#ভালোবাসায়_বন্দিনী
#পর্ব_৩০
#জান্নাতুল_নাঈমা
রুদ্রর দৃষ্টি যেমন খুবই তীক্ষ্ণ তেমন শ্রবণশক্তিও খুব প্রখর৷ সে স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে কারো চাপা আর্তনাদ সেই সাথে কিছু পরে যাওয়ার মৃদু শব্দ। হৈমীকে ছেড়ে প্রচন্ড তারাহুরোয় ছুটে গেলো ছাদের দরজার দিকে। হৈমী হাঁপিয়ে ওঠেছে খুব। বুকের ভিতর হার্টবিট টা যেনো ধড়ফড় ধড়ফড় করছে। ঠোঁটে হাত দিয়ে কান্নার ভঙ্গিতে রুদ্রকে বকা শুরু করলো।
রুদ্র ফোনের ফ্ল্যাশ অন করে আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলো না৷ তবে সে নিশ্চিত কেউ এসেছিলো। হয়তো তাঁদের এ অবস্থায় দেখে অপ্রস্তুত হয়েই ফিরে গেছে ভেবেই আবার ফিরে গেলো হৈমীর কাছে। দোলনায় বসে হাঁটুর উপর দুহাতের কনুই ভর করে দুহাতের উপর থুতনি রেখে হৈমীর দিকে তাকালো।
হৈমী রাগে গজগজ করতে করতে রুদ্রর কাঁধে ঘুষি দিলো কয়েকটা।
— কি মনে করেন নিজেকে হুহ্। আপনি একটা রাক্ষস, আপনি একটা খারাপ লোক,রাক্ষসজামাই। সড়ুন এখান থেকে চলে যান আপনাকে দু চোখে সহ্য হচ্ছে না আমার। আমার এতো সুন্দর নরম ঠোঁটটাকে আপনি খুব টর্চার করেছেন৷ আপনার ঠোঁটের কোনদিন ভালো হবে না বলে দিলাম।
রুদ্র মিটিমিটি হাসতে লাগলো। তা দেখে হৈমী তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে রাগে গজগজ করতে করতে ছাদ থেকে নিচে চলে গেলো। দিয়ে গেলো হাজারটা বকা।
.
রুমে এসে দরজা লক করে ওড়নাটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে শুয়ে পড়লো। রুদ্র এসে দরজা নক করলেও হৈমী দরজা খুললো না। রুদ্রর কাছে এক্সট্রা চাবি থাকায় খুব সহজেই দরজা খুলে ঢুকে আবার দরজা লক করে দিলো। হৈমী রাগে ফুঁস ফুঁস করতে করতে শোয়া থেকে ওঠে বসলো। অগ্নি দৃষ্টিতে চেয়ে আঙুল ওঠিয়ে বললো,
— একদম এই বিছানায় আমার পাশে শোবেন না৷ আমি মানুষ ছাড়া অন্যকোন জীবকে আমার পাশে এলাও করবো না।
রুদ্র ফোন আর ওয়ালেট টেবিলের ওপর রেখে চুলগুলো আঙুলের ফাঁকে ঢুকিয়ে পিছন দিক মেলতে মেলতে অন্যদিক ঘুরে দু আঙুল দেখিয়ে বললো,
— ওড়নাটা গায়ে জরিয়ে নিলে ভালো হয়। আর মাএ দুদিন বাকি বাসরের আয়োজন ছাড়া বাসর আমি করছিনা৷ তাই এভাবে ইংগিত করে লাভ নেই।
হৈমীর মাথায় যেনো বাজ পড়লো। চিৎকার দিয়ে ছিঃ ছিঃ করে ওড়নাটা গায়ে জরিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
— আপনি একটা বেহায়া পুরুষ থাকবো না আমি আপনার সাথে। আপনার মতো বেশরম আমি দুটো দেখিনি।
রুদ্র বাঁকা হেসে হৈমীর দিকে ঘুরে মাথা দুলিয়ে বললো,
— তুমি দেখালে দোষ নেই আমি বললেই দোষ? ইন্টারেস্টিং!
