#ভালোবাসায়_বন্দিনী
#পর্ব_৪০
#জান্নাতুল_নাঈমা
বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে আছে মাহের। মাহেরের রিয়্যাক্ট দেখে সূচনা মাথা নিচু করে ফেললো৷ বুঝতে পারলো সে ভুল জায়গায় ভুল আবদার করে ফেলেছে। লজ্জায় মাথা কাঁটা যাচ্ছে তাঁর। ইচ্ছে করছে ছুটে পালাতে। মনে হচ্ছে বেহায়ার চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে সে। নয়তো বারবার ভুল জায়গায় ভুল আবদার কেনো করে বসে? মাহের যেখানে হৈমীকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে সেখানে তাঁর প্রস্তাব কেনো গ্রহণ করবে? মেয়ে হয়ে একটা ছেলেকে এভাবে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া উচিত হয়নি তাঁর।
‘ খুব কি ক্ষতি হয়ে যেতো প্রস্তাবটা গ্রহণ করতে? হৈমীকে তো কোনদিন পাবেনা মাহের তাহলে কেনো এতো রিয়্যাক্ট করলো কিসের আশায়? নাকি মেয়ে হয়ে আগে প্রস্তাব দিয়েছি বলে এটিটিওট দেখাচ্ছে’?
মনে মনে অসংখ্য কথোপকথন করে মাথা নিচু করেই ওঠে দাঁড়ালো সে। নয়নার রুমের দিকে পা বাড়াতে নিতেই মাহের বললো,
—- দাঁড়ান। প্লিজ যাবেন না আই এম সরি আমি এমন কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না তাই রিয়্যাক্ট করে ফেলেছি। আপনি আমায় ক্লিয়ার ভাবে সবটা বলুন। হঠাৎ এমন প্রস্তাব কেনো দিচ্ছেন এনি প্রবলেম?
হুহু করে কেঁদে ওঠলো সূচনা। সোফায় বসে দুহাতে মুখ গুঁজে কাঁদতে শুরু করলো সে। হতভম্ব হয়ে গেলো মাহের। বিস্ময় নিয়ে বললো,
—- প্লিজ কাঁদবেন না৷ কান্না কোন সমাধান নয়। আপনার কি প্রবলেম সবটা শেয়ার করুন আমায়। ইনশাআল্লাহ সমাধান পাবেন৷
—- খালামুনি ওরা বিয়ের জন্য প্রেশার দিচ্ছে খুব।
—- আপনি কি বিয়েটা করতে চাইছেন না কিন্তু কেনো? এখনো কি সমস্যা?
—- চেয়েছিলাম কিন্তু মনকে মানাতে পারছিনা। যাকে ভালোবাসতে পারবোনা তাঁকে বিয়ে করা কি ঠিক হবে? ঠকানো হবেনা?
—- সবটা জানালেই তো প্রবলেম হবেনা৷
—- আপনার কি মনে হয় এসব কথা জানলে কেউ আমাকে বিয়ে করবে? আর আমি যদি এসব জানাই সে খবর কি খালামুনি সহ বাড়ির সকলের কানে যাবেনা? তখন যদি তাঁরা আমাকে বাঁধ্য করে মুখ বন্ধ রাখতে? আর যদি সব জেনে আমাকে কেউ বিয়ে করে সেখানে আমার সুখ ঠিক কতোটা?
চিন্তিত হয়ে গেলো মাহের। ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা কি হয়? ভালোবাসার মানুষ কে হারিয়ে অন্যকারো সাথে ঘর বাঁধার কথা সে ভাবতেই পারেনা। অথচ দিনের পর দিন সূচনাকে এসব ভাবতে হচ্ছে পরিবার থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। সূচনার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মাহের প্রশ্ন করলো,
—- তাহলে আমায় কেনো প্রস্তাব দিলেন? আপনি তো বিয়ে করতে চাননা।
—- আমি কখনো কোন ছেলের সাথে বন্ধুত্ব তো দূরের কথা প্রয়োজন ব্যাতিত কথা পর্যন্ত বলিনি। ছোট থেকেই রুদ্র কে নিয়ে স্বপ্ন বুনেছি। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার পর দ্বিতীয় বার কাউকে নিয়ে ভাবার সাহস হয়ে ওঠেনি। আমার খারাপ পরিস্থিতি তে একমাএ আপনাকেই পাশে পেয়েছি। ইচ্ছেয় হোক অনিচ্ছায় হোক আপনার সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে। আপনার ব্যাক্তিত্ব মুগ্ধ করেছে আমায়। ভরসা করার মতো আর কাউকে পাচ্ছি না। আমি জানি আপনার সাথে আমার বিয়ে হলেও কোনদিন আপনি স্বামীর অধিকার ফলাতে আসবেন না। কারন আপনি হৈমীকে ভালোবাসেন। আমরা দুজন একি পথের পথিক। আমি আপনাকে সারাজীবন বন্ধুর মতো পাশে পাবো সেই ভরসায় আমি লাজ লজ্জা ভুলে গিয়ে আপনাকে প্রস্তাব দিয়েছি মাহের। ক্ষমা করবেন আমায়।
—- এতোটা ভরসা করা ঠিক হয়নি আপনার।
—- মানে?
