রঙ তুলির প্রেয়সী-১৩,১৪
ফারজানা আহমেদ
১৩
দুই দিন থেকে জাওয়াদের চালচলন ভালো ঠেকছেনা তিথির কাছে। সারাদিন রুমে দরজা লাগিয়ে বসে থাকে। খাওয়ার সময় এসে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে কোনোমতে কয়েক লোকমা খেয়েই চলে যায় আবার রুমে। এই দুই দিন জাওয়াদ অফিসেও যায়নি। কারো সাথে কথা বলেনা, কারো দিকে তাকায় ও না। এই দুই দিন তিথি জাওয়াদের সাথে একটু সময় কথা বলার জন্য অনেক উসখুস করেছে কিন্তু সুযোগ পায়নি। ভেবেছিলো জাওয়াদের রুমে গিয়ে একটু বসবে, কিন্তু দরজা সবসময় আঁটকানো থাকে বিধায় সেটাও করা যাচ্ছেনা। মুখ গোমড়া করে তিথি বসে আছে নিজের বারান্দায়। এমন সময় আদিয়া এলো।
‘কীরে, এতোক্ষণ থেকে খুঁজি আর তুই এখানে?’
তিথি আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কেন খুঁজিস?’
‘আগে একটু সরে আমাকে বসতে দে তো।’
তিথি ফিরে তাকালো আদিয়ার দিকে। সরু চোখে তাকিয়ে বললো, ‘এইখানে তোর জায়গা হবে? তুই বসার সাথেসাথেই তো আমি ধুম করে পড়ে যাবো।’
‘তিথি একদম বেশি বেশি বলবিনা। নাহিদ সবসময় বলে আমাকে যে আমার কোমর একদম ফিটফাট।’ বলেই মুখ ভেংচি দিলো আদিয়া।
‘আচ্ছা? ওসব প্রেমিকরা একটু বাড়িয়ে তো বলবেই।’
‘উহুম, একদম বাড়িয়ে বলে না।’
‘বাড়িয়েই বলে। ও কীভাবে জানলো যে তোর কোমর ফিটফাট?’
‘ও জানবে নাতো কে জানবে? ও তো যখন আমাকে জড়িয়ে ধরে তখন তো আমার কোম…’ এইটুক বলেই তিথির দিকে তাকাতেই গলায় কথা আঁটকে গেলো আদিয়ার। তিথি হা হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ইশ, কী বলতে কী বলে দিলো! লজ্জা লাগছে খুব আদিয়ার। মুখটা একদম লাল হয়ে গেছে। হঠাৎ করে তিথি হেসে উঠলো, একদম ডাকাতিয়া হাসি। আদিয়া আরো বেশি লজ্জা পেয়ে গেল। হাসতে হাসতে তিথি বললো, ‘পড়তে বসে এসব চলে, না?’
‘তিথি চুপ কর প্লিজ।’ দু’হাতে মুখ ঢেকে বললো আদিয়া। তিথি হাসলো আরো কিছুক্ষণ। তারপর সরে বসে জায়গা দিলো আদিয়াকে। আদিয়া এসে চেয়ারে তিথিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বসলো। তিথি বললো, ‘খুঁজছিলি কেন?’
‘ওহ হ্যাঁ, শোন। কাল সকালে নানুবাড়ি যাবো সবাই। এটাই বলতে তোকে খুঁজছিলাম।’
‘সবাই মানে? আমিও?’
