#ভালোবাসায়_বন্দিনী
#পর্ব_৩৫
#জান্নাতুল_নাঈমা
মাহেরের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না রাদিফ৷ এদিকে এতো ঝামেলায় নয়নার মাথা ঘুরে এলো।মাহেরের কাঁধ চেপে ধরতেই রাদিফ নয়নাকে ধরে ফেললো। মাহেরও নয়না বলে হালকা চিৎকার দিয়ে ধরে ফেললো। নয়না হাঁপাচ্ছে কেমন। মাহের রাদিফ দুজনই ভয় পেয়ে গেলো। নয়না হাঁপিয়ে ওঠা গলায় বললো,
— আমাকে উপরে নিয়ে যাও একটু শরীরটা খারাপ লাগছে।
মাহের আর রাদিফ দুজনই নয়নাকে ধরে ধরে উপরে নিয়ে গেলো৷ নয়ন, মনিকা বেগম পিছন পিছন ছুটে গেলো। হৈমীও পিছন পিছন গেলো। রুমে গিয়ে নয়নাকে বসিয়ে দিয়ে এসির পাওয়ারটা বাড়িয়ে দিলো রাদিফ৷ মনিকা বেগম মেয়েকে বুকে জরিয়ে বসে রইলেন। নয়নাও চুপচাপ মায়ের বুকে মাথা রেখে বসে রইলো।
নয়ন এক গ্লাস পানি দিলো নয়নাকে। নয়না পানিটা খেয়ে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো। মনিকা বেগম কাঁদো কাঁদো মুখে ওটা সেটা জিগ্যেস করছে। মাহের রাদিফকে বললো,ডক্টরকে ফোন দিতে।
হৈমীও এসেই প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগলো। মাহের হৈমীর দিকে শীতল দৃষ্টি তে চেয়ে বললো,
— ব্যাস্ত হচ্ছো কেনো একটু শরীর খারাপ। তুমি নিচে যাও সবাই খোঁজ করবে তো। এদিকটা আমরা দেখছি।
মাহেরের কথায় পাত্তা না দিয়ে হৈমী গিয়ে নয়নার পাশে বসলো। কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,
— আপু কি হয়েছে তোমার?
— আরে বাবা কিছু না একটু মাথা ঘুরে এসেছে। তুই নিচে যা মেহমানরা এসে খুঁজবে তো। আজ তো সবাই তোকে দেখতেই এসেছে।
— না যাবো না আমি৷ তোমার কোথায় খারাপ লাগছে বলো?
নয়ন বললো,
— আরে ভাই তুই মুখটা বন্ধ রাখ এতো কথা বললে আরো অসুস্থ হয়ে যাবে। ভাইয়া ডাক্তার কে ফোন করোতো তারাতাড়ি।
.
সুরভী বেগম খবর পেয়ে উপরে এলেন৷ হৈমীকে দেখে জোর করে নিচে পাঠিয়ে দিলেন। কারন মেহমানদের অনেকেই তাঁর সাথে এখনো পরিচিত হয়নি। বাড়ির সবাই ছারা প্রত্যেকেরই খাওয়া হয়েছে। নয়নার জন্য টেনশনে কেউ আর খেতে বসলো না৷ ডাক্তার আসার পর চেকআপ করে রাদিফকে বললো, মিষ্টি খাওয়াতে। কারো আর বুঝার বাকি রইলো না নয়না মা হতে চলেছে। এতো ঝামেলার মধ্যে এই খুশির খবরটা যেনো পরিবেশ অনেকটাই শান্ত করে তুললো৷ নয়না আর রাদিফ কে একা সময় কাটাতে দিয়ে সকলেই বেরিয়ে পড়লো।মাহেরেরও আর যাওয়া হলো না বোনের খুশির মূহুর্তটা নষ্ট করতে মন সায় দিলো না তাঁর। অনিচ্ছা থাকা সত্তেও সকলের সাথে বসে খেতে হলো তাঁকে।
হৈমী কিচ্ছু খেতে পারলো না৷ নয়নার কাছে যাওয়ার জন্য মনটা আকুপাকু করছে তাঁর। কিন্তু তাকে কেউ যেতেই দিচ্ছে না। বাড়িতে নতুন সদস্য আসতে চলেছে শুনেই তাঁর নাচতে মন চাচ্ছে। কিন্তু নাচতে পারছেনা৷ এদিকে রুদ্র যে গম্ভীর মুখে তাঁর পাশে বসে আছে আর আশেপাশে তাকিয়ে দেখছে না৷ হৈমী চুপ থাকতে না পেরে নিচু স্বরে জিগ্যেস করলো,
— বাড়িতে নতুন সদস্য আসছে আর আপনি এমন পেঁচার মতো মুখ করে আছেন কেনো শুনি?
