চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা,৪৮,৪৯

0
771

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা,৪৮,৪৯
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪৮
____________

দুই দিনের ট্রিপ শেষে এডমন্টনে ফিরছে ওরা। বানফ এবং ক্যালগারিকে পিছনে ফেলে গাড়ি এডমন্টনে প্রবেশ করেছে। মিতুল ড্রাইভিং সিটের পাশে বিবশ মুখ নিয়ে বসে আছে। একটু পর পর আবার পিছন ফিরে ক্যামিলাকে দেখছে একনজর। ও ভাবতে পারেনি ক্যামিলার ওই সুন্দর মুখের পিছনে একটা বিষণ্নতার গল্প আছে। ঠকে যাওয়ার গল্প আছে। কালকে রাতেই ক্যামিলার জীবনের গল্প শুনেছে ও। ক্যামিলা অনাথ। কেউ নেই ওর এখন। ক্যামিলার যখন ছয় বছর বয়স তখন তার বাবা মারা যায়। মায়ের সাথেই ছিল ক্যামিলা। কিন্তু মা’ও মারা যায় ক্যামিলার বিয়ের পর। উনিশ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল ক্যামিলার। লাভ ম্যারেজ। ক্যামিলার বিয়ের এক মাসের মাথাতেই মারা যায় তার মা। ক্যামিলা হাসব্যান্ডকে নিয়ে নিজ বাড়িতেই থাকতো। প্রথম দিকে কয়েক মাস দুজনের সংসার ভালোই ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সংসারটা অন্যরকম হয়ে উঠেছিল। টুকিটাকি বিষয় নিয়েও অনেক ঝগড়া করতো ক্যামিলার হাসব্যান্ড।
বিয়ের নয় মাসের মাথায় ক্যামিলা প্রেগন্যান্ট হলো। ক্যামিলার ধারণা ছিল তার হাসব্যান্ড খুশি হবে। কিন্তু হলো না। তার হাসব্যান্ড বললো, বাচ্চাটা নষ্ট করে দিতে। ক্যামিলা রাজি ছিল না। প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর দুজনের ভিতরের ঝামেলা আরও অনেক বেশি বেড়ে গেল। রোজ ঝগড়া-ঝাটি চলতেই লাগলো। প্রেগন্যান্সির যখন আট মাস চলে, তখন হঠাৎ ক্যামিলার হাসব্যান্ড উধাও হয়ে গেল। শুধু যে একা উধাও হলো তা নয়। ক্যামিলার জমানো সমস্ত ডলার নিয়ে ফেরারি হলো সে। ক্যামিলা ভেঙে পড়লো। নিঃস্ব হয়ে গেল একেবারে। ক্যামিলার আপন বলতে কেউ ছিল না যে তাকে সাহায্য করবে। অনেক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাচ্চাকে পৃথিবীর আলো দেখালো। কিন্তু ভাগ্য ছিল বড়ো নির্মম। বাচ্চাটার দুই মাস হতে চারদিন বাকি ছিল, তখনই বাচ্চাটা মারা গেল! ক্যামিলা আরও বেশি ভেঙে পড়লো। নিজের এমন দুরবস্থায় পাশে পেয়েছিল জোহানের ফ্যামিলিকে। জোহানের ফ্যামিলির অনুপ্রেরণাতেই নিজেকে সামলে নেয় ক্যামিলা। নতুন একটা জীবন শুরু করার জন্য উঠে দাঁড়ায় আবার।
এর মাঝে একদিন খবর পায় তার হাসব্যান্ড ক্যুবেক সিটিতে আছে। সেখানে নিজের নতুন সংসার নিয়ে ব্যস্ত সে। ক্যামিলা আরও জানতে পারে, তাদের বিয়ের চার মাসের মধ্যেই তার হাসব্যান্ড অন্য একটা রিলেশনে জড়িয়ে গিয়েছিল। তবে বর্তমানে ক্যামিলার হাসব্যান্ড সেই মেয়েটিকে নিয়েও থাকছে না। অন্য আরেকটি মেয়েকে নিয়ে সংসার পেতেছে সে।

মিতুল কালকে এতকিছু জানলো শুধু একটা ছবির কারণে। কালকে যখন লেক মিনেওয়াঙ্কা এবং পেটু লেক ঘুরতে গিয়েছিল, তখন মিতুল নিজের একটা পানির বোতল রেখেছিল ক্যামিলার ব্যাগে। হোটেলে ফিরে যখন সেই বোতল আবার ক্যামিলার ব্যাগ থেকে বের করতে গেল, তখন একটা ছবি দেখেছিল ক্যামিলার ব্যাগে। একটা ছোটো বাচ্চার সাথে ক্যামিলার ছবি। বাচ্চাটি কে, সেটা জিজ্ঞেস করতেই কথায় কথায় ক্যামিলার পুরো জীবন কাহিনী শুনে নিলো মিতুল। ক্যামিলার জন্য খুব খারাপ লাগছে ওর। এই খারাপ লাগাটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না। মিতুল বড়ো করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ভালোবেসে কেন ঠকতে হবে?
মিতুল উইন্ডোর বাইরে থেকে চোখ ফিরিয়ে আনলো। জোহানের দিকে তাকালো। জোহানের ওই মুখটা দেখেই ও বলে দিতে পারে, ও কোনোদিনও ঠকবে না। ওদের ভালোবাসার মাঝে কখনো বিশ্বাস ঘাতকতা স্থান পাবে না।

_______________

মিতুলের বাংলাদেশ ফেরার সমস্ত বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। কাল বাদে পরশুই ফ্লাইট। সকাল নয়টার ফ্লাইটে ক্যালগারি থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হবে ও। আর মাত্র দুই দিন আছে এই কানাডা। ভাবতেই হৃদয় কষ্টের খরস্রোতে ভেসে যাচ্ছে। কানাডা আসার আগে কি একবারও ভেবেছিল এমন হবে? ভাবেনি। জোহানকে ছাড়া থাকতে যে বড্ড কষ্ট হবে ওর!

