#তুমি_তাই,০৯,১০
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৯
আজকে একসপ্তাহ বাদে অফিসে জয়েন করেছে নিলি। শরীর এখনো ভীষণ দুর্বল। কাজে যোগ দিতে একদম মন চাইছিলো না। কিন্তু উপায় নেই। রেজোয়ান সাফ জানিয়ে দিয়েছে ছুটিতে থাকাকালীন সময় বেতন কাটা হবে। তাই বাধ্য হয়ে অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজে জয়েন দিয়েছে। এদিকে নিজামউদ্দিন সাহেবের অবস্থাও খুব বেশি ভালো নয়। শ্বাসের টান বেড়েছে। নিলির ভাগ্য ভালো সে, জেলে থাকাকালীন পাশের কিছু প্রতিবেশী উনার দেখাশোনা করেছেন। নইলে জেল থেকে বেরিয়ে বাবার মুখ আর দেখা হতো না নিলির।
ইনফরমেশন লিকের আসল সত্যিটা বের হয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু নিলির প্রতি অফিসের কলিগদের আচরণের কোন পরিবর্তন হয় নি। একে তো নিম্ন পদমর্যাদার কর্মচারী তার ওপর কলিগদের অবস্থা এমন যেন জেল থেকে বেরিয়ে কোন ঘৃণিত কাজ করে ফিরে এসেছে সে।
★
দুপুরের দিকে নিজের ডেস্কে বসে কাজ করছিলো নিলি। লাঞ্চের একটু আগে একজন সিনিয়র অফিসার, এসে নিজের তিনখানা ফাইল ধরিয়ে দিলেন ডেটা চেক করার জন্য। ফাইল টেবিলের ওপর রেখে তিনি বেরিয়ে গেলেন লাঞ্চ করতে। তিনি বেরিয়ে গেলে তাঁর পাশের দুজন মিলে নিলিকে পাঠালেন চা করে আনার জন্য।
নিলির আত্মসম্মানে লাগলো খানিকটা। এরা চাকর বাকরের মতন ট্রিট করছে নিলির সঙ্গে। অথচ এই কয়বছরে সে কষ্ট করেছে ঠিকই কিন্তু কখনো কারো কাছে হাত পাতে নি। আত্মসম্মান নিয়েই চলেছে।
তথাপি প্রতিবাদ করলো না। চাকরীটা এখন তাঁর একমাত্র সম্বল। চুপচাপ চা এনে দিয়ে নিজের কাজে মনযোগ দিলো। তাঁকে প্রতিবাদ না করতে দেখে পেছন থেকে একজন শিষ বাজালো। আরেকজন কমেন্ট ছুঁড়ে দিলো জেল খাটা আসামীর সঙ্গে ডেস্ক শেয়ার করতে পারবে না তাঁরা। প্রয়োজনে এই নিয়ে রেজোয়ানের সঙ্গে কথা বলবে।
নিলি শুনেও না শোনার ভান করে রইলো। কিন্তু থেমে রইলো রইলো কমেন্টকারী। নিলির জেলে যাওয়ার প্রসঙ্গ নিয়ে বেশ রসাত্মক গল্প শুরু করে দিলো অফিসের সবার সঙ্গে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব শুনতে ভালো লাগছিলো না নিলির। ফ্রেশ হওয়ার বাহানায় ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।
রেজোয়ানের সঙ্গে রেজা গ্রুপের একটা মিটিং শেষ করে সবে অফিসে ঢুকছিলো জাহিদ। ভেতরে ঢুকতেই কলিগদের কথোপকথন কানে এলো। নিলিকে হাসিঠাট্টা করছে সবাই। এগিয়ে এলো সে। গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে? তাঁকে দেখে গুঞ্জন থেমে গেলো। কেউ কেউ আবার মুখ টিপে হাসা শুরু করলো। বলা বাহুল্য, নিলির প্রতি সিমপ্যাথি থাকার কারণে অফিসের সবাই ইদানীং তাঁকে নিয়েও ঠাট্টামশকরা শুরু করে দিয়েছে।
তাঁকে উদ্দেশ্যে একজন নিচুস্বরে ফিসফিস করে বললো,’ঐ যে এসে গেছে। চোরের সাক্ষী কোতোয়াল!’