হৈমীর কথা শুনে রুদ্র এমন দৃষ্টি তে তাকালো যে ভয়ে হৈমীর গলা থেকে বুক অবদি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো৷ মুখে জোর পূর্বক হাসি টেনে বললো,
— সসরি।
রুদ্র চোখ সড়িয়ে নিলো। হৈমীও আর কিছু বললো না। তার এতোক্ষণ নাচতে মন চাইলেও এখন কাঁদতে মন চাচ্ছে। রুদ্রর অমন ভয়ংকর মুখ দেখে খুব ভয় লাগছে৷ না জানি একা পেলে কি করে। মনটা বড় কু ডাকছে তাঁর।
.
একে একে সব মেহমান রা বিদায় নিলো। রুদ্রর সব বন্ধু রা আর মামাতো ভাইরা মিলে বাসর সাজাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। হৈমী পুতুলের মতো নিচেই বসে আছে। রুদ্র ওঠে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। নিচে তেমন মানুষ জন নেই বাড়ির মানুষ সব নয়নার ঘরে। হৈমীও ওঠে দাঁড়ালো শরীর দূর্বল লাগছে সেই যে সকালে খেয়েছিলো তারপর আর খেতে পারেনি। দূর্বলতা লাগলেও খেতে একটুও ইচ্ছে করছে না৷ সোজা চলে গেলো নয়নার রুমে। সেখানে সবাই ছিলো কিন্তু দাদিকে দেখে মুখের খুশিটা উড়ে গেলো।
নয়না হৈমীকে দেখে মিষ্টি করে হেসে বললো,
— ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো ভিতরে আয়।
হৈমী খুশিতে গদগদ হয়ে ভিতরে ঢুকে চেচিয়ে বললো,
— আপ্পু,,,আমি আর নয়ন খালামুনি হচ্ছি আমার যে কি ভালো লাগছে ইচ্ছে করছে ডান্স করি।পরোক্ষনেই চুপসে গেলো বিরবির করে নিজেকে গালি দিলো কয়টা কোনভাবেই নিজের এক্সাইটেডমেন্ট চেপে রাখতে পারে না সে।
সুরভী বেগম বেরিয়ে গেলেন। সাথে মনিকা বেগমও বেরিয়ে গেলেন।দাদি ওঠতে ওঠতে বললো,
— নাচানাচি পোয়াতি মেয়ের সামনে করা যাবে না৷ নাচতে মন চাইলে রুমে দরজা বন্ধ করে নাচতে হবে। আমার নাত বউয়ের জানি কোন ক্ষতি না হয় বলে দিলাম। বলেই বেড়িয়ে গেলেন৷
হৈমী মুখ ভেঙচি দিয়ে আবারো খুশিতে গদগদ হয়ে বাবু নিয়ে গল্প শুর করে দিলো। নয়ন বললো,
—আসলেই এই বুড়িটা বেশী খ্যাট খ্যার করে। অসহ্য একটা।
নয়না সহ হৈমী অট্রহাসিতে ঘর কাঁপিয়ে তুললো। কিছুক্ষণ পর সূচনাও রুমে এলো নয়নাকে কনগ্রেস জানাতে। তারপর ওরা চারজন মিলে অনেকটা সময় আড্ডা দিলো।
.
রাত আটটা বাজে। বাসর সাজানো শেষে সাদমান রুদ্র কে বললো,
— দোস্ত আমাদের ব্যবস্থা হয়েছে তো?