‘সবাই মানেতো ঘরের সবাই। আর ঘরের সবার মাঝে তুই আছিস সো তুইও।’
তিথি একটু নড়েচড়ে বসলো। তারপর বললো, ‘আমি কীভাবে যাবো… মানে, আমাকে কেউ চেনেও না।’
‘কুল! চেনেনা, চিনবে। আমাদের নানুবাড়ি সবাই অনেক মিশুক। তুই গিয়ে দেখিস, তোর মনেই হবেনা যে তুই প্রথমবার গেছিস।’
‘কিন্তু…’
‘আমি মাকে বলবো?’ চোখ রাঙালো আদিয়া।
‘ন-না।’
‘তাহলে বেশি কথা বলবিনা।’
তিথি আর কিছু বললোনা। আদিয়া বললো, ‘শোন, সেদিন যে আমরা একইরকম স্কার্ট কিনলাম না? সাথে একইরকম টপস? ঐটা পরবি বুঝলি। আমিও পরবো।’
‘আচ্ছা।’ বলে পাশের বারান্দায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো তিথি। সেই লাঞ্চের সময় দেখেছিলো জাওয়াদকে। তারপর জাওয়াদ যে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আঁটকালো, আর বেরোলোনা। আচ্ছা, কী এতো করে দরজা আঁটকিয়ে? কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকলো তিথি জাওয়াদের বারান্দায়।
_______________
রিয়াদকে কল করে ঠাণ্ডা ড্রিংকস নিয়ে আসতে বললো জাওয়াদ। তারপর হেঁটে ছবি দুটোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো, যে ছবি দুটো সে দু’দিন দিন দুনিয়া ভুলে ঘরবন্দী হয়ে আঁকছিলো। দুটো ছবিই তিথির। তিথি বারান্দায় রেলিংএর দিকে পিছনদিকে হেলে দাঁড়িয়ে আছে চোখ বন্ধ করে। তিথির চুল পেছনদিকে রেলিংএর বাইরে ঝুলছে। বাতাসে নড়ছে। দু’হাত দু’দিকে প্রসারিত। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। ঠিক সেদিন যেভাবে তিথিকে দেখেছিলো, হুবহু সেভাবেই এঁকেছে জাওয়াদ। আরেকটা ছবিতে তিথি ঘুমোচ্ছে কাত হয়ে, গায়ে চাদর জড়ানো। সেদিন খুব কাছ থেকে দেখেছিলো জাওয়াদ তিথিকে। ঠিক সেভাবেই এঁকেছে। তিথির চোখ, নাক, ঠোঁট সবকিছু নিখুঁতভাবে এঁকেছে জাওয়াদ। এগিয়ে গিয়ে আলতো করে ছবিটায় হাত বুলালো জাওয়াদ। তারপর তিথির বৃষ্টিতে ভেজার ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর মুচকি হেসে বললো, ‘তুমি আমার বৃষ্টি বিলাসী। জানো? সেদিন আমার আত্মায় কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলে। বৃষ্টির সাথে তোমার সৌন্দর্য মিলে একাকার হয়ে আমার হৃদয়ে ছুরি চালিয়েছে। সেই ছুরি চালানো ক্ষতটা যে একদম শুকাচ্ছেনা, বরং আরো বিস্তৃত হচ্ছে। বলোতো বৃষ্টি বিলাসী, আমার হৃদয়ের ক্ষত স্থানটা ভরাট করা যায় কীভাবে?’
দরজায় করাঘাতের শব্দে ঘোর কাটে জাওয়াদের। দরজা খুলে দেখলো দুটো টাইগারে বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রিয়াদ। জাওয়াদ দরজা খুলতেই হেসে বললো, ‘শুভ সন্ধ্যা ব্রাদার!’
জাওয়াদ হেসে ফিরতি শুভেচ্ছা জানালো। তারপর বললো, ‘আয় ভেতরে আয়।’
ভেতরে এসেই থমকে দাঁড়ালো রিয়াদ। হাত থেকে টাইগারের বোতল দুটো পড়ে গেল। ত্রস্ত পায়ে ছবি দুটোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো রিয়াদ। জাওয়াদ টাইগারের বোতল দুটো তুলে টেবিলে রেখে রিয়াদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ ছবি দুটোর দিকে তাকিয়ে পেছন ফিরলো রিয়াদ। মুখে তার হাসি, চোখ চিকচিক করছে জলে। সে বললো, ‘তুই ছবি এঁকেছিস!’
জাওয়াদ নিচের দিকে তাকিয়ে হাসলো। রিয়াদ জাওয়াদের কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘তিথির ছবি। তার মানে তুই দু’দিন এটাই করছিলি। আর আমি চিন্তায় ছিলাম হুট করে তোর কী হলো।’
জাওয়াদ মুখ তুলে তাকালো। তার ঠোঁটে হাসি লেগেই আছে। রিয়াদ আবার বললো, ‘ইউ… ইউ আর…’ রিয়াদের গলা কাঁপছে। সে কথা পুরো করতে পারছেনা।
‘আই অ্যাম ইন লাভ ব্রাদার। এগেইন!’ হেসে রিয়াদের কথাটা পুরো করে দিলো জাওয়াদ। হুট করেই রিয়াদ দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো জাওয়াদকে। জাওয়াদও ধরলো। রিয়াদের ভেতরটা যেন ভরে উঠলো খুশিতে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, ‘আমি কিচ্ছু জানিনা। আমি শুধু এটা জানি যে, দু’বছর পর এই মেয়েটা তোর হাতে রঙ তুলি তুলতে বাধ্য করেছে। আমি এটা জানি যে, মাহির শেষ ইচ্ছাটা পূরণ হয়েছে।’
জাওয়াদ রিয়াদকে ছেড়ে দিয়ে মুচকি হাসলো। তারপর তিথির ছবির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তুই কি তিথির চুল দেখেছিস জাওয়াদ?’
