বৈধ_ধর্ষণ,১২,১৩

0
1397

#বৈধ_ধর্ষণ,১২,১৩
#মিমি_সুলতানা

পর্ব-১২
——————–
কোন উত্তর না পেয়ে ফিরে আসার জন্য পা বাড়াতেই পিছন থেকে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন হানিফ সাহেব।
এই হাসির মাঝে লুকিয়ে আছে অনেক ভৎসনা।
জড়িয়ে আছে শুনতে না পাওয়া হাজার প্রশ্নের উত্তর।
সবকিছু খুব অদ্ভুত লাগছে।
কেন যেন মনে হচ্ছে আমরা সবাই যেখানে শেষ ভাবছি সেখান থেকেই হয়ত নতুন কিছুর শুরু হতে চলেছে…
.
.
.
দুইদিন কেটে গেলো।
এরমধ্যে ফাহাদ আর হানিফ সাহেবের সাথে দেখা করতে যায়নি। এই দুইদিন রুমে শুয়ে বসেই কাটিয়েছে সে। কিন্তু আর এভাবে যেন মন মানছে না। আজ আমাকে যেতেই হবে নিজের সব প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত কোনোকিছুতে মন বসছে না,ভাবা মাত্রই বের হয়ে পরলো ফাহাদ।
.
.
.
হানিফ সাহেবের সাথে ফাহাদ দেখা করতেই তিনি ঝরঝর করে চোখের পানি ছেড়ে দিলেন।
ফাহাদের ও খুব কষ্ট হচ্ছে তার বাবাকে এভাবে দেখতে কিন্তু সে সেটা প্রকাশ করলো না।
ফাহাদ হানিফ সাহেবকে কিছু বলার আগেই তিনি নিজ থেকে বলে উঠলো,
-আমাকে ক্ষমা করে দে বাবা।
আমি তোর ভালোর জন্যই সবটা করেছি কিন্তু কিভাবে কি হয়ে গেলো নিজেই বুঝলাম না।
রোজার সাথে আমার ব্যক্তিগত একটা কারণ নিয়ে ঝামেলা হয়, সেটা আমি মিটমাট করতে অনেক টাকা অফার করি। কিন্তু সে কিছুতেই রাজি হয় না। আমি খুব ঘাবড়ে যাই রোজা মুখ খুললে আমার এতোদিনের মানসম্মান সব শেষ হয়ে যেত।
বাঁধ্য হয়ে আমি শুভ ও দারোয়ানের সাহায্য নিয়ে খাবারের সাথে ওকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে দেই।
ঔষধ খাওয়ানোর কিছুক্ষণ পরে ও ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে। তারপর টেনে হিঁচড়ে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দেই। এতটুকু বলেই হানিফ সাহেব থেমে যান।

ফাহাদ নির্বাক হয়ে তার বাবার কথা শুনতে থাকে।
সবটা বিশ্বাস করতে তার খুব কষ্ট হচ্ছে।
কেমন হতো যদি এখন ঘুম ভেঙে যেত আর দেখতাম সবটাই মিথ্যা!
হানিফ সাহেবের কাশির শব্দে চিন্তায় ছেদ পরলো ফাহাদের।
নিরবতা ভেঙে হানিফ সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন,
-আমি শুরু থেকেই জানতাম তোর আর আরোহীর সম্পর্কের কথা। কিন্তু এটা মেনে নেওয়া আমার জন্য অতোটাও সহজ ছিলো না।
অনেক আগের থেকেই আমি আমার বিজনেস পার্টনারের মেয়ে “লাইসার” সাথে তোর বিয়ে দেবো বলে ঠিক করে রাখি। এটা আমার ব্যাবসার জন্য ও ভালো হতো আর তোর জন্যেও।
কিন্তু সামান্য ওই মেয়ের জন্য আমি আমার স্বপ্ন মাটি হয়ে দেখতে চাচ্ছিলাম না। অনেকদিন ধরেই সুযোগ খুজছিলাম ওকে তোর জীবন থেকে দুরে সরানোর। রোজার খুন শেষে একটা সুন্দর আইডিয়া আমার মাথায় আসে। রোজার খুন হওয়ার ব্যাপারটা আরশী ধরতে পেরেছে বুঝতে পেরে রোজার খুনীর সন্দেহ আমি আরোহীর দিকে ঘুরিয়ে দেই কিছু প্রমাণ ওর বিরুদ্ধে রেখে।
এ যেন এক ঢিলে দুই পাখি মারার মত অবস্থা।
কিন্তু সমস্যা বেঁধে যায় আরেক জায়গায়।
রোজার বন্ধু ইভাদ আসে শুভর বাসায়।
ওকে রোজা খুন হওয়ার দিন রাতেই সবটা জানিয়েছিলো কিন্তু ও ডাবল গেম খেলে।
ইভাদ আরশীকে সাহায্য করবে বলে আশ্বাস তো দেয় কিন্তু আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে।
ওকে আমি অনেক টাকা অফার করি কিন্তু ওর চাহিদা টা একটু বেশিই হয়ে যায়।ও আমার বিজনেস এর ফিফটি পারসেন্ট শেয়ার চায়।
আমি ইভাদকে হ্যা বলে দারোয়ানের সাথে মিলে আরো একটা প্লান করে ফেলি। সেদিন রাত ১২ টার আগেই আমি আর শুভর দারোয়ান মিলে…….