“তুমি কি বোরিং ফিল করছো? সং প্লে করে দেবো?” পাশ থেকে জোহানের কণ্ঠস্বরে মিতুলের ভাবনায় ছেদ পড়লো। মিতুল নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো। বললো,
“না, আমি বোরিং ফিল করছি না।”

“তাহলে এত চুপচাপ কেন? পার্টিতে যাচ্ছ, খুশি থাকা উচিত তো তোমার।”

জোহানের ব্ল্যাক কারটি রিকার্ডোর ফ্ল্যাটের দিকে যাত্রা শুরু করেছে। মিতুলের জন্য ডিনার পার্টির আয়োজন করা হয়েছে রিকার্ডোর ফ্ল্যাটে। এটাকে আসলে মিতুলের বিদায়কালীন পার্টি বলা চলে।

মিতুলকে চুপ দেখে জোহান নিজেই বললো,
“বাংলাদেশ গিয়ে আমাকে ছেড়ে কীভাবে থাকবে সেটাই ভাবছো তুমি, তাই না?”

মিতুল স্বীকার করলো না। বললো,
“আমি সেটা ভাবছি না। অন্যকিছু ভাবছি।”

“অন্যকিছু? কী সেটা?”

মিতুল সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারলো না। একটু ভাবতে হলো। বললো,
“কানাডা থেকে যাওয়ার দিন কী পরে যাব সেটাই ভাবছি। স্কার্ট, টপস পরে গেলে ভালো হবে মনে হচ্ছে।”

“তাই? তুমি মনে মনে স্কার্ট-টপস নিয়ে ভাবনার আসর বসিয়েছিলে?”

“হুম।”

“মিথ্যা কথা।”

“মোটেই মিথ্যা নয়। আমি এটাই ভাবছিলাম।”

“আমাকে বোকা মনে করো? আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি তুমি আমাকে ভাবছিলে। আমাকে ছাড়া কীভাবে থাকবে সেটাই ভাবছিলে।”

জোহানের মুখ থেকে সহজ ভাবে এই কথাগুলো শুনে মিতুলের মনের এক কোণে কষ্ট মেঘেরা জড়ো হয়ে আঁধার করে ফেলেছে। কান্না পেয়ে গেল ওর। মিতুল জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। চোখের পাতা ভিজে উঠছে। মিতুল মনের ভিতরের কথাটা আর চেপে রাখতে পারল না। বলেই দিলো,
“বাংলাদেশ চলে যাওয়ার পর তোমাকে আমি খুবই মিস করবো জোহান। ভীষণ মনে পড়বে তোমায়।”

মিতুলের কথা শুনে জোহানের বুকের মাঝটাতে চিনচিনে এক ব্যথায় ছেয়ে গেল। মিতুল চলে যাবে সেজন্য এমনিতেই মন খারাপ ওর। অস্থিরতায় সময় পার করছে কিছু দিন ধরে। এবার মন খারাপের পাল্লাটা আরও ভারী হলো। যদিও সেটা ধরা দিতে চায় না মিতুলের কাছে। মিতুল যখন চলে যাবে তখন মিতুলের সাথে থাকতেও পারবে না ও। মিতুলকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ছাড়তে পারবে না। কারণ, মিতুলের আগে নিজেকেই টরোন্টো যাওয়ার ফ্লাইট ধরতে হবে। কয়েকদিন পরই টরোন্টোতে এক বিশাল ফেস্টিবলের আয়োজন করা হচ্ছে। এটা সত্যিই খুব বিশাল আয়োজন। সেখানে অংশগ্রহণ করার জন্য আগে ভাগেই যেতে হবে ওর। ওখানে অংশগ্রহণ করলে ওর গানের ব্যাপারটার ভালো উন্নতি হবে বলেই ধারণা জোহানের। সেজন্য এই বিষয়টিকে হালকা করে দেখছে না। মিতুলের যেদিন ফ্লাইট, সেদিন সকাল ছয়টার ফ্লাইটে টরন্টো চলে যাবে ও।

জোহান মন খারাপের ব্যাপারটা মিতুলের কাছে ধরা না দিয়ে, উল্টো মিতুলের সাথে মজা করে বললো,
“একটা কাজ করা যায় তুলতুল। বাংলাদেশ চলে যাওয়ার পর যখন তুমি আমাকে এতই মিস করবে, তখন তোমার যাওয়ারই দরকার নেই বাংলাদেশ। অবৈধ উপায়ে এখানেই থেকে যাও। বানফের লেক লুইসের নিচে আমরা ছোট্ট একটা ঘর বানাবো। ঠিক আমার টাইম হাউজের মতো। ওটার ভিতরেই দুজনে আত্মগোপন করে থাকবো। আমাদের যখন ক্ষুধা লাগবে, তখন আমরা একটু পানি খাবো। তোমার যদি পানি ছাড়া আরও কিছু খেতে ইচ্ছা করে, তাহলে ক্যামিলাকে বলবো কিছু খাবার এনে ঠিক আমাদের ঘর বরাবর ছুঁড়ে মারতে। আমরা টুকিটাকি খাবার এবং অফুরন্ত পানি খেয়ে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেবো লেক লুইসের নিচে। কেউ কোনোদিন জানতেও পারবে না, মিতুল নামের একজন বাংলাদেশি অবৈধ ভাবে কানাডা রয়ে গেছে জো নামের এক কানাডিয়ান এবং বেঙ্গলি ছেলের জন্য।”

জোহানের বলা প্রতিটি শব্দ মিতুলের মাঝে রাগ ছড়িয়ে দিলো। ও এত সিরিয়াস ভাবে বললো কথাটা, আর জোহান মজা করছে সেটা নিয়ে? মিতুল রাগে ফুঁসে উঠলো।
“গাড়ি থামাও।”

“গাড়ি থামাবো কেন? আমার দেওয়া আইডিয়াটা তোমার পছন্দ হয়েছে কি না সেটা বলো তুমি। মুখ দিয়ে শুধু হ্যাঁ অথবা না বলো। এরপর কী করে ওখানে ঘর উঠাতে হবে, সেটা আমি বুঝে নেবো। আচ্ছা, ওই ঘরের নাম কী দেওয়া যায় বলো তো? এই নামটা কেমন? ‘মানুষ থেকে মারমেইড হতে চাওয়া বৃথা চেষ্টাকারী জো, তুলতুলের সিক্রেট হাউজ’! এটা সুন্দর হবে না?”

