চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা,৪০,৪১

0
670

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা,৪০,৪১
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪০
____________

জোহান এবং ওর মমের মাঝের মনোমালিন্যটা মিটে গেছে। সবকিছু আবার আগের মতো। সবার একসঙ্গে ডিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। এরপর থেকেই সব মিটমাট। মিতুলের কাছে পরিবেশটা এখন একটু হালকা লাগছে। যতদিন জোহান এবং ওর মমের মাঝে গুমোট গুমোট একটা ব্যাপার ছিল, ততদিন ঠিক পরিবেশটা অন্যরকম লাগছিল। আজ সব স্বাভাবিক।
মিতুল জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ক্লান্ত সূর্যটা ঘুমোতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘের সাথে রুপালি, বেগুনি আর কমলা রঙের ঘনঘটা মিলেমিশে একাকার। সন্ধ্যার আকাশ এতটা ভালো করে এর আগে কখনো দেখা হয়নি ওর। ইচ্ছে হচ্ছে আজকের এই আকাশের দৃশ্যটা রং তুলি দিয়ে আঁকে ক্যানভাসে। কিন্তু ইচ্ছা করলে কী উপায়! ও তো আঁকতে পারদর্শী নয়। কোনো কালেই ছিল না। তাছাড়া ড্রইং করার জন্য ওর কাছে তো এখন কোনো সামগ্রী নেই। আঁকবে কীসে? মিতুলের মন একটা দুটো কষ্টের আঁচড় টানলো।
আচ্ছা, জোহান আঁকতে পারে না? ও যদি এই সন্ধ্যার আকাশ এঁকে দিতে বলে, জোহান পারবে আঁকতে? ব্যাপারটা জানতে হবে তো।
মিতুল জোহানকে খোঁজাখুঁজি করে শেষে কিচেনে পেল।
ফ্রিজ থেকে সফট ড্রিঙ্কসের বোতল বের করে কয়েক ঢোক খেয়ে বোতলটা আবার ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখলো জোহান। মিতুল চুপিচুপি কিচেনে দাঁড়িয়ে আছে সেটা খেয়াল করেনি। হঠাৎই তাই পিছনে ফিরে ভয় পেয়ে গেল।
“উহ! তুমি তো আমাকে মেরে ফেলবে দেখছি!”

“আমি কোনো খুনি নই যে তোমাকে মেরে ফেলবো।”

“এখানে কী চাই তোমার?”

“আমাকে এঁকে দিতে পারবে?”

“মানে?”

“আঁকতে পারো তুমি?”

“কেন জিজ্ঞেস করছো? তোমার ছবি এঁকে দিতে হবে? যদি তোমার ছবি এঁকে দেওয়ারই ব্যাপার হয়, তবে আগেই বলে রাখি। তোমার ওই রাগে ফুলো নাক নিখুঁত ভাবে আঁকা সম্ভব নয়। আঁকতে পারব না আমি।”

“বেশি কথা বলো কেন? তোমাকে কে বললো যে আমার ছবি এঁকে দিতে হবে? আমি আকাশের কথা বলছি। সন্ধ্যার আকাশের কথা। এঁকে দিতে পারবে?”

“আকাশ কেন আঁকতে হবে? আকাশ তো আকাশের জায়গাতেই থাকবে। নিয়ম করে প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে। কেউ তো নিষেধ করবে না তোমায়। ইচ্ছে হলে সারাদিনও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে পারো।”

মিতুলের একটু রাগ হলো। জোহানের সাথে আর কথা বলার রুচি হলো না ওর। রাগ করে কিচেন থেকে চলে যাওয়া দিলেই জোহান কিচেনের দরজা বন্ধ করে ফেললো।
“কোথায় যাচ্ছ? শুধু এইটুকু বলবে বলেই কি এখানে এসেছো? না কি অন্য কোনো কারণ আছে এর পিছনে? যেমন, আমাকে দেখতে ইচ্ছা করছিল তোমার। যদি তাই হয় তবে আমাকে ভালো করে না দেখে চলে যাচ্ছ কেন? কী ভেবেছিলে? আকাশ আঁকানোর নাম করে আমাকে দেখতে আসবে, আর সেটা আমি বুঝতে পারব না? নো মিতুল। বোকা তুমি। আমি নই। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি তুমি আসলে আমাকে দেখতেই এখানে এসেছো।”

মিতুল ভেবে দেখলো, ও কি আকাশ আঁকানোর নাম করে জোহানকে দেখতে এসেছে? না, এমনটা ভেবে তো এখানে আসেনি ও। জোহান আঁকতে পারে কি না সেটা জানার জন্যই এসেছিল। তাহলে ওর কেন এমন ফিল হচ্ছে? ভিতরে ভিতরে কেমন একটা চোর চোর ফিল হচ্ছে ওর। মিতুল খুব করে চাইছে জোহানের কথার প্রতিবাদ করতে, কিন্তু পারছে না। ওর এই ফিলিংসটা ওকে প্রতিবাদী করে তুলতে বাধা দিচ্ছে। আচ্ছা এমন কেন হচ্ছে? কোনো রকম ভাবে ব্যাপারটা এমন নয়তো যে, ও আসলেই জোহানকে দেখতে এসেছে?