দু’চোখ বন্ধ করে ফেলে ফাহাদ।
হানিফ সাহেবের মুখে এমন নৃশংস কথা শুনে তার দিকে তাকাতেও ইচ্ছে করছে না ফাহাদের।
তবুও নিজেকে সামলে বলে উঠলো,
-আরশীকে কেন ফাঁসালেন?
-আমি আরশীকে ফাঁসাইনি। ইভাদ আরশীকে দেখা করতে বলেছিলো সেটা আমরা জানতাম ও না। তবে আরশীর ফেঁসে যাওয়াটা আমাদের জন্য মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মত ছিলো। আরশী সব দায়ভার নিজের উপর নিয়ে নেয় সাথে আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে যাই।
আমার জানতাম আরশীকে শুভর ফ্যামিলির কেউ ভালোবাসে না। তাঁকে বাঁচানোর মত কেউ নেই।
কিন্তু তুইও যে নাছোড়বান্দা সেটা নিয়েও ভয় ছিলো। ভয় হচ্ছিল সবটা যদি তুই জেনে যাস তাহলে কি হবে!
-আর তাই নিজের ছেলেকে মারতে রেডি হয়ে গেলেন?
-আমি তোকে মারতে চাইনি। আমি শুধু চেয়েছিলাম তুই ভয় পেয়ে সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নে।
তিরস্কারমূলক একটু মুচকি হেঁসে ফাহাদ আবার জিজ্ঞাসা করলো,
-আচ্ছা আপনি বললেন রোজাকে খুন করার পেছনে আপনার পারসোনাল একটা কারণ ছিলো সেই কারণটা আমি জানতে চাই।
কথাটা শুনতেই হানিফ সাহেব কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। আমতা আমতা করে বললেন,
-আমার যা যা বলার ছিলো বলে দিয়েছি।
আমি আর তোকে কিছু বলতে পারবো না।
কথাটা বলেই হানিফ সাহেব দুরে সরে গেলেন।
“একটা সত্য চাপা দিতে একটা অন্যায়! সেটা চাপা দিতে খুন! সেই খুনের দায় থেকে বাঁচতে আরেকটি খুন! এভাবে নিজের অপরাধের পাল্লাটা কতটা ভারি করেছেন সেটা নিশ্চয় বুঝতেই পেরেছেন? আপনার করা সব অন্যায়ের মত সবকিছুর পেছনে থাকা সেই সত্যি টাও আমি খুব দ্রুত খুঁজে বের করবো নিশ্চিত থাকুন।”
কথাগুলো বলেই ফাহাদ বের হয়ে গেলো।
তাঁর দিকে তাকানোর মত সাহস হানিফ সাহেবের আর হয়ে ওঠেনি।
.
.
.