কথাটা কানে এলো জাহিদের। রেগে যাওয়ার পরিবর্তে উলটে মুচকি হাসলো সে। কমেন্ট কারীর উদ্দেশ্য করে বার তিনেক তুড়ি বাজিয়ে বললো,’মি.হাসান? কি মনে হয় আপনার? আমি বোকা? স্যারের পার্সনাল সেক্রেটারি হয়ে কেন একজন সামান্য ক্লার্কের পক্ষ নিয়ে কথা বলছি? তাহলে শুনুন মি.হাসান। আপনি ভুল ভাবছেন। আমি আপনাদের বোকা নই। আমি ভাল করেই জানি কোথায় কি করতে হয়। ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, একটা কথা আপনাদের সবাইকে জানিয়ে রাখি , বস কিন্তু কাউকে ছাড়বে না। যারা যারা উনার সঙ্গে মিস বিহেভ করছেন, ইচ অ্যান্ড এভ্রি পার্সনকে টার্গেট করে রেখেছেন বস। সময়মত ঠিক বুঝতে পারবেন।’
তাঁর কথা শুনে দপ করে নিভে গেলো প্রত্যেক হাস্যরত ব্যক্তির চেহারা। অবাক, বিস্মিত চাহনি নিয়ে চেয়ে রইলো জাহিদের দিকে। জাহিদ তাদেরকে কোন প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে ভেতরে চলে গেলো। এরপরেও যদি এরা সাবধান না হয় তাহলে আর কিছুই করার নেই তাঁর।
★
জাহিদ আসার ঘন্টাখানেক বাদে অফিসে এসে ঢুকলো রেজোয়ান। রেজা গ্রুপের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের টাকাটা আদায় করে নিয়েছে সে। ভেতরে ঢুকেই জাহিদকে খবর পাঠালো নিলিকে ডেকে আনার জন্য।
রেজোয়ান ডাকছে নিলির পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। আজকে আবার কি ঘটেছে! রেজোয়ান এসেই তাঁর খোঁজ করছে? মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করলো অন্তত আজকের দিনে যেন কোন খারাপ খবর শুনতে না হয়। এমনিতেই শরীর ভালো নেই। তারওপর কোন দুঃসংবাদ সহ্য হবে না। মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।
ভয়ে ভয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাইলো সে। রেজোয়ান লাঞ্চ করছে। হাত ইশারায় ভেতরে ঢুকতে বললো।
ভেতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে রইলো নিলি। রেজোয়ান তাঁকে বসতে বললো না। নিলিকে দাঁড় করিয়েই লাঞ্চ শেষ করলো। খাওয়া শেষে টিস্যু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বললো,’আজিজের ব্যাপারে ইনভেস্টিগেশনের জন্য পুলিশ আপনার বাসায় যেতে পারে কিংবা অফিসেও আসতে পারে। আমি আশা করবো আপনি তাদের কোন রং ইনফরমেশন দেবেন না।’
নিলি দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। এরমানে কোনরকম রং ইনফরমেশন দেবে না সে।
-‘আজ অথবা কাল এই দুদিনের ভেতরই আসবে। কোনো প্রশ্নের উত্তর গুছিয়ে বলতে না পারলে জাহিদকে জিজ্ঞাসা করে নেবেন। উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করলে উত্তর দেওয়ার দরকার নেই।’
-‘ঠিক আছে।’
-‘শুনুন?’
-‘জি?’
