বৈধ_ধর্ষণ,পর্ব- ১

0
2732

#বৈধ_ধর্ষণ,পর্ব- ১
#মিমি_সুলতানা

_____________________
নিচে মেয়েদের চিল্লাচিল্লি শুনে জানালা দিয়ে তাকাতেই সেই পুরনো দৃশ্য আবার দেখতে পেলাম।
পাশের বিল্ডিং এর মালিক হাসিবুল ইসলাম ফাহাদের বাসার দারোয়ান মেয়েদের হাতে মার খাচ্ছে।
এটা যেন তার নিত্যদিনের রুটিনে পরিণত হয়েছে।
মেয়েদের সাথে ফ্ল্যার্ট করতে যাবে আর তাদের জুতার বাড়ি খাবে।
কিন্তু আমি মাঝে মাঝে অবাক হই এটা ভেবে যে, কতটা ছ্যাঁচড়া হলে মেয়েদের জুতার বাড়ি খেয়েও একজন বলতে পারে ম্যাম আপনার জুতাটা খুব সফট!
সিদ্দিক না হয় তার কর্মের সাজা এভাবে পেয়েই যাবে কিন্তু সমাজে ভদ্রতার পোশাকে সজ্জিত কিছু পশুদের কি শাস্তি হবে!
তাদের অন্যায় গুলো ভদ্রতার পোশাকের নিচেই চাপা পরে যায়। প্রতিবাদ করার সাহস আর কেউ করে ওঠে না। আর যদি কেউ করেও ফেলে তাহলে তার গল্পটাও হয় ঠিক আমার মতোই।
তার পৃথিবীটাও হয়তো আমার মতোই চার দেওয়ালের মাঝে থমকে যায়, প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হতে হয় এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষার।
.
.
.
আমি আরশী।
আমার জীবনে অন্যতম একজন আদর্শ মানুষ আবার বাবা। সেই ছোট্ট জীবনেই ছোটখাটো রঙিন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম বাবার আশ্বাসে। সাজানো এক স্বপ্নের আকাশে উড়াল দিয়েছিলাম বাবার হাতটি ধরেই। তার হাত ধরে পথচলা, কতশত উপদেশ সব যেন আজ পরিষ্কার এক ডায়েরির পাতা,কোথাও কোন দাগ পড়েনি কিন্তু ডায়েরির পাতা থেকে জীবনের সাথে তাকে আর জোড়া হয়ে ওঠেনি।
স্বপ্নের আকাশে দু-চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে সময়টা যেন আমার মতোই এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সময়েরও নিজস্ব এক গতি আছে হঠাৎ-ই সে থমকে গেলো। এক দমকা হাওয়া এসে সবটা ওলট-পালট করে দিলো। এক সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা প্যারালাইজড হয়ে যায়,আমি তখন সবে ক্লাস টেন এ পড়ি ।
বাবার অসুস্থতার পরে আমি একদম-ই আমার পৃথিবীতে একা হয়ে গেলাম। কিন্তু আমার তখনো অনেক পথচলা বাকি, বাকি আছে আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ করা। আমি বাবার চোখের দিকে তাকালেই যেন টানটান কন্ঠে বলা সেই কথাটি ভেসে ওঠে “মা সবসময় লক্ষ্যের দিকে লক্ষ্য কর, লক্ষ্যের মাঝে কোন বাঁধা কে নয়”
সবাই বলে আমি বাঘের মেয়ে, আমি এভাবে হেরে গেলে চলবে না।
আমার বাবা সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন, স্বল্প বেতন হলেও আমাদের সুখের কমতি ছিলো না। মা -বাবা আর আমার ছোট বোন আরোহী মিলে পরিবারটা যেন স্বর্গের ছোঁয়া পেয়েছিলো। কিন্তু হঠাৎ-ই এই ঝড়টা এসে সব এলোমেলো করে দিলো তবে আমি ভেঙে পরিনি আমার এখন অনেক দায়িত্ব, মা কে সামলাতে হবে। আরোহীর পড়াশোনাও চালাতে হবে সাথে নিজের ক্যারিয়ার গোছাতে হবে।
ব্যাংকে জমা রাখা কিছু অর্থ আর পাশাপাশি কয়েকটা টিউশনি করে কোনরকমে চলে যাচ্ছিল আমাদের সংসার।
আর আমিও এগিয়ে যাচ্ছিলাম নিজের লক্ষ্যে।
.