মিতুলের রাগ এখন গুরুতর অবস্থায়। মিতুল হুংকার দিয়ে বললো,
“গাড়ি থামাও।”

“কেন? আমরা তো ডিনার পার্টিতে যাচ্ছি। সেখানে না গিয়ে এখানে গাড়ি থামবো কেন? এই মাঝপথে গাড়ি থাম…”

“আমি কোথাও যাব না তোমার সাথে। তুমি এখানেই গাড়ি থামাও।” মিতুল জোহানের কথা শেষ না করতে দিয়েই বলে উঠলো।

“গাড়ি থামানো সম্ভব নয়। কানাডায় যেখানে-সেখানে গাড়ি থামানো যায় না। পুলিশ দেখতে পেলে জরিমানার বিশাল এমাউন্ট হাতে ধরিয়ে দেবে। আমি এই বিশাল এমাউন্টের জরিমানার ভার সামলাতে পারবো না। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, আজকের ডিনার পার্টি আমার জন্য নয়। তোমার জন্য। আমার ফ্রেন্ডসরা এত কষ্ট করে তোমার জন্য ডিনার পার্টির আয়োজন করলো, আর তুমি সেখানে যাবে না? আমার ফ্রেন্ডসরা তোমার সম্পর্কে কী ভাববে বলো তো?”

মিতুল একটু শান্ত হলো। কিন্তু ভিতরে রাগ, অভিমান রয়ে গেল।
মাত্র কিছুক্ষণের মধ্যেই বিশাল এপার্টমেন্টে পৌঁছে গেল ওরা। মিতুল এর মাঝে জোহানের সাথে আর একবারের জন্যও মুখ খোলেনি। প্রথম মুখ খুললো লিফটে উঠে। জোহান নয় নম্বর ফ্লোরের বাটন চাপতেই মিতুল তীব্র রাগ-অভিমান নিয়ে বললো,
“আমি যখন যাই বলি, তাই তোমার কাছে মজা মনে হয়, তাই না? আমি তোমাকে মিস করবো বললাম, সেটা নিয়েও তুমি মজা করলে! তোমার কি মন নেই? হার্টলেস তুমি?”

মিতুলের কথা শেষ হতেই জোহান মিতুলের ডান হাত এনে নিজের বুকের বাম পাশে রাখলো।
হঠাৎ এমন করায় মিতুল একটু চমকালো।
জোহান শান্ত কণ্ঠে বললো,
“মন আছে কি না নিজেই দেখো সেটা। উপলব্ধি করতে পারছো কিছু? কী মনে হয়? মন আছে আমার? হৃদয়ের কী খবর? কী চলছে আমার হৃদয়ে? নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছ এখানটায়?”

জোহানের শান্ত চোখের চাহনিতে এবং কথাগুলো শুনে দুর্বল হয়ে পড়ছে মিতুল। ভিতরের রাগটা উধাও হয়ে গিয়ে অদ্ভুত একটা অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে। জোহানের ওই বাদামি চোখে যতই চেয়ে থাকছে, ততই দুর্বল হচ্ছে ও। দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে আসছে। মিতুল দ্রুত চোখ সরিয়ে ফেললো। জোহানের হৃদয়ের চলন উপলব্ধি করতে পারছে ও। মিতুল আরও ভালো করে উপলব্ধি করার চেষ্টা করলো। ওর মনে হচ্ছে জোহানের হৃদয়ের সবটা জুড়েই ও। জোহানের হৃদয়ের চলন উপলব্ধি করতে করতে হঠাৎ ওর হৃদয়ও তাল হারিয়ে ফেললো। হৃদস্পন্দন বাড়তে লাগলো। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ওর।
মিতুল নিজের হাতটা জোহানের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনতে চাইলেই, জোহান আরও শক্ত করে হাতটা বুকে চেপে ধরলো। বললো,
“হেই মিতুল, এমন কেন করছো তুমি! একটু স্থির হয়ে থাকো না।”

জোহানের কথায় একেবারে স্ট্যাচুর মতো হয়ে গেল মিতুল।
জোহান বললো,
“কী আছে আমার হৃদয়ে? উপলব্ধি করতে পারছো সেটা? যদি পারো, বলো তাহলে।”

মিতুলের দৃষ্টি আবারও জোহানের বাদামি চোখ জোড়ার উপর পড়লো। নিঃশ্বাস বোধহয় সত্যিই বন্ধ হয়ে যাবে। কী বলবে ও জোহানকে? গলাটাও যে ভীষণ কাঁপছে। মিতুল কাঁপা কাঁপা গলাতেই কোনো রকম উচ্চারণ করলো,
“আমি কিছু উপলব্ধি করতে পারছি না।”

“পারছো না? না কি পেরেও সেটা বলতে চাইছো না? কোনটা? সত্যি করে বলো, কী উপলব্ধি করতে পারছো তুমি?”

লিফট এসে নয় নাম্বার ফ্লোরে থামলো। দরজা খুলে যেতেই মিতুল কোনো কথা ছাড়াই হাতটা দ্রুত ছাড়িয়ে নিলো। আগে আগে বেরিয়ে গেল লিফট থেকে। একেবারে রিকার্ডোর ফ্ল্যাটের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। জোহান এসে নক করলো ডোরে। লেনি দরজা খুলে দিলো। লেনিকে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো মিতুল।
লেনি স্বাভাবিক ভাবে হেসে ভিতরে প্রবেশ করতে বললো ওদের।
লেনির হাসি দেখে মিতুলের অপ্রস্তুত ভাবটা কেটে গেল।

রিকার্ডোর ফ্ল্যাটে ঢুকেই মিতুলের মন একদম ভালো হয়ে গেল। প্রথম যেদিন জোহান ওকে নিজের ফ্রেন্ডসদের মাঝে নিয়ে এসেছিল, সেই দিনের মতো ফিল হচ্ছে ওর। সেদিন যারা উপস্থিত ছিল, আজও তারা সবাই আছে এখানে।