— না এ বাড়িতে আজ ওসব ব্যবস্থা নেই। গম্ভীর গলায় বললো রুদ্র।
সাদমান মুখটা ভাড় করে বললো,
— ভাই কাজটা কি ঠিক হইলো। সারাদিন অপেক্ষা করলাম। আর এখন তুই এই কথা বলছিস। ভাবলাম রাতে গলাটা ঠান্ডা করুম একটু।
— কালই বলেছি আজ থেকে নতুন জীবন শুরু। যে জীবনে হারাম কোন জিনিসের স্থান নেই। এসব বাদ দিয়ে বিয়ে সাদির চিন্তা কর এখন। আর প্রতিজ্ঞা কর জীবনে এসবের নামও নিবি না৷
রুদ্রর কথায় সবাই সমর্থন করলেও সাদমান করতে চাইলো না আবার না করেও পারলো না৷
.
যে কজন আত্নীয় রয়েছে তাঁদের রাতের খাবার খাওয়িয়ে শোয়ার ব্যবস্থা করে দিলো সুরভী বেগম। হৈমী যে ঠিকভাবে খায়নি দুপুরে খেয়াল করেছে সুরভী বেগম। রুদ্রও কিছুক্ষণ আগে বলে গেছে,হৈমীকে খেতে দিতে না খেতে চাইলে জোর করে খাওয়াতে জাষ্ট দুটো দিন মায়ের কাছে বউয়ের দায়িত্ব দিয়েছে। যেখানে ছয়মাস থাকার কথা ছিলো এ বাড়িতে রুদ্রর সেখানে ছয়দিনও টিকতে দিলো না তাঁর শাশুড়ী। রুদ্র চলে যাবে শুনে কষ্ট হলেও সুরভী বেগম রুদ্র কে সাপোর্ট করেছে৷ সারাজীবন যে বিভেদ নিয়ে রুদ্র বড় হয়েছে সেই বিভেদ রুদ্রর বউ বাচ্চার ওপর পড়ুক তা রুদ্র বা সুরভী বেগম কেউই চায়না৷ নয়না মা হতে চলেছে কদিন পর হৈমীও মা হবে। যতোদিন রুদ্রর দাদি বেচে আছে ততোদিন রাদিফ সহ রাদিফের বউ বাচ্চা পাবে সোনার মতো ভালোবাসা আর রুদ্রর বউ বাচ্চা পাবে তামার মতো ভালোবাসা। তাই এইসব অযৌক্তিক কারবার থেকে রুদ্র যদি দূরে থাকতে চায় তাই ভালো। ভেবেই এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সুরভী বেগম।
.
নয়ন আর হৈমীকে খেতে দিলেন। নয়নাও বসেছে পাশে সে বেড়ে দিচ্ছে। হৈমী খেতে পারছেনা। এটাই স্বাভাবিক। সে অনেক নার্ভাস ফিল করছে৷ তাঁর পোশাকটাও পালটানো হয়নি৷ কারন তাঁকে রুমে যেতে দেওয়া হয়নি৷ রুদ্রর বন্ধুরা রুম দখল করে বসে আছে। নয়না ফিসফিস করে বললো,
— কিরে খাচ্ছিস না কোনো? এখনি খাওয়া ওঠে গেলো?
হৈমী আড় চোখে তাকালো। তারপর পানি খেয়ে বললো,
— আমি আর খেতে পারছিনা আপু। আর খাবো না৷
— আরে পাগল মেয়ে খেয়ে নে। অসুস্থ হয়ে পড়বি সারাদিন তো খাসই নি।
সুরভী বেগম এসে চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
— কি ব্যাপার খাচ্ছো না কেনো? শরীরের তো এই অবস্থা না খেয়ে থাকলে আরো রোগা হয়ে যাবা৷ বেশী বেশী খেতে হবে শরীর স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে তো চলবে না মা৷ নয়না মা হতে চলেছে কদিনপর তুমিও মা হবে৷ আর মা হতে গেলে সর্বপ্রথম নিজেকে শারিরীক দিক দিয়ে প্রস্তুত করতে হবে। আমার কিন্তু এক নাতিতে চলবে না ঘর ভর্তি নাতি,নাতনী চাই। আমার রাদিফ বাবা হতে চলেছে আমার রুদ্রকেও তো বাবা হতে হবে তাইনা৷
লজ্জা পেয়ে গেলো হৈমী। নয়না আর নয়ন মুচকি হাসলো৷ দাদি সোফায় বসে পান চিবুচ্ছিলো। সুরভী বেগমের কথা শুনে বাঁকা চোখে চেয়ে বললো,
— বাচ্চা জন্মানোর প্রতিযোগিতা চলবো নাকি আমার বাড়ি? বিয়ে হয়েই সারলো না এখুনি বাচ্চার কথা চিন্তা করো কোন আক্কেলে? দেখাদেখি বাচ্চা নিতে হবো নাকি?
