতে হবে তিন মাইল দূরের করণদিঘি থেকে।ক্লাবে তার জন্য অপেক্ষা করছে সুধীর।সুধীর বাপ্পার বাবার ম‍্যানেজারের ছেলে।ম‍্যানেজারকাকু তাদের বিষয়সম্পত্তি দেখাশুনো করেন।সুধীরের মামাবাড়ি করণদিঘি।বাপ্পা ওকে নিয়ে ডাবলক‍্যারি করে মামাবাড়িতে সাইকেল জমা দিয়ে বাস ধরবে।ক্লাবে সবার মিষ্টিমুখের ব‍্যবস্থা হয়েছিল।বাপ্পাই খালি পালিয়ে এসেছিল অপুর কাছে ,বেস্ট প্লেয়ারের পুরস্কারটা সুধীরের হাতে দিয়ে।
– সুধাই, পরশু কিন্তু এখানে আসবো মাছ ধরতে।অপুপিসির সাথে দেখা করব।তোকেও আসতে হবে-
– আসবো-
তৎক্ষণাৎ রাজী সুধীর।পড়ে ক্লাস ইলেভেনে।বয়সে বাপ্পার চেয়ে বছর তিনেকের ছোট।তবে সব ক্লাসেই শেকড় গেড়ে গেড়ে ওঠা কিনা, তাই একটু বয়সেই আপাতত ইলেভেনে স্থিতিলাভ করেছে।পড়াশুনো ছাড়া অবশ্য সব কাজেই ওস্তাদ।দাদা বাড়িতে এলে তো কথাই নেই।সবাই ওকে ডাকে বাপ্পার বাহন বলে।শুধুমাত্র যদি দাদা ডেকে বলে,’তোর বইটা আনতো সুধাই’,তখনই বাহন বিদ্রোহ করে।বাহনের হিউম্যান রাইটসে হাত পড়া বলে কথা! © মুক্তা রায়
– এইজন্য বলেছিলাম দাদা গাড়িটা নিয়ে চল।সাইকেলে ডাবলক‍্যারি,তারপর বাসে ঝুলে যাওয়া-
অনুযোগ করে ফেরার পথে সুধীর।বাপ্পা হাসে।
– হুঁ, আমি যেন কোন্ ক্রিকেটার বা ফিল্মটার-গাড়ি নিয়ে গ্রামে আসবো-
– ইস্!শীতকালে আমরা সবাই এসেছিলাম গাড়ি নিয়ে অপর্ণাদির ইয়ে অপুপিসিদের বাগানে-
– কে কে এসেছিল?
– কে আবার?পিসিমণি, জ‍্যেঠিমা, মা,মামীমা আর আমি-
– বাহ্!মেয়েদের পিকনিকে তুই!
– মেয়েদের পিকনিকে দারুণ খাওয়া জমে।ছেলেদের পিকনিকে শুধু বোতল আর আধপোড়া মাংস।যা চমৎকার রান্না না অপুপিসির!
বাপ্পা ফিরে উকিলপাড়ায় বাড়িতে না গিয়ে ঢুকলো মোহনবাটিতে পিসিমণির বাড়ি।পিসিমণির বাড়িতে তার একচ্ছত্র রাজত্ব সেই শিশুকাল থেকে।নিঃসন্তান পিসিমণি-পিসেমশাইয়ের চোখের মণি বাপ্পার কোন দোষ দেখেন না তাঁরা।বৌদি অনুযোগ করলে উল্টে বৌদিকে ধমক দেন।দাদাও ছেলের নামে নালিশ করতে পারেন না।
– হ‍্যাঁরে বাপ্পা,তোর ট্রফি কই?
– ক্লাবে-
– হাতমুখ ধো।খাবার আনছি।ভেটকির চপ আর মাংসের সিঙ্গারা-
– আনো।তবে অনেকগুলো নয়।একটা করে।খেয়েই ফিরেছি-
– ক্লাবের থেকে খুব খাওয়ালো বুঝি?নইলে পেটুকরামের খাদ্যে অরুচি-
– না।আমার পিসির বাড়ি খেলাম।তোমার বোন গো।অপুপিসি-
– আরে,অপু তোর চেয়ে কত ছোট-
– হোক গে।আমার মাকে যে বৌদি বলে সে তো আমার পিসিই হয়-
ছেলের কথা শুনে বনানী হাসেন।কিছু দুষ্টুমি বুদ্ধি আছে বটে ওর ঘটে!
