রঙ তুলির প্রেয়সী,পর্ব-১

0
2302

রঙ তুলির প্রেয়সী,পর্ব-১
ফারজানা আহমেদ

‘আচ্ছা মেয়েটা বাড়ি চিনবে তো? আসতে পারবে তো? আমার হয়েছে যতো জ্বালা! কাজের সময় আমি কাউকে পাইনা। দুই দুইটা ছেলে আমার, অথচ দেখো… কাজের সময় মনে হয় আমার যেনো ছেলেই নাই। কী যে করছে মেয়েটা…’ সদর দরজা খুলে তার সামনে পায়চারি করতে করতে দরজার দিকে খানিক পর পর উকি মারছিলেন আর কথাগুলো বিড়বিড় করছিলেন মুনতাহা বেগম। সোফায় বসে উনার অস্থিরতা দেখে ঠোঁট টিপে হাসছিলো আদিয়া। আড়চোখে আদিয়ার হাসি দেখেন মুনতাহা। তারপর মুখ দিয়ে ‘চ’ কারান্ত শব্দ করেন। তারপর আবার দরজায় উকি দেন। তারপর এসে সোফায় আদিয়ার পাশে বসে চোখ কটমট করে তাকান। আদিয়া চট করে পাশে রাখা হুমায়ুন আহমেদ এর ‘আজ হিমুর বিয়ে’ বইটা চোখের সামনে মেলে ধরে নিজের হাসিকে আড়াল করার ব্যার্থ চেষ্টা করে। সেদিকে তাকিয়ে ফুসলেন মুনতাহা। তারপর খ্যাঁকানো গলায় বললেন, ‘হয়েছে ভং করতে হবেনা। দিনকাল ভালো না, তুই কী বুঝবি এসবের? মেয়েটা এখানে নতুন। কীজানি বাবা ঠিকমতো আসতে পারবে কি না।’

‘মা, শুধুশুধু কেন এতো টেনশন করছো? একা আসছে নাকি? গাড়ি তো পাঠিয়ে দিয়েছো। আব্দুল ভাইয়ের সাথে ফটোও দিয়েছো। তারপরেও কেন এমন করছো?’ বইটা নামিয়ে রেখে বললো আদিয়া।

‘চিন্তা করবোনা? গাড়ি পাঠিয়ে দিলেই হয় নাকি হে? একটা দায়িত্ববোধ আছেনা? চিন্তা করবোনা?’

‘চিন্তা করলেই সেটা দায়িত্ববোধ? নাহলে দায়িত্ববোধ না?’ কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করে আদিয়া। আগ্নিঝরা চোখ নিয়ে তাকালেন মুনতাহা। ঢোঁক গিলে মুখে হাসি এনে বললো আদিয়া, ‘মা, ও তো এসেছে আরো একবার। তুমি চিন্তা করো না। এইতো আর এসেই যাবে বেশিক্ষণ লাগবেনা।’

‘এসেছে সেই দুই বছর আগে। অতো কিছু মনে আছে নাকি মেয়েটার? উফ, রিয়াদ টাও যে কই গেল! ওকে সঙ্গে দিলেও এতো চিন্তা থাকতোনা।’ মাথায় হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন মুনতাহা।

‘আচ্ছা মা, কোন ঘরটায় থাকবে ও?’

‘কেন ঐ দোতলার দু’নম্বর বারান্দাওয়ালা ঘরটায়। খোলামেলা আছে, মেয়েটার ভালো লাগবে।’

‘বড় ভাইয়ার পাশের ঘরটায়? যেটায় বড় ভাইয়ার…’

‘হ্যাঁ ওখানেই।’

‘কী বলছো মা?’ চোখ বড় বড় করে বললো আদিয়া।

‘কেন কী হয়েছে?’ মাথা থেকে হাত সরিয়ে আদিয়ার দিকে তাকালেন মুনতাহা।

‘বড় ভাইয়া জানে? মানবে ও?’

‘ম-মানবেনা ক্ব-কেন?’ চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়ে মুনতাহার। টুনিকে দিয়ে ঘরটা তো পরিষ্কার করিয়ে রেখেছেন ঠিকই। কিন্তু এই কথাটা উনার মাথায় আসেনি। আদিয়া আবার বললো, ‘মা, আরো তো ঘর খালি আছে। ওগুলো কোনো একটা ঠিকঠাক করে দেই টুনিকে দিয়ে?’

