ভালোবাসায়_বন্দিনী #পর্ব_৪৫ (শেষ পার্ট)(প্রথম অংশ)

0
2906

#ভালোবাসায়_বন্দিনী
#পর্ব_৪৫ (শেষ পার্ট)(প্রথম অংশ)
#জান্নাতুল_নাঈমা

ফোনের শব্দে হৈমীর থেকে চোখ সরিয়ে নিলো রুদ্র। সাদমান ফোন করেছে রিসিভ করতেই জানালো তাঁর ব্লাডগ্রুপ O নেগেটিভ। অর্থাৎ হৈমীর ব্লাডগ্রুপের সাথে তাঁর ব্লাডগ্রুপ মিলেছে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো রুদ্রর। বুকের ওপর থেকে যেনো পাথর সড়ে গেলো তাঁর। সুবর্ণা যখন তাঁকে জানায় হৈমীর ডেলিভারির পর ব্লাডের প্রয়োজন পড়তে পারে৷ তখনি সে তাঁর সকল আত্মীয়,বন্ধু, বান্ধব কে জানায় আর তাঁরা সকলেই তাঁদের ব্লাডগ্রুপ জানায়৷ কারো সাথেই ম্যাচ করছিলোনা৷ এদিকে রক্ত কিনে স্ত্রীর শরীরে প্রবেশ করাবে এতেও সে নারাজ৷ অবশেষে সাদমানেরটাই ম্যাচ করেছে। আল্লাহ তায়ালা কে অনেক অনেক শুকরিয়া জানালো রুদ্র। দুহাতে চোখ মুখ মুছে ফোন করলো সুবর্ণাকে।

” রক্ত কেনাবেচা ইসলামে নিষেধ রয়েছে। ইসলামে কোনো বিনিময় ছাড়া রক্তদান বৈধ, তবে কেনাবেচা অবৈধ। আরব-অনারবের সব আলেমের ঐকমত্যেই মানব অঙ্গের ক্রয়-বিক্রয় হারাম। উপমহাদেশের প্রখ্যাত ফকিহ আল্লামা মুফতি শফি (রহ.) ‘জাওয়াহিরুল ফিকহ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘যেহেতু কোনো রকমের কাটাছেঁড়া ছাড়াই রক্তের দেহান্তর সম্ভব, তাই ইসলামে রক্তদান বৈধ। একজন মুসলিম অমুসলিমকেও রক্ত দিতে পারবে। তবে তা বিক্রি করা সম্পূর্ণ হারাম। এর যৌক্তিকতা হলো, রক্ত ও মায়ের দুধ দুটোই শরীর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর দ্রুতই তার অভার পূরণের ব্যবস্থা আল্লাহপাক কুদরতিভাবে মানবদেহে করে রেখেছেন। রোগীর সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে অর্থ ছাড়া রক্ত পাওয়া না গেলে অর্থের বিনিময়ে রক্ত সংগ্রহ করা বৈধ। কিন্তু যে ব্যক্তি এর বিনিময় গ্রহণ করল, সে হারাম গ্রহণ করল”।

আজ যদি রুদ্র বিপদে পড়েও টাকার বিনিময়ে রক্ত সংগ্রহ করতো তাহলে যিনি রক্ত বিক্রয় করতেন তিনিই গুনাহগার হতেন৷ আর একারনেই রুদ্র রক্ত ক্রয় করতে নারাজ ছিলো।
.
পেটে ধরে আস্তে করে ওঠে দাঁড়ালো হৈমী। রুদ্র ফোনে কথা বলা শেষ করে হৈমীকে টেনে কাছে নিয়ে এলো। চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,

—- সরি। আমার মাথা ঠিক ছিলোনা। আজকের দিন অন্তত এমনটা করতে চাইনি আমি৷

ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠলো হৈমী৷ রুদ্র তাঁর দুগালে চেপে ধরে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,

—- প্লিজ, আমার মাথা ঠিক নেই। অতিরিক্ত টেনশনে আমি ঠিক থাকতে পারছিনা৷

—- আপনি কাঁদছেন কেনো? আমি কাঁদবো আপনি আমাকে মেরেছেন। দেখুন বাবুও কাঁদছে কেমন ব্যাথা হচ্ছে।

কপালে চুমু খেলো রুদ্র। তারপর ঠোঁটের কোনায়ও আলতো ঠোঁট ছোঁয়ালো৷ এক হাতে পেটের ওপর আলতোভাবে ধরে জিগ্যেস করলো,