.
.
এসএসসি তে এ+ পেয়ে আমি কলেজ এ পা রাখি।তখন আরোহী ক্লাস সেভেনে। কলেজে দেখতে দেখতে ১ টা বছর কেটেও যায় আমি সেকেন্ড ইয়ারে উত্তীর্ন হয়ে যাই। এরমধ্যে আমার আর প্রেম-ভালোবাসা হয়ে ওঠেনি,কিন্তু আজকাল কেন যেন আমার ক্লাসমেট অভিকে একটু বেশিই ভালো লাগছে। ক্লাসে লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে চোখাচোখি, ছুটি শেষে কলেজের পাশে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা, প্রতিদিন কলেজে গেলে এক একজনের হাত থেকে আমার প্রিয় বকুল ফুল পাঠিয়ে দেওয়া, এগুলো সবই আমি লক্ষ্য করেছি।এভাবেই একটা অন্যরকম ভালোলাগার মধ্য দিয়ে বেশ ভালোই দিন কেটে যাচ্ছিল আমার। কিন্তু ভালো লাগারও তো একটা শেষ আছে এতোদিনে হয়তো অভির মনেও আমার প্রতি ভালো লাগাটা ভালোবাসার রুপ নেয়। তাই হঠাৎ-ই আমাকে চমকে দিয়ে কলেজ এর মাঠে সবার সামনে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে “আমি তোমার মাঝে নিজেকে বিলিয়ে আমিহীনতায় ভুগতে চাই,তুমি কি আমায় আমিহীন করে রাখবে?” সেদিন অভিকে ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য আমার হয়নি।এতোদিনে যে কেউ আমাকে প্রপোজ করেনি তা নয়, আমি আহামরি সুন্দরী না হলেও সুন্দরী ছিলাম না এমনটাও না। কলেজে ওঠার পর অনেকভাবেই অনেক ছেলে প্রপোজ করেছে কিন্তু সাদা-কালো এই জীবনে কাউকে মেলাতে পারিনি হয়তো শুরু থেকেই মনের কোণটা অভির নামে দখল হয়ে ছিলো।
.
.
.
.
৬ মাস হয়ে গেলো আমাদের সম্পর্কের।
এর মাঝে কখনো দু’জনের মধ্যে মতের অমিল হয়নি।
একজন আরেকজনকে সবটা দিয়ে আগলে রেখেছি, ক্লাস শেষে সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে বসে গল্প করা, মাঝে মাঝে বকুলের মালা পাঠানো,লাল গোলাপ এনে খোঁপায় গুজে দিয়ে বলা তুমিই লাল গোলাপের রানী। ঝগড়া হলে দু’জনেই ভুলটা মেনে নেওয়া সবটাই যেন চলছিলো ভালেবাসার সেই প্রথম দিনের মতো।এতোদিনের সাদা-কালো জীবনটা যেন অভি আসাতে রংধনুর মতো রঙিন হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু এই রঙিন সময়ও আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসে।
দিনটি ছিলো সোমবার, কলেজ শেষে বাসায় ফিরতেই অনেকগুলো মানুষকে দেখতে পাই। মা আমাকে তাড়াতাড়ি করে ভিতরে নিয়ে গিয়ে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই একটা শাড়ী হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে এটা পড়ে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে, খুব ভালো পরিবার থেকে সম্মন্ধ এসেছে। তাদের অনেক টাকা পয়সা আছে,ছেলের নিজের গাড়ি-বাড়ি ও আছে, আমাদের কিছু দেওয়া লাগবে না ওরা তোকে রানী করে রাখবে রানী। কথাগুলো এক নিঃস্বাসে বলেই মা রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
কিছুক্ষণের জন্য আমি যেন একটা ঘোরের ভিতরে চলে গেলাম।
অভির সাথে চলা এতোটা সময়, হাতে হাত রেখে সারাজীবন কাটানোর প্রতিশ্রুতি, ছোট্ট সাজানো একটা কল্পনার রাজ্য, সবটা যেন নিমিষেই ভেঙে গুড়িয়ে গেলো।
যেই মনে অভির বাস সেখানে আমি কিভাবে অন্য কাউকে ঠাঁই দেবো! ভাবতেই আমার চারদিক অন্ধকারে ছেয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ পরে এসে মা আবারও তাড়া দিতে লাগলো,কিরে এখনো রেডি হসনি!