‘দেখেছি তো।’
‘উহুম না। খোলা চুল।’
‘উম, না। খুলতে তো দেখলাম না। তবে এই ছবিতে দেখে অবাক হয়েছি। একদম…’
‘একদম মাহির চুলের মতো।’ জাওয়াদ বললো রিয়াদের দিকে তাকিয়ে।
‘হ্যাঁ।’
‘তিথির ঠোঁটের নিচেও তিল আছে। মাহির মতো।’
রিয়াদ হাসলো। বললো, ‘এইবারে আমি মা কে বলবো। দুই ভাইয়ের একই দিনে বিয়ে হবে। উফ, আমিতো…’
রিয়াদকে আঁটকে দিয়ে জাওয়াদ বললো, ‘এতো আগাম ভাবিস কেন তুই?’
‘মানে কী? বলবোনা! উনার ছেলে যে প্রেমে পড়েছে উনার মামণির উপর সেটা বলবোনা?’ অবাক হয়ে বললো রিয়াদ।
‘না বলবিনা। এইটা কাউকে বলবিনা তুই। আমি… আমি ওর মনোভাব জানতে চাই।’ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো জাওয়াদ।
‘তাহলে তুই যে আবার ছবি আঁকলি এটাতো বলতে পারি?’ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় রিয়াদ।
‘এটা বলা যায়।’
রিয়াদ হেসে দিলো। তারপর বিছানায় বসে টাইগারে চুমুক দিয়ে বললো, ‘যাই হোক, পিচ্চিটা কিন্তু প্রচুর ডেঞ্জারাস।’
জাওয়াদ রিয়াদের পাশে এসে বসে। টাইগারের বোতল হাতে নিয়ে বলে, ‘জানি।’ দুই চুমুক দিয়ে আবার বললো, ‘বলেছিলাম ঠাণ্ডা আনার জন্য।’
‘আমি এটাই পেয়েছি।’
তারপর কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। রিয়াদ খাওয়া শেষ করে বললো, ‘এবার? প্লান কী?’
‘কিসের প্লান?’
‘প্রপোজ করবি কবে?’
‘পাগল?’ জাওয়াদের কণ্ঠে জোর। সে আবার বললো, ‘ওসব আমি পারবোনা।’
‘ছবি আঁকলি কেন তাইলে?’
‘ছবি আঁকলাম বলে প্রপোজ করতে হবে?’
‘প্রপোজ না করলে জানবে কেমনে?’
‘মেয়েরা নাকি ছেলেদের চোখে তাকিয়ে সব বুঝে যায়?’
হো হো করে হেসে উঠলো রিয়াদ। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বললো, ‘হাসিস কেন?’
‘তুই প্রেম নিয়ে তাকাস নাকি ওর দিকে? তুই তো চোখে একরাশ ঝগড়া নিয়ে তাকাস।’
‘কই? এই কদিন আমাকে ঝগড়া করতে দেখেছিস? সন্ধিচুক্তি হয়ে গেছে।’
‘কিসের সন্ধিচুক্তি?’
‘সেদিন এসে বলেছে, আর ঝগড়াঝাটি করবেনা।’
রিয়াদ আবার হাসলো জোরে জোরে। এবার হাসতেই থাকলো। জাওয়াদ বালিশ ছুড়ে মারলো রিয়াদের দিকে। রিয়াদ সেটা দুহাতে ধরে কোনোরকম হাসি আঁটকালো। তারপর জোরে জোরে শ্বাস নিলো। কিছুক্ষণ চুপ করে জিরিয়ে নিলো। তারপর বললো, ‘কাল নানুবাড়ি যাবো।’
‘বল শ্বশুরবাড়ি যাবো।’ হেসে বললো জাওয়াদ।
‘ধুর। সেটা তো হওয়ার পরে।’
‘কখন যাবি?’
‘কখন যাবি মানে? আমরা সবাই যাবো।’
‘সবাই? আমিও?’
