#সমর্পণ,চতুর্থ পর্ব
#মুক্তা_রায়
– কাল তোমায় সুখ দেবো।কথা দিলাম-
-কাল তো চলে যাব।কতদিন বাড়ি ছাড়া-
-এখন থেকে এটাই তোমার বাড়ি।
বাপ্পার কথায় হেসে ফেলে অপু।বাপ্পা গাঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরে থাকে অপুকে।কানের কাছে মুখ এনে বলে-
– এতটুকু মেয়ের কিনা কনজুগাল লাইফ লিড করার ইচ্ছে করে!বনানী দিদিমণি শুনে বলবে কী?ওনার ভাইপোকে বিয়ে করে ইন্টারকোর্স করে ওনার প্রিয় ছাত্রী!
– তুমি কিছু বল না দিদিমণিকে।আমার দারুণ লজ্জা লাগছে।কিসব বাজে কথা বল তুমি!মুখে আটকায় না কিছু-
লজ্জায় বাপ্পার বুকে মুখ লুকোয় অপু।বাপ্পা সস্নেহে অপুর মাথায় হাত বুলোয়। © মুক্তা রায়
– আমি বাজে কথা বলি?তুমি যে বাজে কাজ করতে চাও,সেই বেলায়?
– ছিঃ!তুমি তো পর নও।স্বামীর সাথে কাল কাটানো কোন পাপ বা অন্যায় নয়।খারাপ কাজ তো নয়ই, বোকা ছেলে।
শেষ রাতেরও আগে বাপ্পা উঠে চলে যায় নিজের ঘরে।খুলে ফেলে সিঁদুরমাখা শার্টটা।হেসে বুকে চেপে থাকে খানিকক্ষণ।তারপরই তড়িৎবেগে উঠে স্যুটকেসে চালান দেয় সেটা।চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে বিছানায়।
ভোররাতে উঠে স্নান সারে অপু।সিঁদুর ঢাকতে গিয়ে পাল্টে ফেলে সিঁথি।তাড়াতাড়ি গিয়ে ঢোকে পূজোর ঘরে।মায়ের মুখের দিকে তাকায়।মায়ের কী মহিমা!কাল ছিল কুমারী, আজ কারও স্ত্রী!তার এই নিঃশব্দ পরিবর্তন মা ছাড়া জানে না কেউ।
– এখন আমায় পিসি বলে ডাকবে না?
– তাহলে তো নিজেকে পিসেমশাই বলতে হয়।আমার দিকে অমন করে অত চেয়ো না।দেখো না দু’-দুটো বডিগার্ড আমার!কেমন করে পাহারা দেয় আমাকে!
বাপ্পার কথায় হেসে ফেলে অপু।
– আর আমার বডিগার্ড তুমি-
কথাটা বলেই হেসে ভোগের ঘরে চলে যায়।
ঠাকুর নামানো হয়েছে।বৌদি–না না, মা ঠাকুরকে সিঁদুর পরান।চোখে জল তাঁর।একে এক বাড়ির, পাড়ার সবাই সিঁদুর পরিয়ে গেল।একফাঁকে একটা নতুন সিঁদুরের কৌটো নিয়ে সবার অলক্ষ্যে মাকে ছোঁয়ায় অপু।
– তোমার আশির্বাদে যাকে পেয়েছি , যা পেয়েছি যেন অক্ষয় হয়ে আমার মাথায় থাকে-
বিকেলে অপুর বাবা আসেন অপুকে নিতে।মা না করেন।আগামীকাল পাঠাবেন তিনি অপুকে।এত খাটনির পর আজ বিশ্রাম করুক।আগামীকাল সুধাই ওকে দিয়ে আসবে।অপুর মনের আনন্দটুকুর ভাগীদার কেউ নেই।বাপ্পা গেছে ঠাকুর বিসর্জন দিতে।বাকীরাও গেছে সব।বাড়িতে শুধু বুড়ো বংশীদা, মা আর সে।মা শুয়ে আছেন।অপু নিঃশব্দে গিয়ে ওনার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।অসুস্থ শরীরে বড্ড ধকল গেল মানুষটার!শুনেছে বড়ছেলে সুইসাইড করার পর থেকেই মা অসুস্থ।কী হয়েছিল ওনার বড়ছেলের যে সুইসাইড করল?ইঞ্জিনিয়ার ছেলে।বাপ্পার চেয়ে দু’বছরের বড়। © মুক্তা রায়
– একটা কথা বলবি মা?লুকোবি নাতো?