হৈমীর মেজাজ চটে গেলো৷ কিছু বলতে নিবে তখনি নয়না হাত চেপে থামিয়ে দিলো৷ সুরভী বেগম বললেন,
—রাত তো অনেক হয়েছে মা আপনি নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমান এখন৷ বয়স হয়েছে সব বিষয়ে এতো মাথা ঘামাবেন না৷
— তুমি চুপ করো তোমার পেটেই যদি এতো হিংসা থাকে তাহলে বউদের তো হবোই। বলেই নয়নাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— নাতবউ তুমি সাবধানে থাকবা। কোন সমস্যা হলে আমারে আগে জানাবা। যাও ঘরে গিয়ে ঘুমাও এতো রাত জাগতে হবো না৷ হৈমীর দিকে চেয়ে বললো,
— পাল্লা দিয়ে বাচ্চা নিতে হবো না। সময় বুইঝা নেওয়া উচিত। পেটে জানি কুবুদ্ধি না আটে কেউ৷
হৈমী ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলো৷ পাল্লা দিয়ে বাচ্চা নেওয়া, বাচ্চার সাথে পেটে কুবুদ্ধি এসবের আগা মাথা কিছুই বুঝলো না৷ তবে সুরভী বেগমের বিরক্তি মুখটা দেখে বুঝলো এসবের মানেটা অবশ্যই বিরক্তিকর কিছু।
.
প্রচন্ড অস্বস্তি তে হৈমীর এবার কান্না পাচ্ছে। এতো ভারী পোশাক পড়ে এমন গর্জিয়াজ সাজে আর থাকতে পারছেনা৷ শরীর চুলকাচ্ছে, মাথা ব্যাথায় সোফায়ই নেতিয়ে পড়ছে৷ নয়না এসব দেখে উপরে গিয়ে রুদ্রর রুমে টোকা দিলো। সাদমান একটু দরজা খুলে ওকি দিতেই নয়না বললো,
— ভাই তোমরা কি বের হবা৷ হৈমীর এখন শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে। একটু পর জ্ঞান না হারায় এবার তো রুমটা ফাঁকা করো।
সাদমান বোকা বোকা হাসি দিয়ে বললো,
— তোমার বোনকে আমার কাছে যদি বিয়ে দেও তাহলে রুম ফাঁকা করতে রাজি আছি৷ এবার বলো তুমি রাজি? রাজি থাকলে এক বাটন চাপো।
নয়না চোখ ছোট করে তাকাতেই রুদ্র সাদমানকে সড়িয়ে দিয়ে দরজা পুরো খুলে সবাইকে বের হতে বললো। সবাইকে সবার পাওনা ঠিক দেওয়া হবে তাই কেউ কথা না বাড়িয়ে বেড়িয়ে গেলো। নয়নাও গিয়ে হৈমীকে উপরে নিয়ে এলো। পিছন পিছন নয়ন আসতে নিলে নয়ন কে এক ধমক দিয়ে রুমে যেতে বললো। নয়ন বললো,
— এহ। আমার বেষ্ট ফ্রেন্ডের বাসর আর আমি দেখবো না?
নয়না চোখ বড় বড় করে তাকাতেই নয়ন জিহ্বে কামড় দিয়ে বললো,
— সরি সরি মানে বাসর ঘর সাজানো দেখবো না আমি সেটা হয় নাকি?