খাওয়া-দাওয়া শেষে একটা গিফট বক্স দেওয়া হলো মিতুলকে। মিতুল যেহেতু কানাডা থেকে চলে যাচ্ছে, সেজন্য জোহানের সব ফ্রেন্ডসরা মিলে এই গিফট দিলো মিতুলকে।
গিফট বক্সটা বড়ো এবং একটু ভারী। কী আছে ভিতরে জানা নেই মিতুলের। বাড়িতে গিয়ে খুলে দেখতে বলা হয়েছে। জোহানের ফ্রেন্ডসগুলোও বেশ আপন হয়ে গেছে ওর। জোহানকে মনে মনে অনেকবার থ্যাঙ্কস জানিয়েছে এই মানুষগুলোর সাথে ওকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। মিতুলের এটা ভেবে শান্তি লাগে যে, জোহান বাড়িতে যেমন সময়ই কাটাক না কেন, ওর ফ্রেন্ডসদের সাথে খুব ভালো সময় কাটাবে ও। ওর ফ্রেন্ডসরা ওকে খুব ভালোবাসে।

পার্টির অনেকটা সময়ই মিতুল জোহানকে দেখেছে চুপিচুপি। ওর দু চোখ শুধু জোহানের দিকেই ছুটে গেছে। জোহানকে দেখার তৃষ্ণা যেন ওর মিটছে না। মনে হচ্ছে জোহানকে সামনে বসিয়ে রেখে সারাদিন দেখলেও এই তৃষ্ণা মিটবে না। এমন কেন হচ্ছে? কানাডা থেকে চলে যাবে বলে?

জোহান, মিতুল রিকার্ডোর ফ্ল্যাট থেকে বের হলো। লিফটে ঢুকে এক কোণে চুপচাপ দাঁড়ালো মিতুল। জোহান ঢুকে বাটন চাপলো। মিতুলের থেকে একটু দূরে দাঁড়ালো জোহান।
মিতুল জোহানের দিকে তাকিয়ে রইল। সত্যিই কানাডা থেকে চলে যেতে অনেক কষ্ট হবে ওর। জোহানকে না দেখে থাকবে কীভাবে? জোহানকে প্রতিটা মুহূর্তে মিস করবে। একটা মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারবে না জোহানকে। জোহানের হাস্যজ্জ্বল মুখটা সবসময় মনে গেঁথে থাকবে। মিতুল জোহানের দিকে তাকিয়ে থেকেই এগিয়ে এলো জোহানের দিকে। জোহানের সামনে এসে দাঁড়ালো।
জোহান বললো,
“কী?”

মিতুল কিছু না বলে নিজের ডান হাত রাখলো জোহানের বুকের বাঁ পাশে। ঠিক হৃদয় বরাবর। বললো,
“আমি উপলব্ধি করতে পারি তোমার হৃদয়ে কী আছে। তোমার হৃদয়ে আমি আছি। আমার প্রতি ভালোবাসার বিস্তীর্ণ অনুভূতি আছে তোমার মনে। তোমার হৃদয়ের সব জায়গায় তোমার লিটল এঞ্জেলের অস্তিত্ব স্পষ্টতর ছড়িয়ে আছে। আমি উপলব্ধি করতে পারি সেটা। খুব সহজে টের পাই।”

জোহান কিছুটা বিস্ময়াভিভূত। খানিক সময় গভীর চোখে তাকিয়ে রইল মিতুলের দিকে। তারপর বললো,
“আর তুমি? তোমার হৃদয়ের খবর কী?”

মিতুল একটু হাসলো। বললো,
“আমার হৃদয়? আমার হৃদয় তো সবসময় বলে, ‘ভালোবাসি’। জোহানকে খুব ভালোবাসে সেটাই বলে আমার হৃদয়। কেন তুমি টের পাচ্ছ না?”

জোহান মিতুলের হাতটা ধরে বললো,
“শুধু এখন নয়, অনেক আগে থেকেই টের পাই আমি। তোমারও আগে থেকে।”

(চলবে)