‘না। ঐ ঘরেই থাকবে তিথি।’

‘কিন্তু বড় ভাইয়া…’

‘আমি ঐ আলমারি থেকে সব জিনিসপত্র সরিয়ে রেখেছি।’

‘মা! তুমি ওগুলোতে হাত দিয়েছো? বড় ভাইয়া পই পই করে মানা করেছে মা…’

‘এই চুপ কর তো। আমি ভয় পাই নাকি ওকে? ও আমার পেটে জন্মেছে? নাকি আমি ওর পেটে জন্মেছি?’ বলে উঠে দাঁড়ালেন মুনতাহা। তারপর আবার বললেন, ‘ফোন করে দেখতো রহমানকে। কদ্দুর এলো। আমি দেখি খাবারদাবারের দিক। মেয়েটা এসে খাবে।’ বলে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন উনি। আদিয়া মোবাইল হাতে নিয়ে ড্রাইভার রহমানের নাম্বার ডায়াল করলো।
_______________________________________________

‘খালাম্মা, ও খালাম্মা, খালাম্মাগো, দেহেন আফারে আনছি।’ হাতে একটা বড়সড় লাগেজ নিয়ে টানতে টানতে ঘরে ঢুকে চেচাতে লাগলো আব্দুল। তারপর ব্যাগটা রেখে বেরিয়ে গেলো বাইরে। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন মুনতাহা। পেছন পেছন আদিয়াও এলো। আদিয়া এসেই জোরেসোরে এক চিৎকার দিলো, ‘ও আল্লাহ, তিথি! এতো লম্বা চুল!’

পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিলো তিথি। আদিয়ার চিৎকার শুনে ফিরে তাকালো। তারপর আদিয়ার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়েই বলে উঠলো, ‘স্ট্যাচু!’ সাথেসাথে আদিয়া স্ট্যাচু হয়ে যেমন ছিলো ওমনই দাঁড়িয়ে থাকলো, দুগালে হাত দিয়ে অবাক করা মুখ নিয়ে। তিথি দৌড়ে গিয়ে মুনতাহাকে জড়িয়ে ধরলো। মুনতাহা তিথিকে বুকে নিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কেমন আছিস মা? কতো বছর পর দেখা! কতো করে বলেছি আয় আমার এখানে আয় মায়ের কাছে আয়। এলিনা।’

‘মামণি, আর আফসোস করো না। এবার একেবারেই চলে এসেছি হয়েছে?’ মুনতাহার বুক থেকে মাথা তুলে উনার দিকে তাকিয়ে বললো তিথি।

‘আচ্ছা ঠিক আছে। আর ওদিকে যাওয়াযাওয়ি চলবেনা আমি বলে দিলাম। এখানে ভালো একটা ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দেবো। এসব হোস্টেল টোস্লেল এ আর না।’

‘আসার সময় বুড়িমা খুব কাঁদছিলো জানো মামণি? আমারও যেনো বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো। মা চলে যাওয়ার পর ঐ মানুষটাই তো আগলে রেখেছিলো আমায়…’ বলতে গিয়ে যেনো চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিলো তিথির। মুনতাহা ধমকের স্বরে বললেন, ‘একটা থাপ্পড় দিবো! এসব কথা ভেবে আবার যদি মন খারাপ করবি। এই আমি তোর মা না? তোকে মামণি ডাকা এমনি এমনি শিখিয়েছি নাকি?’

‘শিখিয়েছিলে বলেই তো নিজের রক্ত আমাকে ছুঁড়ে ফেলার পরও একটা মাথা গুঁজার ঠাই পেয়েছি।’

‘আবার?’ চোখে কাঠিন্য এনে বললেন মুনতাহা।

‘ইচ চ্যলি!’ দুআঙ্গুলে আলতো করে একটা কানের লতি ধরে খিলখিল করে হেসে উঠলো তিথি।

‘আর পারছিনা, এতোক্ষণ স্ট্যাচু বানিয়ে রাখার কোনো নিয়ম নেই।’ পাশ থেকে নড়ে ওঠে বললো আদিয়া।

হাসতে লাগলো তিথি। মুনতাহা বললেন, ‘যা গোসল কর ফ্রেশ হো। আমি খাবার দিচ্ছি। খাসনি তো জানি রাস্তায় একদম। যা তো আদিয়া ওকে ঘরে নিয়ে যা।’ বলতে বলতে রান্নাঘরের দিকে ছুটলেন মুনতাহা।