জোহান মিতুলকে নিশ্চুপ দেখে বললো,
“তুমি আসলে আমাকেই দেখতে এসেছো। তোমার নীরবতা এটাই বোঝাচ্ছে।”

মিতুল এবার প্রতিবাদ করে উঠলো,
“কে বললো যে আমি তোমাকে দেখতে এসেছি? তোমাকে দেখে কী লাভ আমার? আমি মোটেই তোমাকে দেখতে আসিনি। তুমি আঁকতে পারো কি না সেটাই জানতে এসেছি শুধু। এর বেশি আর কিছু না।”

“সত্যিই তুমি শুধু এটাই জানতে এসেছো?”

“হ্যাঁ।” কণ্ঠে বিশেষ জোর দিলো মিতুল।

জোহান মুখ কালো করে ফেললো। কিচেনের দরজা খুলে দিয়ে বললো,
“যাও।”

মিতুল তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল।

জোহান পিছন থেকে আবার ডাকলো,
“দাঁড়াও।”

মিতুল দাঁড়ালো ঠিক। কিন্তু পিছন ফিরলো না।
জোহান বললো,
“মুখে যাই বলো না কেন, তুমি আসলে আমাকেই দেখতে এসেছো। আমি খুব গভীর ভাবে টের পাচ্ছি সেটা।”

“তোমার ধারণা ভুল।”
বলেই দ্রুত পায়ে রুমের দিকে ছুটলো মিতুল।

___________

অপরাধ বোধ ঘিরে রেখেছে মিতুলকে। জোহান চেয়ারসহ নিচে পড়ে যাবে এটা ভাবেনি ও। ঘটনাটা ঘটেছিল ব্রেকফাস্টের সময়। ক্যামিলাকে কাজে সাহায্য করছিল ও। কিচেন থেকে খাবার এনে রাখছিল টেবিলে। খাবারগুলো জোহানের পাশে দাঁড়িয়েই সাজিয়ে রাখছিল। কিচেন থেকে জুস আনা বাকি ছিল। ও জুস আনার জন্য কেবল ঘুরেছে, এর মাঝেই কেমন করে যেন ওর পা তাল হারিয়ে ফেললো। ও হেলে পড়লো জোহানের দিকে। কিন্তু ও পড়লো না। টেবিল ধরে নিজের পতন ঠেকিয়েছে। কিন্তু ওর ধাক্কায় জোহান নিচে পড়ে যায় চেয়ার নিয়ে। দৃশ্যটা মনে হতে এখনও অপরাধ বোধ ওর ভিতরটা ছেয়ে ফেলে। এতটুকু জায়গা ছাড়ে না। জোহানের ডান হাতের তালুর এক পাশে কীভাবে যেন ছিলে গেছে সেই এক্সিডেন্টে। কোমরেও ব্যথা পেয়েছে। ব্রেকফাস্ট না করে জোহান রাগারাগি করে সোজা নিজের টাইম হাউজে চলে গেছে। এই ব্যাপারটা জোহান বাড়াবাড়ি করেছে। এরকম এক্সিডেন্ট তো হতেই পারে, তাতে এমন মেজাজ দেখানোর কী আছে? আজ ওর জায়গায় যদি জোহান নিজে থাকতো, তাহলে?

জোহান সেই যে সকালে টাইম হাউজে গিয়েছে আর আসেনি। বিকেল চলছে এখন। জোহান টাইম হাউজে বসে কী খেয়েছে কে জানে! রাগ দেখিয়ে চলে গিয়েছে, না খেয়ে থাকলেই ভালো। মিতুল কথাটা ভেবে শেষ করতে না করতেই জোহানের কল পেল।
রিসিভ করতেই জোহান বললো,
“তাড়াতাড়ি আমার জন্য খাবার নিয়ে আসো। তোমার জন্য আমার ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ মিস গেছে।”

“আমার জন্য মানে? তুমি নিজেই তো না খেয়ে চলে গেলে। আমি কি নিষেধ করেছি খেতে?”

“এত কথা বাড়াও কেন? যা বললাম তাই করো। খাবার নিয়ে টাইম হাউজে আসো।”
বলেই ফোন কেটে দিলো জোহান।

মিতুল পড়লো মহা মুসিবতে। কী খাবার নিয়ে যাবে জোহানের জন্য?
মিতুল ক্যামিলার কাছে এসে বললো জোহানের কথা। দুপুরে খাওয়ার পরে ভাত এবং গোরুর গোশত ছিল। ক্যামিলা প্লেটে খাবার বেড়ে ট্রে ধরিয়ে দিলো মিতুলের হাতে। মিতুল খাবার নিয়ে চললো জোহানের জন্য।
টাইম হাউজে এসে কড়া নাড়লো দরজায়।
ভিতর থেকে জোহান বললো,
“দরজা খোলা। ধাক্কা দাও।”

মিতুল ধাক্কা দিলে দরজা খুলে গেল। ভিতরে প্রবেশ করতেই জোহানকে দেখতে পেল কাউচের উপর শোয়া। জোহান শোয়া থেকে উঠে বসলো। মিতুল ওই পাশে থাকা টি টেবিলটা টেনে কাউচের সামনে নিয়ে এসে তার উপর ট্রে রাখলো।

“কী এনেছো?”

মিতুল ঢাকনা সরাতে সরাতে বললো,
“ভাত এবং গোরুর গোশ।”

জোহান বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে ফেললো,
“ভাত, গোরুর গোশ ছাড়া আর কিছু ছিল না?”