‘তুইও।’
জাওয়াদ হেসে দিলো। বললো, ‘আমি যাবো এটা কে বললো তোকে?’
‘আমি বলেছি। যাবিনা?’
‘কেন যাবোনা তুই জানিস।’
রিয়াদ নড়েচড়ে বসলো। তারপর জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘একজনের জন্য তুই ঐ বাড়ির সবকটা মানুষের সাথে এমন করতে পারিসনা জাওয়াদ। দু’বছর থেকে যাসনা। প্রতিবার এইভাবে মানা করে দেস। তাছাড়া, প্রতিবার নানু আক্ষেপ করেন। এবার অন্তত আয় জাওয়াদ। ঐ বাড়িটা তোর ভাইর শ্বশুরবাড়ি হতে যাচ্ছে।’
‘নানুকে এবার আসার সময় জোর করে নিয়ে আসিস।’ দায়সারাভাবে বললো জাওয়াদ।
‘কাজ হবেনা। জানিসই তুই না গেলে নানু আর আসবেনা।’
‘রিয়াদ প্লিজ…’
‘তিথিও যাবে।’
থমকে গেল জাওয়াদ। ঢোঁক গিলে বললো, ‘এসব বলে আমাকে ওখানে নিতে চাইছিস তুই? আমি যাবোনা রিয়াদ। ঐ মেয়েটাকে দেখলে আমার মগজে রক্ত উঠেযায়।’
‘মেয়েটাকে দেখবিনা। তিথিকে দেখবি। চলে আয় জাওয়াদ!’
জাওয়াদ চুপ করে বসে থাকলো। রিয়াদ আবার বললো, ‘প্লিজ ভাই। নানু অনেক আফসোস করেছেন আজ ফোন করে। খুউউব কেঁদেছেন।’
‘ওকে ফাইন। যাবো। শুধুমাত্র নানুর জন্য।’
হাসলো রিয়াদ। একটু টেনে টেনে বললো, ‘নানুর জন্য?’
জাওয়াদ চোখ রাঙায়। রিয়াদ হেসে উঠে দাঁড়ায় বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। দরজার কাছে যেতেই জাওয়াদ পিছু ডাকে। রিয়াদ ফিরে তাকায়। জাওয়াদ বলে, ‘সেদিন তুই-ই অন্তুকে বেধম পিটিয়েছিলি। তাইনা রিয়াদ?’
চমকে ওঠে রিয়াদ। জাওয়াদের দিকে তাকাতে পারেনা। নিচের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কিসের পেটানো? কী বলছিস?’
‘ভেরি বেড এক্টিং রিয়াদ। বাই দ্য ওয়ে, দরজা লাগিয়ে যাস।’
তাড়াতাড়ি দরজা লাগিয়ে বেরিয়ে গেল রিয়াদ। ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে অস্বস্তি লাগছিল তার। রিয়াদ বেরিয়ে যেতেই হেসে দিলো জাওয়াদ। তারপর তিথির ছবিগুলোর দিকে তাকালো। উঠে গিয়ে খুব সাবধানে সেগুলো আলমারিতে তুলে রাখলো। তারপর মাহির ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ছবির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘পা মাড়াচ্ছি আবারও। নতুন অনুভূতি নিয়ে, পুরোনো স্মৃতির সাথে নতুনের সংমিশ্রণ করতে।’
________________
খাবার টেবিলে বসেই হেলাল আহমেদ প্রশ্ন করলেন, ‘তিথি মা কোথায়? আর জাওয়াদও তো আসলোনা।’
মুনতাহা বললেন, ‘তোমার ছেলে দু’দিন পরপর কী শুরু করে। এখন তো সারাদিন দরজা লাগিয়ে থাকে। ছেলেটার কী যে হলো!’