— কি,,,আপনি এতো অসভ্য। থাকবো না আমি আপনার সাথে বলেই পিছন ঘুরে ফেললো। লজ্জায় যেনো বুক ফেটে কান্না আসছে তাঁর। পুরো মুখ লালচে আভায় ভরে গেলো মূহুর্তেই।
রুদ্র হাসতে হাসতে বাথরুম ঢুকে গেলো। যা নজরে পড়লো না হৈমীর। গম্ভীর রুদ্রর মুখেও ইদানীং হাসির ঝলক দেখা যায় তা কি সবাই জানে?
.
বাথরুমে হাটু গেড়ে বসে প্রায় আধাঘন্টা সময় ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে সূচনা। সব কিছু অসহ্য লাগছে তাঁর। সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার পরও কেনো এতো কষ্ট পেতে হচ্ছে তাঁকে। তাঁর সবটা জুরে যে মানুষ টাকে রেখেছিলো সেই মানুষ টা কেনো হলো না তাঁর? নিয়তি কে কেনো এতো নিষ্ঠুর হতে হবে? একটু দয়ালু হলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো?
চোখের জল মুছে ওঠে দাঁড়ালো সূচনা। বিরবির করে বলতে থাকলো,
— না না, আর কাঁদবো না আমি। আর কষ্ট পাবো না আমি। আর ভাববো না ওদের নিয়ে। ওরা থাকুক সুখে সবাই তো সুখে থাকার জন্য জন্মায় না। আমি না হয় সারাজীবন দুঃখকে, শূন্যতাকে,ব্যার্থতাকেই আপন করে বাঁচবো।
মাহেরের বলা কিছুদিন আগের কথাটা মনে পড়ছে খুব। সেদিন রাতে যখন সূচনা রাগ করে চলে যায় ছাদ থেকে৷ তাঁর কিছুদিন পরের ঘটনা।
মাহের দেখা করে সূচনার সাথে এক রেষ্টুরেন্টে। মাহের যেভাবে তাঁর ভালোবাসা কে সেক্রিফাইস করেছে। কখনো জানতেই দেয়নি সে হৈমীকে কতোটা ভালোবাসে, সবটা জানায় সূচনাকে। সব শুনে মাহের সূচনাকেও বোঝায়৷ ভালোবাসার আরেক নাম ত্যাগ দিলে কি খুব ক্ষতি হবে? প্রশ্ন করে মাহের। সূচনা মলিন হেসে সম্মতি জানায় ক্ষতি হবে না। সেদিন থেকেই মাহের বন্ধুর মতো পাশে রয়েছে সূচনার।
এমন মানসিক অবস্থায় মাহেরের মতো একজনকে পাশে পেয়ে সূচনা নিজেকে কিছুটা হলেও স্বান্তনা দিতে পারছে। সফল হয়েছে মাহের তাঁর ভালোবাসার মানুষ কে সম্পূর্ণ বিপদ মুক্ত করতে সফল হয়েছে সে। সেই সাথে মানুষ হিসেবে একজন ডিপ্রেশনে ভোগা মেয়ের প্রতি যে মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে এতে তাঁর মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটেছে বহুগুন।
.