-‘যা-ই বলবেন না কেন কম্পানীর সম্মানের বিষয়টা অবশ্যই মাথায় রাখবেন।’
আবারো মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালো নিলি। রেজোয়ানের একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলো। হাত দুটো চেপে ধরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে নিলি। সেদিনের পর থেকে রেজোয়ানকে অসম্ভব ভয় পায় সে। তাঁর বুঝতে বাকি নেই, যতই কান্নাকাটি,যতই ক্ষমাপ্রার্থনা করুক না কেন তাঁকে কষ্ট দেওয়ার কোন সুযোগ হাতছাড়া করবে না রেজোয়ান। নিলিকে মনে প্রাণে ঘৃণা করে সে।
কিন্তু সত্যি কি তাই? সত্যিই কি নিলিকে ঘৃণা করে রেজোয়ান? নাকি জোর করে ঘৃণা করতে চাইছে? ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
ভুলটা সেদিনই করে ফেলেছে রেজোয়ান। নিলিকে চাকরীটা দেওয়া মোটেও উচিত হয় নি। এখন না চাইতেও মন বারবার এই লোভী, স্বার্থপর মেয়েটার কথাই ভাবছে। নিজেকে সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ছে।
★
ঘড়ির কাঁটায় টিকটিক! নিলির বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটাচ্ছে। রেজোয়ান তাঁর একেবারে মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।
তাঁর প্রতিটা নিশ্বাস গুনতে পারছে নিলি। পারফিউমের গন্ধ অনুভব করতে পারছে।
রেজোয়ান জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজালো। আচ্ছন্ন গলায় বললো,’আই হ্যাভ অ্যান অফার ফর ইউ?’
ভয়ে,অস্বস্তিতে কথা বলতে পারলো না নিলি। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। রেজোয়ান তাঁর আপাদমস্তক একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বললো,’ইউ ক্যান সার্ভ মি। পার নাইট টুয়েন্টি থাউজেন্ড!’
অপমানে রক্ত সরে নিলির মুখ থেকে। বিস্ময়ে চক্ষু কোটরাগত! রেজোয়ান সেসব পাত্তা না দিয়ে নতুন করে যোগ করলো,’ডোন্ট ওরি। ইট’স আ ডিল। নো ইমোশনাল এ্যাটাচমেন্ট!’
ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো নিলি। এতবড় অপমান সহ্য করার ক্ষমতা তাঁর নেই। নিজেকে শান্ত করার যথাসম্ভব চেষ্টা করে বললো,’আর কত অপমান করবে? আর কত অপমান করলে শান্তি হবে তোমার?’
তাঁর চোখের পানি রেজোয়ানের মুখের হাসি কেড়ে নিলো। কিন্তু প্রকাশ করলো না। বুক ভর্তি হাহাকার নিয়ে কৃত্রিম হেসে বললো,’তুমি আমাকে যেই আঘাত দিয়েছো তাঁর কাছে এইসব অপমান কিছুই না মিসেস মুবিন তালুকদার। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে তোমার গলাটা টিপে ধরে কলিজটা ছিঁড়ে নিতো। আর না হলে প্রথমদিনই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে অফিস থেকে বের করে দিতো।’
এত ঘৃণা আর সহ্য করতে পারছিলো না নিলি। বিনাদোষে এতগুলো দিন সাজা ভোগ করেছে। তবুও নিজেকে সঠিক প্রমাণ করার কোন চেষ্টা করে নি। কারণ তাঁর মনে হয়েছে যার ভালোবাসা যত বেশি তাঁর ঘৃণার পরিমাণও ততো বেশি। কিন্তু আজকে আর পারলো না। রেজোয়ান ঘৃণার মাত্রাটা দিনদিন বাড়ছে।
চোখভর্তি পানি নিয়ে বললো,’তোমার কি সত্যিই মনে হয় আমি টাকার জন্য মুবিনকে বিয়ে করেছিলাম?’.
-‘করো নি?’, অবাক হওয়ার ভান করলো রেজোয়ান। তাঁর চোখেমুখে তিরস্কার।
-‘ওরা তোমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিলো।’, বলতেই বলতেই নিলি কেঁদে ফেললো।
কিছুক্ষণের জন্য বাক্যহারা হয়ে গেলো রেজোয়ান! কি বলছে নিলি! তবে কি তাঁর ধারণা ভুল?