—- আজ রাতে আমি তুমি আর ও অনেক গল্প করবো।

রুদ্রর চোখের পানি দুহাতে মুছিয়ে দিয়ে রুদ্রর কপালেও চুমু খেলো হৈমী। তারপর দুগালে, দুহাতে, গলায়ও চুমু খেলো। একজন অপরজনকে আদর করতে ব্যাস্ত হয়ে গেলো। অনেকটা সময় রুদ্র হৈমীকে নিজের বুকে চেপে ধরে ছিলো। হৈমীও চোখ বুজে রুদ্রর বুকের প্রতিটি অশান্ত স্পন্দন শুনেছে।

দুপুর দুটা বেজে গেছে দুজন একে অপরের মাঝে যেনো হারিয়ে গেছে৷ কেউ কোন কথা বলছেনা শুধু অনুভব করছে দুজন দুজনের হৃদয়ের কথাগুলোকে।

—- হৈমী তুমি কিন্তু ভয় পাবেনা জাষ্ট ওরা তোমাকে ভিতরে নিয়ে যাবে বাবুকে বের করেই পেটে সেলাই করে দেবে। তারপর সব ঠিকঠাক। নরমালে রিক্স হবে বলেই কিন্তু সিজার করাচ্ছি। তুমি শুধু ভয় না পেয়ে স্ট্রং থাকবে।

চোখ, মুখ খিচে রুদ্র কে জরিয়ে ধরলো হৈমী৷ কেঁদে দিয়ে বললো,

—- ওরা তো আমার পেট কাটবে অনেক ব্যাথা পাবো আমি, অনেক চিৎকার করবো, অনেক রক্ত বের হবে, আমিতো সেসব সহ্য করতে পারবোনা। আপনি আমার হাতটা ধরে থাকবেন প্লিজ আপনিও সাথে থাকবেন৷ আপনি আমাকে সাহস দেবেন। আপনি ছাড়া আমি যে খুব দূর্বল রুদ্র, খুব দূর্বল।

রুদ্র আরো গভীরভাবে জরিয়ে নিলো হৈমীকে। এবং কথা দিলো সে সাথে থাকবে সুবর্ণা যেহেতু আছে সেহেতু সমস্যা হবেনা৷
.
ডেলিভারি করানোর আগে আলট্রাসনোগ্রাফি করে দেখে নিলো বাচ্চা টা কোন পজিশনে আছে। কিন্তু যা দেখলো এতে বিষম খেলো সুবর্ণা। রিপোর্ট টা যখন রুদ্র দেখলো বিস্ময় নিয়ে তাকালো হৈমীর দিকে। হৈমী তো কেঁদে দেবে প্রায়৷ তাঁর সে কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে মুচকি হাসলো রুদ্র। হৈমীর পাশে গিয়ে বসে তাঁর মা কে উদ্দেশ্য করে বললো,

—- মা একটু বাইরে যাও আর হ্যাঁ সবাইকে বলো তোমার নাতি-নাতনির নাম ঠিক করতে।

সুরভী বেগম খুশিতে কেঁদেই দিলেন৷ হৈমীও কেঁদে ফেললো। ওদের দুজনকে কেবিনে একা রেখে সকলেই বেরিয়ে গেছে৷ এই সুযোগে রুদ্র দ্রুত হৈমীর মেক্সি উপরে ওঠিয়ে পেটের দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে এক হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

—- এই পিচ্চি পেটে দুদুটো বাবু আছে ভাবা যায়?

—- দুজন মিলে ঝগরা করে বলেই হয়তো আমি এতো ব্যাথা পেয়েছি। নয়না আপুরতো একটা ছিলো তাই কম ব্যাথা পেয়েছে৷

হেসে ফেলে রুদ্র পেটে পরপর দুটো চুমু খেয়ে বলে,

—- মাই প্রিন্স এন্ড প্রিন্সেস তারাতাড়ি বাবার কোলে এসে পড়ো৷
.
কেবিনের বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে কেউ বসে আছে। রুদ্রর দাদি আর সুখনীড়ের দাদু আসেনি। বয়স্ক মানুষ তাই তাঁদের নিয়ে আসা হয়নি৷ রুদ্র ভিতরে রয়েছে৷ একজন মহিলা ডক্টর, একজন নার্স আর রুদ্র রয়েছে। হৈমীর বেডের পাশের মোড়ায় বসে আছে রুদ্র। হৈমীর একহাত চেপে ধরে আছে সে। হৈমী তাকিয়ে আছে রুদ্রর দিকে। রুদ্রও তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে৷ ইনজেকশন দেওয়াতে তাঁর কোমড় থেকে শুরু করে পা অবদি অবশ রয়েছে। যখন পেট কাটছিলো তখন টের পায় হৈমী কিন্তু তাঁর কোন অনুভূতি কাজ করেনা।