সারারাত প্রচন্ড জ্বালিয়েছে হৈমী। শেষে দুহাতে রুদ্রর পা জরিয়ে পেটের ওপর পা তুলে দিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। রুদ্রর ইচ্ছে করলো এক শর্ট দিয়ে নিচে ফেলে দিতে। কিন্তু ঐ যে ভালোবাসার মানুষ,মনের মানুষ। যতো যাই হোক ছুঁড়ে ফেলতে মন মানেনি। রাগে বিরবির করে শুধু এটুকুই বললো,
— এমন পাগলী বউ যেনো আর কারো কপালে না জুটে। আমার প্রত্যেকটা রাত হারাম করার জন্য এই এক মাথার স্ক্রু ঢিলাই যথেষ্ট। সব শুধে আসলে মিটিয়ে দিবো জাষ্ট ওয়েট এন্ড সি। আমাকে জ্বালিয়ে আরাম করে ঘুমানোর স্বাদ দুদিনে যতো পারো নিয়ে নাও।
হৈমী জেগে থাকলে নিশ্চিত ক্ষেপে গিয়ে জিগ্যেস করতো,
— এই আপনি আমাকে স্ক্রু ঢিলা বললেন? আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন? অপমানই যখন করবেন বিয়ে করতে কে বলেছিলো? আপনি একটা খারাপ লোক। ভেবেই মৃদু হাসলো রুদ্র।
.
রুদ্রর ফোন বেজে ওঠতেই চোখ বুজেই ফোনটা রিসিভ করে কানে দিলো। আরেকহাতে হৈমীর পিঠ চেপে নিলো। হৈমী তাঁর উপরে ওঠে কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। ঘুমের ঘোরে যে কিসব করে তা যদি জানতো তাহলে লজ্জায় তিনদিন খাবারই খেতো না মেয়েটা। ভেবেই মুচকি হাসলো। ফোনের ওপাশে সাদমান হেলো হেলো করছে রুদ্র হেলো বলতেই এক ঝাঁক চুল মুখের ভিতর ঢুকে গেলো। নাকেও সুড়সুড়ি লাগলো। চুলের ঘ্রানে এতোক্ষণ আরাম পেলেও এখন বিরক্তি নিয়ে বললো,
— হায় খোদা এই মেয়ে কি একটু শান্ত হয়ে ঘুমাতে পারেনা৷ ঘুমের মধ্যেও এতো ছটফট কেনো করে। কাঁধ থেকে হৈমীর মাথা ওঠিয়ে বালিশে শুইয়িয়ে দিলো।
সাদমান অবাক হয়ে বললো,
— কি রে,,,তুই কি করছিস? ছটফট করে কেনো কি করেছিস তুই?
— বেশী কথা না বলে কি বলতে ফোন দিয়েছিস সেটা বল।
— তুই বন্ধু না শত্রু বলতো? বউয়ের সাথে রোমান্স করে বন্ধুকে বলবিনা তো শত্রু কে বলবি?
— চল বিয়ে করাই দেই তোর বউয়ের সাথে রোমান্স করবি আর আমরা বন্ধুরা মিলে লাইভ দেখবো।
— শালা তুই খোলস থেকে বের হইছোস তাইনা৷ ডাক তোর বউরে আসল রূপ দেখাই।
— নিজের জিনিস নিয়ে খোঁচাখোঁচি করলে কেমন লাগে বুঝেছিস তো?