‘তোদের বাড়িটা আগে যেমন ছিলো এখনও ঠিক তেমনই আছে। কোনো পরিবর্তন নেই।’ লাগেজ হাতে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বললো তিথি।

‘হ্যাঁ আর পরিবর্তনও হবেনা। আচ্ছা তোর মোবাইল কই? কল দিয়ে দু’দিন থেকে পাইনা। মেসেঞ্জারেও এক্টিভ না তুই দু’দিন থেকে।’

‘আমার হচ্ছে ফাটা কপাল। মোবাইল চুরি হয়ে গেছে। বুড়িমাকে নিয়ে বেরিয়েছিলাম একটু দরকারি জিনিসপত্র কিনবো বলে। ওখানেই… হাতে নাই টাকা যে আবার মোবাইল কিনবো। তাছাড়া ভাবলাম চলেই যেহেতু আসছি মোবাইলের দরকার নাই। কে আছে আমার? খবরাখবর এক বুড়িমার নেয়া দরকার সেটা এখান থেকেই নেয়া যাবে।’ বলে হাসলো তিথি। সবসময় হাসি লেপ্টে থাকে মেয়েটার ঠোঁটে। আদিয়া ভাবে, একটা মানুষ ভেতরে এত চাপা কষ্ট নিয়ে কীভাবে মুখে এমন মিষ্টি হাসি নিয়ে থাকতে পারে?

দোতলায় সোজা ডানদিকের ঘরটায় ঢুকতে যাচ্ছিলো তিথি। ওকে হাত ধরে আঁটকে আদিয়া বললো, ‘আরে আরে ওদিকে কী? পাশেরটায় তো।’

‘কিন্তু আমিতো মামণিকে বলেছিলাম এটার কথা।’

‘এটা বড় ভাইয়ার ঘর।’

‘উনি দেশে?’

‘হুম, দু’বছর থেকে। চল চল, তাড়াতাড়ি গোসল করবি। তোর জন্য আমরাও না খেয়ে।’

‘ধুর বাবা, ওঘর থেকে কী সুন্দর সূর্যাস্ত আর সূর্যদ্বয় দেখা যেতো…’ ঠোঁট উল্টিয়ে নিজের রুমে ঢুকলো তিথি। আদিয়া মনে মনে বললো, ‘এই ঘরটায়-ই যে তোমারে দেয়া হইছে সেটা ভেবেই আমার ঘাম ছোটে আর তুমি ঐ ঘরে যাবা…’
________________________________________________

খাবার টেবিলে রিয়াদের সাথে দেখা হয়ে গেল তিথির। রিয়াদ টেবিলে বসতে বসতে বললো, ‘কী অবস্থা তোমার? ভালো আছো?’

‘ভালো আছি ভাইয়া। তুমি?’ হেসে বললো তিথি।

‘ভালো। তুমিতো দেখছি হুবহু ফটোর মতোই। আমি ভাবলাম কিছু চেঞ্জিং হবে। এভাবে সচরাচর ফটোর মতোই কোনো মেয়ে হয়না। অনেকে তো আবার ঘণ্টা লাগিয়ে এডিট করে ফেইসবুকে ফটো আপলোড দেয়।’ কথাটা বলার সময় আদিয়ার দিকে তাকালো রিয়াদ। আদিয়া সাথেসাথে চ্যাতে উঠে বললো, ‘দেখলে মা দেখলে? আমাকে পিঞ্চ করছে ছোট ভাইয়া। এইযে আমি একদম এডিট করিনা ফটো বুঝেছো? আমাকে তোমার ঐ গা…’ কথাটা পুরো করতে পারলোনা আদিয়া, তার আগেই রিয়াদের রাঙানো চোখ দেখে আঁটকে গেল সে।

‘লেগে গেলি তোরা? মেয়েটাকে শান্তিতে খেতে দিবিনা?’ ধমকে উঠলেন মুনতাহা। জোরে জোরে হেসে উঠলো তিথি। রিয়াদ বললো, ‘হেসোনা তিথি। এসেছো তো, এবার কালে কালে সব দেখবে তুমি।’

মুখ ভেংচি দিলো আদিয়া। তিথি জিজ্ঞেস করলো, ‘আঙ্কেল কোথায়?’

