শুষ্ক_পাতার_ভাজে?৩

0
1991

শুষ্ক_পাতার_ভাজে?৩
#লাবিবা_তানহা_লিজা?

মাসুদ ফাইল হাতে খুলে দেখতে দেখতে কেবিনে ঢুকে পড়ে । রায়ানের সামনে ঘুরিয়ে এগিয়ে দিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়ে । রায়ান ফাইল হাতে নিয়ে বলে
–প্লিজ এখন বলিস না যে এইটা আমাকে চেক করতে হবে । বোরিং লাগে যাস্ট।
–হুম কাজে তোর বোরিং ই লাগবে । ভালো তো লাগে শুধু মেয়েদের । একগাদা মেয়ের সাথে মন আদান প্রদান করে বসে আসিছ । আজকাল হোটেলে হোটেলে শরীর আদান প্রদান ও করছিস দেখছি ।
রায়ান ফাইলে চোখ বুলিয়ে নিয়ে সাইন করে দেয় । মাসুদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে
— রায়ান চৌধুরী কি করে না করে এইটা এতো তাচ্ছিল্য ভাবে বলতে হবে না তোকে দোস্ত। রায়ান চৌধুরী সব দিক ই সামলায় ।
— হা দেখলাম তো গত বছর সামির সাথে যে সমস্যাটা হলো লাভ করেছিলো তোকে সত্যি সত্যি ।
–হা সেজন্যই টেন লাখ হাতে পেয়েই আমার রাস্তা থেকে সরে গেছে । এরা শুধু রায়ান চৌধুরীর টাকাকেই ভালোবাসে রায়ান চৌধুরীকে নয় । রঙ্গমঞ্চে গিয়ে নিজেকে ওপেন করে টাকা লুটতে পারে । নিজেকে সব সময় সস্তা ভাবে আর একাধিক সম্পর্কে জড়িয়ে উপরে উঠতে চায় ।
–রায়ান কুল ইয়ারর… আমি বুঝতে পারছি তৃষাকে নিয়ে হাইপার হয়ে যাচ্ছিস ।
–ওকে আলাদা ভেবেছিলাম । কিন্তু না সেও নিজেকে সস্তাই ভাবে ।
— সবাই তো আর তৃনলতা হবে না তাইনা ?
–তৃনলতার সাথে কারো তুলনা করবিনা তুই ।
–ওকে করছিনা । আংকেল ফোন দিয়েছিলো । বাসায় ডেকেছে তোকে ।
–বাসায় যাচ্ছি না । ধানমন্ডি যাচ্ছি । ইমপর্টেন্ট মিটিং আছে ।
— হোটেলে নিশ্চয় ! নাম কি এর ?
— ওহ আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আমার জি এফ দের নাম লিস্টের দায়িত্ব নিয়েছিস । ছোয়া নাম ।
মাসুদ মিন মিনিয়ে টেনে টেনে বলে ছো…য়া…। প্রেমে ছোয়া । ওহ সরি । এটা হবে …. বলার প্রয়োজন নেই । মুখটা একটা পাপ থেকে হেফাজতে থাকুক।