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪৯
____________

রিকার্ডোদের দেওয়া গিফট বক্স খুলে মিতুল যারপরনাই অবাক। বক্সের ভিতর থেকে ছোটো ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটা হাতে তুলে নিলো মিতুল। এই ফ্রেমে বন্দি আছে ও এবং জোহান। ছবির ভিতরের জায়গাটা লেক লুইস। লেক লুইসের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে ও আর জোহান। মিতুল মুগ্ধমনা হয়ে তাকিয়ে আছে দূরে লেক লুইস ঘেঁষে থাকা পাহাড়ের অপার সৌন্দর্যে। আর ঠিক ওর পাশে দাঁড়িয়েই জোহান মুগ্ধমনা হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ছবি এটাই বলছে। এই ছবিটা তোলা না হলে মিতুল কখনোই জানতে পারতো না জোহান এই সময় এভাবে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। এটা ওর দৃষ্টির অগোচরে থেকে যেত। মিতুল ভালো করে জোহানের চাহনিটা পরখ করলো। কী মায়া লুকিয়ে আছে ওই চাহনিতে! এমন মায়াবী চোখে কেউ কি এর আগে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল? না, আর কেউ তাকায়নি। মিতুলের ভিতরটা আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠলো। এই ছবি কখন, কীভাবে তোলা হলো জানে না ও। ও নিশ্চিত জোহানও জানে না। এটা ওদের অগোচরে তোলা হয়েছে। দারুণ একটি মুহূর্ত ক্যামেরা বন্দি করেছে রিকার্ডো। আর গিফট হিসেবেও চমৎকার একটা গিফট। এর থেকে চমৎকার গিফট আর কী হতে পারে?
মিতুল আবার গিফট বক্সটার দিকে তাকালো। শুধু ওর এবং জোহানের ছবি নয়, ভিতরে আরও একটা ফ্রেম বাঁধানো ছবি আছে। মিতুল সেটাও হাতে তুলে নিলো। এটার ভিতরে ওকে দেখা যাচ্ছে জোহানসহ জোহানের সব ফ্রেন্ডসদের সাথে। এটা কখন তোলা হয়েছে জানে ও। প্রথম যেদিন জোহান ওকে নিজের ফ্রেন্ডসদের সাথে মিট করাতে রিকার্ডোর বাসায় নিয়ে গিয়েছিল, তখনকার এটা। তখন সবাই মিলে একটা ছবি তোলা হয়েছিল। সেটাই এটা। মিতুল ছবি দুটো বিছানার উপর রাখলো। বক্সের ভিতর আরও কিছু আছে। দেখলো একটা অ্যালবাম। জোহানের গানের অ্যালবাম এটা। ‘Guilty Summer’!
অ্যালবামটার সাথে আবার একটি নেকলেস বক্স। এত কিছু দিয়েছে জোহানের ফ্রেন্ডসরা? মিতুল খুবই আবেগী হয়ে পড়ছে। তবে বেশিক্ষণ থাকলো না ওর এই আবেগ ঘন মুহূর্ত। ধীরে ধীরে চিন্তারা এসে ভিড় জমালো মস্তিষ্কে। ওর এবং জোহানের একই সাথে থাকা ফ্রেম বন্দি ছবিটার দিকে তাকালো। এই ছবি কোথায় লুকাবে ও? এই ছবি যদি কেউ দেখে ফেলে তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে! কোথায় লুকাবে এটা? কানাডা তো যেমন-তেমন, কিন্তু বাংলাদেশ? মা-আব্বুর চোখে যদি একবার পড়ে তাহলে তো… মিতুল একটু থমকে গেল।
কী হবে তাহলে? মাথায় এখন সেটাও আসছে না। এখন কিছুতেই মা-আব্বুর সামনে জোহানকে ভালোবাসে সেটা প্রকাশ করা যাবে না। ধীরে ধীরে এটা তাদের বোঝাতে হবে। বাড়িতে যখন বিয়ের কথা উঠবে, তখন আস্তে আস্তে বুঝিয়ে বলবে তাদের। হুট করে এই ব্যাপারটা তারা জেনে গেলে বিরাট কেলেঙ্কারি হবে। আব্বু হয়তো রাগের মাথায় বাড়ি থেকেই বের করে দেবে ওকে। নয়তো বিয়েও দিয়ে দিতে পারে! মিতুলের কিছু সময় চিন্তায় কেটে গেল। পরে আবার মাথাটা হালকা হলো। কোনো টেনশন নেই। এই ছবি লুকানোর বুদ্ধি মেহরিনের কাছ থেকে নেবে ও। মেহরিনের মাথায় ভালো ভালো বুদ্ধিই আছে। মিতুলের চোখ আবারও ছুটে গেল ওদের দুজনের ছবিটার উপর। ছবিটা তুলে নিলো হাতে। জোহানকে দেখানো উচিত এটা?
মিতুল সব গিফটগুলো আবার বক্সে ভরে জোহানের রুমের দিকে চললো। প্যাসেজওয়েতে থেকে এদিক-ওদিক চোখ বুলালো। কেউ নেই। জোহানের রুমের দরজায় আস্তে করে নক করলো। দরজা খুললো না। আবারও নক করলো। একটু পরই দরজা খুলে গেল।
জোহান মিতুলকে দেখে বললো,
“তুমি?”

মিতুল কোনো কথা না বলে জোহানকে ঠেলে রুমে ঢুকে গেল। তারপর দরজাটা চেপে বন্ধ করলো। জোহান বললো,
“এখানে এসেছো কেন?”

মিতুল গিফট বক্সটা জোহানের দিকে বাড়িয়ে দিলো।

জোহান বক্সটা না ধরে বললো,
“এটা আমাকে দিচ্ছ কেন?”

মিতুল বক্সটা বেডের উপর রাখলো এবার। বললো,
“খুলে দেখো।”

“তোমার গিফট তুমি দেখবে। আমি দেখবো কেন?”

“খুলে দেখোই না।”

জোহান বিছানায় বসে গিফট বক্সটা খুললো। সবচেয়ে উপরে ওর এবং মিতুলের সেই ছবিটা। জোহান ছবিটা দেখে থতমত খেয়ে গেল। মিতুলের অগোচরে মিতুলকে দেখছিল, আর সেটা এভাবে ফাঁস করে দিলো রিকার্ডো? জোহান বিড়বিড় করে বললো,
“রিক আর কিছু পেল না তোলার জন্য? এটাই কেন তুলতে হলো?”

জোহান কথাটা বিড়বিড় করে বললেও মিতুলের কানে এলো। বললো,
“তুললো বলেই তো জানতে পারলাম কেউ এতটা মায়াবী চোখেও তাকাতে পারে আমার দিকে।”

জোহান ভীষণ বিব্রত অবস্থায় পড়লো। মিতুলের দিকে তাকিয়ে দেখলো মিতুলের মুখে হাসি। মিতুল এগিয়ে এলো ওর কাছে। বেডে বসে বললো,
“শুধু এটা নয়। আরও দিয়েছে তোমার ফ্রেন্ডসরা।”

মিতুল সব বের করে দেখালো। জোহান সেসবে আগ্রহ খুঁজে পেল না। ওর চিন্তা আটকে আছে ওদের দুজনের একসাথে থাকা ছবিটাতে। রিকার্ডো ছবিটা তুলেছিল ঠিক আছে, কিন্তু তা মিতুলকে কেন দেখাতে হবে? রিকার্ডো আসলেই বোকা! গোপন জিনিস গোপন রাখতে জানে না।
মিতুল গিফটগুলো নিয়ে কীসব যেন বলে চলছিল। জোহানের কানে সেসব ঢোকেনি। ও মিতুলের কথার মাঝেই হঠাৎ বলে উঠলো,
“আসলে এই ছবিতে যা দেখছো তা সত্যি নয়। আমি তোমাকে না। তোমার ওই পাশে থাকা ছোটো একটা মেয়েকে দেখছিলাম। যেটা ক্যামেরায় এমন ভাবে এসেছে।”

মিতুল জোহানের কথা শুনে হেসে ফেললো।
“ও তাই না কি? কোন ছোটো মেয়ে ছিল আমার পাশে?”