– অপু–অপুপিসিদের অবস্থা দেখলাম ভালো নয়।কী পরিশ্রম ওকে করতে হয়!
– তুই যে স্কুলকে গাঁইয়া স্কুল বলিস,সেই স্কুলের ফার্স্টগার্ল ও।হায়ারসেকেন্ডারীতে এইট্টি পার্সেন্টের ওপর পেয়েছে।ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হওয়ার।জয়েন্ট দিলে অবশ্যই চান্স পেতো।কিন্তু জয়েন্টেই বসলো না।বলে, পেলে পড়তে না পারলে আরও দুঃখ।দাদার ভরসাতেই ইংরেজি অনার্স নিল।টিউটরের খরচ লাগবে না, বইপত্রও অনেক দেন দাদা।ওর সুবিধে হয়েছে।দাদা বলেন, ইংরেজিতেও ভালো মেয়েটা। © মুক্তা রায়
উঠে পড়ে বাপ্পা।যত অপুর কথা ভাবছে তত অবাক লাগছে।সকালের কথাটা মনে পড়ে।ওই মেয়ে এক মূহুর্ত্তের জন্য তার বুকের মধ্যে যখন এসে পড়েছিল তখন বোঝেনি তার বুকটাই ওর স্থায়ী ঠিকানা হবে।অদ্ভুত!একদিনের চেনা, তবু মনে হচ্ছে চিরদিনের চেনা!তার কল্পলোকের মানসী।সেই কল্পনার থেকে বের হয়ে মানবী রূপে দাঁড়িয়েছে আজ তার সামনে।
– অপুপিসি, দাদা বলল আজ দুপুরে তোমার কাছে খাবে।এই মাছগুলো পাঠিয়ে দিয়েছে।ঘন্টাখানেক পরেই আসবে।বড়পুকুরে মাছ ধরছে-
– তুইও খেয়ে যাস-
– না না।মামীমার কাছে না খেলে মামীমা ধরে পেটাবে-
এক নিঃশ্বাসে কথাটা বলে দৌড়ে বেরিয়ে যায় সুধীর।অপু আর কী করে?তাড়াতাড়ি মাছ কুটতে বসে।গোটা পাঁচেক মাগুর মাছ।মাঝারি সাইজের।তিনটে জিইয়ে রেখে দুটো কেটে ফেলে।বৌদির কাছে শুনেছিল মাগুরমাছ ভালোবাসে ছেলে।এমন একটা আশা করেইছিল।তাই বাবাকে দিয়ে বড় রুইমাছ আনিয়েছে।রান্নাবান্নাও হচ্ছে বেশ।
ঘন্টাখানেক পরে অপু যখন মাগুরমাছের ঝোল রাঁধছিল বাপ্পা এল।বাকি রান্না আগেই হয়েছে।অপুর বাবা ছিলেন বাগানে।আগাছা পরিষ্কার করছিলেন।মেয়ের ডাক শুনে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলেন।দেখেন হাফপ্যান্ট আর স্পোর্টস গেঞ্জি পরা একটা ছেলে।এগিয়ে এসে তাঁকে প্রনাম করল।কাঁধের ঝোলাটা বেঞ্চে নামিয়ে রাখলো।বর্শিদুটো বারান্দার একপাশে হেলান দিয়ে রাখলো। © মুক্তা রায়
– কাকু,চলুন বাগানে যাওয়া যাক।সেখানে গল্প করা যাবে।এত সুন্দর বাগান আপনাদের!কপির চারাগুলো দেখতে দারুণ লাগে-
– কিন্তু তুমি যদি একটু বিশ্রাম-
– কোন কিন্তু নয়।অপু রাঁধছে রাঁধুক।একেবারে স্নান করে খেয়ে বিশ্রাম নেব-
ছেলেটার আন্তরিক ব‍্যবহারে অবাক হয়ে যান রতনবাবু।মুগ্ধও।কত বড় ঘরের ধনীর ছেলে অথচ এমন মিষ্টি আন্তরিক ব‍্যবহার!অপু বলছিল ডাক্তার।কোথাও কোন অহঙ্কার নেই!অথচ আজকালকার ছেলেমেয়েরা গুরুজন মানে না।তাঁর মতো এক সাধারণ হকারকে তো মশামাছি মনে করে।