— তুই আসলেই একটা জিনিস স্বাদে কি আর এমন প্রফেশনে যেতে পারছিস এলেম আছে বলতে হবে।
বাঁকা হাসলো রুদ্র হৈমীর ওড়না ঠিক করে দিতে দিতে বললো,
— এবার কাজের কথা বল এতো ফাউল আলাপ করার জন্য নিশ্চয়ই সকাল সকাল ফোন করিসনি।
— হুম বাড়ির সামনে আয় প্যান্ডেরলের লোক নিয়ে এসেছি।
— ওকে।
ফোন রেখে হৈমীর গালে আলতো ছুঁয়ে গম্ভীর গলায় ডাকতে শুরু করলো রুদ্র। আটটা বেজে গেছে বেশী রাতে ঘুমানোর ফলে জাগতে দেরী হচ্ছে হৈমীর।
হৈমী একটু নড়ে চড়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়লো। রুদ্র বিরক্ত হলো ভীষণ হৈমীর চুলগুলে হাতের মুঠোয় নিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
— ঘুম ভাঙবে নাকি চুলগুলো কেঁচি দিয়ে কাটতে শুরু করবো।
ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসলো হৈমী। চুলগুলো সামনে নিয়ে দুহাতে ধরে ঠোঁট ফুলিয়ে রুদ্রর দিকে তাকালো। ঘুমু ঘুমু চোখে চেয়ে আধো আধো গলায় বললো,
— চুল কাটবেন কোনো? এতোই যখন কাঁটার শখ নিজেরগুলো কাটেন মহিলাদের মতো চুল রাখতে লজ্জা করেনা? আমার এই মাসুম বাচ্চা গুলো কে কাটতে চাইছেন।
— বাহ! গলার স্বর ভাঙা তবু ত্যাজ কম না। কথা কি অলওয়েজ মুখে রেডি করে রাখো নাকি। বেশী কথা না বলে ফ্রেশ হয়ে নিচে ভাবি আর মায়ের কাছে যাও। বলেই রুদ্র ওঠে পড়লো।
— যাবো না আমি।
— এক চড়ে অজ্ঞান করে ফেলবো ফাইজলামি বাদ দিয়ে যা বলছি তাই করো বেশী কথা যেনো বলতে না দেখি।
হৈমীর চোখ দুটো টলমল হয়ে গেলো। ঘুম থেকে ওঠে এমন ধমক খাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলো না সে। মিনমন করে বললো,
— সকাল সকাল বকছেন কেনো? আপনি আমাকে না ঘাটতে এলে কি আমি কিছু বলতাম নাকি? আমার কি সূচনার আপুর মতো অতো লম্বা চুল যে আপনি কাটতে চাইলে আমি আপত্তি করবো না। এমনিতেই ছোট চুল তারওপর আপনি কেটে ফেললে তো আমাকে বাজে লাগবে।
রুদ্র ট্রাউজারের উপরই কাবলী পড়ে নিয়ে বললো,
— দেখো হৈমী সবসময় এতো কথা বলবেনা। যা বলেছি তাই করো আমি আসছি। বলেই বেরিয়ে গেলো।
হৈমী ভ্রু কুঁচকে যাওয়ার পানে চেয়ে মুখ ফুলিয়ে ওঠে চলে গেলো ফ্রেশ হতে।
.
নিচে যেতেই দাদি বিরক্ত হয়ে হৈমীর দিকে চেয়ে বললো,
— এই যে নবাবের বেটি আসছে দাও দাও মুখের সামনে খাবার দাও। জমিদারের কন্যা খাবার গিলুক।
সোফায় বেশ আয়েশ করে বসে পান চিবাচ্ছে দাদি। হৈমী রান্নাঘরের দিকে যেতে নিয়েও থেমে গেলো। দাদির দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বললো,
— আমি সকালেই ওঠি আজ একটু লেট হয়ে গেছে। তাই বলে এভাবে টিটকারি দিতে হবে। ভালো করে বললেই হতো। বলেই মুখ ভেঙচি দিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো।
— এই মেয়ে তোমার ধরন তো খুব খারাপ। মুখের ওপর কথা বলা কোন ধরনের বেয়াদবি। রুদ্র আসুক আমি বলবো কেমন মেয়ে ধরে আনছোস বড়দের সম্মান দেয় না।
হৈমী শুনেও না শোনার ভান করে নয়নার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। সুরভী বেগম বললেন,
— দেখো মা তুমি ওনার সাথে কথা বাড়িও না। ওনি কিছু বললে চুপ করে শুনবে উত্তর দেবে না। আর এসব নিয়ে রুদ্রকেও কিছু বলো না। শুধু শুধু অশান্তি হবে।
হৈমী কিছু বললোনা জোর পূর্বক হেসে নয়নাকে বললো, কাজে সহায়তা করবে কিনা নয়না না করে শুধু বললো তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেই হবে।
.