হানিফ সাহেবের কাছ থেকে ফাহাদ সোজা আরোহীদের বাসায় গেলো।

বাসার ভেতর ঢুকতেই আমি ফাহাদকে সাদরে ভেতরে নিয়ে গিয়ে একটা চেয়ার এগিয়ে দিলাম।
“আমার বাবা যেটা করেছে সেটার জন্য ক্ষমা চাওয়াটাও অন্যায় বলে আমি মনে করি তবুও একজন ছেলে হিসেবে আমি তাঁর হয়ে ক্ষমা চাচ্ছি আপনার কাছে। ” মাথা নিচু করে একনাগাড়ে কথাগুলো বলে গেলো ফাহাদ।
আমি কিছু বলতে যাবো তখনই আরোহী আর হিমেল হাসতে হাসতে রুমে ঢুকলো।
ফাহাদ হুট করেই মাথা তুলে ওদের দিকে তাকালো।
ফাহাদ তাকাতেই আরোহী হাই ফাহাদ তুমি কখন এলে! বলে হিমেলকে নিয়ে খাটের উপর গিয়ে বসলো।
ফাহাদ কোনো উত্তর দিলো না।
আমি বেশ বুঝতে পারলাম যে এদের মাঝে কিছুই ঠিক নেই।
আমি আরোহীকে টেনে একটু পাশে নিয়ে কি হচ্ছে জিজ্ঞেস করলে আরোহী ফাহাদকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো,
-কি হবে আপু? কিছুই তো হয়নি।
দুইদিন পরে আমার প্রাক্তনকে দেখলাম কুশল বিনিময় তো একটু করতেই হবে। কথা শেষ করে আরোহী হিমেলের অনেক কাছে গিয়ে বসে আবার হেঁসে হেঁসে কথা বলতে লাগলো।
আমি ফাহাদের দিকে ফিরে তাকাতেই দেখলাম ফাহাদ উঠে চলে যাচ্ছে।
পেছন থেকে কয়েকবার ডেকেও কোনো লাভ হলো না।
আমি আরহীকে ডেকে অনেক বকা দিলাম।
এই সময়ে ফাহাদ খুব একা। তোদের মাঝে কি হয়েছে আমি জানিনা কিন্তু এখন তোর ফাহাদের পাশে থাকাটা খুব প্রয়োজন।
-কিন্তু যখন আমি একাকিত্বে ভুগছিলাম তখন ও কেন আমাকে দুরে সরিয়ে দিয়েছিলো বলো?
– ফাহাদ যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছেলে। ও যেটা করবে ভেবেই করবে আর ভালোর জন্যই করবে বলে আমার বিশ্বাস যেটা তোর ও মনে রাখা উচিৎ।
আমাকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো আরোহী।
.
.
.
.
সব কিছু শেষে আমি বাবার রুমে এলাম।
নিঃসঙ্গ পরে থাকা আলমারিটা আজ আবার খুললাম। আলমারিটা বাবার কথা মনে করিয়ে দেয় বার বার। বাবার খুটিনাটি সবটাই এই আলমারিতে বন্দী থাকতো।
অশ্রুসিক্ত চোখে আমি আলমারিটা গোছাতে লাগলাম।
গোছাতে গিয়ে একটা ছোট লকার চোখে পড়লো।
অজানা কারণেই লকারটা খুলে দেখতে ইচ্ছে করলো খুব।
বাবা চাবি কোথায় রাখতো সেটা আমি আর বাবা ছাড়া কেউ জানতো না।
আমি চাবিটা নিয়ে লকারটা খুলে অনেকগুলো কাগজপত্র দেখতে পেলাম।
ওগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে কিছু ছবি গেলাম।
ছবি গুলো দেখে আমি বিস্ময়ে চতুর্থ আসমান থেকে পড়লাম।
একই ফ্রেমে বন্দি মা আর ফাহাদের বাবা!
কিন্তু এটা কি করে সম্ভব!!

চলবে….
লেখিকাঃ মিমি সুলতানা

#বৈধ_ধর্ষণ
#মিমি_সুলতানা

পর্ব – ১৩

———————–
সব কিছু শেষে আমি বাবার রুমে এলাম।
নিঃসঙ্গ পরে থাকা আলমারিটা আজ আবার খুললাম। আলমারিটা বাবার কথা মনে করিয়ে দেয় বার বার। বাবার খুটিনাটি সবটাই এই আলমারিতে বন্দী থাকতো।
অশ্রুসিক্ত চোখে আমি আলমারিটা গোছাতে লাগলাম।
গোছাতে গিয়ে একটা ছোট লকার চোখে পড়লো।
অজানা কারণেই লকারটা খুলে দেখতে ইচ্ছে করলো খুব।
বাবা চাবি কোথায় রাখতো সেটা আমি আর বাবা ছাড়া কেউ জানতো না।
আমি চাবিটা নিয়ে লকারটা খুলে অনেকগুলো কাগজপত্র দেখতে পেলাম।
ওগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে কিছু ছবি গেলাম।
ছবি গুলো দেখে আমি বিস্ময়ে চতুর্থ আসমান থেকে পড়লাম।
একই ফ্রেমে বন্দি মা আর ফাহাদের বাবা!
