#বৈধ_ধর্ষণ,৪,৫
#মিমি_সুলতানা
__________
পর্ব- ৪
______________
কাপটা আরোহীর হাতে
দেওয়ার সময় ওর হাতের দিকে তাকাতেই একটা গভীরভাবে আঁচড়ের দাগ দেখতে পেলাম।
অজানা কারণেই রোজার নখের মাঝে জমে থাকা রক্তের কথা আমার মনে পরে গেলো।
যেগুলো ঠিক এমন শক্তভাবে আঁচড়েই আসতে পারে।
আমি খপ করে আরোহীর হাত ধরে ফেললাম।
আঁচড়ের দাগগুলো খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণও করলাম।
আরোহীর চেহারায় ভয় ও আতংকের ছাপ স্পষ্ট।
-এটা কিসের দাগ আরোহী?
প্রশ্নটা করতেই আরোহী আরো ভয় পেয়ে গেলো।
তোতলাতে তোতলাতে জবাব দিলো,
-কিসের দাগ মানে? দাগ কি হতে পারে না?
জানোই তো আমার তাড়াহুড়ো করে চলার অভ্যাস। বাথরুমে পরে গিয়ে কেটে গিয়েছিল।
-কিন্তু এটা তো কোনো কেটে যাওয়ার দাগ নয়!
-তাহলে কি বলতে চাইছো তুমি?
আমি তোমাকে মিথ্যা বলছি?
-ছোট থেকে বড় হতে দেখেছি আমি তোকে। কোনটা সত্যি বলিস কোনটা মিথ্যা সেটা আমি ভালো করেই বুঝতে পারি।
-তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছো আপু? আমার উপর কি একটুও বিশ্বাস নেই তোমার?
-সন্দেহ করার কথাটা মানুষ তখনই বেশি বলে যখন সে কোনো অন্যায় করে অথবা সত্যি লুকানোর চেষ্টা করে। আর রইলো বিশ্বাসের কথা!
তুই সত্যি বললে অবশ্যই আমি বিশ্বাস করতাম।
আরোহী অভিমান করে বেলকনি থেকে বের হয়ে গেলো। আরোহীকে ভীষন অপ্রস্তুত লাগছে।
.
.
আরোহী চলে যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি।
হাজার ধরনের চিন্তা আমার পিছু ছাড়তে চাচ্ছে না।
আরোহীর হাতে আঁচড়ের দাগ কোথা থেকে আসলো? যেভাবেই আসুক ও আমাকে মিথ্যা কেন বলবে?
তবে কি রোজার খুনের সাথে ও কোনোভাবে জড়িয়ে আছে!
ছি ছি, কি ভাবছি আমি এসব?
আমি নিজের বোনকেই সন্দেহ করছি!
পরিস্থিতি মানুষকে কত কিছুই না ভাবতে বাধ্য করে। নিজের উপর একরাশ বিরক্তি নিয়ে বেলকনি থেকে বের হয়ে গেলাম।
.
.
.
.
রাত ন’টা বাজে।
কয়েকবার কলিংবেল বেজে উঠলো কিন্তু দরজা কেউ খুলতে না যাওয়ায় আমি ই এগিয়ে গেলাম।
দরজা খুলে দিতেই আমাকে ধমকি দিতে দিতে একটা ছেলেকে নিয়ে প্রবেশ করলো শুভ।
ছেলেটাকে আগে কখনো দেখিনি তবে বেশ স্মার্ট ছেলেটা। মাথায় সাজানো গোছানো এক গাদা চুল।
গায়ের রং ফরসা।উঁচু লম্বাও বেশ, বলতে গেলে পারফেক্ট একটা ছেলে।
বাসার অন্যান্য সদস্যদের আচরণে বুঝতে পারলাম ছেলেটার নাম ইভাদ।শুভর অনেক পুরনো বন্ধু। এর আগেও বেশ কয়েকবার এসেছে।
ছেলেটার সাথে আমার আর আলাপ হয়নি অবশ্য এটা নতুন কিছু না। এই বাড়িতে কোনো অতিথি আসলে আমাকে কখনোই কেউ নিজ থেকে পরিচয় করিয়ে দেয়না। যদি অপরিচিত কারো সামনে পরে যাওয়ায় সে আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করে তাহলে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে ” শুভর বউ।”
সাথে আরো এমন কিছু বলে যা
এড়িয়ে চলতে আমারও এখন কোনো অতিথিদের সামনে যাওয়া হয় না।
“ইভাদকে ওর রুমটা কেউ দেখিয়ে দাও ও ফ্রেশ হয়ে নিক তারপর একসাথে ডিনার করা যাবে।”
শুভ কথাটা বলতেই অনু ইভাদকে সাথে নিয়ে ওর রুমটা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য এগিয়ে চলল।
দু একপা বাড়াতেই পিছু ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে একটি হাসি দিলো ইভাদ।
এই হাসিটা কোনো সাধারণ হাসি নয়! এই হাসি জুড়ে আছে গভীর রহস্য।
কে এই ইভাদ?