নয়না তারপরও নয়নকে যেতে দিলোনা জোর করে চোখ রাঙিয়ে পাঠিয়ে দিলো৷ হৈমীর শরীর খারাপ লাগছে তাই সে চুপচাপ রুমে গিয়ে বিছানায় একপাশে বসলো। ঘরের দিকে কারোরি তেমন নজর নেই। নয়না কে গয়না দেখিয়ে বললো,
— একটু এসব খুলে দাও আপু আর থাকতে পারছিনা৷
নয়না আস্তে করে বললো,
— আরে যার জন্য সাজ তাঁকে ভালো করে না দেখতে দিয়েই খুলবি নাকি আজব। পরে খোল গাধী আর শোন কোন সমস্যা হলেই ফোন করবি ঠিকাছে?
— কি সমস্যা হবে? ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করলো হৈমী।
নয়না মুচকি হেসে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কিছু বলতেই হৈমী লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। বললো,
— ওসব কিছু হবে না আপু আমি ঘুমাবো আমার শরীর খারাপ লাগছে৷
নয়না দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো,
— আহারে সোনামুনি এতোগুলা দিন অপেক্ষা করে আজ এমনি এমনি ছেড়ে দেবে বুঝি?
হৈমীর বুকের ভিতরে ঝড় ওঠে গেলো কেমন। সব খারাপ লাগা দূরে গিয়ে একরাশ ভয় আর লজ্জা এসে ভর করলো চোখে মুখে। তা দেখে নয়না বললো,
— আমি তো ভেবেছিলাম তোদের সব হয়ে গেছে। সেদিন না বললে তো জানতামই না। বাবা,,, মানতে হবে আমার দেবরের অনেক ধৈর্য্য আছে।
হৈমীর নিঃশ্বাস চঞ্চল হয়ে গেলো। বসে থাকতে পারলো না সে আর দাঁড়িয়ে পড়লো। ডান হাত দিয়ে নিজের বাম হাত মোচড়াতে শুরু করলো। নয়না হেসে ফেললো বললো,
—আচ্ছা থাক আমি যাই। রুদ্র ভাই মনে হয় রুমে আসার জন্য উসখুস করছে। বেষ্ট অফ লাক বলেই হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
হৈমী কিছুক্ষণ চুপ মেরে বসে থেকে অপেক্ষা করলো রুদ্রর জন্য। যখন দেখলো রুদ্রর আসার কোন নাম নেই তখন বিরক্ত হয়ে আয়নার সামনে গিয়ে বসে চুড়ি খুলতে লাগলো৷ তখনি রুমে এলো রুদ্র। পড়নে তাঁর কালো ট্রাউজার আর কালো টিশার্ট। হৈমী এক পলক দেখেই আবার নিজের কাজে মন দিলো। রুদ্র দরজা লক করে বিছানায় এসে বসলো। পুরো বিছানায় ফুলের ছড়াছড়ি। ছাদের দেয়াল থেকে শুরু করে পুরো ঘরে তাজা ফুল দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। বিছানায় মাঝ বরাবর গোলাপের পাপড়ি দিয়ে কিছু লেখা আছে। যা হৈমী বা নয়না কেউ খেয়াল করেনি। রুদ্র একপাশে বসে সেখানটায় চেয়ে রইলো। তারপর হৈমীর দিকে তাকলাে৷ হৈমী চুড়ি খুলতেই ব্যাস্ত। রুদ্র গম্ভীর গলায় বললো,
— ওভাবে খুললে সারারাতেও শেষ হবে না।
হৈমী পিছন ঘুরে তাকালো৷ গাল ফুলিয়ে বললো,
— নয়না আপু তো খুলে দিলো না আমার কি দোষ।
— এদিকে এসো৷
— দাঁড়ান এগুলো খুলে নেই।
— এদিকে আসতে বলেছি??
হৈমী ওঠে দাঁড়ালো ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো বিছানার দিকে রুদ্র সোজা হয়ে বসলো। আর হৈমীকে বসতে বললো।হৈমী বসতেই বিছানায় ইশারা করলো আর বললো,
— পছন্দ হয়েছে?