– রবিবার বা বিকেলে স্নানের সময় একটু বাগান করি।কখনো সখনো জন খাটাই।যেমন আলুক্ষেত করার সময় জন খাটাব।জলটল দেয় অপুমাই।ওর যত্নেই টিকে আছে বাগানটা।মাটা আমার বড্ড ভালো।
বাঁধাকপির চারাকটা লাগাতে লাগাতে বলেন রতনবাবু।দেখেন ছেলেটাও তাঁর সাথে হাত লাগালো।সামনের পালংশাকগুলো বেশ বড় হয়েছে।পটল, ঝিঙেগাছ এখনো ফলন দিচ্ছে।টমেটো, ধনে,লাউয়ের চারা লাগিয়েছেন।আর শীতলী বেগুন।পাঞ্জিপাড়ার বেগুনের চারাও লাগিয়েছেন।
– শীতে হবে আলুর ক্ষেত।শীতের সময় যদি দেখতে বাবা, ভারী ভালো লাগতো।গেলবার বনানী দিদিমণিরা এসে ছবি তুলে গেছেন।পিকনিক করেছিলেন এখানে।বলতে নেই, আমাদের ছোট্ট সব্জির বাগানের মতো সুন্দর বাগান এই তল্লাটে নেই।দু’-আড়াই কাঠা জায়গায় করা বাগান এত ফলন দেয় যে বলার নয়।লঙ্কা গাছের পাতা দেখা যায় না।তোমাদের বাড়ির পূজোর জন্য কটা মিষ্টি কুমড়ো রেখেছি।চিনির মতো মিষ্টি।
স্নান করে বাপ্পা খেতে বসেছে রতনবাবুর সাথে।দেখছে কাঁসার থালাবাটিগ্লাসে পরিপাটি করে সাজানো সব।সুন্দর কাজকরা আসন পাতা বড়ঘরে বসার জন্য।ভালোলাগায় মনটা ভরে ওঠে বাপ্পার। © মুক্তা রায়
– কত কী রান্না করেছ!এত খাওয়া যায়?
– বেশ যায়।দিল্লিতে কী খান?শুকনো ছোলা আর বরফের মাছ।খাওয়া নিয়ে আপনার দুঃখের কথা শুনেছি বৌদির কাছে-
– তা যা বলেছ অপুপিসি।আমার মতো পেটুক মানুষের দুঃখের শেষ নেই দিল্লিতে।আমার ছাই ফাস্টফুড ভালো লাগে না।শরীরের পক্ষেও খারাপ।এই রকম ফ্রেশ মাছ-ডাল-সব্জিই প্রিয় আমার।ঘরের রান্না।সাথে ভাত।আর একটু ডাল দাও তো।রুইয়ের মাথা দিয়ে ভাজা মুগের ডালটা দারুণ হয়েছে !এমন টাটকা গোবরসারের পালংশাক যেন অমৃত।এত সুন্দর মিষ্টিকুমড়োর বড়া।পটলপোস্ত অনবদ্য।ঠিক বুঝেছি বাগানের পটল।
অপু খুব সন্তুষ্ট মনে খাওয়ায় ছেলেটাকে।ঔ খায় পরিতৃপ্তি সহকারে।মাছেরই হয়েছে তিনপদ।রুই মাছের কালিয়া, ছোটমাছের চচ্চড়ি আর মাগুরমাছের শুক্তোঝোল।রতনবাবুও খুব খুশি।ওদের বাড়ির থেকে এত যত্ন করে মেয়েটার।তিনি কিছুই করতে পারেন না।শেষপাতে পড়ে তেঁতুলের টক,দই,মিষ্টি।
– এগুলো কেন?মিষ্টি কেন আনতে দিলে অপু?
– আমাদের গ্রামের ময়রার মিষ্টি।খেয়ে দেখুন-অমৃত।দামও বেশি নয়।আমাদের বুঝি খাওয়াতে ইচ্ছে করে না?
মেয়ের কথা শুনে হেসে ফেলে বাপ্পা।খাওয়ার পর বারান্দায় বসে গল্প হচ্ছিল।রতনবাবু খেয়েই দুপুরের ঘুম দিয়েছেন।এই একটা দিন ওনার বিশ্রামের দিন।আগে রবিবারও বের হতেন।বছর তিনেক হল মেয়ে যেতে দেয় না।বলে একদিন একটু বিশ্রাম নাও।বয়স হচ্ছে।মেয়ের কথা অমান্য করতে পারেন না। ©মুক্তা রায়
– আচ্ছা, কলেজে তোমার কোন ছেলেবন্ধু নেই?