মিতুল সহজ ভাবে উত্তর দিলো,
“না। আর কী থাকবে? তোমার জন্য কি কেউ এই বিকেলে রান্না করে রেখেছে না কি? তেমন হলে রাতে বলতে। তোমার জন্য বিভিন্ন আইটেম রান্না করে রেখে দিতো ক্যামিলা। যা এনেছি এখন তাই খাও চুপচাপ।”

“খেতে পারব না।”

“খেতে পারবে না মানে? যখন নাই খাবে তখন আমাকে দিয়ে খাবার আনালে কেন?”

“আমি খাবো না সেটা বলিনি। আমি খাবো। তবে নিজ হাতে না, তুমি খাইয়ে দাও।”

“আমি?” মিতুলের কণ্ঠে বিস্ময়ের ধারা ঝরে পড়লো।

“হ্যাঁ। দেখছো না তোমার জন্য আমার হাত আহত হয়েছে!”

মিতুল অন্য সময় হলে কখনও খাইয়ে দিতো না জোহানকে। কিন্তু এখন জোহানের প্রতি মায়া হচ্ছে ওর। আর তাছাড়া একটা অপরাধ বোধও তো আছে। যদিও ও ইচ্ছাকৃতভাবে করেনি কাজটা। কিন্তু ওর জন্যই তো এক্সিডেন্টটা ঘটলো আজকে।
মিতুল কিচেনে গিয়ে একটা চামচ নিয়ে এলো।

জোহান বললো,
“চামচ দিয়ে কী করবে?”

“চামচ দিয়ে খাইয়ে দেবো তোমাকে।”

“উহু, চামচ দিয়ে খাবো না আমি। চামচ দিয়ে নয়, নিজ হাতে খাইয়ে দাও।”

“নিজ হাতে?”

জোহান মাথা নাড়লো।

“পারবো না আমি। কিছুতেই তোমাকে হাত দিয়ে খাইয়ে দেবো না।”

“তাই? তুমি কি চাও আমি আজকে সারাদিন না খেয়ে থাকি?”

মিতুল কোনো কথা বললো না। কেমন একটা লাগছে ওর। নিজ হাতে লোকমা তুকে খাইয়ে দেবে জোহানকে? ইশ, কেমন হবে ব্যাপারটা?

“কী হলো? দাঁড়িয়ে আছো কেন? খাইয়ে দাও।”

মিতুল কিচেন থেকে হাত ধুয়ে এলো আরও একবার। জড়তা নিয়ে বসলো জোহানকে খাইয়ে দেওয়ার জন্য। ট্রে থেকে প্লেট তুলে ভাত মাখিয়ে এক লোকমা তুলে দিলো জোহানের মুখে। টের পেল হাতটা কেমন কাঁপছে।
ধ‍্যাত্তেরি! মানুষকে খাইয়ে দেওয়ার মতো ঝামেলা আর দুটো নেই পৃথিবীতে। এর আগে একবার ওর ছোটো ভাইয়ের হাড় কাঁপিয়ে জ্বর এসেছিল। নিজ হাতে খেতে পারতো না ওর ভাই। সেসময় ও খাইয়ে দিয়েছিল ভাইকে। এছাড়া ওর এক বছর বয়সের এক লিটল কাজিনকে খাইয়ে দিয়েছিল। ভাই এবং সেই লিটল কাজিনকে খাইয়ে দেওয়ার সময়ই বুঝে গিয়েছিল যে, মানুষকে খাইয়ে দেওয়ার মতো ঝামেলা আর দুটো নেই পৃথিবীতে। কিন্তু ভাই এবং লিটল কাজিনকে খাইয়ে দিতে কী এমনই বা ঝামেলা হয়েছিল। তার থেকে অনেক বেশি ঝামেলা হচ্ছে এখন এই জোহানকে খাইয়ে দিতে! কখনো কি ভেবেছিল ও জোহানকে নিজ হাতে খাইয়ে দেবে?

জোহানকে ছোটো ছোটো করে চার লোকমা খাইয়ে দেওয়ার পর মিতুলের হাত থেমে গেল। ওর হাত আর চলছে না।
জোহান বললো,
“কী হলো? থেমে গেলে কেন? খাইয়ে দাও। এমনিতেই সকাল থেকে না খাওয়া আমি। আর এখন একটু খেতে বসলাম, তাও তুমি একটুখানি খাইয়ে দিয়ে থেমে গেলে? কেন? এটা কোন ধরনের টর্চার?”

মিতুল আর কথাটা চেপে রাখতে পারলো না। বললো,
“তোমাকে খাইয়ে দিতে সমস্যা হচ্ছে আমার। আমি খাইয়ে দিতে পারব না।”

“কেন?”

“একটা মানুষকে অন্য একটা মানুষ খাইয়ে দেয় কীভাবে? আমি পারব না।”

“এটা কী কথা বললে তুলতুল? একটা মানুষকে অন্য একটা মানুষ খাইয়ে দেয় কীভাবে মানে? ছোটো বেলায় তো সবাইকেই খাইয়ে দেওয়া হয়। আর শুধু ছোটোবেলা কেন? কত মায়েরাই তো তাদের সন্তান বড়ো হওয়ার পরেও নিজ হাতে খাইয়ে দেয়।”

“মায়েদের ব্যাপার ভিন্ন। আমি কি তোমার মা?”