—- আমি হয়তো মন থেকে ঘর বাঁধতে চাইনা। কিন্তু আমার বাবা,মায়ের জন্য ঘর আমাকে বাঁধতেই হবে। আর আমি যার সাথে ঘর বাঁধবো সে হবে আমার অর্ধাঙ্গিনী। যিনি উপরওয়ালার তরফ থেকেই আমার জীবনে উপহার সরূপ আসবেন৷ স্বামী হিসেবে তাঁর প্রতি সকল দায়িত্ব কর্তব্য পালন করতে আমার কোন অসুবিধা বা অনিচ্ছা থাকবেনা৷ তাঁর সকল চাওয়া,পাওয়াকে মন থেকে সম্মান করেই পূরন করবো। সে যদি ভালোবাসা চায় তাহলে তাঁকে ভালোবাসা দিতে আমি বাঁধ্য সে যদি ভালোবাসার ফসল হিসেবে একটা সন্তান চায় তাহলেও তা দিতেও আমি বাঁধ্য। হতে পারে আমি হৈমীকে ভালোবাসি হ্যাঁ আজো ভালোবাসি ওকে আমি কিন্তু পার্থক্য এটাই আগে আমি ওকে চাইতাম এখন ওকে আমি চাইনা। কারন এখন যদি ওকে আমি চাই তাহলে এটা পাপ হবে,অন্যায় হবে। আর বিয়ে না করে সারাজীবন দেবদাস হয়ে কাটালে আমার বাবা-মা ইহকালে যেমন দুঃখ পাবে পরকালেও তাঁদের উপরওয়ালার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তাছাড়া বাবার শরীরের অবস্থা অনেকটাই খারাপ সামনে বছর হজ্জে যাওয়ার নিয়ত করেছেন। তাই আগে তিনি ছেলে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিতে চান। ভার্সিটিতে এডমিশন নেওয়ার পর নয়নের একটা ব্যবস্থা করে দিব। আর এক বছরের মধ্যে যে কোন টাইমে হয়তো আমাকেও করতে হবে।
সূচনার কান্না থেমে গেছে মাহেরের কথা শুনে। চোখ ছোট করে তাকিয়ে আছে সে। এতোদিনের মাহের আর আজকের মাহেরের মধ্যে কি যেনো একটা পার্থক্য আছে। তাঁর মুখোভঙ্গি দেখে মাহের হালকা কেশে ওঠলো। তাঁর দিকে একটু ঝুঁকে বললো,
—- কি ভাবছেন? আমাকে নিয়ে কনফিউশনে পড়ে গেছেন?
সূচনা ইতস্ততভাবে ওঠে দাঁড়ালো। বললো,
—- আমি রুমে যাবো।
মাহেরও দাঁড়ালো। সূচনার একদম কাছে এসে ধীর গলায় করে বললো,
—- আমরা যাদের ভালোবাসি সবসময় তাঁদের পাইনা। তাই বলে তো আমাদের জীবন থেমে থাকতে পারেনা আর থেমে নেইও। জীবন চলছে জীবনের মতোনই তাহলে সেই চলার পথে একাকিত্বকে বেছে না নিয়ে একজন সঙ্গী খুঁজে নেওয়াই কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়?
সূচনার মাথা ঘুরছে। সে কিছু বুঝতে পারছেনা মাহেরের কথা। সে প্রশ্ন করেছিলে বিয়ে করবে কিনা তাঁর বদৌলতে এতো কঠিন ভারী ভারী কথা বলছে যে মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে না৷ আর এক মূহুর্ত দেরী না করে খানিকটা দৌড়েই চলে গেলো সে। তাঁর যাওয়া দেখে মৃদু হাসলো মাহের। বিরবির করে বললো,’আপনিও অনেকটা ছেলেমানুষ সূচনা।প্রত্যেকটা মেয়ের মাঝেই বড্ড বেশী ছেলেমানুষী লুকিয়ে থাকে। আপনার সেই লুকানো ছেলেমানুষী আমি ধরে ফেলেছি যে’ ড্রয়িং রুম থেকে মাহের চলে গেলো তাঁর বাবার রুমে।
.