না মিথ্যে বলছে নিলি। টাকার জন্যই রেজোয়ানকে ছেড়ে গিয়েছিলো সে। নিজেকে সামলে নিয়ে বরফ শীতল কন্ঠে বললো,’সেটা তুমি আমাকে এতদিন পরে জানানোর প্রয়োজন মনে করলে? কেন?’
নিলি জবাব দিলো না। রেজোয়ান ফের ঠাট্টার সুরে বললো,’দয়া করে এসব কান্নাকাটির ড্রামা বন্ধ করো প্লিজ। বিপদে পড়ে এখন নিজের দোষ কাটাতে চাইছো তো? কোন লাভ নেই। তোমাকে আমি চিনে গেছি। এরবেশি চেনার রুচি আর নেই।’
নিলি আর টু শব্দটি পর্যন্ত করলো না। নির্বাক দৃষ্টিতে রেজোয়ানের দিকে চেয়ে থেকে মলিন হাসলো। ঠোঁট কামড়ে কান্না চাপার চেষ্টা করে,’তুমি প্রয়োজনের চাইতে সত্যিই অনেক বেশি চিনে গেছো আমাকে রেজোয়ান। এতটা না চিনলেই বোধহয় ভালো হতো।’
-‘রেজোয়ান? হোয়াই আর ইউ কলিং মি উইথ মাই নেইম? হোয়াট ডু ইউ থিংক? ইউ ক্যান কল ইউর বস উইথ হিজ নেইম?’
-‘সরি।’
অনুমতির অপেক্ষা করলো না নিলি। বেরিয়ে গেলো। সে যাওয়ার সময় রেজোয়ান পুনরায় চেঁচিয়ে উঠে জানালো তাঁর কাছ থেকে অনুমতি না নিয়ে ভুল করেছে নিলি। রেজোয়ানের সঙ্গে রাগ দেখানোর কোন অধিকার তাঁর নেই। সে যেন নিজের বিহেভিয়ার কন্ট্রোলে রাখে।
কিন্তু নিলি বেরিয়ে যাওয়ার আধঘন্টা বাদেই দিনের সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনাটা ঘটলো রেজোয়ানের সঙ্গে। জাহিদের হাতে করে রেজিগনেশন লেটার পাঠিয়ে দিয়েছে নিলি। সেটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে জাহিদের দিকে চেয়ে রইলো রেজোয়ান। একেবারে ব্ল্যাংক রিয়েকশন দিয়ে গম্ভীরমুখে বললো,’তাঁকে ডাকো।’
-‘উনি বেরিয়ে গেছেন স্যার। যাওয়ার সময় আমার হাতে এটা দিয়ে গেছেন।’
চোখ বন্ধ করে বড় নিশ্বাস ছাড়লো রেজোয়ান। মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিলো। ভালো হয়েছে নিলি চাকরী চেয়ে দিয়েছে। এখন আর তাঁর সঙ্গে দেখা হবে না রেজোয়ানের।
কিন্তু মন থেকে খটকা দূর করতে পারলো না। এত দিনের এত অপমান, এত লাঞ্ছনা সব সহ্য করে অফিসে কাজ করে গেছে নিলি। কোনদিন কোন প্রতিবাদ করে নি। কিন্তু আজকে হঠাৎ এমন কি হলো যে তাঁর দুটো কথাতে সে চাকরী ছেড়ে দেওয়ার মত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো? তবে কি নিলির সত্যিই কোন দোষ ছিলো না? রেজিগনেশন লেটারটা টেবিলের ওপর রেখে গম্ভীর মুখে বসে রইলো সে। অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়।
এতদিন ভালোবাসার মানুষের সমস্ত অপমান মুখ বুজে সহ্য করেছে নিলি। কিন্তু ভালোবাসার মানুষের অপমান সহ্য করা গেলেও ভালোবাসা নিয়ে অপমান সহ্য করা যায় না। রেজোয়ান আজকে তাঁর ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, সব শুনেও তাঁর ভালোবাসাকে অপমান করেছে।