চমকে তাকালো হৈমী৷ এতোক্ষণ সে কোন জগতে ছিলো এতো সুন্দর ঘরটা তাঁর চোখেই পড়লো না আল্লাহ ভাবতেই চিল্লিয়ে বললো,
— ওয়াও এতো সুন্দর। তারপর লেখাটায় দেখলো লাল গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লেখা ভালোবাসায় বন্দিনী। সাদা চাদরে লাল গোলাপের পাপড়ি দেখতে অপূর্ব লাগছে। তাজা ফুলের ঘ্রানে কেমন নেশা ধরে যাচ্ছে। পুরো ঘর ফুলের ঘ্রানে মোমো করছে হৈমী লজ্জায় লালে লাল হয়ে গেলো। ফুলের সুবাসে মন মাতোয়ারা হয়ে যাচ্ছে।
হৈমীর ভাবভঙ্গি দেখে রুদ্র বাঁকা হেসে হৈমীর দিক এগিয়ে পিছন ঘুরতে বললো। হৈমী জিগ্যাসু চোখে তাকাতেই রুদ্র নিজে ঘুরিয়ে বসালো তারপর গয়না খুলে দিতে দিতে বললো,
— এতো সাজতে কে বলেছে? যে সাজে নিজের ওপর এতো ধকল জায় সেই সাজ কেনো সাজতে হবে? তোমরা মেয়েরা পারোও বটে৷
রুদ্র কথা বলছে আর এক এক করে গয়না খুলছে। হৈমীর সুড়সুড়ি লাগায় কেমন নড়েচড়ে ওঠছে। রুদ্র সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সব গয়না খুলে বললো,
— যাও রেখে আসো।
হৈমী লজ্জা ভরা মুখেই সব গয়না ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে রাখলো গিয়ে। আর বললো আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি। রুদ্র কিছু বললো না। হৈমী কাবার্ড থেকে একটা সূতি শাড়ি বের করলো নয়নাই বলেছিলো গোসল সেড়ে সূতি শাড়ি পড়ে ঘুমাতে। সে তাই করলো। প্রায় এক ঘন্টা সময় নিয়ে গোসল করলো সে। রুদ্র ঘরি দেখতে দেখতে রুম পাইচারি করতে করতে বিরক্ত হয়ে বাথরুমের দরজায় নক করলো। তখনি দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো হৈমী।
— কি হয়েছে শান্তি তে গোসলও করতে দেবেন না দেখা যায়।
— আরো দু’ঘন্টা বাথরুমে কাটিয়ে আসতে। দাঁত চেপে বললো রুদ্র।
হৈমী ভ্রু কুঁচকে চেয়ে পাশ কাটিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে তয়ালে দিয়ে চুল মুছতে লাগলো৷ রুদ্র ধৈর্য্যহারা হয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। ফোন বের করে ফোন ঘাটতে লাগলো৷ হৈমী চুলগুলো ভালোভাবে মুছে তয়ালে রেখে আবারো আয়নার সামনে দাঁড়ালো। শাড়ি পড়াটা কোনোরকমে শিখে নিয়েছে আরেকটু ঠিকঠাক করে নিলো৷ চুল দিয়ে টপটপ পানি পড়েই যাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে অন্য একটা তয়ালে নিয়ে আবারো চুল বেঁধে ফেললো। এদিকে রুদ্র রেগে গিয়ে বললো,
— সমস্যা কি এমন ঘুরঘুর করছো কেনো? কাজ শেষ হয়নি?
— আপনি এতো রাগ করছেন কেনো? দেখছেন না চুল শুকাচ্ছেনা ভেজা চুলে ঘুমালে মাথায় পোকা হবে।
— বেশী কথা না বলে এখানে আসো।
হৈমী গটগট পায়ে গিয়ে রুদ্রর সামনে বসলো। রুদ্র ফোন রেখে মৃদু হেসে পকেট থেকে হৈমীর স্বর্নের চেইনটা বের করলো। বললো,
— এটা ছাড়া ছিলে কেনো সারাদিন?