না এখন চুপ করে থাকলে আমার অনেক কিছু হারাতে হবে। যে করেই হোক মা’কে বলতেই হবে অভির কথা। মনের সমস্ত সাহস একত্র করে বলেই ফেললাম এ বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না আমি একটা ছেলেকে ভালোবাসি।
মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ করেই হেঁসে দিয়ে বললো,
-এই বয়সে এমন একটু-আধটু হয়েই থাকে কোনো ব্যাপার না, আয় তোকে আজ আমি শাড়ী পড়িয়ে দেই।
-আমি কোনো আবেগ থেকে বলছি না, আমি সত্যি অভিকে খুব ভালোবাসি। আর আমি এখন বিয়ের জন্য প্রস্তুত না। আমি আমার লক্ষ্য পর্যন্ত পৌঁছাবো, অভিও নিজের পায়ে দাঁড়াবে তারপর আমরা বিয়ে করবো তার আগে নয়।

মা বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমাকে টেনে নিয়ে শাড়ীটা পরাতে পরাতে বলতে লাগলো.
-ছেলে অনেক বড় ব্যাবসায়ী, বিয়ে হয়ে গেলে তোর বাবার চিকিৎসার সব খরচ দেবে বলেছে।
আরোহীর পড়ালেখা নিয়েও কোনো চিন্তা করতে হবে না আমাদের। কতটা উদার মনের মানুষ হলে এমন করে বল? যদি এই সংসারের ভালো চাস, যদি চাস তোর বাবার চিকিৎসা হোক তাহলে নিজ থেকে চুপচাপ এই বিয়েতে রাজি হয়ে যা।
বিয়ে তো তোকে করতেই হবে সোজা আঙ্গুলে ঘী না উঠলে আঙুল আমি বাঁকাতেও জানি।
শেষের কথাগুলো যখন শুনছিলাম নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মা কে এর আগে কখনো এতোটা নিষ্ঠুর রুপে দেখিনি।
তবে সত্যি এটাও আমি চাইলেও এখন বাবার চিকিৎসার জন্য এতো টাকা জোগাড় করতে পারবো না। ঠিক সেই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে আমার কি করা উচিৎ ভেবে পাচ্ছিলাম না। অভিকে জানানোর মতো সাহসটুকুর তখন বড়ই অভাব ছিলো।
.
.
.
.
পর মূহুর্তে দুই একজন এসে আমার চুলগুলো বেঁধে দিয়ে চোখে হালকা করে কাজল টেনে দিলো।
অভি বলতো,চিকন কাজলে তোমাকে ঠিক সেই রাজকন্যার মতো লাগে, যেই রাজকন্যাকে পেতে চেয়েছে তো সবাই কিন্তু দেখতে পায়নি কেউ।
ভাবতে ভাবতেই আমার মাথায় লম্বা এক ঘোমটা টেনে তাদের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো।
তাদের ভিতরে কেউ তেমন প্রশ্ন ও করলো না।
একটু কানাঘুঁষা করেই তারা জানালো আমাকে আংটি পড়িয়ে রেখে যেতে চায়, তারা আরো চায় বিয়েটা যেন ১ সপ্তাহের মধ্যেই হয়ে যায়।
জেলখানায় বন্দী এক অপরাধীর মতো লাগছে নিজেকে, যে হাজার আর্তনাদ করলেও কেউ ভ্রুক্ষেপ করবে না।
.
.
.
আজ আমার গায়ে হলুদ।
খুব বড় করে আয়োজন করা হয়েছে।
শুনেছি সবটাই না-কি ছেলেপক্ষ করছে। আরোহী সবার সাথে আনন্দে মেতে আছে, পুরোটা বাড়িতে এক খুশির আমেজ।
অভিকে খুব মনে পড়ছে।
আমাকে ছাড়া সে ভালো থাকবে না আমি জানি তবে একটা সময় সবই ঠিক হয়ে যাবে। বাস্তবতার চাপে পরে না-জানি এমন কত ভালোবাসার বলিদান হচ্ছে।
.
.