দীর্ঘ পাচ দিন পর বাসায় ফিরেছে রায়ান । যদিও আরো লেইট করার কথা ছিলো প্রতিবারের মতো তবে এবার আগেই ফেরা হয়ে গেছে । বাসায় ঢুকেই ড্রয়িংরুমে রোহান চৌধুরীকে দেখে গিয়ে পাশে বসল। রোহান ভুত দেখার মতো চমকে উঠে স্ত্রী রোহানাকে জোর গলায় ডাকতে ডাকতে বলে –কই গো রোহানা কোথায় গেলে ..বাড়িতে আমাবস্যার চাদ এসেছে । দেখে যাও । তা জনাব আপনি হটাৎ কোথা থেকে উদিত হইয়া আমার বাসায় পড়িলেন ।
রায়ান আড়চোখে একবার তাকিয়ে মোজা খুলতে খুলতে বলে –পাপা হেয়ালি করো না । তুমি ডেকেছিলে তাই এসেছি । নাহয় আসতাম না । এ বাসায় দম বন্ধ হয়ে আসে আমার ।
রোহান চৌধুরী ছেলের কাধে দু বার চাপড় দিয়ে বলে –আই নো পাপা । ভাগ্যিস এই বাড়িটায় তোর দাদুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে নয়তো আমিই তোকে বলতাম অন্য বাসায় শিফট করতে । আমার কাছে তোমার ভালো থাকাটাই মূখ্য।
–আমার সাথে ফ্লাটে গিয়ে থাকতে কি হয় তোমাদের ?
–ঐ যে বললাম তোমার দাদুর স্মৃতি আমাকে বেধে রেখেছে ।
–তুমি দাদুর স্মৃতির টানে এ বাসায় আছো আমি কিন্তু তোমার স্মৃতির টানে এ বাসায় থাকবোনা বলে দিলাম ।
রেহানা এক গ্লাস জুস এনে রায়ানের হাতে দেয় । রায়ান এক চুমুকে পুরোটা শেষ করে বলে –মম পাপা আই এম সো টায়ার্ড। একটু ঘুমোতে চাই । উঠছি।
রায়ান উঠে গেস্ট রুমে গিয়ে শরীর এলিয়ে দেয় । রাজ্য জুড়ে নেমে আসা গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় ।
রোহান রেহানা কিছুক্ষন থম ধরে বসে থাকে দুজন দুজনের দিকে চেয়ে। রেহানাই মুখ ফুটে বলে –পাপা হয়ে ছেলের এমন অবনতি তুমি দেখতে পারো কিন্তু আমি আর মেনে নিতে পারছি না । ছেলের সাথে কথা বলো । এবার একটা বিয়ে দিয়ে ঘরমূখী করো ছেলেকে।
–ছেলে আমার সব ঘাটে জল খায় তাকে আর কোন ঘাটের জল দিয়ে আটকাবো বলো ? প্রনয় টান ছাড়া তাকে সুপথে আনা সম্ভব নয় ।
রোহানা হা নিশ্বাস ফেলে উঠে যায় ।