সিজার করানোর ইচ্ছে রুদ্রর ছিলোনা কিন্তু হৈমীর শারীরিক কন্ডিশন দেখে সিজার না করে উপায় ছিলো না। জরুরি অবস্থা বলে একটা কথা আছে। সুতরাং একান্ত অপারগতাবশত সিজার করতে কোনো সমস্যা নেই। অর্থাৎ যখন বাচ্চা বা মায়ের জীবননাশের বা বড় কোনো ক্ষতির আশঙ্কা হয় এবং কোনো বিজ্ঞ চিকিৎসক সিজার করাতে বলেন, তখন সিজার করানো যাবে। তবে নরমাল ডেলিভারি সম্ভব হলে সিজার করা জায়েজ নেই। কোনো চিকিৎসক বা প্রতিষ্ঠান নিজেদের স্বার্থে সিজার করাতে বাধ্য করলে তারা অবশ্যই গুনাহগার হবেন। দুনিয়াবি দিক থেকেও এটা মারাত্মক অপরাধ।

রুদ্র যখন এ বিষয়ে সুবর্ণার সাথে কথা বলে তখন সুবর্ণা জানায় হৈমীর শারীরিক এবং মানসিক দিক দিয়ে খুব দূর্বল। বাচ্চা পেটে থাকা অবস্থায়ই যে ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারিয়েছে দুবার সে কি করে প্রসব বেদনা সহ্য করবে? তাই হৈমীর সিজার করানোই উচিত। সে যেহেতু একজন ডক্টর তাই রুদ্র কে দুটি উদাহরণ দেয় যে কন্ডিশনে নরমাল ডেলিভারি করানো উচিত নয়। এক; গর্ভস্হ শিশুর মাথার আয়তন যদি প্রসব রাস্তার চেয়ে বড় হয়৷ তখন সিজার করা ছাড়া উপায় থাকেনা৷ কারন যদি এই মূহুর্তে আপনি সিজার না করান তাহলে মায়ের মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে।তাই নয়মাসের সময় বাচ্চার মাথার সাইজ বা ডক্টরের সাথে কথা বলে নিতে হয় সিজারের দরকার হবে কিনা। দুই; যদি গর্ভবতী মা স্বাভাবিকের চেয়ে দূর্বল হয়ে থাকেন। তাহলে নরমাল ডেলিভারিতে না যাওয়াই ভালো। কারণ বাচ্চা প্রসবের সময় যে ব্যাথা বা যন্ত্রণা হবে সেটা সহ্য করার শক্তি যদি না থাকে তাহলে সিজার করিয়ে নেওয়াই ভালো। এ বিষয়ে আগেই ডক্টরের সাথে পরামর্শ করে নিতে হবে।

দ্বিতীয় রিজনের জন্যই হৈমীর সিজার করার সিদ্ধান্ত নেয় রুদ্র এবং সুবর্ণা৷
.
আল্লাহর অশেষ রহমতে এক কন্যা এবং এক পুএ সন্তানের জনক,জননী হয় রুদ্র, হৈমী। আল্লাহ তায়ালার রহমত, রুদ্রর মনোবল, নিজের সর্বাত্মক চেষ্টা,এবং সমস্ত সচেতনতা অবলম্বনের ফলে জয় হয় দুজন মানুষের পবিএ ভালোবাসার। রুদ্রর সন্তানদের মা হয় হৈমী, হৈমীর সন্তানদের বাবা হয় রুদ্র।