– আছে,শুধু বন্ধু।লিঙ্গহীন-
কথাটা শুনে দুষ্টুহাসি হাসে বাপ্পা।
– তুমি লিঙ্গহীন ক্লীবলিঙ্গের সাথে বন্ধুত্ব কর?তবে তো আমার সাথে তোমার বন্ধুত্ব হবে না-
– তা তো হবেই না।আপনি তো লিঙ্গযুক্ত-ভাইপো-
শুনে আরও হাসে বাপ্পা।
– ভাইপোকে কেউ আপনি করে বলে?
– না মানে, আস্তে আস্তে-
– আস্তে আস্তে কী?একবারেই বলা যায়-
– দিল্লির গল্প কর-
– ধুস্!যে কোন ভ্রমণগাইডে দিল্লির গল্প পাবে।ওই গল্প করে সময় নষ্ট করব?
– তবে তোমার মেয়েবন্ধুর গল্প কর।কয়লাখ যেন বলেছিলে?
– ওরেব্বাস!মরার জন্য গল্প করব?একে তো লিস্টে এত নাম যে বলে শেষ হবে না, তার ওপর নিজের নষ্টামোর কথা এক ইয়ং লেডিকে বলে নিজের ইমেজ ডাউন করব নাকি?তার চেয়ে তোমার গল্প শুনি-
– আমার কোন গল্পই নেই।এই আমায় যা দেখছো আমি তাই।আমজনতা।স্বপ্ন দেখি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর।বাবার বয়স হচ্ছে-এত পরিশ্রম কতদিন করবেন?
– আর কোন স্বপ্ন?
– আমাদের মতো সাধারণ মানুষের আর কোন স্বপ্ন দেখা উচিত?আমি তো পথের ধূলোয় জন্মে,বড় হয়ে, এখানেই শেষ হব।স্বপ্ন দেখে তো বাবুদের ঘরের সুখী মেয়েরা-
– তবুও দেখো স্বপ্ন অপু।জীবনে যাই আসুক-যাই ঘটুক-স্বপ্ন দেখা ছেড়ো না।স্বপ্নের মতো সঞ্জীবনী ওষুধ আর দুটো নেই।
– তুমি স্বপ্ন দেখো?
– দেখি তো।আমি দেখি আমাদের দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতি হয়েছে।দূর দূরান্তের গ্রামেও সুন্দর স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাস্থ‍্যকেন্দ্র গড়ে উঠেছে।সবাই পাচ্ছে চিকিৎসার সুযোগ।ডাক্তারবাবুরা পকেটের থেকে রোগীর দিকে বেশি মন দিচ্ছেন-
বলেই হেসে ফেলে বাপ্পা।এ রামরাজত্ব যে কবে আসবে!
– তুমি?
– আপাতত সার্জারি পড়ছি।ইচ্ছে আছে হার্ট নিয়ে নাড়াচাড়ার।ওই যে বললাম ইউনিভার্সাল লাভার, তাই হার্টের সাথে সখ্যতা-
– তারপর বাইরে গিয়ে মেম বিয়ে করে সুখে ডলার কামানো, না?সব মেধাবী ডাক্তারের গোপন স্বপ্ন-
– তাই?জানতাম না তো?ভালো স্বপ্ন।তোমার এমন কোন গোপন স্বপ্ন নেই তো?মহিলাকূলের গোপনতম স্বপ্ন-
একটু তীক্ষ্ণ-ধারালো হয়ে ওঠে বাপ্পার গলা।অপু অত খেয়াল করেনি।আনমনে হেসে বলে-
– আমি তো ডাক্তার নই।তবে মিস ইন্ডিয়া হবার স্বপ্ন দেখি-
শুনে জোরে হেসে ফেলে বাপ্পা।
– চেষ্টা করলে এই ইচ্ছেটা পূরণ হতে পারে।তুমি যে ছাইচাপা আগুন-
– ধ‍্যাৎ!কী যে বল!
বাপ্পার মুখে আবার দুষ্টু হাসি।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here