সন্ধ্যার আধার নামছে দু ধারে । শপিংমল থেকে কিছু কেনাকাটা সেরে রিকশায় চেপে বাসার উদ্দ্যেশে ফিরছে তৃনা । জ্যামে আটকে যায় ক্ষনে ক্ষনে । ঢাকার জ্যাম হচ্ছে সুখের মতো । থেমে থেমে নেমে আসে আবার উচ্ছেদ হয়ে যায় । বসে বসে ট্রাফিক পুলিশের এদিক ওদিক মুভ দেখতে দেখতে চোখ পড়ে হাত দশেক দূর একটি কাল রংয়ের কারে স্বয়ং রায়ান চৌধুরীকে । কালো সানগ্লাস চোখে খোচাদাড়িতে সুকুমার অবয়ব। সামনের চুলগুলো খয়ারী রঙ্গা । কালো ব্লেজার গায়ে চড়ানো । এক মুহুর্ত তাকিয়ে চোখ ফেরায় তৃনা । বার বার চোখ দুটো তার দিকে অবাধ্যতা প্রমান করতে চাচ্ছে । শক্ত করে চোখ কুচকে বন্ধ করে ফেলে তৃনা । রিকশাওয়ালা মামা এক ঝলক পেছনে তাকিয়ে তৃনাকে দেখে কৌতুক স্বরে বলে –কি গো আফা! বালু কনা বালাই ও তো নাই । এমনিতেই চোখে চশমা লাগাইছেন তার উপর আবার ঐভাবে বন্ধ কইরা আছেন ..আরো কানা হবার চান নাকি ?
তৃনা চোখ খুলে বলে –মামা আপনি বেশি কথা বলেন । জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে যান ।
চলে আসার সময় আশে পাশে আরেকবার তাকায় তৃনা কিন্তু সেই কালো কুচকুচে কার টার আর উদ্দিশ পায় না ।
বাসায় আসতেই পারুল বেগম বলে –আমার জন্য কি আনছো আম্মাজান ?
তৃনা এগিয়ে এসে একটা প্যাকেট হাতে দিয়ে বলে –তোমার রেডিমেট ব্লাউজ ফুপি । নাও ।
তৃষা রিমোট রেখে মায়ের দিকে হা করে থাকে বরাবরের মতো । আঢ়ালে ধান মাড়াই করে সবসময় আর সামনে ক্ষেতে সেচ দেয় । দেখায় সে কতো কাজের । তৃনা হাত দিয়ে তৃষার মুখ লাগিয়ে দিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায় ।
______________
রেস্টুরেন্টে বসে আছে তৃষা রায়ান । অনেক মেসেজ কল দিয়ে দিয়ে এখানে মিট করাতে এনেছে রায়ান কে । এসেও একবার তাকাচ্ছে না তৃষার দিকে । মোবাইলে মুখ গুজে আছে । তাকানোর কি আছে ! সব জিএফ একি ! মুখ ভর্তি রংগের বালতি , স্লিম ফিগার, ফরেনারের মতো শরীরের রং যাকে বলে সাদা বিড়াল, এইতো… এদের মধ্যে না পায় কোন আকর্ষন না পায় একটু ভালবাসা আর না পায় সুখ । শুধু দৈহিক চাহিদার সমাচার । মরিচিকার পেছনে ছুটা বৈকি । তৃষা রায়ানের হাত দুটো মুঠোয় নিয়ে নেয় । রায়ান তৃষার দিকে তাকায় । তৃষা চোখে চোখ রেখে বলে — সেদিনের পর থেকে ভালভাবে কথা বলছো না আমার সাথে । এতো রাগ তোমার আমার প্রতি ? আমি কতো কষ্ট পাচ্ছি জানো তুমি ? কেনো দাও এতো কষ্ট আমাকে ? তুমি জানো সেদিন কতবড় ভুল করতে যাচ্ছিলাম আমরা ?
–হে এক সেকেন্ড। তুমি কি আমাকে জ্ঞান দিতে ডেকেছো ? যদি তাই বলো তো আমি উটছি অনেক কাজ আছে আমার ।
–এই না না উঠো না প্লিজ । বাবু আই লাভ ইউ । বিয়ের পর তো আমি তোমারি তাই না ? ধৈর্য ধরো একটু ।
আড়িচোখে তৃষার দিকে তাকিয়ে বলে –বিয়ে?? ও হা বিয়ে । বিয়ে মানে রায়ান চৌধুরী বিবাহিতো । তার সীমাবন্ধতা শুধু তার স্ত্রীর মাঝেই । তাইনা রুপসী?
— হুম ।
মনে মনে হাসে রায়ান ..বিয়ে ..বিয়ে দ্বারা কাউকে কখনো সীমাবন্ধ করা যায় না । সীমাবন্ধ করা যায় শিক্ষা , সম্মান, ভালোবাসা আর ধর্মভীরুতা দিয়ে ।
ওয়েটার এসে কফি দিয়ে যায় । রায়ান চুমুক দিয়ে বলে –তো বিয়ে করতে চাও আমায় রুপসী ?
তৃষা হাত চেপে ধরে বলে –বল কবে করবে বিয়ে ? তুমি চাইলে এখনি আর না চাইলে___
— কখনোই না । তাইতো রুপসী??
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে রায়ান ।হাসি হাসি চোখ দুটো নিমেষেই বেদনা মুখর হয়ে উঠে তৃষার । রায়ান রিলাক্স বলে গালে হাত দেয় তৃষার ।
–বিয়ে তো করবো রূপসী । সময় হোক । হারিয়ে তো আর যাচ্ছনা ।
হাসি ফুটে তৃষার মুখে । তৃষাকে বিদায় দিয়ে আবার রেস্টুরেন্টে ফিরে আসে রায়ান । মাসুদ পুরো টেবিল খাবারে সাজিয়ে খেতে বসে গেছে কজ্বি ডুবিয়ে । রায়ানের সাথেই এসেছিলো এখানে । রায়ান ও বসে প্লেটে ফ্রাইড রাইস আর ভেজিটেবলস নিয়ে খেতে থাকে । মাসুদ প্রশ্ন করে
–সত্যি সত্যি বিয়ে করবি নাকি ?
–পাগল নাকি ? এভাবে হাতে রাখতে হয় বুঝলি ?তোর দারা সম্ভব নয় ।
–চাই ও না । আমি বিবাহিতো । আমার সব ভালোবাসা আমার বউয়ের জন্য । অন্য কোন মেয়ে চাই না আমার ।
খাওয়া থেমে যায় রায়ানের । মাসুদের দিকে তাকাতেই মাসুদ অস্থির হয়ে পড়ে । হাত ধরে বলে –দোস্ত সরি দোস্ত। প্লিজ খাওয়া রেখে উঠবি না। শেষ কর খাওয়াটা ।
রায়ান কিছু না বলে ফোন হাতে নিয়ে পেছন দিক ফিরে যায় । মাসুদ কে বলে –তুই খাওয়া শেষ কর । আমি ওয়েট করছি । মাসুদ নিজেও আর খেতে পারে না । চুপ চাপ উঠে বিল পে করে আসে । আসার সময় রায়ান মুখে শুধু একটা কথাই বলে –আমার অতীতের কথা কখনো আমাকে শুনাবিনা । আই হেট মাই পাস্ট লাইফ ।
–তৃনলতাকে ও?
–ওর নাম নিবি না ।
–কেনো বল তুই তৃনলতাকে ও হেট করিস ।
মাথা নাড়ায় রায়ান । মাসুদের দিকে তাকিয়ে বলে — এই জীবনে আমি দুজন প্রেয়সীর চোখে আমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি । একজনের টা ছিলো মিথ্যা আরেকজনের টা ছিলো সত্য । চিনতে পারিনি তাই মিথ্যাকে বরন করে সত্যকে বর্জন করেছি আমি । তাই হয়তো ভুলতে পারি না কভু । মিথ্যাটা ছিলো আমার চোখে প্রবল দৃশ্যমান আর সত্যটা ছিলো ধোয়াশার মতো যা শুধু আমার অনুধাবনের ভিত্তিতে গড়া ।
— হয়তো । অনুধাবন সব সময় সঠিক হয় না । তাই হয়তোই বলবো আমি এটাকে ।
–বাদ দে । আসলে যে আমাকে ভালোবাসে তাকে আমি ভালো না বাসতে পারলেও সম্মান করি । তার জায়গাও আমার হৃদয়ে হয় । তৃনলতাকেও হয়তো জায়গা দিয়েছি আমি ।