– কী কথা মা–বৌদি?
– আমায় তুই মা বলেই ডাকিস।বৌদি তোর মুখে মানায় না।তুই আমার মেয়ের মতো।মেয়ের মতো কী?মেয়েই।বাপ্পা থাকে না, তুই আমার জীবনে আলো হয়ে এসেছিস-
বসুধাদেবীর চোখে জল।চোখে জল অপুরও।মাকে জড়িয়ে ধরে।
– আচ্ছা মা,আমায় কী যেন জিজ্ঞেস করছিলে?
– তুই বাপ্পাকে ভালোবাসিস?
শুনে মাথা নীচু করে অপু।চোখমুখ লাল।
– বুঝেছি।হতভাগী নিজের কপাল পুড়িয়েছে!এমন আশঙ্কাই করছিলাম।ওর আবেদন, সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব, আর দৈহিক সৌন্দর্যের জালে তোকেও ও মেরেছে!তোর কী হবে রে?কষ্ট পেতে হবে তোকে-
– ও আমায় ভালোবাসে মা–খুব ভালোবাসে-
– ওর কথায় বিশ্বাস করিস তুই?
– কেন করব না?
– ও কোনদিন কোন মেয়েকে ভালোবাসতে পারেনি।পারবে কিনা জানি না।তবে মেয়েদের নিয়ে ভালোবাসার খেলা খেলতে ভালোবাসে।খেলা শেষ হলে—আর কী বলব মা?ছুঁড়ে ফেলে মেয়েটাকে!
– মা–!!
– হ্যাঁ মা।চার বছর আগেও আমাদের জীবনে কোত্থাও দুঃখের ছায়াটুকু ছিল না।দুইছেলে দুটো রত্ন।পড়াশুনো, স্বভাবচরিত্রে সকলের সেরা।বড়টা চাপা, শান্ত।ছোটটা বিচ্ছু , দুষ্টু।বড়টা নিজের মনে থাকতো।ছোটটা সকলকে নিয়ে হৈহৈ করে থাকতে ভালোবাসতো এখনকার মতো।ওর সবচেয়ে প্রিয় ওর দাদা।দাদাকে ক্ষেপিয়ে, পেছনে লেগে, হাসিয়ে মারতো।বড়টা না পেরে খালি নালিশ করত।ওদের কাণ্ড দেখে হেসে মরতাম আমরা।স্কুলেও শান্তশিষ্ট অভিকে কেউ কিছু বললে বাপ্পা গিয়ে মহড়া নিতো।এত গুণ্ডা!আর এত ভালোবাসতো দাদাকে।কল্যাণীতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত অভি।ওখানেই ওর পরিচয় সঞ্চিতার সাথে।দাদুর বাড়িতে থেকে স্থানীয় একটা কলেজে পড়ত মেয়েটা।কী একটা ফ্যাশন শোতে পরিচয় অভির সাথে।অভির ফোটগ্রাফির নেশা ছিল।সেই সূত্রে গিয়েছিল ওই ফ্যাশন শোতে।অভির কাছেই গল্পটা শুনেছিলাম।দু’বার মেয়েটা এসেছিল পূজোয়।আমরা জানতাম ও আমাদের ছেলের বউ হবে।এতদূর এগিয়ে মেয়েটা অভিকে ধোঁকা দিলো!এমনকি-
একটু থামেন বসুধাদেবী।কাঁপছেন।
– থাক মা।আর বলতে হবে না-
অপু মাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। © মুক্তা রায়
– না না।আমায় বলতে দে আজ।ওই রাক্ষসী শেষ করেছে আমার ছেলেটাকে!এমনকি ওদের বাচ্চাটাকেও নষ্ট করল অভিকে না জানিয়ে!এত কিছু সহ্য করতে পারেনি ছেলেটা।চলে গেল।বড্ড নরম, সংবেদনশীল মনের ছিল আমার অভি।তখন থেকেই বাপ্পা উওম্যান হেটার।প্রচণ্ড ঘৃণা করে মেয়েদের।ওদের দুঃখ, চোখের জল ওকে আনন্দ দেয়।আমার কী দুঃখ জানিস?আমার একজন চলে গেল, আর একজন এত সহজ-সরল-প্রাণবন্ত ছেলের মধ্যে এল বিকৃতি, প্রতিশোধস্পৃহা!কিভাবে স্বাভাবিক হবে ও?