“উফ তুলতুল! শুধু যে মায়েরাই তাদের সন্তানদের খাইয়ে দেয় তা তো নয়। এছাড়াও অনেকে অনেককে খাইয়ে দেয়। যেমন…”
বলতে গিয়েও একটু থামলো জোহান।

মিতুল উদ্বিগ্নতা নিয়ে তাকিয়ে আছে জোহানের দিকে। কী উদাহরণ দেবে জোহান?

জোহান নিজের উদাহরণ শোনালো,
“যেমন অনেক ভাই-বোনও একে অপরকে খাইয়ে দেয়।”

জোহানের কথা শুনে মিতুল থ হয়ে গেল।
“বোন! আমাকে তোমার বোন মনে হয়? আমি তোমার বোন? এটাই ভাবো তুমি?”

“এটা তো জাস্ট উদাহরণ দিলাম। কেন, এই উদাহরণে খুশি হওনি তুমি? কী রকম উদাহরণ আশা করেছিলে?”

মিতুল কিছুটা থতমত খেয়ে গেল। বললো,
“কোনো উদাহরণই শুনতে চাইনি আমি।”
বলেই দ্রুত আরেক লোকমা তুলে জোহানের মুখে পুরে দিলো।

জোহান মনে মনে হাসলো। তারপর মুখের খাবার টুকু গিলে বললো,
“অনেক লাভার্সরাও কিন্তু একে অপরকে খাইয়ে দেয়।”

জোহানের কথায় মিতুলের দম বন্ধ হয়ে এলো। ভিতরটা ছটফট করছে আবার।

মিতুল জোহানকে খুব কষ্টে খাওয়ানো সম্পন্ন করলো। তারপর প্লেট নিয়ে চলে এলো কিচেনে। প্লেট ধৌত করলো। বিকেল প্রায় শেষের পথে। একটু পরই বোধহয় সন্ধ্যা নেমে যাবে।
মিতুল লিভিং রুমে ফিরে দেয়াল ঘেঁষে রাখা টি টেবিলের উপর প্লেটটা রাখলো।
টি টেবিলটা কাউচের সামনে থেকে এনে যথা স্থানে রেখে দিয়েছে আবার।

জোহান মোবাইলে কী একটা যেন দেখতে দেখতে বললো,
“মিতুল এদিকে এসো।”

মিতুল কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে এলো। কাউচে বসে উঁকি দিলো মোবাইলে। দেখলো জোহান অনলাইনে একটা গেস্ট হাউজের পিক দেখছে।

“আমরা ফ্রেন্ডসরা সবাই ঠিক করেছি ঘুরতে যাব পরের সপ্তাহে। ঘুরতে গিয়ে এই গেস্ট হাউজে উঠবো আমরা।”

“কোথায় এটা?”

“এটা গ্রামের ওদিকে। তুমি চিনবে না।”

“ও।”

মিতুল উইন্ডো দিয়ে বাইরে তাকালো। পরিবেশ ধীরে ধীরে অন্ধকার হতে শুরু করেছে। বললো,
“আচ্ছা এখন আমি যাচ্ছি। রাত হয়ে যাবে কিছুক্ষণ পর।”

জোহান বললো,
“চলে যাবে?”

মিতুল মাথা নেড়ে বললো,
“হুম।”
বলে উঠে দাঁড়ালো। যাবে বলে এক পা বাড়াবে কি বাড়াবে না এর মধ্যেই জোহান ওর হাত ধরে টান দিলো। মিতুল আবারও বসে পড়লো কাউচের উপর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জোহান শুয়ে পড়লো ওর কোলে মাথা রেখে।
হঠাৎ করে এমন হওয়ায় গা শিউরে উঠলো মিতুলের। জোহান চোখ বন্ধ করে নিবিড় স্বরে বললো,
“আরও কিছুক্ষণ থাকো আমার সাথে। আমার এই টাইম হাউজে আমি খুব একা। আর কিছুটা সময় থাকো তুমি।”

মিতুল বিভোর চোখে তাকিয়ে আছে। হৃদস্পন্দন শিথিল। শুধু টের পাচ্ছে ওর মনের ভিতরে দমকা হাওয়ার সাথে সাথে এক গাঢ় কোমল অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ছে আনাচে-কানাচে। সেই অনুভূতি এতটুকু পরিমাণ জায়গা ছাড়েনি। সবটাই দখল করেছে। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা দুষ্কর। এই অনুভূতি এতটাই তীব্র যে, ওর সব কিছু অবশ হয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে।

(চলবে)