কিন্তু এটা কি করে সম্ভব!!
.
.
.
ছবিটি হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকি।
কোনকিছুর হিসাব মিলছে না।
ফাহাদের বাবা আর মায়ের ছবি একসাথে কি করে হতে পারে?
আর এটাই বা বাবার লকারে কি করছে!
আমি ছবিগুলো নিয়ে মা’র কাছে গেলাম।
ছবিগুলো দেখিয়ে ছবিটার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে ছবিটা দেখে মা বেশ ঘাবড়ে গেলো।
খপ করে হাত থেকে কেড়ে নিয়ে টেনে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিলো।
এরপর কিছু না বলেই রুমের দিকে চলে যায়।
মা’র এমন আচরন দেখে আমি বেশখানিকটা অবাক হলাম। এই ছবিটাকে ঘিরে রয়েছে গভীর রহস্য যেটা আমি ভালোভাবেই বুঝতে পারছি।
এই ব্যাপারে ফাহাদের সাথে আলোচনা করতে হবে।
আমি ফাহাদকে কল করে বাইরে কোথাও দেখা করতে বললাম।
.
.
.
.
ছবিগুলোকে কোনোভাবে স্কচটেপ দিয়ে একত্র করে ফাহাদের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে বের হলাম। আরোহীকেও এই ব্যাপারে কিছু জানালাম না। এমনিতেই ওইটুকু মেয়ে এ ক’দিনে অনেক কিছু সহ্য করেছে।
.
.
.
আমি একটি ক্যাফেতে বসে ফাহাদের অপেক্ষা করছিলাম। এমন বিষয়ে আলোচনা করার জন্য এটাই নিরাপদ জায়গা মনে হলো আমার।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাহাদ এসে হাজির হলো।
চোখ মুখ শুঁকিয়ে গিয়েছে ছেলেটার।
ফাহাদের জায়গায় আমরা থাকলে তার মতো এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম কি-না সেটা নিয়ে সন্দিহান।
ফাহাদের সালাম শুনে আমি ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে আসলাম।
সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বললাম ফাহাদকে।
“হঠাৎ এতো জরুরী তলব? কোন সমস্যা হয়েছে কি?” ফাহাদের প্রশ্নের উত্তরটা আমি কি ভাবে দেবো ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।
আমি কিছু না বলে ছবিগুলো তাঁর দিকে এগিয়ে দিলাম। অবাক চোখে ফাহাদ আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
অনেক জানি আমার মতো তাঁর মাথায় ও অনেক প্রশ্ন ঘুরছে।
আমরা দু’জনেই সিদ্ধান্ত নিলাম আরেক বার হানিফ সাহেবের সাথে দেখা করবো।
এখান থেকে বেশি দুর না পুলিশ স্টেশন।
আমরা দু’জনে পায়ে হেঁটেই এগিয়ে চললাম।
-হিমেল কি আরোহীর খুব ভালো বন্ধু?
ফাহাদ নিচু স্বরে প্রশ্নটা করলো।
আমি একটু মুচকি হেঁসে হাঁটতে হাঁটতেই বলতে লাগলাম,
-আজ আরোহী আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রচুর কেঁদেছে।
ও তোমার আর তাঁর মাঝের দুরত্বটাকে মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু ছোট মানুষ তো অভিমান বরাবরই একটু বেশি ও সেটাকেও দুরে ঠেলে দিতে পারছে না। অভিমানী মেয়েদের ভালোবাসার গভীরতা সমুদ্রের মতোই অতল। শুধু সেটাকে অনুভব করতে হয়।
কথা বলতে বলতেই থানার সামনে চলে আসি।এরমাঝে ফাহাদ আর কোনো কথা বলেনি।
.
.
.
তখন থেকে দু’জনে মিলে হানিফ সাহেবকে ছবিগুলোর ব্যাপারে প্রশ্ন করেই যাচ্ছি।
শুরুতে আমি কিছু জানিনা বলে বরাবরের মতোই তিনি নিশ্চুপ। ছবিগুলো দেখে তিনিও মায়ের মত চমকে উঠেছিলেন।
তাঁর থেকে কোন উত্তর আশা করা আমাদের বোকামি ছাড়া কিছুই নয় সেটা বুঝে গেলাম।
যা করার আমাদেরই করতে হবে।
আমি আর ফাহাদ থানা থেকে দ্রুত বের হয়ে গেলাম।
ফাহাদের কথা অনুযায়ী আমি ওড়না দিয়ে ভালো করে মুখ ঢেকে ফাহাদের সাথে তাঁর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হই। আশা করি সেখানে গেলে নিরাশ হবো না।
.
