#সমর্পণ,অন্তিম পর্ব
#মুক্তা_রায়
এই প্রথম বাপ্পার পিসিমণি বাপ্পাকে ধমক দিলেন।ছেলেটার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে বুক পুড়ছে তাঁর।বৌদি ফোনে কেঁদে ফেলেছিল সব কথা বলে।বনানী খালি বলেছেন,’ কেন তুমি চুপ করে ছিলে বৌদি?মেয়েটার চোখমুখ দেখে যখন আন্দাজ করেছ বাপ্পা ওকেও ওর শিকার বানিয়েছে-কেন আমাদের বলনি?’বৌদি বলল মেয়েটাকে সাবধান করার পরও যে ও শুনবে না বুঝতে পারেনি।মেয়েটার জন্য অস্থির হয়েছিলেন বনানী।আজ বাপ্পাকে দেখে অস্থিরতা আরও বাড়লো।অর্ধেক হয়ে গেছে ছেলেটা!কোথায় গেল ওর চঞ্চলতা?এ যেন অন্য মানুষ! © মুক্তা রায়
– কেন তুই মেয়েটাকে নিয়ে খেলা করলি?গরীবের মেয়ে-আজ তো অনাথই-
– ও অনাথ নয় পিসিমণি।ও আমার স্ত্রী-বিবাহিতা স্ত্রী-
– বিয়ে করেছিস তোরা?মানে?
– তোমরা যাকে বিয়ে বল সেই বিয়ে করেছি আমরা।তারপর স্বামী হিসেবে ওকে আমি ভোগ করেছি-
মাথা নীচু করার বদলে সরাসরি পিসিমণির দিকে তাকিয়ে শান্ত ধীর গলায় কথাটা বলে বাপ্পা।
– ওকে যে স্ত্রী বলিস,স্বামীর কোন কর্তব্য করেছিস?
– কোন কর্তব্য করিনি-কোন মায়া দেখাইনি।আমি যে পাষাণ -প্রাণহীন মানুষ-
– তুই ওকে ভালোবাসিস?
বাপ্পার চকিত চাহনি সব বুঝিয়ে দিয়ে গেল বনানীকে।এই জন্য ছেলে এমন চেহারা বানিয়েছে?দেখেন জানলার কাছঘেঁষা শোকেসটার ওপর অপুর বধূবেশের ছবি।দামী ফ্রেমে বাঁধানো।
– যে মেয়ে এই বাড়ির বউ হবার উপযুক্ত-এই বাড়িরই বউ যে,তার জন্য শুধু অনাদর!আর যে কোনদিন এ বাড়ির উপযুক্ত ছিল না তাকে বুঝিয়েসুজিয়ে আনতে গেছিলি না তুই?বোকাটা ওই রকম একটা মেয়ের জন্য প্রাণটা দিয়ে দিল!বাহ্! কী সুন্দর দুরকমের নীতি!
পিসিমণিকে এসে জড়িয়ে ধরে বাপ্পা।খাটে নিয়ে গিয়ে বসায়।মুছিয়ে দেয় চোখের জল।
– আমার অপুর কিছু হতে পারে না পিসিমণি।দেখবে, ওকে আমরা ফিরে পাবোই-
– তাড়াতাড়ি কর বাবু।যত দিন যাবে পাবার সম্ভাবনা কমতে থাকবে-
– না না পিসিমণি, ওকে আমি ফিরে পাবোই-
প্রত্যয়ী গলা বাপ্পার।ঝটিতে তক্ষুণি মনে পড়ল সুধাইয়ের কথা।ওর পাত্তা নেই কদিন ধরে!সে ফিরেছে জেনেও,এত বিপদ বুঝেও আসেনি ছেলেটা!কেন?সঙ্গে সঙ্গে উঠে চলে গেল সুধাইদের বাড়ি।একই পাড়ায় বাড়ি।
– সুধাই, তোর কী ব্যাপার রে?আমি এসেছি।আর তুই আমার সাথে দেখা করতে পর্যন্ত এলি না!