হৈমী জিহ্বে কামড় দিয়ে বললো,
— ওমা এটা কোথায় রেখেছিলাম আল্লাহ মনেই ছিলো না৷ থ্যাংকিউ থ্যাংকিউ বলেই হাত থেকে নিতে যাবে তখনি রুদ্র সড়িয়ে ফেললো আর লকেট খুলে হৈমীর দিকে ঘুরিয়ে দেখালো হৈমী একপাশে তাঁর বাবা-মা আর একপাশে রুদ্রর ছবি দেখলো। ন্যাকা কান্না করে বললো,
— আল্লাহ আমার ছবি কোথায় আপনি এটা কবে করেছেন?
রুদ্র কিছু বললো না একটু এগিয়ে হৈমীকে পেছন ঘুরিয়ে তয়ালেটা খুলে ফেললো। শ্যাম্পুর কড়া স্মেল পেতেই তাঁর শ্বাস ভারী হয়ে গেলো আলতো হাতে ঘাড়ে পড়ে থাকা ভেজা চুলগুলো একপাশে দিয়ে চেইনটা পড়িয়ে দিতে দিতে বললো,
— এটা তো সেই কবে থেকেই আছে৷ তুমি একটা ব্যাকুব বলেই এতোদিন দেখতে পাওনি।
হৈমী একটু সড়ে গিয়ে ধীর গলায় বললো,
— আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন৷
রুদ্র হৈমীকে কাছে টেনে নিলো। একহাতে হৈমীর পেট চেপে ধরে আরেক হাত কাঁধে রেখে ভেজা ভেজা ঘাড়ে ঠোঁট ছুয়িয়ে দিলো। পুরো শরীরে যেনো বিদ্যুৎ চমকালো তাঁর। রুদ্র আরো গভীর ভাবে তাঁকে জরিয়ে নিয়ে কানের লতিতে আলতো কামড় দিলো। হৈমী বিছানার চাদর খামচে ধরলো। নিঃশ্বাসে তাঁর অস্থিরতা স্পষ্ট। রুদ্র সেই অস্থিরতা আরো দ্বিগুণ করে দেওয়ার জন্য ফিসফিস করে বললো,
— আজ তো তুমি পুরোটাই বন্দিনী হয়ে যাবে। রেডি তো?
হৈমীর কি হলো কে জানে বেশ জোর খাটিয়েই রুদ্র কে ছাড়িয়ে বিছানা থেকে ওঠে পড়লো৷ কোথায় যাবে কোথায় পালাবে আজ ভাবতেই এক ছুটে চলে গেলো বেলকনিতে। দেয়ালে কপাল ঠেকিয়ে ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে আর ছারছে। রুদ্র কিছু সময় পর বেলকনিতে গিয়ে হৈমীকে ও অবস্থায় দেখে এগিয়ে গিয়ে বললো,
— তোতাপাখি কি বোবাপাখি হয়ে গেলো নাকি আজ?
হৈমী চোখ বুজেই সড়ে যেতে নিলো কিন্তু রুদ্র তাঁকে আঁটকে ফেললো। শাড়ি ভেদ করে নাভির ওপর হাত রেখে বেশ চাপ দিয়েই নিজের কাছে টেনে নিলো। পেটের ওপর রাখা হাতের ওপর হাত রাখলো হৈমী। রুদ্রর হাত সড়ানোর চেষ্টা করতেই রুদ্র আরেকটু চেপে ধরলো। সইতে না পেয়ে চোখ বুজে ঠোঁট কামড়ে ধরে ভারী শ্বাস নিতে নিতে বললো,
— আপনি কিন্তু ঠিক করছেন না৷ আমি কিন্তু থাকবো না এখানে চলে যাবো।
রুদ্র বাঁকা হাসলো কানের পিঠে ঠোঁট ছুয়িয়ে বললো,
— ওকে ডান তবে আজ না কাল সকালে চলে যেও। রাত করে বাড়ি থেকে চলে যেতে দেওয়াকে অভদ্রতা বলে। তাই সকালে দায়িত্ব নিয়ে দিয়ে আসবো যেখানে যেতে চাও। আবার যেনো থাকার জন্য বায়না করো না। আমি কিন্তু থাকতে দিবো না।
হৈমী অবাক হয়ে গেলো। ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকাতে নিতেই রুদ্র তাঁর ঘাড়ে গভীর একটা চুমু খেলো। আর কিছু বলার বা করার শক্তি পেলো না হৈমী। পুরো শরীর তাঁর অবশ হয়ে এলো৷ রুদ্রও আর অপেক্ষা করলো না পাজাকোল করে নিয়ে চলে গেলো রুমের ভিতর৷
.