একমাস পর ঢাকায় ফিরে রুদ্র আর হৈমী। তাঁরা সরাসরি সুখনীড়েই ওঠেছে। রুদ্রর দিনরাত কেটে যাচ্ছে ব্যাস্ততায়। আর হৈমী কাটাচ্ছে বাচ্চা দের সাথে। ইদানীং রাতেও ফিরে না রুদ্র। কাজের জন্য ফিরতে পারেনা৷ আর যখন ফিরে তখনো বাড়ির কাজে ব্যাস্ত থাকে৷ সুখনীড়ের ছাদ থেকে সুখরাজ্যের কাজ দেখে সে। রুম থেকে শুধু ছাদেই যেতে পারে। নতুন বিল্ডিংয়ের কাজ চলছে নানারকম অপরিচিত মানুষদের আনাগোনা তাই বাইরে বের হতে নিষেধ করে দিয়েছে তাঁকে রুদ্র।
এইচএসসি রেজাল্ট প্রকাশিত হয়েছে। নয়ন আর হৈমীর রেজাল্ট বেশ ভালো হয়েছে। নয়ন এসেছে হৈমীর সাথে দেখা করতে৷ অনেক দিন পর দু বান্ধবী বেশ অনেকক্ষণ আড্ডা দিলো। ইতিমধ্যেই মাহের আর সূচনার বিয়েও ঠিক হয়ে গেছে। সেদিনের পর সূচনা কে কিছু না জানিয়েই মাহের তাঁর বাবা,মা কে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় রেদওয়ান শেখ এর কাছে। মাহেরের ব্যাক্তিত্ব সম্পর্কে সকলেই অবগত। চোখ বুজে যে কোন মেয়ের বাবাই তাঁর কাছে মেয়ে দিতে রাজি হয়ে যাবেন। সেক্ষেএে রেদওয়ান শেখও এর বিপরীত নয়৷ এতো ভালো ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন শিক্ষিত, মার্জিত ছেলের প্রস্তাব সে ফেলতে পারেনি। বরং খুশি হয়েছে সূচনার লাইফ পার্টনার হিসেবে এমন একজনকে বেছে নিতে পেরেছে বলে।
মাহের তাঁর ভালোবাসার মানুষ কে জীবনসঙ্গীনী হিসেবে পায়নি৷ কিন্তু একজন ভালো বন্ধু কে জীবনসঙ্গীনী করতে তাঁর কোন আপত্তি নেই। যদিও সূচনার মতো তাঁর মনেও এটা এসেছিলো সে কখনোই বিয়ে করবেনা৷ কিন্তু যখন সূচনা তাঁর এই ভাবনা তাঁকে জানায় তখন তাঁর বিবেকে নাড়া দেয়। মন বলে সূচনা ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। অন্যের ভুল, অন্যের দোষ চিন্হিত করতে গিয়ে নিজের ভুল,নিজের দোষটাও খুব স্পষ্ট ভাবে ফুটে ওঠে তাঁর মনে। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় যেহেতু সূচনা নিজ থেকে তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে সেহেতু তাঁরও উচিত তাঁকে সম্মান দিয়ে প্রস্তাবটি একসেপ্ট করা৷ বিয়ে ঠিক হওয়ার পর সূচনা নিজেকে খুবই অপরাধী ভাবে৷ সে ভাবে মাহের তাঁকে দয়া করে বিয়ে করছে।কিন্তু তাঁর এই ভুলটা ভাঙিয়ে দেয় মাহের নিজেই। এবং প্রতিশ্রুতি দেয় সারাজীবন বন্ধুর মতোন আগলে রাখবে তাঁকে।
মাহের সূচনার বিয়ের ব্যাপার শুনে হৈমী প্রচন্ড খুশি হয়৷ সেই সাথে তাঁর ভিতরের একটা অপরাধ বোধও দূর হয়ে যায়৷ তাঁর সবসময় মনে হতো নিজের অজান্তেই হয়তো মাহেরকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে সে। সেই অপরাধ বোধ এখন অনেক কমে গেছে তাঁর।
.
নয়নার পাঁচ মাস চলছে। আর একমাস পরই মাহের আর সূচনার বিয়ে তাই সে বাপের বাড়ি গেছে। হৈমী জানতো না নয়না নিজের বাড়ি চলে গেছে। ভার্সিটি থেকে সরাসরি সে শেখ বাড়ি যায়। নয়নার জন্য চালতার আচার কিনেছে সেটা দিতেই ও বাড়ি যায় সে।
চলবে।