‘উফ মা, এতো চিন্তা করছো কেন তুমি? জাওয়াদ ছবি আঁকায় ব্যস্ত ছিলো।’ বললো রিয়াদ।
‘মানে!’ আদিয়া একপ্রকার চিৎকার করে উঠলো। মুনতাহা এতোই অবাক হলেন যে কিছু বলতে পারলেন না। হেলাল আহমেদ ও অবাক হলেন। রিয়াদ আদিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘চিক্কুর দিস কেন? ছবি আঁকতেই পারে।’
হেলাল আহমেদ বললেন, ‘তুই সত্যি বলছিস?’ উনার গলা কাঁপছে। মুনতাহা তো কেঁদেই দিয়েছেন। রিয়াদ উঠে এসে মুনতাহার চোখের পানি মুছে দিয়ে মাথায় হাত রেখে বললো, ‘মা, এইটা শুরু। তোমার ছেলে আবার আগের মতো হয়ে যাবে তুমি দেখো। একটু সময় দাও।’
আদিয়া কিছু বলছেনা। সে হাসছে মিটিমিটি। সে হয়তো বুঝে গেছে কিছু। মুনতাহা চোখ মুছে হেলাল আহমেদ এর দিকে তাকালেন। হেলাল আহমেদ হাসলেন নিচের দিকে তাকিয়ে। মুনতাহা হাঁক ছাড়লেন, ‘টুনি, যা তো জাওয়াদকে বল খেতে আসতে। তিথিকেও বলিস।’
_______________
তিথি রুম থেকে বেরিয়েই দেখে টুনি জাওয়াদের ঘরের দিকে যাচ্ছে। সে টুনিকে ডাকলো। টুনি এসে তার সামনে দাঁড়াতেই জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় যাচ্ছো?’
‘বড় ভাইজান রে খাওনের জন্য ডাকতে। আপনেরেও ডাকে, খাইতে আহেন।’
‘আচ্ছা আমি উনাকে ডাকছি। তুমি যাও।’
‘আইচ্ছা। জলদি আহেন। সবাই হোয়াইট করতেছে।’
‘হোয়াইট?’ ভ্রু কুঁচকায় তিথি।
টুনি মাথায় হাত দিয়ে বললো, ‘ইশ আফা, ইংরিজি বুঝেন না? অপেক্ষা অপেক্ষা।’
‘ওহ আচ্ছা।’ হেসে দিলো তিথি। ওয়েট কে হোয়াইট বানিয়ে দিয়েছে টুনি। সে হেসে বললো, ‘আসছি। যাও।’
টুনি চলে গেল। তিথি পা বাড়ালো জাওয়াদের ঘরের দিকে। জাওয়াদের ঘরে গিয়ে দেখলো একটা হলুদ ডিম লাইট জ্বলছে। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো জাওয়াদ নেই। কোথায় গেল? নিশ্চয়ই বারান্দাতে। তিথি বারান্দায় গিয়ে উঁকি দিতে নিলো, তখনই কেউ ওর হাত ধরে টান দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। ধাতস্থ হতেই হলুদাভ আলোতে খেয়াল করলো সে জাওয়াদের বুকে। জাওয়াদের এক হাত তার কোমরে আর এক হাতে মুখ চেপে ধরে আছে। চোখ দুটো বড় হয়ে গেল তার। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটা শুরু হলো। নিশ্বাস যেন এক্ষুণি বন্ধ হয়ে যাবে এমন অবস্থা। হলুদাভ আলোয় জাওয়াদকে এতো কাছ থেকে দেখে যেনো শরীর অবশ হয়ে আসতে চাইলো তার। তিথি নড়ছেও না। রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছে। জাওয়াদ ফিসফিস করে বললো, ‘প্রথমত, ঘুরেএ দাঁড়িয়ে আমাকে দেখলেও ভয় পেয়ে সেদিনের মতো পড়ে যেতে নিতে। তাই এভাবে আগেই ধরে রাখলাম। দ্বিতীয়ত, হুট করে আমাকে দেখে চিৎকারও দিতে পারতে তুমি, তাই সেফটির জন্য মুখ চেপে ধরলাম। এবার বলো, আমার ঘরে কেন?’
তিথি মুর্তির মতো তাকিয়ে আছে জাওয়াদের দিকে। তার যেন শরীরে শক্তি নেই একদম। বরফ হয়ে জমে গেছে সে। যতবারই মনে হচ্ছে তার কোমরে জাওয়াদের হাত, ততবারই যেন শরীর ভেঙ্গে অবশ হয়ে পড়ছে। সে কোনোমতে কিছু একটা বললো, কিন্তু কথাটা চাপা পড়ে গেল। জাওয়াদ বুঝলোনা। পরক্ষণেই মনে হলো সে তো তিথির মুখ চেপে ধরেছে। ছেড়ে দিলো তিথির মুখ। ফোঁৎ করে নিশ্বাস ছাড়লো তিথি। তারপর দুর্বল শরীরে জাওয়াদের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য খানিক শক্তি প্রয়োগ করে জাওয়াদকে সরানোর জন্য ধাক্কা দিল। কিন্তু জাওয়াদ তাকে ছাড়ার বদলে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। হলুদাভ আলোয় সেই ভ্রু কুঁচকে তাকানোটা যেন তিথির বুকে গিয়ে লাগলো। হায় আল্লাহ! এভাবে মাথাটা ঘুরছে কেন!