আমার দেখিয়ে এমন রহস্যময় হাসি দেওয়ার পিছনে কারণ কি?
তাছাড়া এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে এই বাড়িতে এসে ওঠার উদ্দেশ্যই বা কি হতে পারে?
তখনের মতো রুমে চলে আসলাম ঠিকই কিন্তু ইভাদের এভাবে আগমনটা আমাকে খুব দ্বন্দ্বে ফেলে দিলো।
আপাততঃ সব চিন্তা সরিয়ে রেখে আমি রুমের দিকে পা বাড়ালাম।
.
.
.
.
ডিনার সেরে রুমে আসলো শুভ।
আমি জানি আজ আমার উপর দিয়ে বড় একটা ঝড় বয়ে যাবে।
আজ বিকেলের ই কথা। কিচেন এ অনু আমার চরিত্র নিয়ে অযথাই অনেক বাজে বাজে কথা শুনাচ্ছিলো। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয় প্রতিদিন এসব শুনতে শুনতে আমি অভ্যস্ত। তবে আজ একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলো। আমার মা-বাবাকে গালি দিয়ে আমার জন্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলো যেটা আমি একদমই মেনে নিতে পারিনি। আমিও তার উত্তরে বলেছিলাম, তুমি নিজেকে কি মনে করো? একজন আদর্শ চরিত্রবান নারী? আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম নিজেকে একজন নারী বলে তো দুর একজন মানুষ বলে পরিচয় দিতেও বিবেকে বাধতো। ছিহ,কতোটা জঘন্য তোমার মন-মানসিকতা। আমার এটুকু কথা বানিয়ে বানিয়ে আরো বড় করে, অনু শুভর কাছে আমার নামে নালিশ করবে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম। তারপর এটাকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়ে যাবে শুভর অত্যাচার।
যেটা ভাবলাম সেটাই হলো, শুভ আসতেই আমাকে জোরে একটা থাপ্পড় দিয়ে বসলো।থাপ্পড়ের জোরে আমি দুরে ছিটকে পড়ে গেলাম।আমার চুল ধরে টেনে তুলে বলতে লাগলো:
-খুব বাড় বেড়েছিস তাই না!
আমার বোনকে কথা শোনানো! এতো সাহস তোর। এটা বলে আমার চুল ধরেই দেওয়ালের সাথে ধাক্কা দিলো। কপাল ফেটে রক্ত পড়ছে।চারদিকে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। অসহ্য রকম ব্যাথায় কাতরাতে লাগলাম আমি। কিন্তু শুভ তবুও থেমে থাকলো না শার্ট খুলতে খুলতে বললো,
-তোর তো এসবে কিছু হবে না। তোর কিসে শিক্ষা হবে সেটা তো আমি ভালো করেই জানি।
ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ও আমার দিকে। ওর চোখে হিংস্রতার নেশা স্পষ্ট। ভয়ে পুরো শরীর আমার কাঁপতে শুরু করলো।ওর এমন হিংস্রতা আর মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। আমাকে আজ কিছু একটা করতেই হবে। আশেপাশে তাকিয়ে পাশের টেবিলের উপর থাকা ফুলদানির উপর আমার চোখ পরলো। আমি ফুলদানিটা শক্ত করে ধরলাম শুভ একদম কাছে এসে আমাকে ছুঁতে যাওয়ার সময়ই আমি সমস্ত শক্তি দিয়ে ওর মাথায় আঘাত করলাম। ফুলদানি ভেঙে গেলো, মাথাটাও কেটেছে বেশ খানিক। মাথা চেপে ধরে বিস্ময়ের নজরে তাকিয়ে আছে শুভ,হয়তো ও এটা বিশ্বাস করতে পারছে না। ও আমাকে যতটা কষ্ট দিয়েছে তার কাছে এটা কিছুই না তবুও কেন যেন খুব শান্তি লাগছে আজ।
ফুলদানি ভাঙার শব্দ শুনে দৌড়ে আসলো অনু আর আমার জা। এসেই আমাকে হাজারটা কথা শুনাতে লাগলো কিন্তু আমি এখন এসব কানে তুলছি না। নিজের ভিতরে আজ অদ্ভুত একটা শক্তি অনুভব করছি। শয়তান-টাকে শিক্ষা দিতে পেরে আজ হয়তো শান্তির একটা ঘুম হবে।
.