.দেখতে দেখতে আমার বিয়েটা হয়েই গেলো।
শুনেছি যার সাথে বিয়ে হয়েছে সে না-কি খুব স্মার্ট।
তার নাম আরাফাত হোসেন শুভ। সত্যি এরা খুব বড়লোক, বড় বড় কয়েকটা বাড়ির মালিক । কিন্তু এগুলো দিয়ে কি হবে? আমি তো এসবের কিছুই চাইনি!
চেয়েছিলাম বাবার চোখে দেখা নিজের স্বপ্নটা পূরণ করতে, সাথে নিজের ভালোবাসার মানুষটার হাত ধরে বাঁচতে। আচ্ছা আমার গল্পটা কি তাহলে হেরে যাওয়ার গল্প হিসেবেই নামকরণ হবে?

সারাদিন ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে কেটে গেলো, অনেক মানুষের সাথে পরিচিত হলাম কিন্তু সবকিছুর মাঝেও অভিকে ভুলতে পারলাম না।
ছেলেটা হয়তো সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে পাগলের মতো পরে আছে।
.
.
দিনশেষে রাত এলো সাথে বিষন্নতাও আমাকে গ্রাস করে নিলো। আজ আমি পুরোপুরি অন্যকারো।আমার নিজের উপর আজ থেকে অন্য কারো রাজত্ব চলবে। নিজের দেহের উপর এমন একজনের ছোঁয়া পড়বে, যাকে কখনো দেখি-ই নি, যার প্রতি নেই কোনো ভালোবাসার অনূভুতি! এটা আমি কি করে মেনে নেবো?
এসব ভাবতেই সালাম দিয়ে প্রবেশ করলো শুভ।
এই প্রথম আমি ওকে দেখলাম, চেহারায় সুস্পষ্ট এক ভদ্রতার ছাপ।
শুভর ভিতরে কোনোকিছুর কমতি নেই শুধু তার জন্য নেই মনে কোনো অনূভুতি। তিনবার কবুল বলে শরীরের বৈধতা দেওয়া গেলেও বুকের বা’পাশের জায়গা টা সবাইকে দেওয়া যায় না।
আমি চাইনা আমাকে এমন কেউ স্পর্শ করুক যার প্রতি আমার নেই কোনো ভালোবাসা।
.
.
আমি আস্তে করে সালামের উত্তর দিয়ে ওভাবে মাথা নিচু করেই বসে রইলাম। ঠিক এই মূহুর্তে নিজেকে পথ হারিয়ে যাওয়া এক পথিকের মতো মনে হচ্ছে। কিন্তু হার মেনে নিলে চলবে না আমার নিজেকেই নিজের পথ তৈরি করে নিতে হবে।
গলা খাঁকারি দিয়ে শুভ বলতে লাগলো,
তোমার সাথে আগে কখনো কথা হয়নি।
প্রথম যখন তোমাকে রাস্তার পাশে কিছু বাচ্চাদের সাথে আইসক্রিম খেতে দেখেছিলাম তখনই তোমার ওই অমায়িক হাসি দেখে আমি ঠিক করে নেই আমার এ মেয়েটাকেই চাই। আর দেখো এখন তুমি আমার স্ত্রী। আমি জীবনে চেয়েছি কিন্তু পাইনি এমন কিছু নেই বললেই চলে।
যেটা চেয়েছি সেটাই পেয়েছি নয়তো জোর করে হলেও হাসিল করে নিয়েছি চাই সেটা নাম হোক সম্মান হোক বা তুমি।
কথাগুলো শুনে আমি একভাবে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। শুভ হেঁসে দিয়ে বলে বলল,
হা হা হা মজা করলাম কিছু মনে করো না।
তারপর তোমার সম্পর্কে কিছু বলো আমরা একজন আরেকজনকে জানি বুঝি।
এই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইলাম না। আমি একটু উত্তেজিত হয়েই বলে উঠলাম আমি একটু সময় নিতে চাই দু’জন দু’জনকে চেনা জানার পেছনে, হুট করেইতো আর একটা সম্পর্ক হয়ে যায় না।
শুভ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, নিজেকে সময় দিতে চাও? না-কি সম্পর্ককে?
আমি প্রশ্নটা শুনে একটু অবাক হলাম কিন্তু পর মূহুর্তে শুভ আবার হেসে দিয়ে বলল আচ্ছা সময় নাও সমস্যা নেই আমি চাই তুমি সময় নিয়ে হলেও নিজেকে পূর্ণভাবে আমার কাছে সঁপে দাও।
কথাগুলো কেমন যেন মনে এক দাগ কেটে গেলো। তার কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়ার কথাটা হয়তো মিথ্যা হলেই ভালো হতো।
.