.
.
ফাহাদের বাসায় ঢুকেই আমরা সোজা হানিফ সাহেবের রুমে চলে যাই। তাঁর সকল লকার তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকি। ফাহাদ হানিফ সাহেবের ল্যাপটপের লক খোলার চেষ্টা করছে।
আমি হানিফ সাহেবের গোপন একটি ড্রয়ারের মধ্যে খুঁজে খুঁজে একটা পুরানো মোবাইল ফোন দেখতে পাই।
ফোনটা বের করে আমি ঘুরেফিরে সব দেখতে থাকি।
কোথাও কোনো ছবি কল বা মেসেজ কিছুই নেই না। হঠাৎ করে কল রেকর্ডার চোখে পড়ে। এখানেও কিছু পাবো না এমন ভাবনা নিয়ে ঢুকেই শকড হয়ে গেলাম।
একই নাম্বারে অনেকগুলো কল রেকর্ড!
প্রত্যেকবারই বেশ সময় নিয়ে কথা বলা হ’য়েছে।
ফাহাদকে দেখালে ফাহাদও বেশ অবাক হয়।
সে জানায় তাঁর বাবার দুইটা নাম্বার আছে বলেই সে জানে যেগুলো ব্যবসার কাজে ব্যবহার করা হয়।
সেগুলোও এখন পুলিশের আওতায় আছে।
এই ফোনটা না তো সে কখনো দেখেছে আর না তো নাম্বার টি তার চেনা।
উত্তেজনা নিয়ে আমি একটা রেকর্ড প্লে করলাম।
অপরজনের কন্ঠটা শুনতেই আমি কিছুটা কেঁপে উঠলাম। আমার ভাবনা যদি ভুল না হয় এটা তাহলে রোজার কন্ঠ। কিন্তু রোজার সাথে হানিফ সাহেবের এতো কি কথা হতে পারে!
আমাকে ভাবান্বীত দেখে ফাহাদ ডাক দিলো।
আমি বিস্ময় কাটিয়ে ফাহাদকে সবটা বললাম।
ফাহাদ শুনে তেমনটা অবাক হয়েছে বলে আমার মনে হলো না বরং তার চেহারার মাঝে একটা খুশি আবির্ভাব ঘটেছে।
ফাহাদ আমার থেকে ফোনটা টান দিয়ে নিয়েই বলে উঠলো “এটাইতো চেয়েছিলাম আমি”।
আমি তাঁর কথার কিছুই বুঝলাম না তবে প্রশ্ন ও করিনি কোন এই মূহুর্তে আমাদের উচিৎ রেকর্ডগুলোর উপর ধ্যান দেওয়া।
২-৩ টা রেকর্ড শুনে বুঝলাম, রোজার আর হানিফ সাহেবের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে খুব ঝামেলা হচ্ছিল। রোজা আমাকে সত্যি টা জানাতে চাচ্ছে কিন্তু হানিফ সাহেব তাঁর জন্য তাঁকে নানারকম হুমকি দিচ্ছেন।
কিন্তু কি এমন সত্যি থাকতে পারে যেটা আমার জানার প্রয়োজন বলে বলছে রোজা?
আমরা তাড়াহুড়ো করে আরো কয়েকটি রেকর্ড শুনলাম।
রেকর্ড শোনার একমূহুর্তে এসে আমি থমকে গেলাম। চারদিকে মনে হচ্ছে আমি অন্ধকার দেখছি। ফাহাদ আমাকে বসিয়ে পানি এনে দিলো।
আমি কোনোভাবেই নিজেকে সামলাতে পারছি না।
জীবনের একমুহূর্তে এসে আমার বাবার এক্সিডেন্ট এর জন্য দ্বায়ী আমার মা! এমন একটা কথা শুনতে হবে এমন নিকৃষ্ট কোনো কথা আমি কল্পনাও করিনি।
সবগুলো রেকর্ড শুনে যা বুঝলাম..