.
.
চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। আশেপাশে কারো সাড়াশব্দ নেই। পায়ের নিচে সেঁতসেঁতে একটা ভাব। কোথায় আছি আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। আমি সামনে আগানোর জন্য আরেকটু পা বাড়াতেই পিছলে পড়ে গেলাম পুরো শরীরে আঠালো কিছু একটা মেখে গেলো। আমার নিচে কারো একটা অস্তিত্ব অনুভব করলাম।
-কে! কে এখানে?
কয়েকবার ডেকেও কোনো নড়াচড়া না পেয়ে আমি চারপাশে হাতড়াতে লাগলাম। হাতে কিছু একটার নাগাল পেলাম ।
হ্যা এটা টর্চ লাইট ।লাইটটি হাতে পেয়েই টর্চ অন করতেই আমি দেখতে পেলাম সামনে সাদা কাপড়ে ঢাকা একটা লাশ পড়ে আছে।
আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম। অনেকক্ষণ চিৎকারের পরেও কারো কোনো শব্দ না পেয়ে আমি লাশটি কার দেখার জন্য লাশের মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে আলো ফেলতেই চমকে উঠলাম।
বাবা! বাবা এখানে কি করে আসলো!
আর বাবার এমন অবস্থাই বা হলো কি করে!
আমি বাবাকে জড়িয়ে কান্না করতে লাগলাম।
বেশ কিছুক্ষণ পরে আমার হাতে আলো পড়তেই দেখলাম আমার হাত রক্তে ভিজে আছে আরো ভালোভাবে লক্ষ্য করে যেটা দেখলাম আমি সম্পুর্ণই রক্তের উপর বসে আছি শুধু তাই নয় এটা দেখে তো স্টোর রুম বলে মনে হচ্ছে যেটা পুরোটাই রক্তে ভরপুর।
একটা বিকট হাসির শব্দে পুরো রুমটা কেঁপে উঠলো। উপর থেকে ধুপ করে ভারি কিছু একটা পড়ার শব্দে আমি কেঁপে উঠলাম।
লক্ষ্য করে দেখলাম সামনে পড়ে আছে সাদা কাপড়ে জড়ানো আরও একটি মৃতদেহ। আমি মৃতদেহটার মুখের দিকে লাইট মারতেই জোরে চিৎকার করে উঠলাম,
-আরোহীর লাশ!!…
চলবে…
লেখিকা-Mimi Sultana
#বৈধ_ধর্ষণ
#মিমি_সুলতানা
পর্ব: ৫
————–
একটা বিকট হাসির শব্দে পুরো রুমটা কেঁপে উঠলো। উপর থেকে ধুপ করে ভারি কিছু একটা পড়ার শব্দে আমি কেঁপে উঠলাম।
লক্ষ্য করে দেখলাম সামনে পড়ে আছে সাদা কাপড়ে জড়ানো আরও একটি মৃতদেহ। আমি মৃতদেহটার মুখের দিকে লাইট মারতেই জোরে চিৎকার করে উঠলাম,
-আরোহীর লাশ!!…
আরোহীইইই বলে চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে বসলাম। দরদর করে ঘামছি। আশেপাশের সবকিছুই ঠিকঠাক আমি কোন স্টোর রুমে নেই আমি আমার রুমেই আছি। তারমানে এটা একটা দুঃস্বপ্ন ছিলো!
ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে আছে।
লাইট অন করে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত ৩ টা বাজে।
পাশের টেবিলে রাখা পানিভর্তি গ্লাস টি হাতে নিয়ে গ্লাসের ভিতরে তাকাতেই আমি চমকে উঠলাম।
গ্লাসটি সম্পূর্ণ টাটকা রক্তে পরিপূর্ণ।
চিৎকার করে আমি গ্লাসটি হাত থেকে ফেলে দিয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগলাম।
কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পরে গ্লাসটির দিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করে বুঝতে পারলাম আমার ধারণা ভুল ছিলো। গ্লাসে কোনো রক্ত নয় পানিই ছিলো। রক্তের বিষয়টা আমার হ্যালুসিলেশন। আমি এখনো ভয়ংকর স্বপ্নটার ঘোরে আছি। রোজার খুন আমাকে এতোটাই মানসিক চাপে ফেলেছে যে আমার মস্তিষ্ক ঠিকভাবে কাজ করছেনা। এই সমস্যাটার সমাধান তখনই হবে যখন সমস্যার সকল গোড়া আমি উপড়ে ফেলতে পারবো।
যে করেই হোক রোজার খুনীকে আমার বের করতেই হবে আর সেটা খুব দ্রুতই তাহলে আমার মনটা একটু শান্তি পাবে। এখন গভীর রাত, সবাই ঘুম। শুভও আজ আমার পাশে নেই।এই সুযোগে রোজার জিনিসপত্র নিশ্চিন্তে খুঁজে দেখতে পারবো। পেলে পেতেও পারি এমন কোনো প্রমাণ যা হয়তো প্রথমদিন লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে গিয়েছিল।
.
.
.
আমি পা টিপে টিপে আরোহীর রুমের সামনে এলাম। দরজা ভিতর থেকে লক করা এরমানে আরোহী এখন ঘুম। বাকি সবার রুমগুলো একটু দুরে দুরেই।
আমি রুমটার সমস্ত জায়গা এমং রোজার সবকিছু তন্নতন্ন করে খুঁজেও তেমন কিছু পেলাম না।
মনে একটা খুতখুতানি নিয়ে ফিরতে যাবো,
তখনই পায়ের নিচে শক্ত কিছু একটা চাপা পড়ায় প্রচন্ড ব্যাথা পেয়ে উহ বলে বসে পড়লাম। জিনিসটা হাতে আনতেই দেখলাম একটা রঙিন পুঁথি। যেগুলো সাধারণত মালায় ব্যবহৃত হয়। পুঁথিটা খুব চেনা চেনা লাগছে। রোজা তো এমন ধরনের কিছু পড়তো না। তাহলে এটা কার হতে পারে?
আমি পুঁথি টা নিয়ে উঠতে যাবো ঠিক তখনই দরজার কাছে একটি ছায়া দেখতে পেলাম।
এরমানে কেউ আমাকে অনুসরণ করছে।
আমি পুঁথিটিকে যত্ন করে নিজের কাছে রেখে ছায়ামূর্তিটাকে অনুসরণ করলাম। চাপা স্বরে চিৎকার দিয়ে বললাম,
-কে? কে আপনি? আড়ালে না থেকে সামনে আসুন।
ধীরে ধীরে আঁধার থেকে আলোতে একটা অস্তিত্ব দৃশ্যমান হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। অবশেষে আমাকে অনুসরণ করা লোকটাকে দেখতে পেলাম।
আলোতে ইভাদের চেহারা দেখে আমি খানিকটা চমকে উঠলাম।
ইভাদ! ইভাদ কেন আমাকে ফলো করবে তা ও আবার এতো রাতে?
রোজার খুনের সাথে ইভাদ ও জড়িত নেই তো? মনে মনে কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকলো।
-কি? চমকে গেলে আমাকে দেখে?জানি এই মূহুর্তে আমাকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন ঘুরছে তোমার মনে। অপেক্ষা করো ধীরে ধীরে সবটা জানতে পারবে। আপাতত যেটা জানা তোমার জন্য জরুরি সেটা হলো আমি তোমার কোনো শত্রু নই আর না তো রোজার খুনের সাথে আমি কোনোভাবে জড়িত।
-তাহলে তুমি কে?
-জানা টা কি খুব প্রয়োজন?
-অবশ্যই।
-বাহ। তবে নিজেকে নিয়ে আগে চিন্তা করো। তারপর অন্যকে নিয়ে ভাব।
-তুমি কি বোঝাতে চাচ্ছো?