রুদ্রর নানা বাড়ির লোকজন এসে গেছে। এছাড়া নিকটস্থ যতো আত্মীয় ছিলো সকলেই ধীরে ধীরে এসে পড়ছে। পাড়া থেকেও লোকজন এলো হৈমীকে দেখতে। সুরভী বেগম আর নয়না আপ্যায়ন করতে ব্যাস্ত। হৈমীর পাশে নয়ন বসে আছে। রুদ্রর দুই মামি টুকটাক কথা বার্তা বলছে। রুদ্রর দাদি পাড়ার আরেক বৃদ্ধ মহিলার সাথে কথা বলছিলো। মহিলাটি হঠাৎ বলে ওঠলো,
— মেয়ে তো বেশী লম্বা নারে রেদুর মা। দেখি চুল আছে কিনা? বলতেই রুদ্রর মামাতো বোন শাম্মি হৈমীর মাথার চুল বের করে দেখালো।
মহিলাটি চোখ,মুখ কুঁচকে বললো,
— সাদা চামড়া ছাড়া কিছুই তো নাই দেখা যায়। বড় বউটার মতো না গায়ে,পায়ে সমান আর না চুল আছে।
— আমিতো বড় বউ না দাদি ছোট বউরা সব দিক থেকে ছোটই হয়৷ বলেই দাঁত কেলিয়ে হাসলো হৈমী।
উপস্থিত সকলের চোখ, মুখ শুকিয়ে গেলো। নয়ন হৈমীর হাতে চিমটি কাটতে শুরু করলো। যাতে চুপ করে। রুদ্রর মামিরা ইশারায় সমানে চুপ থাকতে বলছে। রুদ্রর দাদি চোখ কটমট করে বললো,
— রুদ্রর পছন্দ তাই আমরা আর নাকোচ করিনাই।
মহিলাটি তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,
— কি আর করবা আজকালকার পোলাপানের রুচি দেখে মরে যাই। এরা তো ভবিষ্যত না ভাইবাই কাজ করে। রুদ্র দাদুভাই এই বউ নিয়া রাস্তা দিয়া হাঁটলে মানুষ বলবো তালগাছের সাথে তুলসীগাছ। তাছারা বাচ্চা হইলে বাচ্চা যদি মায়ের ধরন পায় তাইলে তো কথাই নাই সবকয়টা ডিব্বা হবো। বলেই হায় হুতাশ শুরু করলো।
হৈমীর প্রচন্ড অপমানবোধ হলো এমন কথা শুনে সে অভ্যস্ত নয়৷ পরিবারের এমন জটিলতায় সে কখনো পড়েনি। তাই রেগেমেগে বললো,
— আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন। শুধু শুধু আমার দোষ ধরছেন। আপনি যেভাবে বলছেন মনে হয় আমি দেখতে খুব কুৎসিত। কিন্তু আমি মোটেই কুৎসিত না আপনাদের থেকে যথেষ্ট সুন্দরী। আর আমি মোটেই খাটো না বরং আপনাদের ছেলেই খাম্বার মতো লম্বা। তাই ওনাকে গিয়েই কথা শুনিয়ে আসুন এতো লম্বা কে হতে বলেছে ওনাকে? আমার তো এখন চিন্তা হচ্ছে বাচ্চা যদি ওনার মতো খাম্বা হয়? কিন্তু এটা ভেবে আমি তো ওনার দোষ ধরছি না। আপনারা কেনো দোষ ধরবেন?
— মা গো মা এটা কি মেয়েগো? শরম লজ্জার বালাই নাই। কেমন কইরা বাচ্চার কথা মুখে নেয়। হায়রে কল্যা গো! হায় হায় গো রেদুর মা তোমার ছেলের কপালে এমন পুএবধু জুটলো। শেষ বয়সে ভাত দেবে তো?