‘আ-আপ-আপনাকে খেতে ডাক-ডাকছে।’
জাওয়াদ তিথিকে ছেড়ে দিয়ে বললো, ‘তাই বলো।’ বলেই হেটে চলে গেল। দরজার কাছে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর পেছন ফিরে বললো, ‘বাই দ্য ওয়ে। তোমার কোমর আসলেই পাতলা। ঠিকমতো খাবারদাবার খেও।’ বলেই বেরিয়ে গেল জাওয়াদ। তার ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি। কথাটা কানে আসতেই ধুপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো তিথি। তার পুরো শরীর তিরতির করে কাঁপছে। বুক করছে ধড়ফড়। সে দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে রইলো। এতো কাছে এসে যেনো সবকিছু এলোমেলো লাগছে তার।
__________
চলবে…….
@ফারজানা আহমেদ
রঙ তুলির প্রেয়সী
১৪.
‘ফাহি, ও ফাহি, এদিকে আয় তাড়াতাড়ি আয়। হ্যারে এতোদিন পরে বুঝি আমার নাতিটার অভিমান ভাঙ্গলো রে! ও বড় বৌমা, আরে কই গেলে তোমরা?’ হাঁক ছাড়লেন চাঁনতারা বেগম। মুখ তাঁর উজ্জ্বল। চোখ চিকচিক করছে খুশির অশ্রুতে। যেনো এক্ষুণি টুপ করে পড়বে গাল বেয়ে। শাড়ির আঁচলে সাবধানে চোখ মুছে নিলেন।
‘নানু, এভাবে চিল্লাতে তোমাকে কতোবার মানা করেছি বলোতো! এমন করলে শরীরের ক্ষতি হবে।’ চায়ের কাপটা বিছানার পাশে টুলের ওপর রেখে বললো নুহা।
‘আরে আমার তো ইচ্ছে করছে লাফিয়ে লাফিয়ে নাচি। সেই শক্তি তো আর শরীরে নেই।’ উল্লাসে ফেটে পড়ে বললেন চাঁনতারা বেগম।
‘কী এমন হয়েছে শুনি? আর আমার মোবাইলটা কই রাখলা দাদু?’ রুমে ঢুকেই এদিক ওদিক নিজের মোবাইল খুঁজতে লাগলো ফাহি।
‘তোর মোবাইল নানুর হাতে।’ বললো নুহা। ফাহি চাঁনতারা বেগমের হাত থেকে মোবাইল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ব্যাপার কী?’
চাঁনতারা বেগম ফাহির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যা তো, বেশি করে তুঁতফল পেড়ে নিয়ে আসবি। কাঁচাগুলো ঝাল দিয়ে চাটনি করবি। ধনেপাতা দিবি। আদিয়া বলে দিয়েছে এমন করে রাখতে। আর পাকাগুলো আলাদা রাখবি। আমার জাওয়াদ খুব পছন্দ করে পাকা তুঁতফল।’
জাওয়াদের নাম শুনতেই চমকে উঠলো নুহা। সে জিজ্ঞেস করলো, ‘যাওয়ার সময় সাথে নিয়ে যাবে? তাহলে হালকা পাকা যেগুলো সেগুলো গাছেই থাকুক। ওরা তো থাকবে আজকে সবাই। যাওয়ার সময় পাড়া যাবে। তখন পেকেও যাবে।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ। নুহা আপু ঠিক বলেছে।’ হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলালো ফাহি।
‘বেশি কথা বলিস কেন? যাওয়ার সময় তো নিয়ে যাবেই। এখন এসে খাবে না? আমি সেজন্যেই পাড়তে বলেছি।’ বলে উঠে দাঁড়ালেন চাঁনতারা বেগম। তারপর টুলের ওপর থেকে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললেন, ‘দুটোতে মিলে গল্পে লাগাইলি আমাকে। চা টা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। যাই তো একটু রান্নাঘরে। চা ও গরম করে দিতে বলবো।’
‘কিন্তু দাদু জাওয়াদ ভাইয়া তো আ…’
ফাহিকে থামিয়ে দিয়ে চাঁনতারা বেগম হেসে বললেন, ‘আসবে আসবে। জাওয়াদ আসবে। এক্ষুণি আমাকে রিয়াদ বললো। যাই যাই, আমি গিয়ে বলি পাটপাতা চাটনি আর কাঠাল বিচির ভর্তা করে রাখতে। আমার জাওয়াদটা কতো পছন্দ করে!’ বলে বেরিয়ে গেলেন উনি। উনি বেরিয়ে যেতেই ফাহি বললো, ‘নুহাপু! শুনলে তুমি? জাওয়াদ ভাইয়া আসবে! কত্তোদিন পর আমরা সব কাজিনসরা একসাথে হবো!’