-যখন তোমার উপর পাশবিক নির্যাতন চলে তখন তোমার প্রতিবাদ করা উচিৎ।
ভুলে যেওনা, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়াটাও একটা অন্যায়। অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে কখনো মহান হওয়া যায়না।
তুমি যতদিন নিজের সাথে হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়াবে ততদিন অন্যকে ন্যায় বিচার কিভাবে দিবে!
ইভাদের কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম।কত সুন্দর করে কথাগুলো বলল সে। প্রতিটি কথা যেন হৃদয় ছুঁয়ে গেল।
রোজা ছাড়া এভাবে আমার সমস্যাগুলোকে নিজের করে আর কেউ দেখেনি। আর কেউ এভাবে আমাকে সাহস ও দেয়নি।
কিন্তু অদ্ভুত বিষয়, ইভাদ এগুলো জানলো কি করে? আমি তো রোজা ছাড়া অন্য কাউকে বলিনি!
তাহলে কি সবটা রোজা ওকে বলেছে?
ও কি রোজার কোনো আপনজন!
আমার মনের কথাটা তুলে ধরে ইভাদ নিজের থেকেই বলতে লাগলো,
-তুমি যেটা ভাবছো সেটাই ঠিক।
আমাকে সবটা রোজাই বলেছে।আমি রোজার বেস্ট ফ্রেন্ড ওর খুব কাছের একটা মানুষ। ও মারা যাওয়ার দিন রাতেই আমাকে সবটা বলেছিলো।
তবে ও আপসেট ছিলো খুব। রাতেই ও জানিয়েছিলো ও বড় একটা তথ্য পেয়েছে তোমার বাবার এক্সিডেন্ট এর ব্যাপারে। ওর সন্দেহ ছিলো ওইটা কোনো এক্সিডেন্ট ছিলো না, ছিলো সাজানো গোছানো একটা প্লান। এমনকি ও এটাও বুঝতে পেরেছিলো যে, এর পেছনে কার হাত ছিলো। আমি জানতে চাইলে বলল ও আজ রাতে সব প্রমাণ সংগ্রহ করে নিশ্চিত হয়ে প্রমাণসহ আমাকে জানাবে। আমিও আর ওকে প্রেসার দেইনি।
পরদিন সকালেই ওর মৃত্যুর খবরটি শুনতে পেলাম।
দু’জনের মাঝেই নিরবতা বিরাজ করছে।
বাবা-র এক্সিডেন্ট কোনো সাধারণ এক্সিডেন্ট ছিলো না এটা ছিলো একটা প্ল্যান ভাবতেই বুকের ভিতর একটা মোচড় দিয়ে উঠলো। অপরাধীকে খুঁজে বের করার আকাঙ্খাটা দিগুণ হয়ে গেলো।
নিরবতা ভেঙে ইভাদ আবার বলে উঠলো,
-আমি সেদিন সকালেই রওনা হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রোজার আর আমার বন্ধুত্বের ব্যাপারে শুভ বা এই পরিবারের কেউ ই জানতো না।
সেদিন আসলে সবাই আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতো আর আমি চাইনি এমন কিছু হোক।
তাছাড়া আমি জানতাম কেউ না বুঝলেও তুমি ঠিক বুঝবে রোজা আত্মহত্যা করার মতো মেয়ে না।
ইভাদকে আমি কিছু বলতে যাবো তখনই ইভাদ আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
-উহু এখন আর কোনো কথা নয়।এখন সোজা রুমে যাবে। সকাল হয়ে গিয়েছে প্রায়, কেউ আমাদের একসাথে দেখলে ব্যাপারটা ভালো হবে না। আমাদের দুজনের উদ্দেশ্য রোজার খুনীকে বের করা।
এর মাঝে কোনো বাঁধা আসুক সেটা কোনোভাবেই চাই না।
সুতরাং অনেক সাবধানে থাকতে হবে আমরা একে অপরকে চিনি এটা কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবে না।
আমি ইভাদের কথায় সম্মতি জানিয়ে রুমের দিকে পা বাড়াতেই “এই শোনো” বলে আবার ইভাদের ডাক।
আমি ফিরে তাকাতেই সে বললো,
-মাঝে মাঝে একটু হাসতে হয়। গম্ভীরতা তোমাকে একটুও মানায় না। রোজার কাছ থেকে শুনেছি তুমি হাসলে না-কি তোমাকে অপরুপ সুন্দরী লাগে।
কথাটি আমার মনের মাঝে অন্যরকম একটা অনুভূতি তৈরি করলো। আমি একটু মুচকি হেঁসে রুমে চলে আসলাম। হাসার পর খেয়াল হলো ঠিক কতদিন পর আমি এভাবে একটু হেসেছি।
.