— ওমা! আপনি বাচ্চার কথা বললেন বলেই তো আমি উত্তর দিলাম লজ্জার কি হলো এখানে? অন্যের বাড়ি এসে আলগা মাতব্বরি দেখাচ্ছেন আপনি লজ্জা তো আপনার পাওয়া উচিত। তাছাড়া আপনি তো দেখা যায় সিনেমার কুটনী ভিলেনের মতো হয়ে এ বাড়িতে এসেছেন৷ আমার কি মনে হচ্ছে জানেন আপনি আমাকে হিংসে করছেন। আর এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেনো আপনি প্রিন্সেস ডায়না আর আমি আপনার চাকরানী। অথচ দেখুন বয়স হয়ে চেহেরায় ভাজ ধরে গেছে আপনার আর আমাকে দেখুন যথেষ্ট সুন্দরী। বাই দ্যা পাড়ার কুটনী দাদি সত্যি করে বলুন তো আমার বরের দিকে আপনার কুনজর আছে কিনা? নয়তো আমাকে নিয়ে আপনার এতো জ্বলছে কেনো? বসা থেকে দাঁড়িয়ে বেশ ঝগরার মুডে বললো হৈমী৷
— যতো বড় মুখ না ততোবড় কথা। সাহস তো কম না আমাকে কুটনী বলো। বাপ,মা কিছু শেখায়নি নাকি? ওও শুনলাম বাপ, মাকে অনেক আগেই খেয়ে বসে আছো এখন কি এ বাড়ির লোকদের খেতে এসেছো? ঠোঁটকাটা মেয়ে কোথাকার!
— বাবা, মা তুলে একদম কথা বলবেন না বলে দিচ্ছি। আপনি আমাকে যা, তা বলবেন আর আমি চুপ করে থাকবো? আমাকে কি বাংলা সিনেমার নায়িকা সাবানা মনে হয় আপনার?
ড্রয়িং রুমে হট্রগোল বেজে গেলো। কেউ হৈমীকে চুপ করাতে পারছেনা৷ হৈমী সিরিয়াস রেগে গেছে এবার। এদিকে রুদ্রর দাদিও মহিলাটির সাথে তাল মেলাচ্ছে।
শাম্মি গিয়ে সুরভী বেগম কে সব জানাতেই সুরভী বেগম ছুটে এসে হৈমীকে এক ধমক দিলো।
হৈমী ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,
— ওনি আমাকে,,,
বাকিটুকু বলতে দিলোনা সুরভী বেগম সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে হৈমী টেনেটুনে নিয়ে গেলো উপরে। পিছন পিছন নয়নও গেলো৷ নয়ন সুরভী বেগম কে বললো,
— আন্টি আসলে ওনি নানারকম ভাবে অপমান করছিলো।
সুরভী বেগম রেগে বললেন,
— দেখো মা শশুড় বাড়িতে এসব কথাবার্তা হয়ই তাই বলে এভাবে মুখ চালানোটা ভদ্রতার মধ্যে পড়ে না৷
নয়নের মুখটা চুপসে গেলো৷ হৈমীর মুখটাও ভাড় হয়ে গেলো৷ রুদ্রর রুমে এসে হাত ছাড়লো সুরভী বেগম যাওয়ার আগে আরো কয়েকটা কথা বলে হৈমীকে বলে গেলেন,
— রুদ্র যেনো এসব জানতে না পারে অনেক অশান্তি হবে। রুম ছাড়া বাইরে যাবে না৷ এ বাড়ির লোক ছাড়া যেই আসুক কারো সাথে কথা বাড়াবে না৷
.
ভেতরের সব খবর রুদ্রর কানে ঠিক পৌঁছে দিলো তাঁর মামাতো ভাই শোভন। হৈমীর রিয়্যাক্টের কথা শুনে রুদ্র আর কিছু বললো না। দাদিকে এমনিতেই সহ্য করতে পারেনা৷ দাদির ওপর ক্ষোপটা যেনো আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেলো তাঁর। কিন্তু প্রকাশ করলো না।
.