.
.
.
দুইদিন কেটে গেলো, এর মাঝে বৌ-ভাত ও হয়ে গেলো। আজ আমি আর শুভ সহ বাবার বাসাতে এসেছি। আসার সময় সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটির পাশ দিয়ে এসেছি, এই প্রথমবার গাছটাকে দেখে খুব বিষন্ন আর রঙহীন লেগেছে।
আমি বাবার পাশে বসে সব কথা বললাম। বাবা সুস্থ থাকলে হয়তো গল্পটা ভিন্ন হতো। স্বপ্নের হাত ধরে পাড়ি দিতাম নিজের রাজ্য।
অভিকে খুব মনে পড়ছে আজ। দুপুরে আমার বান্ধবী আলিজার থেকে জানতে পেরেছি অভি হাসপাতাল আছে।আমার বিয়ের পরে একদম ই ভেঙে পড়েছে। সারাদিন রাত বৃষ্টি রোদ উপেক্ষা করে ওই কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে ছিলো।
হাসপাতালে বেহুশ অবস্থাতেও শুধু আমার নাম ধরেই ডেকে যাচ্ছে।
মনটা আর কোনো বারণ শুনছে না। যে করেই হোক অভির সাথে আমার কথা বলতেই হবে।
আর কিছু না ভেবে আমি আমার রুমে এসে অভির ফোনে কল করলাম।কয়েকবার রিং হওয়ার পরে ফোন তুললো অভি।
ওপাশ থেকে করুন কন্ঠে ভেসে এলো, কেমন আছো আরশী?
আমি নিজেকে কোনোভাবেই আর সামলে রাখতে পারলাম না শব্দ করে কেঁদে উঠে বললাম,
-অভি তুমি এমন কেন করছো?
তুমি কি জানো না তুমি আমার কাছে ঠিক কি?
বিয়ে হয়ে যাওয়া মানেই একটা সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়ার নয়, মনটা আজও তোমার-ই আছে অভি।তুমি ভালো না থাকলে যে আমিও ভালো থাকবো না অন্তত আমার জন্য তুমি নিজেকে ভালো রাখো!
-আমি তোমাকে কোনো দোষ দেইনা আরশী।
আমি জানি তুমি আমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসো আমাকে। আর বিয়েটাও যে তুমি পরিস্থিতির চাপে পরে করেছো সেটাও আমি বুঝতে পারি। শতবার বিয়ে হয়ে গেলেও তুমি আমার এটা চিরন্তন সত্য।
আমি ভালো থাকতে চাই কিন্তু কি করবো বলো আমাদের স্মৃতিগুলো সবসময় তোমার শুন্যতা আমাকে বুঝিয়ে দেয়।আমাকে ভাবতে বাধ্য করে তুমি আর আমার কাছে নেই।আমি পারছি না আর, আমি তোমার ভালোবাসায় আমিহীন হতে চেয়েছিলাম কিন্তু বাস্তবতা আমাকে তুমিহীন করে দিলো।
এতটুকু বলেই অভি অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়লো। অভিকে স্বান্তনা দেওয়ার মত কোনো ভাষা আমি খুঁজে পাচ্ছি না। কিছু না বলেই ফোনটা কেটে দিয়ে বুকে জড়িয়ে বললাম ভালোবাসি অভি,শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।
বাহ! দারুন!
কথাটা শোনা মাত্রই পুরো শরীর কেঁপে উঠলো আমার।পিছনে ফিরে দেখলাম দরজার কাছে শুভ দাঁড়িয়ে আছে, রাগে চোখদুটো রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।
আমি কিছু বলে ওঠার আগেই শুভ এসে সমস্ত শক্তি দিয়ে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। আচমকা এমন কিছু ঘটে যাওয়ায় নিজেকে সামলাতে না পেরে দুরে ছিটকে পড়ে গেলাম।
-নষ্ট মেয়ে,এই ছিলো তোর মনে?
এরজন্য তুই আমাকে তোর কাছে যেতে দিস না?
আর কি বলেছিলিস তুই সময় চাস তাই না?
– আমার কথা টা একটু শুনুন প্লিজ, সবটা না শুনে এমন অন্যায় করবেন না। আমি আপনাকে সবটা বলছি একটু সময় দিন আ..