.
.
ভাঙা গ্লাসের কাঁচের টুকরোগুলো পরিষ্কার করে আমি ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসলাম।
আজ নিজেকে খুব সুন্দর মনে হচ্ছে। আয়নার দিকে তাকিয়ে কোন বিধ্বস্ত প্রজাপতি নয় বরং হাসিমাখা এক অপরূপাকে দেখছি মনে হচ্ছে।
ইভাদ ছেলেটার মধ্যে সবধরনের গুন আছে। কত সুন্দর করে কথা বলে,ওর বলা একটা কথাই সকল বিষন্নতা নিমিষেই হাওয়া করে দেয়। একজন পারফেক্ট জীবনসঙ্গিনীর প্রত্যেকটি বৈশিষ্ট্যই যেন তার মাঝে বিদ্যমান।
কত ভালো হতো যদি শুভ এমনটা হতো।
আমারও খুব ইচ্ছে করে হাসিমুখে সারাটা দিন কাটিয়ে দিতে। কাছের মানুষদের নিয়ে ভালো থাকতে। কিন্তু নিয়তি বড়ই নিষ্ঠুর।
জীবনটা কেমন চার দেওয়ালের মাঝে থমকে গেলো। যেখানে বিষন্নতা ছাড়া অন্য কোনোকিছুর ঠাঁই নেই।
.
.
.
.
দরজায় নক করে ভিতরে ঢুকলো আরোহী।
ওকে দেখতেই রাতের সেই ভয়ংকর স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে বুকটা কেঁপে উঠলো। আমি শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম আরোহীকে। হঠাৎ এমন ব্যবহারে আরোহী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-তোমার কি হয়েছে আপু? কে কি বলেছে তোমাকে একবার শুধু বলো!
-কিছু হয়নিরে পাগল বাবার কথা মনে পড়ছে খুব।
-বাবা ভালো আছে তো। তুমি শুধু শুধু চিন্তা করো না তো।
আমি আরোহীর কাঁধ থেকে মাথা তোলার সময় ওর গলার দিকে নজর গেলো। হ্যা আরোহী ই তো নানারকম বড় বড় পুঁথির মালা পড়তে পছন্দ করে। এমনকি ও সবসময় একটা মালা গলায় পড়ে থাকতো যেটা আজ নেই। পুঁথি টা সেই মালারই ছিলো আমি নিশ্চিত আর তাই হয়তো পুঁথি টা আমার এতোটা চেনা চেনা লাগছে।
কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো আরোহীর মালার পুঁথি রোজার রুমে কি করে যাবে!
আরোহী কখনোই রোজার রুমে যায়নি রোজার সাথে ওর সম্পর্কটাও ততটা ভালো হয়ে ওঠেনি।
এই বাসায় আসার পর থেকে রোজার ওর রুমে কাউকে ঢুকতে দেয়নি।কারো প্রয়োজন হলে ও নিজে যেত তার রুমে তবুও কেউ তার রুমে ঢুকুক সেটা পছন্দ করত না। তাহলে আরোহীর মালার পুঁথি ওইরুমে কি করে যাবে?
আমি আর কিছু না ভেবেই আরোহীকে প্রশ্ন করে বসলাম,
-তুই গলায় যেই মালাটা পড়তি সেটা কোথায়?
-ওইটার কথা আর বলিস না আপু, আমার কতো পছন্দের একটা মালা ছিলো কিন্তু সেদিন হাতে টান লেগে ছিড়ে গেলো।
-এমনিতেই ছিড়ে গিয়েছে না-কি কারো সাথে হাতাহাতি করতে গিয়ে ছিড়লো?
কথাটা শুনতেই আরোহী থতমত খেয়ে অভিযোগ আর অভিমানের নজরে আমার দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকালো।
ও হয়তো এমন একটি কথার শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।
.
.
.
চলবে…