– তোমাকে আমার ভালো লাগে না।তুমি নিষ্ঠুর-খারাপ ছেলে-
– ঠিক বলেছিস তুই।আমি সত্যিই খুব খারাপ, খুব নিষ্ঠুর।নরকের কীট আমি।তোর বৌদি আমার জন্যই চলে গেছে-
কান্নায় বুজে আসে বাপ্পার গলা।
– না না দাদা।আমি সেকথা-
– ওর কিছু হলে আমি জীবন্মৃত হয়ে যাব।দাদার মতো মরে গিয়ে বাবা-মাকে দাগাও দিতে পারবো না, আবার ওকে ছাড়া বাঁচবোও না-
– দাদা, বৌদি বেঁচে আছে-
– কী?তুই কিভাবে জানিস?
বিস্ময়ে-আনন্দে ছেয়ে যাচ্ছে বাপ্পা।
– আমি তো জানতাম তোমরা প্রেম করছ।নবমীর দিন রাতে দেখলামও তুমি ওকে সিঁদুর পরালে।তারপর তুমি চলে গেলে।বৌদির মুখ দেখে বুঝলাম তুমি ওকে ধোঁকা দিলে।ওর বাবার মরার খবরেও এলে না।তারপর শুনলাম তোমার দিল্লিতে বিয়ে ঠিক হয়েছে।লুকিয়ে দেখতাম বৌদি কেমন যেন হয়ে গেছে।চুপচাপ, উদাসী।ছাদে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা থাকতো।দরকার ছাড়া কারও সাথে কথা বলত না।ঠিক বড়দার লক্ষণগুলো দেখতে পেলাম।শুনলাম চাকরি হয়েছে।তবুও ভয় গেল না।বড়দারও তো মস্ত চাকরি হয়েছিল শুনেছিলাম।সবাইকে বলে বৌদি ছোট্ট একটা ব্যাগ নিয়ে রওনা দিল।আমার তখনই সন্দেহ হল -এত ছোট ব্যাগ নিয়ে কেউ যায় অত দূরে চাকরি করতে?বাসে উঠল বৌদি।আমি পেছন পেছন উঠি।বৌদি আমায় দেখেনি।গিয়ে যখন নামলো ফারাক্কায় তখনই বৌদির মতলব বুঝেছি।ব্যাগটা রেখে গঙ্গায় ঝাঁপ দিতে নিয়েছিল, পেছন থেকে আমি গিয়ে ধরেছি। © মুক্তা রায়
কথা শুনে কিছুক্ষণের জন্য হতচেতন হয়ে পড়ে বাপ্পা।শ্বাসটুকু ফেলতে পারছে না।সুধাই যদি না থাকতো!তারপরই বুকে জড়িয়ে ধরে সুধাইকে।
– সুধাই, বৃথাই তোকে সবাই বলে তোর মাথায় বুদ্ধি নেই।মানুষকে বুঝতে তোর মতো কেউ পারে না।তোর কাছে যে হেরেও সুখ।আমার নির্বুদ্ধিতা, নিষ্ঠুরতায় আমার ভালোবাসা আমায় ছেড়ে চলে যেতে নিয়েছিল।ওকে বাঁচিয়ে তুই আমায় বাঁচিয়েছিস।কোথায় ও?
– করণদিঘি।আমার মামাবাড়িতে রেখে এসেছি।যাবে না?ওহ্,তোমার তো বিয়ে,না?
– নারে।ওগুলো—।তোকে সব পরে বলব।শুধু শুনে রাখ,তোর বৌদি ছাড়া আর কেউ নেই আমার জীবনে।কোনদিন ছিলও না কেউ।আমি ওকে ঠকাতে পারি, কিন্তু আমার ভালোবাসা মিথ্যে নয়।কায়মনোবাক্যে আমি ওর-
অধীর হয়ে ওঠে বাপ্পা।কখন ওকে দেখবে?
– চল দাদা বৌদির কাছে।আমি চট করে গাড়িটা নিয়ে আসি?