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪১
____________

সূর্য ডুবে যাওয়ার পথে। প্রকৃতি তার কালো রঙের বিস্তর ছড়াচ্ছে ক্রমে ক্রমে। গাছের পাতা ঝিরিঝিরি বাতাসে হালকা দুলে উঠে একটা দুটো ঝরে পড়ছে। মিতুল অনেকক্ষণ হলো সটান হয়ে বসে আছে। একটু পরিমাণও নড়েনি। কোনো কথাও ফোঁটেনি ওর মুখে। শুধু যে ও নিশ্চুপ ছিল তা নয়, জোহানও আর একটা কথা বলেনি। পরিবেশ তাই বড়ো নিস্তব্ধ। এই নিস্তব্ধ পরিবেশে মিতুল শুধু ওর হৃদয়ের চলন উপলব্ধি করতে পারছে। ধিকিধিকি একটা বাড়ন অন্তরে।
প্রকৃতিতে ঝাপসা অন্ধকারের বিরাজ খেয়াল হতে মিতুল নিজের জাগতিক হুঁশে ফিরে আসে। বাড়ি ফিরতে হবে ওর। মিতুল জোহানের দিকে তাকালো। বন্ধ আঁখির জোহানকে খুব শান্ত, নিষ্পাপ মনে হলো ওর কাছে। মিতুলের ইচ্ছা হলো না জোহানকে ডেকে বিরক্ত করে। জোহানের বন্ধ আঁখি জোড়া খুলে যাক ও চায় না। কিন্তু ওর তো যেতে হবে। মিতুল চাইলেই সহজ ভাবে বলতে পারলো না জোহানকে। ওর গলার কাছে কিছু যেন একটা আটকে আছে। যা ওর মুখ থেকে একটি বর্ণ বের হতেও শক্তির অভাব বিলাচ্ছে। ওর কণ্ঠ বড়োই নিশ্চেষ্ট। ও মনে মনে অনেক চেষ্টা করে ইতস্তত ভাবকে কিছুটা সামাল দিলো। শেষমেশ কোনো রকম কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
“আ…আমি যাব এখন?”

জোহানের ঘুম ঘুম কণ্ঠ ভেসে এলো,
“না। আরও কিছুটা সময় থাকো।”

জোহানের কথার পর মিতুল আর কিছু বলতে পারলো না। জেদ দেখাতে পারলো না যাওয়ার। জোহানের কথাকে মেনে নিলো ওর মন। ও থাকলো। কতক্ষণ থাকলো তার হিসেব নেই। ওর কোলে মাথা রেখেই তন্দ্রাচ্ছন্নতার গহীনে হারিয়ে গেল জোহান। বাইরে অন্ধকার। সন্ধ্যা কেটে গিয়ে রাত নেমে গেছে। এবার মিতুলের উৎকণ্ঠা বাড়লো। বাড়ি ফিরতে হবে ওকে। কিন্তু ওর মন তীব্র প্রতিবাদ জানালো জোহানের ঘুম না ভাঙানোর। ও সাহস করতে পারলো না জোহানের ঘুম ভেঙে দেওয়ার। মিতুল জোহানের মাথা দুই হাত দিয়ে যতটা সম্ভব আলতো করে ধরার চেষ্টা করলো। হাত দিয়ে জোহানের মাথা ধরে রেখে উঠে গেল ও। পাশ থেকে একটা কুশন এনে দিয়ে দিলো জোহানের মাথার নিচে। জোহান এখনও তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায়ই আছে। যাক জোহানের ঘুমটা ভাঙেনি। এতক্ষণে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো ও। বাড়ি ফিরতে হবে ওর। এখনই।
মিতুল টি টেবিল থেকে ট্রে উঠিয়ে নিলো হাতে। দরজার কাছে গিয়ে ওর টনক নড়লো।
এই অন্ধকারে কী করে যাবে? মোবাইল তো সাথে করে আনেনি। মিতুলের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। বাইরে শুধুই ধূ ধূ অন্ধকার। দেখেই বুকের ভিতর ভয় দপদপ করে জেগে ওঠে। আলো ছাড়া কি এই জঙ্গল পেরোনো সম্ভব? জোৎস্না থাকলে না হয় অনায়াসেই আলো ছাড়া জঙ্গল পেরোনো যেত। কিন্তু এখন?
মিতুল জোহানের দিকে তাকালো। জোহানকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা ঘোরতর অন্যায় মনে হচ্ছে ওর কাছে। না ও জোহানকে জাগাবে না।
মিতুল বেডরুমের ওয়ার্ডোবে আলোক জাতীয় কিছু পাওয়ার আশায় খোঁজ চালালো। লাভ হলো না। কিচ্ছু নেই। জোহানের প্রতি ভারী রাগ হলো। একটা ছোটো টর্চ রাখলে কী এমন ক্ষতি হতো? এখন বাড়ি যাবে কী করে?

হঠাৎ করে জোহানের ঘুমটা ভেঙে গেল। আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো দ্রুত। পুরো লিভিং রুমে একবার চোখ বুলাতে গিয়ে মিতুলকে ফ্রিসিয়াস ফুলের উইন্ডোর কাছে দাঁড়ানো দেখলো। উইন্ডোর বাইরে তাকিয়ে দেখলো অন্ধকার হয়ে গেছে পরিবেশ।

“তুমি এখনও যাওনি?”

জোহানের কণ্ঠ কানে আসতেই মিতুল চকিতে ঘুরে তাকালো।
“উঠে গেছো তুমি?”

“হুম উঠলাম।”
জোহান কাউচ থেকে উঠে মিতুলের কাছে এলো।

মিতুল বললো,
“বাড়ি যাব কীভাবে? দেখো তাকিয়ে, বাইরে কী অন্ধকার! আমার কাছে মোবাইলও নেই।”

জোহান আর কথা বাড়ালো না। বললো,
“বাড়ি চলো।”

“তুমিও যাবে?”

“হুম। চলো।”

মিতুলও আর কথা বাড়ালো না। জোহানের পিছন পিছন টাইম হাউজ থেকে বের হলো। জোহান দরজা লক করে আগে আগে চললো। মিতুল চললো পিছন পিছন। কয়েক পা হেঁটে আসলো ওরা। এর মধ্যে কেউ কোনো কথা বলেনি। প্রথম কথা বললো জোহান,
“হেই তুলতুল, ভয় করছে তোমার?”