” ফাহাদের বাবার সাথে আমার বাবার অনেক আগের থেকেই বন্ধুত্ব ছিলো। সেই সুবাদে প্রায়ই আমাদের বাসায় হানিফ সাহেবের যাওয়া আসা হতো। আমার জানামতে তখন হানিফ সাহেব এতো বড় ব্যবসায়ি ও ছিলেন না। ছোটখাটো একটা জব করেই চলতো। মা বাবার হয়ত তখন বছরখানেক হয়েছে বিয়ের এমন। এরমাঝেই ফাহাদের মা মারা যায়। ফাহাদ তখন ছোট।
তখন প্রায়ই হানিফ সাহেব আমাদের বাসায় যেতেন। আব্বু প্রায় সময়ই বাসায় থাকতো না সেই সুযোগে হয়ত মা’য়ের সাথে তিনি কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পরেন। আমার বাবার সাথে মা’য়ের সম্পর্ক ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকে। একসময়ে বাবা সেটা বুঝতে পেরে ফাহাদের বাবার সাথে সম্পর্ক শেষ করে দেন।
ফাহাদের বাবা তখন থেকে আর আমাদের বাসায় যেতেন না। ফাহাদকে নিয়ে হঠাৎ করেই তিনি শহর ছেড়ে চলে যান।
বেশ কয়েকবছর পরে একজন বড় ব্যবসায়ি হয়ে ফিরে আসেন তিনি।
ততদিনে আমি আর আরোহী অনেক বড় হয়ে হয়ে যাই। শহরে ফিরেই গোপনে মা’র সাথে আবার যোগাযোগ শুরু করে।
বেশ কিছুদিন এভাবে চলার পরে বাবা বিষয়টি জানতে পেরে হানিফ সাহেবকে আইনের হুমকি দেয়।
মা বরাবরই বিলাসপ্রিয় মানুষ।
হয়ত সেকারণে নিজেও ভুল পথে বাড়ায়।
হানিফ সাহেবের সাথে হাত মিলিয়ে এক্সিডেন্ট এর নাম দিয়ে বাবাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্লান করে।
সবটাই তাদের প্লান মোতাবেক হচ্ছিল কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত তাদের প্লান পুরোপুরি কাজ করে না।
বাবার মৃত্যু হয়না ঠিকই কিন্তু প্যারালাইজড হয়ে যায়।
আর এই সবটাই জেনে যায় রোজা।
রোজা হানিফ সাহেবকে তার দোষ স্বীকার করে নিজেকে আইনের হাতে তুলে দিতে বলে।
কিন্তু হানিফ সাহেব রোজাকেও অনেক টাকার প্রোলোভন দেখায়। রোজা এক পর্যায়ে এসে টাকা নিয়ে চেপে যেতে রাজিও হয়ে যায়। এরপর আমার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেলে আমার সব কাহিনি শুনে সে নিজের ভিতরে আবার অপরাধবোধ করতে থাকে।
রোজা সবকিছু আমাকে জানিয়ে দেবে এবং হানিফ সাহেবের টাকা ফেরৎ দিবে বলে ঠিক করে। হানিফ সাহেব এটা জানতে পেরে রোজাকে নানাভাবে হুঁমকি দেয়। কিন্তু রোজা সবকিছু উপেক্ষা করে নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে যেটা একসময় তার দুর্ভাগ্য হয়ে ওঠে।
অকালেই জীবন দিতে হয় তার। সাথে পেতে হয় কলঙ্কিনী তকমা।
নিজের বাবার মৃত্যুর জন্য কোনো না কোনোভাবে নিজের মা জড়িত ভাবতেই গা শিউড়ে উঠলো।
বাবার মৃত্যুর দায়ে মা’কে শাস্তি!
এটা বাস্তবতার কোন ধরণের রুপ জানি না।
ফাহাদের দিকে তাকাতেই দেখলাম তার চোখের কোণায় পানি চকচক করছে।
“ছেলেরা কখনো কাঁদে না, যদি কখনো তাঁদের চোখ থেকে একফোঁটা পানি বের হয় বুঝে নিতে হয় তার মাঝে পাহাড়সম যন্ত্রণার ঠাঁই ”
আমি ওর কষ্ট টা বুঝতে পারছি। নিজের বাবার এমন নিচু কাজ কোনো সন্তানই মেনে নিতে পারে না যেমন আমিও আমার মা’য়ের কাজকে মানতে পারছি না।
-নিজেকে হানিফ চৌধুরীর সন্তান বলে পরিচয় দিতে আজ ঘৃণা হচ্ছে। আচ্ছা আমার মা’য়ের মৃত্যুটা স্বাভাবিক তো!
ফাহাদের এমন প্রশ্নে আমি নির্বাক হয়ে গেলাম।
.
.
.
চলবে….
লেখিকাঃ mimi Sultana

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here