“ছিল একটা রাশিয়ান মেয়ে। গোল্ডেন হেয়ার।”

মিতুল আবারও হেসে ফেললো। বললো,
“আমাকে এতটাই বোকা ভাবো? এমন আজগুবি একটা কথা বলবে সেটাও বিশ্বাস করবো আমি? তুমি কোনো গোল্ডেন হেয়ারের রাশিয়ান মেয়েকে নয়, আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলে।”

জোহান আর কিছু বলতে পারলো না।

মিতুল সব গিফট গুটিয়ে চলে যাওয়া দিয়েও দরজার কাছে গিয়ে থামলো। বললো,
“একটা কথা বলবো।”

“কী কথা?”

“আমাকে সাইকেল করে ঘুরতে নিয়ে যাবে?”

“এখন?”

“না। যখন সবাই ঘুমিয়ে যাবে। আমরা চুপিচুপি ঘুরতে যাব। এটা হবে তোমার সাথে শেষ সাইকেল ঘোরা।”

“শেষ বলছো কেন? আমরা তো আরও অনেক বার সাইকেলে ঘুরবো।”

“সেটা কবে ঘোরা হবে তার তো ঠিক নেই। এবারের মতো তো এটাই শেষ।”
এসব বলতে মিতুলের ভিতরটা ক্ষয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাইরে তা ধরা দিলো না। মুখে একটু হাসি ফুঁটিয়ে চলে গেল।

জোহান অপলক তাকিয়ে রইল শূন্য দরজায়।
_____________

পুরো বাড়ি যখন ঘুমে তলিয়ে গেল, তখন গ্যারেজে এলো জোহান আর মিতুল।
সাইকেলে উঠে বসলো দুজন। জোহান সাইকেল চালাতে শুরু করার আগে মিতুল বললো,
“আস্তে চালাবে না। খুব দ্রুত চালাবে। যাতে তোমাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে হয়।”

“আঁকড়ে ধরার জন্য দ্রুত সাইকেল চালাতে হবে না আমার, এমনিতেই ধরতে পারো তুমি।”

জোহান আর কথা না বাড়িয়ে সাইকেল চালাতে শুরু করলো।
মিতুলও কিছু বললো না। শুধু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো জোহানকে। জোহানের পিঠে মাথা ঠেকালো পরম আবেশে। জোহানের সাথে এরকম করে আর কবে সাইকেলে ঘোরা হবে তা জানে না ও। কোনো ঠিক নেই তার! মিতুল চোখ বন্ধ করলো। চোখের পাতা ভিজে উঠলো অশ্রুতে। একটু পরে মিতুল চোখ খুললো। ডাকলো জোহানকে,
“জোহান!”

“বলো।”

“আমি ছাড়া আর কোনো মেয়েকে জীবনে সাইকেলে উঠাবে না। এ জায়গাটা শুধু আমার। আমিই কেবল তোমার সাইকেলে উঠে তোমাকে এভাবে আঁকড়ে ধরবো। আর কেউ পারবে না।”

জোহানের সাইকেলের গতি ধীরই ছিল। প্রথমে জোরে চালালেও পরে ধীর করে ফেলে গতি। মিতুলের কথা যেন ধীর গতিটাকে আরও ধীর করে দিলো।
মিতুল আবারও ডেকে উঠলো জোহানকে,
“শোনো…”
জোহানের সাড়া দিতে হলো না। মিতুল তার আগেই বলতে লাগলো,
“আর কখনো কোনো মেয়েকে জড়িয়ে ধরবে না তুমি। যদি কেউ জড়িয়ে ধরতে আসে তবে দূরে সরে যাবে। তোমার উষ্ণ আলিঙ্গন অন্য কারো জন্য নয়। ওটা শুধু আমার প্রাপ্তি হবে।”
থামলো মিতুল।

জোহান কিছু বললো না। শুধু নীরবে শুনে গেল। হয়তো অন্যসময় হলে মিতুলের কথা নিয়ে অনেক মজা করতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। হৃদয়টা ছটফট করেই চলছে!
জোহান আবারও পিছন থেকে মিতুলের কণ্ঠ শুনতে পেল,
“আরও একটা কথা, তোমার যে বাংলা শেখার তিনটা বই আছে, ওগুলো আর কখনো স্পর্শ করবে না। একদমই বাংলা শিখবে না তুমি। আমি রেগে গেলে বাংলাতে বকবো তোমায়। আমার বকুনিগুলো তোমার কাছে বোধগম্য না থাক। তুমি শুধু, ‘চু চু’ করবে, কখনও যেন ‘চুবিয়ে’ না বলতে পারো।”

জোহান চুপচাপ মিতুলের উপদেশ শুনতে লাগলো। মিতুলের বলা এখনও শেষ হয়নি। ও আবার বলতে শুরু করলো,
“আর হ্যাঁ, মদ! জীবনে আর একবারও মদ জাতীয় কিছু স্পর্শ করবে না। যদি করো, তবে সত্যি সত্যিই আর কানাডা আসবো না আমি। আমাকে আর দেখতে পাবে না কোনোদিন। সুতরাং ওগুলো একদম ছুঁয়ে দেখবে না। তোমার বন্ধুরা ড্রিঙ্কস করলে, তুমি তাদের সাথে জুস দিয়ে চিয়ার্স করবে।”

জোহান নীরব থাকলো। ড্রিঙ্কস করা ছেড়ে দিয়েছে ও। আগে বেশিই মমের জন্য কষ্ট হতো বলে ড্রিংকস করতো মাঝে মধ্যে। কিন্তু মিতুল আসার পর কমে গেছে সেটা। ধীরে ধীরে একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছে।

মিতুল নিশ্চুপ। জোহান মিতুলকে নিশ্চুপ দেখে বললো,
“আর কিছু বলবে না?”

“হুম, বলবো।”

“বলো তাহলে।”

“তুমি লেনির প্রোপোজ একসেপ্ট না করে একেবারে ঠিক কাজ করেছিলে।”

জোহান মিতুলের কথা শুনে হেসে দিলো।
“লেনি?”