পুরো রাত আর ঘুমাতে দিলো না রুদ্র। রুদ্র যেনো প্রতিজ্ঞা বদ্ধ ছিলো আজকের রাত হারাম করে দেবে হৈমীর৷ এতোদিনের চেনা রুদ্র কে যেনো আবারো নতুনভাবে নতুন রূপে চিনলো সে। অন্য এক রুদ্রর সাথে পরিচয় ঘটলো তাঁর। যে রুদ্র তাকে দেখিয়েছে যন্ত্রণাময় এক আলাদা সুখের ঠিকানা৷ আর সেই সুখের ঠিকানায়ই হবে তাঁর শেষ ঠিকানা।
শেষ রাতের দিকে রুদ্র হৈমীর বুকে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পড়লো৷ ঘুম হলো না হৈমীর তাঁর কানে শুধু রুদ্রর কথাগুলো ভাসছে ঘুমানোর আগে রুদ্র বলেছে,
— হৈমী আমার একটা বাচ্চা চাই বাবা হতে চাই আমি । তুমি আর বাচ্চা এ দুটো ছাড়া আর কিছু চাওয়ার নেই আমার। আমার একরা পরিবার খুব প্রয়োজন। আমার পারিবারিক সুখের খুব প্রয়োজন হৈমী। একজীবনে এটুকু চাওয়া কি খুব বেশী হয়ে যাবে? এ বাড়িতে আর দুদিন থাকবো আমরা তারপর হানিমুনে যাবো। তারপর ফিরবো সুখনীড়ে৷ বেঁচে থাকতে ভুলেও কোনদিন এ বাড়ির নাম নিতে পারবে না৷ মাঝে আসতে পারবে অতিথি হিসেবে তবুও আমার সঙ্গে। তোমার জন্য আমি সুখরাজ্য তৈরী করছি সেখানেই আমরা আমাদের ছোট্ট সংসার সাজাবো। সবার কপালে শশুড় ঘর থাকে না তোমার কপালেও নেই তুমি স্বামীর ঘরই করবে। স্বামী আর বাচ্চা সামলানোই তোমার কাজ।
রুদ্রর বলা সে কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই চোখ লেগে এলো হৈমীর। একহাত রুদ্রর পিঠে আরেকহাত রুদ্রর চুলে রেখেই ঘুমের দেশে পারি জমালো সে।
.
সকালে রুদ্রর আগে ঘুম ভাঙলো। নিজেকে আবিষ্কার করলো হৈমীর মাঝে। সুখের এক লম্বা শ্বাস ছেড়ে ওঠে পাশে শুয়ে পড়লো৷ কিছু সময় পর রাতের কথা মনে পড়তেই চট করে হৈমীর দিকে ঝুকে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
— হ্যালো মিসেস.ওঠুন ওঠুন ড্রাইভার কে বলে দিয়েছি। আপনি যেখানে যেতে চান যেতে পারেন। আপনাকে সসম্মানে দিয়ে আসা হবে।
হৈমী নড়েচড়ে ওপাশ ফিরলো। রুদ্র হেসে ফেললো। আবারো কানের কাছে মুখ নিয়ে খানিকটা জোরেই বললো,
— কি হলো যাবে না? তারাতাড়ি ওঠে রেডি হও। শাওয়ার নিতে হবে তো তোমার সাথে কি ঘটেছে ভুলে গেছো নাকি?
ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসলো হৈমী। হাই দিয়ে রুদ্রর দিকে চেয়ে ঘুমকাতুরে গলায় বললো,
— কি হয়েছে? কোথায় যাবো?
রুদ্র গা এলিয়ে শুয়ে ছাদের দেয়ালে চোখ স্থির রেখে বললো,
— কি হয়েছে সেটা নিজের দিকে তাকালেই বুঝবে। আর কোথায় যাবে সেটা মনে করলেই বুঝবে। কালই তো বললে চলে যাবে। ড্রাইভার কে বলে দিয়েছি নাও গো।
চলবে…