মিতুল পিছনে হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দিলো,
“না।”

“ভয় করলে আমার হাত ধরে হাঁটতে পারো। অনুমতি দিলাম তোমায়।”

“দরকার নেই। আমার ভয় করছে না। আমাকে কি তোমার ভীতু মনে হয়?”

“ও আচ্ছা, ভীতু নও তুমি। সাহসী মেয়ে, তাই না? তাহলে একদিন পিছন ঘুরে আমাকে দেখেই ভয়ে চিৎকার করে রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলে কেন?”

“কবে?”

“মনে পড়ছে না?”

“না পড়ছে না। এমন কিছু ঘটেছে? মনে পড়বে কী?” মিতুল সরাসরি অস্বীকার করলো জোহানের কথাটি।

“ঠিক আছে, এখন মনে না পড়লে সমস্যা নেই। পড়ে যাবে ধীরে ধীরে।”
জোহান কথা শেষ করে দাঁড়িয়ে গেল।
জোহানকে দাঁড়াতে দেখে মিতুলও দাঁড়ালো।
জোহান বললো,
“হাত না ধরো, আমার সামনে এসে হাঁটো।”

“কেন?”

“জানতে হবে না তোমার। যা বলছি তাই করো।”

মিতুল আর কিছু না বলে জোহানের পাশ কাটিয়ে সামনে এলো। আবার চুপচাপ হাঁটতে লাগলো দুজনে।

বাড়ি ফিরে ওদের প্রথম দেখা হয়ে গেল রেশমীর সাথে। রেশমী হলরুমে বসে হিসাব-নিকাশ করছিলেন শপ সম্পর্কিত। ওদের এক সাথে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি।
মিতুলের মাঝে ভয় ভয় একটা ব্যাপার জেগে উঠছে। রেশমী আন্টি আজ হলরুম ছাড়া আর কোনো জায়গা পেল না বসার?

“তোমরা দুজন একসাথে কোত্থেকে আসলে?”

মিতুল জানতো রেশমী আন্টি এই প্রশ্ন করবে। আর এই প্রশ্নেই যত ভয় ওর। জোহানের সাথে ছিল কথাটা বলতে গেলেই ভয়, সংকোচ সব পেয়ে বসে ওকে। কী করে বলবে এখন, ও জোহানের সাথে ছিল এতক্ষণ! জোহানের টাইম হাউজ থেকে এসেছে! মিতুল আমতা আমতা করে বললো,
“আসলে আন্টি, আমরা…”

“গার্ডেনে ছিলাম।” মিতুলের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললো জোহান।

মিতুল অবাক হয়ে তাকালো জোহানের দিকে। গার্ডেন?

রেশমী বললেন,
“গার্ডেনে ছিলে?”

“ইয়েস মম। আমি গার্ডেনে দাঁড়িয়ে মনে মনে গান ভাবছিলাম। সেই সময় ও গার্ডেনে গিয়েছিল লেবু আনতে।”

গার্ডেন! লেবু! এসব কী বলছে জোহান? এমন একটা মিথ্যা কথা বললো কেন? আর কিছু পেল না বলার? রেশমী আন্টি যদি একটু আগেও গার্ডেনে গিয়ে থাকে, তখন? তখন কী করবে? কী জবাব দেবে রেশমী আন্টিকে? ইশ, মিথ্যা বলতেও জানে না ছেলেটা।

“লেবু এনেছো মিতুল?”

রেশমী আন্টির কথায় সম্বিৎ ফিরলো মিতুলের।
“হ্যাঁ? লেবু? না লেবু তো আনিনি আন্টি। লেবুগুলো দেখে মনে হলো এখনও খুব ছোটো, তাই না নিয়েই চলে এসেছি।”

“ও, ঠিক আছে। রুমে যাও তোমরা।”

মিতুলের বুক চিরে স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো ফোঁস করে। যাক, বিশ্বাস করেছে রেশমী আন্টি।
মিতুল আগে আগে পা বাড়ালো।

রুমের দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই শুনতে পেল জোহানের কণ্ঠ।
“তোমার জন্য মিথ্যা বললাম মমকে।”

মিতুল জোহানের দিকে তাকালো। জোহান নিজের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে। মিতুল বললো,
“মানে?”

জোহান আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে মিতুলের কাছে এগিয়ে এলো। গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললো,
“মানে হলো, তুমি তো মমকে আমার কথা বলো না। আমার সাথে থাকলে সেটাকে অন্যরকম ভাবে উপস্থাপন করো মমের কাছে। যার প্রমাণ, ওই যে আতশবাজি দেখিয়ে ছিলাম তোমাকে, সেদিনই পেয়েছি। আমি চাইলেই বলে দিতে পারতাম মমকে, যে তুমি আমার সাথে টাইম হাউজে ছিলে। কিন্তু বললাম না শুধু তোমার জন্য। যেহেতু তুমি মমকে বলো না তুমি আমার সাথে ছিলে। তাই আমিও আজকে বললাম না।”
জোহান কণ্ঠটাকে কিছুটা অন্যরকম করে বললো,
“আর তাছাড়া, তুমি নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছিলে আমাকে, তোমার কোলে মাথা রেখে শুয়েছিলাম আমি, এসব কথা কি আর মমকে বলা যায়?”
একটু হাসলো জোহান। তারপর নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো।