নুহা যেন খানিক স্তব্ধ হলো। তার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছেনা জাওয়াদ আসবে। জাওয়াদ সত্যিই আসবে? সে একবার তাকালো ফাহির দিকে। ফাহি হাসছে। হেসে দিলো নুহাও। কেমন যেন কান্না পেয়ে যাচ্ছিলো তার। কতোদিন… কতো কতো দিন পর দেখতে পাবে সে জাওয়াদকে…
_________________________
একটা গাড়িতে টুনি, হেলাল আহমেদ আর মুনতাহা যাচ্ছেন। আরেকটা গাড়িতে জাওয়াদ, রিয়াদ, আদিয়া আর তিথি। গাড়ি চলছিলো। হেলাল আহমেদ ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসেছিলেন। পেছনে মুনতাহা আর টুনি। হেলাল আহমেদ ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে বললেন, ‘জাওয়াদকে কীভাবে রাজি করালে?’
মুনতাহা বললেন, ‘আমি কিছুই করিনি। আমি তো ভেবেছিলাম বরাবরের মতোই তোমার ছেলে আসছেনা। আমিতো একটু আগেই দেখলাম গাড়িতে উঠছে। যা করার রিয়াদই করেছে।’
‘তাই বলো। যাই হোক, অনেকদিন পরে সবাই একসাথে যাচ্ছি। ভালো লাগছে খুব।’
মুনতাহা কিছু বললেন না। সিটে হেলান দিয়ে বসলেন। পাশে বসা টুনি খানিকক্ষণ পরপর জানালার দিকে মুখ করে ওড়নায় মুখ চেপে হাসছে। তার কারণ হচ্ছে সামনে বসা ড্রাইভার আব্দুল লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে চোখ টিপ দিয়েছে ওকে। টুনির এই বারবার হাসি নজর এড়ালোনা মুনতাহার। তিনি একবার ওর দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকালেন। টুনি ঘাড় ঘুরাতেই দেখে মুনতাহা কপাল কুঁচকে দেখছেন তাকে। সে চট করে আবার জানালার দিকে তাকালো। তার বুকটা দুরুদুরু করছে।
তিথি ডানদিকে বাকা হয়ে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। এক সেকেন্ডের জন্যও সে সোজা হয়ে বসতে পারছেনা। কারণ ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে জাওয়াদ বসে আছে। লুকিং গ্লাসটা একেবারে নিজের দিকে দিয়ে রেখেছে। সোজা হয়ে বসলেই লুকিং গ্লাসে জাওয়াদের মুখ দেখা যাচ্ছে। তিথি ডানদিকে বসার কারণে জাওয়াদের ডানদিকের সাইডও দেখা যাচ্ছে। জাওয়াদ একটু মাথা নাড়ালেই তিথির চোখে চোখ পড়ছে। মহা মুশকিল হয়েছে, এদিকে একসাইড হয়ে বসতে বসতে ডান হাতটায় চাপ লাগছে, কোমরেও খানিক ব্যথা করছে। হঠাৎ পাশ থেকে আদিয়া বলে উঠলো, ‘এই তিথি, এভাবে বসেছিস কেন? এদিকে ফিরে বস গল্প করি।’
আস্তে আস্তে সোজা হয়ে বসলো তিথি। বসতেই চোখ পড়লো সামনে আর সেই একই অবস্থা! দেখলো জাওয়াদকে। সমস্যা হচ্ছে জাওয়াদকে দেখলে চোখ ফেরাতে পারছেনা তিথি। হালকা নীল রঙের একটা টি-শার্ট পরেছে সে। এই একেবারে নরমাল ড্রেসআপেও চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে তিথির ওর দিকে তাকালেই। আরো বেশি লজ্জা লাগছে তিথির কারণ সেও একইরকম নীল রঙের টপস পরেছে। যদিও এখানে লজ্জা লাগার কিছু নেই তারপরেও তিথির খুব লজ্জা লাগছে। হঠাৎ করে তিথির কী হয়ে গেল, জাওয়াদের দিকে তাকালেই দুনিয়ার সব লজ্জা এসে তার ওপর ভর করে। এমন কেন হচ্ছে সে জানেনা। রিয়াদ ড্রাইভ করছিলো। সে বললো, ‘তিথি কিছু খাবে? চকলেট বা আইসক্রিম?’