– হ্যাঁ, চল।তোকেও দিল্লি নিয়ে যাব তোর বৌদির সাথে-
– সে তো যাবই।আমি লক্ষ্মণ দেওর বৌদির।বৌদির জোরেই হায়ার সেকেন্ডারী তরালাম।বৌদি আমার দিদিমণি-
– আয় মা,চুলটা বেঁধে দেই।এমন চাঁদের মতো রূপ তোর!এয়োস্ত্রী মানুষ হয়ে এমনধারা খোলা চুলে থাকে?গা ধুয়ে এসে ভালো করে কাপড়টাও পরিসনি দেখছি-
– কী হবে মামীমা সেজেগুঁজে?যাও গে।কে কুটুম এসেছে, তাদের সাথে গল্প কর।রান্নাঘরে যাই আমি।
– আর রান্নাঘরে যেতে হবে না।দিনেরবেলা তো রান্নাঘরেই কাটাস-
জোর করেই সুধীরের মামীমা সরস্বতীদেবী অপুকে চুল বেঁধে দেন।কপালে-সিঁথিতে বড় করে সিঁদুর পরান।অপু ছাপার শাড়িটা ঠিক করে পরতে নিলে বলেন বাসন্তী রঙের লালজড়ি পেড়ে সিল্কের শাড়িটা পরতে।মামীমা শাঁখাপলা আগেই পরিয়েছিলেন।
– ওই শাড়ি!
বাপ্পার দেওয়া শাড়ি।এই শাড়িটা পরেই মরতে গিয়েছিল। © মুক্তা রায়
– হ্যাঁ, আজ একটু পর।দুচোখ ভরে একটু দেখি তোকে।এরপর তো চাকরিতে জয়েনই করবি-
অগত্যা উঠে অপু শাড়িটা পরে ফেলে।এখন আবার একক পথচলা।মরতে যখন পারলোই না পাগল ভাইটার ,জন্য জীবনের ভাবনা ভাবতেই হবে।আবেগে বয়ে গিয়ে চরম অপরাধ করে ফেলেছে দুটি মানুষের কাছে-স্যার আর মা।কত উৎকণ্ঠা নিয়ে আছেন তাঁরা।ক্ষমা চাওয়ারও তো মুখ নেই।সে যদি মারা যেত মা আর একবার শোক পেতেন।মায়ের এত ভালোবাসার বদলে মাকে কী করে শোকটা দিতে চলেছিল অপু?ভালোবাসা তো পেয়েছেই অপু।মা, স্যার, সুধাই, মামীমা-সকলের ভালোবাসায় সে সমৃদ্ধ।তবে?এই পাওয়াই তার সারা জীবনের চলার পথের পাথেয়।শুধু একটাই দুঃখ, মানুষটাকে ঠিক পথে আনতে পারলো না অপু।ভেবেছিল তার নীরবতা ওকে পথে আনবে।কিন্তু যেদিন শুনলো ও বিয়ে করছে বুঝেছিল সঞ্চিতার ঘূন ওকেও ধরেছে।ওর দাদার ট্র্যাজেডি ওকে উইমেন হেটার করেছে-সত্যটা সহজেই মেনে নিয়েছিল।একজন নরম মনের সেনসেটিভ ছেলের এমনটি হওয়া খুবই স্বাভাবিক।দাদার প্রতি ওর ভালোবাসা দেখে শ্রদ্ধা করত ওকে।ভালোবাসাও আরও আরও যেন ঘন হয়েছিল।ও তাকে ভুলে যাক, সইত অপু।কিন্তু একজন ক্ষমতা ও অর্থলোভী মানুষকে মনপ্রাণ দিয়েছে, সহ্য করতে পারেনি অপু।ওই মা-বাবার এই ছেলে?
– এই যে দেখো মামীমা, আমি শাড়াটা পরেছি-
বলে পেছন ঘুরেই দেখে মামীমা নেই।সেখানে দাঁড়িয়ে আছে বাপ্পা।ভূমিকম্প হচ্ছে নাকি?অপুর সামনে সবকিছু কেমন দুলে ওঠে।
জ্ঞান ফিরতেই দেখে মানুষটার কোলে তার মাথা।চোখেমুখে জল।নিশ্চয়ই ও ছিঁটিয়েছে?