সন্ধ্যে সাতটা বাজে। শাম্মি আর নয়ন মিলে হৈমীকে মেহেদী পড়িয়ে দেওয়ার জন্য নিয়ে গেলো ছাদে। আগামীকালই অনুষ্ঠান। ছাঁদে ছোট করে স্টেজ সাজানো হয়েছে মেহেদী পড়ানো হবে সেই সাথে ছোটরা মিলে একটু আনন্দ, ফূর্তি করবে আর কি। রুদ্র সারাদিন প্রচন্ড ব্যাস্ত ছিলো তাঁর ব্যাস্ততা তবুও শেষ হয়নি।
পুরোবাড়িটায় আলোকসজ্জায় সজ্জিত করেছে। কাল ভোরে সিঁড়ির দুপাশে গাধা ফুল দিয়ে সাজানো হবে৷ সে বিষয়েই কথা বলছে লোকদের সাথে রুদ্র।
.
মাহের সদর দরজায় আসতেই রুদ্র মুখে হাসি টেনে বললো,
— আরে বেয়াই সাহেব! এতো দেরী যে? আরো আগে আসা উচিত ছিলো। আন্টি,আংকেল কোথায়?
মাহের মৃদু হেসে বললো,
— ঐ আর কি অফিস থেকে দুদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরে তারপর এখানে এলাম। নয়ন বলছিলো কিসব গান বাজনা করবে তাই গিটার নিয়ে এলাম। আর মা,বাবা,কাল সকালেই এসে পড়বে।
রুদ্র মাহেরের হাতের দিকে চেয়ে বললো,
— গান তো তোমার ফ্যাশন রাইট?
জোর পূর্বক হাসলো মাহের। রুদ্র বললো,
— তাহলে গানের জন্য সকলে সর্বপ্রথম তোমাকে স্মরন করবে এটাই তো স্বাভাবিক। ওরা সবাই ছাদে আছে ওখানেই পাবে সবাইকে। বলেই রুদ্র তাঁর পাশে থাকা লোকটিকে নিয়ে বাইরে চলে গেলো কথা বলতে বলতে৷
মাহের এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সিঁড়ির দিকে পা চালালো।
.
ছাদে যেতেই দেখতে পেলো এক ঝাঁক মানুষ জন গোল হয়ে বসে আছে স্টেজে। সকলের হাসির শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। সকলের মাঝখানে বসে আছে হৈমী৷ পড়নে লাল টকটকে সেলোয়ার-কামিজ। মাথায় লাল ওড়না দিয়ে ঘোমটা দেওয়া৷ একদম বউ বউ লাগছে। লাল রঙে পুরো মুখজুরে আলাদা এক স্নিগ্ধতা ছেয়ে আছে। দুহাত ভর্তি করে মেহেদী লাগিয়ে দিচ্ছে দুজন মেয়ে। তাঁর পাশে বসে আছে নয়ন আরো পরিচিত,অপরিচিত মুখ। হৈমী সকলের সাথে গল্প করছে মাঝে মাঝে শব্দ করে হেসে ওঠছে। ঠোঁটের কোনে তাঁর অসম্ভব সুখের হাসি। সেই হাসি দেখেই যেনো বুকটা শীতলতায় ভরে গেলো। এই হাসিতেই যেনো সব ব্যাথা নিমিষেই ভুলে যাওয়া যায়। এই হাসি দেখলেই ইচ্ছে করে হাজারবার ত্যাগ স্বিকার করতে। আবার কখনো কখনো বুকটা কেঁপেও ওঠে। এই মানুষ টা যে সবটা জুরে রয়েছে তাঁর। অথচ তাঁর সবটা জুরে রয়েছে শুধু রুদ্র। এই মানুষ টার শূন্যতা প্রতিটা রাত যে খুবই যন্ত্রণা দেয়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সামনে গিয়ে খুব শক্ত করে জরিয়ে ধরে এক নিঃশ্বাসে প্রশ্ন করতে, ‘আমার ভিতর বাহির সবটা জুরেই তুমি থাকলে অথচ ভাগ্যেই থাকলেনা এ কেমন থাকা থেকে গেলে তুমি’?
চলবে।