কিন্তু বিপদ ঘটে কন্যা সন্তান কে নিয়ে। পুএ সন্তান কান্না করলেও কন্যা সন্তান কাঁদেনি। তবে প্রাণ আছে। পুএ সন্তানের শারিরীক সুস্থতা নিশ্চিত করলেও কন্যা সন্তান না কাঁদায় ডক্টর এবং নার্স চিন্তিত হয়ে পড়লেন৷ কিন্তু রুদ্রর মুখে কোন চিন্তার ছাপ দেখা গেলো না। তাঁর সন্তান দের দেহে প্রান আছে এতেই উপরওয়ালা কে শুকরিয়া জানাচ্ছে সে। ডক্টর কন্যা সন্তান কে উল্টে পাল্টে দেখছে যাতে কান্না করে সে চেষ্টা করছে। মেয়েটা কাঁদলো প্রায় নয় মিনিট পর৷ খুশিতে চোখে পানি এসে গেলো রুদ্রর৷ ডক্টর এবং নার্সরাও আলহামদুলিল্লাহ বলে বাচ্চা দুটোকে একসাথে বাবার কোলে দিলো।
.
রাত আটটা বাজে। হৈমীর পাশে বসে আছে রুদ্র।সুরভী বেগমের কোলে রয়েছে রুদ্রিক, রুদ্র এবং হৈমীর একমাএ ছেলে রুদ্রিক শেখ। রেদওয়ান শেখের কোলে রয়েছে রুদবা রুদ্র এবং হৈমীর একমাএ মেয়ে রুদবা শেখ।

রুদ্রিক মাঝে মাঝে গলা ফাটিয়ে কান্না করলেও রুদবাকে সেই একবারই কাঁদতে শুনেছে সবাই। ডক্টর বলেছে রুদবা একটু দুর্বল এটা তেমন কোন সমস্যা নয়৷ জমজ সন্তান হলে একটা আরেকটার থেকে একটু দূর্বল হয়ই।

বাচ্চা দের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে হৈমী। ডেলিভারির পর তাঁকে কথা বলতে দেখা যায়নি। শুধু রুদ্রিক আর রুদবাকে যখন রুদ্র তাঁর কাছে নিয়ে আসে মৃদু হেসেছিলো সে। তৃপ্তি ভরে চেয়েছিলো তাঁর সন্তানদের দিকে। মনে মনে আওড়িয়ে ছিলো আমার বাবা,মা কে একসাথে ফিরিয়ে দিয়েছেন মহান আল্লাহ তায়ালা৷ কে বলে উপরওয়ালা শুধু কেড়ে নেয়? যা কেড়ে নেয় তা দ্বিগুণ করে যে ফিরিয়ে দেয় সেটা কি মানুষরা বুঝেনা? আমি আমার বাবা,মা কে আমার সর্বস্ব দিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবো। উপরওয়ালার দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার আমার সন্তানরা৷ আমি মা এরা আমার সন্তান, এরা আমাদের সন্তান, আমার আর রুদ্রর সন্তান ভেবেই সুখের অশ্রু বিসর্জন দেয়।
.
একে একে প্রায় সবাই ফিরে যায়। রুদ্র, সুরভী বেগম, মনিকা বেগম আর সূচনা রয়েছে শুধু। নয়ন থাকতে চেয়েছিলো, সে বাচ্চাদের রেখে যেতেই চাইছিলো না। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে তাঁকে পাঠানো হয়েছে বলা হয়েছে সকাল সকালই আবার এসে পড়তে।
.
রুদ্রিক রাত দশটা থেকে কাঁদতে শুরু করেছে থামার নাম নেই। রুদবা হৈমীর বুকেই ঘুমিয়ে আছে৷ কিন্তু রুদ্রিক ঘুমাচ্ছে না সে কেঁদেই চলেছে। একবার সুরভী বেগম একবার রুদ্র তাঁকে কোলে করে পুরো রুম ঘুরে বেড়াচ্ছে। উপায় না পেয়ে সুরভী বেগম রুদবাকে কোলে নিয়ে রুদ্রিক কে হৈমীর কাছে দিতে বললো৷ রুদ্র তাই করলো৷ সুরভী বেগম আবারো ছেলেকে ফিডিং করাতে বললো। রুদ্র হেল্প করলো হৈমীকে৷ কিন্তু রুদ্রিক কান্নায় ব্যাস্ত৷ খাচ্ছে না বলে হৈমীও কেঁদে দিলো বললো,

—- ও এমন কাঁদে কেনো? আমরা কি ওকে বকেছি নাকি কতো ভালোবাসছি সবাই তবুও কেঁদেই যাচ্ছে।

রুদ্র মুচকি হেসে বললো,

—- মায়ের ছেলে মায়ের মতোন হতে হবেনা? মা রেডিও, ক্যাসেট জুরে বসে আর ছেলে ব্যান্ড বাজাচ্ছে।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here