– তুমি এখানে কেন?তোমার–না, আপনার স্ত্রী-
– আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে।বোকা মেয়ে!যেমন বাজে ছেলেকে ভালোবেসেছ তেমন বোঝ মজাটা।আমার কী?আমি একশটা প্রেম করে দশটা বিয়ে করব।পারবে তুমি সইতে?আর আর ওইসব কুচিন্তা মাথায় আনবে কখনো?আমাকে কষ্ট দিতে চাও,তাই না?আর যদি–ওগো, তুমি আমার এখানে, এই বুকে ছিলে-আছো।তোমায় দেখেই তোমার প্রেমে পড়েছিলাম।কোনদিন তোমার সাথে অভিনয় করিনি আমি।ওই শেষের রাতটুকু ছাড়া।সেদিন আমি অভিনয় করেছি।তোমায় না ভালোবাসার অভিনয়।কতগুলো নির্জলা মিথ্যেকথা বলেছি তোমায় কষ্ট দিতে।যাক,তোমায় যে ফিরে পেয়েছি-
– তুমি আমায় ভালোবাসো না।আমার এত বিপদেও এলে না!ফোনটুকু করলে না!আমার সবচেয়ে যখন দরকার ছিল তোমায়-
অপুর গলায় অভিমান।চোখে জল।মুখ ফিরিয়ে নেয়। © মুক্তা রায়
– আমি যে তোমাকে আর নিজেকে ঠকাতে গিয়েছিলাম সোনা।কিছুতেই মানতে পারছিলাম না আমি একটা মেয়েকে ভালোবেসেছি।ভীষণ ভালোবাসি।দাদার ভালোবাসার চেয়েও বেশি।দাদা ভালোবেসে মরে গেছে।আমি মরতে চাইনি, তিলে তিলে নিজেকে পোড়াতে চেয়েছি।প্রথমটায় নিজেকে কষ্ট দিয়ে শাস্তি দিয়েছি,আমার আদালতে নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করে।নির্দয়ভাবে নিজের সব ইচ্ছের টুঁটি চেপে ধরে নিজেকে তোমার থেকে দূরে আরও দূরে নিয়ে গেছি।তোমার সাথে দেখা হওয়ার ভয়ে সুযোগ পেয়েও রায়গঞ্জে আসিনি।পরে যখন বুঝলাম সব আমার ভুল বড্ড দেরী হয়ে গেছে।সুধাই না থাকলে আজ তোমাকে পেতাম না।
অপু উঠে বসে।দেখছে মানুষটাকে।কী চেহারা হয়েছে!মুখ ভর্তি বড় বড় দাড়িগোঁফ,করুণ দুটি চোখে ব্যথা ঝরে পড়ছে।বুকের মধ্যে হ হু করে ওঠে অপুর।বোঝে ছেলেটা সেই থেকে যন্ত্রণায় ভুগছে।তাকে ভালোবাসার যন্ত্রণা, আর তাকে ভালোবাসতে না চাওয়ার যন্ত্রণা।দুয়ে মিলেমিশে এক অসহনীয় জ্বালায় ভুগছে ছেলেটা।
– বাবার প্রতি সবচেয়ে অন্যায় আমি করেছি অপু।তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে আসিনি।তক্ষুণি না আসতে হতো আমায়।ছেলের মতো পাশে থাকতে হতো তাঁর কন্যার।আমি একটা ওয়ার্থলেস-
এবার অপু বাপ্পাকে জড়িয়ে ধরে পিঠে-গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়।
– দোষ আমিও করেছি।তোমার সাথে একটি কথাও না বলে তুমি সঞ্চিতার মতো লোভী হয়ে গেছো এই ভেবে নিয়ে আমিও মরতে চলেছিলাম।আমি মরে গেলে মা নতুন করে সন্তানশোক পেতেন-
– সেখানেও যে আমারই নির্বুদ্ধিতা সোনা।ভেবেছিলাম আমার বিয়ের গল্প শুনে তুমি হয়তো মাকে অন্তত আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা জানাবে।তুমি যে এভাবে আমার বুক খালি করে-
কথা শেষ করতে পারে না বাপ্পা।অপুকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলে।তার এতদিনের যন্ত্রণা কান্না হয়ে নামলো।কেঁদে ফেলেছে অপুও।একটু সময় নিয়ে ঠাণ্ডা হয় অপু।স্বামীর চোখের জল মুছিয়ে দেয়।সেই দুষ্টু-চঞ্চল-সদাহাস্যময় ছেলেটা এক্কেবারে যেন অন্য মানুষ!না না, ওকে আবার আগের মতো করে তুলবে অপু।নিজের নারীত্বের সম্পদে ওকে সমৃদ্ধ করবে।
– এই যে পিসেমশাই, আমার মার কাছে নিয়ে যাবে না?