কথাটা পুরো শেষ করার আগেই আমার চুল ধরে বিছানার উপর ফেলে দিলো।
শুভর এমন হিংস্র রুপ দেখে অনেকটা ভয় পেয়ে গেলাম।
শুভ আবার বলতে থাকলো,
-আমাকে কি পুরুষ মনে হয় না?
আজ দেখবি আসল পুরুষত্ব কি।
বলেই প্যান্ট এর বেল্ট খুলতে লাগলো।আমি এবার শুভর পা ধরে জোরে কেঁদে উঠে বললাম প্লিজ এমন করবেন না। আমি আমার ভুল স্বীকার করছি এই ভুলের শাস্তি টা এভাবে দিবেন না।
-শাস্তির দেখেছিস কি?
এই শরীরে আমার ছোয়া তুই চাস না তাই না?
আজ থেকে এই শরীরটাই হবে আমার সর্বক্ষণের ভোগবস্তু।
আমার মুখে কাপড় বেঁধে হাত চেপে ধরে আমার উপর চালিয়ে গেলো পাশবিক নির্যাতন।
ব্যথায় কষ্টে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম।
সে আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললো তোকে বলেছিলাম না আমি যেটা চাই সেটাই পাই আর না পেলে সেটা জোর করে নিজের করে নেই।
রুম থেকে বের হয়ে গেলো শুভ।
আর আমি ওভাবেই বিছানায় পড়ে থাকলাম।
আমার গল্পটা এখন শুধু সাদা-কালোর মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলো না তার সাথে যুক্ত হলো এক বৈধ ধর্ষণের অধ্যায়।
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে রুমের বাইরে আসলাম। মা, আরোহী আর শুভ মিলে আড্ডা দিচ্ছে। এই মানুষটাকে দেখলে কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত ও সম্মান আসতো মন থেকে আর এখন বেঁচে আছে শুধুই ঘৃনা।
.
.
.
৭ দিন হয়ে গিয়েছে আমি শ্বশুর বাড়িতে এসেছি।
এর মধ্যে নিজের উপর চলেছে অবর্ননীয় অত্যাচার। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এখন আর নিজেকে চিনতে পারছি না। চোখের নিচে কালো দাগ, ঠোঁটের একপাশে কালো হয়ে ফুলে আছে, পুরো শরীরে কালো কালো দাগ, বুকে রয়েছে অসংখ্য কামড়ের চিহ্ন, আয়নার ভিতরে এখন আর নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাই না, পাই এক বিধ্বস্ত প্রজাপতির দেখা।
ভাবতেই অবাক লাগে এই মেয়েটি-ই একসময় ছিলো তার বাবার স্বপ্নপরী,কারো কাছে ছিলো তার স্বপ্নরানী। মানুষের জীবন কি অদ্ভুত তাই না!ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে “তোমার গায়ে আমি কখনো ফুলের টোকাও লাগতে দেবো না ”
শোনা মানুষটা আজ ময়লা কাগজের মতো অন্য একজনের পায়ের নিচে পড়ে পিষে যাচ্ছে। এগুল ভাবতে ভাবতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েই কান্না করছিলাম।
কখন যেন শুভ এসে রুমে প্রবেশ করলো, টের পাইনি। যখন দেখলাম ওকে,
এক রাশ ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠলো।
এসেই আমার কোমরে হাত দিয়ে বললো ইশশ এখানে দাগ এতো কম পড়লো কি করে!
তোমাকে মানাচ্ছে না এতো কম দাগে বলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে আবার বিছানায় ফেলে দিলো।
শুরু হয়ে গেলো আবার সেই পাশবিক নির্যাতন।
আজকে ওর পাশবিকতার মাত্রা টা একটু বেশিই ছিলো, ১ ঘন্টার নির্যাতন শেষে হাঁপিয়ে আমাকে ছেড়ে দিলো। প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে শুরু করলো। নিচে বিছানা ভিজে যাচ্ছে। অসহ্য ধরনের ব্যথা আর যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। ৩০ মিনিট পরে আমার জ্ঞান ফিরলো। কোথাও কেউ নেই।মনে হচ্ছে এক মরুভূমির ভিতর সংগ্রাম করে একাই কোনরকমে বেঁচে আছি। আরোহী কে খুব মনে পরছে আজ। ছোট হলেও সবসময় আমি ওকে আমার পাশে পেয়েছি।অনেক ইচ্ছে করছিল ওর সাথে একটু কথা বলতে।ব্যাথা সামলে কোনরকম উঠে, কল করলাম আরোহী কে। আরোহী যখন জিজ্ঞেস করলো আপু কেমন আছিস?