‘ন-না ভাইয়া, লাগবেনা কিছু।’ মিনমিন করে বললো তিথি।
আদিয়া বললো, ‘এই আসার সময় না বললি আইসক্রিম খাবি?’
এটা শোনার সাথেসাথে পেছনে ফিরে তাকালো জাওয়াদ। তিথির চোখে চোখ পড়লো। তিথির যেন একটুর জন্য মনে হলো নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। সে চোখ ফিরিয়ে আদিয়াকে বললো, ‘না এখন লাগবেনা।’
‘একটু বনফুলেরর সামনে ব্রেক করিসতো রিয়াদ।’ জাওয়াদ রিয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো। তারপর পেছনে ফিরে আদিয়াকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোন ফ্লেভার?’
আদিয়া খুশি হয়ে বললো, ‘চকলেট চকলেট।’
তিথি জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। জাওয়াদ তিথির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তিথি তুমি কোন ফ্লেভার খাবে?’
এই প্রথম জাওয়াদের মুখে নিজের নাম শুনে চমকে উঠলো তিথি। মেরুদণ্ডে যেনো এক শীতল বাতাসের ঝাপটা লাগলো। কানের মাঝে বাজতে লাগলো জাওয়াদের বলা লাইনটা, ‘তিথি তুমি কোন ফ্লেভার খাবে? তিথি তুমি কোন ফ্লেভার খাবে? তিথি তুমি কোন ফ্লেভার খাবে?…’
‘তিথি…’ আবার ডাকলো জাওয়াদ। হুঁশ হলো তিথির। সে বললো, ‘হ-হ্যাঁ!’
জাওয়াদ বললো, ‘বললেনা কোন ফ্লেভার?’
‘চ-চকলেট…’
‘কুল।’
বনফুলের সামনে গাড়ি থামালো রিয়াদ। জাওয়াদ নেমে গিয়ে তিনটা আইসক্রিম কিনে আনলো। এসে গাড়িতে বসে পেছনে আদিয়ার হাতে দুইটা দিলো। আর একটা সে নিজের হাতে রাখলো। রিয়াদ গাড়ি স্টার্ট দিলো। তিথি আইসক্রিমটা হাতে নিয়ে বসে থাকলো। আস্তে আস্তে আঙ্গুল বুলালো। একটু আগে এই আইসক্রিমটা জাওয়াদের হাতে ছিলো। জাওয়াদের হাতের ছোঁয়া আছে এটাতে। আনমনে হাসলো তিথি। আইসক্রিম খেতে খেতে সামনে তাকাতেই দেখে জাওয়াদ লুকিং গ্লাসে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নিজে একটু আইসক্রিম খাচ্ছে, তারপর হাত বাড়িয়ে রিয়াদকে খাইয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তাকিয়ে আছে লুকিং গ্লাসে তিথির দিকে। তিথির কেমন লাগলো। সে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে জানালার বাইরে তাকালো। কিছুক্ষণ পর আইসক্রিম শেষ করে আবার সামনে তাকাতেই দেখে জাওয়াদ তাকিয়ে আছে। আশ্চর্য! এভাবে তাকাচ্ছে কেন? তিথির খুব অস্বস্তি হচ্ছে। সে নড়েচড়ে বসলো। এখনও জাওয়াদ তাকিয়ে আছে। নির্নিমেষ! তিথি একটু ভ্রু উঁচিয়ে ইশারা করলো, সাথেসাথে জাওয়াদ খুব অদ্ভুত ভাবে একটা হাসি দিলো চোখ ছোট ছোট করে। সেই হাসিতে কী ছিলো তিথি জানেনা। কিন্তু সেই হাসিটা দেখামাত্রই মনে হলো যেন তিথির বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠলো। তিথি সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত আর চোখ খুলবেনা সে… একদম না…
_________
চলবে……….