– সিওর পিসি।সিওর নিয়ে যাব।মার কাছে বধূরানীই সব।তোমায় নিতে আসছি শুনে মা বললেন তাঁর গৌরী কদিন আগেই আসছে।ওনার দশভূজা এসে পড়লে পূজায় আর চিন্তা নেই।বাবারও সেই মত।ছাত্রীর দিকেই টান বেশী।ছেলে তো ফেলনা-
– দুষ্টু ছেলেকে কান ধরে নীলডাউন করাতে বলব-
– হুঁ, সারারাত ছেলে যদি নীলডাউন থাকে তবে নীট লস কার বলতো?
লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে অপু।শরীরটা অবশ লাগছে।দেখে ছিটকিনি বন্ধ। © মুক্তা রায়
– আমায় তোমার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে সুধাই বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়েছে।ওর বৌদিকে আদর করতে হুকুম দিয়েছে।
– ও, সুধাইয়ের হুকুম তামিল করছ তাহলে?
– কী করব?অগত্যা করতেই হচ্ছে-
– যাও যাও।কাউকে আমার দরকার নেই।আমি একাই জীবন কাটাতে পারি-
পেছন ফিরে শুয়ে পড়ে অপু।লুকিয়ে হাসছে।পেছন থেকে অপুকে জড়িয়ে ধরে বাপ্পা।
– আরে,আমি বলে বউকে কোথায় এম.এ পড়াব সেটাও চিন্তা করছি।আমি যখন কাজে ব্যস্ত থাকবো তখন ফাঁকি না দিয়ে পড়াশুনো করবে,যাতে রাতে আমায় ফাঁকি না দাও।এম.এ, পি.এইচ.ডি যা যা করতে চাও,যত পড়তে চাও পড়।
পড়ার নাম শুনে উৎসাহে মুখ ফেরায় অপু।কিছু বলতে যায়,কিন্তু তার আগেই ঠোঁট সিল হয়ে গেছে।বুঝেছে তার রক্ষে নেই।দীর্ঘদিন পর ওর বউ-ওর ভালোবাসাকে পেয়ে নেশায় পেয়েছে লোকটাকে।ইস্!এতগুলো মানুষের সামনে লজ্জায় মুখ দেখাবে কী করে অপু?ছেলেটা তো নির্লজ্জ।ইস্—!আর চিন্তা করতে পারে না অপু।ছেলেটাও অশান্ত হয়ে উঠেছে।অপু সসঙ্কোচে চেপে ধরে বাপ্পার হাত।
– বোকা মেয়ে,সঙ্কোচ করে দেখো!আমাকে সেদিন পণ্ডিতিমার্কা কথা কে বলেছিল?তুমি তো তোমার স্বামীর সাথে আছো।প্রতি রাতে নিজেকে দিতাম তোমায়।অথচ দেখো জীবনের প্রয়োজনকে-জীবনের সত্যকে স্বীকার করতে দেরী করে নিজেকেও কষ্ট দিলাম, তোমাকেও কষ্ট দিলাম।আচ্ছা, পরশু কী বলতো?আমাদের বিয়ের দিন-
– হুঁ, আমার বিয়ের দিন।আরেকজন তো সেটাকে খেলাই ভেবেছিল-
অপুর অভিমান যায় না।
– তুমি ঠিক বলেছ।আমি তো খেলোয়ারই ছিলাম।তবে গতবছর ছুটি নিয়ে এদিন পূজো দিয়েছিলাম তোমার নামে।তারপর সারাদিন কাটালাম আগ্রায় তাজমহল দেখে-
– তুমি-
– এঘরে তুমি বলে কেউ আছে অপু?