একমূহূর্তেই নিজের দৈন্যদশার কথা ভুলে গিয়ে চাকরী ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো নিলি। ভুলে গেলো এই চাকরীটা ছাড়া তাঁর অসুস্থ বাবার মুখে খাবার জুটবে না। রেজিগনেশন লেটারটা জাহিদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে শূন্য হাতে অফিস ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
#তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১০
নিলির বিষয়ে সব তথ্য বের করার দায়িত্ব জাহিদের ওপর দিয়েছ ছিলো রেজোয়ান। আশানুরূপ অনেক কিছুই বের করেছে জাহিদ। এই যেমন, নিলির স্বামী মুবিন মারা যাওয়ার পর তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজন সম্পত্তি বিক্রি করে দেশের বাইরে সেটেল হয়ে গেছে, তাদের সঙ্গে এখন আর নিলির কোন যোগাযোগ নেই, তিনবছর আগে পুলিশের গুলিতে নিলির ভাই নিহত হয়েছে ইত্যাদি নানারকম খোঁজখবর।
তাঁর মুখ থেকে সব শুনে গম্ভীর মুখে বসে রইলো রেজোয়ান। নিলি যে আর্থিক সংকটে আছে সেটা ও আগেই বুঝতে পেরেছিলো। এমনি এমনি তো আর তাঁর অফিসে চাকরী করতে আসে নি? তাও আবার সামান্য একটা ক্লার্কের চাকরী।
কিন্তু একটা প্রশ্নই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। নিজামউদ্দিন সাহেবের এমন দুরবস্থা হলো কি করে? তিনি তো বেশ ভালোই অবিস্থাসম্পন্ন লোক ছিলেন।
নিলির কথা জিজ্ঞেস করলো ,’তার খোঁজ পেয়েছো? কোথায় এখন সে?’
-‘এখনো সেরকমভাবে কিছু জানা যায় নি স্যার। তবে শুনেছি রেজা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ এর মালিক মি.রেজা নাকি উনাকে তাঁর পি.এস এর পোস্টে যোগ দেওয়ার জন্য অফার করেছেন।’
অবাক হলো রেজোয়ান। কিছু দিন আগেই তাঁদের কম্পানীর সঙ্গে রেজা গ্রুপের একটা স্ক্যান্ডাল হয়েছে। এরই মধ্যে মি.রেজা কি করে নিলিকে এমন অফার দিতে পারে? এর মানে কি? ব্যক্তিগত কোন আক্রোশ? হতেও পারে। ইনরফরমেশন চুরি করার অভিযোগে ব্যবিসায়িক সমিতি থেকে সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছে রেজার। কিন্তু তার সঙ্গে নিলির কি সম্পর্ক?
চিন্তিত মুখে জাহিদের দিকে একঝলক চাইলো সে। জাহিদ ইতস্তত করে বললো,’মিসেস নিলি বোধহয় অফারটা এক্সেপ্ট করবেন স্যার। স্যালারি ভালোই দেবে শুনেছি। কিন্তু আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না এতে করে রেজা গ্রুপের লাভটা কি হলো? মিসেস নিলি মাত্র অল্প কিছুদিন আমাদের এখানে কাজ করেছেন। উনার পক্ষে এই অল্প সময়ে কম্পানীর সমস্ত প্রটোকল ঠিকমত বোঝাও সম্ভব নয়! তাহলে ওরা মিসেস নিলিকে কেন হায়ার করছেন?’
-‘আমিও তো সেটাই ভাবছি। কোন একটা কারণ তো অবশ্যই আছে। এমনি এমনি তো আর রেজা গ্রুপ সিদ্ধান্তটা নেয় নি?’