অপু দৌড়ে চলে এসেছে ঠাকুরদালানে।শূন্য বেদীর ওপর উপুড় হয়ে ভেঙ্গে পড়ে কান্নায়।মা,তুমি এ কী করলে?এমন মানুষকে ভালোবাসলাম যে কিনা নারীবিদ্বেষী?মানুষটার ভালোবাসা কোনদিন পাবো না!ও–ও আমায় ঘৃণা করে মেয়ে বলে!ওকে আমি ভালো করবই।যেভাবে হোক।এই বিকৃতির নাশ করতে আমায় তুমি সাহায্য কর মা।….হঠাৎ কানে বাপ্পার গলার আওয়াজ শোনে।গোটা বাড়িটা শুনশান।টিমটিম করে লাইট জ্বলছে ঠাকুরদালানে।
– আই লাভ ইউ দিয়া।বিলিভ মি।তুমি ছাড়া আমার মনে আর কেউ নেই।তোমায় দেখে আমি-ধ্যাৎ-প্রেমের কথা আসে না আমার।ই-মেল কর আমায়,কেমন? তোমায় বড্ড মিস করব দিল্লিতে-
– প্লিজ, আমায় একটু আদর কর।তুমি এত সেক্সী!কলকাতায় গেলে তোমার সাথে ডেটিং করব-
অস্থির-আদুরে গলা দিয়ার।
– এত আদরেও মন ভরে না?
– আমার সারা শরীরে আগুন জ্বলছে-অসম্ভব উত্তেজনা লাগছে-
বোজা গলা দিয়ার।
– এই যে আমার কাছে বসে আদর খাচ্ছো,খুব মজা লাগে না দিয়া?ভগবানকে ধণ্যবাদ দাও যে তোমায় আমি নষ্ট করিনি-
– জানি তো।কেন করনি?কে না করেছিল?
– আমার বিবেক।গতকাল–না, গতপরশু তোমার বোন বান্টিও এমনটিই করেছে আমার কোলে বসে আদর খেতে খেতে।ঔ আমায় চায়।আমি কী করি?টস করব?নাকি ছ’মাস বড়বোনের কাছে ছ’মাস ছোটবোনের কাছে কাটাবো? © মুক্তা রায়
– মানে?
– তোমরা তো কাল ফিরে যাচ্ছ ,না?আমায় খুব ভালোবাসো?বিয়ে করতে চাও?আমার ভোগে লাগতে চাও?কিন্তু তোমাদের চাই না আমি।একটুও নয়।তোমাদের হেট করি।তোমরা রক্তমাংসে গড়া,কিন্তু তোমাদের মন নেই।পয়সার লোভে তোমরা সব পারো।আমার দাদা সঞ্চিতাকে ভালোবাসতো পাগলের মতো।বোকা কোথাকার!তোমাদের ভালোবাসতে আছে?তোমাদের নিয়ে খালি খেলতে হয় আর টাকা ছড়াতে হয়।মাছ ধরে যেমন টোপ দিয়ে।যার ক্ষেত্রে যেমন টোপ।সঞ্চিতা ডাবল বয়সী প্রবাসী ভারতীয় শিল্পপতিকে বিয়ে করার জন্য আমার দাদার বাচ্চাটাকেও অ্যাবরশন করালো।দাদা সহ্য করতে পারেনি-
– আমার কী দোষ?বল?আমি তো তোমায় ভালোবেসেছি-
– আহ্!ভালোবাসা কথাটা মেয়েদের মুখে সহ্য করতে পারি না আমি।যাও আমার সামনে থেকে।আই হেট ইউ–আই হেট বোথ অফ ইউ-
অন্ধকারে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল অপু।বুঝলো বাপ্পা ভেতরে চলে গেল।একটু পরে মেয়েটাও ফোঁপাতে ফোঁপাতে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল বুঝলো অপু।নিঃশব্দে গিয়ে নিজের ঘরে শুয়ে পড়ে।শাড়িটা ছাড়তেও ইচ্ছে করছে না।ঘুম নেই চোখে।দরজাটা ভেজানো।দেখা যাক তার স্বামী আসে কিনা।
( চলবে )