বাপ্পা বউয়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসে।এক শিশিরভেজা পদ্মকলির সমর্পণকে একদিন অস্বীকার করে রূঢ় আঘাতে ফিরিয়ে দিয়েছিল।পরে সেই উপেক্ষিতাকে পাওয়ার জন্য মাথা কুটেছে।নিজেকে লুটিয়ে দিতে চেয়েছে তার সমর্পিতার পায়ে।বুঝেছে নারী ছাড়া জীবন বড় কঠিন, মরুময়।তার কলি আজ কমল হয়ে ফুটেছে।কত বড় মন কমলের!অপেক্ষা আর উপেক্ষায় ঝরে যেতে নিয়েও অমলিন-পবিত্র রয়েছে!
– না না, আর সময় নষ্ট নয়।আমার মার জন্য মনটা কেমন করছে।চল আমায় নিয়ে মার কাছে-
– আমি তো জানতামই।তাই মামীমাকে বলেছি আমাদের জন্য রান্না না বসাতে।অন্যদিন এসে খেয়ে যাব-
এই জন্যই মেয়েটাকে এত ভালোবেসেও আশ মেটে না বাপ্পার।সবাইকে সাথে নিয়ে চলার মতো মানুষ কটা পাওয়া যায় আজকাল? © মুক্তা রায়
সপ্তমীপূজো।চৌধুরীবাড়ি গমগম করছে লোকজনে।সকালবেলা।অপু ব্যস্ত ছিল ঠাকুরদালানে পূজোর কাজে।কাজ করতে করতে অনভ্যস্ত হাতে ঘোমটা টানছে।মানুষটার বায়নাক্কায় ছাপার শাড়ির বদলে চওড়া লালপেড়ে গরদের শাড়ি সাধারণভাবে পরেছে।গায়ে গাদা গয়না।গতরাতে নিজের হাতে পরিয়েছে নূপূর।তার পুরাতনী সাজ বলে ভালো লাগে ওর।রান্নার আরতি কাকিমা ঠাট্টা করে বললেন লক্ষ্মীঠাকরুণের জায়গায় তাকেই বলে বসানো যায়।এত শ্রীময়ী বউ তিনি কখনো দেখেননি।লাজুক হাসে অপু।এমন সময় বংশীদা এসে খবর দেয় মা তাকে দোতলায় মায়ের ঘরে ডাকছেন।পূজো মাত্র শেষ হয়েছে।মা একটু আগেই ঘরে গেলেন।কী এমন দরকার?তাড়াতাড়ি উঠে ঘোমটা সামলাতে সামলাতে দৌড়ায় হলের মধ্যে দিয়ে সিঁড়ির দিকে।উঠছে।আবার ধাক্কা।সিল্কের পাঞ্জাবী পরা দুটি হাত তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচায়।কয়েক মূহুর্ত্তের জন্য অপু স্থির হয়ে থাকে ওই বুকে।তারপরই লজ্জায় দে দৌড় ওপরে।পেছনে শুনতে পায় ভরাট গলার তরল হাসি।অপু জানে ওই হাত দুটোর মালিক ঠিক কোথাও ঘাপটি মেরে থাকবে তাকে পাকড়াও করার জন্য, তারপর—-!আর ভাবতে পারে না অপু, শরীর অবশ অবশ লাগছে।দোতলার বারান্দার থেকে দেখে দেওয়ালের কার্নিশে পুরুষ শালিকটা মেয়ে শালিককে আদর করছে।থমকে দাঁড়িয়ে পায়ের আঙ্গুল দিয়ে কবার মেঝে ঘষে ঢুকে যায় মায়ের ঘরে।
চলবে