‘বাবা তো দেশের বাইরে। ফর বিজনেস।’ খেতে খেতে বললো রিয়াদ। তারপর তিথির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তারপর বলো, ভার্সিটির এডমিশন টেস্টের প্রিপারেশন কেমন?’

‘আরে ধুর, ওসব এডমিশনের প্রিপারেশনে কী হবে? আমি চান্সই পাবোনা।’ বলেই আবার খিলখিল করে হাসলো তিথি। রিয়াদ অবাক চোখে বললো, ‘কী বলো এসব? এই একদম গফিলতি করবেনা। পড়ায় মন দাও। এই সময়টা খুব বেশিই গুরুত্বপূর্ণ। লাইফের টার্নিং পয়েন্ট।’

‘হ্যাঁ। এসেছিস তো এখন এখানে। আদিয়ার সাথেসাথে তোকেও কানমলা দিয়ে পড়াবো। পড়ায় কোনো হেরফের নেই।’ খেতে বসতে বসতে বললেন মুনতাহা।

‘সাস্টে এক্সাম দেয়ার প্লান আছেতো?’ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো রিয়াদ তিথির দিকে। তিথি চোখ তুলে তাকালো। তার দৃষ্টিতে খানিকটা সংকোচ। সে আমতাআমতা করে বললো, ‘আসলে ভাইয়া… কোনো প্লান করিনি। আসলে… মন মেজাজ ভালো ছিলোনা তো তাই এসবে মন দেইনি। ন্যাশনালে যেকোনো একটায়…’

‘নো নো, এসব চলবেনা তিথি। তুমি কাল থেকেই আদিয়ার সাথে পড়তে শুরু করবে টিচারের কাছে। আমি বই এনে দেবো। আর আদিয়ার সাথেই ফর্ম পূরণ করবে তুমি। আদিয়াকে তো সিলেটে আর ঢাকায় এক্সাম দেয়াবো সাথে তুমিও দিবে। টার্গেট তোমার পাব্লিক থাকা চাই। গফিলতি চলবেনা।’ কথাগুলো বলে রিয়াদ একটা গম্ভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তিথির দিকে। ওর খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। সে একটা হাসি দিয়ে আবার বললো, ‘থাকো তাহলে। আবার দেখা হবে।’ বলে চলে গেল সেখান থেকে।

‘লেখাপড়া নিয়ে এতো স্ট্রিক্ট!’ চোখ বড় বড় করে বললো তিথি।

‘তুমি বেঁচে গেলে বুঝলে? এসব কথা বড় ভাইয়ার সামনে বলিস নি তুই এটা তোর ভাগ্য।’ বললো আদিয়া।

‘হয়েছে হয়েছে। খাওয়া শেষ করে গল্পগুজব করো।’ তাড়া দিলেন মুনতাহা।
________________________________________________

ঘড়িতে যখন আটটা বাজলো তখনই তাড়াহুড়ো করে বই নিয়ে বসে পড়লো আদিয়া। তিথি অবাক হয়ে বললো, ‘কীরে? এতোক্ষণ গল্পে মশগুল ছিলি। আমাকে যেতে দিলিনা বলেছিলাম ঘুমাবো। আর এখন এতো শিক্ষিত হয়ে যাচ্ছিস যে?’

‘বড় ভাইয়া আসার সময় হয়ে গেছে।’ বই খুলতে খুলতে বললো আদিয়া।

‘বুঝলাম না। আসার পর থেকেই দেখতে পাচ্ছি এই “বড় ভাইয়া” শব্দ দুটো যেন তোর কাছে আতঙ্ক। উনি কি খুব রাগী? মানে সিনেমার ভিলেন টাইপ?’

‘আরে নাহ। ভাইয়া অনেক ভালো আর হাসিখুশি। আমাদের কেউই সিনেমার ভিলেন টাইপ না। তুই রিয়াদ ভাইয়াকে দেখিস না? আর বাবাকেও দেখলিনা?’

‘তাহলে এমন করিস কেন তুই?’

‘তুই বুঝবিনা তিথি। আমরা বড় ভাইয়াকে কখনও রাগাই না।’ কথাটা বলে বইয়ে মুখ গুঁজলো আদিয়া।

‘আচ্ছা পড়। যাই আমি একটু শুয়ে থাকি।’ বলে উঠে গেল তিথি।’

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here