“হুম।”

জোহান সাইকেল থামালো। মিতুল সাথে সাথে জোহানকে ছেড়ে দিলো। জোহান মিতুলের দিকে ফিরে বললো,
“তুমি চলে গেলে তোমাকে কতটা মিস করবো সেই পরিমাণটা আমি হিসেব করতে পারছি না তুলতুল!”

মিতুলের এমনিতেই কান্না উদ্বেল ভাব। জোহানের এই কথায় চোখ ফেঁটে অশ্রু গড়িয়ে পড়ার মতো অবস্থা। মিতুল খুব কষ্টে নিজের কান্না চেপে রাখলো।

________________

এই রুমে আর থাকা হবে না মিতুলের। উইন্ডোর কাছে দাঁড়ালে চেরি গাছগুলো দেখতে পাবে না আর। আজকে শেষ দিন ওর। কানাডাতে শুধু আজ একটা দিন অবশিষ্ট আছে। কাল সকালেই বিদায় নিতে হবে কানাডার বুক থেকে। মিতুলের জানা ছিল না জোহান কালকে টরন্টো যাচ্ছে। ওর মন খারাপ হবে দেখে জোহান জানায়নি আগে। কিন্তু কালকে রাতে বলেছে। সাইকেল ভ্রমণ শেষে যখন বাড়ি ফিরেছিল তখন বলেছে কথাটা। সত্যিই, কথাটা শুনে ওর খুব বেশি মন খারাপ হয়েছে। শেষ মুহূর্তে জোহানকে দেখতে পাবে না! জোহানের ফ্লাইট ওর আগে। ওর ফ্লাইট সকাল নয়টায়, আর জোহানের সকাল ছয়টায়। তিন ঘণ্টার ব্যবধান। ভাবা যায়? এই তিন ঘণ্টা কানাডা থাকলেও ও জোহানকে দেখতে পাবে না! এই তিন ঘণ্টা সময় তো খুব কম নয়। এই তিন ঘণ্টা সময়ে জোহানকে আরও ভালো করে দেখে নেওয়া যেত। মিতুল দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
আজ অনেক কাজ ওর হাতে। দুপুরে রান্না করবে ও। মূলত জোহানের জন্য। কিন্তু বাড়ির সবাইকেই খাওয়াবে। মিতুল কী কী রান্না করবে সব ঠিক করে রেখেছে। ভাত, মাছ আর মুরগি। এই তিন আইটেম ও রান্না করবে। এর থেকে বেশি কিছু রান্না করার প্রয়োজন হলে ক্যামিলা করবে।

দুপুরে রান্না করতে সুবিধাই হলো মিতুলের। কেউ বাড়িতে ছিল না। রেশমী আন্টিও শপে গেছেন আজকে। তবে যেকোনো সময় চলে আসতে পারেন। তার আসা যাওয়ার ধরা বাধা নিয়ম নেই। যখন খুশি তখন যেতে পারেন, আবার আসতে পারেন।
রান্না শেষে মিতুল গোসলটা সেরে নিলো। জোহানকে সকালে একবার দেখেছিল। যখন জিম থেকে ফিরেছিল জোহান। এরপর আর একবারও দেখেনি। জিম থেকে ফিরে ঘুম দিয়েছে। জোহান বড্ড বেশি ঘুমায়। মিতুল এই জিনিসটা ঠাহর করতে পেরেছে। ঘুমকাতুরে একটা!

মিতুল খয়েরি রঙের থ্রি পিস পরেছে। কানাডা আসার পর যে থ্রি পিসটা প্রথম পরেছিল। মিতুল এর আগে জানতো জোহান থ্রি পিস খুব অপছন্দ করে। কিন্তু তা না। আসলে জোহানের থ্রি পিস পছন্দ। কালকে বললো, থ্রি পিসে না কি ওকে খুব সুন্দর লাগে। জোহানই আজকে এই থ্রি পিসটা পরতে বলেছে। জোহান আসলে খুব কঠিন একটা মানুষ। সহজে বোঝা যায় না ওকে। কালকে বললো ওকে থ্রি পিসে খুব সুন্দর লাগে। অথচ প্রথম যেদিন ওকে থ্রি পিস পরা দেখেছিল, সেদিন কত কী বলেই না অপমান করেছিল। উহ, সেসব আর মনে করতে চায় না ও। পুরোনো অপমানগুলোর কথা মনে পড়লে মাঝে মধ্যে খুব রাগ হয় জোহানের প্রতি। তবে আজকে কোনো রাগ নয়। আজকে কানাডাতে শেষ দিন, জোহানের সাথেও শেষ দিন। সুতরাং রাগের ধার কাছ দিয়েও যাবে না আজ। ও ঠিক করেছে আজকে নিজ হাতে খাইয়ে দেবে জোহানকে। বাড়িতে বসে এই রিস্ক নেওয়া যায় না। রেশমী আন্টি ফেরেননি এখনও। তবে কখন ফিরবে তার কোনো ঠিক নেই। যেকোনো সময় চলে আসতে পারে। জোহানের খাবার নিয়ে টাইম হাউজে যাবে ও।
যেমন ভাবনা তেমন কাজ। মিতুল জোহানের খাবার নিয়ে টাইম হাউজে এসেছে। দরজা লক। চাবি তো নেই ওর কাছে। মিতুল হাতের ট্রে সিঁড়িতে নামিয়ে রেখে জোহানকে কল দিলো। ঘুমকাতুরে উঠেছে কি না সেটাই সন্দেহ। কল রিসিভ হলো। ও প্রান্ত থেকে ঘুম ঘুম কণ্ঠ শোনা গেল,
“ইট’স জোহান। হু স্পিকিং?”

“তোমার ঘুম এখনও ভাঙেনি?”

“এটা কি তুলতুল?”

“হ্যাঁ, আমি। তোমার টাইম হাউজের সামনে বসে আছি লাঞ্চ নিয়ে। দ্রুত আসো।”

কল কেটে দেওয়ার দশ-পনেরো মিনিট পরই জোহানকে দেখা গেল। কোনো ঘুম ঘুম ভাব নেই জোহানের মাঝে। বাদামি চুল, পোশাক-আশাক সবই পরিপাটি। হঠাৎ করে গোছানো স্বভাবের হয়ে গেল না কি জোহান?