বেশ কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলো জাহিদ এবং রেজোয়ান। কিন্তু কোন সুরাহা করতে পারলো না। জাহিদকে নিলির ওপর নজর রাখতে বলে দিলো রেজোয়ান। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যাপারটা জানা চাই। বল যায় না কখন কোন ঝামেলা এসে আবার উপস্থিত হয়ে যায়।
★
জাহিদের সঙ্গে আলোচনা শেষে নিজের রুমে বসে একা একা নিলির কথা ভাবছিলো রেজোয়ান। নিলির সঙ্গে মি.রেজার কোন পূর্বপরিচয় থাকার কথা নয়। তাহলে ঠিক কোন সূত্র ধরে নিলিকে তিনি চাকরীটা অফার করেছেন? আসল উদ্দেশ্যটা কি? রেজোয়ান? কিন্তু নিলির মাধ্যমে?…সেটা কীভাবে সম্ভব?
ইত্যাদি নানারকম প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলো মাথায়। হঠাৎ সেলফোনটা বেজে উঠতে চমকে গেলো। অপরিচিত নাম্বার! রিসিভ করলো রেজোয়ান।
ফোন রিসিভ করতেই মি.রেজা প্রথমে তাঁর পরিচয় জানালেন। রেজোয়ান ভেতরে ভেতরে চমকে গেলেও ভদ্রতাসূচক হেসে বললো,’কি খবর মি.রেজা? হঠাৎ আমার কথা মনে পড়লো যে?’
অপরপাশ থেকে রেজাও হাসিমুখে জবাব দিলো,’এখন তো আপনার কথাই বেশি মনে পড়বে ভাই। শেষ সম্বল যে আপনার হাতেই তুলে দিয়েছি।’
মি.রেজা স্পষ্টত ক্ষতিপূরণের টাকার দিকেই ইঙ্গিত করছেন। রেজোয়ান সেটা বুঝতে পেরে অট্টহাসি দিয়ে বললো,’বড় বড় কম্পানীর মালিকেরা এসব বললে আমার মত অভাগাদের উপায় কি? আমরা তো আপনাদের ওপরেই নির্ভরশীল।’
-‘এসব আপনার বিনয়!’
-‘সত্যি বলছি। আপনার সঙ্গে কি আর আমার তুলনা হয়?’
-‘তা জানি না। কিন্তু টাকাটা যে এবার ফেরত দিতে হয় ভাই?’
-‘মানে?’
-‘মানে টাকাটা আপনাকে ফেরত দিতে হবে। সেই সঙ্গে আরো হাফ বিলিয়ন আমার অ্যাকাউন্টে জমা করতে হবে।’
রেজোয়ান তাঁর কথার আগাগোড়া কিছু বুঝতে না পেরে উচ্চস্বরে হেসে উঠে বললো,’আপনি তো দেখছি বেশ ভালোই ঠাট্টা করেন।
ক্রুর হাসলো রেজা। অত্যাধিক মোলায়েম কন্ঠে বললো,’আপনাদের দুজনকে কিন্তু বেশ ভালোই মানায় মি.মুরসালীন। আমি তো চোখই ফেরাতে পারছিলাম না। দারুণ প্রেম ছিলো বোধহয় আপনাদের তাই না? আমি কার কথা বলছি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই? আমি আপনার আর আমার সুন্দরী পিএস মিসেস নিলির কথা বলছি।’
বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো রেজোয়ান। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো। কি থেকে কি ঘটেছে কিছুই বুঝতে পারছে ন। এদিকে রেজা চুপ করে নেই। ক্রমাগত বলে যাচ্ছে,’মিসেস নিলি বোধহয় ছাত্রজীবনে খুব সুন্দরী ছিলেন? দারুণ ফিগার, একেবারে আগুন! আমিও একটা সুযোগ নেবো ভাবছি।’
চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো রেজোয়ানের। বদমাশটার জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলতে মন চাইলো। কিন্তু একটা ব্যাপার কিছুতেই মাথায় ঢুকছিলো না। ছবিগুলো তাঁর নিজস্ব ল্যাপটপের খুবই গোপন ফোল্ডারে সেইভ করা ছিলো। সেগুলো রেজার হাতে গেলো কী করে?
রেজা তাঁর মনের কথা বুঝতে পেরে বললো,’সেদিন মিটিংয়ে আপনি ভুল করে ল্যাপটপ রেখে প্রায় দশ মিনিটের মতন বাইরে গিয়েছিলেন? অ্যাম আই রাইট?’