কোন উত্তর দিতে পারলাম না। ভেতর থেকে হুহু করে কান্না চলে আসলো। শুধু ভাঙা মন নিয়ে অভিযোগের সুরে কিছুক্ষন কান্নাই করে গেলাম।
.
.
.
.
পরদিন সকাল হুট করেই আরোহী চলে আসলো বাসায়। ওকে দেখে আমি যতটা না খুশি হলাম তার থেকে বেশি চিন্তায় পরে গেলাম। আমার চেহারার এই অবস্থা দেখে কোনো প্রশ্ন করলে কি উত্তর দেবো আমি?
যে ভয়টা পাচ্ছিলাম সেটাই হলো, ও আমার এই অবস্থা দেখে আমাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ছোট এই বোনটাকে আমি আগে কখনো এভাবে কান্না করতে দেখিনি। ওর কান্না দেখে আমিও নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না, আমিও ওকে ধরে কান্না করে দিলাম। এরমধ্যে শুভর আগমন আমাদের এভাবে দেখে রেগে ফেটে পড়লো আর অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগলো।
-নষ্টামি করার কারণে মাইর খাস আবার বোনকে কান্না করে নালিশ ও করিস বেহায়া মেয়ে লজ্জা করে না তোর! বলেই আমাকে টান দিয়ে আরোহীর থেকে ছাড়িয়ে আবারও মারতে লাগলো। ক্লান্ত শরীরটা এই অত্যাচার আর বেশিক্ষণ নিতে পারলো না। হ্যা আমি ধীরে ধীরে আঁধারের কোলে ঢলে পড়ছি। তার আগে দেখেছি আপুকে আর মারবেন না ওকে ছেড়ে দিন বলে শুভর পা জড়িয়ে আরোহীর সে কি কান্না!!
ঝাপসা চোখে দেখলাম শুভ আরোহীর হাত ধরে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
.
.
.
তোমার বোনের গায়ে কি আমি সাধে হাত তুলেছি?
আমাকে সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ তোমার বোন।
আমার তো মনে হচ্ছে ওকে বিয়ে করে আমার লাইফ শেষ হয়ে গেছে।
আরোহীর সামনে রাগ দেখিয়ে চিৎকার করে কথাগুলো বলছিলো শুভ।
আরোহী কান্না করতে করতে বলে,
– আপুকে আমি অনেক ভালোবাসি৷ ওর এমন অবস্থা আমি সহ্য করতে পারছিনা। আপনার ভালো না লাগলে আপুকে ডিভোর্স দিয়ে দেন। তবুও এমন অত্যাচার করবেন না প্লিজ।
– ডিভোর্স! ডিভোর্স দিলে আমার বাইরে সবার কাছে ছোট হতে পারে।
তবে একটা উপায়ে তোমার আপুকে বাঁচাতে পারো।
তোমার আপু আমাকে যে শারিরীক সুখ দিতে পারেনি সেটা যদি তুমি দাও, তাহলে ওর সাথে আমি আর কোন প্রকার খারাপ ব্যবহার করব না। আর এমনিতেও তোমাকে আমার ওর থেকে বেশি ভালো লাগে৷
শুনে আরোহীর পুরো শরীর কেঁপে উঠলো। এটা কি শুনলো সে!
কিন্তু চোখের সামনে নিজের বোনের এমন পরিস্থিতিও মেনে নিতে পারছেনা আরোহী। সে বোনকে এতটাই বেশি ভালোবাসে যে নিজের জীবন দিয়ে দেয়ার জন্য ও সে এক সেকেন্ড ও ভাবতো না। কিন্তু এটা জীবন বা অন্যকিছুর বিষয় নয়। নিজের সম্মানের ব্যপার।কি করতে হবে আরোহী বুঝতে পারছেনা কিছুই, আরোহীর মনে হচ্ছে অনেক বড় একটা দায়িত্ব এসে পড়লো তার মাথায়। বোনের ভালো থাকা বা খারাপ থাকা নির্ভর করছে তার সিদ্ধান্তের উপর।
.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here