জোহান কিছু না বলেই দরজা খুললো। তারপর বললো,
“স্যরি এত সময় ঘুমানোর জন্য।”

“তোমার ঘুম তুমি ঘুমাবে, এখানে আমাকে স্যরি বলার কী আছে?”

“আছে অনেক কিছু, সেটা উল্লেখ করতে চাই না। ভিতরে এসো।”

মিতুল ট্রে নিয়ে টাইম হাউজে প্রবেশ করলো। ফ্রিসিয়াস ফুলের মিষ্টি সুবাস এসে লাগলো নাকে। মিতুলের হঠাৎ কৌতূহল হলো, জোহানের প্রিয় ফুল কী? একদিন বারান্দা থেকে লাল রঙা একটা ফুল কানে গুঁজেছিল, সেদিন জোহান বলেছিল এটা ওর প্রিয় ফুল নয়। ওর ব্রাদারের প্রিয়। জোহানের প্রিয় ফুল কী? এই ফ্রিসিয়াস না কি?
মিতুল প্রশ্নটা করেই বসলো জোহানকে,
“ফ্রিসিয়াস কি তোমার প্রিয় ফুল?”

জোহান উত্তর দিলো,
“কোনো ফুলই আমার প্রিয় নয়। তবে ফ্রিসিয়াস ফুল একটু একটু পছন্দ করি। স্মেলটা ভালো লাগে আমার।”

জোহানের কথা শুনে মিতুল অবাক। বললো,
“তুমিই বোধহয় প্রথম ব্যক্তি যার কি না ফুল পছন্দ নয়।”

জোহান একটু হাসলো।

মিতুল বললো,
“আমার কিন্তু ফুল ভীষণ প্রিয়। পরের বার যখন আসবো তখন তোমার টাইম হাউজ আমি ফুলে ফুলে ভরিয়ে দেবো। আপত্তি করতে পারবে না।”

“ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিয়ো সমস্যা নেই। তবে এত ফুলের মাঝে আমার জন্যও একটু জায়গা রেখো।”

মিতুল হাসলো। কাউচের সামনের টি টেবিলে ট্রে রাখলো। এটা নতুন টি টেবিল। কিছুদিন আগে জোহান কিনেছে। মিতুল হেয়ার রাবার দিয়ে চুলগুলো বেঁধে নিলো। জোহানের দেওয়া হেয়ার রাবার এটা। সাথে সাথেই রাখে।
জোহান বললো,
“নিজে রান্না করেছো?”

“হুম। ভাত, মাছ, মুরগি।”
বলতে বলতে কিচেনের দিকে গেল। পানি নিয়ে এলো এবং হাত ধুয়ে এসেছে।
মিতুলের পরনে যে থ্রি পিস সেটা আগে খেয়াল করেনি জোহান। খেয়াল হতেই বললো,
“বিয়ের পর বেশিই থ্রি পিস পরবে তুলতুল। খুব সুন্দর লাগে তোমাকে।”

মিতুল লজ্জা পেল জোহানের থেকে প্রশংসা শুনে। মানুষ শাড়ি পরলে প্রশংসা করে। আর জোহান ওকে থ্রি পিসে প্রশংসা করছে। ভালো লাগলো ওর। ও লজ্জা মাখা মুখ নিয়ে জোহানের পাশে বসলো। লজ্জাটা কোনো রকমে চেপে রেখে বললো,
“আজকে আমি খাইয়ে দেবো তোমায়।”
বলে খাবারের উপর থেকে ঢাকনা সরালো।
“মাছ দিয়ে খাবে আগে? না কি মুরগি দিয়ে?”

“মুরগি দিয়ে। মাছ তেমন পছন্দ নয় আমার। শেষে এক লোকমা খাবো মাছ দিয়ে। আমি বাংলাদেশি মাছ পছন্দ করি। ফুটি(পুঁটি), টেংরা(ট্যাংরা), শি…শিং আরও আছে অনেক। যেগুলোর নাম মনে নেই আমার। বাংলাদেশে গিয়ে আমার গ্র্যান্ডমাদারের কাছ থেকে জেনে বলবো তোমায়।”

জোহানের উচ্চারিত মাছের নামগুলো শুনে মুখ টিপে হাসলো মিতুল। ফুটি! টেংরা! ও জোহানের মতো করে বললো,
“ফুটি, টেংরা মাছ পছন্দ তোমার? কী করে এগুলো পছন্দ হয়ে গেল তোমার?”

“বাংলাদেশে যখন গিয়েছিলাম, তখন এই মাছ খেয়েছি। ফুটি মাছগুলো ছিল খুবই ছোটো ছোটো। পান্তা ভাতের সাথে খেতে দিয়েছিল আমার গ্র্যান্ডমাদার।”

মিতুল অবাক হয়ে বললো,
“তুমি পান্তা ভাতও খাও?”

“খাই তো।”

মিতুল হেসে ফেললো। বললো,
“ঠিক আছে, তুমি যখন বাংলাদেশ যাবে তখন আমি পুঁটি মাছ দিয়ে তোমাকে পান্তা ভাত খেতে দেবো।”

“আমি ফুটি মাছের থেকে টেংরা মাছ বেশি পছন্দ করি।”

“ঠিক আছে, আমি তোমাকে ট্যাংরা মাছও রেঁধে খাওয়াবো।”

“শুধু ফুটি, টেংরা না তো। আমার তো আরও অনেক মাছ পছন্দ। সেগুলো খাওয়াবে না?”

“সবই খাওয়াবো। আগে তো বাংলাদেশ যাও।”

মিতুল জোহানের কথা মতো মুরগি দিয়ে খাইয়ে দিতে লাগলো জোহানকে।
জোহান একসময় বললো,
“বিয়ের পর আমাকে প্রতিদিন এভাবে খাইয়ে দিতে হবে। দেবে তো?”

মিতুল আবার লজ্জায় পড়ে গেল। বিয়ের কথা শুনলেই ওর লজ্জা লাগে। ঠোঁটের কোণে একটু লজ্জা মিশ্রিত হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“হুম দেবো।”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here