-‘আপনি আমার ল্যাপটপ হ্যাক করেছেন?’
-‘করে খুব একটা লাভ হয় নি। ভেবেছিলাম কম্পানীর কিছু গোপন তথ্য পাবো কিন্তু শেষমেশ দেখলাম পুরো ল্যাপটপই আপনার প্রেমের স্মৃতি দিয়ে ভরা।’
-‘হাউ ক্যান ইউ বি সো চিপ মি.রেজা? আই ডিডন্ট এক্সপেক্ট দিজ ফ্রম ইউ! আপনি তো মেন্টালি সিক!’
রেজোয়ানের কথা গুলো গায়েই মাখলো না রেজা। উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। একশো কোটি টাকার জন্য একটু আধটু কথা শোনাই যায়। হাসি থামিয়ে বললো,’আপনি টাকাটা কবে পাঠাবেন মি.মুরসালীন?’
-‘এক পয়সাও দেবো না।’
-‘আপনি পাঠাবেন মি.মুরসালীন।’
-‘যদি না পাঠাই?’
-‘সেটা অবশ্যই আপনার ব্যক্তিগত মতামত। কিন্তু আমি আপনাকে পাঠানোর জন্য সাজেস্ট করবো। আফটার অল ব্যবসায়িক মহলে আপনার একটা রেপুটেশন আছে। হঠাৎ করে পুরাতন প্রেমিকার সঙ্গে এসব ছবি ভাইরাল হলে বুঝতেই তো পারছেন….এই দেশে মানুষ তিলকে তাল বানায়। এমনও তো হতে পারে সবাই ভাবলো আপনার সঙ্গে মিসেস নিলির অবৈধ কোন সম্পর্ক আছে। আই মিন পরকীয়া, তাই আপনারা দুজন মিলে মুবিন তালুকদারকে খুন করেছেন। নানারকম পুলিশি ঝামেলা….সেটা কি ভালো হবে?’
এমন নোংরা কথাবার্তা শুনে কপালের শিরা দপদপ করে উঠলো রেজোয়ানের। সে ভাবতেই পারে নি রেজার মত একজন শিক্ষিত মানুষের মনমানসিকতা এত জঘন্য হতে পারে। খুন করতে মন চাইলো কুলাঙ্গারটাকে। তথাপি দাঁতেদাঁত চেপে সহ্য করে নিলো।
রেজে কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফের গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,’আচ্ছা ঠিক আছে মি.মুরসালীন, মিসেস নিলির বিষয়টা থাক। উনার সঙ্গে যেহেতু এখন আর আপনার কোন সম্পর্ক নেই তাই উনাকে নিয়ে আপনার চিন্তা না করলেও চলবে। আপনি বরং ক্ষতিপূরণের টাকাটা পাঠিয়ে দিন। আমি ছবি ব্লার করে দেবো। আপনাকে কেউ চিনবে না।’
আন্দাজেই ঢিলটা ছুঁড়লো রেজা। তাঁর ধারণা রেজোয়ান এই প্রস্তাবে রাজি হবে না। নিলির প্রতি এখনো যথেষ্ট ফিলিংস আছে তাঁর। নতুবা এতদিন পর্যন্ত ল্যাপটপে ছবিগুলো রাখার কোন মানেই ছিলো না। নিলির বিয়ের পরই ডিলিট করে দিতে পারতো। কিন্তু খুব যত্ন করে ছবিগুলো গোপনে লুকিয়ে রেখেছে রেজোয়ান। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে নিলির কথা ভেবেই রেজোয়ান এখন পর্যন্ত কোন রিয়েক্ট করছে না। নইলে আরো আগেই চিৎকার চেঁচামেচি করে এক অবস্থা হতো।
তাঁর চিন্তাভাবনা ছেদ ঘটালো রেজোয়ানের শান্ত, গম্ভীর কন্ঠস্বর, ‘তাঁকে এক্সপোজ করে আপনার লাভ?’
