রঙ তুলির প্রেয়সী
৬.
ভোর পাঁচটা। জাওয়াদের মোবাইল বাজছে। ঘুম ঘুম চোখে মোবাইলটা হাতে নিলো সে। একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল এসেছে। চোখ কচলে উঠে বসে জাওয়াদ। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো একটি পুরুষালী কণ্ঠ, ‘ভেরি বেড! ভে-রি বে-ড! ঘুমোচ্ছিস এখনো? মর্নিং ওয়াকএ যাসনি?’
চোখ থেকে ঘুম যেনো উবে গেল মুহূর্তেই। নড়েচড়ে উঠে বসলো জাওয়াদ। তারপর কান থেকে মোবাইলটা নামিয়ে চোখের সামনে ধরলো, হ্যাঁ! বাংলাদেশী নাম্বার। তার মানে… সে আবার মোবাইলটা কানে চেপে ধরলো। ওপাশ থেকে আবারও ভেসে এলো, ‘কীরে, ঘুমিয়ে গেলি নাকি?’
‘বাবা তুমি চলে এসেছো?’ অবাক কণ্ঠে বললো জাওয়াদ।
‘তোর বাপের আত্মা এসেছে।’
হেসে দিলো জাওয়াদ। তারপর হাই তুলে বললো, ‘এভাবে করলে কেন? আগে বললে গাড়ি পাঠিয়ে দিতাম অথবা আমি গাড়ি নিয়ে গিয়ে অপেক্ষা করতাম। আর তোমার না মাসখানেক পর আসার কথা?’
‘তোর মাকে সারপ্রাইজ দিবো বলে চলে এলাম না বলে। কোনোদিন মাসখানেকের জন্য গিয়েছি কোথাও?’
হাসলো জাওয়াদ শব্দ করে। হেলাল আহমেদ আবার বললেন, ‘আমি এয়ারপোর্টে বসে আছি। আয়তো তাড়াতাড়ি। শোন, কাউকে বলিস না এসেছি যে। রিয়াদকে এজন্যেই কল করিনি, ওটা হচ্ছে মায়ের ছেলে।’
‘আচ্ছা ঠিকাছে আমি আসছি ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই।’ বলে কল কেটে ফ্রেশ হতে গেল জাওয়াদ। পাঁচ মিনিটেই ফ্রেশ হয়ে যেমন ড্রেসআপে ছিলো সেভাবেই গাড়ির চাবি হাতে বেরিয়ে গেল। একটা টি-শার্ট আর ফুল ব্লাক ট্রাউজার পরা।
নামায পড়ে একবার রুমের বাইরে বেরোলো তিথি। আজ কেন যেন ঘুম লাগছেনা ওর। তাই ভাবলো এক কাপ চা বানিয়ে বারান্দায় এসে বসে আরামসে খাবে। সিঁড়ির কাছে যেতেই কারো সাথে ধাক্কা খেলো তিথি। জাওয়াদকে দেখেই তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। ‘স্যরি’ বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেল জাওয়াদ। সেদিকে তাকিয়ে ভেংচি দিলো তিথি। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো। কী মনে করে জাওয়াদের রুমের দিকে যেতে লাগলো সে। রুমের সামনে এসে চোখ চিলিক দিয়ে উঠলো তিথির। ‘দরজা খোলা!’ বলে চাপা উল্লাসে ফেটে পড়লো যেন সে। তারপর তাড়াতাড়ি রুমে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিলো। চোখ পড়লো আবার দেয়ালে টানানো ছবির দিকে। দুটো ছবি। এরমাঝে একটা ছবি খুব সুন্দর একটা মেয়ের। আর আরেকটা হচ্ছে মোগ্যাম্বো টার। দুটো ছবিই রঙ তুলির আঁকা। দুটো ছবিতেই দুজনে হাসছে। প্রাণখোলা হাসি। আসার পর থেকে তিথি একবারও এই ছেলেটাকে এভাবে হাসতে দেখেনি। না হাসুক, তার কী। তিথি আরেকবার তাকালো মেয়েটার ছবির দিকে। রঙ তুলির আঁকা ছবিতেই এতো সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। না জানি মেয়েটা বাস্তবে কতো সুন্দর! কে মেয়েটা? যেই হোক, সে এতো ভাবছে কেন? মাথা ঝাড়া দিয়ে এগিয়ে গেল তিথি জাওয়াদের আলমারির দিকে। দেখলো আলমারিতে চাবি ঝুলছে। একটা পৈশাচিক হাসি ফুটে ওঠে তিথির ঠোঁটে। সে চাবি ঘুরিয়ে আলমারি খুললো। তারপর জোরে জোরে বললো, ‘এবার আমিও এই সুন্দর করে ভাঁজ করে রাখা কাপড়গুলো ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে ফেলবো! মুহাহাহা!’ বলেই প্রথমে জাওয়াদের একটা ভাঁজ করা শার্ট গান গাইতে গাইতে পেছনে ফেলল ছুঁড়ে। এভাবে একে একে প্রায় ৫/৬ টা কাপড় ছুঁড়ে ফেললো পেছনে। তারপর হাতে নিলো একটা ক্যাপ। সেটা প্রথমে মাথায় দিলো। দিয়ে আলমারির আয়নায় নিজেকে দেখলো। হঠাৎ বা’দিক থেকে কেউ একজন বলে উঠলো, ‘ভালো দেখাচ্ছে। বিউটিফুল। নিয়ে নাও এটা তুমি।’
গলা শুনে বুঝতে বাকি রইলো না তিথির যে এটা কে। কলিজা যেন শুঁকিয়ে আসতে লাগলো তার। মোগ্যাম্বো! আস্তে আস্তে ক্যাপটা মাথা থেকে সরিয়ে আলমারিতে জায়গামতো রাখলো তিথি। তারপর বা’দিকে ঘুরে দেখলো দরজা লাগিয়ে সেখানে হেলান দিয়ে বুকে দু’হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জাওয়াদ। খুব গম্ভীর চাহনি। ঢোঁক গিললো তিথি। তারপর আস্তে আস্তে বললো, ‘আ-আমি যাবো।’
জাওয়াদ একবার হাতের ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। বিশ মিনিট আছে হাতে। একটু স্পিডে ড্রাইভ করলেই এয়ারপোর্টে পৌঁছে যাবে দশ মিনিটেই। সে তাকালো তিথির দিকে। তিথি আবার বললো, ‘ঘ-ঘরে যাবো। মামণি…’
জাওয়াদ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তিথির দিকে একটু এগিয়ে এসে বললো, ‘অবশ্যই যাবে। তার আগে যেগুলো এইমাত্র ফেলে দিলে সেগুলো আগেরমতো জায়গায় ঠিক করে রাখো।’
‘হ্যা?’ অবাক হয়ে বললো তিথি। তিথিকে তার কাপড় ভাঁজ করতে বলছে?
‘শুনতে পাওনি?’
‘আমি পারবোনা।’ সোজাসাপটা উত্তর দিলো তিথি।
‘তাহলে আমি এক কাজ করি বরং। বাড়ির সবাইকে একত্রে জড়ো করে তোমার এই কাণ্ডটার কথা বলি।’
তিথির চোখদুটো বড় হয়ে গেল। ব্ল্যাকমেইল! এটা করলে যে তিথির মানসম্মান আর থাকবেনা সেটা ভালোই বুঝতে পারছে সে। তিথি আস্তে আস্তে বললো, ‘এইযে শুনুন, আমার সাথে লাগালাগি কিন্তু ভালো হচ্ছেনা। একবার আমার রুমমেট আমার সাথে লেগেছিলো। আমি ওর ঘুমের মধ্যে ওর পাজামার ফিতা এমনভাবে গিট্টু দিয়ে রেখেছিলাম যে বাথরুমে বড়টা করতে গিয়ে যখন খুলতে পারেনি তখন চিৎকার করে কান্না করেছে হুম।’
হাসি পেয়ে গেল জাওয়াদের। কিন্তু হাসলোনা সে। মুখে গম্ভীর্য রেখেই বললো, ‘সমস্যা নেই। আমি পাজামা পরিনা।’ বলে নিচে ছড়িয়ে থাকা কাপড়ের দিকে চোখ দিয়ে ইশারা করলো জাওয়াদ। তিথির কেমন যেন অসহায় লাগলো। সে আস্তে আস্তে ফ্লোরে পড়ে থাকা কাপড়গুলো তুলে ভাঁজ করে জায়গামতো রাখতে লাগলো। আল্লাহ বাঁচিয়েছেন, বেশি কাপড় ফেলেনি। চার-পাঁচটা হবে। নাহলে এতো কাপড় ভাঁজ করতে গেলে তো হয়ে গেছিলো!
দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসি আঁটকানোর চেষ্টা করছে জাওয়াদ। তিথির এই অসহায় ভরা মুখটা দেখতে তার বেশ ভালো লাগছে। মোবাইলটা ফেলে রেখে গিয়েছিলো ভুলে, সেটাই নিতে এসেছিলো সে। এগিয়ে গিয়ে বিছানার ওপর থেকে মোবাইলটা নিয়ে পকেটে রাখলো সে। পেছন থেকে তিথি বললো, ‘নিন জনাব শেষ।’
‘গুড।’ বলে আলমারিটা তালা দিয়ে চাবিটা হাতে নিয়েই বেরিয়ে গেল জাওয়াদ। পেছন ফিরেও তাকালোনা। ফোঁস ফোঁস করতে করতে নিজের রুমে চলে গেল তিথি।
________________________
গাড়িতে উঠে বসে হাসতে লাগলো জাওয়াদ। খুব হাসছে সে। এতো পাগল মেয়েটা! একেবারেই একটা বাচ্চা। তিথির বলা রুমমেটের ঘটনাটা মনে পড়তেই জোরে শব্দ করে হাসলো জাওয়াদ। ‘বড়টা! গিট্টু!’ বলে আবার হাসলো শব্দ করে সে। তারপর হেসে মাথা নেড়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
_________________________
বিছানায় বসে আছে তিথি। হাতে তার একটা নীল রঙের ডায়েরি। যেটা একটু আগে সে জাওয়াদের আলমারি থেকে নিয়ে এসেছে লুকিয়ে। জাওয়াদ যখন মোবাইল পকেটে নিচ্ছিলো উল্টো ঘুরে ঠিক তখনই নিজের টপসের নিচে লুকিয়ে রেখেছিলো ডায়েরিটা তিথি। ডায়েরিটা দেখেই চিনতে পেরে গিয়েছিলো তিথি। এটা সেই ডায়েরি, যেটা সেদিন জাওয়াদ তিথির ঘরে সব লণ্ডভণ্ড করে খুঁজছিল। ডায়েরিটার সাথে আরো কিছু একটা ছিলো সেদিন। সম্ভবত একটা ছোট ব্যাগ। সে যাই হোক, ডায়েরিটা দেখে দারুণ কৌতূহল হলো তিথির। তাই আগপিছ না ভেবে নিয়ে নিলো। কী এমন আছে এতে যে ওভাবে পাগলের মতো খুঁজছিলো? আজ দেখবে তিথি। এই ডায়েরিটা হাতে নিয়ে যেনো এভারেস্ট জয় করে ফেলেছে এমন অনুভূতি হচ্ছে তার। উঠে দাঁড়িয়ে আলমারির দিকে এগোতে এগোতে ভাবতে লাগলো, ডায়েরিটা অনেক লুকিয়ে রাখা ছিলো। মনে হয়না এটা বের করে কখনো আলমারি থেকে। তাই তিথি নিশ্চিন্তে পড়তে পারে। এভাবে কারো পারসোনাল ডায়েরি পড়তে নেই। কিন্তু ঐযে, নিষিদ্ধ জিনিস আকর্ষণ করে বেশি। নিজেকে দমাতে পারেনি তিথি। তারতো জানতেই হবে কী আছে এটায় যে ওভাবে তার কাপড়গুলো ফেলেছিলো। বাব্বাহ! কতোক্ষণ লাগলো পরে গোছাতে! ডায়েরিটা আলমারিতে রেখে দিলো তিথি। পরে শান্তিতে বসে বসে পড়বে। তাড়া নেই। যেহেতু এটা আগে তার রুমে ছিলো সেহেতু এটা কখনোই বের করেনা জাওয়াদ। বড় করে একটা নিশ্বাস নিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো তিথি।
_____________
চলবে……..
ফারজানা আহমেদ