মিতুলও নিজের অজান্তে হেসে রুমে ঢুকে গেল।

______________

মিতুলের ঘুম ভাঙলো মোবাইলে কল আসার শব্দে। বিছানা হাতড়ে মোবাইলটা পেল। পিটপিট চোখে স্কিনে কার্লের নাম দেখে ঘুম উবে গেল ওর। গায়ের কম্বল এক টানে সরিয়ে উঠে বসলো ও। কার্ল? কার্ল কেন ফোন করেছে? মিতুল কী করবে বুঝতে পারছে না। কার্লের ফোন ধরা অসম্ভব ওর কাছে। কিছুতেই কার্লের কল রিসিভ করবে না ও। কার্লের গলা শুনলেই ওর বুকে ব্যথা হবে। না, পারবে না ও। প্রথম কলটা রিং বাজতে বাজতেই কেটে গেল। পরে আবার ফোন করলো কার্ল। উহ, কী করবে? ওর অস্থির লাগছে। কল রিসিভ না করলে কার্ল কী ভাববে? মিতুল নিজেকে শান্ত করে কাঁপা কাঁপা হাতে কল রিসিভ করে কানে ধরলো।
“হ্যালো!”

“হাই রাবা। হাউ আর ইউ?”

কার্লের কণ্ঠ মিতুলের ভিতরটা দগ্ধ করে দিলো। মনে হচ্ছে পুড়ে যাচ্ছে ওর হৃদয়। হ্যাঁ, এই তো। ও হৃদয় পোড়ার গন্ধ শুকতে পারছে। মিতুল কষ্ট চেপে রেখে স্বাভাবিক ভাবে বলার চেষ্টা করলো,
“ভালো আছি। তুমি?”

“আমিও ভালো। অনেক দিন হয়ে গেল তোমার কোনো খোঁজ নেই। ভাবলাম কিছু হয়েছে কি না। তাই ফোন করলাম।”

“না, কিছু হয়নি আমার। ঠিক আছি। আসলে তোমার রেস্টুরেন্টের ওদিকে যাওয়া হয় না। এসব ছাড়ো। বলো, অলিভার কেমন আছে?”

“হ্যাঁ, ভালো আছে। তুমি আজকে আসো না রেস্টুরেন্টে। গল্প হতো তোমার সাথে।”

“আমি স্যরি কার্ল। যেতে পারব না। জোহানের সাথে ক্যালগারি ঘুরতে যাব আমি। এখনই রেডি হতে হবে আমাকে। আমি রাখছি। পরে কথা হবে আবার।”
মিতুল কার্লকে মিথ্যা বলে ফোন কেটে দিলো। বুকের সাথে চেপে ধরলো মোবাইলটা। কতদিন পর কার্লের সাথে কথা বললো। কতদিন! বুকের ভিতর কেমন একটা চাপা কষ্ট হচ্ছে। কার্ল! ওর প্রথম প্রেম!

_______________

জোহানের সামনে পড়তেও মিতুলের লজ্জা লজ্জা লাগে। কেন এই লজ্জা লজ্জা লাগা, সেটা বুঝছে না ও। কালকের পর থেকেই কী যেন হয়েছে ওর। জোহানকে অন্যরকম লাগে এখন। কেমন লাগে সেটা বলতে পারবে না। ও নিজেই বুঝে উঠতে পারছে না সেটা। সকাল থেকে খুব একটা জোহানের সামনে পড়েনি। পড়লেও অল্পতে এড়িয়ে এসেছে।
সকালে কার্লের কল পাওয়ার পর থেকে মন একটু খারাপ ছিল। কিন্তু জোহানকে দেখার পরপরই ওর মন খারাপি রইল না আর। ভালো হয়ে গেছে ওর মন। কার্লের কথা মনেই পড়ছে না বলতে গেলে। আজকের পরিবেশটাও খুব ভালো লাগছে। বিকেলের এই মৃদুমন্দ বাতাস, বসন্ত ফুলের সুবাস, সব কিছুই ভারী মিষ্টি লাগছে। এই তো এখনই একটা প্রজাপতি ঠিক ওর সামনে দিয়ে উড়ে চলে গেল। নীল, কালো পাখনার প্রজাপতিটা দেখতে কী সুন্দর ছিল! আনমনে হেসে ফেললো মিতুল।
বারান্দার আর্ম চেয়ারের একটা দখল করে বসে আছে ও। বারান্দায় থাকা ফুলের টব থেকে নাম না জানা একটা ফুল তুলে কানে গুঁজেছে। ফুলটা লাল রঙা। দেখতে দারুণ। সুবাস নেই কোনো। সুবাসের কী দরকার? দেখতে যেমন সুন্দর তাতে সুবাসের প্রয়োজন পড়ে না।

“এই নাও।”

মিতুলের ভাবন ঘরে হানা পড়লো জোহানের, ‘এই নাও’ দুটি শব্দের বাক্যতে।
জোহান ওর দিকে কফির মগ বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও তাকাতেই জোহান বললো,
“আনমনে কাকে ভাবছিলে?”