-‘কিছু না। জাস্ট একটু মজা নেবো!’
দাঁতেদাঁত দাঁত ঘষলো রেজোয়ান। মেজাজ শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললো,’ঠিক আছে কালকে সন্ধ্যা আগেই টাকা পেয়ে যাবেন। কিন্তু ছবিগুলো ডিলিট করতে হবে।’
-‘হয়ে যাবে।’
-‘হাউ ক্যান আই আই ট্রাস্ট ইউ?’
-‘ইট’স আ ডিল। সো ইউ হ্যাভ টু!…বস্তুত আমাকে বিশ্বাস করা ছাড়া আপনার হাতে আর কোন উপায় নেই। ইউ হ্যাভ নো চয়েস।’
★
রেজার ফোন রাখতেই জাহিদকে নিজের রুমে ডাকলো রেজোয়ান। জাহিদ ভেতরে ঢুকে সামনে চেয়ার টেনে বসলো। নিলির সঙ্গে নিজের সম্পর্কের কথা তাঁকে খুলে বললো রেজোয়ান।
সব শুনে খুব বেশি চমকালো না জাহিদ। নিলির সঙ্গে যে রেজোয়ানের আগে থেকেই একটা সম্পর্ক আছে সেটা প্রথম দিন দেখেই বুঝে গিয়েছিলো সে। কিন্তু এতদিন ভয়ে জিজ্ঞেস করার সাহস পায় নি। সব শেষে রেজোয়ান প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো তাঁর দিকে,
-‘তোমার কি মনে হয় জাহিদ? ও সত্যি সত্যি চাপের মুখে পড়ে মুবিনকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলো?’
-‘বুঝতে পারছিনা স্যার। তবে আমার মনে উনি সত্যি বলছেন।’
তাঁর জবাবটা রেজোয়ানকে ঠিক আনন্দ দিলো না কি দুঃখ দিলো বোঝা গেলো না। চোখ বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো সে। বেশকিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর পুনরায় সোজা হয়ে বসলো। এইবার রেজার ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করার সময়।
★
রেজার হুমকির কথা শুনে টাকা না দেওয়ারই পরামর্শ দিলো জাহিদ। কারণ টাকাটা দিলে হিউজ লসের মুখে পড়ে যাবে রেজোয়ান। সবে মাত্র উঠে দাঁড়িয়েছে কম্পানী। এরই মধ্যে এতগুলো টাকার ধকল কম্পানীর জন্য ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
রেজোয়ানকে নির্লিপ্ত দেখে উদ্বিগ্নস্বরে বললো,’ওয়ান বিলিয়ন ইজ নট আ স্মল অ্যামাউন্ট স্যার! কম্পানীর জন্য এই লস ক্যারি করা টাফ হয়ে যাবে।’
সম্মতি সূচক মাথা দোলালো রেজোয়ান। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’তোমার চিন্তাটা আমি বুঝতে পারছি জাহিদ। কিন্তু সম্মানের দিকটাও তো দেখতে হবে?’
-‘কিন্তু স্যার…’
-‘ছবিগুলো খুব বেশি যে ইন্টিমেট তেমন না। আবার একেবারেই যে ইন্টিমেট নয় তেমনও নয়। ব্যাপারটা দৃষ্টিভঙ্গির এবং সিচুয়েশনের ওপর নির্ভর করেছে। কে কীভাবে নেবে সেটা তাঁর চয়েস। কিন্তু সমস্যা একটাই, ধরো কোনভাবে ছবিগুলো এক্সপোজ হয়ে গেলো, মানে রেজাই এক্সপোজ করলো তখন কিন্তু সবাই জাজমেন্টাল হয়ে যাবে। ব্যাপারটা তখন আর পজিটিভ থাকবে না। নেগেটিভলিই নেবে সবাই। সত্যিটা খতিয়ে দেখবে না। কারণ একবার যদি কোনকিছু নিয়ে গুজব ছড়িয়ে যায় তখন মানুষ সেটাকেই সত্যি মনে করে।’