বাসায় এসে রাগ নিয়ে পার্স ছুড়ে ফেলে তৃষা । চোখ মুখ জ্বল জ্বল করছে রাগে । এমন রাগ দেখে মনোয়ার ও চমকে যায় । শিল্পি এসে জিজ্জাসা করতেই রাগে গজ গজ করে বলে –মামুনি তোমার ছেলের জন্য কি নাক কাটা যাবে আমার ? বাসা থেকে বের হতে পারি না । যা ইচ্ছা তাই শুনতে হয় লোকের মুখে ।
শিল্পি অধৈর্য্য হয়ে বলে –আরে কি শুনেছিস বলবিতো নাকি ? –আর বলো না মামুনি । গলির মাথায় নাকি প্রেমিকা__ চুপ হয়ে মনোয়ারের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে । মনোয়ার প্রস্থান করতেই আবার বলে — গলির মাথায় নাকি প্রেমিকার হাত ধরে , জড়িয়ে ধরে প্রেমালাপ করে । এগুলো কোন কথা বলো ? মান সম্মান আছে তো আমাদের । তাড়াতাড়ি বিয়ে দাও তো ওকে নয়তো পাবলিক প্লেসে আর না জানি কি করবে আল্লাহ জানে ।
রাতে রবিন তৃষার রুমে ডুকে বলে
–আম্মুকে কি বলেছিস তুই ?
–যা সত্য তাই বলেছি । রাস্তার মাঝে প্রেম করতে পারবে জড়িয়ে ধরে আর আমি বললেই দোষ!
–দেখেছিস নিজের চোখে ?
–দেখিনি বাট বান্ধুবীর মুখে শুনেছি । ঐখানেই এক বিল্ডিং এ থাকে ।
–লোকের মুখে তো আমিও শুনি তৃষা । তুই হাজার টা করতে পারিস মেয়ে হয়ে আর আমি করলে দোষ ? আমি তো জড়িয়ে ধরেছিলাম আর তুই তো বিছানাতেও চলে গেছিলি ।
তৃষার কলিজা ছেত করে উঠে । কাপা গলায় বলে –ভা ভা ভাইয়া..আমি কিছু করিনি । বিশ্বাস করো । আমি …
–জানি আমি । সব জানি । কিছু হয়ে গেলে এই বাড়িতে আর তোর জায়গা হতো না ।
–তোমাকে কি আপু বলে দিয়েছে ?
–তোর আপু তো নিজের কথাই কখনো বললো না আর তোর কথা বলবে এটা তুই ভাবিস নাকি ? পিঠাপিঠি ভাই বোন ছিলাম । তখন ততোটাও কিছু ভাবিনি । সব সময় বইয়ে মুখ গুজে পড়ে থাকতাম । যখন বোনটার অস্বাভাবিকতা নজরে আসলো তখন আমার ভাবনার বেগতিক পেল যে আমি বড় ভাই । আমি আমার বোন দের দেখে রাখিনি । তার পর থেকে তোদের দুজনের উপর আমার পূর্ণ নজর থাকে বিশেষ করে তোর উপর । তোর উৎশৃঙ্খলতার উপর ।
মাথা নিচু করে ফেলে তৃষা । মুখ থেকে আর টু শব্দ বের করে না । চিবুকে হাত দিকে মুখ উচিয়ে তুলে রবিন । ছল ছল নয়না তৃষার চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে ছোট চুল গুলো কানের পাশে গুজে দেয় ।

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here