“কাউকে না তো।”
বলে মিতুল জোহানের হাত থেকে কফির মগটা নিলো।
জোহান ওর পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
“ভেবো না যে আমি কফি বানিয়ে এনেছি তোমার জন্য। ক্যামিলা দুই মগ কফি হাতে দিয়ে বললো, এক মগ তুমি খাও, আর এক মগ মিতুলকে দাও। তাই নিয়ে এলাম। শুধুমাত্র ক্যামিলার কথায়।”

মিতুলের একটু অভিমান হলো। কেন? জোহান নিজ হাতে ওর জন্য কফি বানিয়ে আনলে কী ক্ষতি হতো?
মিতুল মনে মনে এটা ভাবলেও, বাইরে এর বিন্দুমাত্র কিছু ধরা দিলো না। বারান্দা জুড়ে নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেল। না মিতুল কোনো কথা বললো, আর না জোহান। মিতুল কথা বলবে কী? ওর মাথাতেই কিছু আসছে না। চুপচাপ কিছুক্ষণ কফির মগে চুমুক চললো।

হঠাৎ শুনতে পেল জোহান বলছে,
“তোমার সমস্যা কী তুলতুল? তুমি কফি পান করছো? না কি পানি? কফি আর পানির তফাৎ গুলিয়ে ফেলেছো তুমি? একটা ঘোড়ার মতো কফি পান করছো কেন তুমি?”

মিতুলের সারা শরীর অপমানে জর্জরিত হলো। ঘোড়ার মতো! এটাই বললো জোহান? আগুন জ্বলে গেল ওর মাথায়। ইচ্ছে করছে এই কফি জোহানের মুখে ছুঁড়ে মেরে কফি খাওয়া শিখিয়ে দিতে। কিন্তু সেটা তো পারবে না ও। মিতুল চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে তারস্বরে বলে উঠলো,
“ঘোড়ার মতো কফি পান করি আমি? আমি ঘোড়া? আমাকে ঘোড়া বলতে গলা কাঁপলো না তোমার? যখন ইচ্ছা তখন তুমি অপমান করো আমাকে! কেন? আমাকে কি তোমার মোমের তৈরি একটা পুতুল মনে হয়? আমার মন নেই? কষ্ট পাই না আমি? ভেবেছিলাম অপমান জিনিসটা আমার পিছু ছেড়ে দিয়েছে। না, ছাড়লো না। এই ইহজনমে অপমান জিনিসটা পিছু ছাড়বে না আমার। তুমি ছাড়তে দেবে না। টেনে ধরে বসবে তুমি। কেন? এত অপমান কেন করো তুমি আমাকে? কী শান্তি পাও আমাকে অপমান করে? আমাকে অপমান করবে বলেই কি জন্মগ্রহণ করেছো তুমি? আমাকে অপমান না করলে কি তোমার রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়?”
মিতুল হাতের মগটা রাগ, অভিমানে ছুঁড়ে ফেললো ফ্লোরে। তারপর হনহন করে হেঁটে চললো।

জোহান পিছন থেকে বললো,
“হেই, তুমি কফির মগ ছুঁড়ে মেরেছো কেন? যদি এটা ভেঙে যেত তাহলে কী হতো? কে জবাবদিহিতা করতো এর জন্য? আমি যেগুলো ভাঙবো, সেগুলোর ব্যাপারে জবাবদিহি করবো আমি। কিন্তু তুমি ভাঙলে সেটা দেখার বিষয় আমার না।”

জোহানের কোনো কথাই মিতুলকে থামাতে পারলো না। বরং ওর চলার গতি আরও বেড়ে গেল। ওর থেকে একটা মগের জন্য জোহানের দরদ বেশি? মিতুলের কান্না পেয়ে যাচ্ছে। হনহনিয়ে চলে গেল ও।

জোহান ফ্লোর থেকে মগটা উঠালো।
ওর মগে কফির যে অংশটুকু বাকি ছিল তা এক চুমুকে শেষ করে দৌঁড়ে এলো। মিতুল প্রায় নিজের রুমের কাছাকাছি।
জোহান পিছন থেকে দৌঁড়ে এসে পথ আটকে ধরলো ওর। থেমে যেতে হলো মিতুলকে।
জোহান শান্ত সহজ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কী পছন্দ করো তুমি সবচেয়ে?”

“এই মুহূর্তে কানাডা থেকে চলে যাওয়াটাই সবচেয়ে বেশি পছন্দ আমার।” জেদের সাথে বললো মিতুল।

“নো তুলতুল, এভাবে তো যেতে দেবো না তোমাকে। তোমাকে কিছু দেওয়ার আছে আমার। নেবে না সেটা? আমি মনে করি সেটা নিয়েই ফেরা উচিত তোমার।”

“এত এত অপমান করেও আর কী দেওয়ার বাকি আছে তোমার? কী দেবে?”

“সন্ধ্যায় রেডি হয়ে থেকো, দেখতে পাবে।”
বলে হাসলো জোহান। তারপর যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। কতক দূর গিয়ে থামলো আবার।
ফিরে এলো মিতুলের কাছে। মিতুলের কানে গুঁজে রাখা ফুলটা নিয়ে নিলো।

“এই ফুল আমার ব্রাদারের প্রিয়। আমার নয়।”
বলে ফুলটা নিয়ে চলে গেল জোহান।

মিতুল কিছুই বুঝতে পারলো না। কী বলে গেল জোহান? ওই ফুল ওর ব্রাদারের প্রিয়, কিন্তু ওর প্রিয় না। সেটা ওকে শোনালো কেন?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here